(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮)
থুতুকুড়ি গামী বিমানে বিজেপির তামিলনাড়ু সভাপতি ভামিলিসাই সুন্দররাজনকে লক্ষ্য করে 'ফ্যাসিস্ত বিজেপি' শ্লোগান দিয়েছিলেন কানাডার মন্ট্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ বছর বয়স্ক ছাত্রী লুই সোফিয়া, আর সেই অভিযোগে থুতুকুড়ি বিমান বন্দরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবং তাদের হাতের পুতুল তামিলনাড়ুর বর্তমান সরকার উভয়ে মিলে বেদান্তের স্টারলাইট তামা নিষ্কাসন কারখানার বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত নিরস্ত্র প্রতিবাদকারিদের গণহত্যা সংঘটিত করে। তাঁর দলকে 'ফ্যাসিস্ত' বলায় ক্ষিপ্ত হয়ে বিজেপি সভাপতি যে অভিযোগ দায়ের করেন, তার ভিত্তিতে লুই সোফিয়াকে গ্রেপ্তার করে ১৪ দিনের বিচার বিভাগীয় হেফাজত দেওয়া হয়। সুন্দররাজন দাবি করেন, ঐ শ্লোগানের ফলে তিনি 'নিরাপত্তাহীন' বোধ করতে থাকেন। এই ঘটনা আজকের ভারতের এক প্রতীক হয়েই দেখা দিচ্ছে—যেখানে পুলিশ চালিত গণহত্যা এবং পরিবেশ ধ্বংসকারী প্রকল্প 'নিরাপত্তার প্রতি বিপদ' হয়ে দেখা দেয় না, কিন্তু ফ্যাসিস্তদের চালানো সরকারের বিরোধিতা করলে তাকে অপরাধরূপে গণ্য করে নিরাপত্তার প্রতি বিপদ বলে ছাপ মারা হয়।
সোফিয়ার গ্রেপ্তারি এই ধরনের ঘটনার একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়। পুনের সরকারি আইনজীবী উজ্জ্বলা পাওয়ার আদালতে বলেন, দানবীয় সন্ত্রাস-বিরোধী আইনে পাঁচ মানবাধিকার আইনজীবী ও কর্মীর গ্রেপ্তারি এই কারণে যুক্তিযুক্তি ছিল যে, তারা বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে সংগঠিত 'ফ্যাসি-বিরোধী' ফ্রন্টের অংশ ছিল। এই অভিযোগটা সত্যকে খুলে ধরে। মনে হচ্ছে, সরকারি আইনজীবী স্বীকার করছেন যে মোদী সরকার সুনিশ্চিত ভাবেই ফ্যাসিস্ত, কেননা, 'ফ্যাসি-বিরোধিতাকে' তিনি সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সঙ্গে একাকার করে তুলছেন। যে সকার ফ্যাসিবাদকে অনুমোদন করে, কেবলমাত্র সেই সরকারই 'ফ্যাসি-বিরোধী' কার্যকলাপকে অপরাধ বলে গণ্য করবে এবং তাকে 'সন্ত্রাসবাদ'-এর সঙ্গে এক করে দেখবে।
মোতিহারির মহাত্মা গান্ধি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার গণ পিটুনিতে মত্ত জনতার হাতে আক্রান্ত হন। তাঁর অপরাধ ছিল, তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী সম্পর্কে একটি পোস্ট করেন, যাতে তিনি বাজপেয়ীর প্রয়ানকে ''ফ্যাসিবাদের একটি যুগের অবসান'' বলে বর্ণনা করেন। কোন বিজেপি নেতাকে ফ্যাসিস্ত বলে অভিহিত করাটা আরো একবার ফ্যাসিবাদী লোকজনের দ্বারা ভয়াবহ আক্রমণে পরিণতি লাভ করল। বিজেপির ফ্যাসিস্ত চরিত্রের এর চেয়ে ভালো প্রমান আর কি হতে পারে?
আজ ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, পূর্ণ হল গৌরি লঙ্কেশ হত্যার এক বছর। তদন্তে জানা গেছে, গৌরি লঙ্কেশের হত্যাকারিরা ছিল চরমপন্থী এবং তাদের প্রশিক্ষন দিয়েছে সনাতন সংস্থা। এই সনাতন সংস্থা হত্যাকারি এবং সন্ত্রাসবাদীদের জন্য প্রশিক্ষন শিবির চালায় এবং সংঘের ফ্যাসিস্ত রাজনীতির সমালোচকদের 'হিন্দু-বিরোধী' বলে দেগে দিয়ে হত্যা করতে উৎসাহ জোগায়। এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে, মোদী সরকার একদিকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিরোধ সংগঠিত করলে বা এমনকি মুখে প্রতিবাদের কথা বললেও সেগুলোকে সন্ত্রাসবাদের সমতুল্যরূপে গণ্য করছে, ঐ সরকারই আবার সনাতন সংস্থার মতো সংগঠনগুলোকে সন্ত্রাসবাদী বলতে অস্বীকার করছে।
সনাতন সংস্থা গুপ্তহত্যা সংঘটিত করে, বোমা জড়ো করে এবং প্রকাশ্যেই ভারতীয় সংবিধানকে হটানো এবং 'হিন্দু রাষ্ট্র' অর্জনের কথা বলে সন্ত্রাস ছড়ায়। সনাতন সংস্থার এক প্রতিনিধি সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে খোলাখুলি ঘোষণা করে যে, তাদের সংগঠন ''ভারতীয় সংবিধানের বদল ঘটিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র আনতে চায়।'' এ সত্ত্বেও এই ধরনের সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয় না। এর বিপরিতে দেখা যায়, আজ যিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী সেই নরেন্দ্র মোদী তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর পদাধিকার বলে ২০১৩ সালের জুন মাসে গোয়ায় সনাতন সংস্থা আয়োজিত এক হিন্দু সম্মেলনে একটি চিঠি পাঠান। সেই চিঠিতে তিনি সনাতন সংস্থা এবং ঐ ধরনের সংগঠনগুলিকে 'জাতীয়তাবাদী' বলে বর্ণনা করেন। এটা দেখাচ্ছে যে, সনাতন সংস্থার মতই মোদীও সংঘের স্বপ্নের ফ্যাসিবাদী 'হিন্দু রাষ্ট্র'-কেই স্বীকার করেন—ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধানের উপর ভিত্তি করা বর্তমান ভারতীয় রাষ্ট্রকে তিনি স্বীকৃতি দেন না। সম্ভবত এই কারণেই তাঁর সরকার সনাতন সংস্থার সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না, ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা।
বিজেপি-আরএসএস-এর রাজনৈতিক শাখা। এটা লিখিত সত্য যে, আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতারা ১৯৩০ এবং ১৯৪০-এর দশকে তাঁদের লেখালেখিতে ''হিন্দু রাষ্ট্র'' সম্পর্কে তাঁদের ধারণাকে ফ্যাসিবাদী জার্মানি ও ইতালির আদলে খাড়া করেন। উদাহরনস্বরূপ, আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা গোলওয়ালকার তাঁর আমরা অথবা আমাদের জাতীয়তার সংজ্ঞা নামক বইয়ে নাজিদের দ্বারা ইহুদিদের বহিষ্কারের ঘটনাটির প্রশংসা করেন, সেটাকে তিনি ''জার্মান জাতির অস্মিতা'' বলে বর্ণনা করেন এবং ''হিন্দুস্থানে আমাদের একটা ভালো শিক্ষা এবং সুফল লাভ''-এর বিষয় রূপে স্বাগত জানান। হিন্দু জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক ডি ভি সাভারকার ১৯৪০ সালে হিন্দু মহাসভার ২২তম অধিবেশনে তাঁর সভাপতির ভাষণে ''নাজি অথবা ফ্যাসিবাদী জাদুদণ্ডের স্পর্শের'' প্রশংসা করেন, যা জার্মানি এবং ইতালির রূপান্তর সাধন করেছিল এবং প্রমাণ করেছিল যে, ''ঐ রাজনৈতিক মতবাদগুলি তাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে অপরিহার্য হয়ে ওঠা সবচেয়ে উপকারি টনিক ছিল।'' ফ্যাসিবাদের ঐ ধরনের স্তুতি সংঘ ও বিজেপির কাছে অতীতের কোনো বিষয় নয়। মোদী শাসিত গুজরাটে ২০০৪ সালে হাইস্কুলের পাঠ্য বইগুলিতে উল্লিখিত হয়েছিল যে, হিটলার ''জার্মান সরকারকে মর্যাদা ও মানসম্মান এনে দিয়েছিলেন'', ''জার্মানিকে আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন'' এবং ''সাধারণ জনগণের মধ্যে দু:সাহসিকতার স্পিরিটের সঞ্চার করেছিলেন।''
আজ মোদী সরকার ভারতকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলা এবং ভারতের অর্থনীতির রূপান্তর সাধনে 'জাদু দণ্ড' হওয়ার যে দাবি করছে তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিমুদ্রাকরন করা নোট সমূহের ৯৩ শতাংশই ফিরে এসেছে বলে আরবিআই স্বীকার করায় অর্থনীতিকে কালো টাকা থেকে মুক্ত করার নোট বন্দীর দাবি চূড়ান্ত মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। আজ ভারতে কর্মসংস্থান আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে গেছে, আর তেলের দাম এতোদিনের মধ্যে সবচেয়ে উঁচুতে উঠেছে। টাকার দামে ধস নেমেছে, আর ব্যঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। কৃষি সংকট তীব্রতর হয়ে উঠেছে এবং কৃষকরা সংঘাতের পথে। যে কৃতিত্ব মোদী সরকার নিজের জন্য দাবি করতে পারে তা হল—উচ্ছৃঙ্খল জনতার গণপিটুনি এবং মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী ও সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারি ও হত্যা।
আজকের এই সন্ধিক্ষণে তামিলনাড়ুর ছাত্রীটির তোলা শ্লোগানকে সারা দেশে, গণতন্ত্র নিয়ে ভাবিত ভারতের প্রতিটি নাগরিকের কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হতে হবে। ফ্যাসিবাদী বিজেপি নিপাত যাক। নিপাত যাক!