আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে
১) বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট এবং তার প্রতিকারে নয়া - উদারবাদী সরকারগুলো যে দাওয়াই প্রয়োগ করছে (কর্পোরেটদের জন্য বেল আউট আর সাধারণ জনগণের জন্য ব্যয় সংকোচনের পদক্ষেপ) তা গত এক দশকে বেকারি, কাজের ও জীবনধারণের পরিস্থিতির অবনতি ও বিপন্নতা এবং ক্রমেই তীব্রতর হয়ে ওঠা অসাম্যকে বাড়িয়ে তুলেছে। বিশ্বে অসাম্য সম্পর্কে সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে গত এক দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতে আয়ের কেন্দ্রীভবন ১৯২০-র দশকের স্তরে পৌঁছেছে।
২) ২০১৭-১৮ রুশ বিপ্লবের শতবার্ষিকী এবং কার্ল মার্কস-এর পুঁজি গ্রন্থের সার্ধ শতবার্ষিকী বছর। সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্বর্তন প্রদেশগুলো এখনও যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন-সৃষ্ট ধাক্কাকে কাটিয়ে উঠতে পারেনি, সেখানে ক্রমবর্ধমান অসাম্য এবং জনকল্যাণ বরাদ্দে ব্যাপক পরিমাণ ছাঁটকাটের মুখোমুখি হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেন সহ বিশ্বের অনেক দেশেই সমাজতন্ত্রের ধারণার আবেদনের পুনরুজ্জীবন দেখা যাচ্ছে।
৩) সুগভীর নিরাপত্তাহীনতা এবং বঞ্চনার এই পরিমণ্ডল যে সারা বিশ্বে ফ্যাসিবাদী এবং স্বৈরাচারী শক্তিগুলোর উত্থানের উর্বর ভূমি হয়ে উঠেছে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এই শক্তিগুলো অসাম্য ও নিরাপত্তাহীনতার জন্য নয়া-উদারবাদী নীতিগুলোর বদলে সংখ্যালঘু এবং অভিবাসীদের ওপর দায় চাপিয়েছে। এই শক্তিগুলো একদিকে ‘জাতীয়তাবাদ’-এর ভেক ধরে বিদেশাতঙ্ক (জেনোফোবিয়া) ও ইসলামাতঙ্ককে (ইসলামোফোবিয়া) উসকিয়ে তুলে এবং অন্যদিকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবন এবং জাতীয় “মহত্বর” প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি ঘটিয়েছে এবং নাটকীয় নির্বাচনী সাফল্যও অর্জন করেছে।
৪) এই শক্তিগুলো যেখানে যেখানে ক্ষমতায় আসীন হয়েছে সেই জমানাগুলোর বৈশিষ্ট্য রূপে সামনে এসেছে ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীগুলো দ্বারা সংগঠিত বর্ণবাদী/ সাম্প্রদায়িক হিংসা; ভিন্নমত প্রকাশ, নাগরিক স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ; নারীবাদ-বিরোধী রাজনীতির তীব্রতা বৃদ্ধি এবং নারীদের অধিকারের উপর আক্রমণ; মিথ্যা সংবাদ প্রচারের মধ্যে দিয়ে ঘৃণা ও বিদ্বেষকে উসকিয়ে তোলা; এবং এগুলোর সাথে ব্যক্তিপূজা এবং একক শক্তিশালী নেতার হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন। ভারতে মোদী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প এই ধরনের রাজনীতির দুই সাম্প্রতিক সফল দৃষ্টান্ত। ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বাড়বাড়ন্তের অন্যান্য দৃষ্টান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে ফ্রান্সে মারি ল পেন-এর ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এফএন), জার্মানিতে দ্য অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি), নয়া নাজিদের সাথে সংযোগ থাকা অস্ট্রিয়ার ফ্রিডম পার্টি এবং গ্রেট ব্রিটেনের সফল ব্রেক্সিট ভোট।
৫) তুরস্কে এর্দোগান এবং রাশিয়ায় পুতিনও সাম্প্রতিক কালে সেই সমস্ত নেতাদেরই উদাহরণ যাঁরা নিজ নিজ দেশের স্বৈরাচারী জমানার ওপর তাদের কব্জাকে শক্তিশালী করে তুলেছেন। এই জমানাগুলো রূপের দিক থেকে গণতন্ত্র হিসেবে চলতে থাকলেও অন্তর্বস্তুতে সেগুলো চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক জমানা রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে: বিরোধী মতামত দমন করে, গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে এবং দেশের সংবিধানকে নতুনভাবে রচনা করে সেগুলো এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যাতে এই নেতারা কার্যত অনির্দিষ্টকাল ধরে শাসন চালাতে পারেন। স্বৈরাচার দেশপ্রেমের ভেক ধরেছে। পুতিন সরকার রাশিয়ার শাসকচক্রের পুঁজিপতিদের স্বার্থ সুরক্ষিত ও তাদের আনুগত্য নিয়ন্ত্রণ করে, পুতিন নিজেই যে পুঁজিপতিদের অন্যতম।
৬) ট্রাম্প একদিকে ‘হোয়াইট-ল্যাশ’-কে — বিত্তশালী অভিজাতদের আগ্রাসী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীতার আত্মঘোষণা—সংহত করে এবং অন্যদিকে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ কর্মহীন শ্রমিক শ্রেণীর ক্ষোভ ও নিরাপত্তাহীনতার বোধকে বর্ণবাদী এবং বিদেশাতঙ্কের ধারায় চালিত করে বিজয় হাসিল করেন। ট্রাম্প নিজে ধনকুবের ব্যবসায়ী এবং তিনি এমন অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করেছেন যা নয়া-উদারবাদী ব্যবস্থাকে বিন্দুমাত্র চ্যালেঞ্জ জানায় না। তিনি একদিকে শ্রমিকদের অধিকার এবং কল্যাণের ওপর তীব্র আক্রমণ হানছেন, অন্যদিকে অভিবাসনকে আটকে দিয়ে বেকারি সমস্যার সমাধান করার দাবি করছেন।
৭) ট্রাম্পের বিজয় শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী শক্তিগুলোকে স্পর্ধিত করে তুলেছে যার ফলে অভিবাসী এবং কালো মানুষদের বিরুদ্ধে ঘৃণাজাত অপরাধগুলো বেড়ে উঠেছে। ফ্যাসিবিরোধী প্রতিবাদগুলোকে ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠিগুলো চালিত সংগঠিত হিংসার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
৮) ট্রাম্প সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসংখ্যার সাতটি দেশ থেকে জনগণের আমেরিকায় আসার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন এবং মেক্সিকোরই খরচে মেক্সিকোর সীমানা বরাবর পাঁচিল তোলা নিয়ে যে অনড় মনোভাব দেখিয়েছেন তা ট্রাম্পের অভিপ্রেত নির্ভেজাল ইসলামোফোবিয়া এবং বর্ণবাদী পলিসি কাঠামোর উদাহরণ।
৯) নির্বাচনী প্রচার পর্যায়ে ট্রাম্প পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিরোধিতা করেছিলেন এবং সারা বিশ্বে খবরদারি করার পরিবর্তে ‘সর্বাগ্রে আমেরিকা’ কর্মপ্রণালী গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এখন এটা পরিষ্কার যে, তার পূর্বসুরীদের মতই তিনিও যুদ্ধবাজি এবং সরকার পরিবর্তনের সাম্রাজ্যবাদী এজেণ্ডার প্রতি একনিষ্ঠ।
১০) ট্রাম্প উত্তর কোরিয়া এবং ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক আস্ফালন করছেন এবং এমনকি টুইটারের মতো উত্তেজনা প্রবণ মঞ্চ থেকে বিপজ্জনকভাবে পারমাণবিক পেশী জাহির করছেন। মার্কিন প্রশাসন বর্ণবাদী প্রচারের ভিত্তিতে উত্তর কোরিয়াকে দানব রূপে প্রতিপন্ন করে তার বিরুদ্ধে চালানো অর্থনৈতিক যুদ্ধ এবং সামরিক ঘেরাওকে যুক্তিযুক্ত করে তুলছে। মার্কিনের অন্যায় হস্তক্ষেপকে প্রতিহত করার পদক্ষেপ হিসেবে উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া পরস্পরের সঙ্গে যে আলোচনা শুরু করেছে, তা যথেষ্ট উৎসাহ জাগায়।
১১) ট্রাম্প চীনের সাপেক্ষে সংরক্ষণ নীতি গ্রহণের হুমকি দিচ্ছেন — এই পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গী এই বিষয়টির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থেকেছে যে, চীনও তার অভ্যন্তরীণ বাজারে মার্কিন বিনিয়োগের দরজা বন্ধ করে দিয়ে প্রতিশোধ নিতে পারে এবং এরমধ্যে দিয়ে চীনে ভালো মাত্রায় পা রাখা মার্কিন কর্পোরেশনগুলো যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ‘সর্বাগ্রে আমেরিকা’ পলিসির নাম নিয়ে ট্রাম্প প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক অংশীদারিত্ব চুক্তি থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে নিয়েছেন, যেটি ছিল ১২ দেশের এক বাণিজ্য চুক্তি এবং যার নাকি চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন এক ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি হওয়ার কথা ছিল। চীন এই প্রত্যাহারকে কাজে লাগিয়েছে। ভূরাজনৈতিক স্তরে ট্রাম্প প্রশাসন তার পূর্বসূরীদের চালিয়ে যাওয়া চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার নীতিকে তীব্রতর করে তুলেছে। এই নীতির অনুসারী হয়ে ট্রাম্প প্রশাসন এই অঞ্চলকে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বলার বদলে ‘ভারত- প্রশান্ত মহাসাগরীয়’ অঞ্চল বলে উল্লেখ করতে শুরু করেছে। ট্রাম্প সম্প্রতি আমদানিকৃত ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের উপর যথাক্রমে ২৫ শতাংশ ও ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসানোর পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছেন, যার মূল লক্ষ্য হল সস্তায় ধাতুদ্ৰব্য রপ্তানির জন্য চীনকে শাস্তি দেওয়া। এই আমদানি শুল্ক চাপানোর ফলে ভারতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই ক্ষেত্রে আমেরিকার দু-মুখো নীতি সুস্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে, কেননা, একদিকে সে নিজের দেশের শিল্পগুলোর সুরক্ষায় শাস্তিমূলক আমদানি শুল্ক চাপাচ্ছে, আর অন্যদিকে একই ব্যবস্থা নেওয়া থেকে ভারতের মতো দেশগুলোকে আটকানোর জন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাচ্ছে।
১২) চীনকে নিয়ন্ত্রিত করার তার রাজনৈতিক পলিসির অঙ্গ হিসাবে ভারতকে তাতে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ট্রাম্প পাকিস্তানকে দেওয়া আর্থিক সাহায্য বন্ধের প্রস্তাবের প্রকাশ্য ঘোষণা করেছেন। ট্রাম্প পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়া এবং চীনের এক অঞ্চল এক রাস্তা প্রকল্প সম্পর্কে ভারতের অবস্থান সমর্থন করেছেন, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নতুন নামকরণ করেছেন ভারতীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, ভারত আফগানিস্তানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকায় অবতীর্ণ হবে বলে ঘোষণা করেছেন এবং হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত গ্লোবাল এন্ট্রেপ্রেনিয়রশীপ শীর্ষ বৈঠকে যোগ দিতে তার কন্যা এবং রাষ্ট্রপতির পরামর্শদাতা ইভাঙ্কা ট্রাম্পকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু ভারতের সঙ্গে এই রণনৈতিক আলিঙ্গনের—যার মধ্যে ভারতের শুধু কিছু প্রসাধনিক লাভেরই সম্ভাবনা—সাথেই আসছে এইচ-১বি ভিসার সম্প্রসারণে লাগাম টানার মতো সংরক্ষণবাদী নীতি যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত হাজার হাজার দক্ষ ভারতীয় কর্মীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত হওয়ার আশঙ্কাকে সামনে নিয়ে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত হিন্দুত্ব লবি ট্রাম্পের অভিবাসী বিরোধী পলিসিকে সমর্থন জানালেও তারা কিন্তু তীব্রতর হয়ে ওঠা বর্ণবাদী ও বিদেশাতঙ্ক প্রসূত আক্রমণগুলো সম্পর্কে মুখ বুজে থাকছে, ভারতীয়দেরও যে আক্রমণগুলোর মুখে পড়তে হচ্ছে।
১৩) রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের জমানা ইজরায়েলি দখলদারি-র প্রতি নির্লজ্জ সমর্থনও দিয়ে চলেছে—ইজরায়েলের রাজধানী রূপে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দেওয়ার পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে যা প্রমাণিত হচ্ছে। অন্যান্য দেশগুলোকে হুমকি দিয়ে ও ভয় দেখিয়ে জেরুজালেম প্রশ্নে নিজেদের অবস্থানে-র পক্ষে সমর্থন আদায়ের ট্রাম্প প্রশাসনের প্রচেষ্ট সত্ত্বেও রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে তারা ব্যাপক বিচ্ছিন্নতার মুখে পড়ে এবং নিরাপত্তা পরিষদ নির্ণায়কভাবে ঐ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ভোট দেয়।
১৪) ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব) গ্রেট ব্রিটেনের গণভোটে অপ্রত্যাশিত জয়লাভ করে এবং ইউকেআইপি-এর মতো দক্ষিণপন্থী দলগুলোর বিদেশাতঙ্কের লাগাতার প্রচার এবং রক্ষণশীল দলের একটি গোষ্ঠীর ‘লিভ’-কে সমর্থনের কারণেই ওই বিজয় আসে। এই প্রচার ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটকে অভিবাসী এবং শরণার্থীদের বিরুদ্ধে গণভোটে পরিণত করে, সরকারি ব্যয় সংকোচনের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে জনগণের ব্যাপক ক্রোধ এবং উদ্বেগকে কাজে লাগিয়ে ঐ প্রচার বর্ণবাদী এজেণ্ডাকে উস্কিয়ে তোলে। গ্রেট ব্রিটেনে ব্রেক্সিট বিজয়ী হওয়ার পর বর্ণবাদী, বিদেশাতঙ্ক এবং ইসলাম আতঙ্ক সৃষ্ট হিংসায় লক্ষ্যণীয় বৃদ্ধি ঘটে।
১৫) ব্রেক্সিট গণভোট যদি গ্রেট ব্রিটেনের সমাজের গভীরে শিকড় চাড়ানো বর্ণবাদকে উন্মোচিত করে থাকে, তবে পরবর্তীতে ঘটনাবলীর বিকাশ দেখিয়েছে যে সেখানে একই সাথে দৃঢ় বামপন্থী রাজনীতির সম্ভাবনাও রয়েছে যা ব্যয় সংকোচন এবং নয়া-উদারবাদের বিরুদ্ধে ইতিবাচক অনুপ্রেরণাময় বিকল্প নীতির কথা বলে। গ্রেট ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ২০১৭-র জুন মাসে হঠাৎ যে নির্বাচন ডাকেন তাতে মে-র কনজার্ভেটিভ পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় এবং জেরেমি করবিনের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি তাদের আসন সংখ্যাকে ৩০ থেকে বাড়িয়ে ২৬২-তে নিয়ে যায় এবং তাদের প্রাপ্ত ভোটের হারও বাড়ে ১০ শতাংশ। করবিন ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে তাঁর নিজের দলের মধ্যকার ব্লেয়ারপন্থীদের পরাজিত করে লেবার পার্টির নেতা নির্বাচিত হন এবং তিনি নির্বাচনী প্রচারে ‘অনেকের জন্য, অল্প কয়েক জনের জন্য নয়’ শ্লোগানকে তুলে ধরে তরুণ ভোটারদের সক্রিয় সমর্থন লাভ করেন। করবিনের এজেণ্ডাকে উপহাস করতে এবং তার দানবীয়করণ ঘটাতে প্রচারমাধ্যম ওই এজেণ্ডাকে অকার্যকর ও বিপজ্জনকভাবে বামপন্থী বলে লাগাতার প্রচার করে চলা সত্ত্বেও করবিন সাফল্য লাভ করেন।
১৬) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং গ্রেট ব্রিটেনে দক্ষিণপন্থী এবং ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলোর উত্থান যখন দেখা যাচ্ছে, তখন এটা স্মরণ করা জরুরি যে, প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী নির্বাচনের জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টির অভ্যন্তরীণ নির্বাচনে স্বঘোষিত ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী’ বার্নি স্যাণ্ডার্স তাঁর স্পষ্টতই বামঘেঁষা এজেণ্ডাকে তুলে ধরে কীভাবে তরুণদের মধ্যে যথেষ্ট উদ্দীপনা ও সক্রিয়তা জাগিয়ে তোলেন। বাসস্থানের অধিকার এবং শ্রমিক শ্রেণীর জন্য ন্যূনতম মজুরির এজেণ্ডাকে সামনে এনে সমাজতান্ত্রিক বিকল্প দলের প্রার্থী খাসমা শাওয়ান্ত-এর সিয়াটল সিটি কাউন্সিল নির্বাচনে পরপর দুবার বিজয় বাম রাজনীতির সম্ভাবনা ছোট হলেও উৎসাহজনক সংকেত দেয়।
১৭) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের উত্থান প্রগতিশীল শক্তিগুলোকে ফ্যাসিবিরোধী ঐক্য গড়ে তুলে তার প্রতিরোধেও উজ্জীবিত করেছে। পুলিশের হাতে কালো মানুষের হত্যা ও তাদের ওপর আক্রমণের মোকাবিলায় ওবামা শাসনের দ্বিতীয় পর্বে শুরু হওয়া ‘কালো মানুষের জীবনেরও মূল্য আছে’ আন্দোলন এই প্রতিরোধের অন্যতম মূল শক্তি হয়ে উঠেছে। ট্রাম্প জমানার একেবারে প্রথম দিন থেকেই নারীবাদী, ল্যাটিনো শ্রমিক, কালো মানুষ সম্মিলিতভাবে বিশাল ট্রাম্প-বিরোধী সমাবেশগুলো সংগঠিত করেছেন। যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে চালিত ‘আমিও’ এবং ‘সময় শেষ’ আন্দোলনগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীবাদী আন্দোলনের কাছে এক মোড় হয়ে উঠেছে এবং আন্তর্জাতিক স্তরেও এর অনুরণন শোনা গেছে।
১৮) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারীবাদী আন্দোলনে কিছুটা পুঁজি-বিরোধী এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জোর পড়তে দেখা গেছে এবং ২০১৭ ও ২০১৮ সালে ৮ মার্চ (নারী দিবসে) আন্তর্জাতিক স্তরে নারীরা ধর্মঘট সংগঠিত করেছেন। আন্তর্জাতিক স্তরে নারী ধর্মঘট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সাথে অন্য আরো ৫০টি দেশে বিপুল সাড়া পেয়েছে।
১৯) গ্রীসে ব্যয় সংকোচন বিরোধী প্রতিবাদের জোয়ারের ওপর ভর করে বামপন্থী জোট সিরিজা নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০১৫-র জানুয়ারি মাসে সরকার গঠন করে (দক্ষিণপন্থী এএনইএল-এর সাথে জোট বেঁধে)। গ্রীসে ঋণ সংকটের প্রেক্ষাপটে গ্রীসকে বেলআউট করতে ইউরোপিয়ান কমিশন, আইএমএফ এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের চাপানো শর্ত গ্রীস মেনে নেবে কিনা তা নিয়ে এলেক্স সিপ্রাসের নেতৃত্বাধীন সিরিজা সরকার ২০১৫-র জুনে এক ঐতিহাসিক গণভোটের ডাক দেয়। গ্রীসে ব্যাপক সংখ্যাধিক জনগণ ‘না’-এর পক্ষে রায় দেন। এই গণভোটের রায়কে অগ্রাহ্য করে এক মাস পর বেল আউটের শর্তের কাছে সিরিজা সরকারের আত্মসমর্পণের পরিণতিতে সিরিজা সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৫-র সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সিরিজা-এএনইএল জোট পুনরায় নির্বাচিত হয়, কিন্তু তারপর থেকেই তাদের বিশাল প্রতিবাদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এই গণ আন্দোলনগুলোর কেন্দ্রে রয়েছে ট্রেড ইউনিয়ন ও বামপন্থী শক্তিগুলো। গ্রীসে অবশ্য ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থানও দেখা গেছে।
২০) ফিদেল কাস্ত্রোর প্রয়াণের পরবর্তী পরিস্থিতিতেও কিউবা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে তার স্বাধীনতার আত্মঘোষণা করে চলেছে। ওবামা প্রশাসন কিউবার ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পদক্ষেপ নিয়েছিল কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সেই পদক্ষেপগুলো বাতিল করছে। কাস্ত্রোর মৃত্যুর পর ট্রাম্প তাঁর টুইটগুলোর মধ্যে দিয়ে মার্কিনের উদ্যোগে জমানা বদলের ইঙ্গিত দেন। কাস্ত্রোকে একনায়করূপে অভিহিত করে তার উত্তরাধিকার “কল্পনাতীত দুঃখকষ্ট, দারিদ্র্য ও বুনিয়াদী অধিকারের বঞ্চনা” ছিল বলে মন্তব্য করে তিনি ঘোষণা করেন, কিউবার জনগণ যাতে ‘সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতার দিকে যাত্রা শুরু করতে পারে’ তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সর্বশক্তি দিয়ে তাদের সাহায্য করবে। কাস্ত্রোর অন্ত্যেষ্টি যাত্রায় বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহণ করে কিউবার জনগণ এর প্রত্যুত্তর দেন এবং এই ভাবে তারা কিউবার বিপ্লবের প্রতি সমর্থন ও ভরসা স্থাপনের কথা পুনরায় দৃঢ ভাবে ব্যক্ত করেন।
২১) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলাতেও জমানা বদলের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শাভেজের উত্তরসুরি রাষ্ট্রপতি মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার একমাত্র এজেণ্ডাকে সামনে রেখে তারা দক্ষিণপন্থী বিরোধী পক্ষকে সমর্থন জানাচ্ছে। ট্রাম্প সরকার ভেনেজুয়েলার অর্থনীতিকে শ্বাসরুদ্ধ করতে তার উপর নতুন করে অর্থনৈতিক তিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে এবং সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকি দিয়েছে। ২০১৫ সালে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে ভেনেজুয়েলার সোশ্যালিস্ট পার্টি (পিএসইউভি) পরাজিত হয়, ১৬৭টি আসনের মধ্যে তারা মাত্র ৫৫টি আসনে জয়ী হয়। মূল বিরোধী শক্তি গণতান্ত্রিক ঐক্য জোট-এর (এনইউডি) প্রাপ্ত ভোট মাত্র ৪.২২ শতাংশ বাড়লেও দেশের বুর্জোয়াদের সাপেক্ষে ভীরু এবং আপোষমূলক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণের ফলে পিএসইউভি-র সামাজিক ভিত্তির অপেক্ষাকৃত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়াটা ঐ পরাজয়ের অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে।
২২) ঐ পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে পিএসইউভি এবং মাদুরো সরকার তাদের পথকে সংশোধন করে নেয়। বিরোধী পক্ষ রাস্তায় নেমে লাগাতার হিংসামূলক কাণ্ডকারখানা চালিয়ে গেলেও জাতীয় সংবিধান সভার নির্বাচনে ব্যাপক জনগণ উৎসাহের সাথে অংশগ্রহণ করেন। এই জাতীয় সংবিধান সভা ভেনেজুয়েলার সংবিধান প্রদত্ত একটি সংস্থা যাতে ট্রেড ইউনিয়ন, স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলির পরিষদ, দরিদ্র কৃষক, জনজাতি গোষ্ঠীগুলি, ছাত্র এবং পেনশনভোগীদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতিনিধিত্ব থাকে। বিরোধী পক্ষ সংবিধান সভার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে, কিন্তু জনগণ সংবিধান সভার নির্বাচনে যে প্রবল আগ্রহ দেখান তাতে বিরোধী পক্ষের এজেন্ডা ধাক্কা খায়। এর পরবর্তীতে পিএসইউভি ২০১৭-র অক্টোবরে অনুষ্ঠিত গভর্নরের পদগুলির নির্বাচনে বড় ব্যবধানে জয়ী হয় এবং তারপর ২০১৭-র ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত মেয়র পদগুলির নির্বাচনে বিপুল ভাবে জয়লাভ করে। এটা সুস্পষ্টরূপে দেখা যাচ্ছে যে, বহু চ্যালেঞ্জ এবং দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দিক থেকে আগ্রাসন ও হুমকি আসা সত্ত্বেও বলিভারিয়ান বিপ্লব লড়াই করে চলেছে এবং এখনও জনগণের যথেষ্ট সমর্থন পাচ্ছে।
২৩) ব্রাজিলে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব ২০১১ সাল থেকে অনুভূত হতে থাকে। ঐ সংকট ওয়ার্কার্স পার্টির সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক মডেলকে — যা ধনীদের সুবিধা দেওয়ার সাথে দরিদ্রদের জীবনে উন্নতি বিধানের সুযোগও দেয় — অকার্যকর করে তোলে। ওয়ার্কার্স পার্টি ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং তার নেতা ডিলমা রউসেফকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অপসারিত করা হয়। রউসেফ বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে অর্থ নিয়ে তার অপব্যবহার করেছিলেন — তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এনে বিতর্কিত এক ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এই অপসারণ সংঘটিত হয়। এই ইমপিচমেন্ট যে চরিত্রগত দিক থেকে কপটতাপূর্ণ এবং প্রহসনমূলক ছিল তা এই ঘটনা থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, তাকে ইমপিচ করার জন্য ব্রাজিল সেনেটের যে সমস্ত সদস্য ভোট দেন, তারা এবং তার সাথে প্রধান বিরোধী দলের এবং ওয়ার্কার্স পার্টির অন্যান্য কিছু নেতাও উৎকোচ, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অর্থ যোগান এবং পেটোয়া পুঁজিবাদের সঙ্গে যুক্ত এক বিশাল দুর্নীতিতে কলঙ্কিত। পরবর্তীকালে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এবং ওয়ার্কার্স পার্টির প্রধান নেতা লুইজ ইনসিও লুলা দ্য সিলভাকে দুর্নীতির তুচ্ছ ও সাজানো অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ফলে লুলা সম্ভবত ২০১৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। তাকে দোষী সাব্যস্ত করার সাথে সাথে সরকার এবং সেনেট শ্রমিকদের সুরক্ষাদায়ী শ্রম আইনগুলোকে বিলোপ করার পদক্ষেপও নিয়েছে। লুলাকে কারান্তরীণ করার ফলে ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনৈতিক সাফল্যের সম্ভাবনায় কতটা প্রভাব পড়ে তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
২৪) মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ লাতিন আমেরিকায় ব্যাপক বিপর্যয় সৃষ্টি করে চলেছে। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হওয়ার যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও হন্ডুরাসে মার্কিন- মদতপুষ্ট রাষ্ট্রপতি জুয়ান অরল্যাণ্ডো হার্নাণ্ডেজকে পুননির্বাচিত ঘোষণা করার পর সেখানে প্রতিবাদের ঢল নামে। হার্নাণ্ডেজের পিছনে মার্কিনের মদত রয়েছে এবং এর আগের শাসন পর্বে তিনি মাদক ব্যবসা ও অপরাধ দমনের অছিলায় মার্কিন প্রশিক্ষিত এক নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে তোলেন। এখন তিনি ঐ বাহিনীগুলিকে নামিয়ে জালিয়াতি করে হাতানো নির্বাচনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী হাজার-হাজার জনগণের বিরুদ্ধে নির্মম দমন নামিয়ে আনছেন। বহু সংখ্যক মানুষ নিহত হয়েছেন, এবং রাত্রির অন্ধকারে অনেক মানুষকে গ্রেপ্তার করার পর তারা নিখোঁজ হয়ে গেছে।
২৫) মুভমেন্ট ফর সোশ্যালিজম-এর (এমএএস) ইভো মোরালেস ২০০৬ সালে বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২০১৬ সালের মধ্যে বলিভিয়া তাদের চরম দারিদ্র্য অর্ধেক কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়, ৩৮.২ শতাংশ থেকে কমে তা নেমে আসে ১৬.২ শতাংশে। বলিভিয়ার সরকার জনজাতি জনগণের অধিকার এবং পরিবেশ সুরক্ষাকে বাড়িয়ে তোলে। তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রের জাতীয়করণের ফলে বলিভিয়া ২০১০ থেকে ২০১৪-র মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির রপ্তানি থেকে বিশ্ব বাজারে চড়া দামের সুবিধা ঘরে তোলে। এখন বিশ্ব বাজারে তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় বলিভিয়া নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। রাষ্ট্রপতি পদে মোরালেসকে চতুর্থবারের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেওয়ার লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধন করতে চাওয়া নিয়ে ২০১৬ সালে যে গণভোট হয় তাতে মোরালেস এবং এম এ এস হেরে যায়। কিন্তু বলিভিয়ার সর্বোচ্চ আদালত, প্লুরিন্যাশনাল সাংবিধানিক আদালত রাষ্ট্রপতির পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার অধিকারের আইনি ও সাংবিধানিক সীমাকে খারিজ করে দেয়।
২৬) লাতিন আমেরিকায় আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে এবং চিলিতে রক্ষণশীল বা দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। দক্ষিণপন্থার এই বাড়বাড়ন্ত সত্ত্বেও কিউবা ও ভেনেজুয়েলার উদ্যোগে চালিত আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সংহতির মঞ্চগুলি তাদের ভূমিকা চালিয়ে যাচ্ছে, যেগুলির মধ্যে রয়েছে বলিভারিয়ান অলটারনেটিভ অব আওয়ার আমেরিকাজ (এএলবিএ) এবং কমিউনিটি অব লাতিন আমেরিকা এন্ড ক্যারিবিয়ান স্টেটস (সিইএলএসি) । আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংহতির আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ কাজ হল ট্রুথ কমিশন গঠন, যেটি আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, উরুগুয়ে এবং বলিভিয়া ‘অপারেশন কনডোর’-এর সত্যানুসন্ধানে যৌথভাবে গড়ে তুলেছে। এই ‘অপারেশন কনডোর’ হল মার্কিনের উদ্যোগে চালিত এক গুপ্ত কর্মসুচি যা লাতিন আমেরিকার ছটি দেশে নির্মম স্বৈরাচারী সরকারগুলিকে মদত জোগায় এবং যার পরিণতিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের গুপ্তহত্যা সংগঠিত হয় এবং ৬০,০০০ মানুষ নিখোঁজ হয়ে যায়।
২৭) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণ এবং ইরাক দখলের পর তার চালানো ‘বাথপন্থী নির্মূলীকরণ’ অভিযানের উপজাত ফসল হল ইসলামিক স্টেট অব সিরিয়া এণ্ড ইরাক (আইএসআইএস) অথবা ডয়েস-এর উত্থান। দখলীকৃত ইরাকে সুন্নি জনগণকে অকিঞ্চিৎকর করে তোলার পর তাদের ক্ষোভের পরিণতিতে সাদ্দাম হুসেনের বাথ পার্টির পুর্বতন নেতারা আইএসআইএস (ডয়েস)-এ যোগ দেন। এখন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ডয়েসকে অর্থ জুগিয়েছে আর তাকে অস্ত্র যোগানো দেশগুলোর মধ্যে ইজরায়েলও রয়েছে। আরব বসন্তের সময় পর্যন্ত ঐ অঞ্চলে ডয়েস-এর তেমন গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা ছিল না; মিশরের প্রেসিডেন্ট মুবারকের মত একনায়কদের গদিচ্যুত করার বিরুদ্ধে তাদের হুমকিতে বলতে গেলে কেউই গুরুত্ব দিত না। আরব বসন্তের উপর নামিয়ে আনা নিপীড়ন এবং তার পরিণামে উদ্ভূত হতাশা ও ক্রোধের পরিমণ্ডল আইএসআইএস-এর পক্ষে উত্থানের ঊর্বর জমি হয়ে ওঠে।
২৮) আরব বসন্তের অংশ হিসাবেই সিরিয়ায় বাসার-আল-আসাদ জমানার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান দেখা দেয়। আসাদ এই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে নির্মম দমন নামিয়ে আনেন যার পরিণামে গৃহযুদ্ধ ও মানবতাবাদী সংকটের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, লক্ষ লক্ষ শরণার্থী সিরিয়া থেকে পালাতে বাধ্য হন। আসাদ শহরগুলিকে ‘সন্ত্রাসবাদীদের’ হাত থেকে মুক্ত করার নামে অসামরিক জনগণের উপর বর্বোরোচিত বোমা বর্ষণ এবং রাসায়নিক আক্রমণ চালান। একদিকে রাশিয়ার সেনাবাহিনী যখন বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে আসাদ জমানাকে মদত জোগায়, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন আল-কায়দা এবং তার পূর্বতন শাখা সংগঠন আল-নুসরা সহ বিরোধী পক্ষের কিছু শক্তির পক্ষ নিয়ে সিরিয়ায় বোমা বর্ষণ শুরু করে এবং ফলাফলের তোয়াক্কা না করে জমানা বদল সংঘটিত করায় মরিয়া হয়ে ওঠে। অবশ্য, সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়া এবং আসাদ জমানা সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার অবস্থানে মিল দেখা যাচ্ছে। আমরা এই অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মাথা গলানোর বিরোধী, তবে যা প্রয়োজন তা হল রাষ্ট্রপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের রাজনৈতিক সমাধান প্রক্রিয়া শুরু করা।
২৯) আইএসআইএস/ডয়েস চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শের প্রতিভূ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একের পর এক সন্ত্রাসবাদী হানাদারি চালানোর পাশাপাশি সে নাগরিকদের উপর সীমাহীন দমন-পীড়ন চালিয়েছে, বিশেষভাবে তার নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোতে সংখ্যালঘু জনগণ এবং নারীদের উপর। এটা অনেকাংশেই ঘটেছে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি, পিকেকে-র চালানো প্রতিরোধের কারণে। পিকেকে এবং তার মিলিশিয়া ওয়াইপিজি কয়েক দশক ধরে তুরস্ক, সিরিয়া এবং ইরাকের অভ্যন্তরে নিজেদের স্বতন্ত্র বাসভূমির জন্য লড়াই চালিয়ে আসছে। গত দু-বছরে কুর্দরা ডয়েস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মার্কিনের সাহায্য পেয়েছে এবং এই অঞ্চলে বস্তুত মার্কিনের মিত্র হয়ে উঠেছে। তবে, এ বছরের জানুয়ারি মাস থেকে তুরস্ক — যে পিকেকে এবং ওয়াইপিজি-কে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বলে গণ্য করে — ওয়াইপিজি-র শক্তিশালী জায়গা সিরিয়ার আফরিন শহরে নির্মমভাবে বোমাবর্ষণ করে চলেছে, নাগরিক বসবাসের কেন্দ্রগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে শত শত অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশুদের হত্যা করছে। তুরস্ক এখন উত্তর সিরিয়ায় স্থল আক্রমণের পরিকল্পনা করছে যার ফলে কুর্দদের উপর তার গণহত্যাকারী আক্রমণ তীব্রতর হয়ে উঠবে। যথার্থই এক একনায়ক তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইইপ এর্ডোগান ন্যাটোর শরিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এনেছেন যে, তারা তাদের দেশের সীমান্তে এক সন্ত্রাসবাদী শক্তি গড়ে তুলছে যেটাকে তারা মেনে নেবে না এবং “তা জন্মানোর আগেই” তার মোকাবিলা করবে।
৩০) পশ্চিম এশিয়ায় আর একটি লক্ষণীয় পরিঘটনা হল সাম্রাজ্যবাদী মিত্র সৌদি আরব এবং ইজরায়েলের মধ্যে পারস্পরিক অঘোষিত সহযোগিতা, যারা ইরান-বিরোধী বৈরিতায় ঐক্যবদ্ধ। উত্তর ইয়েমেনে সিয়া হৌথিদের প্রভাব খর্ব করার নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গ্রেট ব্রিটেনের বাহিনী সহ সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর ইয়েমেনের উপর বোমা বর্ষণে অসামরিক জনগণের গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে এবং ইয়েমেনে এক বিশাল মানবতাবাদী সংকট দেখা দিয়েছে। ইরান বিরোধী আগ্রাসনে ইজরায়েলের সমর্থন সুস্পষ্ট। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াধে অবস্থানকালীন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির ‘পদত্যাগ’ ভয় দেখিয়ে এবং জোর করে ঘটানো হয়েছে বলেই ব্যাপকতর স্তরে মনে করা হয়ে থাকে। আর সৌদি আরব এবং ইজরায়েল এই ‘পদত্যাগ’-কে এক সুযোগ মনে করে লেবানন সরকারে হিজবুল্লার অংশগ্রহণ এবং এই অঞ্চলে তার রাজনৈতিক ও সামরিক ভূমিকার অবসান ঘটাতে উদ্যোগী হয়। সৌদি মিত্র হারিরি অবশ্য তারপর থেকে তার পদত্যাগকে স্থগিত রেখেছেন।
৩১) ইরানে সাধারণ জনগণ রাস্তায় নেমে ব্যাপক সরকার-বিরোধী প্রতিবাদ দেখাচ্ছেন। এই প্রতিবাদগুলির কেন্দ্রে রয়েছে বেকারি, দারিদ্র এবং বঞ্চনার ইস্যু, রাষ্ট্রপতি হাসান রৌহানির নেতৃত্বাধীন সংস্কারবাদী সরকার যেগুলির সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইজরায়েলের এই প্রতিবাদগুলির প্রতি সমর্থনের ইঙ্গিত দেওয়া এবং প্রতিবাদগুলিকে ধরেই ইরানে জমানা বদলের তাদের এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা ইরানের প্রতিবাদী জনগণ প্রত্যাখ্যান করছেন। প্রতিবাদগুলির নিশানায় রয়েছে রৌহানি সরকারের নয়া-উদারবাদী নীতি- ব্যয় সংকোচনের পদক্ষেপ, শিক্ষার বেসরকারিকরণ, ভর্তুকি ছাঁটাই এবং ক্রমবর্ধমান বেকারি। প্রতিবাদকারীরা অবশ্য এটা বুঝতেও ভুল করছেন না যে, ব্যয় সংকোচনের পদক্ষেপের পিছনে অংশত দায়ি হল সাম্রাজ্যবাদী সরকারগুলি দ্বারা ইরানের উপর চাপানো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। ইরানের রাষ্ট্র ১৯৮৩ সাল থেকে নারীদের হিজব পরাকে যে বাধ্যতামূলক করে, তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এবং প্রত্যাখ্যান করে ইরানে নারীদের বিপুল প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে।
৩২) ইজরায়েলের দখলদারি এবং প্যালেস্তিনীয় জনগণের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধের তীব্রতা ক্রমবর্ধমান, ২০১৪ সালে তার গাজা অবরোধের পরিণতিতে ভয়াবহ মাত্রায় প্যালেস্তিনীয় জনগণের জীবন সংহার হয়েছে; ইজরায়েল এখনও গাজায় অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে, ফলে ওষুধ সরবরাহ সম্ভব হচ্ছে না এবং খাদ্য ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ঘাটতিও অব্যাহত রয়েছে। অতি সম্প্রতি এক ইজরায়েলি সেনাকে চড় মারার জন্য গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ হওয়া ১৬ বছরের প্যালেস্তিনীয় মেয়ে আহেদ তামিনির ঘটনাটা বিশ্বের কাছে একই সাথে ইজরায়েলি রাষ্ট্রের নির্মমতা — যে প্রতি বছর শত শত প্যালেস্তিনীয় ছেলে-মেয়েদের আটক, জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন করে—এবং প্যালেস্তিনীয়দের ধারাবাহিক প্রতিরোধকে তুলে ধরে। আহেদের নিজের সাহস ও দৃঢ়তা, ব্যাপকতর স্তরে আন্তর্জাতিক সংহতি এবং ইজরায়েলি কাজের নিন্দা এবং প্যালেস্তিনীয় যুবকদের সংগঠিত করা গণজমায়েত—সম্মিলিতভাবে এগুলো অন্ততপক্ষে আংশিক সফল হয় এবং ইজরায়েলি রাষ্ট্রকে আহেদের বিরুদ্ধে আনা সর্বাপেক্ষা গুরুতর অভিযোগগুলো তুলে নিতে বাধ্য করে, যে অভিযোগের শাস্তি ছিল দীর্ঘ তিন বছরের কারাদণ্ড। প্রতারণামূলকভাবে জায়নবাদ-বিরোধিতাকে ইহুদি-বিরোধিতার সঙ্গে একাকার করে তুলে ইজরায়েল তার সমালোচকদের কলঙ্কিত করার লাগাতার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বয়কট, বিনিয়োগ প্রত্যাহার এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানো (বিডিএস) আন্দোলন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্রমেই বেশি শক্তিশালী হচ্ছে এবং ব্যাপকতর স্তরে এটাও এখন স্বীকৃত হচ্ছে যে, ১৯৯৪ পূর্ববর্তী পর্যায়ের দক্ষিণ আফ্রিকার মত ইজরায়েলও একটা বর্ণবৈষম্যবাদী রাষ্ট্র, সমস্ত সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী এবং বর্ণবাদ-বিরোধী শক্তিগুলোকে যার প্রবল বিরোধিতা করে যেতে হবে। ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান রণনৈতিক সর্ম্পকের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে বিডিএস আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তোলাটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
৩৩) জিম্বাবোয়েতে তার বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্টের শুনানি চলা এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা অধিগ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে ৩৭ বছর ক্ষমতায় থাকার পর রবার্ট মুগাবে ২০১৭-র নভেম্বর মাসে পদত্যাগ করেন। নতুন প্রেসিডেন্ট এমার্সন মানানগাগওয়া ছিলেন প্রাক্তন ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং জানু-পিএফ দলের শাসনকালে বিরোধীদের বিরুদ্ধে চালানো নিকৃষ্টতম অত্যাচারের সঙ্গে তিনি যুক্ত। তিনি অতি উৎসাহের সঙ্গে নয়া-উদারবাদী নীতিমালা গ্রহণ করেছেন। প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশীয়করণ করা মুগাবের তৈরি আইনকে, যাতে বিদেশী বাণিজ্য সংস্থাকে কালো মানুষের ৫১ শতাংশ মালিকানা সুনিশ্চিত করতে হত, হীরা ও প্লাটিনাম খনন বাদে অন্য সমস্ত শিল্পের ক্ষেত্রে বাতিল করা হয়েছে।
৩৪) দক্ষিণ আফ্রিকায় দুর্নীতি এবং পেটোয়া পুঁজিবাদে মদত দেওয়ার অভিযোগে কলঙ্কিত জেকব জুমাকে—যিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন — পদত্যাগ করতে হয়েছে। জুমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি গুপ্তা ভাইদের (যারা ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং উত্তরপ্রদেশের সাহারণপুর থেকে সে দেশে গেছে এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যবসার এক বিশাল অংশ যাদের নিয়ন্ত্রণে) দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রটি কার্যত কব্জা করে নিতে দিচ্ছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টি এসএসিপি-র সমর্থন পেয়ে সম্প্রতি এএনসি-র প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত সিরিল রামাফোসা জুমাকে সরিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের অন্যতম রামাফোসা জুমার প্রধান সহকারি ছিলেন। তিনি খনি কোম্পানি লোনমিন-এর এক শেয়ারহোল্ডার ও ডাইরেক্টর। ২০১২ সালে আফ্রিকার নিরাপত্তা বাহিনী যখন লোনমিনের মারিকানা কারখানার ধমর্ঘটী শ্রমিকদের গণহত্যা করে, রামাফোসা তখন উদ্ধতভাবে আরো দমন-পীড়ন চালানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন।
৩৫) সমস্ত দিক থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, সিরিল রামাফোসার জমানাতেও পেটোয়া পুঁজিবাদ, দমনপীড়ন ও বর্ণবাদ-এর ইস্যুগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারকে জর্জরিত করতে থাকবে। অবশ্য, ঘটনাবলীর গুরুত্বপূর্ণ একটি বিকাশে দক্ষিণ আফ্রিকার পার্লামেন্ট বামপন্থী ৠাডিক্যাল ইকনমিক ফ্রিডম ফাইটার্স পার্টির আনা সংবিধান পরিবর্তনের একটি প্রস্তাবকে—যার উদ্দেশ্য শ্বেত মালিকদের কাছ থেকে কালো মালিকদের কাছে জমির মালিকানার হস্তান্তরকে ত্বরান্বিত করা — সমর্থন করেছে। শাসক আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস জমি মালিকানার ক্ষেত্রে বিদ্যমান বর্ণবাদী বৈষম্যের প্রতিকারে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দীর্ঘদিন আগেই দিয়েছিল। কিন্তু বর্ণবৈষম্যবাদের অবসানের দু-দশক পরও দক্ষিণ আফ্রিকার অধিকাংশ জমির মালিকানা শ্বেতাঙ্গ মালিকদের হাতেই রয়েছে, যার মূল কারণ হল শতকের পর শতক ধরে নির্মম উপনিবেশবাদী শাসনের মধ্যে দিয়ে জমি বেদখল হয়ে যাওয়া। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা এই সংস্কারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা করতে গিয়ে তিনি অবশ্য খাদ্য উৎপাদন এবং নিরাপত্তার সুরক্ষাকে অব্যাহত রাখার উপরও জোর দিয়েছেন।
৩৬) তিপ্পান্ন বছর আগে, ১৯৬৫-৬৬ সালে ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিস্ট এবং কমিউনিস্ট সমর্থকদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার নামে সুহার্তো সরকার ১০ লক্ষ মানুষের গণহত্যা সংঘটিত করেছিল। সে সময় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম কমিউনিস্ট পার্টি ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিকে ধ্বংস ও চূর্ণ করা হয়েছিল। সম্প্রতি জাকার্তায় মার্কিন দূতাবাসের গোপন ফাইলগুলি গোপনীয়তা থেকে মুক্ত হবার পর সেগুলি থেকে এটা প্রমাণিত হচ্ছে যে, গণহত্যা যখন চলছিল তখন সে সম্পর্কে মার্কিন সরকার এবং সিআইএ শুধু সবকিছু জানতই না, তারা সেটাতে অনুমোদনও দিয়েছিল। জোকোউই উইডোডো নাগরিক অধিকারের লঙ্ঘন এবং দুর্নীতির বিষয়গুলির উপর গুরুত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৪ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কাজে নিয়োগের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের বংশধরদের কালো তালিকাভুক্ত করে রাখার পলিসির অবসান ঘটানো এবং গণহত্যা সম্পর্কে ‘সত্য উন্মোচন ও সম্প্রীতি স্থাপন’ প্রক্রিয়া শুরু করার যে আশা করা গিয়েছিল, তাঁর শাসন পর্বে এখনও পর্যন্ত তা ব্যর্থ প্রতিপন্ন হয়েছে। ইতিমধ্যে, ২০১৯ সালে হতে চলা নির্বাচনের আগে দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলো আবারও কমিউনিস্ট জুজুর কথা উসকিয়ে তুলে এবং চীনা বংশোদ্ভূত জনগণ সম্পর্কে মিথ্যা সংবাদ এবং ঘৃণা ছড়িয়ে নিজেদের বিস্তার ঘটাচ্ছে।
৩৭) আমাদের নবম কংগ্রেসে আমরা “সমাজতন্ত্রের দিকে কোনো ধরনের অর্থবহ অগ্রগতি” থেকে চীনের ক্রমেই সরে যাওয়া সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলাম এবং আরো উল্লেখ করেছিলাম যে, “বিপ্লবী সামাজিক রূপান্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত অপরিহার্য বন্ধনমুক্তির লক্ষ্যের প্রকট অনুপস্থিতি—যে রূপান্তর সামাজিক বৈষম্যকে কমিয়ে আনে এবং তাদের ঘাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিছক সুবিধা গ্রহিতার অবস্থান থেকে বুনিয়াদী জনগণকে উন্নীত করে দেশের প্রকৃত শাসকে।” আরো ভালোর দিকে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না এবং তা একইরকম চলছে; চীন থেকে পাওয়া উদ্বেগজনক রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে, জনগণের জীবনধারণের এবং কাজের পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে এবং তাদের সংগ্রামের উপর দমন পীড়ন তীব্রতর হয়ে উঠেছে। শ্রমিক শ্রেণী এবং নারীবাদীদের প্রতিবাদ এবং তিব্বত ও জিনজিয়াং অঞ্চলগুলোতে জাতিসত্ত্বার আন্দোলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর পরিচালনায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ঊনবিংশ কংগ্রেস পথ সংশোধনে কোনও উদ্যোগ নেয়নি। মুসলিম সংখ্যালঘু জনগণের সঙ্গে চীন যে ধরনের আচরণ করে থাকে তাও যথেষ্ট উদ্বেগজনক। নজরদারির রাষ্ট্রকে সম্প্রসারিত করে চলাটা এবং নাগরিকদের বিশ্বাসযোগ্যতার পরিমাপে “সোশ্যাল ক্রেডিট” ব্যবস্থার প্রচলন জনগণের অধিকার এবং কল্যাণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিপদজনক ইঙ্গিত দেয়।
৩৮) আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোতে হস্তক্ষেপের প্রশ্নে তেমন সরব না হওয়ার যে পলিসি চীন আগে অনুসরণ করত, তার থেকে সে স্পষ্টতই সরে এসেছে এবং দেশের বাইরে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন সহ বিদেশ নীতিতে সক্রিয়তা বাড়িয়ে চলেছে। এই আত্মপ্রতিষ্ঠার সঙ্গেই এসেছে একজন কতবার প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন তার সীমার বিলুপ্তি, যার ফলে বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি শিন ফিং-এর সীমাহীন সময় ধরে প্রেসিডেন্ট পদে থাকার সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে। আত্মপ্রতিষ্ঠার এই বৃদ্ধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে বিশ্বকে আরো বহুমুখী করে তোলার দিকে শুভ ইঙ্গিতবাহি হলেও নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে চীনের বিদেশ নীতির সক্রিয়তা বৃদ্ধির তাৎপর্যকে আমাদের মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করতে হবে।
৩৯) ব্রিকস কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র রাজনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে, কি অর্থনীতির উপর আই এম এফ-বিশ্ব ব্যাঙ্ক-বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কব্জার বিরুদ্ধে বহুমেরুতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তার সম্ভাবনার প্রতি কখনই সুবিচার করতে পারেনি। এমনকি ব্রিকস-এর সদস্য দেশগুলোর মধ্যেও (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা) অর্থনৈতিক সহযোগিতার বলতে গেলে কোনো বিকাশই হয়নি। ভারত সাংহাই সহযোগিতা সংগঠনেরও (এসসিও) সদস্য, কিন্তু এখানে ভারতের ভূমিকা অত্যন্ত নিচু পর্দায় বাঁধা থেকেছে এবং এটাকে কাজে লাগিয়ে চীন অথবা এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করে তোলার কোনো চেষ্টাই ভারত করেনি। এর বিপরীতে ভারত জাপান ও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে লেনদেন এবং পারস্পরিক সম্পর্ককে বাড়িয়ে তুলেছে (যথা, জাপানকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া বিশাল বুলেট ট্রেন প্রকল্প এবং ২০১৮-র প্রজাতন্ত্রদিবস উদযাপনে আসিয়ানভুক্ত রাষ্ট্র প্রধানদের আমন্ত্রণের লক্ষণীয় প্রতীকময়তা)।
৪০) দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে মোদী সরকারের বড়দা সুলভ হাবভাব ভারতকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে। নেপালের মর্মান্তিক ভূমিকম্পে ভারত প্রদত্ত ত্রাণকে নিজের রাজনৈতিক পুঁজি ও ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজে লাগাতে গিয়ে মোদী ভারতের প্রতি সম্প্রসারিত নেপালের হৃদ্যতাকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন। আরএসএস তার রাজনৈতিক বীক্ষার অনুগামী হয়ে নেপালের সংবিধান রচনার অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে নেপালের উপর চাপ সৃষ্টি করে যাতে সে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বদলে হিন্দুরাষ্ট্র রূপে ঘোষণা করে। এরপর মোদী সরকার নেপালের প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান ঘোষণার ঐতিহাসিক মুহূর্তে নেপালের অবমাননা ঘটায়, নেপাল তার সংবিধানে যেভাবে মধেশি ইস্যুটিকে এনেছে তার জন্য নেপালকে তিরস্কার করে। তারপর মধেশি প্রশ্নে ভারতীয় চাপের কাছে নেপালকে নত করানোর লক্ষ্যে নেপালের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ চালানোয় মোদী সরকার মদত দিয়েছিল।
৪১) নেপালের সাম্প্রতিক নির্বাচনে সে দেশের দুই প্রধান বাম দল সিপিএন(ইউএমএল) এবং সিপিএন(মাওবাদী)-র কাঙ্খিত জোট নির্ধারক বিজয় অর্জন করে। পরবর্তীতে দুই দল ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যে ঘোষণা করে তাও ঘটনাবলীর এক অভিপ্রেত বিকাশ। প্রজাতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে সংহত করে তোলার যাত্রায় এটা নেপালের পক্ষে শুভ সংকেত বহন করে।
৪২) চীন সম্পর্কে মোদী সরকারের রণং দেহি হাবভাব — যথা, ডোকলাম সীমান্ত বিবাদ এবং তার সাথে আরএসএস-এর চীন-বিরোধী প্রচার কঠোর অর্থনৈতিক বাস্তবতার কষ্টিপাথরে মেকি বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে। ভারতীয় অর্থনীতির এক বড় অংশ চীনা সামগ্রীর উপর নির্ভরশীল; পেটিএম এবং ফ্লিপকার্ট-এর মতো ভারতীয় স্টার্ট-আপ কোম্পানি চীনা পুঁজির উপর নির্ভর করে; চীনে তৈরি এবং ভারতে যন্ত্রাংশ জোড়া সেলফোন ভারতীয় টেলিকম শিল্পের মেরুদণ্ড। চীনের এক অঞ্চল এক রাস্তা প্রকল্পের বিরোধিতা করে ভারত সরকার এই উপমহাদেশে ব্যাপক বিচ্ছিন্নতার মুখে পড়ে। চীন তার আন্তর্জাতিক ভূমিকায়, বিশেষত এই উপমহাদেশে, আরো সোচ্চার ও সক্রিয় হয়ে ওঠায় এই উপমহাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের মিত্র হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার ভারতের প্রচেষ্টা তেমন আমল পাচ্ছে না।
৪৩) চীন ও মালদ্বীপের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর ভারত সরকার চরম ঔদ্ধত্য দেখিয়ে একটি বিবৃতি জারি করে মালদ্বীপকে ‘সর্বাগ্রে ভারত’ নীতির প্রতি অবিচল থাকতে বলে। তা না করে মালদ্বীপ সরকার ভারতীয় রাষ্ট্রদ তের সঙ্গে অননুমোদিত বৈঠক করার জন্য স্থানীয় তিন কাউন্সিলরকে সাসপেণ্ড করে এবং এর মধ্যে দিয়ে তারা পরিস্কার করে দেয় যে মালদ্বীপের সাপেক্ষে ভারত যা ইচ্ছা তাই করতে পারে না।
৪৪) মালদ্বীপে ঘটনাবলির সাম্প্রতিক বিকাশ উদ্বেগজনক। দেশের সুপ্রিম কোর্ট সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেয়। আবদুল্লা ইয়ামিন নেতৃত্বাধীন সরকার এই নির্দেশ মানতে তো অস্বীকার করেই, উল্টে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে। সুপ্রিম কোর্টকে মুলতুবি করা হয়েছে, প্রধান বিচারপতিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বিরোধী নেতৃবৃন্দও গ্রেপ্তার হয়েছেন। এক প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এবং বিরোধীপক্ষের নেতা মহম্মদ নাসিদ ভারতের দিক থেকে কূটনৈতিক এবং সামরিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন। ভারত সামরিক হস্তক্ষেপ করলে তা আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধী হবে। মালদ্বীপে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারে ভারতের উদ্যোগ কূটনৈতিক পদক্ষেপের মধ্যেই সীমিত থাকতে হবে।
৪৫) মায়ানমারে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে চালিত দীর্ঘস্থায়ী বর্ণবাদী বৈষম্য ও হিংসা চরম স্তরে পৌঁছেছে, যা গণহত্যার মাত্রা পেয়েছে। মায়ানমারের অসামরিক নেত্রী আং সান সু কি গণহত্যার কথা মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন। মায়ানমার থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়া রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন যেখানে তাদের অস্তিত্ব রীতিমত বিপদসঙ্কুল। রোহিঙ্গাদের ছোট যে অংশটি ভারতে পালিয়ে এসেছে তারা অত্যন্ত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছেন। মোদী সরকার আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকারকে অবজ্ঞা করে তাদের বহিষ্কার করার হুমকি দিচ্ছে, আর সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলো শরণার্থীদের উপর হিংসা চালাবে বলে হুমকি দিচ্ছে। ভারত রাষ্ট্রসংঘের ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন এবং ১৯৬৭ সালের প্রোটোকলে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে চলেছে : যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভারতকে ওগুলোতে স্বাক্ষর করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক প্রোটোকল ও রীতি অনুসারে রোহিঙ্গা শরণার্থী সহ সমস্ত শরণার্থীদের সঙ্গে আচরণ করতে হবে। রাখাইন অঞ্চল থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদের পিছনে ভূরাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণও রয়েছে যেগুলোর মধ্যে তেল উত্তোলন প্রকল্প, তেলের পাইপলাইন এবং রাস্তা ও বন্দর নির্মাণের মতো পরিকাঠামো প্রকল্প রয়েছে, যেগুলোতে চীন ও ভারতের কর্পোরেট সংস্থাগুলোর স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। আমরা দাবি জানাচ্ছি যে, ভারত সরকারকে ভারতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তা, সম্ভ্রম এবং শরণার্থী মর্যাদা সুনিশ্চিত করতে হবে এবং ন্যায়বিচার, পূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদান এবং মায়ানমার সরকারের সঙ্গে ও রাষ্ট্র সঙ্ঘের মতো আন্তর্জাতিক মঞ্চে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যর্পণের মত বিষয়গুলোতে উদ্যোগ জারি রাখতে হবে।
৪৬) বাংলাদেশে গণতন্ত্র সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে, শাসক দল সেখানে নয়া-উদারবাদী আক্রমণ নামিয়েছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নাশকতা চালাচ্ছে, বিরোধী দলগুলোর কণ্ঠরোধ করছে এবং ‘দুর্নীতি দমনের’ নামে গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করছে। এই ধরনের কদর্য পরিমণ্ডলে মৌলবাদী শক্তিগুলোও প্রভাব বিস্তার করছে এবং ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল এবং যুক্তিবাদী কণ্ঠস্বরগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে। ২০১৮ সালে হতে চলা সাধারণ নির্বাচন যখন এগিয়ে আসছে, দুর্নীতিবিরোধী আদালত বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির (বিএনপি) প্রেসিডেন্ট পুর্বতন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির দায়ে অপরাধী সাব্যস্ত করে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। একটা জোরালো আশঙ্কা রয়েছে যে, বিগত নির্বাচনের মতো এবারের নির্বাচনও গণতন্ত্রের প্রহসন হয়ে উঠবে।
৪৭) বাংলাদেশের জনগণ পরিবেশ ধ্বংসকারী যে সমস্ত ভারতীয় প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন — যার মধ্যে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং তার সঙ্গে সংযুক্ত সুন্দরবন অঞ্চলে রিলায়েন্স ও আদানিদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত বিদ্যুৎ ও শক্তি সম্পর্কিত ‘মৌ’-গুলো রয়েছে—আমরা তার প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করছি। মৌলবাদ এবং নয়া-উদারবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানো বাংলাদেশের জনগণ এবং বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর প্রতিও আমরা সমর্থন জানাচ্ছি। ব্রহ্মপুত্রের জল ভাগাভাগি নিয়ে চীন, বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে সংঘাত ও প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা সামনে আসছে। ইয়ারলুং সাংপো/ব্ৰহ্মপুত্র নদীর উপর জলবিদ্যুৎ বাঁধ প্রকল্প নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে প্রতিযোগিতা এই অঞ্চলের জীব-বৈচিত্র্য এবং স্থানীয় জনগণের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল নীতির ভিত্তিতে আলাপ-আলোচনা এবং বহুপাক্ষিক সহযোগিতাকেই নদীর জল ভাগাভাগি নিয়ে বিবাদের নিষ্পত্তির ভিত্তি করে তুলতে হবে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা অবৈধ বলে অভিযুক্ত অভিবাসীদের সনাক্তকরণ এবং নির্বাসনও আর একটা স্পর্শকাতর ইস্যু দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মধ্যে দিয়ে যার সমাধান করতে হবে এবং ভারতের দিক থেকে যে কোনো একতরফা পদক্ষেপ ভারত-বাংলাদেশ পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে এবং মানবতাবাদী সংকটের জন্ম দেবে।
৪৮) পাকিস্তানেও সাধারণ নির্বাচন ২০১৮ সালে হওয়ার কথা। এখানে পানামা পেপার্সকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশের মত পাকিস্তানেও এই আশঙ্কা জোরালো হয়েছে যে, ব্যবস্থারই একটা কলুষ হিসাবে গণ্য করে দুর্নীতির মোকাবিলা করার পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রতিশোধ তুলতে এবং গণতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রিত করতে দুর্নীতির ইস্যুকে কাজে লাগানো হচ্ছে। পাকিস্তানের ঈশ্বর-নিন্দা আইন নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত করতে এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং তার সাথে ধর্মনিরপেক্ষ ও যুক্তিবাদী মানুষদের পিটিয়ে হত্যা করতে উন্মত্ত ও উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে জোরালো অজুহাত হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মশাল খানের বিরুদ্ধে ঈশ্বর নিন্দার অভিযোগ এনে তার সহপাঠিরা তাকে যে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং ঐ হত্যাকাণ্ডকে ভিডিও-তে ধরে রাখে তা ওই ধরনের নারকীয় ঘটনার এক সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানে ঈশ্বরনিন্দা সম্পর্কিত আইনগুলোর সমর্থনে বড় বড় জনসমাবেশ দেখা যাচ্ছে যা ওই আইনগুলোর বিরোধিতা করা আন্দোলনের কর্মী ও ভাষ্যকারদের বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করতে মেলবাদীদের স্পর্ধিত করছে। বালুচিস্তানে জাতিসত্তার আন্দোলনের উপরও পাকিস্তান তীব্র দমনপীড়ন নামিয়ে এনেছে। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ভিত্তিতে শাসিত উপজাতি অঞ্চলেও (এফএটিএ) দমন, মানুষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে পাস্তুনরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। ভুয়ো সংঘর্ষে পুলিশের হাতে করাচিতে পাস্তুন জাতিসত্তার মানুষ মডেল নাকিবুল্লা মেহসুদের হত্যায় পাস্তুনরা বিশাল প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত করেন যা পাস্তুন লংমার্চ নামে পরিচিত। পাকিস্তানের দশটি বাম এবং প্রগতিশীল দল ও সংগঠন একটি জোট গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছে যেটি ঘটনাবলীর এক ইতিবাচক বিকাশ। পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী সীমান্তপারের সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের কোনও সদিচ্ছাই দেখায়নি। এই বিষয়টা এবং তার সাথে ভারত সরকারের যুদ্ধবাজির পলিসি যুক্ত হয়ে উপমহাদেশের শান্তিকে বিপন্ন করে তুলছে।
৪৯) কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় দীর্ঘস্থায়ী বিবাদের বিষয় হয়ে রয়েছে। এই বিবাদের মীমাংসার লক্ষ্যে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানোর পরিবর্তে উভয় দেশের সরকারই এই বিবাদকে স্থায়ী ও তীব্রতর করে তুলতেই ব্যস্ত। ঘটনা হল, ভারত এটাকে বিবাদের বিষয় বলেই স্বীকার করেনা এবং ক্রমেই আরো বেশি করে অত্যন্ত প্রকট রূপে কাশ্মীরের রাজনৈতিক প্রশ্নের সামরিক সমাধানের উপরই জোর দিচ্ছে। কাশ্মীরের জনগণের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিগণ এবং ভারত ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে মতামত আদান প্রদানের মধ্যে দিয়েই কাশ্মীর সমস্যার স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব। নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করবে, কাশ্মীরী জনগণের এই আকাঙ্খর পরিপ্রেক্ষিতেই ঐ সমাধান হতে হবে।
৫০) শ্রীলঙ্কায় মাহিন্দর রাজাপাক্ষের সরকারের পুর্বতন মন্ত্রী মাইথ্রিপালা সিরিসেনা বিরোধী জোটের প্রার্থী হিসেবে রাজাপাক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগের উপর প্রচারে জোর দিয়ে ২০১৫-র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তামিল ও মুসলিম সংখ্যালঘুদের ভোট পেয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। সিরিসেনা তামিলদের বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধগুলোর তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং তামিল জনগণকে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার লক্ষ্যে তার সরকার এক নতুন সংবিধানও রচনা করছে। তবে সেনাবাহিনীর অসামরিক জনগণের জমি দখল করে রাখা, অসামরিকীকরণ এবং তামিল রাজনৈতিক বন্দীদের আটক থাকার মতো গুরুত্বপুর্ণ ইস্যুগুলোর সমাধানের কোনও সদিচ্ছা তিনি এখনও দেখাননি। এর পরিবর্তে স্বেচ্ছাচারীভাবে তামিলদের গ্রেপ্তারি ও তাদের ‘নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার’ ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় সংস্থাগুলোর নির্বাচনে রাজাপাক্ষের প্রার্থীরা বিপুলভাবে জয়লাভ করেছেন, যা সিরিসেনা নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের পক্ষে সংকটের সংকেত দিয়েছে। তামিল জনগণের ন্যায়লাভ ও মর্যাদার ইস্যুগুলোর সমাধানের জন্য কুটনৈতিক স্তরে সিরিসেনা সরকারের সঙ্গে আলোচনার কোনও উদ্যোগই মোদী সরকার নিচ্ছে না। মাছ ধরার অধিকারের বিষয় নিয়ে ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে আলোচনার পরিণতিতে উভয় দেশই অপর দেশের কিছু মৎস্যজীবিকে মুক্তি দিয়েছে।
৫১) ‘বটম ট্রলিং’ (মাছ ধরার পরিবেশ ধ্বংসকারী এক পদ্ধতি) উভয় দেশের মধ্যে সংঘাতের এক উৎস ছিল, তবে শ্রীলঙ্কা বটম ট্রলিংকে নিষিদ্ধ করেছে এবং ভারতও ধাপে ধাপে বটম ট্রলিংকে বাতিল করতে সম্মত হয়েছে। শ্রীলঙ্কার জলসীমায় বেআইনিভাবে মাছ ধরার অভিযোগে ভারতীয় মৎসজীবিদের গ্রেপ্তার এবং এমনকি নিহত হওয়ার প্রশ্নটি এমন একটি বিষয় হয়ে রয়েছে যেটির জন্য ভারত সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে যাতে ভারতীয় মৎসজীবীদের অধিকার সুরক্ষিত হয়। বটম ট্রলারকে পাল্টে সেগুলোর স্থানে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার ভিন্ন ধরনের জলযান নিয়ে আসার যে পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের রয়েছে এবং যার জন্য উভয় সরকারই ভর্তুকি দেবে, তা এই বিষয়টার সমাধান করতে পারবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত পরিস্থিতি যা, তাতে পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় প্রতিটি মৎসজীবীকে ৮লক্ষ টাকা করে দিতে হবে এবং ছোট মৎসজীবীরা এত টাকা দিয়ে নতুন পদ্ধতির শরিক হতে পারবে না। ভারত সরকার এবং তামিলনাড়ু সরকারকে যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ দিতে হবে যাতে ছোট মৎসজীবীদের গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার জলযান ব্যবহার সুনিশ্চিত হয় এবং বটম ট্রলিং থেকে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার পদ্ধতিতে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য সহায়তা সমস্ত মৎসজীবী যাতে পায়, সেটাও সুনিশ্চিত করতে হবে।
৫২) শ্রীলঙ্কায় ক্যাণ্ডি জেলায় সম্প্রতি সংখ্যালঘু মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে সিংহলী বৌদ্ধধর্মাবলম্বী দাঙ্গাবাজ জনতাকে সাম্প্রদায়িক হিংসা চালাতে দেখা যায় — যার পিছনে পুলিশের মৌন মদত এবং সুপরিকল্পিত নিষ্ক্রিয়তা থাকে। নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সিংহলী পক্ষপাত থাকার কথা বিবেচনা করলে জরুরি অবস্থা জারি সংখ্যালঘ জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলো শ্রীলঙ্কার প্রধান শাসক এবং বিরোধী দলগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে।
৫৩) আমরা বিপ্লবী কমিউনিস্ট, আর তাই সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো ও বিভিন্ন ধারার প্রগতিশীল আন্দোলন এবং শক্তিগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিকাশে আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হবে; যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের সপক্ষে, বর্ণবাদ ও ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে এবং প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সংহতিকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে; শ্রম আইন ও দেশের আইন লঙ্ঘনকারী বিশ্ব-পুঁজি ও বহুজাতিক সংস্থাগুলোর আক্রমণের বিরুদ্ধে ঘনিষ্ঠতর সহযোগিতা ও সমন্বয়ের বিকাশ ঘটাতে হবে; এবং শান্তি ও গণতন্ত্রের লক্ষ্যে এবং যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় উগ্রপন্থা এবং ঘৃণা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির রাজনীতির বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার প্রগতিশীল শক্তিগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠতর সহযোগিতা গড়ে তুলতে হবে।