নির্লজ্জরাও একটা সীমা মেনে চলে। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী ওই নাম-কা-ওয়াস্তে আড়ালটুকুও বজায় রাখতে জানেন না। লক্ষাধিক কৃষকের লালে লাল সমাবেশে রাজধানীর রাজপথ যখন প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সংকল্প ও বজ্রনির্ঘোষে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলছিল, নামহীন-পরিচয়হীন সমাজের প্রান্তসীমায় ঠেলে দেওয়া কৃষক সমাজের আলোড়ন যখন সমস্ত প্রান্তসীমায় ঠেলে দেওয়া কৃষক সমাজের আলোড়ন যখন সমস্ত বিরোধীদলকে এক মঞ্চে টেনে কৃষি প্রশ্নটাকে জাতীয় রাজনৈতিক অ্যাজেণ্ডা বানিয়ে ফেলল তখন একমাত্র, ব্যতিক্রমহীনভাবে একমাত্র মমতার প্রতিনিধি দীনেশ ত্রিবেদী নির্লজ্জতার সমস্ত আবরণকে হেলায় ছিঁড়ে ঘোষণা করলেন যে এ রাজ্যে নাকি ইতিমধ্যেই কৃষকদের আয় তিনগুণ হয়ে গেছে!
সেই ডাহা মিথ্যে ঘোষণা ওইদিনই প্রতিধ্বনিত হল কালনার অঘোরনাথ পার্ক স্টেডিয়ামে মুখ্যমন্ত্রীর কন্ঠে। তিনি ওখানে বলেছেন, ''কেন্দ্র বলছে, চাষিদের আয় দ্বিগুণ করবে। আমরা এখনই তিনগুণ করে দিয়েছি।'' মমতার এই ঘোষণা যে কত বড় মিথ্যে তা এবার আলোচনা করা যাক।
গোটা দেশের মধ্যে পশ্চিমবাংলা চাষযোগ্য কৃষি ক্ষেত্রের পরিমাণ এবং ধান, আলু, পাট, মাছ, ফল ও সব্জি উৎপাদনে অন্যতম অগ্রণী রাজ্য ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও, কৃষি নির্ভর পরিবার পিছু আয়ের ক্ষেত্রে পশ্চিমবাংলার স্থান ২৭তম—বিহারের এক ধাপ উপরে। এন এস এস ও ২০১৬-র তথ্য অনুসারে পাঞ্জাবে চাষিরা যে আয় করে (পরিবার পিছু ১৮,০৫৯ টাকা) তার তুলনায় এক-চতুর্থাংশেরও কম। এগ্রিকালচারাল স্ট্যাটিসটিকস অ্যাক্ট এ গ্ল্যান্স, ২০১৬-র অনুসন্ধান অনুযায়ী, এ রাজ্যে জমির বিরাট মাত্রায় খণ্ডিকারণের ফলে কৃষিক্ষেত্র থেকে আয় এত নিচে নেমে গেছে। ১৪ শতাংশ ছোট এবং ৮২ শতাংশ প্রান্তিক কৃষকেরা ০.৭৭ হেক্টরেরও কম জমিতে চাষবাস করেন। এত খণ্ডিত ছোট আবাদে চাষ করার ফলে উৎপাদন খুবই কম হয়, বাজারজাত উদ্বৃত্ত নেহাতই নগণ্য, আর সে জন্য কৃষি কাজ থেকে তেমন আয় তারা করতে পারেন না।
কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণা চরম হাস্যকর ও শঠতাপূর্ণ। কেন্দ্রীয় সরকারের কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্টস অ্যাণ্ড প্রাইসেস-এর ভূতপূর্ব চেয়ারম্যান এবং ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিক রিলেশনসের অধ্যাপক অশোক গুলাটি বলেছেন, ''কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার দাবি এক অত্যাশ্চর্য অলৌকিক ঘটনা'! তিনি বলেছেন, তা করতে গেলে টানা বেশ কয়েক বছর যাবৎ জাতীয় আয়ের সীমা পৌঁছাতে হবে ১২ শতাংশ হারে। নীতি আয়োগের অন্যতম সদস্য, অর্থনীতিবিদ বিবেক দেবরয়কে যখন এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়, তখন তিনি স্পষ্ট করেই বলেন যে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে যুক্ত করে আয় দ্বিগুণ করার কথা বলা হচ্ছে না। ওই আয় বৃদ্ধি হবে সাধারণ স্তরে।''
চাষির আয় দ্বিগুণ করতে হলে, সমস্ত স্তরের কৃষক ও কৃষিকাজে যুক্ত চাষিদের ক্ষেত্রেই তা করতে হবে। কিন্তু বাস্তব এটাই যে, কৃষিকাজে যুক্ত বিভিন্ন স্তরের কৃষকদের প্রকৃত আয়ের ক্ষেত্রে তারতম্য রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যে সমস্ত কৃষি পরিবারের হাতে ছিল ০.০১-০.৪ হেক্টর জমি তাদের ১০ বছরের ব্যবধানে (২০০২-০৩ থেকে ২০১২-১৩) আয়ের ক্ষেত্রে প্রকৃত বৃদ্ধি হয় ২১ শতাংশ। আর ৪-১০ হেক্টর পিছু পরিবারগুলোর বৃদ্ধি হয় ৪৭ শতাংশ। এটা সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে।
গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে কৃষিক্ষেত্র জুড়ে চলছে মারাত্মক কাঠামোগত সংকট। ২০১৩-র শেষভাগ থেকে মজুরি বৃদ্ধি থমকে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪-র অনেক আগে রীতিমতো নীচের দিকে নামছে। নির্মাণ ক্ষেত্র ধুঁকছে। কৃষিজাত পণ্যের ক্ষেত্রে ডিফ্লেশন, ২০১৪-র ভয়াবহ খরা। কৃষিপণ্যের দাম হু হু করে হ্রাসপ্রাপ্ত হওয়া, ইতিমধ্যে ক্ষতবিক্ষত ভঙ্গুর কৃষি অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব ফেলেছে। নোট বাতিল এবং জিএসটি যে মারাত্মক আঘাত দিয়েছে তা সেন্টার ফর মনিটরিং ইণ্ডিয়ান ইকনমির তথ্য থেকেই উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি মন্ত্রকও এক রির্পোটে তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।
সামগ্রিক কৃষি অর্থনীতির এই প্রেক্ষাপটে এ রাজ্যে চাষিদের আয় কোন মন্ত্রবলে তিনগুণ হয়ে গেল তার কোন ব্যাখ্যা নেই। গোটা ভারতীয় অর্থব্যবস্থা থেকে এ রাজ্য যেন বিচ্ছিন্ন এক ব-দ্বীপ! জননেত্রীর অনুপ্রেরণায় উন্নয়নের উন্মত্ত গতিতে 'এগিয়ে চলা' এ রাজ্য তাই নাকি এমনই অত্যাশ্চার্য অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে। দেশব্যাপী কৃষি সংকটের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হবে এ রাজ্যে কৃষকদের আয় তিনগুণ হয়েছে।
'চ্যালেঞ্জেস, অপশনস অ্যাণ্ড স্ট্রাটেজিস ফর ডাবলিং ফার্মাস ইনকাম ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল'—শিরোনামে ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চের ৬ জন কৃষি বিজ্ঞানী, শুভাশীষ মণ্ডল, ডি বর্মণ, ইউ কে মণ্ডল, টি ডি লামা, বি মাঝি এবং পি সি শর্মা একটি গবেষণা পত্রে দেখিয়েছেন যে জাতীয় ক্ষেত্রে গড় কৃষি আয় মাসে ৬৪২৬ টাকা পরিবার পিছু। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় তা একেবারেই নীচের দিকে। এ রাজ্যে পরিবার পিছু মাসিক আয় ৩৯৮০ টাকা! বিহার থেকে ঠিক এক ধাপ ওপরে, ২৭টি রাজ্যের মধ্যে। রাজ্যের মোট আয়ের ক্ষেত্রে কৃষি ক্ষেত্রের অবদান আশঙ্কাজনক মাত্রায় কমছে। ২০০৪-০৫ সালে যা ছিল ২৫ শতাংশ তা ২০১৪-১৫-তে মুখ থুবড়ে পড়েছে ১৬ শতাংশ হারে। কৃষিক্ষেত্রে অত্যন্ত নিম্ন আয়ের কারণে এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাবে ছদ্ম বেকারত্বের মাত্রা বিরাট হারে বেড়ে চলেছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে।
২০০৩-০৪ থেকে ২০১৩-১৪, এই দশ বছরের ব্যবধানে এ রাজ্যে কৃষির ওপর নির্ভরশীল পরিবারের সংখ্যা ৬৯.২৩ লক্ষ থেকে কমে ৬৩.৬২ লক্ষ (৫.৬০ শতাংশ) হয়। অপরদিকে, গোটা শ্রমশক্তির মধ্যে কৃষি শ্রমিকদের সংখ্যা ৫৭ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ কমে ৪৫ শতাংশে দাঁড়ায়। কৃষির ওপর নির্ভরশীল পরিবারের সংখ্যা এ রাজ্যে কমলেও, বিপরীত দিকে, জাতীয় ক্ষেত্রে কৃষির উপর নির্ভরশীল পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে ৮.৫ শতাংশ হারে। এ রাজ্যে কৃষি জোতের আয়তন সামান্য হারে কমেছে—০.৭৯ হেক্টর থেকে ০.৭৭ হেক্টর। কিন্তু একই সময়ে, জাতীয় ক্ষেত্রে কৃষি জোতের গড় আয়তন অনেক বেশি কমেছে—১.৪১ হেক্টর থেকে ১.১৫ হেক্টর। সমগ্র কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা (কৃষক ও কৃষিশ্রমিকের সম্মিলিত সংখ্যা) এ রাজ্যে জাতীয় ক্ষেত্রের তুলনায় সামান্য হারে বেড়েছে। এ রাজ্যে, ৯.৮৭ শতাংশ চাষি কৃষি কাজ থেকে সরে এসে বা উৎখাত হয়ে কৃষি শ্রমিকে পরিণত হয়েছেন। অতএব, দেখা যাচ্ছে যে ২০০৪-০৫ থেকে ২০১৪-১৫ পর্বে কৃষির ওপর নির্ভরশীল শ্রমশক্তির সংখ্যা প্রায় একই থেকেছে চাষিদের একটা অংশ কৃষি শ্রমিকে রূপান্তরিত হওয়ার ফলে। একদিকে, রাজ্য অর্থনীতিতে কৃষির অংশ বা অবদান লাগাতারভাবে কমছে, কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে নির্ভরশীল শ্রমশক্তির সংখ্যা একই থেকে যাওয়ায় কৃষির সঙ্গে যুক্ত পরিবারপিছু মাসিক আয় কমতেই চলেছে।
নরেন্দ্র মোদী সরকার নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে তারই বশংবদ পরিসংখ্যানবিদদের দিয়ে জি ডি পি-র নয়া 'মানদণ্ড' তৈরি করে আর্থিক বৃদ্ধির গপ্পো শোনালো। আর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও ডাহা মিথ্যা কথা বলে এমনই দাবী করলেন যা মোদীকেও লজ্জা দেবে। মমতার মিথ্যা ভাষণ এবার প্রবাদ সম হয়ে উঠল।