সন্তোষকুমারী দেবী : ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে স্মরণ ও শ্রদ্ধা
Santosh Kumari Devi 125th Birth Anniversary

স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালিত হচ্ছে এখন। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার শোরগোল ফেলেছে ‘স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব’ পালনের কথা বলে। তারা বলেছে অপরিচিত, স্বল্প পরিচিত, হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসার কথা। কিন্তু সরকারিস্তরে উচ্চকিত প্রচার সত্ত্বেও অনেকটা আড়ালেই থেকে গেলেন এক অত্যন্ত ব্যতিক্রমী স্বাধীনতা সংগ্রামী সন্তোষকুমারী দেবী। একদা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অত্যন্ত স্নেহভাজন সন্তোষকুমারী ছিলেন একাধারে স্বাধীনতা সংগ্রামী ও অন্যদিকে শ্রমিক নেত্রী। বস্তুতপক্ষে আজ থেকে একশো বছর আগে সন্তোষকুমারী দেবী অত্যন্ত ব্যতিক্রমী এক মহিলা শ্রমিক নেত্রী হিসেবে জুট শ্রমিকদের মধ্যে কাজ শুরু করেন এবং অচিরেই তাঁদের অত্যন্ত কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। সেই সময় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি আবার জুট শ্রমিকদের সংগঠিত করছেন এক মহিলা শ্রমিক নেত্রী, তাঁদের দাবি দাওয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিতর্কে সামিল হয়ে অধিকার আদায় করে আনছেন — এ ছিল বিশেষভাবেই এক ব্যতিক্রমী এক দিক।

সন্তোষকুমারী দেবীর পৈত্রিক ভিটে ছিল নৈহাটির গড়িফা অঞ্চলে। তাঁর বাবা ছিলেন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মী। চাকরিসূত্রে তাঁকে যেতে হয়েছিল রেঙ্গুনে। রেঙ্গুনেই তাঁর লেখাপড়া। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী হিসেবে কৃতিত্ত্বের সঙ্গে সিনিয়র কেমব্রিজে উত্তীর্ণ হন। মেলে বিলেতে গিয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ। কিন্তু বিলেত যাবার ছাড়পত্র মেলেনি তাঁর। ততদিনে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মন্ত্রে তিনি দীক্ষিত হয়েছেন। জাতীয়তাবাদী নানা কাজ শুরু করেছেন বার্মায়। ফলে দ্রুতই ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে নজরবন্দী করে ফেলে। আটকে দেয় বিলেতে উচ্চশিক্ষার জন্য যাত্রাকে।

রেঙ্গুনে পুলিশী নজরদারিতে কার্যকলাপ সীমিত হয়ে যাওয়ায় সন্তোষকুমারী দেবী চলে আসেন নৈহাটির গড়িফায়, তাঁর পৈত্রিক ভিটেতে। দেশজুড়ে তখন অসহযোগ আন্দোলন। বাংলায় এই আন্দোলনের মূল কারিগর তখন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। সন্তোষকুমারী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অনুগামী হিসেবে কাজ শুরু করেন।

সন্তোষকুমারী দেবীর কাজের মূল ক্ষেত্র ছিল শ্রমিকদের মধ্যে। বস্তুতপক্ষে তিনিই ছিলেন প্রথম মহিলা জুট মজদুর নেত্রী। অসাধারণ বাগ্মী এই নেত্রীর বক্তৃতা হিন্দিভাষী জুট শ্রমিকদের আপ্লুত করত। তাঁদের নানা আর্থিক ও অন্যান্য অধিকারের দাবিদাওয়া নিয়ে মিল ম্যানেজারদের সঙ্গে সন্তোষকুমারী দেবীর তীব্র দ্বন্দ্ব চলত।

শ্রমিকদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য সন্তোষকুমারী দেবী বিশেষ সচেষ্ট ছিলেন। এই উপলক্ষ্যে তিনি শ্রমিক মহল্লায় নাইট স্কুল চালু করেন। এইক্ষেত্রে তিনি এতটাই সফল হয়েছিলেন যে কলকাতা কর্পোরেশনের শিক্ষা সংক্রান্ত কাজের জন্য কর্পোরেশনের সেই সময়ের সর্বোচ্চ আধিকারিক সুভাষচন্দ্র বসু তাঁকে কর্পোরেশনের শিক্ষা কমিটির অন্তর্ভুক্ত করে নেন।

শ্রমিকদের রাজনৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি বিশেষ সচেতন ছিলেন। শ্রমিকদের জন্য একপয়সা মূল্যের একটি কাগজ তিনি নিয়মিত প্রকাশ করা শুরু করেন। এই কাগজ চালানোর খরচ যোগাড়ে তিনি নিজের গয়নাও বন্ধক রেখেছিলেন।

সময়ের চেয়ে কতটা এগিয়ে ছিল সন্তোষকুমারী দেবীর ভাবনা ও কার্যকলাপ তা বোঝা যায় সোনাগাছি অঞ্চলের বারবণিতাদের জন্য নানা সামাজিক কাজের ক্ষেত্রে তাঁর উদ্যোগ থেকে। সেই সময় যখন ভদ্র পরিবারের মহিলাদের নাটক চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মতো ব্যাপারও সমাজ ভালো চোখে দেখে না, তখন একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিতা নারী পতিতাপল্লীতে বারবণিতাদের জন্য কাজ করছেন — এ ছিল এক বিরাট ব্যাপার।

সন্তোষকুমারী দেবী বিশ শতকের তিরিশের দশক থেকে ধীরে ধীরে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ থেকে সরে যান। এর কারণ সঠিকভাবে জানা যায়না। তবে তিনি দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন। প্রায় নব্বই বছর বয়েসে তাঁর জীবনাবসান হয়। তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর জীবন ও কাজ নিয়ে মঞ্জু চট্টোপাধ্যায় এক বিস্তারিত আলোচনা করেন সোশ্যাল সায়েন্টিস্ট পত্রিকায়। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত এই প্রবন্ধটিই আজকের দিনে এই অনন্যাকে জানার অন্যতম সোপান। এছাড়াও তাঁর ছায়া অবলম্বনে এক চরিত্রকে অবলম্বন করে ‘বিকিকিনির হাট’ নামে একটি উপন্যাস লেখেন নৈহাটি নিবাসী প্রখ্যাত অধ্যাপক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়।

জন্মের ১২৫তম বার্ষিকী তথা স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালনের সময় ইতিহাসচর্চায় অনেকটা উপেক্ষিতই থেকে গেলেন সন্তোষকুমারী দেবী। এই উপেক্ষার মধ্যেই উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হল অগ্নিবীণা সাংস্কৃতিক সংস্থার উদ্যোগে তাঁর জন্মের ১২৫তম বার্ষিকী পালনের আয়োজন। অগ্নিবীণা সংস্থাটি সন্তোষকুমারী দেবীর পৈত্রিক বাড়ি সংলগ্নই। সংস্থার পক্ষ থেকে তাঁর লন্ডন নিবাসী পুত্র ও অন্যান্য পরিজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। সন্তোষকুমারী দেবীর পরিবার খুশি যে অন্তত কেউ কেউ এই সময়ে তাঁকে মনে রেখে স্মরণ শ্রদ্ধার আয়োজন করেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল কেন্দ্র বা রাজ্য — কোনও সরকারের তরফেই এরকম এক ব্যতিক্রমী অনন্যার স্মরণে যথাযোগ্য উদ্যোগ নেওয়া হল না। নারীর ক্ষমতায়নের মূর্ত এই সাহসী ছকভাঙা অনন্যাকে রাজ্য তথা দেশবাসীর সামনে হাজির করা দরকার। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কাছে, তরুণ তরুণীদের কাছে অনুসরণযোগ্য এক রোল মডেল হয়ে উঠতে পারেন এই অনন্যা, যদি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে তাঁর কথা স্কুল কলেজের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, প্রকাশ করা যায় তাঁর জীবন ও কাজের বিবরণ সমৃদ্ধ বইপত্র।

- সৌভিক ঘোষাল

খণ্ড-29
সংখ্যা-2