হলিউড তথা আমেরিকা-ইউরোপ থেকে বলিউড হয়ে ভারতের নানা জায়গায় ‘‘মি টু’’-র তরঙ্গ উঠতে শুরু করেছে। যে আগুন ছাই চাপা ছিল, দমকা হাওয়া লাগতেই তার ফুলকি ছড়িয়ে পড়েছে। ঢেউ-এর প্রথম ধাক্কাতেই টালমাটাল কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকে মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টের সদ্য প্রাক্তন বিচারপতি, শিল্পী থেকে চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা, প্রখ্যাত সাংবাদিক থেকে বিসিসি-র সিইও, শিল্পপতি থেকে নামি-দামি কোম্পানির উচ্চপদস্থ অফিসাররা। একের পর এক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত হচ্ছেন এবং অনেকেই তাঁদের পদ থেকে অপসারিত হচ্ছেন বা পদত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন।
নির্ভয়া কাণ্ডের পর নারী আন্দোলনে যে নতুন জোয়ার এসেছে, ‘‘মি টু’’ আলোড়ন বা ক্যাম্পেন তারই অঙ্গ, তারই এক নতুন রূপ। এর উৎস কোথায়? আমরা জানি কর্মক্ষেত্রে সর্বস্তরের মহিলাদের দিবারাত্রি কিভাবে শারীরিক ও মানসিক হেনস্থা ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে কিছু আইন প্রণয়ন হয়েছে কিন্তু সংস্থাগুলোতে পুরুষতন্ত্র এতটাই শক্তিশালী যে এসব বিধিনিয়মের কোনো তোয়াক্কাই করা হয় না। সে উন্নত পুঁজিবাদী দেশই হোক। অধিকাংশ সংস্থা সুপ্রীম কোর্টের বিশাখা গাইড লাইন বা ২০১৩ সালের কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হেনস্থা বিরোধী আইনকে অবজ্ঞা করে চলেছে। অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি গঠন করেনি যেখানে কমিটি আছে, সেখানেও তার কোনো কার্যকরী ভূমিকা নেই। বরং ভিকটিমদেরই কমিটির দ্বারা আবারও নানা হেনস্থার মুখে পড়তে হয়। কমিটিতে মহিলার সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি হওয়া উচিত, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তা করা হয় না। কমিটির মহিলা সদস্য ন্যায্য কথা বললে পুরুষ সদস্যদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ শুনতে হয়, এমন কি তাঁকেও বদলির ভয় দেখানো হয়। আর অভিযোগকারিণীকে তো রীতিমত হুমকির মুখে পড়তে হয়। তাই তাঁরা মুখ বুজে থাকতেই বাধ্য হন। কিন্তু আজ আন্তর্জাতিক ‘‘মি টু’’-র প্রভাবে কেবল নয়, অন্য বহু আন্দোলন এবং দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে মেয়েরা ক্রমশ সাহসী ও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছেন। নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা আদায় করার ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়েছেন তাঁরা। এ সবেরই প্রতিফলন আমরা দেখছি ‘‘মি টু’’-র ভারতীয় সংস্করণে। তার আঘাতে অনেক প্রতিষ্ঠান, যারা আগে এসব বিষয়ে গা করত না এবং আই সি সি ও তৈরি করেনি, হাওয়া বুঝে তারাও কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছে।
আমাদের দেশে ‘‘মি টু’’-র ঝোড়ো হাওয়া বইয়ে দিলেন যাঁরা, অর্থাৎ তনুশ্রী দত্ত ও প্রিয়া রামানির সংগ্রামের কথা আমরা সকলেই জানি। সুতরাং বহু চর্চিত সেসব কথায় আমরা যাচ্ছি না। কিন্তু তাঁদেরও আগে একই লড়াইয়ে নেমেছিলেন যিনি, সংবাদ মাধ্যম তাঁকে ‘‘মি টু’’-র মুখ বলে তুলে ধরেনি। অথচ তিনিও নিজের প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কর্তার দ্বারাই ধর্ষিতা হয়েছেন বার বার। কাজের অছিলায় তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে বা অন্যত্র নিয়ে গিয়ে অপকর্মটি করা হয়েছে। ভয়ে সংকোচে চুপ করে থেকেছেন সেই নারী। যখন সহ্যের সীমা পেরিয়েছে তখন মুখ খুলেছেন। তনুশ্রী ও প্রিয়ার মতো তাঁকেও তখন শুনতে হয়েছে, আগে বলেন নি কেন? অভিযোগ করার পর নিগ্রহকারী কর্তা ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চরিত্র হনন ও হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকে। অর্থাৎ ‘‘মি টু’’-র সবকটি লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্যই এখানে উপস্থিত। তিনি কেরলের মিশনারিস অফ জেসাস চার্চের প্রতিবাদী নান। অভিযুক্ত বিশপ আন্দোলনের চাপে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, সম্প্রতি জামিনে মুক্ত। সন্ন্যাসিনীর লড়াই আজও চলছে।
অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন এতো দেরীতে অভিযোগ কেন? প্রথমত: যে কোনো মেয়ের উপর এ ধরনের ঘটনা ঘটলে তিনি বেশ কিছু দিন ট্রমার মধ্যে থাকেন। একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়ভাব থেকে যায় তাঁর নিজের মধ্যেই। দ্বিতীয়ত, থানা এফআইআর নিতে চায় না। আমাদের বিচারব্যবস্থার হালটা তো জানাই আছে। স্বাভাবিকভাবেই, আত্মীয়, বন্ধুরা বলেন—ওদের সঙ্গে লড়াই করে পারবে? কি লাভ, শুধু নিজের মুখটাই পুড়বে। অতএব চেপে যাও, এই নির্মম বাস্তবতার কাছে নতিস্বীকার করতেই হয়। কিন্তু মনের মধ্যে যন্ত্রণাটা থেকেই যায়। পরে কখনও পায়ের নীচে জমিটা একটু শক্ত হলে, দরদী বন্ধু ও সংগ্রামী সংগঠনকে পাশে পেলে, আজকের মতো প্রতিবাদী আলোড়ন গড়ে উঠলে, সাহস ফিরে আসে। নীরবতা ভেঙ্গে গর্জে ওঠেন নিগৃহীতা। ‘‘মি টু’’ এই নীরবতা ভাঙ্গার জাগরণ, আলোড়ন। এক সুমহান বিলম্বিত বিদ্রোহ।
মন্ত্রী আকবরের অপকর্মে শাসকের ভাবমূর্তীতে বড়রকম চোট লেগেছে বলেই আরএসএস-বিজেপি ‘‘মি টু’’-কে এলিটদের আন্দোলন বলে ছোট করতে চাইছে। আরও কেউ কেউ এই ধরনের মন্তব্য করেছেন। এটা সম্পূর্ণ ভুল। বিভিন্ন শ্রেণী ও স্তরের মেয়েরা নিজেদের নির্দিষ্ঠ সমস্যা ও পরিস্থিতি অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে প্রতিবাদ করেন, লড়াই করেন এবং সেসবের সমারোহে বৃহত্তর নারী আন্দোলন গড়ে ওঠে। ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, অন্যান্য মেহনতী, অফিস কর্মচারী, শিক্ষক, সংবাদ ও সংস্কৃতি বা বিনোদন জগতের কর্মী, যৌন কর্মী ইত্যাদি নানা শ্রেণী, স্তর ও পেশার মেয়েদের সংগ্রাম—কোনটাই ছোট নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক। আজ আলোকপ্রাপ্তদের সংগ্রাম সমাজে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তা সভ্য-শিক্ষিত-সুপ্রতিষ্ঠিত ভদ্দরলোকেদের একাংশের মুখোশ খুলে দিচ্ছে, সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করছে। ঘা পড়ছে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা-কাঠামোয়, শক্তিশালী হচ্ছে সমগ্র নারী আন্দোলন।
মূলত কর্মক্ষেত্রে হেনস্থা ও নিগ্রহের প্রতিবাদে এই আলোড়ন আমাদের স্বাভাবিকভাবেই মনে পড়িয়ে দেয় দলিত বীরাঙ্গনা ভানোয়ারী দেবীর কথা। নিজের ডিউটি করতে গিয়ে, একটি শিশু কন্যার বিয়ে রুখে দিয়ে যিনি গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ১৯৯২ সালে। তিনি নিজে আজও ন্যায়বিচার পাননি, কিন্তু তাঁর মামলাতেই ১৯৯৭ সালে সুপ্রীম কোর্ট বিশাখা নির্দেশিকা জারি করেছিল।
মনে পড়ে আইপিএস অফিসার রূপান বাজাজের কথা, যিনি শাসকের চোখের মণি ‘সুপার কপ’ কে পি এস গিলকে আদালতে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে নিম্ন আদালতে, এমনকি হাইকোর্টেও হেরে যান রূপান। সুপ্রীম কোর্টে যান তিনি। এক ঐতিহাসিক রায়ে সর্বোচ্চ আদালত জানায়, নির্যাতিতার বয়ান যদি বিশ্বাসযোগ্য হয়, তাহলে সাক্ষীর প্রয়োজন নেই। দোষী সাব্যস্ত হন গিল।
মনে পড়ে তহেলকা পত্রিকার প্রখ্যাত সম্পাদক তরুণ তেজপালের বিরুদ্ধে তাঁর অধস্তন মহিলা সাংবাদিকের সংগ্রামের কথা। ২০১৩ সালে তেজপাল গ্রেপ্তার হলেও পরের বছরই জামিনে মুক্ত হয়ে এখন তিনি দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নিগৃহীতা এখনো ন্যায় বিচার পাননি, পাবেন কিনা সন্দেহ, কারণ এই মামলাগুলো কবে শেষ হবে কেউ জানে না।
আদালতে ন্যায়বিচার পাওয়া যে দুষ্কর, সে কথা জেনেও এম জে আকবর, অলোকনাথের দায়ের করা প্রতিশোধমূলক মামলা এবং নানা পাটেকরের অইনী নোটিশের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন বিদ্রোহিনীরা। তাঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন ‘আইপোয়া’ সহ অনেক মহিলা সংগঠন, সমাজকর্মী, আইনজীবী এবং অন্যান্যরা। আগামী দিনেও দেশের যে কোন জায়গায় যে কোনো অভিযোগকারিণীকে সবরকম সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছেন তাঁরা, বিশেষত, প্রগতিশীল আইনজীবীরা।
এমতাবস্থায় সরকারের সক্রিয়তা দেখাতে নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী মানেকা গান্ধি ‘‘মি টু’’ অভিযোগগুলোর দ্রুত মীমাংসার জন্য একটি প্যানেল গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এটা যে শাসক দলের প্রকৃত মনোভাব নয়,সেকথা বোঝা যায় অভিযুক্ত মন্ত্রীর ব্যাপারে তাদের দীর্ঘ নীরবতা থেকে। একে একে বিশ জন মহিলা সাংবাদিকের অভিযোগ আসার পরেই আকবরকে ছেঁটে ফেলতে তারা বাধ্য হয়েছেন। মন্ত্রী থাকাকালীন আকবরের উদ্ধত উক্তিকে (মোদী সরকারকে অপদস্থ করার রাজনৈতিক উদ্দশ্য নিয়েই সাধারণ নির্বাচনের ক’মাস আগে ‘‘মি টু’’ শুরু করা হয়েছে) শাসকেরা নীরব সমর্থনই জানিয়েছে।
মন্ত্রীবরের এই উক্তি যে মিথ্যা, ‘‘মি টু’’ যে রাজ রঙ দেখে হচ্ছে না, তার প্রমাণ হল কেবল মোদী সমর্থক দক্ষিণ ঘেঁষা লোকজনেরাই নয়, বিজেপি বিরোধী অনেক ব্যক্তিত্বও (যেমন সাংবাদিক বিনোদ দূয়া, শিল্পী যতীন দাস, কাথুয়া ধর্ষণ ও হত্যা বিরোধী আন্দোলনের মুখ তালিয়া হুসেন) এই ক্যাম্পেনের টার্গেট হয়েছেন। বস্তুত যৌন হেনস্থার বিষয়টাকে ডান-বাম বা পার্টিগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত নয়। প্রগতিশীল ও বামপন্থী পার্টি বা সংস্থাও তাঁদের সংগঠনের অভ্যন্তরে যৌন হেনস্থা ও নারী বিদ্বেষী মানসিকতা রোধ করার জন্য প্রয়োজনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ থাকবে, এটাই প্রত্যাশিত।