ইসলামপুরের ক্রমশ প্রকাশ্যে আসা ঘটনাবলী অবশ্যই ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত দিচ্ছে। উপলক্ষটা মারাত্মক। সংকেত দিচ্ছে পরিণাম গড়াতে পারে আরও ভীষণ বিপজ্জনক দিকে। শাসকশ্রেণীর দুটি দল বাংলাকে নজীরবিহীন এক নয়া ভাগাভাগির ধ্বংসাত্মক রাজনীতিতে বিভক্ত-বিধ্বস্ত করতে উন্মত্ত। দক্ষিণপন্থার দ্বিমেরুকরণের সংঘাতের আবর্তের সম্মুখীন এখানে এর আগে কখনও এমনভাবে হতে হয় নি।
একটি দল 'বামমুক্ত' বাংলা গড়ে তোলার গর্জন শুনিয়ে উপর্যুপরি ক্ষমতাসীন, অথচ ক্ষমতায় আসার রাস্তা সাফ করতে ব্যবহার করেছিল তথাকথিত অনেক 'বাম' হাবভাব, ক্ষমতায় জাঁকিয়ে বসা পাকা হতেই লোকদেখানো মা-মাটিপনার আবরণ খসিয়ে ধারণ করেছে স্বমূর্তি, 'উত্তরণ' ঘটিয়েছে স্বৈরাচারে, এখন উপরন্তু খোয়াব দেখছে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় ৪২-এ ৪২ পেয়ে যদি দিল্লীর রাজনীতিতে দর তোলার শর্ত পাকানো যায়।
অন্য দলটি 'কংগ্রস মুক্ত' ভারত গড়ে তোলার তথা 'অচ্ছে দিন' নিয়ে আসার প্রতারণা চালিয়ে চালাচ্ছে কেন্দ্রের মসনদ, কাজ করছে হিন্দুভারত-কর্পোরট পুঁজির ভারত বানানোর স্বার্থে, যতদিন গেছে তত তার মুখোশ খসে বেরিয়ে পড়েছে, নিজের 'উত্তরণ' ঘটিয়েছে ফ্যাসিবাদে এখন বাংলায় বিরোধী রাজনীতি থেকে ফ্যাসিস্ত ফায়দা তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে লাগাতার। ইসলামপুরের মাটি এই দুই ধ্বংসাত্মক সংঘর্ষের রাজনীতিতে রক্তাক্ত হচ্ছে, খোরাক হচ্ছে। যেখানে একদিকে উন্মোচিত হচ্ছে শাসক তৃণমূলের শিক্ষক নিয়োগ জড়িত দুর্নীতি আর গুলি চালিয়ে ছাত্র হত্যার চেহারার, পুলিশ লেলিয়ে এলাকা সন্ত্রস্ত করার রাষ্ট্রনীতি-রাজনীতি; তেমনি তার বিপ্রতীপে উদ্ঘাটিত হচ্ছে বিজেপির 'বাংলাকে উর্দুস্তান হতে দেব না' মার্কা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতিতে বিষিয়ে তোলার সুপরিকল্পিত শয়তানী, যার মধ্যে রয়েছে 'কাশ্মীরকে পাকিস্তান হতে দেব না' মার্কা সাম্প্রদায়িক উগ্রজাতিয়তাবাদী জিগিরের বঙ্গসংস্করণ; হিন্দুত্বের আধারে বাঙালী জাত্যাভিমানকে উস্কে দেওয়ার মিশেল মিসাইল।
ইসলামপুরে পরিস্থিতি আগুন হয়ে ওঠার উৎসে রয়েছে শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের দুর্নীতি-দলতন্ত্র-গোষ্ঠী সংঘাত, যার বিরুদ্ধে অসন্তোষকে কাজে লাগাতে বিজেপি কষেছে সাম্প্রদায়িক ছক এবং আগুন যা লাগানোর লাগিয়ে দিয়েছে। তৃণমূলের দুর্নীতি গণরোষের ইস্যু হওয়া এই নতুন নয়। সারদা কেলেঙ্কারি থেকে সিন্ডিকেট রাজ, ছাত্র ভর্তি, শিক্ষক নিয়োগ, স্কুল-কলেজ-সরকারি চাকরিতে বদলি, পঞ্চায়েত-পৌরসভায় দুর্নীতিতে তৃণমূল ছেয়ে গেছে। তার প্রতি অসন্তোষ কোথাও ধূমায়িত হচ্ছে, কোথাও ফেটে পড়ছে। আর, বিজেপি তা পুঁজি করতে মুখিয়ে। সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী বিজেপি কেলেঙ্কারি-দুর্নীতিতে আরও বড় ডাকাত দল। তাদের ওঠাবসা ব্যাঙ্ক লুটেরা ব্যবসায়ী ও ফাটকা পুঁজির কারবারিদের সাথে, বিজেপি জড়িয়েছে কফিন থেকে কয়লা খনি কেলেঙ্কারিতে, এখন জেরবার হচ্ছে যুদ্ধবিমান কেনা সংক্রান্ত বৃহত্তম রাফাল কেলেঙ্কারিতে, একটা মিথ্যা অজস্র মিথ্যার আশ্রয় নিতে হচ্ছে।
বাংলার এই দুর্যোগের পরিস্থিতিতে বামেরা রাস্তায়, মাঠে, ময়দানে নামছেন বটে; কিন্তু পরিস্থিতিকে বামপন্থার অনুকূলে ঘোরাতে প্রথমত, গণউদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে; সর্বোপরি, দৃষ্টান্ত স্থাপনের মতো কার্যকরি কর্মসূচী নিতে হবে, তা সে গণপ্রচার ও আন্দোলন যাইই হোক, যাতে জনমানসে ছাপ ফেলা যায়। পশ্চিমবাংলার নাগরিক সমাজকেও আজকের দুর্বিপাকের পরিস্থিতিকে প্রতিহত করতে সংগঠিত হতে হবে, শুধু পরম্পরা থেকে নয়, আজকের অবস্থার অসীম গুরুত্ব বুঝে তার প্রয়োজনে ভূমিকা নিতে এগিয়ে আসতে হবে। এটা গণতন্ত্রের দাবি, প্রগতির দাবি, সংবেদনশীলতার দাবি।