২০০৮ সাল থেকে পুঁজিবাদের যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে, এক দশক পরেও তা থেকে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির জন্ম হচ্ছে। ফ্রান্স সহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে চলমান ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন এরই এক উদাহরণ। সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর নানা দেশেই জ্বালানি তেলের দাম মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে এবং তার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ আন্দোলন দানা বাঁধছে। সম্প্রতি আমাদের দেশে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান সহ পাঁচ রাজ্যে যে নির্বাচন হয়ে গেল, তাতে সরকার বিরোধী ক্ষোভের এক মারাত্মক বহিঃপ্রকাশ আমরা লক্ষ্য করলাম এবং সেখানে যে সব ইস্যুতে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, তার একটি হল পেট্রোল ডিজেল রান্নার গ্যাসের মারাত্মক দাম বৃদ্ধি। জ্বালানী তেলের দামবৃদ্ধির বিরুদ্ধে ফ্রান্সের বিক্ষোভ আন্দোলন গত একমাস ধরেই বিরাট আকার ধারণ করেছে এবং ফ্রান্স থেকে তা ছড়িয়ে পড়েছে বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড এর মতো পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতেও। আন্দোলনের শুধুমাত্র স্থানিক বিস্তারই হচ্ছে না, তাতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন ইস্যু। ফ্রান্সের আন্দোলন শুরু হয়েছিল মূলত জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধির প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে, কিন্তু পরে তাতে জীবন ধারণের সার্বিক ব্যয়বৃদ্ধি থেকে কর কাঠামোর পুনর্বিন্যাসের মতো নানা ইস্যু যুক্ত হয়ে গেছে।
ফ্রান্সে আলোড়ন তোলা এই গণবিক্ষোভটি পরিচিত হয়েছে ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন নামে। আন্দোলনের শুরুটা করেন গাড়ি চালকেরা। ফ্রান্সের সকল ড্রাইভারের গাড়িতে ইয়েলো ভেস্ট থাকা বাধ্যতামূলক। এই ইয়েলো ভেস্ট গায়ে পরেই তারা বিক্ষোভে সামিল হন এবং সেখান থেকেই আন্দোলনটি এই নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অনলাইনে ক্ষোভ বিক্ষোভ প্রকাশের মধ্যে দিয়ে গত মে মাস থেকেই এর সলতে পাকানো শুরু হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে তা রাস্তার আন্দোলনে বড়সড় ক্ষোভের উদগীরণ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বিগত ১৭ নভেম্বর। ফ্রান্সে অক্টোবর ২০১৭-র তুলনায় অক্টোবর ২০১৮ তে পেট্রোলের দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ এবং ডিজেলের দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ। এর পরে আবার আগামী জানুয়ারী ২০১৯ থেকে জ্বালানি ব্যবহার কর আরো বাড়ানোর কথা বলে ইমানুয়েল মাঁকরের সরকার। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ১ জানুয়ারী থেকে লিটার প্রতি ডিজেলের উপরে ট্যাক্স বাড়ার কথা ছিল ৬.৫ সেন্ট এবং গ্যাসোলিনের উপর বাড়ার কথা ছিল ২.৯ সেন্ট। গাড়ির তেলের এই দাম বৃদ্ধির ঘোষণার প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হয়। শহরের অদূরে যারা ছোট শহর কিংবা গ্রামের দিকগুলোতে থাকেন তাদের বাধ্যতামূলকভাবে গাড়িতেই যাতায়াত করতে হয়। তাদের জীবন ধারণের খরচ এমনিতেই সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেড়েছে। জ্বালানি খরচের এই অতিরিক্ত বোঝা তারা বহন করতে রাজি হন নি এবং সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন।
গত ১৭ নভেম্বর আন্দোলন শুরু হয় এবং প্রথম থেকেই তা ছিল তীব্র গণরোষে পূর্ণ। পুলিশের সাথে আক্রমণকারীরা নানা জায়গায় সংঘর্ষে লিপ্ত হন। সাভোয়ি এলাকায় আন্দোলন চলাকালে একজন আন্দোলনকারী মারা যান। বেশ কিছু পুলিশ অফিসারও সেদিন আহত হন। আর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে চ্যাম্পস-এলিসিস এলাকায় পুলিশ আর আন্দোলনকারীদের মধ্যে বেশ কিছু সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, যেখানে ব্যারিকেডের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, বিভিন্ন অভিজাত দোকানপাট লুটপাট হয় এবং ট্রাফিক লাইট উপড়ে ফেলা হয়। এসময়ে ৩০ জন মানুষ আহত হন এবং শতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ পর্যন্ত ফ্রান্স জুড়ে ২০০০টি আন্দোলন কর্মকান্ডে প্রায় ২,৮৩,০০০ জন মানুষ অংশ নিয়েছেন। সরকার কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেছেন, কিন্তু তাতেও আন্দোলন প্রশমিত হয় নি। নতুন নতুন দাবিতে আন্দোলন আরো বিস্তৃত হচ্ছে।
ফ্রান্স থেকে এই আন্দোলন ছড়িয়েছে নেদারল্যান্ড এবং বেলজিয়ামেও। গত ১ ডিসেম্বর বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে পুলিশ ও ক্ষুব্ধ জনতার মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে এবং ‘ইয়েলো ভেস্ট’ পরে আন্দোলনকারীরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। দাঙ্গা পুলিশ সেখানে জলকামান ব্যবহার করে পাথর নিক্ষেপকারী আন্দোলনকারীদের দমন করে। এর আগে তারা পুলিশের দুটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তারা দেশজুড়ে পথ অবরোধ করেছিল। ১ ও ৮ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডের কিছু শহরেও ছোট ছোট বিক্ষোভ কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ওপেন্সিটিজ পলিটিকাল কনসাল্টেন্সি ফার্ম এর বিশেষজ্ঞ ক্রাম্বমুলার জানান, এই আন্দোলন ফ্রান্সের অবহেলিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কথা বলে। অনেকেরই দাবি, তারা যতখানি কর দেন সেই অনুযায়ী পরিষেবা পাননা রাষ্ট্রের কাছ থেকে। অনেক আন্দোলনকারী তাই চান কর কাঠামোর পুনর্বিন্যাস। ধনীদের করছাড়ের আইন বাতিল করা এবং দরিদ্র্য শ্রেণীর মানুষের সুবিধার্থে নতুন আরো কিছু করছাড়ের ব্যবস্থা শুরু করা। আন্দোলনের মধ্যে থেকে উঠে এসেছে পেনশন এবং মজুরি বৃদ্ধির দাবিও। তাদের অনেকেই প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকঁরের পদত্যাগ চাইছেন। এক জনমত সমীক্ষায় দেখা যায় যে ফ্রান্সের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ নাগরিক আন্দোলনকারীদের সমর্থন করেন এবং ৮০ শতাংশ মানুষ মনে করেন মাকঁরের জ্বালানির দামবৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত খারাপ। মাকঁর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশ বান্ধব পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যকে এই জ্বালানি কর বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। আন্দোলনকারীরা প্রত্যুত্তরে বলেছেন তারাও পরিবেশ পরিবর্তনের সঙ্কটের মোকাবিলা করতে চান। কিন্তু যে সঙ্কট বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা তৈরি করেছে এবং করছে, তার দায়মোচনের ভার শ্রমজীবী ও গরীব মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া চলবে না।
আন্দোলনের বেশ কিছু দাবি মেনে মাকঁরকে পিছু হটতে হয়েছে। ইতোমধ্যেই তিনি ঘোষণা করেছেন ন্যূন্যতম মজুরী মাসে ১০০ ইউরো বাড়ানো হচ্ছে। নিম্ন আয়ের পেনশনভোগীদের কর বাড়ানোর পরিকল্পনা বাতিল করা হবে, ওভারটাইমের মজুরির ওপর কর বসানো হবে না এবং বছর শেষে কর্মচারীদের করমুক্ত বোনাস দেওয়ার বিষয়ে নিয়োগকারীদের উৎসাহিত করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। তবে বিত্তশালীদের ওপর কর পুনর্বহালের সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন; বলেছেন, “এটি আমাদের দুর্বল করবে, আমাদের চাকরি বাড়ানো দরকার।” সর্বনিম্ন মজুরি সাত শতাংশ বাড়বে এবং এই বৃদ্ধিজনিত খরচ নিয়োগকারীদের বদলে সরকার বহন করবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। তবে এই ঘোষণার মধ্যে দিয়েই মাকঁরের সঙ্কট বা আন্দোলন সমাপ্ত হয়ে যাবে এমন মনে হয় না। বেঞ্জামিন কুশি নামের এক ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলনকারী মাকঁর এসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ফ্রান্স টু টিভিকে বলেছেন, “এগুলো অর্ধেক পদক্ষেপ। মাকঁরের আরও অনেক কিছু দেওয়ার আছে।” বিরোধী রাজনীতিকদের মধ্যেও ছিল সমালোচনার সুর। বামপন্থী নেতা জ লুক মিনোশ জানিয়েছেন, আরও প্রতিবাদ হবে বলে ধারণা করছেন তিনি। দক্ষিণপন্থী রাজনীতিক এরিক ইভোর্থ এসব পদক্ষেপকে ‘স্বল্প-মেয়াদি’ সমাধান বলে অভিহিত করেছেন। চরম দক্ষিণপন্থী নেতা পেন বলেছেন, মাকঁর তার কিছু ভুল স্বীকার করলেও সবগুলো করেননি।