(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২ অক্টোবর ২০১৮)
লক্ষ্ণৌতে পুলিশের গুলিতে বিবেক তেওয়ারির হত্যা উত্তরপ্রদেশ পুলিশ এবং আদিত্যনাথ সরকারকে রক্ষণাত্মক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। এই ধরনের হত্যা উত্তরপ্রদেশে কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, বস্তুত, উত্তরপ্রদেশ সরকার নিয়মিতভাবেই এই ধরনের হত্যাকাণ্ডকে উত্তরপ্রদেশকে অপরাধ-মুক্ত করে তোলার লক্ষ্যে সরকারের অঙ্গীকার ও প্রগতির প্রমাণ হিসাবে জাহির করে এবং তাকে বাহবাও দেয়। কিন্তু বিচার-বহির্ভূতভাবে বা হেফাজতে যাদের হত্যা করা হয়, তাদের অধিকাংশই অ-সুবিধাভোগী পৃষ্ঠভূমির মুসলিম বা দলিত হলেও বিবেক ছিল গুরুত্বপূর্ণ আই টি কোম্পানি অ্যাপলের কর্মী এবং জাত ও শ্রেণীর বিচারে সে ছিল সমাজের সুবিধাভোগী অংশেরই মানুষ। তার পরিবার কোনো রাখঢাক না করেই বলেছিল যে, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে যোগীর নিয়োগে তারা খুশিই হয়েছিল এবং কখনই ভাবতে পারেনি যে, তাদের নিজেদেরই কাউকে পুলিশের হাতে কাশ্মীর-ধরনের নিপীড়নের শিকার হতে হবে।
মোদী-যোগী সরকারের প্রশাসনিক মডেলের বৈশিষ্ট্যই হল বিচার-বহির্ভূত হিংসাকে স্বাভাবিক ব্যাপার করে তোলা, তা সে হিংসা সংঘর্ষের নামে পুলিশই চালাক, আর সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বিশ্বাস এবং লোকাচারের মান্যতাকে সুনিশ্চিত করার নামে খুনে বাহিনীই চালাক। মোদী এবং অমিত শাহ গুজরাটে এই প্রশাসনিক মডেলটাকে নিখুঁত করে তুলেছিলেন আর যোগী আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশে সেটারই পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছেন। উত্তরপ্রদেশে ২০১৭-র এপ্রিল থেকে ২০১৮-র ফেব্রুয়ারির মধ্যে হেফাজতে হত্যার একেবারে ৩৬৫টি ঘটনার খবর বেরিয়েছে। যোগীর শাসনাধীনে প্রথম দশ মাসে ৯২১টি তথাকথিত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে যাতে ৩৩ জন মানুষ নিহত হয়েছে। বিবেক তেওয়ারি হত্যার মাত্র এক সপ্তাহ আগেই আলিগড়ে ২০ সেপ্টেম্বর ভোরবেলা পুলিশ সাংবাদিকদের উপস্থিতিতেই সরাসরি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটায় যাতে তারা যুবক মুস্তাকিম এবং নৌশাদকে গুলি করে হত্যা করে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশাসনিক মডেলটা আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচারের নীতি ভিত্তিক মডেলের সঙ্গে খাপ খায় না। গোটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটাকে ধ্বংস করার মধ্যে দিয়ে শাসকরা নিজেদের শাস্তিহীনতাকে চূড়ান্তরূপে সুরক্ষিত করেছে এবং এটাও সুনিশ্চিত করেছে যে, অভিযোগ দায়ের হওয়া এবং তদন্তের স্তর থেকে পরবর্তী পর্যায়ের বিচার প্রক্রিয়া এবং বিচারের রায়ের স্তর পর্যন্ত ন্যায় বিচারের প্রক্রিয়া যেন নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে। একের পর এক সাক্ষীকে হত্যা, বিচারপতিদের রহস্যজনক মৃত্যু এবং বেছে বেছে কিছু মামলায় বিচার চালানো—এ সবই সংঘীয় রাষ্ট্র পরিচালনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সংঘর্ষে হত্যার প্রতিটি ঘটনাতেই পুলিশকে পুরষ্কৃত করা হয় আর বিবেক তেওয়ারির ক্ষেত্রে ডিজিপি এবং মুখ্যমন্ত্রী তার হত্যায় নিন্দা জানালেও সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিযুক্তদের সমর্থনে প্রচার চলতে দেখা যাচ্ছে।
ফ্যাসিবাদ বিচার-বহির্ভূত প্রক্রিয়াকে যেভাবে স্বাভাবিক ব্যাপার করে তুলতে সমর্থ হয় তা হল, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে এই বলে আশ্বস্ত করা যে হিংসা ‘ওদের’ জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু বিবেক তেওয়ারির মর্মান্তিক হত্যা দেখিয়ে দিচ্ছে যে কারুর জন্যই স্থায়ী বা সুনিশ্চিত রেহাই নেই। নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিভাজন ঘটানো যায় না—আমরা যদি নিরাপদ এবং সুরক্ষিত থাকতে চাই এবং স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে চাই তবে অন্যদের ক্ষেত্রেও সেই একই রীতি আমাদের মেনে চলতে হবে এবং সকলের ক্ষেত্রেই নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, স্বাধীনতা ও ন্যায় বিচারের সেই একই মানকে সুরক্ষিত করতে হবে। বিচার-বহির্ভূত হিংসা যে বিপদ ডেকে আনে, বিবেক তেওয়ারির হৃদয়বিদারক হত্যা সে সম্পর্কে সারা ভারতের চোখ খুলে দিক।
এটা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার যে, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক শাখা যেখানে গণতন্ত্রের দমনে বদ্ধপরিকর, বিচারবিভাগ এখনও মাঝে-মধ্যে রাষ্ট্রের রাশ টেনে ধরে নাগরিকদের সাংবিধানিক স্বাধীনতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। যে মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী গৌতম নাভালাখাকে পুনে পুলিশ দানবীয় ইউএপিএ আইনে গ্রেপ্তার করতে চাইছিল, তাকে মুক্ত করার নির্দেশ দিয়ে দিল্লী হাইকোর্টের রায় সংবিধান এবং স্বাধীনতা ও ন্যায় বিচারের বুনিয়াদি নীতিমালার রক্ষায় এক স্মরণীয় রায় হয়েই থেকে যাবে। সংঘর্ষ রাজ, অরাজক জনতার দ্বারা গণপিটুনি এবং ডাইনি খোঁজার মতো মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীদের পিছু ধাওয়া করা—এগুলি হল সাংবিধানিক স্বাধীনতা এবং সহজাত ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে বর্তমানে রাষ্ট্র–চালিত যুদ্ধের তিনটি প্রধান অবলম্বন। আত্মপরিচয় এবং মতাদর্শ নির্বিশেষে ভারতবর্ষের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ এবং দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়িয়ে এই ফ্যাসিবাদী আক্রমণের মোকাবিলা করে সংবিধানকে রক্ষা করতে হবে। ‘পুলিশ রাষ্ট্রকে’ স্বাভাবিক করে তোলাটাকে সমস্ত উপায়েই প্রতিহত করতে হবে।