মেরী বাবা মেরী বাবা/খাবা খাবা খাবা আমি খাবা সব খাবা/থলির ভরতি হাতের কাছে যা পাবা/সোনা চাই দানা চাই কাবুলের দানা চাই/মিছরির পানা চাই ... চেতনার 'মারীচ সংবাদ' নাটকে মেরী বাবার গান গেয়ে অসামান্য অভিনয় করেই পাদপ্রদীপের আলোয় আসা। একই নাটকে আরও একটি অনবদ্য গান তাঁর কন্ঠে দর্শকদের বিভোর করে রাখত—বন থেকে বেরলো টিয়া/সোনার টুপুর মাথায় দিয়া/কোথা থেকে এল পাখি/কোথা গেল উড়িয়া/সব জানতে পারবে শিয়ার কাছে/শিয়া শিয়া শিয়া ... 'মারীচ সংবাদ' নাটকে ছোটখাটো মানুষটির অভিনয় শৈলী আজও নাট্যমোদী দর্শকদের উদ্বেলিত করে। 'মেরী বাবা'র গান গেয়ে নির্দিষ্ট চরিত্রায়নে অসামান্য অভিনয় শৈলী প্রদর্শন করেছিলেন বিপ্লবকেতন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ৩০ নভেম্বর ভোররাতে ঢাকুরিয়ার বাড়িতে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। দীর্ঘদিন তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। অ্যালজাইমার্স রোগেও ভুগছিলেন, জানা যায়, নিজের স্ত্রীকে ছাড়া কাউকেই চিনতে পারতেন না।
হাওড়ার শিবপুরে ১৯৪৬ সালে বিপ্লবকেতন চক্রবর্তীর ২৬ মার্চ জন্ম। পিতা হৃষিকেশ চক্রবর্তী। ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠেন। আজীবন বামপন্থী ভাবধারায় বিশ্বাসী বিপ্লবকেতন ১৯৬৭ সাল নাগাদ শিবপুর ভারতীয় গণনাট্য শাখায় যোগদান করেন। পরিচয় হয় আরও এক শিবপুর নিবাসী, বামপন্থী নাট্য ব্যক্তিত্ব ও পরবর্তীকালে চেতনা গোষ্ঠীর কর্ণধার, নাট্য পরিচালক ও অভিনেতা অরুণ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। অরুণও গণনাট্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গণনাট্যে তাঁরই পরিচালনায় ঠগ, কংক্রিট, হারানের নাতজামাই নাটকে বিপ্লবকেতন অভিনয় করেন। অরুণ মুখোপাধ্যায় ১৯৭২ সালে চেতনা গোষ্ঠী তৈরি করলে বিপ্লবকেতনও যুক্ত হন সেখানে। সে অর্থে তিনিও চেতনার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এরপর অধ্যাবসায়, নিষ্ঠা এবং লক্ষ্যে অবিচল থেকে চেতনা গোষ্ঠী প্রযোজিত মারীচ সংবাদ, জগন্নাথ, স্পার্টাকাস, রামযাত্রা, রোশন, মা, কবির, জ্যেষ্ঠপুত্র ইত্যাদি নাটকে সুনামের সঙ্গে অভিনয় করেন। মারীচ সংবাদে মেরী বাবা গান গেয়ে মেরী বাবা ও বিপ্লবকেতন প্রায় সমর্থাক হয়ে গিয়েছিল।
পরবর্তীকালে বিপ্লবকেতন চেতনা ছেড়ে নিজে একটি নাটকের দল 'থিয়েটারওয়ালা' তৈরি করেন। তাঁর নির্দেশনায় 'বাঘু মান্না' নাটকটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, 'কাচের দেওয়াল'ও যথেষ্ট প্রশংসিত হয়। শুধু থিয়েটার করে সংসার চালানো যে কারোর পক্ষেই একপ্রকার অসম্ভব। বিপ্লবকেতনও তাই সরকাইর চাকরি নিয়েছিলেন, করতেন বামপন্থী কর্মচারী সংগঠন কো-অর্ডিনেশন কমিটি।
নিজের নাট্যদল পরিচালনা ছাড়াও একটি চলচ্চিত্র ও বেশ কিছু টেলিফিল্মে অভিনয় করেছেন। 'চুনি পান্না' ও 'জন্মভূমি' ধারাবাহিকে অভিনয় করে তিনি দর্শকের মন জয় করেছেন। উৎপল দত্ত পরিচালিত ও পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অ্যাকাদেমি প্রযোজিত শেকসপিয়ারের নাটক 'চৈতালি রাতের স্বপ্ন'-এ (মিড সামার নাইটস ড্রিম থেকে বাংলায় অনুদিত) ফ্লুট চরিত্রে অভিনয় করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। 'আকাশবাণী' প্রযোজিত নাটকেও নিয়মিত অভিনয় করতেন। দৈহিক উচ্চতা যে অভিনয় শিল্পে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না তা কয়েক বছর আগে প্রয়াত রমাপ্রসাদ বনিক ও সদ্য প্রয়াত বিপ্লবকেতন প্রমাণ করে গিয়েছেন। স্ত্রী দীপালি ছাড়াও তিন কন্যা বিদীপ্তা, সুদীপ্তা ও বিদিশাকে তিনি রেখে গেছেন। স্ত্রী দীপালী একজন নৃত্যশিল্পী, বিদীপ্তা-সুদীপ্তা টালিগঞ্জ ছায়াছবি প্রতিষ্ঠানের সুপ্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী। নাটক, গান, অভিনয় মিলেমিশে শিবপুরের চক্রবর্তী পরিবারে যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছিল বিপ্লবকেতনের অনুপস্থিতির ব্যাটন রইল মঞ্চ-চলচ্চিত্র সফল দুই কন্যার উপর। নাট্যমোদীরা বিপ্লবকেতনের শারীরিক অবয়বকে ভুলে গেলেও ভুলতে পারবেন না 'মারীচ সংবাদে'র মেরী বাবা খ্যাত গায়ককে। বিপ্লবকেতনের স্মৃতি অমলিন থাকবে।