প্রতিবেদন
কাশ্মীরে নির্বাচনের প্রহসন এবং তারপর সংঘটিত গণহত্যা

ভারত সম্প্রতি কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর রিপোর্টকে মিথ্যা বলে খারিজ করে দিয়েছে। কিন্তু কাশ্মীরে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় সংস্থাগুলির নির্বাচন এবং নিরস্ত্র নাগরিকদের গণহত্যা মোদী সরকার এবং বিজেপির মিথ্যাচারকে আরো একবার প্রকট করে তুলল।

বিজেপির দাবি, তারা জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হয়েছে—কিন্তু আসল সত্যিটা হল তারা জম্মু ও লাদাখে জমি হারিয়েছে এবং কাশ্মীরে তাদের ‘বিজয়’ সেই পরিস্থিতিতেই এসেছে যখন স্থানীয় দুই প্রধান দল এনসি এবং পিডিপি সংবিধানের ৩৫এ ধারা সম্পর্কে মোদী সরকারের নেওয়া অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নির্বাচন বয়কট করেছে।

মাত্র ৪ শতাংশ ভোটার তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন—যে হার ১৯৫১-এর পর থেকে সবচেয়ে কম এবং ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে উপত্যকায় জঙ্গিয়ানার চরম প্রকাশের প্রেক্ষাপটে ৫.১৮ শতাংশের চেয়েও খারাপ। উপত্যকায় ভোটের হার ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে কম হওয়ার কৃতিত্ব অবশ্যই মোদী সরকার দাবি করতে পারেন। উপত্যকায় পুরসভার ৬২৪টি আসনের মধ্যে ভোট হয় ২০৮টি আসনে, বাকি আসনগুলিতে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি—সেগুলিতে হয় মাত্র একজন প্রার্থী ছিল, নয়ত কোনো প্রার্থীই ছিল না! আর কোনো প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করায় ১৮৫টি ওয়ার্ড প্রতিনিধি শূন্য রয়েছে।

বিজেপির শক্তিশালী জায়গা বলে কথিত জম্ শহরের তিনটি বিধানসভা ক্ষেত্রে—গান্ধি নগর, জম্ (পূর্ব) এবং জম্মু (পশ্চিম)—বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার একেবারে ৫১ শতাংশ কমেছে। সাম্বা, কাঠুয়া, উধমপুর, ডোডা, রাজৌরি, কালাকোট এবং রিয়ানি সহ অন্যান্য অনেক জেলাতেও বিজেপির ভোটের হার কমেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, মাত্র কয়েক মাস আগে কাঠুয়ার ধর্ষণ ও হত্যায় অভিযুক্তদরের সমর্থনের নামে বিজেপি জম্মুতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টা চালিয়েছিল। এখন মনে হচ্ছ, এই মেরুকরণও জম্মু্তে বিজেপিকে বাঁচাতে পারেনি।

তাদের হাতে যে সংসদীয় আসনটি রয়েছে, সেই লাদাখও বিজেপির হাতছাড়া হয়েছে। সেখানে লে পুরসভা কমিটির ১৩টি ওয়ার্ডেই কংগ্রেস বিজয়ী হয়েছে, আর কার্গিলে কংগ্রেস জয়ী হয়েছে ৫টি ওয়ার্ডে, সেখানে নির্দলীয়রা জয়ী হয়েছে ৮টি ওয়ার্ডে।

এরপর গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে যৌথ প্রতিরোধ নেতৃত্বের আহ্বানে কাশ্মীর চলে যায় বন‌ধের কবলে। ঐ গণহত্যায় নিহত হন সাতজন নিরস্ত্র নাগরিক এবং আহত হন ২৫ জন, যাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। জঙ্গী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে গুলির লড়াইয়ের ফলে একটি বাড়িতে আগুন লেগে যাওয়ায় নাগরিকরা যখন আগুন নেবানোর চেষ্টা করছিলেন, তখনই ঐ গণহত্যা ঘটে। ঐ স্থানকে বিস্ফোরক মুক্ত না করেই সেনারা ঐ স্থল ছেড়ে চলে যায়—যার ফলে বিস্ফোরকগুলি বিস্ফোরিত হলে নাগরিকরা নিহত ও পঙ্গু হন। অনেক আহত নাগরিকের দেহে বুলেট ও ছররার আঘাত চিহ্ন দেখা যায়, যা সেনাদের স্বেচ্ছাকৃতভাবে গুলি চালনার সাক্ষ্যই বহন করে।

কয়েক মাস আগে নিহত সুজাত বুখারি বলেছিলেন, কাশ্মীরে সুপরিকল্পিত সেনা অভিযানগুলির ক্ষেত্রে ‘সংঘর্ষ’ শব্দটি একেবারেই খাটে না, কেননা ঐ অভিযানগুলির অনিবার্য লক্ষ্য হল নিরস্ত্র নাগরিকরা। ‘সংঘর্ষে’ নাগরিক হত্যার এরকমই এক ঘটনা সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন, “এই নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখিয়ে দেয় জঙ্গী এবং নাগরিক জনগণ কি জটিল সম্পর্কেই না যুক্ত। ... এটা একটা বড় আকারের যুদ্ধ যেখানে নিরস্ত্র নাগরিকরাও সেনাদের মোকাবিলায় রত।’’ তিনি আরো বলেছিলেন, “প্রায় প্রত্যেকটা অভিযানই এমন একটা ধারায় চলে যেটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, তল্লাশি কার্যকলাপ এবং আরক্ষাবেষ্ঠনী তৈরি থেকে গুলি চালনা শুরু এবং নাগরিকদের প্রতিবাদ, পুড়ে যাওয়া বাড়ি ও দেহ থেকে ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণে অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া সমূহ।’’

বুখারি এই কথাগুলি দিয়ে তাঁর লেখা শেষ করেছিলেন, “এটাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসাবে স্বীকার করা এবং সংশ্লিষ্ঠ সমস্ত পক্ষের সঙ্গে নিঃশর্তে আলোচনা চালানোই হল সমাধানের একমাত্র পথ। সমাধানের প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানও গুরুত্বপূর্ণ। জঙ্গীদের হত্যার জন্য বিরাট মূল্য দিতে হয়েছে। সেনারা জঙ্গীদের হত্যা করতে পারে, কিন্তু জঙ্গীপনার পিছনে যে চিন্তাধারা কাজ করছে সেটাকে ওরা নিঃশেষ করতে পারবে না। গত ২৭ বছর বারবারই এটাকে দেখিয়ে দিয়েছে।’’

কিন্তু কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের কোন আগ্রহই মোদী সরকারের নেই। ওরা খুব ভালোভাবেই জানে যে, প্রত্যেকটা হত্যাই কাশ্মীরী জনগণের ক্রোধ ও নৈরাশ্যে ঘৃতাহুতি দেয়। কিন্তু হত্যাকাণ্ডকে অব্যাহত রাখতে ও তীব্রতর করে তুলতে ওরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ওরা আশা করে, এই পথে ওরা কাশ্মীরী জনগণের বিরুদ্ধে ঘৃণাকে উস্কিয়ে তুলে আসন্ন বিধানসভা ও সংসদীয় নির্বাচনে ভোট কুড়োতে পারবে।

খণ্ড-25
সংখ্যা-33