(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮)
সুপ্রিম কোর্টের রায় সমতা এবং প্রেমের অধিকারকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরল।
সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রায় সমকামিতাকে অপরাধ নয় বলে ঘোষণা করেছে, ৩৭৭ ধারার পরিধিকে সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংকুচিত করে দিয়েছে এবং যৌন পছন্দ ও লিঙ্গ-পরিচিতির বিস্তৃত রামধনু জুড়ে রয়েছেন যে ভারতবাসীরা, তাঁদের সকলের মানবসত্ত্বা ও অধিকারগুলোকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। লক্ষণীয়ভাবে প্রগতিশীল এই রায় শতক শতক ধরে চলে আসা গোঁড়ামি এবং সমকামিতা সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব ও ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে বড় আঘাত হেনেছে এবং উপনিবেশ যুগের আইন ৩৭৭ ধারা থেকে নিষ্কৃতির ব্যবস্থা করেছে।
প্রধান বিচারপতির নিজের লেখা রায়টি শুরু হয়েছে জার্মান লেখক গ্যেটের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে, ''আমি যা আমি তাই, আমি যেমন তেমনভাবেই আমাকে গ্রহণ করতে হবে।'' রায় এই বিষয়টাকে জোরের সাথে ঘোষণা করেছে যে, ''সংখ্যাগুরুর মত এবং লোকপ্রিয় নৈতিকতা সাংবিধানিক বৈধতাকে নির্দেশিত করতে পারে না। আমাদের কুসংস্কারকে পরাস্ত করতে হবে, সর্বজনীনতাকে গ্রহন করতে হবে এবং সম অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে হবে।'' সংখ্যাগুরুবাদী রাজনীতি যখন সাংবিধানিক অধিকারকে দমন করে জনগণের খাদ্য, ধর্মীয় বিশ্বাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, জীবনসঙ্গী, মতামতের পছন্দকে এবং মতপ্রকাশের ধারাকে নির্দিষ্ট করে দিতে চাইছে, এমন এক শ্বাসরোধকারি সময়ে এই রায় এক ঝলক তাজা বাতাস হয়েই দেখা দিচ্ছে। এই রায় দৃঢ়ভাবে বলেছে যে, পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে যে কোন ধরনের প্রেম হল প্রেমই এবং তা যেমন এলজিবিটিকিউআইএ জনগণের পক্ষে প্রযোজ্য, সেরকমই প্রযোজ্য ভিন্ন জাত এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের জনগণের মধ্যে প্রেমের ক্ষেত্রেও। সমকামিতা ''প্রকৃতি বিরোধী'', এই যে আপ্তবাক্যটির উপর ৩৭৭ ধারাকে দাঁড় করানো হয়েছিল, রায় সেটিকে ধূলিসাৎ করেছে। এবং তা করেছে বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে উদ্ধৃত করে, যে গবেষণা দেখায় যে, সমকামিতা অথবা উভকামিতা ''ভিন্ন-লিঙ্গ-ভিত্তিক-যৌনতার মতই স্বভাবের গভীরে প্রোথিত, অন্তর্নিহিত এবং সহজাত।'' বিচারপতি চন্দ্রচূড় চিকিৎসকদের উদ্দেশে বলেন, তারা যেন ''রোগই নয় এমন একটা জিনিসকে নিরাময় করার চেষ্টা করে'' সমকামীদের কালিমালিপ্ত করার ভাগীদার না হয়।
বিচারপতি ইন্দু মালহোত্রা তাঁর রায়ে এই বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করেন যে, সমকামিতা এবং উভকামিতা হল ''বৈচিত্র্য, বিপথগামিতা নয়।'' বিচারপতি মালহোত্রার রায় এই দিক থেকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ যে, তিনি ঘোষণা করেন ''শতকের পর শতক ধরে কলঙ্কিত এবং একঘরে হয়ে থাকার যন্ত্রণা ভোগের প্রতিকার প্রদানে বিলম্ব করার জন্য এই সম্প্রদায়ের সদস্যবৃন্দ এবং তাদের পরিবারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার দায় ইতিহাসের রয়েছে।'' দিল্লী হাইকোর্ট ২০০৯ সালে ৩৭৭ ধারার পরিধিকে সংকুচিত করেছিল। সেই রায়কে বানচাল করে সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালে তার কুখ্যাত রায়ে সমকামিতাকে যে অপরাধ বলে পুনরায় ঘোষণা করে, বিচারপতি মালহোত্রার রায়ের এই লাইনটি সুপ্রিম কোর্টের নিজেরই সেই ত্রুটিকে স্বীকার, যাকে স্বাগত জানাতে হবে।
এই রায় অকুতোভয় ব্যক্তিবর্গ এবং এলজিবিটিকিউআইএ সম্প্রদায়ের পক্ষে এক বিরাট বিজয়, যাঁরা কলঙ্কের অপবাদ এবং ঝুঁকিকে উপেক্ষা করে ৩৭৭ ধারার সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের নির্ভীকতার সম্পূর্ণ বিপরীতে রয়েছে ভারত সরকারের কাপুরুষতা, যাঁরা সমকামিতাকে অপরাধ বলে গণ্য হওয়া থেকে মুক্ত করার বিষয়টির বিরোধিতা বা সমর্থন কিছুই না করে সেটিকে 'আদালতের প্রজ্ঞার' উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর রায়ে বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচুড় ভারত সরকারের 'নিরপেক্ষতার' হাবভাবেরও সমালোচনা করেন, যারা ৩৭৭ ধারার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান না নিয়ে বিষয়টির নির্ধারণের দায় সুপ্রিম কোর্টের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল।
এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং নিন্দনীয় যে, কিছু ধর্মীয় সংগঠন—যাদের মধ্যে খ্রিষ্টান, মুসলিম এবং হিন্দু গোষ্ঠীও রয়েছে—সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে এবং সমকামিতা সম্পর্কে নেতিবাচক বিবৃতি দিয়েছে।
বেশ কিছু বিরোধী দল (কংগ্রেস এবং কয়েকটি বাম দল সহ) এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। অনেক বাম দলই ৩৭৭ ধারা বিরোধী আন্দোলনের শরিক থাকলেও এর একটি লক্ষ্যণীয় ব্যতিক্রম হল এস ইউ সি আই (সি) যারা বিষয়টি সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছে। যে সমস্ত সামাজিক এবং রাজনৈতিক শক্তি নিজেদের বামপন্থী, গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল বলে এবং জনগণের সহজাত এবং সাংবিধানিক সমতা ও মর্যাদার রক্ষক বলে দাবি করে থাকে, তাদের কাছে সমকামিতা সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ ও তাকে বরদাস্ত করা থেকে নিবৃত্ত হওয়ার সময় সমুপস্থিত। কিছু বিতর্কের নিষ্পত্তি চিরদিনের মতই হয়ে যায় : প্রকাশ্য চর্চায় অস্পৃশ্যতাকে সমর্থনের কোন স্থান যেমন থাকতে পারে না, সেভাবেই প্রকাশ্য আলোচনায় সমকামিতা সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশের কোন অবকাশও থাকতে পারে না।
একদিকে মোদী সরকার এবং বিজেপি যখন এলজিবিটিকিউআইএ জনগণের সমান অধিকার সম্পর্কে 'নিরপেক্ষ' থাকার দাবি করছে এবং এই রায়কে স্বাগত জানাতে ব্যর্থ হয়েছে, অন্যদিকে তখন সংঘ এবং বিজেপির আসল 'মন কি বাতকে' ব্যক্ত করে দিয়েছেন তাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুখপাত্র। উদাহরণস্বরূপ, আর এস এস যেমন বলেছে যে, সমকামিতাকে অপরাধজনক করে তোলাটাকে তারা সমর্থন করে না, একই সাথে তারা এটাও দাবি করেছে যে, সমকামিতা প্রকৃতি-বিরুদ্ধ এবং অ-ভারতীয়। বিজেপি সাংসদ সুব্রমনিয়ান স্বামী প্রকাশ্যেই এমন মন্তব্য করেছেন যা এলজিবিটিকিউআইএ জনগনকে হেয় করে এবং যা চূড়ান্ত অজ্ঞতাকে দেখিয়ে দেয়। মোদী সরকারও আদালতকে অনুরোধ করে যে, তারা যেন একই লিঙ্গের মধ্যে বিবাহ, দত্তক গ্রহণ, উত্তরাধিকার এবং অন্যান্য নাগরিক অধিকার সম্পর্কে কোন অবস্থানের কথা ঘোষণা না করে—এইভাবে তারা এলজিবিটিকিউআইএ জনগণের সমতা এবং মর্যাদা সম্পর্কে অস্বস্তি এবং তাদের বিরুদ্ধে বৈরিতাকে প্রকট করে দেয়। ভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের জনগণের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংঘ ও বিজেপির বৈরিতার কথা মাথায় রাখলে—'লাভ জেহাদ' বলে যেটার প্রতি তারা বিদ্বেষ পোষণ করে—একই লিঙ্গের মানুষের মধ্যে সম্পর্কের প্রতি তাদের এই বৈরিতা একটুও বিস্মিত করে না।
এই রায় শুধু সমকামিতাকে অপরাধ নয় বলেই ঘোষণা করেনি—তা বস্তুত যৌন পছন্দ এবং লিঙ্গ-পরিচিতি নির্বিশেষে সমতা এবং মর্যাদার প্রতি সমস্ত মানুষের সহজাত এবং সাংবিধানিক অধিকারকেও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এটা প্রশ্নাতীতভাবে প্রতিপন্ন করছে যে, ভারতের অন্য সমস্ত নাগরিকদের কাছে যা লভ্য, এলজিবিটিকিউআইএ ব্যক্তিরাও বিবাহ, দত্তক গ্রহণ, উত্তরাধিকার প্রভৃতির পরিপূর্ণ অধিকার উপভোগের অধিকারি।
ড: আম্বেদকর ১৯৪৯ সালের ২৫ নভেম্বরের সাংবিধানিক সভার বিতর্কে তাঁর প্রদত্ত জবাবে বলেছিলেন যে, ''সাংবিধানিক নৈতিকতা কোন সহজাত মনোবৃত্তি নয়। আমাদের এর বিকাশ ঘটাতে হবে। আমাদের জনগণের এই শিক্ষাটা যে এখনও হয়নি, সেকথা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। ভারতে গণতন্ত্র হল ভারতীয় জমির উপর প্রতিষ্ঠিত লোক দেখানো একটা ভড়ং, যে জমিটা মূলগতভাবে অগণতান্ত্রিক।'' এই মন্তব্যের অর্থ এই নয় যে ভারতীয় জনগণের গণতান্ত্রিক প্রেরণার ঘাটতি রয়েছে—এর অর্থ হল, যে অগণতান্ত্রিক সাধারণ বোধ প্রাধান্যমূলক হয়ে উঠতে চায়, ভারতীয়দের তাকে সক্রিয়ভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে এবং পাল্টাতে হবে। ৩৭৭ ধারা বিরোধী প্রচার এবং এ সম্পর্কে রায় ভারতীয় সমাজের ব্যাপকতর অংশের মধ্যে যথেষ্ট স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই বিষয়টা এবং ৩৭৭ ধারা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের রায় দেখিয়ে দিচ্ছে, যে শক্তিগুলি পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে তারা সফল হতে পারে—এবং যে পশ্চাদমুখী সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিগুলি কুসংস্কার এবং ধর্মীয় গোড়ামিকেই 'ভারতীয়তার' মূল কথা বলে দাবি করে, তাদের উপর বিজয়ী হতে পারে।