প্রতিবেদন
উত্তরবঙ্গে চা-শিল্প শ্রমিকদের বঞ্চনার চালচিত্র

* চীনের সঙ্গে আফিম যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নতুন পুঁজি বিনিয়োগ ক্ষেত্র খোঁজার তাগিদে ব্রিটিশ শাসকেরা প্রথমে আসাম, কিছু বছর পরে উত্তরবাংলার ডুয়ার্স-তরাই- দার্জিলিং পাহাড়ে চা শিল্পের পত্তন ঘটায়।

* প্রায় দেড়শো বছর (১৮৬০-এর বেশি) আগে সাঁওতাল পরগণা, ছোটনাগপুর, মধ্যপ্রদেশ ও উড়িষ্যার দুর্ভিক্ষ পীড়িত আদিবাসী মানুষদের আড়কাঠিদের সাহায্যে প্রথমে নতুন জীবিকার লোভ, পরে আদিম দাসপ্রথার আদলে ভয় দেখিয়ে আসাম ও উত্তরবঙ্গের জঙ্গল ও পাহাড়ি অঞ্চলের প্রত্যন্ত ও দুর্গম প্রান্তে চা বাগানের ঘেরাটোপে 'বন্দী শ্রমিক' হিসাবে নিয়োগ করে।

* হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের বিনিময়ে পরিজন ও লোকবসতি থেকে বিচ্ছিন্ন এই অসহায় শ্রমিকদের অতি সামান্য হাজিরায় চা উৎপাদনের কাজে লাগাতে খুব বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয় নি অমানবিক ও নিষ্ঠুর সাহেব মালিক কর্তৃপক্ষের।

* বিগত শতাব্দীর চারের দশকের শুরুতে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের জোয়ারে মূলত কমিউনিস্ট কর্মীদের সাহসী প্রচেষ্টায় চা শ্রমিকেরা ইউনিয়নের পতাকা তলে সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে।

* স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শ্রমিক আন্দোলনের অভিঘাতে ১৯৫১ সালে 'চা বাগিচা শ্রমিক আইন' বলবৎ হয়। এই আইন বলে শ্রমিকদের মজুরি ও অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে কিছুটা সুরাহা হলেও ১৯৪৮ সালে প্রনয়িত 'ন্যূনতম মজুরি আইন'-এর আওতা থেকে তাঁরা বাদ পড়ে যান।

* ব্রিটিশ মালিক কর্তৃপক্ষের অপসারণের পর নতুন দেশী মালিকদের বৃহদংশের লক্ষ্য থাকে একইভাবে শ্রমিকদের মজুরি ও অন্যান্য প্রাপ্ত সুবিধাগুলি থেকে তাঁদের বঞ্চিত রেখে সর্বোচ্চ মুনাফার শোষনকাঠামো বজায় রাখা।

* ভারতে বিগত শতাব্দীর নয়ের দশকে অর্থনীতির পুঁজিবাদী কাঠামো সংস্কারের নামে প্রতিষ্ঠিত শিল্পক্ষেত্রগুলিকে পুঁজিপতিদের ফাটকা ব্যবসার বাণিজ্যবসতে পাল্টে ফেললে শ্রমকানুনের সামান্য সুবিধাগুলি থেকেও শ্রমিকেরা উত্তরোত্তর বঞ্চিত হতে শুরু করে।

* একবিংশ শতকের প্রথম বছর থেকেই উত্তরবাংলার চা শিল্পে শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের অনাহার ও অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর পরিঘটনাগুলি সামনে আসতে শুরু করে।

* ২০১৫ সালের মার্চ মাস থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ডুয়ার্সের কয়েকটি বন্ধ ও পরিত্যক্ত চা বাগানে এই মৃতসারণীর অন্তর্ভূক্ত হয় ৩০০-র বেশি সংখ্যায় অসহায় শ্রমিক পরিবারের সদস্য নারী, পুরুষ ও শিশুরা।

* বন্ধ বাগান থেকে আবারও নতুন জীবিকার খোঁজে বেরিয়ে এই অনভ্যস্ত, অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত শ্রমিকেরা নতুন দিনের পরিশীলিত আড়কাঠিদের মাধ্যমে পাড়ি দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে ভিনরাজ্যে। কমবয়সী মেয়েরা রাতের অন্ধকারে পাচার হয়ে চলেছে দেহবিক্রির ব্যবসায়। অশক্ত বৃদ্ধবৃদ্ধা ও শিশুরা অনাহারের শিকার।

* এই অন্যায় ও অসাম্যের অবসানে চা শিল্পে নিয়োজিত ২৯টি শ্রমিক সংগঠনের সম্মিলিত মঞ্চ ' জয়েন্ট ফোরাম' বিগত চার বছর ধরে মালিকদের বঞ্চনা ও মুনাফা পাচার এবং রাজ্য সরকারের অবহেলার অবসান চেয়ে দাবি তুলেছে (১) চা শিল্পশ্রমিকদের জন্য রাজ্য সরকারের ন্যূনতম মজুরি কাঠামো ঘোষণা, (২) বন্ধ বাগান খোলা, (৩) খাদ্য সুরক্ষা আইন বলবত হওয়ার পরে রেশন বাবদ টাকা মজুরির সঙ্গে যুক্ত করা, (৪) স্থায়ী শ্রমিক পরিবারগুলির জন্য শ্রমিক বস্তীগুলিতে বসতজমির পাট্টা প্রদান ইত্যাদি।

* এছাড়াও শতাব্দীপ্রাচীন চা গাছগুলি তুলে ফেলে নতুন চা গাছ রোপনে মালিকদের বাধ্য করা, মুনাফার বৃহদংশ চা শিল্পে পুনর্বিনিয়োগ করা, শ্রমিকদের স্বোপার্জিত পিএফ, গ্র্যাচুইটি, পেনশন আত্মসাৎ করা মালিক কর্তৃপক্ষের কঠোর শাস্তি, বন্ধ ও রুগ্ন বাগানগুলিকে সরকারি টি ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন কর্তৃক অধিগ্রহণ করে অন্তত আগামী ১০ বছরের সময়সীমায় পুনরায় লাভজনক করে তোলা।

* চা শিল্পে এতাবৎ পুঁজি বিনিয়োগ বা অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে কোন সঙ্কট নেই। ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে চা উৎপাদন ও বিদেশে রপ্তানির সর্বোচ্চ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে।

খণ্ড-25
সংখ্যা-29