সম্প্রতি টুইটারের সিইও জ্যাক ডোরসে ভারত পরিদর্শনে আসেন এবং তাঁর সঙ্গে ছিলেন টুইটারের আইনি ও জন কর্মনীতি বিষয়ক প্রধান বিজয়া গাড্ডে। তাঁরা ভারতের কিছু মহিলা সাংবাদিক ও লেখকের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এই সাংবাদিক ও লেখকরা তাঁকে জানান, কিভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার মঞ্চ অনেক ক্ষেত্রেই সাম্প্রদায়িক, জাতপাতবাদী এবং লিঙ্গকে লক্ষ্যবস্তু করা ট্রোলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়। ভারতে টুইটারে কদর্য ও উগ্র ট্রোলের বন্যা বয়ে যায় যার অনেকগুলিকেই অনুসরণ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে আলোচনার পর দলিত নারীবাদী আন্দোলনের এক কর্মী ডোরসেকে একটা পোস্টার উপহার দেন যাতে লেখা ছিল ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রকে চূর্ণ করুন’। এরপর ছবি তোলার যে পর্ব চলে তার কয়েকটিতে ডোরসে ঐ পোস্টারটি হাতে ধরে ছিলেন। টুইটারে ঐ ছবিগুলোকে শেয়ার করা হলে দক্ষিণপন্থী তাত্ত্বিকদের নেতৃত্বে উগ্র প্রতিবাদের ঢল নামে, ঐ শ্লোগানকে ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক এবং ‘‘হিন্দু আতঙ্ক’’ প্রসূত ব্রাহ্মণ-বিরোধী ঘৃণার বচন বলে ছাপ মারা হয় এবং ব্রাহ্মণদের ‘‘সংখ্যালঘু’’ বলে বর্ণনা করা হয়।
টুইটার এই চাপের কাছে নতিস্বীকার করে — তারা এটা দাবি করার চেষ্টা করে যে ঐ ছবি ছিল একান্তই ‘‘ব্যক্তিগত’’ যা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করার জন্য নয়। আরো দাবি করা হয় যে, ‘‘নিরপেক্ষ’’ এবং ‘‘অরাজনৈতিক’’ হওয়াই টুইটারের লক্ষ্য এবং টুইটার এমন এক মঞ্চ হওয়ার জন্য গর্বিত ‘‘যেখানে প্রান্তবর্তী মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা ও দেখা যায়।’’
গোটা ঘটনাটাই আজ ভারত এবং সারা বিশ্বে প্রকাশ্যে চলা আলোচনাধারা সম্পর্কে এবং বিশালাকায় কর্পোরেশনগুলোর মূল্যবোধ এবং রাজনীতি সম্পর্কে অনেক কিছুই প্রকাশ করে। প্রথমত, ‘‘ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রকে চূর্ণ করুন’’ এই কথাটা ড: বি আর আম্বেদকরের দেওয়া ‘‘জাত প্রথাকে ধ্বংস করুন’’-এর আহ্বানের এক রকমফের ছাড়া অন্য কিছু নয়—যিনি ছিলেন এক শক্তিশালী জাতপ্রথা-বিরোধী আন্দোলনের নেতা এবং ভারতের সংবিধানের রচয়িতা। ব্রাহ্মণ্যবাদকে চূর্ণ করা বলতে কিন্তু ব্রাহ্মণ জাতের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হিংসার আহ্বানকে বোঝায় না—তা বরং এমন এক ব্যবস্থাকে চূর্ণ করার কথা বলে যা নারী দলিত এবং অন্যান্য নিপীড়িত জাতের জনগণের বিরুদ্ধে নিপীড়ন চালায়।
আম্বেদকর ১৯৩৮ সালে ‘‘ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং পুঁজিবাদকে’’ ভারতে শ্রমিকদের দুই শত্রু রূপে চিহ্নিত করেন। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘‘ব্রাহ্মণ্যবাদ বলতে আমি কিন্তু সম্প্রদায় রূপে ব্রাহ্মণদের ক্ষমতা, সুযোগসুবিধা এবং স্বার্থকে বোঝাই না। ব্রাহ্মণ্যবাদ বলতে আমি স্বাধীনতা, সমতা এবং ভ্রাতৃত্বের স্পিরিটের নেতিকরণকে বোঝাই। এই অর্থে তা সমস্ত শ্রেণীর মধ্যেই অবাধে চলছে এবং তা শুধু ব্রাহ্মণদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, যদিও তারাই এর প্রবর্তক।’’ ভারতে অ-হিন্দু সম্প্রদায়গুলোর মধ্যেও, উদাহরণস্বরূপ, খ্রিস্টান, মুসলিম এবং শিখদের মধ্যেও ব্রাহ্মণ্যবাদ দেখা যায়।
পিতৃতন্ত্রের মধ্যে জাতপ্রথার প্রাধান্যকে বোঝাতে নারীবাদী ঐতিহাসিকরাই ‘‘ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্র’’ কথাটা প্রচলন করেন। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত তাঁর এক মৌলিক রচনায় ঐতিহাসিক উমা চক্রবর্তী জাতপ্রথা ও লিঙ্গের আন্তসম্পর্কের অনুসন্ধান করে যেটিকে চিহ্নিত করেন তা হল ‘‘উচ্চ বর্ণের নারীদের অধীন করে রাখায় যা সম্ভবত কেন্দ্রীয় বিষয় : ঐ নারীদের কার্যকরী যৌনগত নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা যা শুধু পিতৃকূল-পরিচয়ধারী উত্তরাধিকার বজায় রাখার জন্যই নয়, জাতপাতের বিশুদ্ধতা বজায় রাখার জন্যও জরুরি, যে প্রতিষ্ঠানটি হিন্দু সমাজেরই স্বকীয়।’’
চক্রবর্তী উল্লেখ করেছেন যে ‘‘জাতপাত ব্যবস্থায় প্রবেশের ফটক হিসাবে — আক্ষরিকভাবেই প্রবেশ দ্বার হিসাবে — গণ্য করা হয়ে থাকে নারীদের। নিম্নবর্ণের যে পুরুষদের যৌনতা উচ্চবর্ণের বিশুদ্ধতার প্রতি বিপদ, উচ্চবর্ণের নারীদের সঙ্গে তাদের যৌন সংসর্গকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই প্রতিহত করতে হবে, আর তাই সজাগতার সঙ্গে নারীদের আগলাতে হবে।’’
নারীদের চলাফেরা এবং যৌন স্বায়ত্ততার ওপর মাত্রাতিরিক্ত নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ (‘‘সুরক্ষার’’ ছলে) এবং ভিন্ন-জাত যুগলের উপর প্রাণঘাতী হিংসা (বিশেষভাবে উচ্চবর্ণের নারীর দলিত পুরুষকে ভালোবাসা ও বিয়ে করার ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে) আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রের এই বৈশিষ্ট্যটি অতীতের বস্তু নয়। সাম্প্রতিক সময়ের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রতি চারজন ভারতীয়র মধ্যে একজন দলিতদের বিরুদ্ধে অস্পৃশ্যতা চালানোর কথা স্বীকার করেছেন এবং অন্য আর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৫০ শতাংশ বা তার বেশি উচ্চবর্ণের ভারতবাসী দলিতদের সঙ্গে পারস্পরিক বিবাহের বিরোধী।
‘‘ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্র’’-র কথা শুনে যাদের আঁতে ঘা লাগছে তারাই আবার ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে, অর্থাৎ, ‘‘স্বাধীনতা, সমতা এবং ভ্রাতৃত্বের নেতিকরণের’’ সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে তুলেছেন। এই ব্যাপারটা সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করেছেন রিপাবলিক টিভি-র সম্পাদকমণ্ডলীর উপদেষ্টা চিত্রা সুব্রমনিয়াম যিনি দাবি করেছেন যে, ডোরসে কি কখনও ‘‘অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে শি শিন ফিং-এর সামনে পোস্টার তুলে ধরতে পারবেন?’’ এই প্রশ্নটার মধ্যে দিয়ে বস্তুত এই স্বীকৃতিই ঘটছে যে, চীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অনুপস্থিতির মতোই ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রের অস্তিত্বও সমানভাবে সত্য!
সঠিক যে প্রশ্নটা করা দরকার তা হল : টুইটার ও তার সিইও কি, ধরা যাক, একটা মিটু পোস্টার, একটা কালো মানুষের জীবনেরও দাম আছে আন্দোলনের পোস্টার, অথবা, বর্ণবাদী পিতৃতন্ত্র বা শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদিতাকে চূর্ণ করার শ্লোগানের পাশে দাঁড়াতে পারবে? এর উত্তর হবে হ্যাঁ। এটা ঘটনা যে, টুইটারের মঞ্চে দেওয়া ‘শ্বেত আমেরিকা’র আহ্বান জানানো একটা শ্রেষ্ঠত্ববাদী বিজ্ঞাপনের জন্য টুইটার ও জ্যাক ডোরসে সর্বসমক্ষে একটা অবস্থান নিয়ে ক্ষমা চান। ‘বর্ণ, ধর্ম, পঙ্গুত্ব, যৌন উদ্দেশ্য, লিঙ্গ পরিচিতি অথবা জাতীয়তা/জাতীয় উৎস’র উপর ভিত্তি করে ঘৃণা ছড়ানোর বিরুদ্ধে তার নীতিও রয়েছে। (জাত-ভিত্তিক ঘৃণাকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা টুইটারের একটা সমস্যা যেটাকে সংশোধন করানোর চেষ্টা দলিত আন্দোলনের কর্মীরা করেছিলেন।)
স্পষ্টতই, নীতির দিক দিয়ে অন্ততপক্ষে টুইটার বিভিন্ন রূপের ঘৃণা-সঞ্চারি এবং নিপীড়নমূলক মতাদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে ‘‘নিরপেক্ষ’’ নয়। ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং জাতপাতের প্রশ্নে তাহলে ওরা কেন ‘‘নিরপেক্ষ’’ ও ‘‘অরাজনৈতিক’’ হওয়ার কথা বলল? এর উত্তর অংশত রয়েছে ভারতীয় টুইটারের ওপর দক্ষিণপন্থী হিন্দু-শ্রেষ্ঠত্ববাদী তাত্ত্বিকদের কব্জা করা ব্যাপক ক্ষমতা এবং প্রতিপত্তির মধ্যে, যার অনেকটাই ঘটছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতা এবং সান্নিধ্যের কারণে।
‘‘ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রকে চূর্ণ করুন’’ শ্লোগানের বিরুদ্ধে টুইটারে বর্ষানো ব্যাপক ক্রোধের মধ্যে যেটা সবচেয়ে লক্ষণীয় তা হল, কর্তৃত্বকারী সম্প্রদায়ের নিজেদের অন্যায়-অবিচারের শিকার হওয়ার একটা ধারণাকে তুলে ধরার চেষ্টা। ফ্যাসিবাদী এবং চরম-দক্ষিণপন্থী রাজনীতির দিক থেকে অন্যায়-অবিচারের শিকার হওয়ার অভিজাতবাদী দাবি শুধু ভারতবর্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প বারবারই শ্বেত জনগণকে অভিবাসীদের হাতে শিকার হওয়া জনগণ রূপে চিত্রিত করেছেন; আর পুরুষদের তুলে ধরেছেন নারীদের শিকার রূপে। একইভাবে ভারতেও সংঘ পরিবার ও বিজেপি হিন্দুদের বলে তারা যেন মুসলিম, খ্রিস্টান অথবা শিখ সংখ্যালঘুদের হাতে অন্যায়ের শিকার হওয়ার বিপদে গুরুত্ব দেয় এবং এইভাবে তারা টিকে থাকে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলিতে এবং জনসাধারণের সংস্কৃতিতে ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য উচ্চ জাতের জনগণকে জাত-ভিত্তিক সংরক্ষণ এবং প্রান্তিক মানুষদের অধিকতর প্রতিনিধিত্ব প্রদানকারী পদক্ষেপের শিকার রূপে তুলে ধরাটা একটা সাধারণ ব্যাপার। ‘‘পুরুষদের অধিকারের’’ প্রতিনিধিত্বের দাবি করা পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতিও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং তা পুরুষদের এই রূপে তুলে ধরে যে তারা নারীদের সুরক্ষাদায়ী আইনের শিকার।
কংগ্রেসের মুখপাত্র এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মনীষ তিওয়ারি অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে আধুনিক ভারতের ব্রাহ্মণদের তুলনা করেছেন ফ্যাসিস্টদের দমনের শিকার হওয়া ইহুদিদের সঙ্গে! তিওয়ারির টুইট আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে যে, সংঘ এবং বিজেপি ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রের সবচেয়ে একনিষ্ঠ রাজনৈতিক প্রবক্তা হলেও অন্যান্যরাও তার অন্যান্য পৃষ্ঠপোষকতা করে। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধির নিজের পৈতের (ব্রাহ্মণ পুরুষদের পরা পবিত্র সূত্র : যা ব্রাহ্মণ পুরুষদের বিশেষ সুবিধার বিশিষ্ট নির্দেশক) রাজনৈতিক প্রদর্শনী এবং মন্দির পরিদর্শন সুস্পষ্টরূপে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, কংগ্রেস ব্রাহ্মণ্যবাদকে প্রতিরোধ করার চেয়ে তাকে আশ্বস্ত ও তুষ্ট করতেই সচেষ্ট। ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্র যখন সংঘের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে, এই ধরনের কার্যকলাপ তখন ভারতে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে বুনিয়াদিগত দিক থেকেই অসঙ্গতিপূর্ণ হয়ে দেখা দিচ্ছে।