আজকের দেশব্রতী : ০৪ নভেম্বর ২০২১ (অনলাইন সংখ্যা)
4 november_DB

BSF terror

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশিকা জারি করে বিএসএফ-এর অধিক্ষেত্র তিনগুণের বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ প্রকৃত সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার ভেতর পর্যন্ত এলাকা বিএসএফ-এর ক্ষমতার আওতায় আসবে। ক্ষমতা বলতে আইন অনুযায়ি তিনটি — তল্লাশি, বাজেয়াপ্তকরণ ও গ্রেপ্তারি। এতদিন প্রকৃত সীমান্তরেখা থেকে ১৫ কিলোমিটার ভেতর পর্যন্ত বিএসএফ-এর অধিক্ষেত্র ছিল এবং গ্রেপ্তারির অধিকার ছিল না। পশ্চিমবঙ্গে বরাবর তিনটি দেশের সাথে ভারতের সীমানা আছে। তার মধ্যে নেপাল ও ভুটানের সীমানায় এরকম বিএসএফ নেই, আছে কেবল বাংলাদেশ সীমানায়। বাংলাদেশের সাথে সুদীর্ঘ ২,২১৬ কিলোমিটার সীমান্ত আছে। সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার ভেতরে বর্ধিত অধিক্ষেত্রের হিসেবে কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া ও দুই চব্বিশ পরগণা — নয়টি জেলার প্রায় সমগ্র এলাকা বিএসএফ-এর আওতায় চলে যাবে। বিএসএফ-এর অধিক্ষেত্র বৃদ্ধি আসলে যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ও আইনের শাসনের ওপর হামলা। এবিষয়ে দেশব্রতী ২৮ অক্টোবর ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত লেখা দ্রষ্টব্য। কিন্তু এতদিন যে ১৫ কিলোমিটার ভেতর পর্যন্ত বিএসএফ-এর অধিক্ষেত্র প্রসারিত ছিল সেই এলাকার মানুষদের অভিজ্ঞতা কী? কীরকম ক্ষমতাধর বিএসএফ এই এলাকায়?

গত ৩০ অক্টোবর কলকাতায় ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে এই বিষয়ক একটি সভা ও জনশুনানী সংগঠিত করে ‘বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ’ (মাসুম)। উপস্থিত ছিলেন কোচবিহার, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর, উত্তর ২৪ পরগণা, নদীয়া প্রভৃতি সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী এবং বিএসএফ-এর হাতে অত্যাচারিত ও এমনকি নিহত মানুষের পরিবার ও পরিজন। তাঁরা তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। এই সভায় আহুত বক্তাদের মধ্যে ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নেতা কার্তিক পাল। তাঁর কথায়, “সীমান্তবাসীদের জীবনের যে কাহিনী উঠে এল তা খুবই হৃদয় বিদারক। সীমান্তবাসীদের কেন্দ্রীয় সরকার ক্রমাগত ‘নিজভূমে পরবাসী’ করে তুলছে। ফসল উৎপাদন করা ও বাড়িতে বা বাজারে নিয়ে যাওয়ার ওপর বিভিন্ন অবৈধ বিধিনিষেধ আরোপ করে রাখে বিএসএফ। বাজার করতে যাওয়া ব্যক্তি কতটা কি নিতে পারেন তাও ঠিক করে দেয় বিএসএফ। একজন ২ কেজি লবণ নিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু নির্দেশ অনুযায়ী ১ কেজি জলে ফেলে দিয়ে ১ কেজি বাড়িতে নিয়ে যেতে পারলেন। কেউ মাংস কিনে নিয়ে যাচ্ছেন, মেপে দেখা গেল ৬০০ গ্রাম। ৫০০ গ্রাম নিয়ে যেতে পারবেন। ফলে তাকে রেখে চলে যেতে হল। যখন তখন যে কোনও ব্যক্তিকে চোরাচালনকারি হিসাবে চিহ্নিত করে কেস দিতে বা ধরে নিতে পারে। মৎস্যজীবীরাও অত্যাচারিত। পদ্মায় মাছ ধরতে গেলে তাদের দিয়ে বিএসএফ প্রথমে ব্যক্তিগত কাজ করিয়ে নেয়, তারপর ২ ঘন্টা মাছ ধরতে অনুমতি দেয়। এইরকম অনেক কাহিনীর সাথে মেরে দেওয়া, মহিলাদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনাও রয়েছে অজস্র। সীমান্তে বসবাসটাই কঠিন হয়ে পড়েছে।”

উক্ত সভায় জারি করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “সীমান্তবাসীদের ওপর নিয়মিত অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা, শ্লীলতাহানি চলে … সীমান্তে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে বিএসএফ। এখন তারা গুম খুনের খেলায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে। দেহ লোপাট করে দিচ্ছে … বিএসএফ-এর হুকুম না মানলেই নির্যাতন ও মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয় নিরিহ গ্রামবাসীকে। এছাড়া ফসল লুঠ তো আছেই। রাজ্য সরকারের স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না, কার্যত তাকে সমর্থন করছে। স্থানীয় থানা বিএসএফ-এর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেয় না; নিলেও তদন্ত হয় না … আইনি কোনও বিধান না থাকা সত্ত্বেও রাজ্য প্রশাসনের জেলা শাসকরা বেআইনি ও অসাংবিধানিকভাবে একনাগারে দীর্ঘকাল ধরে সীমান্ত এলাকায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা লাগু করছে … বাংলাদেশ সীমান্তে বসবাসকারী কোটি কোটি মানুষের কাছে আজ আতঙ্ক হচ্ছে এনডিপিএস মামলা। স্থানীয় থানা ও বিএসএফ যে কোন মুহহূর্তে যে কোনও মানুষকে এনডিপিএস মামলা দিয়ে পাঠাবে। বাংলাদেশ সীমান্তে থাকা পুলিশ থানাগুলির দায়ের করা মিথ্যা অভিযোগে হাজার হাজার মানুষ আজ জেলের ভেতরে; বিএসএফ-কে সন্তুষ্ট করার জন্য এবং অসাধু উপায়ে অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে পুলিশ এই অসাধু কাজ চালিয়ে যাচ্ছে … আন্তর্জাতিক চোরাচালান, নারী পাচার, মাদক পাচার — এই সকল দুষ্কর্মই কিছু অসাধু বিএসএফ-এর সহযোগিতায় এবং স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের ছত্রছায়ায় ও শুল্ক আধিকারিকদের সাহায্যে ফুলে ফেঁপে উঠেছে।” মাসুমের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে সবকিছু জানার পরেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও রাজ্যের প্রশাসন কি ঘুমিয়েই থাকবে?

border of bangladesh

 

‘মাসুম’ সংস্থাটি দীর্ঘদিন সীমান্তে বিএসএফ-এর সন্ত্রাস ও মানবাধিকার প্রশ্নে তথ্যানুসন্ধানের কাজ করছে। ‘হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ’ নামক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন কর্তৃক এ’বছর ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে যে ‘মাসুম’ ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ দ্বারা ভারতবাসীকে হত্যা করার ১০৫টি ঘটনার তথ্যানুসন্ধান করেছে, যদিও এরকম হত্যার প্রকৃত সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন তাঁরা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে তাঁদের জমা দেওয়া ঘটনাগুলির মধ্যে সাম্প্রতিক দুটি ঘটনা হল, ২০২০ সালে কুচবিহার জেলায় ১৬ বছর বয়সী সামশের প্রামানিককে প্রথমে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে ও তারপর গুলি করে হত্যা করা হয় এবং ২৩ বছর বয়সী সাহিনুর হককে তার বাড়ির সামনেই গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ। পুলিশ কেবলমাত্র ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’র কেস দেয়।

কমরেড কৃষ্ণ প্রামাণিক তিন দশক আগের একটি ঘটনার কথা জানিয়েছেন, “১৯৯১ সালের ১৭ মার্চ নদীয়ার তেহট্ট ব্লকের দেবনাথপুরে ১১ জন কৃষককে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করেছিল। বর্ডার সংলগ্ন এই গ্রাম থেকে গরু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল দুষ্কৃতিরা। বিএসএফ-এর সাথে দুষ্কৃতীদের সংযোগ ছিল। তাই কৃষকের পক্ষ থেকে দুষ্কৃতি ধরার জন্য চাপ দিলে বিএসএফ উল্টে কৃষকদের মারে। কৃষকরা বিএসএফ-কে ঘিরে ধরে একটা ঘরে আবদ্ধ করে রাখে। সংশ্লিষ্ট ব্লক উন্নয়ন আধিকারিককে জানানোর পরে বিএসএফ-এর নিরাপত্তার জন্য একজন পুলিশকে পাহারায় বসানো হয়। বিএসএফ ব্যাটেলিয়ান খবর পাওয়ার পরে দলবেঁধে এসে থানার পুলিশকে লাথি মেরে ফেলে দেয়, তারপরে আটক বিএসএফ-কে উদ্ধার করে। এরপরই বিএসএফ বাহিনী বাজারের দোকানে বসে থাকা লোকজনকে এলোপাথারি গুলি চালায়। মোট ১১ জনকে হত্যা করে ও ৬ জনকে আহত করে রাগ মেটে তাদের। ঘটনাটি আলোড়ন তৈরি করেছিল। বিক্ষোভ আন্দোলন হয়েছিল। হত্যাকারী বিএসএফ-এর শাস্তির দাবি উঠেছিল। জেলা পুলিশ সুপার ও বিএসএফ যৌথ মিটিং করে জনগণের প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বাস্তবে কিছুই হয়নি। কোনও শাস্তি হয়নি। এই ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে বিএসএফ গণহত্যা করেও রেহাই পেয়ে যায়, জনগণের নিরাপত্তার পরিবর্তে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে।”

সীমান্ত সুরক্ষার নামে ভারতের নাগরিকদের ওপর এই সন্ত্রাস কায়েম করে রেখেছে বিএসএফ। বলাই বাহুল্য, সীমান্ত লাগোয়া গ্রামগুলিতে বসবাসকারী মানুষের সিংহভাগই প্রান্তিক, তপশিলি জাতিভুক্ত অথবা মুসলমান, এবং দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ। সীমান্তের ১৫ কিলোমিটার বরাবর এলাকায় এই সন্ত্রাস সীমাবদ্ধ ছিল বলেই কি এতদিন ওপেন সিক্রেটের নীরবতা ছিল? এখন ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তারিত হলে বহু জেলা বা ব্লক শহর, গঞ্জ, জাতীয় সড়ক বিএসএফ-এর এরকম রাজত্বের আওতায় চলে আসবে। অত্যাচারের তীব্রতা এক না হলেও সন্ত্রস্ত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারবে অনেক গভীর পর্যন্ত।

কার্তিক পাল জানিয়েছেন, “নতুন অর্ডার জারি হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই বিজেপির বর্তমান রাজ্য সভাপতির সাথে বিএসএফ আধিকারিকের গোপন বৈঠক কেন হল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে। বিএসএফ-এর মাধ্যমে বিজেপি এবং কেন্দ্রের সরকার বাংলায় প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে তৎপর। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে। রাজ্য সরকার এই আদেশের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু বিডিও অফিস ও পঞ্চায়েতগুলির ভূমিকা ভালো নয়। এই প্রশ্নে আমাদের মনোযোগ বাড়ানো দরকার। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলির নজরদারি দরকার। জেলায় জেলায় স্থানীয়ভাবে এইসব বিষয় নিয়ে বিক্ষোভ সংগঠিত করা প্রয়োজন।”

Russian Revolution

জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের আমলের (১৮৫৫–১৮৮১) আগে থেকেই রাশিয়া একের পর এক কৃষক বিদ্রোহে আলোড়িত হচ্ছিল। ১৮৫০ থেকে ১৮৬০-র মধ্যে রাশিয়া জুড়ে প্রায় আটশো কৃষক বিদ্রোহ হয়। ১৮৩৫ থেকে ১৮৬১-র মধ্যে বিদ্রোহীরা দুশো তিরাশি জন জমিদার বা কুলাককে খতম করে। এই বিদ্রোহের পুরোভাগে ছিল নারোদনিক বা জনগণের বন্ধুরা। রাশিয়ায় সামন্ততন্ত্রের দ্রুত অবক্ষয় দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু তার জায়গায় আধুনিক পুঁজিবাদ তখনো সেভাবে বিকশিত হয়ে ওঠেনি। ছাত্র-যুব এবং জনগণের প্রগতিশীল অংশ সামন্ততন্ত্র এবং জার শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল এবং তা প্রায়শই ব্যক্তিহত্যার পথ বেছে নিত। জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই ক্ষোভ ও ঘৃণার বাতাবরণে ভরা রাশিয়ায় লেনিন বেড়ে উঠছিলেন। লেনিন ও তাঁর নেতৃত্বাধীন রুশ মার্কসবাদীরা অবশ্য নারোদনিকদের ব্যক্তিহত্যার পথ একেবারেই সমর্থন করেননি। তাঁরা মার্কসবাদের এক স্বতন্ত্র পথে জারতন্ত্রের অবসানের কথা ভেবেছিলেন, যা বলশেভিক বা কমিউনিস্ট মতবাদ হিসেবে খ্যাত। ১৯০৫ সালে যে বড়সড় বিপ্লব হয় তারফলেই রাশিয়ায় জার বাধ্য হন জনগণের ভোটাধিকারে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বমুলক একটি সংসদীয় ব্যবস্থা (রাশিয়ান দ্যুমা) প্রবর্তন করতে। জারের নিয়ন্ত্রণাধীন পার্লামেন্ট বা দ্যুমা প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে রাশিয়ায়। এগুলির মধ্যে চরম জার সমর্থক বা জারিস্টরা যেমন ছিল, তেমনি ছিল মধ্যপন্থী অক্টোব্রিস্টরা, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক কাদেতরা। আর ছিল জার শাসনের বিরোধী নারোদনিকদের উত্তরসূরী সোশ্যালিস্ট রেভোলিউশনারী (এসআর) এবং রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি (আরএসডিএলপি) যা কালক্রমে লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক ও মার্তভের নেতৃত্বাধীন মেনশেভিক হিসেবে দু’ভাগ হয়ে যায়।

১৯১৭-র রুশ বিপ্লবের প্রস্তুতির কালক্রম অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা দেখি লেনিন ও বলশেভিকরা বারবার অসংখ্য বিতর্কের মধ্যে দিয়ে বিপ্লবী মার্কসবাদী মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যান্য রাজনৈতিক ধারার সঙ্গেই শুধু নয়, মার্কসবাদীদের নিজেদের মধ্যেও নানা প্রশ্নে চলেছে এই বিতর্ক। এই বিতর্ক একদিকে যেমন তাত্ত্বিক, মতাদর্শগত, দার্শনিক; তেমনি অন্যদিকে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট কার্যক্রম নেওয়ার সঙ্গেও বিশেষভাবে সংযুক্ত ছিল।

জার বিরোধী কার্যকলাপের জন্য লেনিনকে যেতে হয়েছিল নির্বাসনে। নির্বাসনপর্বেই তিনি ‘রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ’ বইটি লেখার কাজ শেষ করেন। রাশিয়ার অর্থনৈতিক বিকাশ নিয়ে এই অসামান্য গবেষণায় লেনিন দেখান যে রাশিয়ার পুঁজিবাদ শুধু শিল্পে নয়, কৃষিতেও জোরদার হচ্ছে। রাশিয়ার সাধারণ জনসংখ্যার মধ্যে শ্রমিকশ্রেণীর সংখ্যাল্পতা সত্বেও লেনিন তাদের মধ্যেই এক মহাশক্তিকে দেখতে পেয়েছিলেন। বিপ্লবী আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃস্থানীয় ছিলেন ভূমিকাকে তিনি সামনে নিয়ে আসেন। একই সঙ্গে লেনিন প্রলেতারিয়েতের সঙ্গে কৃষক সম্প্রদায়ের ঐক্যের আবশ্যিকতার ওপর জোর দেন। কারণ তাছাড়া আসন্ন বিপ্লবে জয়লাভ সম্ভব ছিল না। ১৯০২ সালে লেনিনের সুবিখ্যাত বই ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’ বা ‘কী করিতে হইবে’ প্রকাশিত হয়। এই বইতে লেনিন পার্টি গঠনের মূল নীতি সম্পর্কে আলোচনা করেন।

মেনশেভিক মতবাদের বিপদের দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে লেনিন লেখেন ‘ওয়ান স্টেপ ফরওয়ার্ড টু স্টেপ ব্যাক’ বা ‘এক কদম আগে, দু’কদম পিছে’ নামে তাঁর অতি পরিচিত বইটি। প্রলেতারিয়েতের পার্টির ধরন-ধারণ বিষয়ে লেনিন এই বইতে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি বলেন, “প্রলেতারিয়েতের সংগ্রাম পার্টি সাফল্যের সঙ্গে শুধু তখনই পরিচালনা করতে পারে যখন তার সমস্ত সভ্য একক বাহিনীতে ঐক্যবদ্ধ, একই সংকল্প, কর্ম ও শৃঙ্খলায় সংহত, যখন তা বৈপ্লবিক তত্ত্বে সশস্ত্র।”

১৯১২ সালে রাশিয়ায় চতুর্থ রাষ্ট্রীয় দ্যুমার নির্বাচন হয়। এরআগে তৃতীয় দ্যুমার নির্বাচনের সময়েই লেনিন নির্বাচন বয়কটের আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছিলেন। সেই সময় লেখা ‘এগেইনস্ট বয়কট’ প্রবন্ধেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও বয়কটের সিদ্ধান্ত কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে নিতে হয় তার মূল নীতিমালা তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেই ইউরোপের বিভিন্ন সমাজ গণতান্ত্রিক দলগুলো নিজ নিজ দেশের যুদ্ধস্বার্থ তথা জাতীয় বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তি শুরু করে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের যে নতুন সময়ে দুনিয়া প্রবেশ করল তাকে বিশ্লেষণ করে লেনিন লেখেন ‘ইম্পিরিয়ালিজম: দ্য হায়েস্ট স্টেজ অব ক্যাপিটালিজম’ (সাম্রাজ্যবাদ: পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়) নামক কালজয়ী রচনাটি। এই বইতে লেনিন দেখান সাম্রাজ্যবাদের আমলে দেখা দেয় বড় বড় একচেটিয়া কারবার ও পুঁজিপতিদের জোট। এই সাম্রাজ্যবাদকে তাই লেনিন বলেন একচেটিয়া পুঁজিবাদ। লেনিন দেখান কীভাবে পুঁজিবাদ ক্রমশ হয়ে উঠেছে প্রতিক্রিয়াশীল, সমাজের বিকাশের পথে এক মহা বিঘ্ন। মানবসমাজের সামনে অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজতন্ত্রের পথে হাঁটা অথবা উপনিবেশ, একচেটিয়াদের বিশেষ সুবিধা, সব ধরনের জাতীয় পীড়নে অভ্যস্ত হয়ে পড়া। সাম্রাজ্যবাদ মানবসমাজকে এক বিশেষ অর্থে সমাজতন্ত্রের কাছাকাছি নিয়ে আসে।

rushia revolution and lenin

 

১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বলশেভিক পার্টির আহ্বানে রাশিয়ার শ্রমিকেরা একটি রাজনৈতিক সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। এই আহ্বান অভূতপূর্ব সাফল্যলাভ করে এবং এতে যোগ দেয় দুই লক্ষের বেশি শ্রমিক নারীপুরুষ। ধর্মঘট বেড়ে ওঠে এক পরাক্রান্ত রাজনৈতিক শোভাযাত্রায়। “স্বৈরতন্ত্র ধ্বংস হোক। যুদ্ধ শেষ হোক। রুটি চাই।” এই স্লোগান নিয়ে রাজধানীর শ্রমিকেরা পথে নামে। ১৫ মার্চ ১৯১৭ রাষ্ট্রীয় দ্যুমার সাময়িক কমিটির প্রতিনিধিরা জারের সাথে সাক্ষাৎ করে সিংহাসন ত্যাগ করতে বলে। জার স্বৈরতন্ত্রের পতন হয়। রাশিয়ায় সম্পন্ন হয় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব।

জারতন্ত্রের পতনের পর যে বুর্জোয়া সরকার ক্ষমতায় আসীন হয় তা বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিলেও যুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষপাতী ছিলনা। লেনিন বলেন বিপ্লবের প্রথম পর্যায়টিই কেবল সমাপ্ত হয়েছে এবং তার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা গেছে বুর্জোয়াদের হাতে। তিনি শ্লোগান তুললেন সোভিয়েতগুলির হাতে সমস্ত ক্ষমতা তুলে দিতে হবে। বলশেভিকদের সভায় প্রলেতারিয়েতের কর্তব্য নির্দেশ করে ১৯১৭-র ১৭ এপ্রিল তিনি একটি বক্তৃতা দেন। এটি ‘এপ্রিল থিসিস’ নামে বিখ্যাত। এখানে তিনি বললেন ক্ষমতা যাওয়া চাই শ্রমিক শ্রেণি ও গরীব কৃষকের হাতে। সব ক্ষমতা চাই সোভিয়েতের হাতে। তিনি বোঝালেন কেবল সোভিয়েতগুলির রাজই পারে জনগণের জন্য শান্তি, কৃষকদের জমি এবং ক্ষুধিতদের রুটি দিতে।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক দেওয়ার পর বুর্জোয়া রাষ্ট্রের প্রতি পার্টির মনোভাব কী হবে এবং প্রলেতারিয়েতের হাতে ক্ষমতা এলে কী ধরনের রাষ্ট্র গঠিত হবে — সেই সময়ের সেইসব জ্বলন্ত প্রশ্নকে কেন্দ্র করে লেনিন লেখেন ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ বা ‘স্টেট অ্যান্ড রেভোলিউশন’ নামে তার বিখ্যাত বইটি। লেনিন সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমকে বিকাশের দুই পর্যায় হিসেবে গণ্য করেন ও সে সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা করেন।

সেপ্টেম্বর থেকে পরিস্থিতির চাকা আবার উল্টোদিকে ঘুরতে থাকে। জেনারেল কার্ণিলভ বলশেভিকদের চূর্ণ করার লক্ষ্য নিয়ে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন পেত্রোগ্রাদ অভিমুখে। কার্নিলভের বাহিনীর বিরুদ্ধে শ্রমিক জনগণের সংগ্রামে বলশেভিকরা নেতৃত্ব দিল। কয়েকদিনের মধ্যেই কার্নিলভ বাহিনী বিধ্বস্ত হল। এই বিজয়ের মধ্যে দিয়ে জনগণের ব্যাপক অংশ সবেগে বাঁক নিতে শুরু করল বলশেভিকদের দিকে।

১৯১৭’র ৬ নভেম্বর প্রাভদার ছাপাখানায় হামলার হুকুম দিল সাময়িক সরকার। পাল্টা বার্তা পাঠাল যুদ্ধ জাহাজ ‘অরোরা’, সাময়িক সরকারের রক্ষীদের পেত্রোগ্রাদে ঢুকতে দেবে না। বৈপ্লবিক সাঁজোয়া বাহিনীগুলো মিলিত হতে থাকল বিপ্লবের হেড কোয়ার্টার স্মোলনি ইন্সটিটিউটের কাছে। লেনিন চিঠি লিখলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের অভ্যুত্থানে বিলম্ব মানে সত্যিই মৃত্যু। ৭ নভেম্বর সকালে অভ্যুত্থানকারীদের দখলে যায় টেলিফোন, টেলিগ্রাফ ভবন, রেডিও স্টেশন। সব রেলসেতু, রেলস্টেশন এবং রাজধানীর অতি গুরূত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠান। ৭-৮ নভেম্বর মধ্যরাত্রের পর অভ্যুত্থানকারীদের হাতে এলো প্রধান ডাকঘর, নিকোলায়ভস্কি স্টেশন আর বিদ্যুৎ স্টেশন। সকালে নৌ বহরের নাবিকরা দখল করল রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্ক। দখল হল ওয়ারশ স্টেশন। যুদ্ধ জাহাজ ‘অরোরা’ এসে দাঁড়াল শীতপ্রসাদে কামান দাগার আওতার মধ্যে। সকালের মধ্যেই শহর চলে এলো অভ্যুত্থানকারীদের হাতে। ৮ নভেম্বর সকালে সামরিক বৈপ্লবিক কমিটি গ্রহণ করল লেনিনের আবেদন — রাশিয়ার নাগরিকদের প্রতি ঘোষিত হল সাময়িক সরকারের উচ্ছেদ ঘটেছে।

‘আরোরা’ থেকে শীত প্রাসাদে গোলাবর্ষণ শুরু হল, সাময়িক সরকারের প্রধানমন্ত্রী কেরেনস্কিরা পালিয়ে গেলেন। রাতে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ভরা জোয়ারে স্মোলনিতে শ্রমিক ও সৈনিকদের দ্বিতীয় সারা রুশ সোভিয়েত কংগ্রেসের উদ্বোধন হল। ৯ নভেম্বর রাতে সাময়িক সরকারের মন্ত্রীরা গ্রেপ্তার হলেন। ১০ নভেম্বর ভোরে শেষ হল সারা রুশ সোভিয়েত কংগ্রেস। ঘোষিত হল শান্তির ডিক্রি, ভূমির ডিক্রি, বলা হল — অবিলম্বে জমির ওপর জমিদারি মালিকানা উচ্ছেদ হবে। গঠিত হল বিশ্বের প্রথম শ্রমিক-কৃষকের সরকার, জন কমিশার পরিষদ। লেনিন নির্বাচিত হলেন তার প্রধান। জন্ম হল পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশের।

বিভিন্ন ডিক্রি জারি করে জনগণের দীর্ঘকালীন দাবি দাওয়াগুলির সমাধানের কাজ শুরু হয় সরকার প্রতিষ্ঠার দিন থেকেই। জমি, শান্তি ও রুটির শ্লোগানে বলশেভিকরা জনগণকে সংগঠিত করেছিল। নতুন সরকারের প্রথম পদক্ষেপ ছিল জমি ও শান্তির জন্য ডিক্রি জারি করা। ‘শান্তির ডিক্রি’র মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য অবিলম্বে শান্তি আলোচনা শুরুর ডাক দেওয়া হয়। ‘জমির ডিক্রি’র মাধ্যমে খোদ কৃষককে জমির ওপর অধিকার প্রদান করা হয়। এরপর একে একে জারি করা অন্যান্য ডিক্রিগুলো ছিল আট ঘন্টা শ্রমসময়, শ্রমিকদের হাতে কারখানার নিয়ন্ত্রণ, শ্রেণিভেদ ও সামাজিক মর্যাদাভেদ নিষিদ্ধকরণ, ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ, সেনাবাহিনীতে কর্মরত সমস্ত সেনার সমান অধিকার প্রদান, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, অবৈতনিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যরক্ষা এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের নতুন ইউনিয়ন গঠন ইত্যাদি সম্পর্কিত।

রুশ বিপ্লব ছিল খাঁটি গণবিপ্লব। বুর্জোয়া ব্যবস্থার বিলোপ ঘটে এর মধ্য দিয়ে। মানব ইতিহাসে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব, স্থাপিত হল শ্রমিক কৃষকের রাষ্ট্র। নভেম্বর বিপ্লব শুধুমাত্র একটা রাজনৈতিক ক্ষমতার বদল ছিলনা। রাশিয়ার জনগণের জীবনে এক গভীর সামাজিক অর্থনৈতিক রদবদল সূচিত করে এই বিপ্লব, শুরু হয় দেশের বৈপ্লবিক পুনঃনির্মান — নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের সূত্রপাত। একটি পিছিয়ে পড়া দেশে দ্রুত উন্নতি কীভাবে হতে পারে, একটি চরম বৈষম্য ও বিভাজনে জর্জরিত সমাজ কীভাবে সাম্য, ন্যায় ও প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে পারে — সোভিয়েত সমাজতন্ত্র তা সারা বিশ্বকে হাতেকলমে দেখিয়েছে। ভারত সহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলি গড়ে উঠেছে। পরবর্তীকালে চিন, ভিয়েতনাম বা কিউবার বিপ্লব এখান থেকে প্রেরণা সংগ্রহ করেছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতিয়তাবাদী আন্দোলনকে রুশ বিপ্লব নানাভাবে প্রেরণা দিয়েছে, প্রভাবিত করেছে। ভারতের সমাজের আমূল রূপান্তর, কৃষক, শ্রমিক, সমস্ত মেহনতি মানুষ, নারী, দলিত, আদিবাসীদের ক্ষমতায়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সবার সমান অধিকার, বৈষম্য ও শোষণের অবসানের জন্য যে লড়াই চলমান, রুশ বিপ্লব আজও তাকে প্রতিনিয়ত প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে।

- সৌভিক ঘোষাল

 public health

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘স্বাস্থ্যসাথী’ চিকিৎসা বিমা প্রকল্প চালুর এখনও বছর গড়ায়নি, এখনও কার্ড বিলি লক্ষ্যমাত্রা থেকে বহু পেছনে পড়ে রয়েছে, এরমধ্যে সরকারপক্ষ শোনাতে শুরু করেছে এমন নানা পর্যালোচনী নির্দেশিকা, যেসব ঠেকছে পরস্পর বিরোধী হিসেবে। যেমন একদিকে বলা হচ্ছে, রোগীকে ‘রিফিউজ’ করা —‘রেফার’ করা যাবে না, অন্যদিকে পূর্বশর্তারোপ করা হচ্ছে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে গেলে ‘স্বাস্থ্যসাথী’ বা সিজিএইচএস, ডব্লিউবিজিএস, ইএসআই — কোনও না কোনও ধরনের কার্ড লাগবেই। না থাকলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এতই যদি সদিচ্ছা তাহলে গোড়া থেকেই এই ব্যবস্থা চালু করা হয়নি কেন? যখন ‘দুয়ারে’ কার্ড বিলিবন্টনের পরিকাঠামো পর্যাপ্ত নয় বলে প্রমাণিত হচ্ছে তখন হাসপাতালে তার ব্যবস্থা কি নিশ্চিত করে তোলা হবে? নাকি শোনানো হচ্ছে স্তোকবাক্য! এই সন্দেহ জাগে এজন্য কারণ সরকার পক্ষের কথায় ও কাজে প্রায়শই ধোঁকা খেতে হয়। সরকার দাবি করছে কার্ড পেয়ে গেছে প্রায় ২.৩০ কোটি পরিবার, সেইমতো পরিষেবা পাওয়ার আওতায় এসে যাওয়া জনসংখ্যা কমবেশি ৮ কোটির মতো। যদিও অনুন্নত জেলাগুলোতে কার্ড বণ্টন কর্মসূচি যথেষ্ট অবহেলিত। ফলে যত কোটি পরিবারকে কার্ড দিয়ে দেওয়ার পরিসংখ্যান সরকার জানাচ্ছে তার যথার্থতা নিয়ে জিজ্ঞাসা থেকেই যাচ্ছে। রাজ্য সরকার উপরন্তু বড় গলা তুলে দাবি করছে ইতিমধ্যেই ‘জাল’ কার্ড ধরা পড়েছে বিপুল সংখ্যায়, যার উপভোক্তার সংখ্যা আনুমানিক ৫০ লক্ষের মতো। কেবলমাত্র একজন সদস্য ভিত্তিক উপভোক্তার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ লক্ষের মতো। সরকারি অনুমানে এই সংখ্যাটিও যথেষ্ট গোলমেলে। স্বাস্থ্য প্রশাসন বলছে এহেন ভূয়ো কার্ডের প্রমাণ হল, হয় তাতে আধার নম্বর উল্লেখ নেই, নয়তো একই আধার নম্বর উল্লেখ রয়েছে একাধিক কার্ডে। কিন্তু তাতে কি তথ্যপ্রমাণ হয় যে, জাল? সরকার কি করে দাবি করতে পারে এইসমস্ত অসঙ্গতির দায় সরকারি দায়িত্বে কার্ড তৈরির বেলায় হয়নি? সরকারের দাবি মতো ভুতুড়ে কার্ডের সংখ্যা প্রমাণ হলে তো মোট বিলি হওয়া কার্ডের সংখ্যা অনেক কমে আসবে। এবিষয়ে আমজনতাকে রাখা হচ্ছে ধোঁয়াশায়। নাকি এরমধ্যে রয়েছে এক বড় সংখ্যায় উপভোক্তাদের ছেঁটে ফেলতে ‘গল্প’ তৈরির চেষ্টা, অথবা প্রকল্পটি থামানো-গোটানোর ‘খেলা’! এরকম ‘খেলা’ কেন্দ্রের মোদী সরকার তো বহুত দেখিয়েছে। সরকারি গণবণ্টন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে, এমএনআরইজিএ খাতে, বা রাজ্যে রাজ্যে ভ্যাক্সিন কোটা বিলির ক্ষেত্রে। সংখ্যাতত্ত্বে জল মেশানোয়, বৈষম্য চালানোয় মোদীর খাতায় কোনও অভাব দ্বিধা রাখা হয় না।

মমতা সরকারও নেয় একই হীন কৌশলের আশ্রয়, যেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রবিশেষে জনপ্রিয়তাবাদী সংস্কারসূচি রূপায়ণের পদক্ষেপ করা হয় এক বর্গের জন্য প্যাকেজ চালু করা হয় অন্য আরেক বর্গের জন্য অনুসৃত প্যাকেজ প্রত্যাহারের বিনিময়ে। যেমন স্কুলের মেয়েদের জন্য সাইকেল প্রদানের প্রকল্প চালু হয়েছে, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে নির্মাণ শ্রমিকদের সাইকেল পাওয়ার সুযোগ। নয়া উদারবাদী অর্থনীতির ধাঁচায় সস্তা জনপ্রিয়তাবাদী ফায়দা লুটে নেওয়ার এটাই জারিজুরি। বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিং হোম ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার এখনও ব্যর্থ। প্রয়োজনীয় কার্যকরি পদক্ষেপ করছে কি! এক্ষেত্রে মালিক ও দালালচক্রের আঁতাত গজিয়ে ওঠা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতাল ব্যবস্থা যখন অপ্রতুল, সেখানে যখন রিফিউজ আর রেফারে হয়রান হতে হয়, তখন নিরুপায় হয়ে দ্বারস্থ হতে হয় বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমের, আর তার সুযোগ নিয়ে উত্তরোত্তর হয়রান করায় কর্তৃপক্ষ। সরকারের হিসেব মতো রাজ্যে কার্ড গ্রহণযোগ্য নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা মোট আনুমানিক ৩,৩০০। রাজ্যের ৮-৯ কোটি জনসংখ্যার তুলনায় কম। সরকারি হাসপাতালে যেমন, তেমনি বেসরকারি হাসপাতালেও রোগীর পরিচিতি থেকে শুরু করে ভর্তিতে, রোগ নির্ণয়ে ও চিকিৎসায় চলে দীর্ঘসূত্রিতা। সরকার বলছে বেসরকারি হাসপাতালবর্গ চিকিৎসার নামে কার্ডের বিনিময়ে কেবলই বাড়াচ্ছে ভূয়ো বিল। এইসব যদি শুরু হয়ে থাকে তবে সরকার জরুরি কড়া ব্যবস্থা নিক। তা না করে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে মাঝেমধ্যে ‘বাড়াবাড়ি করলে লাইসেন্স বাতিলের’ হুঙ্কার কার্যত প্রতিপন্ন হয় বায়বীয়ই।

এযাবত পর্যালোচনা থেকে কতগুলো জরুরী গণদাবি উঠে আসে। প্রথমত, যুদ্ধকালীন পদক্ষেপে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড বিলির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হবে। কার্ড থাকুক না-থাকুক কোন অজুহাতে একজনও উপভোক্তার চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া চলবে না। সরকারের তত্ত্বাবধান কার্যকরি করতে হবে জেট গতিতে, ঝেঁটিয়ে দূর করতে হবে গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিকতাকে, জায়গা করে দিতে হবে জনগণের গণতান্ত্রিকতাকে, সমাজ-সংগঠনের গণতদারকিকে। আর প্রয়োজনে সজাগতা বহুগুণ বাড়াতে হবে, সাহসী ব্যবস্থা নিতে হবে মুনাফাখোর স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের।

Reality Check On Vaccine

পিএম নরেন্দ্র মোদী এক ভাষণে এবং একটি প্রতি-সম্পাদকীয় পাতায় দাবি করেছেন যে তাঁর নেতৃত্বে ভারত টীকাকরণে ‘ঐতিহাসিক’ ও চমকপ্রদ বিজয় অর্জন করেছে, ২০২১-র ২১ অক্টোবর কোভিড১৯-র ১০০ কোটি ডোজ প্রদান সম্পন্ন হয়েছে।

ভ্যাক্সিন নিয়ে এই আত্মগরিমা প্রচারের সাথে সাথে চেষ্টা করা হচ্ছে মোদীকে ‘ভ্যাক্সিন ম্যান’ হিসেবে তুলে ধরার। কোভিডের প্রথম ঢেউয়ে লকডাউনে ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংকটে ভারতে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন গেছে। এই অপরাধসম অপদার্থতার মূল নায়ক হিসেবে নরেন্দ্র মোদী দেশ বিদেশে পরিচয় লাভ করে। এখন সেই ইমেজ মেরামত করতে তাঁকে ‘ভ্যাক্সিন ম্যান’ বানিয়ে প্রচার চালানো হচ্ছে। গঙ্গায় বয়ে চলা লাশের পর লাশ আর অক্সিজেনের অভাবে খাবি খেতে খেতে মরে যাওয়ার ভয়ঙ্কর দৃশ্যগুলি যে জনস্মৃতিকে আজও তাড়িয়ে ফেরে তা বিলক্ষণ জানেন নরেন্দ্র মোদী। কেন্দ্রের ও উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারকে চরম ধিক্কার জানিয়ে ২০২১ সালের ৫ মে এলাহাবাদ হাইকোর্ট বলেছে, “হাসপাতালগুলিতে শুধুমাত্র অক্সিজেন সরবরাহ না করার ফলে কোভিড রোগীদের এই মৃত্যু অপরাধমূলক কাজ, গণহত্যার থেকে কম কিছু নয়”। এখন উত্তর প্রদেশে নির্বাচন আসন্ন। মোদী সরকার তার অপরাধের ফলশ্রুতির দুঃসহ স্মৃতি চাপা দিতে এখন টীকাকরণের ক্ষেত্রে এই ঐতিহাসিক সাফল্যের মনগড়া রিংটোন বাজিয়ে চলেছে।

কিন্তু খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে মোদীর এই বগল বাজানোর পেছনে কোনও বাস্তব সাফল্য নাই। মোদী সরকার ঘোষণা করেছিল তিনমাসের মধ্যে ১০০ কোটি ডোজ সম্পন্ন করার। তার বদলে লাগিয়েছে নয়মাস। ঘোষণা করেছিল ২০২১-র মধ্যে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্কদের টীকাকরণ সম্পন্ন হয়ে যাবে — এই লক্ষ্য ভারতে এখনও সুদূরপরাহতই হয়ে আছে।

ভারতে ১৮ বছর ও তার বেশি বয়সিরা কোভিড১৯ ভ্যাক্সিন পাওয়ার যোগ্য ধার্য হয়েছে। অন্য প্রায় সমস্ত দেশই কিন্তু ১২ বছর ও তার বেশি বয়স্কদের ভ্যাক্সিন দিয়েছে। সুতরাং ভারতে জনসংখ্যার মোট যত শতাংশকে টীকার যোগ্য ধরা হয়েছে তা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। টীকাযোগ্য এই জনসংখ্যার মধ্যেও মাত্র ৩১ শতাংশ মানুষের পূর্ণ টীকাকরণ হয়েছে, এবং একটা ডোজ অন্তত পেয়েছে এরকম অংশ মাত্র ৭৫ শতাংশ।

অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতের এই করুণ পারফরম্যান্সকে জনসংখ্যার আধিক্যের দোহাই দিয়ে বৈধতা দিতে চাওয়া হয়। কিন্তু এই অজুহাত ধোপে টেঁকে না। ভারতের থেকে অনেক বেশি জনসংখ্যার দেশ হয়েও চীন তাদের ৭১ শতাংশ জনতার সম্পূর্ণ টীকাকরণ সম্পন্ন করেছে।

ভারত ভ্যাক্সিনের অর্ডার দিতেই অপেক্ষা করেছে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত। টীকাকরণের কাজ শুরু হওয়ার মাত্র পাঁচ দিন আগে অর্ডার দিয়েছে। অন্যান্য দেশগুলি যেমন অনেক আগে থেকেই ভ্যাক্সিনের অর্ডার দিয়ে রেখেছিল, ভারত তা করেনি। আর, যে পরিমাণ ভ্যাক্সিন আনা হয় তাতে মাত্র ২০ শতাংশ জনসংখ্যাকে একটি মাত্র ডোজ দেওয়া যাবে। ভ্যাক্সিন সংগ্রহে এই বিলম্ব তীব্র ভ্যাক্সিন সংকটের জন্ম দেয় এবং কোভিড১৯-র দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়ঙ্কর ধাক্কার সামনে ভারতের জনতাকে অসহায় ও বিপর্যস্ত করে তোলে।

মোদী দাবি করছেন, সব ভারতবাসী বিনি পয়সায় টীকা পেয়েছে। মিথ্যা দাবি। বাস্তবে প্রায় সব দেশেই কোভিড১৯ ভ্যাক্সিন একদম ফ্রি। কিন্তু ভারত সেইসব গুটিকয় দেশের মধ্যে অন্যতম যেসব দেশের মানুষকে টাকা খরচ করে ভ্যাক্সিন নিতে হয়েছে। ভ্যাক্সিন দালালদের সাথে নিজেদের মত চুক্তি করে নেওয়ার দায় পিএম মোদী রাজ্যগুলির ঘাড়েই চাপিয়ে দেয়। এরফলে ভ্যাক্সিনের দামে চরম নৈরাজ্য চলতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করে এবং সরকারকে বাধ্য করে ভ্যাক্সিনের কোনও না কোনও মূল্যসীমা বেঁধে দিতে।

মোদী যে দাবি করছেন ‘টীকাকরণে কোনও ভিআইপি কালচার নাই’, সেটাও মিথ্যা। প্রত্যেক মাসে যে পরিমাণ ভ্যাক্সিন আহরণ করা হয়েছে তার ২৫ শতাংশ পাওয়ার অধিকার সরকার দিয়ে দিয়েছে প্রাইভেট হাসপাতালগুলিকে, এবং তুলনামূলক সুবিধাভোগীরা সেসব কিনে নিতে পেরেছে আর গরিব মানুষকে দিনের পর দিন লাইন দিতে হয়েছে সরকারি কেন্দ্রগুলিতে।

ভ্যাক্সিন আহরণে অনেক দেরি করায় তীব্র ভ্যাক্সিন ঘাটতি; এপ্রিল ২০২১-এ কুম্ভ মেলায় বিপুল জমায়েতকে উৎসাহ দেওয়া; হিন্দু উপাসকদের কোভিড১৯ হবে না বলে বার্তা প্রচার; কুম্ভে করোনা টেস্টের ডেটা জাল করে মিথ্যা নিরাপত্তাবোধ তৈরি করা; আর, হাসপাতালে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়া — সব মিলিয়ে দ্বিতীয় ঢেউয়ের আকার, মাত্রা ও ভয়াবহতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য পিএম মোদী ও বিজেপির অন্যান্য নেতারাই ব্যক্তিগতভাবে দায়ি। তখন থেকেই পিএম মোদী দ্বিতীয় করোনা ঢেউয়ের মৃত্যুর পরিসংখ্যান চাপা দিতে মরিয়া। উনি মাত্র ৪ লক্ষ মৃত্যু স্বীকার করেছেন, যদিও বাস্তবে মৃত্যুর সংখ্যা ৪০ লক্ষের কাছাকাছি। এমনকি আজও কোভিড১৯’এ এতিম হওয়া অনেক বাচ্চা ও অনেক সাথীহারা নারী বা পুরুষ বাঁচার জন্য লড়ে যাচ্ছেন, সরকার থেকে কোনও সহযোগিতা পাওয়া তো দূরের কথা স্বীকারই করা হচ্ছে না। প্রথম ঢেউয়ের সময় প্রধানমন্ত্রীর নিষ্ঠুর ও অপরিকল্পিত লকডাউন অগুন্তি পরিযায়ি শ্রমিকের জীবন কেড়ে নিয়েছিল এবং ভারতকে গভীরতর কর্মহীনতায় নিমজ্জিত করেছিলো। এখন পিএম মোদী তাঁর গোদি মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে নিজের অপরাধসম করোনা-ব্যর্থতাকে বদলে দিতে চাইছেন ভ্যাক্সিন-সাফল্যের মনগড়া কাহিনীতে।

বিশ্বের পণ্ডিতদের এক সভা থেকে একটি ‘দুর্বৃত্ত গ্যালারি’ প্রস্তুত করা হয়েছে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে যাদের ভুল নির্দেশনা ও নীতির ফলে কোভিড১৯’এ বিপুল সংখ্যক প্রাণ ঝরে গেছে, অন্যথায় এইসব প্রাণহানি এড়ানো যেত। এই দুর্বৃত্ত তালিকায় নরেন্দ্র মোদীর নাম এক নম্বরে আছে। তালিকায় আছে ব্রাজিলের জাইর বলসনারো, বেলারুশের আলেক্সন্ডার লুকাশেঙ্কো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং মেক্সিকোর আন্দ্রেই ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাডর। জীবনহানি ঘটানোর অপরাধে এইরকম নেতাদের কাঠগড়ায় তোলা দরকার।

একথা স্মরণ করার মতো যে ব্রাজিলে সংসদীয় প্যানেল ১,২০০ পাতার একটি রিপোর্ট পেশ করে সুপারিশ করেছে যে জাইর বলসনারোর ওপর ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’এর চার্জ আনা হোক। কারণ কোভিড১৯ সংক্রান্ত নীতির ক্ষেত্রে তাঁর অপদার্থতা ৬ লক্ষ ব্রাজিলিয়র জীবন কেড়ে নিয়েছে। এই রিপোর্টে ব্রাজিলে ভারত বায়োটেকের প্রাক্তন বিজনেস পার্টনার প্রেচিসা মেডিকামেন্টসকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে প্রতারণা ও জালিয়াতির সাথে সাথে ‘সংগঠিত অপরাধ চালানো’র অভিযোগে। ভারতেও কেন্দ্রীয় সরকার ও সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলিকে কোভিড১৯ ও লকডাউন বিপর্যয়ের জন্য কাঠগড়ায় তোলা দরকার যারা বাস্তবতই ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী’।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৬ অক্টোবর ২০২১)

box number_2

 

constitutional democracy

ত্রিপুরায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে গোমতী জেলার নির্বাচনী আধিকারিক ও জেলাশাসকের কাছে গত ১ নভেম্বর এক ডেপুটেশনে দাবি করা হয় আগে সাংবিধানিক গণতন্ত্র ও আইন শৃঙ্খলার পরিবেশ ফেরাতে হবে, যতদিন তা না হবে ততদিন পৌর ও নগর সংস্থাগুলিতে নির্বাচন বন্ধ রাখার দাবি থাকবে। কারণ গোমতী জেলায় সুষ্ঠু-স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার মতো বাস্তবে কোনও পরিবেশ নেই। গত সেপ্টেম্বর থেকে বিরোধীদের উপর সংঘটিত ক্রমবর্ধমান ভয়াবহ সন্ত্রাসের ফলে জনজীবনে তীব্র আতঙ্ক ও ভীতি সঞ্চারিত হয়েছে। সম্প্রতি রাজ্যে প্রায় সবকয়টি প্যাকস্, ল্যাম্পস্, অন্যান্য সমবায় সমিতি ও সুখ সাগর জলা শ্রমিক সমবায় সমিতি লিমিটেড-এর নির্বাচনে সন্ত্রাসের আবহে বিরোধীদের মনোনয়ন পত্র সংগ্রহে ও প্রতিটি পর্যায়ে অংশগ্রহণ করতে বাধা দেওয়া হয়েছে এবং জোরপূর্বক বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসক দল বিজেপি জয়ী হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর অমানবিক বর্বর ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এ রাজ্যে ও এ জেলায় সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত ও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে সঞ্চারিত অজানা ভীতি ও আতঙ্ক এখনো কাটেনি। তার আগে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসক দল বিজেপি-র ৯৫ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ তাই প্রমাণ করে। গত পৌর ও নগর সংস্থাগুলিতে জবরদস্তি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভয় দেখিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করা এবং পুননির্বাচনের নামে সম্পূর্ণ প্রহসন অনুষ্ঠিত করার মাধ্যমে জোর জবরদস্তি এগুলোকে দখল করে। এগুলো সংবিধান সম্মত বিধি দ্বারা নির্মিত স্বায়ত্ব শাসিত সংস্থা। এগুলোর নির্বাচন প্রক্রিয়াও সংবিধান প্রদত্ত অধিনিয়ম ও বিধি দ্বারা পরিচালিত। আর আইন শৃঙ্খলার গ্যারান্টি সহ সুষ্ঠ, স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ যে কোনও নির্বাচনের প্রাথমিক শর্ত। কিন্তু এর কোনোটাই সমগ্র রাজ্যে ও এই জেলায় নেই।

তাছাড়া, গত প্রায় ৪ বছর ধরে সমগ্র রাজ্যে ও এই জেলায় বিরোধী দলের মিছিল মিটিং করা ও রাজনৈতিক কাজকর্ম করার কোনও অধিকার নেই। সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে বারবার বিরোধী দলের নেতা, কর্মী ও এমএলএ-রা আক্রান্ত হয়েছেন। পার্টি অফিস, বাড়িঘর, দোকানপাট, সহায় সম্পদ হয় ভাঙচুর করে নষ্ট করা হয়েছে। নয় আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নষ্ট করা হয়েছে। পুলিশ বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। ফলে আইন শৃংখলা ভেঙ্গে পড়েছে। সংবিধান ও গণতন্ত্র আজ বিপন্ন। তাছাড়া এই পৌর সংস্থার নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন আধিকারিক, রিটার্নিং অফিসারগণ সব দলকে ডেকে মিটিং করছেন না। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনকে কোনও মিটিং-এ ডাকা হয়নি। অস্বাভাবিক পরিবেশকে স্বাভাবিক করার জন্য প্রশাসন কোনও ভূমিকা গ্রহণ করেনি। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের বাড়িতে বেছে বেছে হামলা করা হচ্ছে। উদয়পুর রাজারবাগে ১৫ নং ওয়ার্ডে রুশো বিবি আক্রান্ত হয়েছেন।

এমতাবস্থায়, অন্যান্য নির্বাচনের মতো এই পৌর সংস্থাগুলির নির্বাচন সম্পূর্ণ প্রহসনে পরিণত হতে বাধ্য। তাই, সিপিআই(এমএল), ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি দাবি করছে যে —

(১) সবার প্রথমে রাজ্যে ও এই জেলায় সংবিধান প্রদত্ত গণতন্ত্র, আইন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।

(২) নির্বাচন হওয়ার মতো সুষ্ঠ, স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। যাতে সমস্ত দলের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ইচ্ছুক প্রার্থীরা নির্ভয়চিত্তে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন এবং নির্বাচকমন্ডলী সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ও নির্ভয়চিত্তে তাদের পবিত্র ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।

(৩) সব দলের প্রার্থীদের, তাদের পরিবারের সদস্যদের ও তাদের জান মালের উপযুক্ত নিরাপত্তা বিধান করতে হবে।

(৪) এগুলো বাস্তবে সম্ভব না হওয়া পর্যন্ত এই পৌর সংস্থাসমূহের নির্বাচন বন্ধ রাখতে হবে। এপ্রশ্নে সব রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। সরকারকে সংবিধান প্রদত্ত গণতন্ত্র ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যক্ষেত্রে দায়বদ্ধ হতে হবে।

ডেপুটেশনের প্রতিলিপি দেওয়া হয় উদয়পুর পৌর পরিষদ নির্বাচনী রিটার্নিং অফিসার এবং ত্রিপুরা রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের কাছে।

Bankura district cleaning workers

একদিকে কেন্দ্রের ‘স্বচ্ছ ভারত’ তো অন্য দিকে রাজ্যের ‘নির্মল বাংলা’র সরকারি শ্লোগান – তবু সাফাইকর্মীরা পড়ে রয়েছেন তিমিরে। রাজ্য সরকার গত ৩০ জুন শ্রম দপ্তর কর্তৃক নির্দেশ দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি পৌরসভাতে কর্মের দক্ষতা অনুযায়ী তিন ধরনের ক্যাটাগরিতে শ্রমিকদের দৈনিক ন্যূনতম মজুরি কত হবে। বাঁকুড়া জেলার সমস্ত পৌরসভাগুলিকে দুটি নির্দিষ্ট জোনে ভাগ করা হয়েছে। এতকিছুর পর বিষ্ণুপুর পৌরসভার সাফাই ও অন্যান্য জরুরি বিভাগের কর্মীরা গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে আন্দোলনে নামেন দৈনিক ৩৪২ টাকা মজুরি চালু করতে হবে এবং সরকারী নির্দেশ মোতাবেক ৪,৫০০ টাকা পুজোর অনুদান দিতে হবে দাবিতে। পৌরকর্তৃপক্ষের কাছে কেবল ফাঁকা আশ্বাস ছাড়া ন্যূনতম সম্মান পর্যন্ত পাননি শ্রমিকদের নেতৃত্ব। এবারের দুর্গাপূজার কয়েকদিন আগে হটাৎ খবর হয় পুজোর অনুদান দেওয়া হবে মাত্র ১,২০০ টাকা। শ্রমিকদের অসন্তোষ বেড়ে হরতালের রূপ নেয়। লাগাতার তিনদিন আন্দোলন চলার পর পুলিশের উপস্থিতিতে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে বেতন বৃদ্ধি ও বকেয়া অনুদানের টাকা মেটানোর আশ্বাস শোনা যায় পুনরায়। পুজোর মুখে শহরবাসীর কথা মাথায় রেখে আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত করেন এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত বিষ্ণুপুর পৌরসভা সংগ্রামী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন।

পুজোর ঠিক পরেপরেই বাঁকুড়া পৌরসভার (এআইটিইউসি অনুমোদিত) এক ইউনিয়নের সাথে বৈঠক করে ‘বাঁকুড়া বিষ্ণুপুর সোনামুখী পৌরসভা শ্রমিক কর্মচারী অধিকার মঞ্চ’ গঠন করা হয়। এই মঞ্চে যুক্ত হয় সিআইটিইউ অনুমোদিত অন্য একটি ইউনিয়ন। সোনামুখীর সাফাই কর্মীরাও এই মঞ্চকে স্বাগত জানায়। মঞ্চের তরফ থেকে পোষ্টার ও দেওয়াল লিখন করে ২৯ অক্টোবর ডিএম ডেপুটেশনের ঘোষণা করা হয়। এই যৌথ আন্দোলনের মেজাজ ছিল শাসক গোষ্ঠীর কাছে যেন এক অশনিসংকেত। ২৯ তারিখ বাঁকুড়া শহরে হিন্দু স্কুলের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয় চারশো শ্রমিককে একত্রিত করে। সেখানে মহিলাদের উপস্থিতি ছিল কম করে তিন ভাগের এক ভাগ। বিষ্ণুপুর থেকেই দেড়শত অধিক শ্রমিক যোগ দেন ঐ মিছিলে। মিছিল শেষে মাচানতলা মোড় আংশিকভাবে অবরুদ্ধ করে চলে সভা। গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন সাথী সাগর দা। বক্তব্য রাখেন বাবলু ব্যানার্জী সহ অন্যান্য বক্তারা। ডেপুটেশনে প্রতিনিধিত্ব করেন সর্বানী সিনহা, ফারহান খান ও জিতেন। মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয়, জেলা প্রশাসন আশ্বাস দিলেও যতক্ষণ না সরকার নির্ধারিত মজুরি চালু করা হচ্ছে এবং বিষ্ণুপুর পৌরসভার সাফাই ও অন্যান্য অস্থায়ী কর্মীদের বকেয়া অনুদান মেটানো হচ্ছে, ততদিন এই আন্দোলন আরো তীব্র করা হবে। আগামীতে প্রয়োজনে একসাথে সবকটি পৌরসভাতে হরতাল করবে শ্রমিকরা জানান ফারহান।

At Tikri Border

২৯-৩০ অক্টোবর দিল্লীর এমপি ক্লাব। অল ইন্ডিয়া সেন্ট্রাল কাউন্সিল অফ ট্রেড ইউনিয়নস-এর সর্বভারতীয় অফিস বেয়ারার মিটিং ছিল। একদিন আগে পৌঁছে ২৮ অক্টোবর দিল্লীর ‘চারু ভবন’ সংলগ্ন লক্ষ্মীনগর মেট্রো স্টেশন থেকে অতনু চক্রবর্তী, বাসুদেব বসু আর এই প্রতিবেদক টিকরি বর্ডারের উদ্দেশে রওনা দিলাম। পন্ডিত শ্রীরামশর্মা স্টেশন লাগোয়া রাস্তায় সারা ভারত কিষাণ মহাসভার তাঁবু পড়েছে।

তাঁবু নিয়ে আমি বরাবর স্মৃতিকাতর। একদম শিশুকালের ঘটনা মাঝে মাঝে মনের কোঠায় ফিরে আসে। আমার বাবা সেনাবাহিনীতে ঢুকে পড়েছিলেন। সদ্য স্বাধীন দেশ, বর্তমান সময়ের মতো সেনাবাহিনীর এতো রমরমা বাজার ছিল না। বাবা দিল্লী থেকে উত্তর প্রদেশের ঝাঁসির বোবিনায় বদলি হলেন। আর পুরো পরিবার নিয়ে আমি, দিদি এবং মাকে সঙ্গে নিয়ে বোবিনায় চলে এলেন। মুস্কিল হল কোয়ার্টার পাননি, অগত্যা মাঠের মাঝেই বিশাল তাঁবু তৈরি হল আমাদের আস্তানার জন্য। কাজ থেকে ফিরে বাবা প্রতিদিন তাঁবুর দড়ি টেনে টেনে শক্ত করতেন যাতে তা হাওয়ায় উড়ে না যায়। দিদি ও আমি দুজনেই এই কাজে হাত লাগাতাম। কিন্তু ঝড়ে তাঁবু মাঝে মধ্যেই কাত্ হয়ে পড়ে যেত আর আমরা খুব ভয় পেতাম। ভয়ের জন্যই এখনও স্মৃতিতে আছে। আর একবার তাঁবুর বিপদে পড়েছিলাম। ১৯৮২-র ২৪ এপ্রিল আইপিএফ’এর দিল্লীতে গঠন সম্মেলন হচ্ছিল তাঁবু টাঙিয়ে, হঠাৎ দমকা হাওয়া আর বৃষ্টির তোড়ে প্রতিনিধিরা তাঁবুর তলায় চাপা পড়ে গেলেন। ঝড়ের জন্য বিদ্যুৎ সরবারহ আগেই বন্ধ করা হয়েছিল, তাই বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া গিয়েছিল। তাঁবুর কথা শুনলেই এই দুটি স্মৃতি চলে আসে।

টিকরিতে তাঁবু বলতে ভেবেছিলাম চারিদিকে সার্কাসের যেমন তাঁবু হয় সেরকমই হবে। ট্রেন থেকে নেমে হতাশ হলাম, কোথায় তাঁবু? একটু নজর দিতেই দেখলাম প্লাস্টিকে মোড়া ছোট ছোট বিভিন্ন মাপের ঘর, তাতে বিভিন্ন রঙের পতাকা, ফেস্টুন, নেতাদের ছবি। বিভিন্ন সংগঠনের নিজের নিজের টেন্টে নিজেদের পরিচিত নেতাদের ছবি। ৭৮২ নম্বর পিলারে সারা ভারত কিষাণ মহাসভার অস্থায়ী তাঁবু। সেখানেই ট্রলি সমাচারের কার্যালয় ও লাইব্রেরি আছে। কয়েকজন আন্দোলনকারী কমরেড চৌধুরী পাল সিং, গুরপাল সিং, বিকর সিংয়ের সাথে আন্দোলনের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা হল। ওনাদের কাছ থেকে শুনলাম মানসার ১৬৬ জন শহীদ হয়েছেন। হরিয়ানার নয়া গাঁও ফ্লাইওভার থেকে মানসার মহিলারা গ্রামে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন সেই সময় একটা ট্রাক তিন জন মহিলাকে পিষে দিলে তিন জনেরই মৃত্যু হয়, কয়েকজন গুরুতর জখম হয়েছেন। প্রতিদিন বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটছে, সবারই ধারণা এগুলো পরিকল্পিতভাবেই হচ্ছে।

কিষাণ মহাসভার টেন্ট থেকে অটো করে স্থায়ী প্রতিবাদী মঞ্চে গিয়ে হাজির হলাম। মঞ্চের পিছনে দিল্লী পুলিশ বিশাল বিশাল কংক্রিটের স্ল্যাব ও কাঁটাতার দিয়ে হরিয়ানা বর্ডার সীল করে দিয়েছে। আন্দোলনকারীরাও মাথার উপর টিনের ছাউনিওলা পাকাপোক্ত স্থায়ী ধর্ণামঞ্চ বানিয়ে দিল্লী বর্ডার সীল করে দিয়েছেন। মিটিং চলছে। আমরা নিজেদের সংগঠনের পরিচয় দিলাম এবং বাসুদেব সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখলেন।

holding hands and living together

 

২২/২৩ কিলোমিটার লম্বা রাস্তার ধারে ধর্ণাস্থলে কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতি। সব তাঁবুগুলোই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, পানীয় জল এবং অন্য কাজের ব্যবহারের জন্যে আলাদা জলের ট্যাংক, এয়ারকুলার, ফ্রীজ সব কিছু আছে সেই তাঁবুগুলিতে। যেখানেই যাবেন, চা না খাইয়ে ছাড়বে না। সবার মধ্যেই এক ধরনের সরলতা ও দৃঢ়তার স্পষ্ট ছাপ। লড়াই দীর্ঘদিন চলবে ধরে নিয়েই ওরা চলছেন। প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারার জন্য স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা পাচ্ছেন। হঠাৎ করে এতো মানুষ প্রায় এক বছরের মতো আছেন, কিন্তু কোনও দুর্গন্ধ-দূষণ পাবেন না। যত দেখছি অবাক হচ্ছি, এটাও কীভাবে সম্ভব! গ্রামগুলোই স্বেচ্ছাসেবকদের আসা এবং ফিরে যাওয়ার ব্যপারটা নিয়ন্ত্রণ করে। যারা অবস্থানে থাকেন তাদের কিছু আর্থিক সহায়তা করা হয়। অনেকেই চাকরি ছেড়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন, তারা অনেকেই এই এক বছরের মধ্যে একদিনের জন্যও বাড়ি যাননি। আর আছেন বিদেশে কর্মরতরা, দু’হাত ভরে সাহায্য করে চলেছেন। টিকরি বর্ডারের ধর্ণায় প্রধানত থাকছেন পাঞ্জাবের কৃষকরাই।

ডাঃ সোয়াই মান সিং আমেরিকায় থাকতেন, পেশায় ডাক্তার। তিনি আমেরিকার পাট চুকিয়ে দিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। সারাদিন চিকিৎসা করে চলেছেন। দিনের নির্দিষ্ট সময় লঙ্গর চালু থাকে, যারা লঙ্গরে যান না, তাদের রেশনের কুপন দেওয়া হয়। নিজেরাই রান্না করেন। ‘পঞ্চ নদীর হৃদয়ে যে ইনকিলাবীর ঢেউ’ উঠেছে তা উদ্বেল করে তুলেছে সুদুর কালিফোর্নিয়া পিন্ড কৃষি আঞ্চলের শিখ কৃষকদেরও। তারা অনেকেই ধর্ণায় সামিল হয়েছেন।

বেলা তিনটে, নিত্যদিনকার মতো সভা শেষ হল। স্বেচ্ছাসেবকরা কয়েক মিনিটের মধ্যে সভার স্থল পরিষ্কার করে ফেললেন। কালান্তর পত্রিকার সাংবাদিক উৎপল দাস লাল জামা গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন, ওনার আফসোস বামেদের বিভাজন নিয়ে। ভাতিন্দা থেকে এসেছেন সিপিএমের কর্মী-সমর্থকরা, একটাই প্রশ্ন — বাংলায় বামেরা কেন দুর্বল হচ্ছে? লাল ঝান্ডা নিয়ে কয়েক জন যুবক যাচ্ছিলেন জিজ্ঞেস করতে জানালেন ওরা এনডি সংগঠনে যুক্ত আছেন, ভাতিন্দায় থাকেন। পথ চলছি। অনেকেই নিজেদের তাঁবুতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। বিকেইউ’র তাঁবুতে গেলাম, অনেক কথা হল, চা খাইয়ে তবে ছাড়লেন। প্রায় ৩০০ মতো সংগঠন, তাদের সবার রাজনৈতিক, সামাজিক নিজস্বতা নিয়েই আছেন, কিন্তু এখানে সবাই এক। আন্দোলনে যুক্ত সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে এক উচ্চ পর্যায়ের ঐক্য লক্ষণীয়, কারও মুখে অন্য কোন সংগঠন সম্পর্কে নিন্দামন্দ শুনিনি।

টিকরি বর্ডারের আন্দোলন পাঞ্জাবের কৃষকরা নিয়ন্ত্রণ করেন। সমগ্র পাঞ্জাবের মানুষ এই লড়াইয়ে আছেন। যার জন্য অর্থবল, লোকবল কোনও কিছুরই সমস্যা নেই। সবারই বক্তব্য কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বা আপের উপস্থিতি ইত্যাদি সত্ত্বেও বিজেপি হারবে। বাংলার মানুষ সম্পর্কে পাঞ্জাবের মানুষ খুব সংবেদনশীল, স্বাধীনতা সংগ্রামে বংলার ভূমিকা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। বাংলায় বিজেপির হারে তারা খুশী, কিন্তু বামেদের করুণ পরিস্থিতিতে চিন্তিত। বিজেপি বিরোধী জনমানসে মমতা ব্যানার্জীর ছাপ স্পষ্ট, আবার এটাও আছে তারা বাংলায় বামকেই চান। খুব অল্প সময়ের পর্যবেক্ষণ। ধান কাটার মরশুম চলছে তুলনামূলকভাবে লোক সমাগম কম। জানুয়ারি থেকে লোকের ভীড় বাড়বে। তবে মোর্চার আহ্বান থাকলে, অল্প সময়েই কয়েক লক্ষ মানুষ জড়ো হয়ে যান। প্রস্তুতি চলছে ২৬ নভেম্বর আন্দোলনের প্রথম বর্ষপূর্তি পালন করার। সার দেশেই এই আন্দোলনের সংহতি পালন হবে। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো গত ২৬ নভেম্বর ভারত বন্ধ ডেকেছিল। এআইসিসিটিইউ এবার ঐ দিন সারা দেশে আন্দোলনের বর্ষপূর্তি দিবস পালন করবে।

- নবেন্দু দাশগুপ্ত 

burns in water

“আমার ঘরটা দেখে যান দাদা, আমার প্যারালাইজড শ্বশুর এই মাচাতে এভাবেই শুয়ে ছিলেন ক’টা দিন, পিঠের নিচেই জল ... ভোটের সময়ে সবাই বলে ঘর দেবে, কিন্তু আজ অবধি একটা ত্রিপলও দিলো না কেউ, পঞ্চায়েতে এল দেখলাম, কারা যে পেল ... আমাদের নেই” — বলে চলেন একের পর এক বাড়ির মহিলারা ... “জানেন বাচ্চাগুলোকে খাওয়ানোর গুঁড়ো দুধটাও জোটাতে পারিনি ক’দিন, কেউ কেউ রামকৃষ্ণ মিশনের দেওয়া চিঁড়ে পেয়েছে”। সোনার ফসল ফলায় যে, তার বান ভেসে জোটে না আহার! কৃষিজীবি মানুষের হাতে সোনা ফলে — হয় বাংলায় নয় বম্বেতে। বয়স্করা এখনও ক্ষেতমজুরিতে লেগে আছেন, যদিও অন্যের জমিতে। গ্রামের কমবয়সী ছেলেরা সোনার কাজে রাজ্যের বাইরে। কিছু গ্রামের মানুষ আবার বাইরে যান না, এলাকাতেই ঘরে ঘরে চলে দর্জির কাজ। সব কিছুই মাইক্রোফিনান্সের ঋণনির্ভর। জানুয়ারী থেকে মে’র মধ্যে টুকটাক চাষবাস, বাকি ৭ মাস দুয়ারে বন্যার প্রহর গোনা। তবে বিগত ৩/৪ বছর সেটা কম থাকলেও এবার আচমকা আঘাত! ডিভিসি জল ছাড়লেই টইটম্বুর, তার উপর অতিবর্ষণ, ভরা কোটাল চলতে থাকলে জল আর নামার নাম নেই। পিলারের উপর দাঁড়ানো পাকা বাড়িগুলোর একতলা অবলীলায় জলতলে আর বাড়ি মাটির হলে তা বারবার বাঁধা আর বারবার কাদা! ইতিউতি এসবই বাংলার বারোমাস্যা। হুগলীর আরামবাগ মহকুমার খানাকুল থানার খানাকুল–২ নং ব্লকের প্রায় ১৫টা অঞ্চলের চিত্র কমবেশি একই। তারকেশ্বর-গড়েরঘাট বাস রাজহাটি পেরোলেই ভূমি ক্রমশ নিচু থেকে আরো নিচু অতএব আরো দুর্গতি!

অগস্টের মাঝামাঝি আমাদের তরফে প্রথমবার যাওয়া হয় মাড়োখানা পঞ্চায়েতের চাঁদকুণ্ডু ও সুন্দরপুর গ্রামে। বাস থেকে নামার পর টোটো নিয়ে খানিকটা ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে কেবল জমির কয়েকটা আল জেগে আছে, সেখান থেকে ঘরের দোরগোড়ায় যাওয়া-আসার ভরসা কিছুদিনের জন্য নৌকাই। যত বেশি ভেতরের গ্রাম, জল নামতে সময় লাগে তত বেশি, বাস রাস্তার দুই ধারের বাড়িগুলোরও দেওয়ালের প্রায় ৮/১০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত উঠে যায় জল। বাড়ির ভিতরে মানুষ-গরু-ছাগল কোথাও কোথাও যৌথ যাপন। যাদের দো’তলা তাদের তবু উপরে ওঠার জায়গা থাকে, বাকিরা কেউ মাচায়, কেউ বা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। পাড়ার ফুটবল মাঠটা জল বাড়লেই যে চেহারা নেয় তার মাঝে ক্লাবঘরটাকে দেখলে মনে হয় তলিয়ে যাওয়া কোনো প্রাচীন সভ্যতার এক খণ্ড সাক্ষী যেন আবার জেগে উঠেছে নদীর বুকে! গ্রামগুলোতে প্রায় শ’দেড়েক তপশিলী জাতিভুক্ত পরিবার, অতীতে দীর্ঘকালের বামপন্থী সমর্থনভিত্তি, এবার ভোট পড়েছে পদ্মফুলে! এলাকায় হনুমানের প্রতি একটা বিশেষ ভক্তি চোখে পড়ে। স্থানীয় একজন জানালেন যে, ব্যাপারটা অনেক বছরেরই, কোথাও হনুমান মারা গেলে সেখানে কেউ কেউ শ্রাদ্ধানুষ্ঠানও করত, তবে ইদানীং কয়েক বছর যাবৎ সে’সব জায়গায় নাকি ভক্তির তোড়ে হনুমান মন্দির অবধি বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। যদিও গোষ্ঠীকোন্দলের (কেবল ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে নয়, সময় নিয়ে লালনপালন করা সাম্প্রদায়িকতার গেরুয়া অন্তঃসলিলা স্রোত এই ঝামেলার গোড়ায় যে অনবরত জল দিয়ে চলে তা কথা বললেই বোঝা যায়) পরিণতিতে এখানে আপাত ভাবসাব দেখে মনে হয় শাসক ও বিরোধী দুই’ই তৃণমূল তবে কিনা এবার এমএলএ হয়েছেন পদ্মফুলের সুশান্ত ঘোষ। কিন্তু গ্রামবাসীরাই জানালেন যে, অনেক আশা নিয়ে আনা নতুন বিধায়ককেও বড় রাস্তা থেকে তেমন ভেতরে ঢুকতে দেখা যায়নি। কিছুটা দূরেই জগৎপুর পঞ্চায়েতের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বনহিজলী গ্রামের অধিকাংশ ভোট জোড়া ফুলে গেলেও থৈ থৈ জলছবিতে ভেদ নাই। বছর বছর কেমন বাঁধ বাঁধা হয়? তাতে আসলে ঠিক কার কী লাভ? বন্যা ঠেকাতে কত যে ‘মাস্টার প্ল্যান’ এর ঢাক বাজলো, অতঃপর সে’সব প্ল্যানের প্রতিমা বন্যার জলেই বিসর্জন। জমানা পাল্টে পাল্টে মাস্টারি চলে, ‘মাস্টার প্ল্যান’ আর পৃথিবীর আলো দেখেনা। মাড়োখানার শেষপ্রান্তে পানশিউলী বাজার — মুণ্ডেশ্বরী আর রূপনারায়ণ নদীর মিলনস্থলে। ওখানটায় কোনো নদীই ৭০-৮০ মিটারের বেশি চওড়া মনে হল না। মুণ্ডেশ্বরীর ওপারের ভূখণ্ড হাওড়ার আমতা আর রূপনারায়ণের ওপারটা পূর্ব মেদিনীপুরের দাসপুর পঞ্চায়েত। আরো খানিক চলে গেলে ঘাটাল। বছরের পর বছর ধরে একই চলছে। বর্ষা এলেই মানুষ আতঙ্কে দিন কাটান। বাঁকুড়া, বর্ধমান, হুগলী, হাওড়ার বিস্তৃত অঞ্চলের মানুষ যখন জলে ভাসেন, তখন কে কত স্কোর করবে তার প্রতিযোগিতা! মমতা ব্যানার্জি ও তার সরকার বলে চলেন ‘ম্যান মেড বন্যা’। কিন্তু তাদের তরফ থেকে জবাব মিলছে না যে, কেন পরপর তিন অর্থবর্ষে (২০১৮-১৯, ১৯-২০, ২০-২১) রাজ্য সেচ দপ্তরের বরাদ্দের মাত্র ২০ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে? এই অভিযোগ সত্য হলে অনুমান করা যায়, নদী, খাল সংস্কার কতটা হয়েছে! বন্যা কবলিত মানুষের বিকল্প আবাস, রাস্তাঘাটের কতটা কী হয়েছে! আর অন্যদিকে কেন্দ্রের সরকার বছরের পর বছর বলেই চলেছে, “আমরা আগাম জানিয়ে ডিভিসির জল ছেড়েছি”! ব্যাস, দায় শেষ? নদীর কেন ড্রেজিং হয় না, নতুন জলাধার তৈরি করে জল সংরক্ষণ হয়না, রেসকিউ সেন্টার কেন তৈরি হয় না? কোনও জবাব নেই।

বিভিন্ন মানুষের সহযোগিতাকে পাথেয় করে ৫ সেপ্টেম্বর মাড়োখানার দু’টি গ্রামে ১৪৫টি পরিবারকে কিছু খাদ্যদ্রব্য আর পানীয় জল পরিশোধক পৌঁছে দিয়ে আসা হয়।

burns in water

 

এরপর ৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় আবার পাশের পঞ্চায়েতের এক বন্ধুর থেকে খবর পাই, হরিশচকে এমন একটা জায়গায় বাঁধ ভেঙেছে যেখান থেকে প্রায় ১০-১৫ হাজারের মতো মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। ডিভিসির ছাড়া জলের তোড়ে আচমকা এই কাণ্ড ঘটায় গ্রামবাসীরা অধিকাংশই একটা বিছানার চাদর তোলারও সময় পাননি। সাবলসিংহপুর, মাড়োখানা, হীরাপুর, রামচন্দ্রপুর, মাইনান সহ প্রায় ১৭টা গ্রাম পুরো ডুবে গিয়েছে যেখানে মেন রাস্তার উপর আবার ৭ ফুট পর্যন্ত জল উঠেছে। যে বন্ধুর থেকে খবর পাই তার বাড়ির একতলাটাও তখন জলের তলায়। এবারের মতো অবস্থা নাকি ১৯৭৮ সালের পরে আর হয়নি। পরেরদিন তার পাঠানো ভিডিয়োতে দেখলাম, জাস্ট তাসের ঘরের মতো ভেসে গেলো সাবলসিংহপুর পঞ্চায়েতের আজগুবিতলার একটা কাঠের ব্রিজ।

অবস্থা শোনা মাত্র পার্টির তরফে বন্যাদুর্গত মানুষদের দ্রুত পুনর্বাসন, বন্যারোধী নতুন আবাস, খাদ্য, পরিস্রুত পানীয় জল, ফসল ও গবাদি পশুর ক্ষতিপূরণ, স্বাস্থ্য পরিষেবার সম্প্রসারণের দাবি জানিয়ে এবং ফি বছর বন্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য সরকার কী পরিকল্পনা করছে তার জবাব চেয়ে জেলাশাসককে চিঠি পাঠানো হয়। ৬ অক্টোবর ঐ ব্লকেরই নতিবপুর ১নং পঞ্চায়েতের জয়রামপুর, শাহ পাড়া, বাবুজান পাড়া, সীতাপুর গ্রাম ও সংলগ্ন এলাকায় পরিস্থিতি দেখতে পৌঁছায় পার্টির হুগলী জেলা কমিটির নেতৃত্বে ছাত্র-যুবদের টিম। এই গ্রামগুলির অধিকাংশ মানুষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। রাজ্যের শাসকদলের কর্মীদের একাংশ আমাদের চলার পথে নজরদারি শুরু করে সাথে সাথে, তাতে অবশ্য উল্টে তাদের প্রতিই মানুষের ব্যপক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় আরেকবার চলে এল।

বাদল চাচার ভাঙা ঘরে বিদ্যুৎ ছিলো না সেদিন, তারমধ্যেই তাঁর বাড়িতে অন্তত একটা নারকেল নাড়ু খেতেই হবে — এই আদরের ওম পেতেই তো আমাদের বেরিয়ে পড়া সভ্যতার খোঁজে মাঠ-প্রান্তরে। ছোট ছেলের ঘরের দেওয়ালটা ধ্বসেছে জলের তোড়ে, সেদিন সকালে মেঝের হাঁটুজল গোড়ালিতে নামতেই চাচী শুরু করেছেন দেওয়ালের নড়ে যাওয়া বাখারিগুলোয় নতুন করে মাটি লেপন। এভাবেই বারবার পড়ে গিয়েও আবার উড়ান দেয় ইচ্ছেডানা-স্বপ্নগুলো জ্বলে। সম্মান, স্বাচ্ছন্দ্য ও অধিকারের সাথে বাঁচার ও বাঁচানোর স্বপ্নগুলো, ইচ্ছেগুলো বাস রাস্তা থেকে মাটির দাওয়া অবধি পৌঁছে দেওয়ার জন্য আলপথগুলো জেগে থাকা খুব দরকার, বারবার সেগুলো তলিয়ে গিয়ে আলপথকে জলপথ হতে দেওয়া চলে না। তাই ছাত্রদল মাটিতে থাকে কারণ স্বপ্নটা বিছানার থেকেও বেশি জরুরি জল-কাদায় দাঁড়িয়ে দেখা — হেই সামালো — লিবারেশন মানে মুক্তি। একুশের ডাক উপেক্ষা করা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব। লক্ষ্য থাকুক ডিজিটাল বৈষম্যের উল্টো ফুটে দাঁড়িয়ে আগামীতে সাধ্যমত মেঠো পাঠশালার বিকল্প নির্মাণে, ভরসা থাকুক অনেক কাঁধে। মানবিক ত্রাণ কাজে নিশ্চয়ই আমাদের সকলকে ঝাঁপাতেই হয়, কিন্তু সেটাই যেন একমাত্র কাজ না হয়ে পড়ে, কারণ তা দিয়ে কেবল সাময়িক সাহারা হয়। দিন বদলাতে হলে প্রশ্নোত্তর চলুক।

- সৌরভ 

hunger index

খিদের জ্বালায় জ্বলছে দেশ। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে আরও নেমে গেল ভারত। ২০২১ সালে বিশ্বের ১১৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০১। ২০২০ সালে ভারত ছিল এই তালিকার ৯৪ নম্বরে। তাৎপর্যপূর্ণ, এবারও ভারতকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে প্রতিবেশী পাকিস্তান, বাংলাদেশ, এমনকী নেপালের মতো দেশ। ভারতের আর এক প্রতিবেশী চিন রয়েছে তালিকার একেবারে শীর্ষে।

বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়েছে এবছরের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের ক্রমতালিকা। সেই তালিকায় ভারতের ধারাবাহিক অবনমন অব্যাহত। গুরুত্বপূর্ণ হল, ভারতের প্রতিবেশী প্রায় প্রতিটি দেশই ভারতের চেয়ে এগিয়ে।

প্রতি বছর আয়ারল্যান্ডের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ এবং জার্মান সংস্থা ‘ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফ’ যৌথভাবে বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে ক্ষুধার পরিমাণ নির্ধারণ করে। এক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে যে কোনও দেশের সমসাময়িক অর্থনৈতিক অবস্থান, শিশুস্বাস্থ্য এবং সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে অসাম্যের মতো বিষয়গুলি। এরসঙ্গে বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে তারা ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স’ বা জিএইচআই স্কোর নির্ধারণ করে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ শিশুদের অপুষ্টি জনিত সমস্যা এবং শিশুমৃত্যু হারের মতো বিষয়।

২০২১ সালের তালিকায় ভারতের স্থান ১০১। তালিকা প্রস্তুতকারীরা একে ‘ভয়াবহ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

বিশ্ব ক্ষুধার ক্রমতালিকায় ভারতের পিছনে রয়েছে পাপুয়া নিউগিনি, আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া, কঙ্গো, লাইবেরিয়া, মোজাম্বিক, ইয়েমেন, সোমালিয়ার মতো ১৫টি দেশ।

২০২০ সালে ১০৭টি দেশের মানুষের মধ্যে ক্ষুধার সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। সেবার ভারত ছিল ৯৪ নম্বরে। ভারতের ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স’ বা জিএইচআই স্কোর-এর ধারাবাহিকভাবে পতন হচ্ছে। ২০০০ সালে ভারতের জিএইচআই স্কোর ছিল ৩৮.৮, সেখানে ২০১২ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ভারতের স্কোর কমে ২৮.৮ থেকে ২৭.৫’র মধ্যে ঘোরাফেরা করছে।

এতো গেল ভারতের কথা। কী অবস্থা প্রতিবেশী দেশগুলোর? বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের সাম্প্রতিকতম তালিকা বলছে, মায়ানমার রয়েছে ৭১এ, নেপাল ও বাংলাদেশ যৌথ ভাবে রয়েছে ৭৬ নম্বর স্থানে। পাকিস্তান বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের নবতম তালিকায় স্থান পেয়েছে ৯২ নম্বরে। সামগ্রিকভাবে ভারতের চেয়ে ভাল করলেও তালিকা প্রস্তুতকারী সংস্থারা এই দেশগুলোকেও রেখেছে ‘ভয়াবহ’ শ্রেণিতে। রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ‘‘কোভিডের ফলে যে বিধিনিষেধ জারি হয়েছিল ভারতে, তার ফলে দেশের নাগরিকদের অবস্থা খারাপ হয়েছে। অপুষ্টিজনিত কারণে শিশুদের ভোগার পরিমাণও বেশি ভারতে।’’

- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ অক্টোবর ২০২১

MGNREGA treasury

কেন্দ্রের ফ্ল্যাগশিপ গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পের অর্থ বছরের মাঝপথে শেষ হয়ে গেছে। আগামি এক মাস পরবর্তী সংসদীয় অধিবেশন শুরু না হওয়া পর্যন্ত সম্পূরক বাজেট বরাদ্দ হবে না। নিজস্ব বিবৃতি অনুসারে, মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি অ্যাক্ট (MGNREGA) প্রকল্পে এখন ₹৮,৬৮৬ কোটির ঋণাত্মক নেট ব্যালেন্স।

এরফলে MGNREGA কর্মীদের জন্য অর্থপ্রদানের পাশাপাশি অন্যান্য খরচ বিলম্বিত হবে, যদি না রাজ্যগুলি তাদের নিজস্ব তহবিল ব্যবহার করে। অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময়ে কেন্দ্র শ্রমিকদের মজুরি প্রদানে বিলম্ব করে জোর করে শ্রম করতে বাধ্য করছে। কেন্দ্র এখন আবার অনেক রাজ্যকে কাজের জন্য ‘কৃত্রিমভাবে চাহিদা তৈরি’ করার অভিযোগ করছে।

MGNREGA হল একটি স্কিম, যেটি গ্রামীণ পরিবারকে ১০০ দিনের অদক্ষ কাজের গ্যারান্টি দেয়, যারা এটি চায়। গত বছর কোভিড১৯ লকডাউনের সময়, প্রকল্পটিতে শেষ পর্যন্ত ₹১.১১ লক্ষ কোটির বাজেট দেওয়া হয়েছিল এবং রেকর্ড ১১ কোটি কর্মীদের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ জীবনরেখা প্রদান করেছিল।

স্কিমের ২০২১-২২ বাজেটে মাত্র ₹৭৩,০০০ কোটি ধার্য করা হয়েছিল এবং কেন্দ্র যুক্তি দিয়েছিল যে দেশব্যাপী লকডাউন শেষ হয়ে গেছে এবং অর্থ ফুরিয়ে গেলে সম্পূরক বাজেট বরাদ্দ পাওয়া যাবে। ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত, বকেয়া অর্থপ্রদান সহ মোট ব্যয় ইতিমধ্যেই ₹৭৯,৮১০ কোটিতে পৌঁছেছে, যা স্কিমটিকে লালের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ইতিমধ্যেই, ২১টি রাজ্য ঋণাত্মক নেট ব্যালেন্স দেখাচ্ছে, যেখানে অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু এবং পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ৷

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রকের একজন ঊর্ধ্বতন আধিকারিক স্বীকার করেছেন, “এই বছর কিছুটা আগেই তহবিল ফুরিয়েছে। মানুষকে কাজ দেওয়া যেতেই পারে। তবে অর্থ প্রদান করা হবে তহবিলে টাকা এলে তবেই। কিন্তু রাজ্য তাদের নিজস্ব অর্থ থেকে অস্থায়ী তহবিল তৈরি করতে পারে এবং তারপর একবার সম্পূরক বাজেট বরাদ্দ হলে, এটি পরিশোধ করা যেতে পারে।”

MGNREGA তথ্য থেকে দেখা যায় যে ১৩ শতাংশ পরিবার প্রকল্পের অধীনে কাজ দাবি করেও কোনো কাজ পায়নি। এই পরিসংখ্যানটি কেবলমাত্র সিস্টেমে নিবন্ধিত চাহিদা অনুযায়ী করা হয়েছে। কর্মসংস্থান গ্যারান্টির জন্য পিপলস অ্যাকশনের গবেষক বিজয় রাম বলেছেন, “অনেক কর্মী যখন তাদের কাজের দাবি করে তখন কর্মকর্তারা তাদের কাছ থেকে সরে যায়, তাদের দাবি একেবারে নিবন্ধিত না করেই”।

- দি হিন্দু, ২৯ অক্টোবর ২০২১

Pegasus Case

এবছরের জুলাই মাসে প্যেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে নাগরিকদের ফোনে আড়িপাতার বিষয়টা প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে মোদী সরকার যা বলে এসেছে, সুপ্রিম কোর্টের কাছে নিজের যে অবস্থান রেখেছে তা ক্রমশ এই আশঙ্কাকেই তীব্র করছিল যে সরকার কিছু লুকোনোর চেষ্টা করছে। গত ২৭ অক্টোবর প্যেগাসাস নজরদারি কাণ্ডে তদন্ত কমিটি গঠনের সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত সেই সন্দেহ পোষণেই শুধু সায় দিল না। গোপনীয়তার ঐ অভিপ্রায়ের পিছনে কোনো অবৈধ প্রয়াস থাকলে তার উন্মোচনের উপায়ও হয়ে উঠল তদন্তের ঐ সিদ্ধান্ত। নাগরিকদের ফোনে এই নজরদারি, তাদের কথপোকথনে আড়িপাতার পিছনে কোনো বেআইনি কাজ হয়নি বলেই সরকার বলে আসছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের কাছে দেওয়া দু’পাতার হলফনামায় সরকার সুস্পষ্টভাবে বলল না যে, নাগরিকদের ফোনে নজরদারিতে তাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল কিনা। এরআগে ১৩ সেপ্টেম্বর এই বিষয়ে শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি এন ভি রমনা সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতার জবানিতে অসন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ধানাইপানাই না করে পরিষ্কার করে বলতে বলেন — নাগরিকদের ফোনে নজরদারিতে সরকার প্যেগাসাসকে কাজে লাগিয়েছিল কিনা। সলিসিটর জেনারেল মোদী সরকারের বহু ব্যবহৃত যুক্তির আশ্রয় নিয়ে বলেন — বিষয়টার সঙ্গে দেশের নিরাপত্তা জড়িত, আর তাই কেন্দ্রীয় সরকার এই বিষয়ে বিষদে জানিয়ে কোনো হলফনামা জমা দিতে চায় না। প্রত্যুত্তরে প্রধান বিচারপতি সলিসিটর জেনারেলকে জানিয়ে দেন, “আমরা জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত বিষয় জানতে চাইছি না। আমাদের একমাত্র দেখার বিষয় হল, কোনো সরকারি সংস্থা আইনের বাইরে গিয়ে দেশের নাগরিকদের উপর নজরদারি করতে কোনো সফটওয়্যার কাজে লাগাচ্ছে কিনা।” সে দিনের শুনানির দেড়মাস পর তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্তের কথা জানাতে গিয়েও প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বলেছে (বেঞ্চের আর দুই বিচারপতি হলেন সূর্য কান্ত ও হিমা কোহলি), “জাতীয় নিরাপত্তা এমন কোনো জুজু নয় যে তার উল্লেখ করলেই বিচারবিভাগ নিরস্ত হয়ে যাবে। …” “রাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তার প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেই তা আদালতকে নীরব দর্শকে পরিণত করতে পারে না।” আর তাই দেশের নিরাপত্তার বিষয়টাকে উপেক্ষা না করেও সুপ্রিম কোর্ট দেশের নাগরিকদের অধিকারের সুরক্ষায় প্রয়াসী হয়ে প্যেগাসাস কাণ্ডের সত্য উন্মোচনে তদন্ত কমিটি গঠনে মনস্থ করে। এই কমিটির সদস্য সংখ্যা হল তিন — নেতৃত্বে থাকবেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আর ভি রবীন্দ্রন, আর সহায়তা করবেন অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অলোক যোশী এবং সাইবার বিশেষজ্ঞ সন্দীপ ওবেরয়। এই কমিটি প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেবে এবং দু’মাসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেবে। প্রসঙ্গত, নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে তদন্ত কমিটি গড়ার প্রস্তাব সরকার দিয়েছিল। কিন্তু তাতে সত্য উদঘাটনের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবেনা মনে করে সুপ্রিম কোর্ট সেই প্রস্তাবে অনাস্থা জ্ঞাপন করে তাকে প্রত্যাখ্যান করে।

আদালত ব্যক্তির নিজস্ব পরিসরের গোপনীয়তার অধিকারকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। এই অধিকারের সুরক্ষায় আদালত অঙ্গীকারবদ্ধ। রাষ্ট্র কি ব্যক্তির নিজস্ব পরিসরে হানা দিতে, সেইক্ষেত্রে নজরদারি চালাতে পারে? বিশেষ জরুরি অবস্থা দেখা দিলে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারই ১৮৮৫ সালের ‘ইণ্ডিয়ান টেলিগ্ৰাফ আইন’ এবং ২০০০ সালের তথ্যপ্রযুক্তি (সংশোধনী) আইন-এর বলে বাছাই করা ব্যক্তিদের মোবাইলে, ইমেল অ্যাকাউন্টে, হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় নজরদারি চালাতে পারে। কিন্তু সেরকম কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব কি ভারতে হয়েছিল? ব্যক্তিগত পরিসরকে, ব্যক্তিদের একেবারে নিজস্ব গোপন মুহূর্তকে, বার্তার আদানপ্রদানকে ঠাওর করাটা কি বৈধ পথেই হয়েছিল? আর তা যদি না হয়ে থাকে তবে এই মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন আদালতের চোখে অপরাধ বলেই বিবেচিত হবে। তদন্তের সিদ্ধান্তের পিছনে এটাও আদালতের কাছে একটা কারণ হয়ে থেকেছে।

সরকার তার ওপর নজরদারি চালাচ্ছে, একথা কেউ জানতে পারলে তার সিড়দাঁড়া দিয়ে আতঙ্কের হিমশীতল স্রোত নেমে আসাটাই স্বাভাবিক। সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে এমনটা হলে তা অবশ্যই সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার বিপর্যয়ের সুনিশ্চিত শর্ত হয়ে ওঠে। বেশ কিছু সাংবাদিকের ফোন আড়িপাতার শিকার হওয়ায় এবং শীর্ষ আদালতের কাছে আবেদনকারীদের মধ্যে সাংবাদিকরা থাকায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সুরক্ষাও আদালতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়েছে। আদালতের রায়ে সাংবাদিকদের ওপর এই নজরদারি “সংবাদপত্রের জনগণের প্রহরী হওয়ার ভূমিকার ওপর আক্রমণ, যা সঠিক এবং বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পরিবেশনের সংবাদপত্রের সামর্থের ক্ষয় ঘটাতে পারে।” সাংবাদিকদের কাছে, বিশেষত তদন্তমূলক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে, খবর ও তথ্যের উৎস হয়ে ওঠে বেশ কিছু গোপন সূত্র। সরকারের বিষ নজরে থাকা সাংবাদিকদের উপর চাপ সৃষ্টি করে সরকার যদি সাংবাদিককে খবর ও তথ্য জোগানো ব্যক্তির সন্ধান পেতে চায় তবে তা সেই সূত্রের সঙ্গে ন্যায়নিষ্ঠ সাংবাদিকতাও বিপন্ন হয়ে পড়ে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সঙ্গে এই সূত্রদের সুরক্ষার ভাবনাও আদালতের তদন্তের সিদ্ধান্ত গ্ৰহণে প্রভাব ফেলেছে।

যে প্যেগাসাস স্পাইওয়্যার দিয়ে ফোনে নজরদারি চালানো হয়েছে সেটির প্রস্তুতকারক ইজরায়েলি সংস্থা এনএসও। এবং তারা জানিয়েছে, কোনো সরকার বা পুরোদস্তুর সরকারি সংস্থা ছাড়া অন্য কাউকে তারা প্যেগাসাস বিক্রি করেনা। ঘটনা এই হওয়ায় ভারতীয় নাগরিকদের ফোনে নজরদারিতে কোনও বিদেশী সংস্থাও কি জড়িত? তা যদি হয়ে থাকে তবে ভারতীয় নাগরিকদের তথ্য কি বিদেশী সংস্থার হস্তগত হয়েছে? এই নজরদারির ফলে বিদেশী সংস্থার হাতে দেশের স্বার্থ ও নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়ার সম্ভাবনাও শীর্ষ আদালতের তদন্তের সিদ্ধান্তের পিছনে অন্যতম কারণ হয়েছে।

ফোনে আড়িপাতার শিকার যারা হয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, নাগরিক আন্দোলনের কর্মী, আইনজীবী, বিরোধীপক্ষের নেতা, সুপ্রিম কোর্টের জনৈক বর্তমান বিচারপতি, এক নির্বাচন কমিশনার, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনা সুপ্রিম কোর্টের মহিলা কর্মী ও তার পরিবারের দশ সদস্য এবং অন্যান্যরা। এদের সংখ্যাটা এক হাজারেরও বেশি হওয়ায়, যাদের নাম পাওয়া গেছে সেই সংখ্যাটাও বড় এবং স্থানাভাবে তাদের উল্লেখ এখানে সম্ভব নয়। তবে, স্পাইওয়্যার দিয়ে ফোনে ঢুকে তথ্য হাতিয়ে (এবং ফোনে এমনকি অনিষ্টকর তথ্য চালান করেও, যেমন ভীমা কোরেগাঁও-এর ঘটনায় অভিযুক্তদের ফোনে অনুপ্রবিষ্ট করা হয়েছে বলে অভিযোগ) তাদের ব্ল্যাকমেইল করা, হুমকি দেওয়া, মামলায় জড়ানোর দুরভিসন্ধিকে একেবারে খারিজ করা যায়না। তবে, ফোনে হানাদারির জন্য যাদের বাছা হয়েছে সেই ব্যক্তিদের কথা বিচার করলে নজরদারির অভিপ্রায়ের বড় অংশই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে নির্দেশিত করে।

প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ জানিয়েছে, “কমিটি গঠন করাটা ছিল একটা দুরূহ কাজ”। কেননা, নিরপেক্ষ, দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের খুঁজে পাওয়াটা সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছিল। প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেছে, তদন্ত কমিটির সদস্য হতে যাদের অনুরোধ করা হয়েছিল তাদের অনেকেই সবিনয়ে সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। গত ১৩ সেপ্টেম্বরের শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি জানিয়েছিলেন, দিন কয়েকের মধ্যেই কিছু নির্দেশ জারি করা হবে। কিন্তু কমিটি গঠনের সিদ্ধান্তের কথা জানাতে যে প্রায় দেড় মাস সময় লেগে গেল তা কাজটার সমস্যাসংকুলতাকেই জানান দিল। এই ধরনের কমিটি গঠনের বিরুদ্ধে সরকারের চাপ থাকাটা অভাবিত নয়, এবং তদন্ত কমিটির সদস্য হতে যাঁরা চাননি, সরকারের রোষ এড়ানোর অভিপ্রায়ই বোধকরি তাদের ক্ষেত্রে নির্ধারক শর্ত হয়েছে। যে প্রশ্নটা এখন সাধারণ জনগণের মনে উঁকি দিচ্ছে তা হল — তদন্ত কমিটিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হবে তো? সরকারের কাছে তথ্য সংগ্ৰহের প্রয়োজনীয়তায় মোদী সরকার সহযোগিতা করবে তো?

প্যেগাসাস কাণ্ডে সুপ্রিম কোর্টের তদন্তের সিদ্ধান্তে সাধারণ জনগণ উৎসাহিত। মোদী জমানায় সিবিআই, ইডি, আইটি, এনআইএ’র মত সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের স্বায়ত্ততা ও নিরপেক্ষতা হারিয়ে সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে, বিরোধীদের বিপর্যস্ত করার সংস্থাতেই পর্যবসিত হয়েছে যা গণতন্ত্রের বিপন্নতারই নির্দেশক। এমনকি বর্তমান প্রধান বিচারপতির আগের সময়ে সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন প্রধান বিচারপতি মোদী সরকার ও বিজেপির সুবিধায় নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন বলেও অভিযোগ ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে মোদী সরকারের অসহযোগিতা ও ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ জুজুকে উপেক্ষা করে প্যেগাসাস কাণ্ডে তদন্তের নির্দেশ ন্যায়ালয়ের ন্যায়সঙ্গত ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হয়েই দেখা দিচ্ছে। শীর্ষ আদালতের কাছে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশ্যা — ব্যাপক সংখ্যক ভারতীয় নাগরিকের ফোনে নজরদারির জন্য যারা দায়ী তাদের খুঁজে বার করে শাস্তি দিতে হবে। ভারতীয় গণতন্ত্রের পথভ্রষ্টতায় তদন্তের এই পদক্ষেপ ইতিবাচক ব্যঞ্জনায় মূর্ত বলেই দেখা যাচ্ছে। শীর্ষ আদালতের গঠন করা কমিটি তাদের অভীষ্ট পূরণে সফল হবে, সেই আশা নিয়ে আমরা সাগ্রহে তাকিয়ে থাকব।

All lies_0

হিন্দুত্ববাদ, ভারতীয় জনতা পার্টি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও মিথ্যাচার-মিথ্যা ভাষণ একাকার হয়ে গিয়েছে। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ-মোহন ভাগবত ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা যা বলেন তার অধিকাংশই অসত্য। গত কয়েকদিন ধরে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়, কোভিড নিয়ন্ত্রণ ও টিকাকরণে ইতিহাস সৃষ্টি নিয়ে একটানা কৌশলী মিথ্যাচার করে চলেছে নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর অনুসারীরা। উত্তর প্রদেশের মন্ত্রী শ্রীমান উপেন্দ্র তেওয়ারি অবলীলাক্রমে বললেন, পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি কেবলমাত্র দেশের ৫ শতাংশ মানুষকে কষ্ট দেয় বাকিদের কিছু হয় না। আরো বললেন, গত ৭ বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়েছে পেট্রল-ডিজেলের দাম তো দ্বিগুণ হয়নি। এই যে মন্ত্রী তেওয়ারি মশাই বললেন, আর উপস্থিত সাংবাদিকরা শুনলেন, কেউ জানতে চাইলেন না কোন পরিসংখ্যান বলছে যে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়েছে? প্রকৃত সত্য হল, ২০১৩-১৪ সাল থেকে ২০২০-২১, এই ৭ বছরে ২০১১-১২ সালের মূল্যে প্রকৃত মাথাপিছু জাতীয় আয় ৬৮,৫৭২ টাকা থেকে ২৬ শতাংশ বেড়ে ৮৬,৬৫৯ হয়েছে। এমনকি চলতি মূল্যে জাতীয় আয় ওই ৭ বছরে ৭৪,৯২০ টাকা থেকে ৭২ শতাংশ বেড়ে ১,২৮,৮২৯ টাকা হয়েছে। ২০১৪-র মে থেকে ২০২১-র অক্টোবর, এই ৮৯ মাসে সময়ে ডিজেলের দাম বেড়েছে ৮২ শতাংশ ও পেট্রলের দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশ। ওই সময়ে বিশ্ব বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমেছে ৩০ শতাংশ। ফলে মন্ত্রী তেওয়ারি গলা তুলে মিথ্যে বললেন ও তারপরেই টুইটারে বা কু’এ বিজেপির দলবল অমিত বিক্রমে সেই ‘সত্য যা রচিব আমি’ প্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

একদিকে যখন মাথাপিছু আয় ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে তেওয়ারিজী মিথ্যে বলছেন, দেশের মানুষকে বোকা বানাচ্ছেন, তখন মোদীজীও এসে পড়েছেন ভ্যাক্সিন সংক্রান্ত মিথ্যা ভাষণ নিয়ে। বলা হল যে, ভারত নিজের দেশজ টিকা নিয়ে টিকাকরণ করেছে। সত্য হল, এস্ট্রাজেনেকার তৈরি টিকা সিরাম ইন্সটিটিউট পুনাতে উৎপাদন করেছে মাত্র। দেশে প্রদত্ত ৯০ শতাংশ টিকা ওই কোভিশিল্ড যা ইংল্যান্ডের এস্ট্রাজেনেকা কর্তৃক সৃষ্ট। কিন্তু তথাকথিত বিশ্ববরেণ্য মোদীজী অবলীলাক্রমে অসত্য বললেন। ভারতে সৃষ্ট যে টিকা নিয়ে মোদীজী ঢাক পিটিয়ে ছিলেন সেই কোভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে মাত্র ১০% ক্ষেত্রে। তাছাড়া কোভ্যাক্সিন এখনো পর্যন্ত (২৬ অক্টোবর) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের ছাড়পত্র পায়নি।

All lies_boxকেবল তাই নয় ১৩৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে দুটি ডোজ প্রয়োজনীয় টিকার সামগ্রিক ১০০ কোটি ডোজ দিয়েই মোদীজী ইতিহাস সৃষ্টির গল্প ফাঁদলেন। এটাতো অত্যন্ত স্বাভাবিক যে চিন ব্যতিরেকে কেবল ভারতেই ৫০ কোটির বেশি মানুষ থাকে যাদের ২টি ডোজ টিকা দিতে গেলে ১০০ কোটি টিকা লাগতে পারে। আর কোনো দেশে তো এত মানুষ থাকে না। সত্য হচ্ছে দেশের অর্ধেক মানুষ এখনো একটি ডোজ টিকাও পায়নি। ওদিকে চিনে ২২৫ কোটি টিকা দেওয়া হয়েছে ও দুটি ডোজ পেয়ে গেছে ১০৫ কোটি মানুষ। ভারতে সেই সংখ্যাদুটি যথাক্রমে ১০২ কোটি ও ৩০ কোটি।

তৃতীয়ত, মোদীজী বললেন, তাঁরা দেশের সমস্ত মানুষকে বিনে পয়সায় টিকা দিয়েছেন। আদতেই তা হয়নি। বহু মানুষ বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে টাকা দিয়ে টিকা নিয়েছে। কেবল তাই নয়, মোদী সরকার ঘোষণা করেছিল যে, ৪৫ বছরের উপরের নাগরিকদের বিনে পয়সায় টিকা দেওয়ার বন্দোবস্ত থাকলেও (তাঁরা ইচ্ছে করলে বেসরকারি হাসপাতালে মূল্য দিয়েও নিতে পারে) ৪৫ বছরের নিচে থাকা নাগরিকদের মূল্য দিয়েই টিকা নিতে হবে বা রাজ্য সরকার ভারত বায়োটেক বা সিরাম ইন্সটিটিউট বা অন্য কোন বিদেশি সংস্থার থেকে কিনে তা রাজ্যের নাগরিকদের বিনামূল্যে দিতে পারে। পরে সুপ্রিম কোর্টের চাপেই মোদী সরকার বিনামূল্যে টিকাকরণের বন্দোবস্ত সবার জন্য রাখতে বাধ্য হয়েছে। যদিও তারসঙ্গে অর্থ ব্যয় করেও বেসরকারি হাসপাতালে টিকার বন্দোবস্ত রাখা হয়েছিল।

ব্লুমবার্গ ট্রাকারের বিশ্বব্যাপী কোভিড টিকাকরণের হিসেব অনুযায়ী ভারতে টিকা পেতে যোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে ৫১ শতাংশ অন্তত একটি টিকা পেয়েছে এবং ২২ শতাংশ দুটি টিকা পেয়েছে। ফলে দুটির মধ্যে অনুপাত দাঁড়িয়েছে ২.৪, বিশ্বে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে চিনের ৮২ শতাংশ মানুষ অন্তত একটি ও ৭৬ শতাংশ দুটি টিকা পেয়েছে, ফলে অনুপাত দাঁড়িয়েছে ১.১। আমেরিকায় তা ১.১৫, যেখানে ৬৬ শতাংশ পেয়েছে অন্তত একটি ও ৫৭ শতাংশ দুটি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ৬৯ শতাংশ অন্তত একটি ও ৬৬ শতাংশ দুটি টিকা পেয়েছে: ফলে অনুপাতটির মান ১.০৪। ভারতে ১৮ বছরের উর্ধে থাকা (সাবালক) মানুষের সংখ্যা ৯৪ কোটি। ফলে সেই সব মানুষকে টিকা দিতে লাগবে ১৮৮ কোটি টিকা। অর্থাৎ আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে টিকাকরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গেলে দৈনিক ১.৫ কোটি টিকা দিতে হবে। যেখানে ২২ অক্টোবর শেষ হওয়া সপ্তাহে গড় দৈনিক টিকাকরণের সংখ্যা ছিল ৫০ লক্ষের মত। এই গতিতে চললে সমস্ত সাবালককে দুটি ডোজ দিতে আরো ৬ মাস লেগে যাবে। লক্ষনীয় যে, কেবল নিজেদের ঢাক পেটাতে নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিনে ১৭ সেপ্টেম্বর ২.৫ কোটি টিকা দেওয়া হয়েছিল। যে হারে টিকা আর কোনদিন দেওয়া হয়নি। স্বতঃই এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, সত্যিই ওইদিন ২.৫ কোটি টিকা দেওয়া হয়েছিল কি? আর যদি তা দেওয়াই হয়, তাহলে কেন অন্যান্য দিনে তা দেওয়া হচ্ছে না?

সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ একটি সরকার মিথ্যা প্রচারের সাফল্যের উপর ভরসা করে দেশের মানুষকে বোকা বানাচ্ছে ও ক্রমাগত বেকারি, গরিবি, ক্ষুধা, গণতন্ত্রহীনতা সব বাড়িয়ে চলেছে। নিচের তালিকা দেখলে তা বোঝা যায়।

আর গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির অবস্থানে অবনমন ২০১৪ সালে ২৭তম থেকে ২০২০-তে ৫৩তম।

- অমিত দাশগুপ্ত

name of religion

(বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রতিক আক্রমণের ঘটনার পর যে সমস্ত তরুণ শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা দ্রুত প্রতিবাদ আন্দোলনে সামিল হন, গল্পকার মোজাফ্ফর তাঁদের অন্যতম। এই লেখাটিতে তিনি সমস্যাটিকে বোঝবার চেষ্টা করেছেন সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে। সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত এই লেখাটি আমরা পুনঃপ্রকাশ করছি। শিরোনাম আমাদের সংযোজন। - দেশব্রতী সম্পাদকমণ্ডলী)

হিন্দু মুসলিম সম্পর্কে যে ঐতিহাসিক ফাঁক সেটা ভারতবর্ষে ধর্মের ভেতর থেকে আসেনি। এই উপমহাদেশের বৃহত্তর নিরক্ষর বা অল্পশিক্ষিত জনগণ নিজেদের ধর্মগ্রন্থ পড়তে পারে না। অধিকাংশ শিক্ষিত জনগণও ধর্মগ্রন্থসমূহ পড়ে দেখে না। ফলে ধর্ম নিয়ে তাদের মধ্যে যে উন্মাদনা সেটা বাইরে থেকে আসে। সমাজ, রাজনীতি এবং ধর্ম ব্যবসায়ীরা সেটা নির্ধারণ করে দেয়। যখন যে ক্ষমতায় আসে, তার হাতে সবচেয়ে সচল হয় ধর্মের ট্রামকার্ড। ভারতবর্ষে ধর্ম একটা রাজনৈতিক গুটি। এদেশে ধর্ম অবমাননার ‘অভিযোগে’ রুটিন করে যে মন্দিরে বা হিন্দুপাড়ায় আগুন দেওয়া হয়, দেখা যাবে যারা জড়িত বা সমর্থক তারা হয়ত জানেও না কিভাবে ইসলামকে অবমাননা করা হয়েছে। কিন্তু তারা জানে তাদের ধর্মানুভুতিতে আঘাত দেয়া হয়েছে, এটা প্রতিহত করতে হবে। তারা এও জানে, প্রতিহত করতে গিয়ে মন্দির লুটপাট ভাঙচুর, হত্যা-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগের মতো নৃশংস ঘটনারও ধর্মীয় অনুমোদন আছে। এবং এইটা করেই বরঞ্চ ইসলামকে সবচেয়ে বড়ো অবমাননাটা তারা করছে। কিন্তু টক ধর্মব্যবসায়ী মামুনুলকে ‘কটাক্ষ’ করে জেলে যায় ঝুমন দাস, এবং সহজে জামিন পায়না। অন্যদিকে, আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, গত ন’বছরে হিন্দুদের উপর ৩,৭০০টির মতো হামলার ঘটনা ঘটেছে — হামলাকারীদের বিচারের দৃষ্টান্ত নেই। এটাই দাবার চাল।

এখন ‘ধর্মানুভূতি’ দিয়ে হয়ত বাংলাদেশের ভূখণ্ড বিভক্ত হচ্ছেনা, কিন্তু বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে, বাংলার আদি সম্পদ লোকধর্ম ও বহুত্ববাদ নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। প্রতিবেশি প্রতিবেশির শত্রু হচ্ছে। দেখা যাবে আমার পূর্বপুরুষ কোনো কালে হিন্দু বা লোকায়ত ধর্মে বিশ্বাসী ছিল। তাহলে আমি কার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছি? আফগান, সিরিয়া, মিয়ানমারের নির্যাতিত মুসলমানের জন্য আমাদের মন কাঁদে, যাদের আমরা চিনি না, তারাও আমাদের চেনে না, অথচ আমার স্বদেশি স্বভাষী আত্মীয় প্রতিবেশিরা নির্যাতনের শিকার হলে মন কাঁদে না শুধুমাত্র হিন্দু হওয়ার কারণে। এইটা কোনো ধর্মের শিক্ষা হতে পারে?

মনে রাখবেন, ভারত যারা নিজের স্বার্থে ভাগ করেছিল তারা কিন্তু আজ বেঁচে নেই কিন্তু ক্ষতটা ক্রমেই আরো দগদগে হয়েছে। আজ বাংলাদেশে যারা (গোপনে মন্দিরে কুরআন চালিয়ে, ফেসবুকে ফেইক আইডি থেকে পোস্ট দিয়ে, ইত্যাদি করে) ‘ধর্মানুভুতি’ নিয়ে ক্ষমতা ও বিদ্বেষের খেলাটা খেলে যাচ্ছে, অহিংস সরল সাধারণ কৃষক থেকে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর মধ্যে ধর্মানুভূতির নামে হিংসা বিদ্বেষের বীজ রোপণ করছে, তারাও বেশিদিন বেঁচে থাকবে না। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার সেটা হয়ে যাবে আগামী দিনের জন্য। বাংলাদেশ পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানের মতো হয়ে যাবে। অলরেডি সে পথে আছে কিনা আপনারা ভালো বলতে পারবেন। আজ হয়ত মন্দিরে হিন্দুপরিবারে আগুন দিলে আপনি সংখ্যাগুরু মুসলমান হিসেবে চুপ থাকেন, আদিবাসীদের জমি দখল হলে সংখ্যাগুরু বাঙালি হিসেবে কথা বলেন না। কিংবা ঠিক হচ্ছে না বলে ঘরের মধ্যে বসে থাকেন। হামলাকারীরা কিন্তু টুপি মাথায় দিয়ে মাঠে।

এভাবে চলতে দিলে ভাবছেন আপনার লাভ হবে? একদিন বাংলাদেশ নিরানব্বই ভাগ মুসলমানের দেশ হবে, একশো ভাগ বাঙালির দেশ হবে — এই তো লাভের হিসাব?

লিখে রাখেন, তখন খুনোখুনি আরো বেশি হবে, সামান্য কারণেও মুসলমান মুসলমানকে মারবে। মাজহাবে মাজহাবে, তরিকায় তরিকায় বাধবে প্রতিদিন। আজ মনে করছেন ‘হিন্দু’ মার খাচ্ছে, কাল মার খাবে আপনার পরিবার। কারণ অসহিষ্ণুতা ও সমাজের বৈচিত্রহীনতা আপনারাই চরিত্রের প্রধান দিক করে তুলছেন। শেষ নবী বা পবিত্র আল কুরআন নিয়ে কেউ কিছু বললে (ধরুন কটুক্তি) ইসলাম ধর্ম হুমকির মুখে পড়ে না, কারণ তাঁর সম্মান রক্ষার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ নিয়েছেন; কুরআন বাইরের জিনিস না, আল্লাহর অস্তিত্বেরই অংশ। এই বোধটুকু আপনার ভেতরে জন্ম না নিলে আল্লাহর প্রতি আপনার বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। কেউ যদি আল্লাহ ও নবীর সম্মান রক্ষা করার নামে কোনো অসহায় পরিবারকে নিঃস্ব করে, কোনো ব্যক্তিকে জ্বালিয়ে মারে, কোনো শিশুকে এতিম করে, কারো উপর জুলুম করে তাহলে সেই বরঞ্চ আল্লাহ ও তাঁর শেষ নবীর অবমাননা করল। তাকেই প্রতিহত করুন, ইসলামের সম্মান কমবেনা, বাড়বে। কারণ ইসলামকে অশান্তি ও অসহিষ্ণুতার ধর্ম বললে আপনারই বাধবে। আপনাকে খুনি বলা হলে আপনি খুন করে তার প্রতিবাদ করতে পারেন না। এটা একটা ট্র্যাপ, বলা হলো ইসলাম জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের ধর্ম আর আপনি সেই মোতাবেক আচরণ করতে শুরু করলেন।

আপনার বিশ্বাস যেন এতটা বিবেচনাহীন না হয় যে, একটা লোক আপনাকে ব্যবহার করে আরেকজনের জমি দখল করে৷ অন্যের প্রতিহিংসার আগুনের আপনি লাকড়ি হবেন কেন? বিশ্বরাজনীতি আপনাকে নিয়ে খেলছে। ক্ষমতা ও বিভেদের রাজনীতি চায় আপনার বোধহীন নৃশংস উন্মাদনা, আপনি মানুষকে ভালোবেসে তার প্রতিউত্তর দেন, ধর্মের বাইরের ডাকে নয়, ভেতরের ডাকে সাড়া দেন। ‘জ্বালাও পোড়াও বর্জন’ আপনার ধর্মানুভুতির ভাষা না, ওটা নষ্ট রাজনীতির ভাষা। কিন্তু আপনার মুখে (এবং হাতেও) এই ভাষা তুলে দিয়ে লাভটা হচ্ছে কার?

- মোজাফ্ফর হোসেন

stop communal attacks

ভারতে একদিকে যখন কৃষকদের নেতৃত্বে চলছে মোদী-শাহের দেশ বেচার বিরুদ্ধে আন্দোলন, অন্যদিকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে উগ্র ধর্মান্ধতা। বাংলাদেশেও অতি সম্প্রতি এর বিপরীত সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্র ও হামলা সংগঠিত হল। তারপর আবার সেই ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমবঙ্গে হামলা লাগানোর চেষ্টা, তারপর শিখ সম্প্রদায়ের কট্টর ও গোঁড়া গোষ্ঠীর সিঙ্ঘু বর্ডারে আন্দোলনরত দলিত কৃষক লখবির সিং-কে হাত পা কেটে খুন, জলপাইগুড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর সফরকালে ময়নাগুড়িতে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর অশান্তি লাগানোর চেষ্টা সহ ঘটনা পরম্পরায় দীর্ঘ হচ্ছে এই তালিকা। সম্প্রতি ময়নাগুড়ির ঘটনাই যদি লক্ষ্য করা যায়, আমরা দেখেছি বিজেপি সমর্থকেরা জড়ো হয়ে সাম্প্রদায়িক জিগির তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু স্থানীয় মানুষ তাড়া করলে তারা পালিয়ে যায়। এরপর সেদিনই সন্ধ্যা ৭.৩০টা নাগাদ বাঁকালি বাজারে প্রায় ৫০ জনের মত বাহিনী ‘হিন্দু বাঁচাও, মুসলিম তাড়াও’ শ্লোগান দিতে দিতে বাজারের কয়েকটি দোকান ভাঙচুর করে। তারপরে বার্ণিশ এলাকার গোলারবাড়ি গ্রামে মসজিদ ও সংলগ্ন মাদ্রাসার সামনে একটি মিছিল নিয়ে এসে আওয়াজ তোলা হয়, ‘মুসলিম তাড়াও, দেশ বাঁচাও’ ইত্যাদি। সেখানে উপস্থিত সংখ্যালঘু নমাজীদের বলা হয় যে মাইক ব্যবহার করে আজান দেওয়া যাবেনা। এই কথা বলে পরিকল্পিতভাবে বচসা তৈরি করা হয় এবং মিছিল থেকে ঢিল, পাটকেল ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে স্থানীয় মানুষজনের ওপর হামলা নামানো হয়। স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষকের খোঁজ চলতে থাকে। সেই সময় স্থানীয় মুসলিম জনগণ প্রতিরোধ করলে তারা পালিয়ে যায়। এবং কিছুটা দূরে গিয়ে ঢিল ছুঁড়তে থাকে। ঢিলের আঘাতে ঘটনাস্থলে তিনজন সংখ্যালঘু গ্রামবাসী আহত হয়। আহত দু’জনকে জলপাইগুড়ি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তৃতীয় ব্যক্তি উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে গুরুতর আঘাত নিয়ে চিকিৎসাধীন। এলাকায় গত রাত থেকে পুলিশ ও আরএএফ মোতায়েন করা হয়েছে। তবুও এলাকাজুড়ে আতঙ্কের পরিবেশ রয়েছে।

সিঙ্ঘু বর্ডারে আমরা দেখেছি কিভাবে আন্দোলনরত কৃষকেরা নিহাঙ্গ গোষ্ঠীর আক্রমণের ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন, অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি করেছেন এবং উক্ত গোষ্ঠীর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। কিন্তু প্রশ্নটা গভীরে। কারা এই নিহাঙ্গ? ১৬৯৯ সালে শিখ সৈন্যদল খালসার উৎপত্তি হয়। তারপর উক্ত দল দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। নিহাঙ্গ-এর উৎপত্তি এর অঙ্গাঙ্গীভাবেই। এরা বরাবর অত্যন্ত আগ্রাসী এবং কঠোর ধর্মীয় নিয়মাবলীর অনুসরণকারী। কট্টর এই গোষ্ঠী অত্যন্ত বেপরোয়া এবং পার্থিব কোনও কিছুর কাছেই মাথা নোয়াতে নারাজ।

লক্ষ্য করে দেখুন এই খুন, রক্ত কোনোটাই কিন্তু অধিকারের দাবিতে নয়। কোনোটাই কিন্তু জীবন-জীবিকা রুজি-রুটির জন্য বা শাসকের বিরুদ্ধে নয়।

বরং এই ধর্মীয় জিগির মানুষকে তার অধিকারের দাবিতে সরব হওয়া থেকে ভুলিয়ে রাখে, বিরত রাখে। পেটে খিদের আগুন জ্বললেও মাথার গেরুয়া ফেট্টি জ্বলতে থাকে। স্বার্থসিদ্ধি হয় ফ্যাসিস্টদের, মৌলবাদী শক্তির। ধর্ম বা ধর্মীয় সংস্থাসমূহ যখন রাষ্ট্র বা দেশের চালিকাশক্তির সঙ্গে যুক্ত হয় তখন তা উৎপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। সমাজ কাঠামোকে চালায় ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতিতে। আর রাষ্ট্র যখন শাসকশক্তির দ্বারা এরকম পক্ষপাতদুষ্ট হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় বিদ্বেষ-বিভাজনপ্রসূত সংখ্যাগুরুবাদের ‘স্বাভাবিকীকরণ’। ফলশ্রুতিতে, রক্ত, খুন, দেশের সম্পদ ধ্বংস, ব্যক্তিজীবন ও অধিকারে হস্তক্ষেপ, নির্যাতন সহ একের পর এক অন্ধকার নেমে আসে। ধিক্কার এই ঘটনা ও প্রবণতাকে। মানুষ বাঁচুক নিজের মত-ধর্ম নিয়ে, সাম্প্রদায়িক হামলা হত্যা বন্ধ হোক!

- সৌমি জানা

== সমাপ্ত ==

খণ্ড-28
সংখ্যা-38