১৯৯৬ সালে গৃহ ও অন্যান্য নির্মাণ শ্রমিক আইন এবং সেস আইন রাজ্যে রাজ্যে সেই অনুযায়ী কল্যাণ পর্ষদ তৈরী হয়। তারপরে ২০০৪ সালে নয়া পেনশন আইন চালু করা হয়।
নির্মাণ শ্রমিকদের পেনশন সহ অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা চালু রাখতে আইন মোতাবেক নির্মাণ শিল্পে নিয়োজিত সমগ্র পুঁজির ১ শতাংশ সেস বাবদ অর্থ নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণপর্ষদে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক।
এই আইনকে বাস্তবায়িত করতে আইনে বিভিন্ন স্তরের ব্যবস্থাপক কমিটি গঠন করা হয়েছে যেমন উপরোক্ত আইন দুটি সংবিধানের রাষ্ট্রীয় কর্মাবস্থার নীতি নির্দেশক নিয়মাবলীকে তুলে ধরে বিশেষ করে ৩৯ নং ধারা যেখানে বলা আছে যে রাষ্ট্র শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও কর্মক্ষমতাকে রক্ষা করবে এবং ৪২ নং ধারা যেখানে বলা আছে যে শ্রমিকদের কাজটি ন্যায্য এবং মানবিক হবে। সংবিধানের ২১ নং ধারায় সকলের জন্য মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকার একটি মৌলিক অধিকার বিভিন্ন রক্ষাকবচ থাকা সত্ত্বেও নির্মাণ শ্রমিকদের অবস্থা দাঁড়িয়েছে শোচনীয়।
নির্মাণ শ্রমিকদের উপর চলছে মধ্যযুগীয় শোষণ,যেমন মজুরী-সরকারীভাবে নির্মাণ শ্রমিকদের চারভাগে ভাগ করা হয়েছে যথা—অতিদক্ষ, দক্ষ, আধাদক্ষ, অদক্ষ। পশ্চিমবাংলায় অতিদক্ষ নির্মাণ শ্রমিকদের সরকার নির্ধারিত মজুরি দৈনিক ৩৯২ টাকার মত। তার চেয়েও কম, বাদবাকীরা এদের থেকে আরো কম।দক্ষতার জন্য কোনো প্রমাণপত্র না থাকায় বেশীরভাগ নির্মাণ শ্রমিক বিশেষ করে মহিলাদের অদক্ষ দেখিয়ে দিনের পর দিন কম মজুরী প্রদান করা হচ্ছে। বহু প্রচলিত মোদীর স্কীল ইন্ডিয়া প্রকল্পকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বড় বড় নির্মাণ শিল্পের মালিকরা অবাধে নির্মাণ শ্রমিকদের মজুরি লুঠ করে চলেছে। এছাড়াও বড় নির্মাণ শিল্পে বহু হাত ঘুরে যখন প্রকৃত নির্মাণ শ্রমিকের কাছে মজুরী পৌঁছায় তা যৎসামান্যই। (বরং ছোটো মাঝারি নির্মাণ শিল্পে ও স্বনিয়োজিত নির্মাণ শ্রমিকেরা সরকার নির্ধারিত নূন্যতম মজুরির চেয়ে বেশী মজুরি আদায় করতে পারেন।) নির্মাণ শিল্পের মালিক—শাসক পার্টির নেতা-পুলিশ-আমলা আঁতাতের বিরুদ্ধে বিশেষত রাঘব বোয়াল মালিকদের বিরুদ্ধে মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন গড়ে তুলে নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য সরকার নির্ধারিত নূন্যতম ১৮০০০ টাকা বেতনের আন্দোলন জোরদার করতে হবে।
সামাজিক সুরক্ষা ১) বি ও সি ডব্লিউ এস এ্যাক্ট ১৯৯৬ অনুযায়ী ১০ লক্ষ টাকার বেশী বড় বড় নির্মাণ শিল্পে নিয়োজিত মোট পুঁজির ১ শতাংশ পুঁজি নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদে জমা নিতে হবে। ২) নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদে জমা হওয়া মোট অর্থের ৯৫ শতাংশ নির্মাণ শ্রমিকদের সামাজিক প্রকল্পে খরচ হবে। ৩)সমস্ত নির্মাণ শ্রমিকদের নাম সরকারীভাবে নথিভুক্ত ও নবীকরণ করতে হবে। ৪) নথিভুক্ত নির্মাণ শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা নিয়মিতভাবে প্রদান করতে হবে।
বাস্তবে নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণে কি হচ্ছে তা দেখা যাক—সেস সংগ্রহ ও তা নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণে কতটা ব্যবহার হয়েছে তা ১৬ তম লোকসভার শ্রম মন্ত্রণালয়ের ১৬-১৭ সালের একটি রিপোর্ট এবং ১৯ শে মার্চ ২০১৮ সুপ্রীম কোর্টের পর্যালোচনা ও কিছু নির্দেশাবলী দেখা যাক।
এস এস এস ও-র রিপোর্টে সারাদেশে ৪.৬ কোটি নির্মাণ শ্রমিকের উল্লেখ করা হয়েছে। বাস্তবে তার দ্বিগুণেরও বেশী নির্মাণ শ্রমিক রয়েছে।তার মধ্যে সরকারীভাবে নির্মাণ শ্রমিক নথিভুক্ত রয়েছেন ২.৫ কোটি। সুবিশাল সংখ্যার নির্মাণ শ্রমিক নথিভুক্ত হয়নি এবং তারা অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে রয়েছেন। এ ব্যপারে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি এবং নির্মাণ শিল্পের মালিকেরা উদাসীন।
অনথীভুক্তিকরণের কারণ ১) বড় বড় নির্মাণ শিল্পের মালিকরা আইন অনুযায়ী সমস্ত শ্রমিকদের হাজিরা খাতায় নাম নথিভুক্ত করান না।কর্মরত শ্রমিকদের কল্যাণ পর্ষদে নাম নথিভুক্তকরণে উদ্যোগ নেন না।কারণ তারা তাদের সমগ্র কর্মকান্ডকে আড়াল করতে চান। ২) সরকারী স্তরে কোনো ব্যবস্থা না গড়ে তুলেই ডিজিটাল ইন্ডিয়ার নামে নির্মাণ শ্রমিকদের অনলাইনে আবেদন পত্র পূরণ করার কাজটা সম্পূর্ণ ভাবে প্রাইভেট ক্ষেত্রে পাড়ায় পাড়ায় তথ্যমিত্র কেন্দ্রের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যার ফলে শ্রমিকরা অতিরিক্ত ২০০/২৫০ টাকা খরচ করেও বারংবার যাতায়াত করে হয়রান, হতাশ হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। ৩) অসংখ্য নথি বারংবার জমা দিতে ব্যয় বৃদ্ধি হচ্ছে। ৪) ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার সম্পূর্ণ রূপে খর্ব করায় অসংগঠিত শ্রমিকরা শাসক পার্টির নির্বাচিত প্রতিনিধি ও আমলাদের উপর নির্ভর হওয়ায় অসুবিধা বেড়েছে। এক্ষেত্রে মোদীর ডিজিটাল ইন্ডিয়ার মুখোশ খুলে গেছে। ৫) সামাজিক সুরক্ষার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে।
২০১৩-১৪ সালে নির্মাণ শিল্পের সমীক্ষায় দেখা গেছে নথিভুক্ত নির্মাণ শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে। সরকারী অনীহা এবং নবীকরণের জটিলতায় নবীকরণ কমেছে।এর ফলে ঐ সব শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে আদায়কৃত সেস ও নির্মাণ শ্রমিকদের নথিভুক্ত করণের জন্য দেওয়া রেজিস্ট্রেশন চাঁদা কোটি কোটি টাকা লুঠ করার সরকারী চক্রান্ত।কারণ সামাজিক সুরক্ষা থেকে নির্মাণ শ্রমিক বঞ্চিত হবেন।
রাজ্যে রাজ্যে নির্মাণ কল্যাণ পর্ষদ কমবেশী ৮-১০ বছর ধরে গড়ে উঠেছে। লোকসভার শ্রম মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটির রিপোর্ট ৩১ মার্চ ২০১৭ পর্যন্ত ৩২,৬৩২ কোটি টাকা সেস কালেকশন হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৭,৫১৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণে। সুপ্রীম কোর্টের পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে নির্মাণ শিল্পের নথিভুক্ত পরিসংখ্যানে ৩১ মার্চ ২০১৭ থেকে ৩০ জুন ২০১৭ পর্যন্ত সংগৃহীত সেসের পরিমাণ হবে ৫০০০ কোটি টাকা-বার্ষিক পরিমাণ ২০০০০ কোটি টাকা।
দুটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে বিগত ১০ বছর ধরে বড় বড় নির্মাণ শিল্পের মালিকরা সেসের কোটি কোটি টাকা কিভাবে চুরি করছে। সুপ্রীমকোর্টের নজরের বাইরেও চুরি করার আরও পথ খোলা আছে। আর এইসব দুর্বলতা রাজ্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কেন্দ্র এই ফান্ড কুক্ষিগত করতে চাইছে। নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য নির্মাণ শিল্প থেকে আদায়কৃত সেস ফান্ড ঘুরপথে লুঠ করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার সমগ্র অসংগঠিত শ্রমিকদের একটি সংস্থার অধীনে আনতে নীল নকশা রচনা করছে আর এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এস এস ওয়াই-২০১৭ রচনা করে আগেভাগেই কেন্দ্রীয় সরকারকে পথ দেখিয়েছে। যেমন নির্মাণ শ্রমিকদের সাইকেল দেওয়া বন্ধ করে 'সবুজ সাথী' চালু করেছে। সমগ্র শ্রমিক শ্রেণী যখন নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে দেশব্যপী ধর্মঘটে সামিল হচ্ছে তখন তাদের সাথে মিলিত হয়ে আরও বলিয়ান হয়ে ৮-৯ জানুয়ারি সমস্ত নির্মাণ শিল্পকে স্তব্ধ করে দিতে হবে।
আওয়াজ তুলতে হবে—১) সেস সংগ্রাহক কর্তৃপক্ষকে নির্মাণ ক্ষেত্রে গিয়ে আদায়কৃত সেসের টাকা ৩০ দিনের মধ্যে নির্মাণ কল্যাণ পর্ষদে জমা দিতে হবে। ২) নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ ও শ্রমিক পরিদর্শককে যৌথভাবে নির্মাণ ক্ষেত্রে যেতে হবে। দেখতে হবে ক) সমস্ত শ্রমিকদের নাম হাজিরা খাতায় আছে কিনা, খ) সরকার নির্ধারিত মজুরি প্রদান হচ্ছে কিনা। ৩) কর্মরত সমস্ত নির্মাণ শ্রমিকদের সরকারীভাবে কল্যাণ পর্ষদে নথিভুক্ত করতে শিবির করতে হবে এবং ট্রেড ইউনিয়নকে এই কাজে সামিল করতে হবে। ৪) নির্মাণ শিল্প থেকে ৩ শতাংশ সেস আদায় করতে হবে। ৫) কেন্দ্রীয় বাজেটে ৩ শতাংশ অর্থ প্রদান করতে হবে,রাজ্য সরকার কেও বাজেটের অর্থ নিশ্চিত করতে হবে। ৬) কল্যাণ পর্ষদে শ্রমিক প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। ৭) নির্মাণ শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার কাজ কল্যাণ পর্ষদ মারফত করতে হবে। ৮) ব্লকে ব্লকে সম্পূর্ণ সরকারী ব্যবস্থায় নির্মাণ শ্রমিকদের নাম নথিভুক্তকরণের কাজ অনলাইনে-অফলাইনে চালু করতে হবে। অনলাইনে নথিভুক্তকরণের জন্য কোনো অর্থ নেওয়া যাবে না। ৯) সামাজিক সুরক্ষা রচনা করতে হবে সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের সাথে আলোচনার মাধ্যমে। ১০) সরকার নির্ধারিত নূন্যতম মাসিক মজুরী ১৮০০০ টাকা ঘোষণা করতে হবে। ১১) সবার জন্য মাসিক ৬০০০ টাকা পেনশন ঘোষণা করতে হবে।
শ্রমের অধিকার বুঝে নিতে আগামী ৮-৯ জানুয়ারি সারা ভারত ধর্মঘট সফল করুন।