"নক্ষত্রের কনফারেন্সে মেঘেরা মিছিল করে হেঁটেছিল কাল সারারাত, প্রত্যেকের হাতে চিল জ্যোৎস্না কালিতে লেখা জ্বলজ্বলে পোস্টার-"
নব্বইয়ের দশক, জেএনইউ ছাত্র সংসদের এক সভাপতি বিহারে গ্রামীন খেটেখাওয়া মানুষের স্বার্থে লড়তে গিয়ে শহীদ হলেন। নাম চন্দ্রশেখর প্রসাদ, সকলের প্রিয় চন্দু। আইসা নেতা চন্দু শহীদ হলেন সিওয়ানে, সিপিআই(এমএল) এর নেতৃত্বে গরিব গুর্বো মানুষগুলোর স্বার্থে লড়তে গিয়ে। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এটাই ঐতিহ্য। জেএনইউ বরাবরই অন্যরকম। অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে 'চিল জ্যোৎস্না কালিতে লেখা জ্বলজ্বলে পোস্টার' হাতে জেএনইউ সবসময় সরব। বাম ছাত্র আন্দোলনের মেরুদন্ডের বার্তাবাহক জেএনইউ। শাসক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জের প্রতীক সে। তাই ফ্যাসিবাদী শক্তি দেশের ক্ষমতায় গদিয়ান হওয়ার পর থেকেই তাদের টার্গেট এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। যাকে কব্জা করতে উঠে পড়ে লেগেছে সংঘ পরিবারের ছাত্র সংগঠনের তকমাআঁটা ঝটিকা বাহিনী অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)। গতবছর ছাত্রসংসদ ভোটের আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল নীল নকশা। ভুয়ো ভিডিও প্রচার করে জেএনইউ'র ছাত্র ছাত্রীদের দেশদ্রোহী হিসেবে দেগে দিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে 'শাট ডাউন জেএনইউ' আওয়াজ তুলে জেএনইউ'কে দখল করার চেষ্টা করেছিল এবিভিপি, বকলমে বিজেপি। এই প্রক্রিয়ায় দেখা গিয়েছিল কি ভয়ংকরভাবে সমগ্র কেন্দ্রীয় সরকার ও তার শাসন কাঠামো কার্যত যুদ্ধ নামিয়ে এনেছিল জেএনইউ'র ওপর। কিন্তু সেই সময়েও জেএনইউ'র ছাত্র-ছাত্রীরা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল এবিভিপি'কে, জয়ী হয়েছিল বামজোট।
এর মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে সংঘের একজন একনিষ্ঠ সেবক জগদীশ কুমারকে। আর তার মদতেই জেএনইউ'কে দখল করার, দখল করতে না পারলে তাকে বন্ধ করে দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। যার প্রতিফলন দেখা গেল এবারের ছাত্রসংসদ নির্বাচনেও। গোটা দেশ তাকিয়ে ছিল জেএনইউ'র দিকে, তার ফলাফলের দিকে। কারণ ফ্যাসিস্টরা জানে ভারতবর্ষের শিক্ষাকে ধ্বংস করতে গেলে তাকে কুক্ষিগত করে গৈরিকীকরণ বেসরকারিকরণ করতে গেলে জেএনইউ'কে দখল করাটা জরুরি, নাহলে তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য পূরন হবে না। আর গোটা দেশ জানতো যদি জেএনইউ এবিভিপি'র কুক্ষিগত হয় তাহলে শিক্ষার অধিকার থেকে কৃষকের ফসলের ন্যায্য দামের দাবির যে সরব কন্ঠস্বর জেএনইউ থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তাকে ধ্বংস করে শিক্ষাজগতে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হবে। ভোটের প্রচারেই এবিভিপি স্পষ্ট করে দিয়েছিল তার বিভাজনমূলক হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদী অ্যাজেন্ডাকে। আর এই ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনকে রুখতেই জোট বেঁধেছিল জেএনইউ'র চারটি বাম ছাত্র সংগঠন- আইসা এসএফআই ডিএসএফ এবং এআইএসএফ।
বামজোটের অগ্রগতি এবং ক্যাম্পাসের মেজাজ দেখে ভীত এবিভিপি এবার প্রথম থেকে মরিয়া হয়ে ওঠে। ফ্যাসিবাদী শক্তি মানুষের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত করে তোলে কিন্তু যখন তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যায় তখন তাদের দাঁত নখ বেরিয়ে আসে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভিএমে ভোট হওয়ার ফলে ইভিএম ট্যাম্পারিং করে যে সুবিধা তারা পেয়েছিল জেএনইউ-তে ব্যলটে ভোট হওয়ায় তা পায়নি। তার ওপর যখন তারা দেখলো দীর্ঘদিন যে সমস্ত স্কুলে তারা কাউন্সিলর জিততো সেখানেও বামজোট জিতছে, তখনই গণনাকেন্দ্র দখল করে তারা। স্থগিত হয়ে যায় ভোটগণনা। গণনাকেন্দ্র দখলমুক্ত করে পুনরায় গননা শুরু হওয়ার পর বামজোটের প্রার্থীরা যখন কেন্দ্রীয় প্যানেলে এগিয়ে যেতে থাকে তখন প্রশাসনিক মদতে এবিভিপি বাইরে থেকে অস্ত্রসহ লোক জমা করতে থাকে। এবিভিপি'র গুন্ডারা ভিতরে ঢুকতে পারলেও কোনো দিল্লি পুলিশের টিকিটাও দেখা যাচ্ছিল না। কর্তৃপক্ষ মিডিয়াকেও ঢুকতে দিচ্ছিল না।
এবিভিপি'র ঝটিকা বাহিনী ঢুকছে খবর পেয়ে গোটা জেএনইউ বামজোটের নেতৃত্বে জড়ো হয়। ভোটগণনা প্রক্রিয়া শেষ হতে দেখা যায় বামজোট বিশাল ব্যবধানে জয়ী হয়েছে। সভাপতি পদে আইসা প্রার্থী কমরেড এন সাই বালাজি ১১৭৯ ভোটে জয়ী হন। সহ সভাপতি পদে ডিএসএফ প্রার্থী কমরেড সারিকা চৌধুরি ১৫৭৯ ভোটে জয়ী হন। সাধারণ সম্পাদক পদে এসএফআই প্রার্থী কমরেড আয়জাজ আহমেদ রাদার ১১৯৩ ভোটে জয়ী হন এবং যুগ্ম সম্পাদক পদে এআইএসএফ প্রার্থী কমরেড আমুথা জয়দীপ ৭৫৭ ভোটে জয়ী হন। গতবারের তুলনায় জয়ের ব্যবধান অভূতপূর্বভাবে বেড়েছে। অধিকাংশ স্কুল কাউন্সিলর পদেও জয়ী হন বাম প্রার্থীরা। এমনকি যে সমস্ত স্কুলগুলি এবিভিপি'র ঘাঁটি হিসেবে এতোদিন পরিচিত ছিল সেগুলির কাউন্সিলর পদেও বাম ঐক্যের জয়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়ে গেল জেএনইউ এবিভিপিকে নাকচ করেছে, প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। আর এতেই ভীত এবিভিপি ফলপ্রকাশের দিন রাতে বর্বরোচিত হামলা চালায় সদ্য নির্বাচিত জেএনইউএসইউ সভাপতি আইসা নেতা কমরেড বালাজি এবং পূর্ববর্তী সভানেত্রী আইসা নেত্রী কমরেড গীতা কুমারি সহ বাম ছাত্র নেতৃত্বের ওপর। পরেরদিন সকালে বসন্ত কুঞ্জ থানায় কমরেড বালাজি অভিযোগ দায়ের করতে গেলে এবিভিপি থানার বাইরে জড়ো হয় এবং বালাজিকে প্রাণনাশের হুমকি দিতে থাকে। নিধিরাম সর্দার দিল্লি পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয় না, কিন্তু জেএনইউ থেকে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক শিক্ষিকারা চলে আসেন থানার কাছে। বিকালে গোটা জেএনইউ ভেঙে পড়ে এবিভিপি'র বিরুদ্ধে ধিক্কার মিছিলে।
বিগত কয়েক বছর ধরে জেএনইউ দাঁড়িয়ে আছে সমগ্র শাসনকাঠামোর সম্মিলিত আক্রমণের বিপরিতে। তবুও শিরদাঁড়া টানটান করে লড়ে যাচ্ছে জেএনইউ। পাশে পেয়েছে জেএনইউ'র শিক্ষক সংগঠন জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনকে (জেএনইউটিএ)। ক্যাম্পাসের পরিসরে ফ্যসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের হাতিয়ার হয়ে উঠছে জেনএনইউ' বামজোট। যা শুধু ভোটের ক্ষেত্রে নয় সমস্ত হামলার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ময়দানে জেএনইউ সহ সমগ্র দেশের ছাত্র আন্দোলনের কাছেও বিকল্প নজীর তৈরি করছে। আজ গোটা দেশের আর্থ-সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশের ওপর ফ্যসিবাদ তার করাল থাবা নামিয়ে আনছে। এর বিপ্রতীপে ক্ষেতের আল থেকে কারখানার গেট হয়ে রাজপথের লড়াই প্রতিরোধের নতুন দিগন্তের দরজা খুলে দেবে ঐক্যবদ্ধ বাম আন্দোলনের ঝঙ্কার। 'হিরকের রাজা ভগবান' না বললে রেহাই নেই, এর বিপ্রতীপে দড়ি ধরে টান মেরে 'রাজা হবে খানখান'-এর স্বপ্ন দেখাচ্ছে জেএনইউ'র লড়াই। ফ্যাসিবাদ আরও তীব্রভাবে আরও নতুন পদ্ধতিতে জেএনইউ'র ওপর আক্রমন নামিয়ে আনতে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাকে রুখে দিতে প্রস্তুত হচ্ছে জেএনইউ'র লড়াকু সাথীরাও।
জেএনইউ'র এই লড়াই গোটা দেশের এক আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেলকে বাঁচানোর লড়াই, শিক্ষার অধিকারের লড়াই, শিক্ষার গৈরিকীকরন বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে লড়াই। তাই এই লড়াই জিততে হবে; জেএনইউ প্রমান করে দিয়েছে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনকে রোখা সম্ভব। বামজোটের নেতৃত্বে সাধারন ছাত্রছাত্রীদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মডেল তারা তৈরি করেছে, এখন দায়িত্বটা আমাদের, তাকে আরও বিস্তৃত করার আরও দৃঢ় করার; প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি স্তরে। ফ্যসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বত্র লাল প্রতিরোধকে তীব্রতর করার সময় এসেছে, তারই নিদর্শন জেএনইউ'র সংগ্রাম। 'মুক্ত মানুষের স্বাধীনতা অধিকার' যারা ঘৃণ্য কৌশলে খর্ব করতে চায় আসুন তাদের বিরুদ্ধে জোট বাঁধি, তৈরি হই,সামনে দিন জোর লড়াই ...।
জেএনইউ'র সকল সংগ্রামী সাথী এবং নবনির্বাচিত ছাত্রসংসদকে রক্তিম অভিনন্দন এবং বাম জোটের নেতৃত্ব দিয়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (আইসা) জেএনইউ ইউনিটকে লাল সেলাম।