কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে নতুন মোটর ভেহিকেল (এমেন্ডমেন্ট) বিল ২০১৮, তড়িঘড়ি করে সংসদে পাশ করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। এর মধ্য দিয়ে একদিকে পুরো পথ পরিবহন ব্যবস্থাকে বেসরকারীকরণ করতে এবং অন্যদিকে পথ পরিবহন শ্রমিকদের (সরকারী ও বেসরকারী ক্ষেত্রের সাথে যারা যুক্ত) ভয়ঙ্কর এক শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আওতায় আনতে। এই বিলের পূর্ববর্তী বিল, রোড ট্রান্সপোর্ট এ্যান্ড সেফটি বিল, ২০১৪ এর বিরুদ্ধে সারা দেশের পরিবহন শ্রমিকরা আন্দোলন করে তা প্রতিহত করেছেন। মোটর ভেহিকেল এ্যামেন্ডমেন্ট বিলের প্রতিবাদে গত ৭ আগস্ট '১৮, সারা দেশের পরিবহন শ্রমিকরা যে ধর্মঘট সফল করেছেন তা নজির বিহীন। এই রাজ্যেও রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের অনুরূপ চেষ্টা চালাচ্ছে পরিকল্পিতভাবে সরকারী পথ পরিবহন ব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে, যার জন্য বেসরকারি ক্ষেত্রে রুট পারমিট দেওয়া হচ্ছে ব্যপকভাবে। রাজ্যের রাস্ট্রায়ত্ব পরিবহন সংস্থায় দীর্ঘদিন কোন স্থায়ী কর্মী নিয়োগ হচ্ছেনা। কন্ট্রাক্ট, ফ্র্যানচাইজি প্রথায় সহস্রাধিক ড্রাইভার কন্ডাক্টর নিয়োগ চলছে। যাদের সমকাজে সম মজুরী দেওয়া হয়না। নেই কোন সামাজিক সুরক্ষা। স্থায়ী কর্মীদের উপর চলছে অমানুষিক অত্যাচার। বেসরকারী পরিবহন সংস্থার কর্মীদের (বাস, লরি, অটো, ম্যাটাডোর, টোটো) জন্য কোন সুনির্দিষ্ট পলিসি নেই। চলছে পুলিশ ও এলাকার দাদাদের জুলুমবাজি। এরকম একটা পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এক দানবীয় আইন আনতে চাইছে।
এই বিল পাশ হলে—(১) চালককে লাইসেন্স পেতে হলে অবশ্যই মাধ্যমিক পাশ হতে হবে। আমাদের দেশের গরিব মানুষ যাদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছোয় নি, যারা জীবিকা হিসাবে ড্রাইভার বা কন্ডাক্টার হয়েছেন—তাদের সব লাইসেন্স বাতিল হবে। (২) আর টি ও অর্থাৎ সরকারি মোটর ভেহিকেল দপ্তর উঠে যাবে। এজেন্ট মানে দালালদের দিয়ে সব কাজ করানো হবে। লাইসেন্স ফি, রিনুউয়াল ফি, ট্যাক্স-এর টাকা সবই তারা ঠিক করবে। সরকারের আয় কমবে,সরকারি চাকরি কমবে। চালক ও গাড়ি
মালিকদের হয়রানি বাড়বে। দুর্নীতি বাড়বে। (৩) সব গ্যারেজ উঠে যাবে। ওলা, উবেরের মতো কোনো কোম্পানি বিভিন্ন জায়গায় মেরামতির শো-রুম দেবে। সেখানেই সব ধরনের গাড়ির সব ধরনের মেরামতি বাধ্যতামূলকভাবে করাতে হবে। হাজার হাজার গ্যারেজ কর্মী বেকার হবে। সব ব্যবস্থাই হবে এখনকার টোলট্যাক্স নেওয়া হচ্ছে যেভাবে সেইভাবে। সরকার একাংশ পাবে। কোনো নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে থাকবে না। ফলে শ্রমিক বা গাড়ির মালিকের অভিযোগ জানানোর কোনো জায়গাই থাকবে না।
এই বিলে শাস্তির যে কথা বলা আছে: (১) কোনো দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে কার দোষ তা বিচারের সুযোগ না রেখেই সরাসরি চালকের সাত বছর জেল এবং তিন লাখ টাকা জরিমানা ধার্য হবে। লাইসেন্স বাতিল হবে। (২) ছোটো দুর্ঘটনাতেও লাইসেন্স বাতিল বা সতর্কীকরণ এবং কম সময়ের জন্যে হলেও জেল খাটতে হবে।
যে সুযোগ সুবিধাগুলো নষ্ট হবে: (১) কোনো সরকারি ভর্তুকি দিয়ে সরকারি বাস চলবে না। (২) স্থায়ী শ্রমিক থাকবে না। (৩) কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষা থাকবে না। (৪) কাজের ঘন্টা ও বেতন ঠিক করবে বেসরকারি কোম্পানি। এসবের ফলে পথ পরিবহন ব্যবস্থা টিকে থাকবে না। সর্বনাশ শুধু শ্রমিকদেরই হবে না বাস, ট্যাক্সি, ম্যাটাডোরের মত ছোট মালিক ও সাধারণ মানুষদেরও। সেকারনেই দেশজোড়া আরও বড় আন্দোলনের পথেই আমাদের যেতে হবে। রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, দিল্লী সহ সারা দেশেই ইতিমধ্যে ব্যপক আন্দোলন গড়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের পথ পরিবহন শ্রমিকদেরও সংগঠিত হতে হবে।
বহু রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকার প্রস্তাবিত বিলের বিরোধিতা করেছে। আমরা রাজ্য সরকারকে ডেপুটেশন দিয়েও বিলের বিরোধিতা করাতে পারিনি। বহু রাজ্যের অনেক সাংসদরা এই বিলের বিরোধিতায় সরব হলেও এই রাজ্য থেকে নির্বাচিত তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদরা একজনও এর বিরোধিতা করেনি।কারন কেন্দ্রের বিল পাশ হওয়ার আগেই এই রাজ্যের পরিবহন দপ্তর শ্রমিক ও ছোট মালিকদের উপর একই ধাচের আক্রমন শুরু করে দিয়েছে।
যেমন—সরকারি বাস ট্রাম উঠে যাবার মুখে; সরকারি বাস ডিপোর জমি যথেচ্ছভাবে ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে; স্থায়ী শ্রমিক কমিয়ে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ করে যা খুশি বেতন দিয়ে চালানো হচ্ছে; স্থায়ী শ্রমিকদের, পেনশনারদের প্রাপ্য দেওয়া হচ্ছে না। সরকার পে কমিশনের রিপোর্ট বের করছে না; বেসরকারি ব্যক্তি বা কোম্পানিকে গাড়ি লিজ দেওয়া হচ্ছে, তাতে নানা দুর্নীতি চলছে। শ্রমিকদের নিয়োগের কোনো নিয়ম নেই। ঘুষ নিয়ে কাজ কাজ দেবার অভিযোগ উঠছে; বেসরকারি ক্ষেত্রে পুলিশি জুলুম লাগামছাড়া; গাড়ির যন্ত্রাংশের দাম বাড়ছে, পুলিশের নজরানা বাড়ছে, দাদাদের গুন্ডা ট্যাক্স বাড়ছে,জালানির দাম রেকর্ড ছাড়াচ্ছে। বহু বাস বসে যাচ্ছে। শত শত শ্রমিক বেকার হচ্ছে; ওলা, উবের চলছে বেপরোয়াভাবে। কোম্পানি ইচ্ছামত ভাড়া নিচ্ছে, রাজ্য সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। মার খাচ্ছে সাধারণ ট্যাক্সি; আর টি ও দপ্তরগুলো সম্পূর্ণ দালাল নির্ভর; পণ্য পরিবহনে পুলিশি জুলুম তোলাবাজির পাশাপাশি সুরক্ষার প্রশ্ন ক্রমশঃ প্রকট হয়ে উঠেছে।
এই অবস্থার প্রতিবাদ করলেই সন্ত্রাস। কাজ হারানোর ভয়। তবুও শ্রমিকরা মনে করছেন এই অবস্থা চলতে পারে না। তাঁদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। সব শেষ হবার আগে তাঁদের রুখে দাড়াতেই হবে। পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই পারে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে। তাই তারা আওয়াজ তুলছে—(১) কেন্দ্রীয় সরকারের তৈরি করা সর্বনাশা পরিবহন বিল বাতিল কর। সকল পরিবহন শ্রমিককে নিয়োগপত্র দিতে হবে। (২) পরিবহন শ্রমিকদের ন্যূনতম ১৮,০০০ টাকা মাসিক আয়ের বা বেতনের ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্ঘটনার ক্ষতিপুরণ, স্বাস্থ্য পরিষেবা, অবসরকালীন পেনশন এবং অন্যান্য সামাজিক ও জীবিকার সুরক্ষা দিতে হবে। (৩) সরকারি পরিবহন তুলে দেওয়া চলবে না। পরিবহনের জমি সহ সম্পত্তি সংস্থার ও শ্রমিকদের কল্যানে ব্যবহার করতে হবে। (৪) সরকারি বাস ও বাসরুট লিজ বা ভাড়া দেওয়া চলবে না। ঠিকা, ফ্রানচাইজি বন্ধ করে সকল শ্রমিককে স্থায়ীকরণ করতে হবে। (৫) সরকারি শ্রমিকদের জন্য গঠিত পে-কমিশনের রিপোর্ট অবিলম্বে প্রকাশ ও কার্যকর করতে হবে। (৬) পণ্য পরিবহন সহ বেসরকারি সমস্ত পরিবহন শ্রমিকদের চালু সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা কমানো চলবে না।শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা দিতে হবে। (৭) বেসরকারি অটো ,ট্যাক্সি, টোটো, ই রিক্সা এবং পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় সুষ্ঠু সরকারি নীতি ঘোষনা করতে হবে। (৮) পুলিশ আর টি ও-র জুলুম ও হয়রানি বন্ধ করতে হবে। দাদাগিরি তোলাবাজি বন্ধ করতে হবে। পুরাতন লাইসেন্স বাতিল করা চলবে না। (৯) ওলা, উবেরের ভাড়া সহ সমগ্র পরিষেবা সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। (১০) মৃত শ্রমিক ও দূর্ঘটনায় অক্ষম শ্রমিক পরিবারের সদস্যকে চাকরি দিতে হবে।
এই দাবিগুলি সরকারী বেসরকারী পরিবহন শিল্পের সাথে যুক্ত সকল শ্রমিকের। তাই সকল পরিবহন শিল্পের শ্রমিকরা আগামী ৮-৯ জানুয়ারীর দুদিন গাড়ি চালাবেন না। ইতিমধ্যেই এ আই সি সি টি ইউ অন্তর্ভুক্ত পরিবহন শ্রমিকদের সংগঠন কেলকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানী বাস ড্রাইভার ও কর্মচারী সমিতি, কেলকাটা স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন সংগ্রামী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন, অল ওয়েষ্ট বেঙ্গল স্টেট ট্রান্সপোর্ট সংগ্রামী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন, অল ওয়েষ্ট বেঙ্গল মোটর ট্রান্সপোর্ট সংগ্রামী শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন, কন্ট্রাক্ট- ফ্রানচাইজি ড্রাইভার এবং কন্ডাক্টর যুক্তমঞ্চের পক্ষ থেকে 'পরিবহন বার্তা' প্রকাশিত হয়েছে। ধর্মঘটে শ্রমিকদের সামিল করতে রাজ্য জুড়ে পত্রিকাটিকে শ্রমিকদের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মালিকপক্ষ এবং সরকারী পরিবহন সংস্থাকে স্ট্রাইক নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ধর্মঘট হবেই কারণ সারা বছর যারা পরিবহনকে সচল রাখে তারাই ঐ দুদিন পরিবহন শিল্পকে অচল করে দেবেন।