আধারের রায় বেরিয়েছে। কি বলা আছে সেই রায়ে। বলেছে কোনো প্রাইভেট কোম্পানি আপনার আধার নিতে পারবে না, আপনি ভাবছেন কি ভালো রায় দিল। আপনাকে বলা হল ব্যাঙ্কে লিঙ্ক করতে হবে না কিন্তু প্যারন-এ লিঙ্ক করতে হবে। তাহলে কি দাঁড়াল ইনকাম ট্যাাক্স রিটার্ন দিতে গেলে আধার লাগবে। তাহলে ঘুরিয়ে নাক দেখান হল না? আপনার বাচ্চার আধার লাগবে না, কিন্তু ১৮ বছর পর লাগবে তাহলে কি দাঁড়াল? সোজা কথা সব কিছুতেই আধার বাধ্যোতামূলক। আজ অথবা কাল ।
বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেছেন যে যেহেতু এটা মানি বিল দিয়ে রাজ্যতসভায় পাশ করানো হয়েছে সেহেতু এটা অসাংবিধানিক। তাহলেও এই আধার আইনকে ফেলে দেওয়া যাবে না, কারণ ৫ জন বিচারপতির মধ্যে ১ জন সংখ্যাালঘু।
ভারতবর্ষে কেন কোথাও সংখ্যােলঘুর মত শোনা হয় না, হবে না।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং ভারতের বিরোধী দলনেতা দুজনেই এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু তাদের দুজনের কাছেই প্রশ্ন।
১। আধার অ্যাক্ট ২০১৬ যদি বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের মত অনুযায়ী অসাংবিধানিক হয়ে থাকে তাহলে কি আধার অ্যাক্টের ৭ নং ধারা কার্যকরী হয়? হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও হবে তার কারণ বিচারপতি চন্দ্রচুড় নিজেই আধার বেঞ্চে সংখ্যারলঘু।
২। আধার আইন-এর ৭ নং ধারা কার্যকরী করা হলে তো রোজ আরও বহু মানুষ ভাত চাইতে চাইতে অনাহারে ঝাড়খণ্ডে মারা যাওয়া সন্তোষীদের তালিকায় যুক্ত হবে।
৩। আধার শুধুমাত্র আমি আমার মোবাইলে আধার কিংবা ব্যাাঙ্কে আধার যুক্ত করছি কিনা সেই প্রশ্ন নয়, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন আধার কি আদৌ একটা পরিচয়পত্র? যা দিয়ে আমাকে চেনা সম্ভব?
ঘুরিয়ে প্রায় গোটা দেশের জন্যই বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হল আধার। ওপরের দিকে আয় এমন ৮-১০ শতাংশ মানুষকে আয়কর দিতে হয়। তাদের জন্য আধার লাগছেই।
অন্যদিকে ভরতুকি পান প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ। তলার দিকের আয়ের এইসব মানুষদেরও আধার লাগবে।
আধারের রায়কে এভাবে স্বাগত জানানোর বদলে তার সম্পর্কে বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের বিশ্লেষণগুলি ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করা দরকার। সেই মতো সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বেঞ্চে সংখ্যালঘু আজ, কিন্তু মূল্যবান। হয়তো ভবিষ্যতে এই সংখ্যা লঘু মতটাই সংখ্যাবগুরুর মত হিসেবে উঠে আসবে। কিন্তু ততদিনে না বড় দেরি হয়ে যায়।
ঝাড়খন্ডের সন্তোষীর কথা নিশ্চিত ভুলে গেছেন। সেই ১১ বছরের মেয়েটি যে দুমুঠো ভাতের জন্য মারা গেছিল। সিমডেগা জেলার ছোট মেয়েটির মৃত্যুর ১ বছর পূর্ণ হবে আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর।
ভারতে অনাহারে মৃত্যু নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা বলছেন যে গত ৩ বছরে সন্তোষী সহ ৫৬ জন মারা গেছেন অনাহারে। তার মধ্যে ৪২ জন ঝাড়খন্ডে আর ১৪ জন উত্তরপ্রদেশে। একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এই গবেষকেরা লিখেছেন, এই অনাহার মৃত্যু র পরিসংখ্যাবন দেখিয়ে দেয় ভারতবর্ষে মানুষ কিভাবে বাঁচে অথবা বাঁচেও না। একটা সুস্হ গণতন্ত্রে এ ধরনের ঘটনা সমস্ত খবরের কাগজে প্রথম পাতায় থাকতো, তার পরে তা নিয়ে বিতর্ক হতো , কি করে এই সমস্যা মানে অনাহারে মৃত্যুটর যন্ত্রণা থেকে বেরোনো যায়? কিন্তু আমাদের দেশে এই অনাহারে মৃত্যু খবর হয় না, ব্রেকিং নিউজ হয় না। আর মৃত্যুর মিছিলও এগিয়ে চলে। ১ থেকে ২ হয়ে ৫৬ ... আর কত মানুষ মরলে তবে মানবে তুমি শেষে/ বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে।
সমাজকর্মী সিরাজ দত্ত, রিতিকা খেরা এবং অর্থনীতিবিদ জন ড্রেজ সহ অন্যান্যরা এই কাজটা করতে গিয়ে দেখেছেন যে এই মানুষগুলোর কাছে খাবার এবং পয়সা কোনোটাই ছিল না। খিদের জন্য মানুষ মারা যায় এই একবিংশ শতাব্দীতে এটা ভাবা না গেলেও সত্যিে। সন্তোষী ‘ভাত ভাত’ করতে করতে মারা যায়, তারপর জানা গেছিল যে আধার সংযোগ না হবার জন্য তাদের বাড়ির রেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছিল। ঝাড়খন্ডের। বেশীর ভাগ গরীব মানুষই পাব্লিক ডিস্ট্রিবিউশন স্কিমের সাথে এবং এনএপিএস বা ন্যাশনাল পেনশন অ্যাসিসটেন্স সাথে যুক্ত। তাদের বেশিরভাগই দলিত, আদিবাসী এবং মুসলমান।
ঝাড়খন্ডে এবিবিএ অর্থাৎ আধার বেসড বায়োমেট্রিক অথেনটিকেশন বাধ্যনতামূলক। উত্তরপ্রদেশেও তাই। যদিও দেখা যাচ্ছে এই ব্যা বস্হার ফলে বহু মানুষ বাদ যাচ্ছেন এবং মারা যাচ্ছেন তাও কেন্দ্রীয় সরকার এটাকে সমস্ত দেশে বাধ্যরতামূলক করার জন্য সচেষ্ট। আসলে এর মাধ্যমে বহু মানুষকে বাদ দেওয়া যাবে এবং সেই সরকারী সুবিধাকে সাইফন করে অন্য জায়গায় পাঠানোর জন্যই এই ব্যবস্থা। দুর্নীতিকে বৈধতা দেওয়ার জন্যই আধার।
আজ যদি ফিরে তাকাই প্রথম যিনি আধার পেয়েছিলেন সেই মহিলা মহারাষ্ট্রের তেম্বুলি গ্রামের রঞ্জনা সোনাওয়ানের দিকে তাকালেই আধারের এই রায়ে কার লাভ কার ক্ষতি পরিস্কার বোঝা যাবে।
মুম্বাই এর ৪১৫ কিমি দূরের সেই গ্রামে যে মাটির বাড়িতে থাকতেন এখনো সেই বাড়িতেই থাকেন।
তারা ভেবেছিলেন হয়তো তাদের কিঞ্চিৎ কিছ উপকার হবে কিন্তু তা তো হয়নি। তারা এখন বলেন তাহলে কি লাভ হল ? এমনকি সেই আধারে যে নামের ভুল আছে সেটাও তো ঠিক করতে আবার ২০০ টাকা খরচ করতে হবে। ওনারা তখন ৫টা ব্যাাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন এখনো সেগুলোতে টাকা আসেনি। ৫ বছর আগে একবার বড় ছেলের জন্য ১০০০ টাকা এসেছিল তারপর আর আসেনি। ওই গ্রামের আরও অনেকেই মনে করেন যে আধারের জন্য হয়তো অনেক পরিচয়পত্র নিতে হয় না, কিন্তু কোনো আলাদা লাভ হয়নি। স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পে একটা বাথরুম বানানোর জন্য রঞ্জনা দরখাস্ত করেছেন, কিন্তু তিনি পাচ্ছেন না, কারণ তার নাম তালিকায় নেই। আধার দিয়েও পাচ্ছেন না, তাহলে কি দাঁড়ালো?
আমরা যারা উল্লসিত আধারের এই রায় নিয়ে তাদের কাছে দুটো কথা।
১। বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন, আমেরিকার সংবিধান রচনা করার সময়ে বলেছিলেন “যারা নিজেদের সাময়িক সুবিধা পাওয়ার জন্য, নিজেদের স্বাধীনতা, আত্মসম্মান বোধ বিসর্জন দিয়ে দিতে পারে, তারা স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা কোনোটা পাওয়ারই যোগ্য নন”।
২। আমেরিকার সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি চার্লস ইভান্স হুগেস বলেছিলেন, “সর্বোচ্চ আদালতের কোনো ভিন্নমত পোষণ করা এটাই দেখিয়ে দেয় যে ভবিষ্যতে হয়তো আজকে যেটা সত্যি বলে মনে হচ্ছে, আজকে যেটা ন্যায়ালয়ে সবাই ঠিক বলে মনে করছে, সেটা সংশোধন হবে”। ভবিষ্যৎ কি বলবে লড়াইয়ের কথা? না মেনে নেওয়ার কথা?