প্রতিবেদন
সিপিআই(এমএল)-এর ১১তম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলন সফল করুন

গণতন্ত্র ও জীবন-জীবিকার উপর হামলা প্রতিহত করুন
ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারকে প্রতিরোধ করুন

এক অভূতপুর্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পশ্চিমবাংলার বামপন্থী গণতান্ত্রিক আন্দোলন। দেশব্যাপী ফ্যাসিস্ত শক্তির আগ্রাসী অভিযান এ রাজ্যেক তার দাঁত-নখ বার করতে শুরু করেছে, অন্যদিকে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত স্বৈরাচারী তৃণমূল কংগ্রেস বিরামহীন দুর্নীতি, অবাধ গোষ্ঠী সংঘর্ষ, গণতন্ত্রের উপর লাগাতার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি যখন শ্রমজীবী জনগণের জীবন-জীবিকাকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে, তখন কিভাবে তার রাশ টানা যায়, সেদিকে কোনো সরকারের কোনো হুঁশ নেই, না কেন্দ্রের, না রাজ্যের। কেন্দ্রের সরকারের এক বরিষ্ঠ নেতা ও মন্ত্রী তো খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছেন, “২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসব না বলেই তো আমরা জেনে বুঝে ‘আচ্ছে দিন’-র গল্প শুনিয়েছি। বছর বছর ২ কোটি বেকার যুবকের চাকরির কথা বলেছি, কাজ-ই নেই তো চাকরি কোথা থেকে আসবে। সব-ই জুমলা।” নিতীন গড়গড়িরা যেটা বলতে ভুলে গেছেন, “গোপনে ‘ওদের’ যে কথাটা বলেছিলাম,তা আমরা মোদীর নেতৃত্বে সবাই মিলে করে চলেছি।” গোপন কথা রবে না গোপনে। লাইসেন্স রাজ খতম, কিন্তু অবাধ লুঠের ছাড়পত্র ‘ওদের’ দিয়ে দিয়েছি। তাই অবাধ লুঠ। ব্যাঙ্ক লুঠ, কয়লা খনি লুঠ, পাহাড় লুঠ (রাজস্থানে ২১টা পাহাড় লুঠ হয়েছে, আশ্চর্য লাগলেও সত্যি)। লুঠ আর দুর্নীতি হাত ধরাধরি করে চলে। রাফাল দুর্নীতি ভাসমান শিলা মাত্র। ব্যাপম কেলেঙ্কারী থেকে ললিত মোদী হয়ে নীরব মোদী, মাঝে বিজয় মাল্যই। এ পথেই এসেছে রাফাল কেলেঙ্কারী। স্বচ্ছ ভারত পুরো পল্লবিত হচ্ছে। বেকারদের কর্মসংস্থান নিয়ে ভাবার সময় কোথায়। বাজারের হাতে সব ছেড়ে দিয়েছে — কেন্দ্রের সরকার থেকে কেরোসিন, রান্নার গ্যাস থেকে পেট্রোল-ডিজেল, সবই বাজার নিয়ন্ত্রিত। বাজারই ঠিক করে দেবে, কোনো দুর্নীতির তদন্ত হবে, আর কেইবা করবে। অলোক ভার্মা আর রাকেশ আস্থানার “জমজমাট লড়াই” এখন মধ্যরাতের খেলা। দুজনেই বাধ্য তামুলক ‘ছুটি’ উপভোগ করছেন, ইত্যবসরে এক পাক্কা আরএসএস ‘দেশসেবক’ সিবিআই এর শীর্ষ পদে চলে এসেছেন, সঙ্গে একটা কাজ নিয়ে, জয় অমিত শাহ’র সম্পত্তি এক বছরে কি করে ১৬০০০ গুণ বৃদ্ধি পেল তার এক বৈদিক ব্যাখ্যাও হাজির করা। এ কাজে সফল হলে রেড্ডি সাহেবের চাকরি পাকা। পরের কাজও বলা আছে। “কালো টাকা উদ্ধারের” সময় অমিত শাহ নিয়ন্ত্রিত গুজরাট সমবায় ব্যাকঙ্কে যে হাজার হাজার কোটি কালো টাকা একদিনে “সাদা” হল, তাকে সিভিসি, সিবিআই, ইনকাম ট্যাাক্স দপ্তরের তদন্তের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়া‌।

এরা আমাদের রাজ্যক শাসন করতে উদগ্রীব, দুর্নীতি মুক্ত “স্বচ্ছ” বাংলা বানাতে চায়। হিটলারের কায়দায় ‘পবিত্র আর্য রক্তের’ জন্য ‘অনুপ্রবেশ কারীদের’ (পড়ুন, মুসলমানদের) উঁই পোকার মতো পিষে মারতে চায়, বাকীদের গলাধাক্কা দিয়ে বার করতে চায়। এই ‘মহান’ কাজের সপক্ষে জনমত তৈরি করতে মাসব্যাপী রথযাত্রা সংগঠিত করবে। আদবানী রথযাত্রা করে বাবরকে মুছে দিতে বাবরি মসজিদ ভেঙেছিল, তীব্র মেরুকরণ করে‌ কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যেগ, (বাবরি ভাঙায় যিনি নীরবে চোখের জল ফেলেছিলেন বলে শোনা যায়), অনুষ্ঠান শেষে তিনিই প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। বাংলা দখলে এরকম এক পরিকল্পনা মাথায় নিয়েই অমিত শাহ’র রথযাত্রা শুরু হবে নভেম্বর-ডিসেম্বরে। রাজস্থান, মধ্যাপ্রদেশ হাতছাড়া হলে, বাংলাতেই ভরসা বাড়াতে হবে। এই “অবাঞ্ছিত অতিথি”-কে যথাযোগ্য “স্বাগত” জানাতে বাংলার প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ছাত্র-যুব সমাজকে এখন থেকেই কাজ শুরু করে দিতে হবে। এখনও এরাজ্যে ক্ষমতায় আসেনি, ইতিমধ্যে পেট্রোল পাম্প ডিলারশিপ দেওয়া নিয়ে টাকা খেতে শুরু করে দিয়েছে। শিশু পাচারে হাত পাকিয়েছে। দাঙ্গা-হাঙ্গামার পাশাপাশি একটা “শবরীমালা” তৈরি করার জন্য নরেন্দ্র মোদী ও তার দলবল ঘনঘন বিবেকানন্দের উদ্ধৃতি আওড়াতে শুরু করেছে, বেলুড় মঠে যাতায়াত শুরু করেছে। সবারই নাকি বিবেকানন্দ হবার ইচ্ছে ছিল‌। শবরীমালা শুরুতে ছিল আদিবাসীদের একটা উপাসনাস্থল, ত্রিবাঙ্কুরের সবর্ণরাজা এটা দখল করে এর রূপান্তর করেছে। তারপর লম্বা ইতিহাস। বেলুড় মঠেরও একটা ইতিহাস আছে। বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর সিস্টার নিবেদিতাকে তাঁর দেহের পাশে বসতে পর্যন্ত দেওয়া হয়নি, সেই ‘ইতিহাস’ ফেরানো যায় কিনা, বাংলা ভাগের দুঃখজনক ইতিহাসকে জীবন্ত করে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে হাসিল করা যায় কিনা, অমিত শাহরা এই জন্যই রথে চড়ে।

এদের লক্ষ্য উদ্দ্যেশ্যের মধ্যে বন্ধ রুগ্ন কারখানা খোলার কোনো ব্যাপার নেই, কৃষকের ঋণমুক্তির কোনো ভাবনা নেই, নিত্যত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমাবার ইচ্ছা নেই, কর্মসংস্থানের প্রশ্ন নেই। এরা বাংলাকে আবার রক্তাত্ত করতে উদ্যত। এই ফ্যাসিস্ট পরিকল্পনা ব্যকর্থ করতেই হবে।

সিপিআই(এমএল)-এর ১১তম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলনের কাছে তাই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, এই আগ্রাসন রুখবে কে, রুখব কিভাবে? যে মাটি, যে আবহাওয়া ও পরিমন্ডল ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের সহায়ক আমাদের রাজ্যে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তৃণমূল সরকার ও তৃণমূল কংগ্রেস দলটি তা প্রস্তুত করছে। ফ্যাসিস্টরা বহুমত পছন্দ করে না। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, বৈচিত্র্যহীন এক দুরমুশ করা সমাজ তাদের বিকাশের জন্য দরকার। যে পদাতিক বাহিনী তার সাম্প্রদায়িক তান্ডব ও গেস্টাপো বাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয়, তা সে বেছে নেয় কর্মহীন যুবক, কর্মচ্যূত শ্রমিক, ভবঘুরে ও লুম্পেন অপরাধীদের মধ্য থেকে। গত সাত-আট বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা তৃণমূল কংগ্রেস সরকার একটাও নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে যেমন লাখো লাখো বেকার কর্মপ্রার্থীর চাকরির সংস্থান যেমন করেনি, তেমনি একটাও বন্ধ কারখানা খুলে কর্মচ্যূেত শ্রমিককে কাজ ফিরিয়ে দিতে পারেনি। গ্রামাঞ্চলে যেটুকু ছিঁটেফোটা কাজ হত একশ দিনের প্রকল্পে সেটাও দলতন্ত্র ও দুর্নীতির কবলে।ফ্যাকসিস্টদের পদাতিক সরবরাহের উর্বর জমি তৈরি হচ্ছে। গণতন্ত্রহীনতার এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ এ রাজ্যে গড়ে উঠেছে। মিটিং-মিছিল-সভা সমাবেশ অনেক হয়েছে, আর দরকার নেই, সরকার, প্রশাসন, দলীয় দুস্কৃতিরা ধর্মঘট ভাঙতে মাঠে নেমে পড়ে। যে কোনো প্রতিবাদ, তা সে ভাঙড়ে হোক বা দাড়িভিটে, আজ বেয়নেট ও বুলেটের মুখোমুখি। রাজ্যজোড়া নৈরাশ্য ও নৈরাজ্য। আদিবাসীরা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, জল-জমি-মজুরির দাবি তুললেই তা নকশালপন্থী বা মাওবাদী বলে দাগিয়ে দিয়ে সন্ত্রাস নামানো হচ্ছে। জঙ্গলমহল ‘হাসছে’ তথাপি যৌথ বাহিনী নিয়মিত টহল দেয়। গ্রাম থেকে শহর সর্বত্র বিরোধীশূন্য করার অভিযান চালানো হয়। এটাই তো ফ্যাজসিস্টদের পছন্দ। ওরা যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সর্বত্র বশংবদ লোককে বসায়, এরাও তেমনি বশংবদ বুদ্ধিজীবী বানায়। এই নৈরাজ্য ও নৈরাশ্যের বাতাবরণ কোন দিকে এগুবে সহজেই বোঝা যায়।

বিপ্লবী শক্তি পরনির্ভরশীল হয়ে এই লড়াইয়ে জয়ী হতে পারেনা। “আঘাত করার ক্ষমতা” বাড়াতে সংগঠনকে রাজনৈতিকভাবে সংহত করার সাথে সাথে সংগঠনের বিস্তারের জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা চালাতে হবে। আক্রমণ যেহেতু সার্বিক ও তীব্র, তাই প্রতিরোধকে সার্বিক ও প্রতি-আক্রমণাত্মক হতে হবে। শত্রুর বিরুদ্ধে সম্ভাব্যে সমস্ত মিত্র শক্তিকে জড়ো করতে হবে। “সংকীর্ণতা” অনেক সময় ‘বিপ্লবী’ বলে মনে হয়। কিন্তু তা সংকীর্ণতাই। বিপ্লবীর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য স্পষ্ট, দায়হীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মতো সে আচরণ করতে পারেনা। কোনো আশু লক্ষ্যে সে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়তে পারেনা। গণতন্ত্রের জন্য, জীবন-জীবিকা রক্ষার জন্য তার লড়াই এগিয়ে যাবে সমাজকে পাল্টানোর লক্ষ্যে। আসুন, আমরা পার্টির আসন্ন রাজ্যর সম্মেলন সফল করে সেই লক্ষ্যের এগিয়ে যাই। এগোতে আমাদের হবেই।

খণ্ড-25
সংখ্যা-33