সম্পাদকীয়
বুঝে নিক দুর্বৃত্ত!

পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, রাফাল দুর্নীতি, মোদী-আম্বানী আঁতাত, রাফাল দুর্নীতির তদন্ত চাপা দিতে শাসন ক্ষমতার সর্বোচ্চ চেয়ারকে ব্যবহার করে সিবিআই এর শীর্ষস্তরে রদবদল ঘটানো, শবরীমালা মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশের সমানাধিকারের প্রশ্নে অমিত শাহদের চরম পিতৃতান্ত্রিক বিরুদ্ধাচরণ, ‘মি টু’ আন্দোলনের প্রসঙ্গে সংঘ পরিবারবাদীদের বিষোদগার ইত্যাদি জ্বলন্ত ইস্যুতে গোটা দেশ উত্তাল। এর রাজনৈতিক যুক্তি-তর্ক-ধাক্কা সামাল দিতে বাকি ভারতে বিজেপি-আরএসএস পড়েছে রক্ষণাত্মক অবস্থায়, আর এই বাংলায় তাদের পথে নামতে দেখা যাচ্ছে না। ওদের রুখে দিতে এইসব দাওয়াই বেশ কাজ দিচ্ছে। তাই মোকাবিলার এই ময়দানে সমস্ত ধরনের বাম, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল উদ্যাগগুলো দৃঢ় ও অবিচল থাকা দরকার।

বাংলা নিয়ে বিজেপির আলাদা বিশেষ নিশানা আছে, পরিকল্পনা আছে। এটা তাদের পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে সম্প্রসারণের পরিকল্পনার অঙ্গ। শঙ্কায় থাকছে জোর নির্বাচনী ধাক্কা অপেক্ষা করছে পশ্চিমাঞ্চল-উত্তরাঞ্চলে, তা সামাল দিতে তাই তারা মরীয়া, সেই ক্ষতে প্রলেপ দিতে বিশেষত ঝাঁপাচ্ছে বাংলায়। তাদের রসদ মূলত হিন্দুত্বের এজেন্ডা, তাছাড়া বাংলায় ফুলে-ফেঁপে উঠতে তৃণমূল শাসনে গণঅসন্তোষকে আত্মসাৎ করে চলছে, শক্তি বাড়াতে পারছে পূর্বতন ক্ষমতাসীন বামেদের প্রতি হতাশা ও ক্ষোভ থেকেও।

এখানে ওরা অনেক ছক কষছে, ছল করছে, আবার আতান্তরেও পড়ছে। ওদের স্বরূপগুলো খুল্লামখুল্লা করে দিতে, মোক্ষম প্রত্যাঘাত হানতে আওয়াজ উঠুক পথে নামো, তৈরি হও!

বিজেপি-র বিদ্বেষ-বিভাজনের মেরুকরণের সংঘ সংস্কৃতি আছে, কিন্তু গণসংস্কৃতির বঙ্গসংস্কৃতিতে কোনো শেকড়বাকড় নেই। এনআরসি-র অপারেশান চালানো আর হিন্দু পক্ষপাতদুষ্ঠ নয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে যেমন ভয়াতঙ্ক সৃষ্টির বিষবায়ু ছড়াচ্ছে, তেমনি বিজেপি বোধহয় আত্মজিজ্ঞাসার মধ্যেও থাকছে এই ভেবে যে, বাংলার মাটিতে তাদের মেরুকরণের রাজনীতি কতটা ফলপ্রসূ হবে? যে চিন্তাটা তাদের ধরা পড়ছে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ভোট পাওয়ার প্রশ্নটা ভাবা প্রসঙ্গে, যা না পেলে তাদের পক্ষে এখানে কাঙ্খিত ফল লাভ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। কারণ এরাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট শতাংশের বৈশিষ্ট্য একটা বড় তফাৎ করে দেয়। এই মাথাব্যথার কারণেই বিজেপি তলে তলে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এনআরসি এবং হিন্দু সর্বস্ব নাগরিকত্ব প্রদানের বিল নিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেদের মন ভুলাতে। স্তোকবাক্য শোনাচ্ছে, পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে অনুপ্রবেশকারী ছাড়া দেশবাসী মুসলিমদের কোনো ভয় নেই। কিন্তু অসংখ্য ঘটনাবলীর নজীরে প্রমাণ মিলছে কিভাবে দেশের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে সন্ত্রস্ত করে রাখতে ‘মিনি পাকিস্তান’-‘বাংলাদেশ’ তকমা দিয়ে দেওয়া হয়, বশ্যতা না মানলে ‘অনুপ্রবেশকারী’, ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে দেগে দেওয়া হয়; এছাড়াও ‘লাভ জেহাদের’ নামে, গো-মাংস ভক্ষণ ও গরু পাচার ইত্যাদি অজুহাতে চালানো হয় অকথ্য উৎপীড়ন। আবার ফ্যাসিবাদী জিগির তোলা হচ্ছে আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগেই রামমন্দির নির্মাণে নেমে পড়ার নামে। ইতিমধ্যে তিন হাজার কোটি টাকার মূল্যে নির্মাণ করা হয়ে গেছে গুজরাটে নর্মদার বুকে প্যাটেলের বিশালাকার মুর্তি তথা বিজেপি-আর এস এস-এর মূর্তিমান এক প্রতীক, যিনি গান্ধী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত আরএসএস-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হলেও কংগ্রেস সরকারের মধ্যে আরএসএস-এরই প্রতিনিধি তথা উপনিবেশ-উত্তর ভারতের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষতার গন্তব্যের বিপ্রতীপে হিন্দুত্বের রাজনীতির নাড়া বাঁধার অন্যতম এক উৎসমুখ হিসেবে ছিলেন।

২০১৪-য় দিল্লী দখলের পর থেকে বিজেপির ডজন ডজন নেতারা বাংলায় আসা-যাওয়ায় আছেন, মোদীও এসেছেন কয়েকবার, অমিত শাহ্ও হাফ ডজন সফরের রাজনীতি সেরে গেছেন। মোদীর ‘অচ্ছে দিন’ নিয়ে আসার প্রচার যত মাঠে মারা গেছে ততই বিজেপি নেতারা ধারণ করেছেন স্বমুর্তি। বুথস্তরে লেঠেল বাহিনী তৈরী করা, ডান্ডা ধরা, পরিবেশকে বিদ্বেষ- বিভাজনে বিষিয়ে দেওয়া, সাম্প্রদায়িক হামলার মহড়া দেওয়ার মারণ খেলায় মেতেছে বিজেপি। ইতিমধ্যে দলের যুব মোর্চাকে দিয়ে একদফা চালিয়েছে ‘সংকল্প অভিযান’। সামনে একমাসের ব্যবধানে নিয়েছে বাংলার বিভিন্ন অংশ থেকে রথযাত্রার কর্মসূচী। চলবে উন্মাদনা সৃষ্টির, অরাজকতা সৃষ্টির বেপরোয়া চেষ্টা। কিন্তু এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের শক্তিকে। একমাত্র এভাবেই ঐ ফ্যাসিবাদী শক্তিকে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের শক্তিগুলোই অতুলনীয় অসীম শক্তিধর, বাংলার মাটি গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য লড়াইয়ের কত দূর্জয় ঘাঁটি !!

খণ্ড-25
সংখ্যা-33