(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮)
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮ সালের ছাত্র সংসদের নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ফ্যাসিবাদী আরএসএস-এর ক্যাম্পস ঝটিকা বাহিনী এবিভিপি-কে ব্যাপকভাবে প্রত্যাখ্যান করে ঐক্যবদ্ধ বাম প্যানেলের প্রার্থীদের বিপুল ব্যবধানে নির্বাচিত করেছেন। জেএনইউ-র এবারের নির্বাচনে রেকর্ড সংখ্যক ৬৭.৮ শতাংশ ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন—যা দেখাচ্ছে যে, জেএনইউ-র ছাত্র সম্প্রদায় মোদী জমানার নিরন্তর আক্রমণ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষা করার আশু প্রয়োজনীয়তাকে সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেছিল।
ঐক্যবদ্ধ বাম প্যানেলের প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী এআইএসএ-র এন সাই বালাজি পান ২১৫১ ভোট এবং এবিভিপি প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে তাঁর জয়ের ব্যবধান হল ১১৭৯ ভোটের। ভাইস প্রেসিডেন্ট, সাধারণ সম্পাদক এবং যুগ্ম সম্পাদক পদে ঐক্যবদ্ধ বাম প্যানেলের প্রার্থীরাও (ডিএসএফ-এর সরিকা চৌধুরী, এসএফআই-এর আইজাজ আহমেদ রাঠের এবং এআইএসএফ-এর আমুথা জয়দীপ) একই ধরনের বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন।
দ্বিতীয় স্থান লাভ করায় এবিভিপি ''নৈতিক বিজয়'' অর্জন করেছে বলে দাবি করেছে—কিন্তু বাস্তব ঘটনা এই দাবিকে উপহাসই করছে। গত বছরের চেয়ে তার প্রাপ্ত ভোটের হার ৪ শতাংশ কমেছে এবং যে সায়েন্স স্কুল সমূহ এবিভিপি-র দুর্গ রূপে দেখা দিত সেখানেও তারা জমি হারিয়েছে। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, উপাচার্য এবং সংঘ পরিবারের প্রতিভূ হওয়া, ছাত্র নাজিবের উপর সমবেত আক্রমণ ও তার নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় তাদের ভূমিকার জন্য এবং আটজন ছাত্রী যার বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনে সেই এবিভিপি-পন্থী অধ্যাপক জোহরিকে সমর্থনের জন্য ছাত্ররা এবিভিপি-কে যথাযথ মূল্য দিতে বাধ্য করেছে।
জেএনইউ ছাত্র সংসদ যে রায় পেয়েছে তা শুধু ঐক্যবদ্ধ বাম এবং ঐক্যবদ্ধ বিরোধী পক্ষের নির্বাচনী জোটের বিজয়ই নয়। এটা জেএনইউ-র উপাচার্য, এবিভিপি, আরএসএস এবং মোদী সরকারের ঐক্যবদ্ধ ফ্যাসিস্ট গাঁটছড়ার বিরুদ্ধে জেএনইউ-র ছাত্রদের ধারাবাহিক ঐক্যের বিজয়। যে ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতি সমস্ত ধরনের বৌদ্ধিক অন্বেষণ, যুক্তিসিদ্ধতা এবং নাগরিকদের তোলা প্রশ্নকে 'শহুরে নকশালবাদ' বলে ছাপ মেরে দেয়, তার বিরুদ্ধে এটা শিক্ষা, বিতর্ক এবং বিচারবুদ্ধির বিজয়।
জেএনইউ-তে বাম ঐক্যের শক্তিশালী অক্ষ রয়েছে এআইএসএ-র মধ্যে। সোভিয়েতের পতনের পর আত্মপ্রকাশ ঘটিয়ে এআইএসএ দিল্লীর ছাত্রদের মধ্যে এক প্রাণবন্ত, অনুপ্রেরণা সঞ্চারি এবং বলিষ্ঠ বাম উপস্থিতি রূপে নিজের বিকাশ ঘটায় এবং পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্টের বিপর্যয় ও ত্রিপুরার ধাক্কাকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়।
জেএনইউ-তে বিজয়ী হওয়া এবং জেএনইউ-র গণতান্ত্রিক নির্বাচনী সংস্কৃতির বিকৃতিসাধনের জন্য এবিভিপি চেষ্টার কোন কসুর করেনি; ওরা ছাত্রদের নিয়ে বিরিয়ানি পার্টি দেয় এবং সংসদে নিয়ে গিয়ে উপরাষ্ট্রপতি ভেঙ্কাইয়া নাইডুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করায়। জেএনইউ-র ছাত্রদের কাছে কিন্তু বাম এবং এবিভিপি-র মধ্যেকার বৈপরীত্য নিয়ে কোন সংশয় ছিল না। বিপুল অঙ্কের জরিমানা এবং চাপানো মামলার সন্ত্রাসের সাহসের সাথে মোকাবিলা করে বাম কর্মীরা আসন সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া, সংরক্ষণের উপর আক্রমণ চালানোর বিরুদ্ধে, ইতিবাচক কর্মনীতি গ্রহণ এবং লিঙ্গ ন্যায়ের জন্য এবং প্রতিবাদের অধিকারের উপর দমন নামিয়ে আনার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যায়। বিপরীতে এবিভিপি-র নেতারা জেএনইউ-র উপাচার্য এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তোলা সেলফি নিয়ে বড়াই করতে থাকে এবং এবিভিপি-র এক প্রাক্তন নেতা জেএনইউ-র কৌঁসুলি হয়ে বিভিন্ন আদালতে জেএনইউ উপাচার্যের প্রতিটি বেআইনি পদক্ষেপ সমর্থন করে চলে। জেএনইউ-কে 'জাতীয়তা বিরোধী' এবং 'শহুরে নকশাল' বলে দেগে দেওয়ার প্রচারও এবিভিপি পরিচালনা করে এবং এক বন্দুকবাজ জেএনইউ ছাত্র আন্দোলনের কর্মী উমর খলিদকে হত্যা করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য আক্ষেপ করতে থাকে।
জেএনইউ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে গণনা-কালীন এবং ফলাফল বেরোনোর পরবর্তী পর্যায়ে এবিভিপি যে ধরনের আচরণ করে তা ২০১৯-এর নির্বাচন চলার সময় এবং তার পরবর্তীতে বিজেপির সম্ভাব্য আচরণ সম্পর্কে আমাদের হুঁশিয়ারি দেয়। আরএসএস-এর সংগঠনগুলো ছলেবলে কৌশলে জেতার চেষ্টা করবে—আর জিততে না পারলে ওরা গণতন্ত্রকেই ধ্বংস করার চেষ্টা করবে।
দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ এবং সন্দেহজনক ইভিএম-কে কেন্দ্র করে বিতর্কে কালিমালিপ্ত হয় এবং তাতে এবিভিপি বিজয় হাসিল করে। এবিভিপি-র নেতারা জেএনইউ-তে সম্পূর্ণরূপেই ছাত্রদের নিয়ে গঠিত নির্বাচন কমিটির উপর দৈহিক আক্রমণ চালায় এবং ব্যালট বাক্সগুলোর দখল নেওয়ার লক্ষ্যে জোর করে গণনা ক্ষেত্রে ঢুকে পড়ে। নির্বাচন কমিটি গণনা প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর নির্বাচনী এজেন্টদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ার বিধির আশ্রয় নিয়েছে, এই অছিলায় ওরা সেখানে ঢোকে। এই বিধি শুধু এবিভিপি-র ক্ষেত্রেই নয়, এআইএসএ-র ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়েছে। কিন্তু বাম ঐক্যের প্যানেলের নেতৃত্বে থাকা এআইএসএ ঐ বিধিকে মেনে চলেলও এবিভিপি হিংসা এবং নাশকতা চালায়। এবিভিপি-র হিংসার উৎস আসলে ছিল সায়েন্স স্কুলগুলো এবং বিশেষ কেন্দ্রগুলোর ফলাফল, যেখানে এবিভিপি একটি ছাড়া কাউন্সিলারদের অন্য সমস্ত পদেই পরাজিত হয়।
গণনা প্রক্রিয়াকে বানচাল করার লক্ষ্যে এবিভিপি হিংসা চালিয়ে যেতে থাকে। গণনা প্রক্রিয়াকে রক্ষা করতে হাজার হাজার ছাত্র জড়ো হয় এবং তাদের এই দৃঢ় ঐক্যই বিপর্যয়কে প্রতিহত করে। নির্বাচনী ফল প্রকাশের পর এবিভিপি বারবারই লোকজন জড়ো করে জেএনইউ ছাত্র সংসদের প্রেসিডেন্ট বালাজি, এর আগের প্রেসিডেন্ট গীতা এবং আরো অনেক বাম কর্মীদের উপর আক্রমণ চালায়। প্রশাসন এবং দিল্লী পুলিশের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার ব্যাপারে সুনিশ্চিত হয়ে এ বি ভি পি-র হামলাকালীরা যখন তাণ্ডব চালাচ্ছিল, জে এন ইউ উপাচার্য তখন খোশমেজাজে স্বচ্ছ ভারত সম্পর্কে টুইট করে যাচ্ছিলেন।
পরবর্তীতে জেএনইউ প্রশাসন এবিভিপি-র দুষ্কৃতিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে এবিভিপি-র চালানো হিংসাকে অজুহাত করে ক্যাম্পাসে গণতন্ত্রের টুঁটি টিপে ধরার এবং ছাত্রদের চলাফেরাকে নিয়ন্ত্রিত করার চেষ্টা করেছে; যার মধ্যে হোস্টেল কারফিউ (এর আগে জেএনইউ-তে যা কোনদিন ঘটেনি) এবং প্রতিবাদ প্রদর্শনের উপর নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে! জে এন ইউ-র জনসমাজ—শিক্ষক, কর্মচারী ও ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধভাবে এই দানবীয় আজ্ঞাকে উপেক্ষা করে ক্যাম্পাসে এক বিশাল মৌন শান্তি পদযাত্রা সংগঠিত করে শান্তি ও গণতন্ত্রের আহ্বান জানায়।
জেএনইউ কোন দ্বীপ নয়। এখানে ভারতের ছাত্র ও যুবকদের প্রাণের স্পন্দন ধরা পড়ছে। জেএনইউ-তে বামেরা যখন বিপুলভাবে জয়ী হচ্ছে, তখন তামিলনাড়ু ও পদুচেরিতে গৈরিকীকরণ এবং প্রশ্ন তোলা ও বিরোধী মত প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন চলেছে। এর আগে এই ধরনের আন্দোলন আছড়ে পড়েছিল বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটি মাদ্রাজ এবং রায়পুরের হিদায়াতুল্লা জাতীয় আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। মোদী সরকার যে জেএনইউ মডেলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্থানে জিও এবং আরএসএস শাখা মডেলগুলিকে আনতে চাইছে, ভারতের ছাত্র ও যুবকরা এই প্রয়াসকে প্রতিরোধ করছে। জিও এবং শাখা মডেলের প্রতিষ্ঠানগুলির অতি উচ্চ হারের ফি সাধারণ ছাত্রদের দূরে সরিয়ে রাখবে, সেখানে সংঘের অনুশাসনের প্রতি মান্যতা ও আনুগত্যই নিয়ম হয়ে উঠবে এবং সেখানে পাঠ্যক্রম উড়োজাহাজ গাধার মূত্রে চালিত হওয়ার মত অজ্ঞতাবাদী আজগুবি বিষয়ে পরিপূর্ণ হবে।
আজকের এই কঠিন সময়ে সারা দেশকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পাশে দাঁড়াতে হবে—কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে সমস্ত লড়াই চলছে তা দেশের ভবিষ্যতের জন্য, আর গণতন্ত্র ও যৌবনের জন্য।