পুস্তক সমীক্ষা : ‘অশান্ত কাশ্মীর উপত্যকা’–ফিনিক্স

‘বুট-বুলেটের অন্তরালে’ বিভীষিকা জাকারিয়া পলাশের ‘কাশ্মীরঃ ইতিহাস ও রাজনীতি’ বইয়ের সমালোচনার (শরিফুল ইসলাম পলাশ-এর লেখা) শিরোনাম থেকে নেওয়া এই পুস্তক সমীক্ষার নাম দেওয়া এক অর্থে ফাঁকিবাজি, কবুল করছি। কিন্তু বইটি (নিত্যানন্দ ঘোষ—‘অশান্ত কাশ্মীর উপত্যকা’) পড়তে পড়তে এমনই মনে হচ্ছিল। অধুনালুপ্ত ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্ট-এর (আইপিএফ) ১৯৯০ সালে এক সরেজমিনে তদন্তের ভিত্তিতেই প্রধানত এই ১৭৭-পৃষ্ঠার বইটি লেখা। সেই প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য লেখক স্বয়ং।এতে আইপিএফ-এর ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত লেখা ও সংকলিত-‘অসির চেয়ে মসীযুদ্ধ শক্তিশালী’ (বানান মূল লেখার)। অবশ্য এ নয় যে লেখক একবারই কাশ্মীর উপত্যকায় গেছেন। দ্বিতীয় সফরের কথাও লিখেছেন। সেটা ২০১২ সালে। লেখক আইপিএফ-এর পক্ষে জোরদার সওয়াল করেছেন এবং দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, কাশ্মীর সমস্যা অনুসন্ধান ও সমীক্ষায় আইপিএফ একাধিক দিক থেকে অগ্রণী ও পথিকৃৎ। এ নিয়ে প্রশ্ন করা বা বিতর্ক উত্থাপন পুস্তক-সমীক্ষকের কাজ নয়। এ ব্যাপারে বেনেডিক্ট ক্রোচের পরামর্শ এই সমীক্ষকের কাছে মান্য। পুস্তক সমীক্ষার উদ্দেশ্য প্রধানত পাঠকের কাছে আলোচ্য পুস্তকের পরিচিতি, খুঁত ধরায় মনোনিবেশ করে বা নানা প্রশ্ন তুলে পাঠককে বিভ্রান্ত করা নয়।

আজ তো কাশ্মীর মানেই নৃশংসভাবে গণতান্ত্রিক অধিকার দমন, মত প্রকাশের মুক্ত বাতাস দূষিতকরণ। এভাবেই আমাদের চোখের সামনে প্রাকৃতিক নিসর্গ এক অতিকায় বিভীষিকার তিমিরে আচ্ছন্ন, যার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুললেই তা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে গণ্য হচ্ছে। একদা ভূস্বর্গ আজ পরিহাস, তুষারশুভ্র ভূস্বর্গ জুড়ে কালো রক্তের দাগ। কাশ্মীর নিয়ে এই সমীক্ষায় একথাই স্ফুট হয়েছে। অবশ্য এই ধারণা নিত্যানন্দ বা আইপিএফ-এর একার নয়। মধ্য-১৯৮০ থেকে যারা কাশ্মীর উপত্যকায় বার বার যেতেন, ফিরে এসে সেই ধারণা ঠারে-ঠুরে লিখেছেন ( কারণ তখন একথা বলতে ভয় পেতেন)। কিন্তু অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক রিপোর্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বারবার উল্লেখিত হ’ত।

কিভাবে বুট-বুলেটের অতিকায় দৌরাত্ম্যে ভূস্বর্গ ভূ-দোজখে পরিণত হচ্ছে, তার নজির বইটির সর্বত্র। বারোটি অধ্যায় সমন্বিত বইটিতে। আজ থেকে ২৮ বছর আগে শ্রীনগরে পা দেবার আগেই ঠাহর করেছেন “... মিনিটে মিনিটে দেখা গেছে মেশিন গান, স্টেন গান ও অটোমেটিক রাইফেলে সজ্জিত মিলিটারি কনভয়। তামিল (নাকি মাদ্রাজ?), গোর্খা, শিখ রেজিমেন্ট। সময় বিশেষে সীমান্ত রক্ষীবাহিনী। পুরো রাস্তাটাই মিলিটারির কব্জায়। কোথাও কোনও স্বাভাবিক জীবনের চিহ্নমাত্র নেই।” কাকে বলে ‘অকুপেশ্যন আর্মি’ (এই তকমা সমীক্ষকের, লেখকের নয়। তিনি হয়ত সতর্কভাবেই লেখেননি। কিন্তু সেটাই বইতে ফুটে উঠেছে)। ছররা বন্দুকের যথেচ্ছ ব্যবহার (কিছু কিছু প্রাক্তন ফৌজি বড় কর্তাও যার প্রতিবাদ করেছেন), অসামরিক কাশ্মীরিদের সামরিক জিপে বেঁধে নিয়ে যাওয়া অর্থাৎ সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সম্মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, এগুলি লেখক একাধিকবার উল্লেখ করেছেন।

কিছু কিছু টুকরো টুকরো কথা ১৯৯০ সালে সমীক্ষাতেই বলা হয়েছিল, কিন্তু পুস্তকাকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে কি না জানা নেই। যেমন বিএসএফ-এর এক সদ্য তরুণ হাবিলদার জানিয়েছিলেন, তাঁর উপর নির্দেশ ছিল প্রতিদিন একজনকে মেরে ঝিলমের জলে ভাসিয়ে দেওয়া (যে স্রোতস্বিনী ‘ঝিলিমিলি’ ঝিলম নদীকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘খাপে ঢাকা বাঁকা তলোয়ার’)। এই আদেশ ওপর থেকে এসেছিল, নাকি কোনো ‘সাদিস্ট’ ফৌজি অফিসারের মস্তিস্কপ্রসূত কি না, জানি না।

যারা বিদেশ নীতি ও যুদ্ধবিরোধী ভূমিকার জন্য ভারতকে পাশে চায়, তারাও ভারতের কাশ্মীর নীতির ঘোর সমালোচক।কারণ শ্রীনগর ও লাদাখ অঞ্চলে ভারত সরকারের ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন আর এখন তা অন্য এলাকাতেও প্রসারিত হয়েছে যা ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত। কাশ্মীরিরা নিজেদের স্বতন্ত্র জাতি মনে করে তাদের বিশ্বাস কাশ্মীর তাদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি। অখন্ড কাশ্মীরের ৬০ ভাগ ভারতের ও ৩০ ভাগ পাকিস্তানের, আর বাকি ১০ ভাগ চীনের, এই সত্য অনস্বীকার্য ।

এই বইয়ের সবচেয়ে উল্লেখ্য ১১২-পৃষ্ঠার পরিশিষ্ট, বিশেষ করে ‘১৯৯০-৯৪ সময়কালে জম্মু-কাশ্মীরে হেফাজতে মৃতদের তালিকা, যাদের সংখ্যা ৪২৩। তার সাথে আছে সেই হতভাগ্যদের নাম-ধাম-ঠিকানা ও কিভাবে তাদের নিধন করা হয়েছে। তথ্যসূত্রও দেওয়া হয়েছে। তবে এই তালিকাই নিহতদের পূর্ণ তালিকা নয়। যারা রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দিষ্ট, যাদের গুম করে দেওয়া হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ১৯৯০ দশক থেকে রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দিস্ট মানুষের তালিকা ভারত সরকারকে বার বার দিয়েছে। ভারত সরকার উত্তর দেয়নি, এড়িয়ে গেছে।

লেখক ও তাঁর সহযাত্রীরা যাদের সঙ্গে দেখা করেছেন,কথা বলেছেন, সেই ভিত্তিতে বলেছেন, ‘কাশ্মীরিদের কেউই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে থাকার কথা বলেননি।‘ তার মানে কাশ্মীরিরা পাকিস্তানে যোগ দিতে চায় না। এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। জাকারিয়া পলাশ লিখেছেন, “কাশ্মীরের অধিকাংশ তরুণ ক্রিকেটে পাকিস্তানের পরে বাংলাদেশকে সমর্থন করে।’ অনেকে বাংলাদেশ-কাশ্মীরের তুলনা করে বলে, ‘তোমরা লড়েছ পাকিস্তানি ফৌজের বিরুদ্ধে ভারতের সাহায্যে। আমরা লড়ছি ভারতীয় ফৌজের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সাহায্যে। শত্রু-মিত্র বদলে গেছে। স্বাধীনতার মর্ম আমাদের একই।’ পলাশ সমীক্ষা করেছেন দক্ষিণ এশিয়া ফাউন্ডেশনের (সাফ) বৃত্তি নিয়ে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্র হিসেবে। তিনি নৃকুলবিদ্যার দিকে জোর দিয়েছেন, রাজনৈতিক নয়। তাঁর সমীক্ষায় কোনো রকম রাজনৈতিক পক্ষপাত আছে তা বলা যাবে না। পাকিস্তানে যাবে, না স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হতে চায়, না ভারতেই থেকে যেতে চায়, তা গণভোট হলেই জানা যাবে। তবে কাশ্মীরে (অর্থাৎ ভারত-এর অধীন অংশে)-র কাশ্মীরিরা পাকিস্তানকে শত্রু মনে করে, তা মনে হয় না। ভারতের বাইরে মানবাধিকার আন্দোলনে শামিল মানুষদের একটা বড় অংশ ১৯৪৭ সালে পার্লামেন্টে ভারতের প্রথম প্রধান মন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর দেওয়া বিবৃতির সুরেই মনে করে, কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে কাশ্মীরের জনগণ।

শেষে একটা কথা না বলে পারছি না। লেখকের ইংরেজী শব্দ ব্যবহারের অত্যধিক প্রবণতা (বহু-ব্যবহৃত বাংলা শব্দের চল সত্বেও) দৃষ্টিকটূ।

নিত্যানন্দ ঘোষ- ‘অশান্ত কাশ্মীর উপত্যকা’–ফিনিক্স, বিনিময় মূল্য-২০০ টাকা
খণ্ড-25
সংখ্যা-35