প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজের জন্য একটা নিয়ম তৈরি করেছেন। সেটা হল, সংসদে, সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যাওয়া। মোদী জমানার সাথে মিডিয়া মালিকদের সম্পর্ক ভীষণ মধুর। বিশেষ করে বড় পুঁজি, পেটোয়া পুঁজি নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় মোদীরাজের নাম-কীর্তনে বিরাম নেই। ভারতীয় হিটলারী মোদীতন্ত্রের বন্দনায়, মোদীর হয়ে ব্যাটে ঝড় তোলায় মিডিয়া ব্যারনদের মধ্যে চলে হুড়োহুড়ি, সবার উপরে চলছে 'ভারতীয় গোয়েবেলস গোস্বামীদের' চ্যানেল, নাগপুরি সংঘী ঘরানাকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে। তাঁর হয়ে আনুগত্যের মিডিয়া এতই বকবকম করে যে সেই কারণে সংসদ সদস্যদের ও সাংবাদিকদের জেরার জবাব দেওয়ার দায় বিজেপির ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতিওয়ালা মেনে চলেন না। তবে ইদানিং কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা লক্ষণীয়। মোদী মুখ খুলছেন সাংবাদিকদের ডেকে। বোধহয় পেটোয়া চ্যানেলে প্রচার যা চলছে তা যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন আর দূরে নয় এবং মুখে যাইই হম্বিতম্বি থাকুক দুর্ভাবনা মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে। তাই সাংবাদিকদের ডেকে মনের কথা বলছেন মোদী। বেশ লম্বা-চওড়া সাক্ষাৎকার (দি টাইমস অব ইন্ডিয়া ১২ আগস্ট ২০১৮)। আসলে বহু জিজ্ঞাসা জমা হয়ে আছে যেমন শিক্ষা সংস্কার, কর্মসংস্থান ইত্যাদি মূল মূল বিষয়ে।
শিক্ষা সংস্কার আর কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি আর প্রকৃত পরিণতির দু:সহ পরস্পর বিপরীত চিত্র বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করা যাক একনজরে।
মোদীর বাণী হল, 'শিক্ষিত ও উদ্ভাবনী সমাজের নয়া ভারত' নির্মিত হবে ২০২২-এর মধ্যে। প্রত্যেক ছাত্র নাকি সুযোগ পাবে পছন্দ অনুযায়ী পঠনের ও দক্ষতা বাড়ানোর,যার দৌলতে কাজ পাবে উপযুক্ত এবং লাগতে পারবে 'স্কিল ইন্ডিয়া' (দক্ষ দেশ) গড়ার কাজে। শিক্ষায় জড়িত ব্যাপকতম অংশকে নিয়ে আসা হবে সেই লক্ষ্যমাত্রায়। সুযোগ পাওয়ার প্রশ্নে থাকবে সমতা। এই শিক্ষা কোন দলের বা গোষ্ঠীর বা মতাদর্শের হবে না। এটা হল নাকি জাতীয় এজেন্ডা। এই লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি সবক্ষেত্রের শিক্ষা- শিল্প- ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে একসাথে ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মাঝারিয়ানার নিয়ন্ত্রণ নয়, প্রদান করা হবে উৎকর্ষ অর্জনের স্বাধিকার। ছাত্ররা পাবে বিনামূল্যে বাজারমুখী দক্ষতা অর্জনের শিক্ষা, যাতে শিক্ষান্তে কাজ পাওয়া যাবে নিশ্চিত।
কি দারুন মোহময় শুনতে!
কিন্তু মোদীর নতুন নতুন রঙ ধরানো সোনার পাথর বাটির প্রতিশ্রুতিতে কান পাতার পরিবর্তে মাথায় রাখা উচিত মোদী জমানায় শিক্ষার কি শোচনীয় হাল হয়েছে। স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় তিন স্তরেই সংকোচনকরণ-ব্যয় বৃদ্ধিকরণ-বেসরকারিকরণ ও গৈরিকীকরণ চালু হয়ে চলেছে। ২০১৭ সালেই কেন্দ্র নিযুক্ত ' নীতি আয়োগ' সুপারিশ করে স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থাকে ২০১৯ সালের মধ্যে ব্যাপকমাত্রায় বেসরকারীকরণের দিকে নিয়ে যেতে হবে। আর চলমান অর্থবর্ষে (২০১৮-১৯) সর্বস্তরের শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ ছেঁটে দেওয়া হয়েছে গত চার বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, গবেষণা, আসন সংখ্যা, সংরক্ষণ সংখ্যা সবেতেই সুযোগের সংকোচনকরণই চলছে। আর প্রাতিষ্ঠানিক 'স্বাধিকার প্রদানের' ধোঁকাবাজি ধরা পড়ছে জেএনইউ থেকে শুরু করে দেশের নামকরা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্র আর সঙ্ঘ'র দখল নেওয়ার ফ্যাসিবাদী অভিযানের মধ্যে। পরিচালন ব্যবস্থায় বশংবদদের নিয়োগ করা, তাদের দিয়ে নানা নিষেধাজ্ঞার ফতোয়া জারী করানো, এবিভিপি'র গুন্ডা বাহিনী-পুলিশের গোয়েন্দা বাহিনী-সশস্ত্র বাহিনী লেলিয়ে দেওয়া, কোনো হামলা বাকি রাখছে না। বিজেপির হিন্দুত্বের ভারত নির্মাণের স্বার্থে শিক্ষার গেরুয়াকরণ তথা গৈরিক মতাদর্শ-তত্ত্ব-স্বাধীনতা সংগ্রাম সংক্রান্ত ইতিহাসগত বিকৃত বিশ্লেষণ ও সাম্প্রদায়িক আচার-বিচারের আক্রমণ নামানো হচ্ছে। ওদের জাতীয় এজেন্ডাই ওরা কার্যকরি করতে উন্মত্ত। যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের দিকে, যে গন্তব্যের রাষ্ট্রব্যবস্থায় অবাধ ক্ষমতা থাকবে কেবল হিন্দুত্ববাদী আর লুটেরা পুঁজির দস্যুদের, যার মহড়া ওরা শুরু করে দিয়েছে।
আসা যাক, মোদী জমানায় শিক্ষান্তে কাজ পাওয়ার কথায়। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মৈত্রী ঘটকের বক্তব্য হল, বর্তমান ভারতবর্ষে কর্মক্ষম ৬০০ মিলিয়নের মধ্যে ফর্মাল সেক্টরে রয়েছে মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ। বাকি সব নিয়োজিত ইনফর্মাল সেক্টরে, যেখানে কাজের শর্ত, পরিবেশ, নিরাপত্তা, মজুরি। বেতন সবকিছুই অতি বেদরদী, অধিকার বঞ্চিত, অনিয়মিত, অনিশ্চিত ও নিম্নমানের এবং অপ্রতুল; যেখানে এক অর্থে জীবন-জীবিকা অথৈ জলে ভাসমান। মোদীর বছরপ্রতি ২ কোটি হাতে কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি পরিণত হয়েছে ভাঁওতায়। বরং গত চার বছরে ফিবছর বেকারি বেড়েছে ১০-১২ মিলিয়ন করে। সংখ্যাটা মোটামুটি বর্তমানে সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত কর্মীসংখ্যার সমান। (দি টাইমস্ অব ইন্ডিয়া, ৩ সেপ্টেম্বর '১৮)।
খতিয়ে দেখা যাক বিভিন্ন স্তরের শিক্ষিত অংশের সাপেক্ষে বেকারি বৃদ্ধির তুলনামূলক শতাংশ।
অষ্টম শ্রেণী পাশ :
২০১১-২০১২ --- ০.৬০ ==== ২০১৫-১৬ --- ২.৪০
দশম শ্রেণী পাশ :
২০১১-২০১২ --- ১.৩০ ==== ২০১৫-১৬ --- ৩.২০
দ্বাদশ শ্রেণী পাশ :
২০১১-২০১২ --- ২.০০ ==== ২০১৫-১৬ --- ৪.৪০
স্নাতক :
২০১১-২০১২ --- ৪.১০ ==== ২০১৫-১৬ --- ৮.৪০
স্নাতকোত্তর :
২০১১-২০১২ --- ৫.৩০ ==== ২০১৫-১৬ --- ৮.৫০
স্নাতক (প্রযুক্তিবিদ্যা) :
২০১১-২০১২ --- ৬.৯০ ==== ২০১৫-১৬ --- ১১.০০
স্নাতকোত্তর (প্রযুক্তবিদ্যা) :
২০১১-২০১২ --- ৫.৭০ ==== ২০১৫-১৬ --- ৭.৭০
কারিগরী প্রশিক্ষিত :
২০১১-২০১২ --- ৪.৯০ ==== ২০১৫-১৬ --- ৭.৯০
তথ্যসূত্র : ২০১১ সালের জতীয় নমুনা সমীক্ষা ও শ্রমমন্ত্রকের অন্তর্গত লেবর ব্যুরোর ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষের রিপোর্টে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জেএনইউ-র অধ্যাপক সন্তোষ মেহরোত্রার সূত্রায়ন ( দি টেলিগ্রাফ, ২০ আগস্ট'১৮)।
লেবর স্টাডিজ বিভাগে নিযুক্ত শ্রীযুক্ত মেহরোত্রা পূর্বতন ইউপিএ আমলের শেষদিকের তুলনায় মোদীর এনডিএ জমানার প্রথম থেকেই উত্তরোত্তর বেকারি বৃদ্ধির তথ্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ২০১১-১২ বর্ষের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা ও কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রকের অন্তর্গত লেবর ব্যুরোর ২০১৫-১৬ বর্ষের তথ্যের ভিত্তিতে মেহরোত্রা তাঁর রিপোর্ট তৈরি করেন। তাতে উল্লেখিত হয়েছে ইউপিএ পর্বের তুলনায় এনডিএ পর্বে ১৫ বছর বয়সী থেকে তদুর্ধ কর্মক্ষম সব বয়সী ক্ষেত্রে শিক্ষিত- অশিক্ষিত নির্বিশেষে বেকারি বেড়েছে ক্রমাগত লাফিয়ে লাফিয়ে। লেবর ব্যুরোর রিপোর্ট হল, ২০১৭-১৮-র শেষ ত্রৈমাসিকে ও ২০১৮-১৯-র প্রথম ত্রৈমাসিকে নির্মাণশিল্প, ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের মতো মূল ক্ষেত্রগুলোতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। ২০১৮-১৯-র দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের সমীক্ষা রিপোর্ট এখনও প্রকাশিত হয়নি। সেক্ষেত্রেও সম্ভবত রিপোর্টের আঁচ একইরকমভাবে নেতিবাচক। তাই মোদী সরকার হয়ত রিপোর্ট প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছে, সমীক্ষা সম্পূর্ণ না করে স্থগিত রেখে দিতে পারে। কর্মী নিয়োগ ও বেকারি সংক্রান্ত ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষের রিপোর্টটি ২০১৬-তে প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু সংশ্লিষ্ট ২০১৬-১৭ বর্ষের রিপোর্ট তারপরে ১৮ মাস পার হয়ে গেলেও প্রকাশ করা হয়নি। অথচ মোদী সরকার বড় গলায় শুনিয়েছিল পূর্বতন ইউপিএ সরকারের চেয়ে নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্র এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংখ্যা বাড়িয়েছে। কিন্তু রিপোর্ট প্রকাশে তবু এতো ব্যর্থ কেন? ২০১৬ থেকে এপর্যন্ত ৭ টি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছ। তাতে ধরা পড়েছে কাজ ক্রমেই হ্রাসমান। সূত্রের খবর ছিল, ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে ২০১৬-১৭-র এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে ১০১.১৭ লক্ষ কাজের হাত থেকে ০.১২ হাজার কাজ উধাও হয়ে গিয়েছিল, পরের বছরে ২০১৬-১৭-র এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে ঐ ক্ষেত্রটিতে আবার প্রায় একইরকম মাত্রায় কাজ খোয়া যায়। এই প্রবণতার সাদৃশ্য চিহ্নিত হয়েছে সমীক্ষা চালানো অন্যান্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই । সেই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রগুলো হল, নির্মাণ, ব্যবসা-বানিজ্য, পরিবহণ, শিক্ষা,স্বাস্থ্য, হোটেল-রেস্তঁরা, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক। তাছাড়া, সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)-র ২০১৬ পরবর্তী পর্যায়ে বেকারি সংক্রান্ত কোন রিপোর্ট প্রকাশ হয়নি। সিএমআইই কর্তৃপক্ষ তবু দাবি করছে কাজ সৃষ্টি হচ্ছে না তা নয়, গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না মনে করা হচ্ছে বলে বেকারি না কমে বেড়ে যাচ্ছে।
ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য কাজের সংস্থান হচ্ছে কিনা সেটা তো কর্মপ্রার্থীর বিচার্যের বিষয় থাকবেই। এটা তো পছন্দের প্রশ্নে স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কারণ বেতন থেকে শুরু করে কাজের অন্যান্য শর্ত যেমন পরিবেশ, সময়সীমা, এ্যাসোসিয়েশন। ইউনিয়ন করার অধিকার ইত্যাদি সব ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্র নির্বিশেষে কর্তৃপক্ষের হামলা বাড়ছে।
লোকসভার গত অধিবেশনে বিরোদীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাবের প্রত্যুত্তর দেওয়া প্রসঙ্গে মোদী কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ভুয়ো তথ্যের কারসাজি করে গলাবাজি করেন।
অর্থনীতির বিশ্লেষক মৈত্রীশ ঘটক প্রতিধ্বনি তুলেছেন কাজ তেমন সৃষ্টি না হওয়ার গোড়ার গলদটা বহু পরিচিত, বহু চর্চিত, অন্তত প্রায় সমস্ত বেসরকারি মতে। মূল কারণ হল, সরকারি বিনিয়োগের হার বাড়ছে না, উল্টে কমছে। কর্মসংস্থানের কল্যাণকর দায়িত্ব পালন থেকে কেন্দ্রীয় সরকার নিজেকে ক্রমাগত প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে সরকারি বিনিয়োগের হার ছিল যেখানে জিডিপি-র ৪০ শতাংশ, এখন তা নামিয়ে আনা হয়েছে ৩০ শতাংশে। সরকার শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত করার লম্বাচওড়া বুলি দিয়ে কাজের সংস্থানের ব্যাপারে কেবল বাজারমুখী হতে বলছে, বেসরকারি ক্ষেত্রকেই ভবিতব্য করে দিচ্ছে। আর, বেসরকারি ক্ষেত্রের মূল প্রবণতা হল, কর্মী-নিবিড়তার বিপরীতে অত্যন্ত কম সংখ্যক কর্মী নিয়োগ করে গড়ে ১০-১২ ঘন্টা শ্রম নিংড়ে নেওয়া। তার কর্মীদের অধিকার সংক্রান্ত সাংবিধানিক বিধিনিয়ম মানামানি থাকে না। তাছাড়া, বিমুদ্রাকরণের অর্থনৈতিক জরুরী অবস্থার জেরে কাজের অসংখ্য ক্ষুদ্র-উদ্যোগী ক্ষেত্র চৌপাট হয়ে গেছে, যেগুলোর কোনো বিকল্প ক্ষেত্র তৈরি হয়নি। অতএব বেসরকারি ক্ষেত্রকে কাজের বাজার হিসেবে দেখিয়ে দেওয়া আসলে আলেয়ার পেছনে ছোটানো। মোদী সরকারের মস্তবড় ধাপ্পাবাজি। মোদী সরকার তাই কাজ দেওয়ার নয়, কাজ খেয়ে নেওয়ার সরকার ; দশগুণ বেকারি বৃদ্ধির সরকার।