(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৩ অক্টোবর ২০১৮)
গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী মরশুম যত এগিয়ে আসছে, প্রতিটা দিন যাওয়ার সঙ্গে সংঘ-বিজেপি অভিসন্ধির রূপরেখা ক্রমেই স্পষ্ঠ হয়ে উঠছে। ২০১৯-এর বড় লড়াইয়ের আগে বিজেপির এজেণ্ডা এবং প্রচারের যে নকশা ক্রমেই উন্মোচিত হচ্ছে তার মধ্যে আমরা চারটি মূল বিষয় দেখতে পাচ্ছি। অযোধ্যার যে স্থানে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাবরি মসজিদ দাঁড়িয়ে ছিল, সেই স্থানে রাম মন্দির নির্মাণকে সম্ভবপর করে তুলতে মোদী সরকারকে আইন করতে হবে বলে আরএসএস-এর জিগির তোলা; শবরীমালা মন্দিরে সব বয়সের মহিলারা প্রবেশ করতে পারবেন বলে সুপ্রীম কোর্টের রায় নিয়ে আরএসএস-এর সম্পূর্ণ উল্টো দিকে ঘুরে যাওয়া এবং কেরলে ঐ রায়ের বাস্তবায়নকে আটকাতে সহিংস কর্মসূচী গ্রহণ করা; আসন্ন কুম্ভমেলা সমাবেশের আগে এলাহাবাদ শহর ও জেলার নাম পাল্টে তাকে প্রয়াগরাজ করার আদিত্যনাথ সরকারের তুঘলকি ফরমান; এবং অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকার গঠনের ঘোষণার ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপনের নামে সুভাষ চন্দ্র বসুর উত্তরাধিকারকে আত্মসাৎ করার মোদীর মরিয়া প্রচেষ্টা। এ সমস্ত কিছুরই লক্ষ্য হল সংঘের ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ অনুসারে ভারতকে নতুন রূপে রূপায়িত করার সংঘ-বিজেপির আগ্রাসি উদ্যোগকে বৈধ করে তুলতে পুরান এবং ইতিহাসের এক উগ্র মিশেল তৈরি করা।
সংঘ বাহিনীর রাম মন্দির কর্মসূচী কখনই রামের জন্য এক সুদৃশ্য মন্দির গড়ার ব্যাপার ছিল না, তা ছিল বাবরি মসজিদকে অপসারিত করে তার স্থানে রাম মন্দির নির্মাণের অভিযান। তার উদ্দেশ্য আবার ষোড়শ শতকে ঘটা তথাকথিত কোনো অন্যায়ের প্রতিশোধ তোলাও ছিল না, তা বরং ছিল সুপ্রীম কোর্ট এবং সে সময়ের সংসদের কোন তোয়াক্কা না করা। ১৯৯২ যদি স্পর্ধার আখ্যান হয়ে থাকে তবে ২০১৮ সালে দেখা যাচ্ছে সুপ্রীম কোর্ট এবং সংসদকে তাদের অভিসন্ধির কাছে নত করানোর চোখ রাঙানি। সংঘ চায় সংসদে আইন রচনার মধ্যে দিয়ে রাম মন্দির নির্মাণকে সম্ভবপর করে তোলা হোক—হয় সুপ্রীম কোর্ট তাদের অভিপ্রায় বুঝে নিয়ে সেই মতো রায় দিক, আর না হয় সরকার সংসদে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে আইন তৈরি করুক যাতে সুপ্রীম কোর্টের সিদ্ধান্তকে খারিজ করা যায়। এটা হিন্দু রাষ্ট্র রূপে ভারতীয় রাষ্ট্রের নতুন নির্মাণ সম্পর্কে সুপ্রীম কোর্ট, সংসদ এবং সংবিধানের কাছে সুস্পষ্ঠ রূপে শর্ত হাজির করা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
শবরীমালা মন্দিরে নারীদের প্রবেশাধিকার দিয়ে সুপ্রীম কোর্টের রায় সম্বন্ধেও আরএসএস প্রকাশ্যেই একই ধরনের অবস্থান ব্যক্ত করেছে। ভাগবত বলেছেন, স্বাধীনতা ও সাম্যের সাংবিধানিক নীতির ভিত্তিতে রায় দেওয়ার পরিবর্তে সম্প্রদায়ের প্রাধান্যকারী মত নির্ধারিত প্রথার অনুগামী হয়েই সুপ্রীম কোর্টের ঐ মামলার মীমাংসা করা উচিৎ ছিল। এরা হল সেই সমস্ত মানুষ যারা মুসলিম নারীদের প্রতি ন্যায়বিচারের নাম নিয়ে তাৎক্ষণিক তিন তালাককে বাতিল করা সুপ্রীম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানায় এবং এমনকি তিন তালাককে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে তুলে একটা অধ্যাদেশও জারি করে। নারীদের প্রবেশাধিকার সম্পর্কে শবরীমালা মন্দিরের বোর্ড এবং হাজি আলি দরগা ট্রাস্ট যে বৈপরীত্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়েছে, এই পরিপ্রেক্ষিতে তার উল্লেখও শিক্ষাপ্রদ হবে। হাজি আলি দরগা ট্রাস্ট সুপ্রীম কোর্টের রায়কে মেনে নিলেও ট্রাভাঙ্কোর দেবাসৌম বোর্ড সুপ্রীম কোর্টের রায়কে লঙ্ঘন করে চলেছে এবং রায়কে এমনকি ‘যৌন পর্যটনের’ পক্ষে উৎসাহ দান বলেও অভিহিত করছে, আর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনন্ত হেগড়ে হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ভাবাবেগ নিয়ে খেলা করার অভিযোগে সুপ্রীম কোর্টের রায়কে অভিযুক্ত করছেন। তিন তালাক এবং হাজি আলি দরগায় নারীদের প্রবেশাধিকার নিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ও যদি অমান্যতা এবং বিরোধিতার একই ধরনের অবস্থান নিত, সে ক্ষেত্রে আরএসএস, বিজেপি এবং মোদী সরকারের প্রতিক্রিয়া কি হত তা কল্পনা করাটা একেবারেই কঠিন ব্যাপার নয়।
উত্তরপ্রদেশে আইনের শাসনের জায়গা নিয়েছে সংঘর্ষ রাজের স্বৈরাচার আর সমস্ত ক্ষেত্রেই প্রশাসন মুখ থুবড়ে পড়েছে। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ নাম পাল্টানোর ধুম লাগিয়েছেন। দীন দয়াল উপাধ্যায়ের নামে মুঘলসরাইয়ের নতুন নামকরণ করার পর উত্তরপ্রদেশ সরকার সুপ্রসিদ্ধ এলাহাবাদ শহর ও জেলার নাম পাল্টে নতুন নাম দিয়েছে প্রয়াগরাজ। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এলাহাবাদের এক বিশিষ্ঠ স্থান রয়েছে। নাম পাল্টানোর এই প্রক্রিয়া এলাহাবাদ হাইকোর্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত হলে এই উদ্যোগে খরচ হবে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এটা বিমুদ্রাকরণ উদ্যোগের মতোই অপচয়মূলক এবং অবাস্তবোচিত এবং এর সঙ্গে আরো যুক্ত রয়েছে সাংস্কৃতিক গোঁড়ামি ও মূঢ়তা। এলাহাবাদ ও প্রয়াগ এই দুই সংলগ্ন শহর কয়েক শতাব্দী ধরে সহাবস্থান করছে। কিন্তু মোগল যুগের যে কোন ঐতিহ্য ও ইতিহাসই ঐ বর্বরদের কাছে ঘৃণার বস্তু যারা আজ ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে জীবন ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই লাগামছাড়া ধ্বংসকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন নামকরণের এই তৎপরতাকে একটা প্যাকেজের অংশ হিসেবে রাম মন্দিরের জন্য নতুন সক্রিয়তা এবং বেনারসে বিদেশে বসবাসকারী ভারতীদের আসন্ন জমায়েত এবং কুম্ভ মেলার আসন্ন সমাবেশের সঙ্গেই দেখতে হবে। আর ২০১৯-এর নির্বাচনের আগের পর্যায়ে এই সব কিছুকেই সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগিয়ে প্রচারকে উচ্চগ্রামে নিয়ে যাওয়া এবং আবেগঘন উন্মাদনাকে চাগিয়ে তোলা হবে।
সাংস্কৃতিক রাজনীতির এই প্রদর্শনীর মধ্যে মোদী সরকার সিঙ্গাপুরের মাটিতে অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকারের ঘোষণার ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপনের নামে সুভাষ চন্দ্র বসুর উত্তরাধিকারকে আত্মসাতের লক্ষ্যে এক মরিয়া প্রচারাভিযান শুরু করেছে। সরকারের দাবি, এর আগের সমস্ত সরকারই নেতাজির ভূমিকা এবং অবদানকে অবজ্ঞা করেছে এবং সরকার নরেন্দ্র মোদীকে সুভাষ বসুর যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে তুলে ধরতে চাইছে, যিনি অবশেষে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এই মহান নেতাকে তাঁর যোগ্য সম্মান প্রদান করছেন। এই সরকার গান্ধিকে যেমন স্বচ্ছ ভারত অভিযান রূপে অভিহিত প্রচারাভিযানের এক প্রতীক মাত্রে পর্যবসিত করেছে, সেরকম ভাবে সুভাষ চন্দ্র বসুকে পরিমার্জিত করার প্রক্রিয়াও সচল রয়েছে। তাঁর বাম ধারার রাজনীতি, অর্থনৈতিক পরিকল্পনার উপর জোর দেওয়ার পুরোগামী ভূমিকা, সর্বজনীনতার দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাভারকারের হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধতার এবং বিভেদমূলক রাজনীতির দৃঢ় প্রত্যাখ্যান—এই সমস্ত কিছুকে মুছে দিয়ে তাঁকে এমন এক প্রেরণাসঞ্চারী নেতা হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে যিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র লড়াই চালাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ও জাপানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন।
কমিউনিস্টরা অবশ্য হিটলার, মুসোলিনি এবং তোজোর সঙ্গে বসুর জোটবদ্ধতাকে মেনে নেয়নি এবং অত্যন্ত কঠোর ভাষায় তাঁর সমালোচনাও করেছিল। তবে, আজাদ হিন্দ ফৌজের (আইএনএ) যোদ্ধাদের মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলনে কমিউনিস্টরা এবং কংগ্রেসই সামনের সারিতে ছিল। বিভিন্ন যে জনশক্তি নিয়ে আজাদ হিন্দু ফৌজ এবং অস্থয়ী আজাদ হিন্দ সকার গঠিত হয়েছিল তা ভারতের বৈচিত্র্য এবং বহুত্বকে প্রতিফলিত করেছিল এবং আইএনএ-র যোদ্ধাদের মুক্তির দাবি ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত অভিযানের রণহুঙ্কার হয়ে উঠেছিল। আইএনএ-র অনেক নেতাই কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগ দেন এবং আইএনএ গঠনের আগে সুভাষ চন্দ্র বসুর তৈরি করা রাজনৈতিক দল সারা ভারত ফরওয়ার্ড ব্লক স্বাধীনতার পর বাম শিবিরের এক শরিক হয়ে ওঠে। কেবলমাত্র মহিলাদের নিয়ে গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের লড়াকু বাহিনী রাণী ঝাঁসি বাহিনীর প্রধান ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র বরিষ্ঠ সদস্যা হয়ে ওঠেন এবং প্রথম এনডিএ জমানায় ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী পক্ষের প্রার্থীও হন। এখানে এই বিষয়ের উল্লেখও জরুরী যে, সুভাষ চন্দ্র বসু প্রকৃতভাবেই ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করলেও আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভা ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে সহযোগিতা করতেই ব্যস্ত ছিল। সাভারকার এমনকি হিন্দুদের বলেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদের— যেটাকে তিনি হিন্দুত্ব বলে অভিহিত করেন—সামরিক সংহতি এবং বিকাশের লক্ষ্যে তারা যেন যোগ দিয়ে ব্রিটিশ বাহিনীকে “ভরিয়ে দেয়’’। সুভাষ চন্দ্র বসুর অবদানকে অবহেলা করার অভিযোগে অন্যদের অভিযুক্ত করার আগে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা এবং ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে সহযোগিতার যে ইতিহাস তাদের রয়েছে তার ব্যাখ্যা মোদী এবং আর এস এস-বিজেপির নেতাদের অবশ্যই দিতে হবে।
জিনিসপত্রের আকাশ-ছোঁয়া দাম, বিপুল বেকারি এবং গভীরতর হয়ে ওঠা কৃষি এবং অর্থনৈতিক সংকটের ভারে জনগণ যখন চোখে সর্ষেফুল দেখছে, মোদী সরকারের বাড়িয়ে তোলা পেটোয়া পুঁজিবাদের দুর্নীতি যখন প্রতিদিনই খবর হয়ে উঠছে এবং এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের বেছে নেওয়া সিবিআই-এর এক উচ্চপদস্থ অফিসারের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে তদন্তও হচ্ছে, তখন তাদের সাড়ে চার বছরের শাসনে প্রতিটি ফ্রন্টে তারা যে নৈরাজ্যের জন্ম দিয়েছে তার কোনো জবাবই মোদী এবং তাঁর দলবলের কাছে নেই। আর তাই জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা এবং তাদের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার পথের সন্ধানে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই সংকটের সমাধানের জন্য লড়াইয়ে জনগণকে দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সংঘ-বিজেপি প্রশাসনের বিভেদ সৃষ্টি এবং দৃষ্টিকে বিক্ষিপ্ত করার এই চক্রান্তকে ব্যর্থ করতে হবে এবং যে শাসকরা দেশের কাছে চরম বিপর্যয় হয়ে দেখা দিয়েছে, নির্বাচনে তাদের নির্ধারকভাবে পরাজিত করতে হবে, ১৯৭৭ সালে জরুরী অবস্থার জমানাকে যেমনভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল ঠিক সেরকমভাবেই।