23-05-2019
নয়া দিল্লী, ২৩ মার্চ ২০১৯

বিজেপি পরিচালিত এনডিএ-র নিরঙ্কুশ জয় মোদী সরকারকে দ্বিতীয় দফার জন্য ক্ষমতায় নিয়ে এলো, কিন্তু যেভাবে এই জয় অর্জিত হল তা ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য এক উদ্বেগজনক নিহিতার্থ বহন করছে। ২০১৪ সালের বিপরীতে এই দফায় মোদীর প্রচারে উন্নয়নের ভাঁওতা কমই ছিল। বরং তা নির্লজ্জভাবে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও উগ্র জাতিদম্ভকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে, এমনকি সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ চালানোয় অভিযুক্ত প্রজ্ঞা ঠাকুরকে বিজেপির এক যথার্থ প্রতীক হিসাবে নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়। এই প্রেক্ষাপটে বিজেপির এই মাত্রায় জয় নিশ্চিতভাবে সেইসব শক্তিকে উৎসাহিত করছে যারা ধারাবাহিকভাবে আইনের শাসন, সামাজিক ন্যায় ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে এসেছে এবং এই জয় নিশ্চিতভাবেই অনেক রাজ্য সরকারের স্থায়িত্ব নষ্ট করার আশু বিপদও হাজির করেছে।

এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল গত ৫ বছর ধরে চলে আসা এক বিষাক্ত পরিবেশে—যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি ও তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ চলেছে, ভিড় জড়ো করে পিটিয়ে খুন করার ব্যাপক ঘটনা ঘটেছে, মুসলমান, দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর বড় মাত্রায় আক্রমণ চালানো হয়েছে এবং বিরোধী মতালম্বীদের ওপর ধারাবাহিক হামলা চলেছে ও খুন করা হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাকে সেই মাত্রায় খর্ব করা হয়েছে যাতে প্রধান প্রধান প্রচার মাধ্যমগুলি মোদী জমানার এবং বিজেপি/আরএসএস-র ধারাবাহিক ঘৃণা ও মিথ্যা বুলির প্রচার ‌যন্ত্রে পর্যবসিত হয়। এসব সত্বেও ২০১৮-র শেষে অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে জনগণের ক্রমবর্ধমান মোহ মুক্তির ও পরিবর্তনের আকাঙ্খা প্রতিফলিত হয়েছিল, যা লোকসভা নির্বাচনের সময় চরম আকার নেবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু পুলওয়ামার ঘটনা ও বালাকোট উপাখ্যানকে কাজে লাগিয়ে চরম যুদ্ধ উন্মাদনা, বেকারত্ব, কৃষি ক্ষেত্রের বিপর্যয় ও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের মতো জ্বলন্ত ইস্যুগুলিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এবং নির্বাচনের রং ও ফলাফলকে পাল্টে দেয়।

গত ৫ বছর ধরে কৃষক, ছাত্র-যুবক, দলিত ও আদিবাসীদের সংগ্রামগুলি এবং গণতান্ত্রিক নাগরিকদের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর মোদী সরকারের বিরোধীতা করে এসেছে। বিরোধী পার্টিগুলির কাজ ছিল জনগণের এইসমস্ত ইস্যু ও উদ্যোগগুলির ভিত্তিতে এক ঐক্যবদ্ধ বিকল্প হাজির করা। কিন্তু, এটা অবশ্যই বলতে হয় যে এই ক্ষেত্রে বিরোধী পক্ষের সাড়া যথেষ্ট ছিল না, বরং খুব কমই ছিল। এছাড়াও ইলেকট্রোরাল বন্ডের সন্দেহজনক ব্যবস্থা থেকে শুরু করে ইভিএম সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান সন্দেহ, ভিভিপ্যাড গণনাকে একগুঁয়ের মতো নাকচ করে দেওয়া এবং নির্বাচন যে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে তার নিশ্চয়তা দিতে ভারতের নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা — এ সমস্তই সমগ্র নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার ও বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

মোদী জমানা ব্যাপকভাবে অঘোষিত জরুরী অবস্থার সমার্থক হিসাবেই গণ্য হয়ে এসেছে এবং ইতিহাসে ২০১৯ সালের নির্বাচন স্বৈরাচারের ছায়ায় অনুষ্ঠিত ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন হিসাবে গণ্য হয়ে থাকবে। বাম শক্তিগুলির কাছে ২০১৯ সালের নির্বাচন আসন সংখ্যা ও ভোট প্রাপ্তির হারের ক্ষেত্রে চরম ভাটার সময়কাল হিসাবে গণ্য হবে। প্রতিটি ফ্যাসিবাদী হামলার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকে রক্ষা করার সাথে সাথে আমরা সিপিআই(এমএল) বাম আন্দোলনের পু্নর্নবীকরণের লক্ষ্যে দৃঢ় চিত্তে কাজ করে যেতে সমস্ত বাম কর্মী বাহিনীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি। ফ্যাসিবাদ বিরোধী ঐক্য ও সংহতি গড়ে তুলতে আমরা নিজেদেরকে পুনরুৎসর্গ করছি এবং ভারতের সমস্ত সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগণের এবং নির্যাতনের শিকার নাগরিকদের পাশে দাঁড়াতে সংকল্প গ্রহণ করছি।

- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য,
সাধারণ সম্পাদক, সিপিআই(এমএল)