সম্পাদকীয়
বাংলায় ফ্যাসিবাদের মোকাবিলায় বামপন্থীদেরই থাকতে হবে সামনে

বাংলায় বিজেপি বিপদ যে বহুলাংশে বেড়েছে সে আর কারও বুঝতে বাকি নেই। তুলকালাম করা ঘটনা ঘটল যে দাড়িভিটে সেখানেও তৃণমূলের সাথে সংঘাতে নাম জড়িয়েছে বিজেপির। কতটা জড়িয়েছে সেই সত্যাসত্য এখনও পুরো সামনে আসেনি। তবে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে বিজেপির রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতারা দাড়িভিটে গেছেন, পরিবেশকে বিষিয়ে তোলার পরিদর্শন সেরেছেন, সভা করেছেন।

বাংলায় বহুদিন যাবত আর এস এস-এর লেঠেল বাহিনীর কুচকাওয়াজ হয় বেশ নিয়ম করেই, তবে সেটা এতদিন দেখা যেত মাঠে বা পার্কের ভেতরে, এবার কোনো এক সঙ্ঘগুরুর জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নেমে এল রাস্তায়, অর্থাৎ সঙ্ঘ শক্তি তার দু:সাহস দেখানোয় আরও বাড়তে শুরু করেছে। গেরুয়া দলের নেতারা হামেশা প্রচ্ছন্ন হুমকি দিচ্ছেন ‘অসম’, ‘ত্রিপুরা’র পর বাংলার দখল নেবেন। বিজেপি শাসিত অন্যান্য রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-বিভাজন-আক্রমণ-নির্যাতনের বিভৎস ঘটনাগুলো ঘটেই চলেছে। উত্তরপ্রদেশে এক হিন্দু মেয়ের উপর চড়াও হল হিন্দুত্বের ‘নৈতিক পুলিশী’ ফলানোর হামলাবাজরা। তার মুসলিম প্রেমিকের হাতে রাখী পরাতে জবরদস্তি বাধ্য করাতে। ঘটনাস্থলে এসে পড়া পুলিশ সব দেখেও থাকল নির্বিকার। মেয়েটি থানায় গেলে পুলিশ অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে, উল্টে চাপ সৃষ্টি করে মুসলিম ছেলেটির বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফুঁসলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ দায়ের করাতে। মেয়েটি রুখে দাঁড়ালে পুলিশ বাধ্য হয় মেয়েটির অভিযোগ নথিভুক্ত করতে। লক্ষ্যণীয় গুজরাট ঘটনা ও প্রবণতা। এক ধর্ষণের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নির্বিচারে আক্রমণ সংঘটিত হল বিহার ও উত্তরপ্রদেশ থেকে গুজরাটে পরিযায়ী মেহনতীদের ওপর। হাজারে হাজারে তাদের গুজরাট ছাড়া করা হল, যা এক ধরনের সংগঠিত জাতি-দাঙ্গা, ভাষিক দাঙ্গার রূপ নিল। গুজরাট, উত্তরপ্রদেশে চলছে বিজেপি রাজ, বিহারেও চলছে নীতীশ কুমারের সাথে বিজেপি-র আঁতাতের রাজত্ব; এক রাজ্যে দুই রাজ্যের ভিন্ জাতি ভিন্ ভাষী গরিব মেহনতীরা মার খাচ্ছেন, তাড়া খাচ্ছেন, একই দলের শাসন থাকা সত্ত্বেও শাসকদের বিশেষ হেলদোল নেই। এইসব ঘটনা ও প্রবণতায় বিজেপি ও সঙ্ঘশক্তি এতটুকু লজ্জ্বিত নয়, রক্ষণাত্বক নয়।

আরএসএস-বিজেপি আবার রাম মন্দির রাজনীতির ইস্যু তুলছে।

খুব পরিষ্কার যে, বাংলা নিয়ে বিজেপির বড় গেমপ্ল্যান রয়েছে। বলছে, এখানেও ‘বিদেশী হটাও’ অর্থাৎ মুসলমান তাড়াও অভিযান দরকার, তার জন্য নাগরিক তথ্যপঞ্জীকরণ শুরু করা প্রয়োজন। প্রচার করছে মোদী সরকারের নাগরিকত্ব প্রদানের (২০১৬) সংশোধনী বিল প্রসঙ্গে, যা কেবলমাত্র বহিরাগত হিন্দুদের প্রথমত শরণার্থী হিসেবে ঠাঁই দেবে, পরবর্তীতে নাগরিকত্ব দেবে, কিন্তু মুসলিমদের ঢুকতে দেবে না। এই বিলটি মোদী সরকার এনেছে ইজরায়েলী মডেল অনুসরণ করে। ইজরায়েল সারা পৃথিবী থেকে কেবলমাত্র ইহুদিদের জন্য প্রশ্নাতীতভাবে ইজরায়েলের নাগরিকত্ব পাওয়ার দরজা খুলে রেখেছে। বিজেপি ধমকি দিতে বলছে, ত্রিপুরায় বামেদের জায়গায় বিজেপি এসে গেছে, বাংলায়ও আসবে, তৃণমূলের শাসনকাল এক অন্তর্বর্তীকালীন অধ্যায় মাত্র। এই উদ্দেশ্যে উল্লম্ফন ঘটাতে বড় আকারে নিশানায় রাখছে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনকে। তার জন্য নতুন নতুন সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ত ঘোট পাকনোয় যে মরীয়া হবে তা সহজেই অনুমেয়। দিন গোনার ব্যাপারে বিজেপির তর সইছে না। ১৯৪৭ পরবর্তী বাংলার হিন্দুপ্রধান সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনের ইতিহাসে হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িকতা-বিদ্বেষ-বিভাজনের প্রবাহ বরাবর এক ধরনের সুপ্ত বা আপাত ফল্গুধারার মতো থেকে গেছে। তাছাড়া বঙ্কিমচন্দ্র, শ্যামাপ্রসাদ ইত্যাদিদের দৌলতে হিন্দুত্বের ভাবধারাগত শেকড়-বাকড় রয়ে গেছে। বর্তমানে দেশজোড়া সবচেয়ে সুবিধাজনক সময় সমাগত মনে করেই বিজেপি বাকি সারা দেশাংশের মতো বাংলায়ও নতুন করে আগ্রাসী হতে চাইছে, তার জন্য হিন্দুত্বের উন্মাদনা মাখানো বাঙালি জাত্যাভিমানকে চাগাতে চাইছে ।

অন্যদিকে, মুখে বিজেপি-কে ফিনিশ করার ফোঁসফোঁসানি করে চললেও বিজেপি-র পল্লবায়ন ত্বরান্বিত হওয়ার পক্ষে পরোক্ষে খাল কাটছে তৃণমূলের বিভিন্ন জনস্বার্থ বিরোধী স্বৈরাচারি অবস্থান ও আচরণ। তৃণমূলের কেন্দ্র বিরোধী, বিজেপি-র ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্যগুলির বিরুদ্ধে কোনো সুস্পষ্ট কর্মসূচী নেই ; আরএসএস বিরোধী ভাবধারার, আদর্শের লড়াইয়ের কর্মসূচী নেই, বরং তৃণমূল কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের ডাকা হরতাল-ধর্মঘট-আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, দমনের পদক্ষেপ করে। তবু তৃণমূল বিজেপি-র বিরোধী হিসেবে নিজেকে চ্যাম্পিয়ন দেখাতে চায়। তার বিজেপি বিরোধী দৌড় কেবল বাংলায় শাসনক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে, বাংলার সংসদীয় আসন চরিতার্থ করতে। এই উদ্দেশ্য পূরণের পথে তৃণমূল বাংলায় অনেক দুর্বল হয়ে যাওয়া কংগ্রসকে নিজের পেছনে লেজুড় করে রাখার চাপে রেখেছে। এবার নাকি সিপিএম বাদে ছোট বাম দলগুলোকে তার পরবর্তী ব্রিগেড সমাবেশে অংশ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানাবে! সে তৃণমূল যা করে করুক।

বামপন্থী দলগুলোকে, বামপন্থী শক্তিগুলোকে নিজেদের শক্তিকে শক্তিশালী করা ও বিস্তৃত করার ব্যাপারেই সমস্ত শক্তি উজার করে ঝাঁপাতে হবে। বামপন্থী দলগুলো এককভাবে, একসাথে সম্মেলন-সংগ্রাম-সমাবেশ করছে, বিপিএমও-র অধিকার যাত্রা হল বাংলার উত্তর থেকে দক্ষিণে, ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশনগুলোর কনভেনশন হল আসন্ন দেশব্যাপী ধর্মঘটকে সফল করে তুলতে, তবু এসবই যথেষ্ট নয়। কতগুলো কর্মসূচী নেওয়া হল কেবল তার সংখ্যাগত অর্থে শক্তির মূল্যায়ন করে লাভ নেই, অথবা কত সাজানো গোছানো হচ্ছে কেবল তা দিয়ে শক্তি মাপার কোনো মানে হয় না। বরং যাচাই করে চলা দরকার বাম মতাদর্শ ও চেতনার দিক থেকে কত ব্যাপক জনসংযোগ করা হচ্ছে, জনগণকে কতটা আকর্ষণ সৃষ্টি করানো যাচ্ছে, আন্দোলনে কতটা নামাতে পারা যাচ্ছে। বামেদের এজেন্ডাকে সামনে আনা, বামেদের হস্তক্ষেপকে তেজী করা, বামেদের প্রতি জনগণের আস্থা-আশা-ভরসা-ভালোবাসা বাড়িয়ে তোলা—হাটে মাঠে ঘাটে বাম শক্তিসমূহকে চর্চার বিষয় করে তোলা, এগুলোই মূলত খতিয়ে দেখা দরকার। বামপন্থীদের এই চ্যালেঞ্জ নিয়েই এগোতে হবে।

খণ্ড-25
সংখ্যা-32