যৌন হেনস্থাকারীদের দিন ফুরিয়ে এসেছে
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়,
১৬ অক্টোবর ২০১৮)

গত দু-সপ্তাহে আমরা ভুক্তভোগী নারীদের নিজেদের মুখেই সিনেমা, সাংবাদিকতা, শিল্প, পড়াশোনা এবং আন্দোলনের জগতে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত স্বভাবগত যৌন হেনস্থাকারীদের মুখোশ খুলে দেওয়ার এক সুনামিই দেখতে পেলাম। গত বছর আমরা আমেরিকার নারীদের হার্ভে উইনস্টেইনের মতো হলিউডের নারী-খাদকদের মুখোশ খুলে দিতে দেখেছিলাম। তাদের মতোই আমাদের দেশের নারীরাও “মি টু’’’ হ্যাশট্যাগটি ব্যবহার করে দাবি করেছেন যে, যৌন হিংসা সম্পর্কে নারীদের অভিজ্ঞতাকে স্বীকার করতে ও বিশ্বাস করতে হবে। বিচ্ছিন্নতার যে বোধ নারীদের আচ্ছন্ন করে, তাকে ভেঙ্গে নারীরা শক্তিশালী এবং সম্মানিত পুরুষদের যৌন হেনস্থার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন, “মি টু’’’ আন্দোলন তাদের উৎপীড়কদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে এবং তাদের মুখোশ খুলে দিতে অনেক মহিলাকেই সাহস যুগিয়েছে।

সাংবাদিক প্রিয়া রামানি প্রবীণ সাংবাদিক এবং মোদী মন্ত্রীসভার সদস্য এম জে আকবরকে এমন এক পীড়ক হিসাবে উন্মোচিত করেছেন যিনি তাঁর সম্পাদনা করা সংবাদপত্র এবং পত্রিকাগুলিতে কর্মরত যুবতীদের শিকারে মুখিয়ে থাকতেন। অন্যান্য মহিলারাও দ্রুতই এগিয়ে এসে আকবরের হাতে যৌন আক্রমণ এবং দীর্ঘস্থায়ী হেনস্থার তাঁদের অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করলেন।

আকবরের পদত্যাগ অথবা মন্ত্রীত্ব থেকে অপসারণের দাবি জোরালো হয়ে উঠলেও তিনি তাঁর পদ আঁকড়ে ধরে থাকলেন, পদত্যাগ করতে অস্বীকার করলেন, অভিযোগকারীদের মিথ্যাবাদী বলে ছাপ মারলেন এবং এই ইঙ্গিত করলেন যে, “মি টু’’ ঝড় উঠেছে “সাধারণ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে’’, এবং তার পিছনে রয়েছে মোদী সরকারকে অপদস্থ করার রাজনৈতিক “এজেণ্ডা’’। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীত্বে অব্যাহত থাকা এবং নিজের সমর্থনে তাঁর যুক্তির ধরন থেকে স্পষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল যে, আকবরের প্রতি প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং বিজেপি দলের সমর্থনের উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে নির্লজ্জ, বেহায়ার মতো চালিয়ে যেতে দেওয়া। ভয় দেখানোর প্রকাশ্য প্রয়াসে আকবর রামানির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করলেন। কিন্তু প্রিয়া রামানির সমর্থনে আকবরের হাতে যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়া আরো কুড়ি জন মহিলা সাংবাদিক নিজেদের সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে আসায় আকবর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। মোদী সরকারের ক্ষমতার বিরুদ্ধে এটা “মি টু’’’ আন্দোলনের এক বিপুল বিজয়।

অভিযোগগুলি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত—আকবরের এই দাবি ভিত্তিহীন, কেননা, “মি টু’’ রাজনৈতিক বিন্যাসের সমস্ত দিকেই থাকা যৌন উৎপীড়কদের মুখোশ খুলে দিয়েছে। আকবর, নানা পাটেকর, চেতন ভগত এবং আলোক নাথের মতো মোদী সমর্থক এবং দক্ষিণপন্থীদের মুখোশ যদি খুলে গিয়ে থাকে, তবে সাংবাদিক বিনোদ দুয়া এবং শিল্পী যতীন দাস সহ বিশিষ্ঠ বিরোধী মুখ ও কণ্ঠদেরও উন্মোচন ঘটেছে।

যৌন নিগ্রহের ইস্যুটিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে বিচার করা ঠিক নয়। প্রগতিবাদী এবং বাম সংগঠনগুলি, দল এবং চক্রগুলিকেও তাদের নিজেদের কর্মীদের মধ্যে যৌন নিগ্রহ এবং নারী বিদ্বেষকে প্রতিহত করা এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতা নিতে হবে। বিশিষ্ঠ এবং শক্তিশালী মানুষদের দ্বারা সংঘটিত যৌন নিগ্রহের উন্মোচন যে সমস্ত নারী ঘটাচ্ছেন, তাঁরা তা করছেন অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে এবং নিজেদের মনের শান্তি ও নিরাপত্তার মূল্যে এবং পেশাদারি জীবনকে বাজি রেখে। ব্যবস্থা তাদের বিরুদ্ধে ঝোঁকা। পাঁচ বছর আগে যে মহিলা সাংবাদিক তরুণ তেজপালের হাতে ধর্ষিতা হন তিনি এখনও নিষ্ফলভাবেই ন্যায় বিচারের জন্য অপেক্ষা করছেন, কেননা, তেজপাল পুলিশ ও আদালতকে কাজে লাগিয়ে আইনি প্রক্রিয়াকে অনির্দিষ্ঠকালের জন্য স্থগিত করে দিতে সক্ষম হয়েছেন।

মানহানির মামলা করে মহিলা অভিযোগকারীদের ভয় দেখানো হচ্ছে। প্রিয়া রামানি ছাড়া সিনেমা প্রযোজক ভিন্টা নন্দা এবং তনুশ্রী দত্তর বিরুদ্ধেও মানহানির মামলা দায়ের হয়েছে। ভিন্টা নন্দা অলোক নাথের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন, আর তনুশ্রী দত্ত নানা পাটেকারের হাতে যৌন নিগ্রহ এবং পাটেকারের সমর্থকদের দ্বারা গণ হিংসা চালানোর অভিযোগ এনেছেন। এই মানহানির মামলাগুলির উদ্দেশ্য হল তাদের মুখ বন্ধ করা এবং ভয় দেখিয়ে অভিযোগ দায়ের থেকে দূরে রাখা। বিজেপি সাংসদ রাজীব চন্দ্রশেখরের ঘনিষ্ঠ সহযোগীর বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ আনার পর ঐ সাংসদ চালিত এক সংগঠনের এক মহিলা কর্মী তাঁর কাজ হারিয়েছেন; ঐ সহযোগী আদালত থেকে মুখ বন্ধের নির্দেশ এনেছেন যার ফলে ঐ মহিলা তাঁর মামলা নিয়ে কোনো কথা বলতে পারবেন না।

কিন্তু মহিলারা পাল্টা লড়াই চালাচ্ছেন। আকবরের সমর্থকরা ভারতের দরিদ্র এবং শ্রমিক শ্রেণীর মহিলাদের “প্রকৃত’’ উদ্বেগগুলির তুলনায় যৌন নিগ্রহের অভিযোগকে তুচ্ছ বলে গণ্য করছেন। তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, এক গ্রামের দলিত মহিলা ভানোয়ারি দেবীর যৌন নিগ্রহের অভিজ্ঞতা এবং তারপর সাথীঁ হিসাবে কাজ করতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনাতেই সুপ্রীম কোর্ট ১৯৯৭ সালে যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধে কর্মস্থলে বিশাখা নীতিমালাকে নির্দেশিত করে। নারী শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রিত করতে বিশ্বের সমস্ত স্থানেই কর্মস্থল ও কারখানাগুলিতে যৌন নিগ্রহকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যাপক হারে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে—আর ভারতবর্ষও এর কোন ব্যতিক্রম নয়।

“মি টু’’ আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকতর স্তরে বিদ্যমান যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধে গৃহ পরিচারিকা, খামার কর্মী, কারখানায় কর্মরত কর্মী, রেস্তোঁরায় কাজ করা কর্মী, সাফাই কর্মী এবং অন্যান্যদের লড়াইয়ে সমর্থন সুনিশ্চিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রেও তা অবশ্যই ঘটতে হবে। “মি টু’’’ আন্দোলনের অভিযোগকারিণীদের ন্যায়বিচার দিতে নারী ও শিশু বিকাশ মন্ত্রী মানেকা গান্ধি চার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে নিয়ে একটি প্যানেল গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই ধরনের পদক্ষেপগুলিকে প্রতারণার কৌশল এবং “মিটু’’’ আন্দোলনে আরো বহু অভিযোগ দায়ের হওয়াকে সংযত ও নিয়ন্ত্রিত করার প্রচেষ্টা হিসাবেই বোঝা যেতে পারে। আকবর সম্পর্কে বিজেপির দীর্ঘ নীরবতা এবং বেশ কিছুটা দেরিতে তাঁর পদত্যাগ, যৌন নিগ্রহের অভিযোগ জানানো নারী কর্মীর মুখ বন্ধ করা এবং তাকে শাস্তি দেওয়ায় যার প্রত্যক্ষ ভূমিকা থেকেছে, তাদের সেই সাংসদ রাজীব চন্দ্রশেখরকে নিয়ন্ত্রিত করতে বিজেপির অস্বীকার করা—এগুলো তাদের “বেটি বাঁচাও’’-এর বাগাড়ম্বরের অন্তঃসারশূন্যতাকেই আরো একবার প্রতীয়মান করল।

খণ্ড-25
সংখ্যা-33