দরং হত্যাকাণ্ড : আসাম মুখ্যমন্ত্রীর অপসারন প্রয়োজন
Assam CM Must Go

বর্তমান সময়ে মবলিঞ্চিং ভারতে বিচার-বহির্ভূত হত্যার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ হিসেবে সামনে এসেছে। আসামের দরং জেলার ঢোলপুর গ্রাম থেকে আসা ভিডিও চলচ্চিত্র আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে রাস্তার মব আর রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেকার ঝাপসা হয়ে আসা পার্থক্যরেখাটা সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেলে হিংসার চেহারা কতটা অকল্পনীয় হিমশীতল ও মানবতা বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে। সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীই রাস্তার মবে পরিণত হল এবং একজন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে তার প্রাণহীন দেহটিকে উল্লাসমঞ্চ বানানো হল, পুলিশের ফটোগ্রাফার তার ওপরে লাফিয়ে পদাঘাত করে উৎসব করল।

আসামের হিমন্ত বিশ্বশর্মা সরকারের কাছে ঢোলপুরের এই নৃশংস হিংস্রতা নিছক কৃষি প্রকল্পের জন্য সরকারি জমি থেকে ‘জবর দখলকারী’ সরানোর এক নিত্যনৈমিত্তিক কাজ মাত্র। এই জমি চর এলাকা নামে পরিচিত, যে এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের প্রায়শই এক জায়গা ছেড়ে আরেক জায়গায় সরে যেতে হয় বছরের পর বছর বন্যার কারণে। আর, যাদের ‘জবর দখলকারি’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে তাঁরা হলেন সেইসব পরিবার যাঁরা দশকের পর দশক ধরে এই বন্যাবিধ্বস্ত এলাকার জমিতে ফসল ফলিয়ে আসছেন, যাঁরা সেই অত্যন্ত প্রতিকুল প্রকৃতিতে দীর্ঘ জীবন-সংগ্রামের মাধ্যমে কৃষিকার্যে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছেন। ঘটনা হল, খুন হওয়া মানুষ দুটির নাম — মইনুল হক ও শেখ ফরিদ — এনআরসি তালিকায় আছে এবং ১৩ বছর বয়সী ফরিদের পকেটে ছিল সদ্য পাওয়া তার আধার কার্ডটি।

এই মানুষেরা কেবলমাত্র এটুকুই চেয়েছিলেন যে, উচ্ছেদের আগে যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থাটুকু অন্তত করুক সরকার। ভিটে ও জমি থেকে উচ্ছেদ করতে হলে সরকারের কাছ থেকে পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত পাওয়া যে কোনও মানুষের মৌলিক আইনি অধিকার। এমনকি গৌহাটি হাইকোর্টও মহামারীর এই সময়ে এই উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ করতে বলেছিল সরকারকে। একথা স্পষ্ট যে সরকারই আসলে আইন ভেঙ্গেছে। তারপরও সরকার এখন এক তীব্র অপপ্রচার ও নিপীড়ন অভিযান চালাচ্ছে। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছে বলে প্রচার চালিয়ে ঢোলপুরের নৃশংসতা আড়াল করতে চাইছে, আর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে ওই মানুষগুলোকে আরও সন্ত্রাসের শিকার বানাচ্ছে। ভীমা কোরেগাঁও/এলগার পরিষদ ও দিল্লী দাঙ্গার কুখ্যাত মামলাগুলির মতই ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব আমদানি করা হচ্ছে জঘন্য অপরাধীদের বাঁচাতে আর অপরাধের শিকার ও তাদের পাশে দাঁড়ানো সকলকে নিগ্রহ করতে।

এনআরসি’র প্রক্রিয়া চলার সময় ওদের শব্দ ছিল অনুপ্রবেশকারী। জনসাধারণকে বলা হয়েছিল যে একবার এনআরসি হয়ে গেলে যাদের নাম তালিকায় উঠে যাবে তাদের আর চিন্তার কোনও কারণ থাকবে না, তারা অনুপ্রবেশকারীর তকমা থেকে মুক্ত হয়ে যাবে, এনআরসি’র ছাঁকনি দিয়ে আসা আসামের সব নাগরিকদের মধ্যে এক নতুন সামাজিক সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি হবে। অভিজ্ঞতা এখন দেখাচ্ছে যে এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়া প্রায় বিশ লক্ষ মানুষের মধ্যেকার অধিকাংশ নারী, পুরুষ ও শিশুর আদতে অন্য কোথাও থেকে আসার কোনও ইতিহাস নাই, এটুকুই বলা যায় যে তাদের ডকুমেন্টগুলো এনআরসি’র পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। এঁরা আসলে আসামের ডকুমেন্ট বিহীন মানুষ। কিন্তু ঢোলপুরে হিংস্রতা দেখিয়ে দিল যে এনআরসি’র পরও মানুষ নিরাপদ হয়নি। এনআরসি’র পরীক্ষায় পাস করার পর তাঁদের এখন নতুন পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে। এখন আবার গোলপোস্ট সরিয়ে দিয়ে তথাকথিত ‘জবর দখলকারিদের’ উচ্ছেদ করতে নেমে পড়েছে সরকার।

সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে জবরদখলকারিদের কাছ থেকে জমি উদ্ধার করে আসামের আদিবাসীদের মধ্যে সেই জমি বিতরণ করবে। কিন্তু ‘অভিবাসী জবর দখলকারী’ ও ‘আদিবাসী’র মধ্যে এই পার্থক্যকরণও আসলে মানুষের মধ্যে বিভাজন ও বিদ্বেষের ধোঁয়াজাল তৈরির চেষ্টা মাত্র। আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে তথাকথিত আদিবাসী মানুষেরা একইরকম নির্মম উচ্ছেদের শিকার, তা সে সরকারি অভিযানের মাধ্যমে হোক বা বন্যায়। জনসাধারণকে জবরদখলকারী বলে দেগে দেওয়া আর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়াই কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা সাম্প্রতিক ভারতের নির্মম বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। কোথাও করা হচ্ছে শিল্পায়ন ও উন্নয়নের নামে, বৃহৎ জলাধার বা বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের নামে, কোথাও শহরের সৌন্দর্যায়ন বা রাস্তা চওড়া করার নামে।

যখন ‘জবর দখলকারীদের’ পরিচয় হয় নিশানা বানানো কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ — ধর্মীয়, ভাষিক বা জাতিগত সংখ্যালঘু — তখন উচ্ছেদ অভিযানের নৃশংসতা অমানবিক মাত্রা নেয়, যেমনটা আসামের স্তম্ভিত করা ভিডিওটিতে দেখা গেল। ভারত ইউনিয়নের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ডকুমেন্টবিহীন নাগরিকদের ‘উঁইপোকা’ বলেছিলেন। এরকম নিধন অভিযান চালানোর উস্কানিই তিনি দিচ্ছিলেন তাঁর শ্রোতাদের। অমিত শাহের কুখ্যাত ‘ক্রনলজি’র না-বলা ভবিষ্যৎ এটাই ছিল, এটাই ছিল এনআরসি-এনপিআর-সিএএ’র বহিষ্কার অনুশীলনের প্রকৃত সঞ্চারপথ।

আসামের সরকার দরং হিংসার তদন্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। হিমন্ত বিশ্বশর্মা মুখ্যমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন বাস্তবে কোনও সদর্থক ও নিরপেক্ষ তদন্ত আদৌ সম্ভব নয়। দরং-এর এসপি মুখ্যমন্ত্রীর নিজের ভাই। এবং মুখ্যমন্ত্রী তো উচ্ছেদ অভিযান প্রসঙ্গে নিজের খুশী প্রকাশ করেছেন। তদন্তের মাধ্যমে কোনও সত্য তুলে এনে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ করা সবার আগে জরুরি এবং তারপর হাইকোর্টের একজন কর্মরত বিচারকের তত্ত্বাবধানে বিচারবিভাগীয় তদন্ত চালানো জরুরি। যারা ভারতের গণতন্ত্র, বৈচিত্র্য ও সাংবিধানিক আইনি শাসন রক্ষা করতে চান তাদের সকলের জন্য এক চূড়ান্ত সতর্কবাণী হোক এই দরং ভিডিওটি। জবরদখলকারিদের কাছ থেকে জমি উদ্ধার করার নামে আরও সন্ত্রাস চালাতে দেওয়া যাবেনা আসাম সরকারকে। সমস্ত রকম উচ্ছেদ অভিযান অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং দরং-এর সমস্ত ভিক্টিম ও উচ্ছিন্ন মানুষের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে — মানবতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সংঘটিত কদর্য অপরাধের প্রেক্ষিতে ন্যূনতম এইটুকু অন্তত আসামের পাওয়া উচিত, ন্যূনতম এটুকু অন্তত ভারতবাসী দাবি করতে পারে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১)

খণ্ড-28
সংখ্যা-36