আজকের দেশব্রতী : ৪ মার্চ ২০২১ (অনলাইন সংখ্যা)
Deshabrati 4 marchInternational Women's DayLet's destroy the corporate raj

শতাব্দীর অভিশপ্ত অধ্যায় অতিমারী পর্ব ধীরে ধীরে সরছে। আবার বসন্ত এসেছে। কোকিল-ডাকা হরিয়ালী আর শিমুল-পলাশ রাঙা দিনে আবার এসেছে আট মার্চ! কিন্তু এই দিনে সেই কন্যারা খুশির আলো ছড়িয়ে চঞ্চল পায়ে আর ঘর-বার করবে না — হাথরাসের সেই দলিত কন্যা কিংবা পাটনার সেই গুলনাজ। এবং আরও অনেক অনেক বালিকা, কিশোরী, তরুণী। বিষাক্ত মানসিকতার বীভৎসতা যাদের স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে, নির্মমভাবে মুছে দিয়েছে চিরতরে। প্রত্যেকটি হত্যা আমাদের মনে গাঁথা আছে! এই বিষ — নারী বিদ্বেষের, জাতি বিদ্বেষের বিষ, ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে সমাজের দেহে। সেই বিষক্রিয়া দেশের প্রশাসন, আইন, বিচার-ব্যবস্থাকেও পঙ্গু করে দিচ্ছে। না হলে দেশের শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি নাবালিকার হাত পা বেঁধে ধর্ষণে অভিযুক্তকে বলতে পারেন, “তুমি কি মেয়েটাকে বিয়ে করবে?”! বলতে পারেন “আন্দোলনে কৃষাণীরা আর প্রবীণরা কেন?”!

এই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে বিজেপি-আরএসএস-এর ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন। তাই এবারে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের বার্তা আরও তাৎপর্যপূর্ণ, আরও গভীর। অতিমারির দুঃসময়ে আমরা হারিয়েছি বহু সাহসী কোভিড যোদ্ধাকে, কোভিড আক্রান্ত সহনাগরিকদের। হারিয়েছি দিল্লী সীমান্তে আন্দোলনকারীদের অনেককে। হারিয়েছি সেইসব বন্ধুদের লকডাউনে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে লাঞ্ছিত অপমানিত হয়ে যারা আত্মঘাতী হয়েছেন। উৎসবের দিনে মনে পড়ে বার বার তাদের কথা। আরও বহুদিন যাদের এই সুন্দর পৃথিবীর বুকে থেকে সমাজটাকে সুন্দর করে গড়ে তোলার কথা ছিল!

হ্যাঁ, আট মার্চ পৃথিবীর সমস্ত নারীর কাছে উৎসবের দিন। আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে দাবি আদায়ের দিন, অধিকার অর্জনের সাফল্য উদযাপনের দিন, আত্মঘোষণার দিন! আগামী সংগ্রামের শপথ নেওয়ার দিন!

সুন্দর প্রকৃতির কোলে সুস্থ উজ্জ্বল কর্মব্যস্ত দিন। কাজ শেষে চমৎকার অবসর, তারপর ঘুম — যে ঘুমে থাকবে না  কোনো দুঃস্বপ্নের রেশ। সুস্থ নিরাপদ পরিবেশে আট ঘন্টা কাজ, আট ঘন্টা একেবারে নিজের মনের মতো করে সময় কাটানো, তারপর আট ঘন্টা বিশ্রাম। আর চাই একজন নাগরিকের অধিকার — ভোটাধিকার। এই দাবিতেই প্রায় দেড়শো বছর আগে বার বার উত্তাল হয়েছিল ইউরোপ আমেরিকার রাজপথ। হাজার হাজার নারী শ্রমিক, লক্ষ লক্ষ মানুষ এই অধিকার অর্জনের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। রক্তাক্ত হয়েছিলেন, কারাযন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন, প্রাণ দিয়েছিলেন কতজন! ১৯১১ সালে কমিউনিস্ট নেত্রীদের এক আন্তজার্তিক সম্মেলনে সেই সব দাবি সামনে রেখে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবসের’ সূচনা হয়। অর্থনৈতিক অধিকার, সামাজিক মর্যাদা আর রাজনৈতিক ন্যায়ের জন্য আজও দিনটি উদযাপিত হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে।

উপরের দাবিগুলো স্বীকৃত, কিন্তু পৃথিবীর বহু নারীর কাছেই অধরা। স্বৈরাচারী শাসকরা অর্জিত অধিকারগুলোও কেড়ে নিচ্ছে। বিশ্বের নানা প্রান্তে মেয়েরা তাই আজ পথে। খোলা আকাশের নিচে শ্লোগান-উচ্চকিত বিনিদ্র নিশিযাপনে।

যেমন আমাদের ভারতবর্ষে। গত বছর সমান নাগরিকত্বের দাবিতে বিলকিস দাদির নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল দিল্লির ‘শাহীনবাগ’ আন্দোলন এবং দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে। গত বছর নভেম্বর থেকে আবার দিল্লি সীমানায় লাখো কৃষকের আন্দোলন চলছে। তিনটি কর্পোরেটভজা কৃষিআইন বাতিলের দাবিতে। সেখানেও মহিলারা রয়েছেন বিপুল সংখ্যায়, ঘর-বাড়ি, খেত-খামার, ঘরের নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে। আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপে তারা পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছেন। যেমন থাকেন চাষের মাঠে। জমি পরিষ্কার করা থেকে ফসল ঘরে তোলার প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্বে লেগে থাকে তাদের ঘাম-রক্ত। জীবন জীবিকা জমিনের লড়াইয়ে ‘ভাগিদারী’ বুঝে নিতে, বুঝিয়ে দিতে, তাই তারা নিজেদের তাগিদে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়ে সামিল হয়েছেন সত্যাগ্রহে। টানা তিন মাসের উপর সেখানেই রয়েছেন। রয়েছেন রান্না, সাফাই, বাচ্চা পড়ানো থেকে ট্রাক্টর চালানো পর্যন্ত — প্রতিটি কাজে।

তারা নিজেদের জন্য চান ‘কৃষকের’ স্বীকৃতি, চান পারিবারিক শ্রমের স্বীকৃতি, চান সম কাজে সম মজুরি, ফসলের ন্যূনতম সমর্থন মূল্যের (উৎপাদন মূল্যের দেড় গুণ) আইনি প্রতিশ্রুতি; চান সুষ্ঠু গণবণ্টন ব্যবস্থ। চান না কৃষিতে কর্পোরেট-রাজ। আর অবশ্যই চান প্রধান বিচারপতির মনুবাদী মন্তব্যের প্রত্যাহার!

প্রধানমন্ত্রীর নতুন আখ্যা (বদনাম) ‘আন্দোলনজীবী’ প্রসঙ্গে ভারতের প্রতিটি নারীর স্পর্ধিত ঘোষণা: তারা ‘আন্দোলনজীবী’ কারণ ‘পরজীবী’ কর্পোরেট এবং তাদের দালাল শাসক তাদের ওপর আন্দোলন চাপিয়ে দিয়েছে। গ্যাসের দাম গত দু’মাসে দু’শো পঁচিশ টাকা বেড়েছে। বেড়েই চলেছে। আর ‘ঘরে ঘরে উজালা’ তো স্রেফ ধোঁকাবাজি! রেশনে কেরোসিন অমিল। পেট্রল ডিজেলের লাগামছাড়া দাম বাজারকে আগুন করে তুলেছে। অথচ তাদের হাতের কাজ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানির পদস্থ কর্মী থেকে ইটভাটার বা কৃষির মহিলা শ্রমিক লিঙ্গ বৈষম্যের শিকা। ‘ওয়ার্কফ্রম হোম’-এর নামে চলছে শ্রম-লুণ্ঠন! শ্রমকোড বিলে কমেছে কাজের পরিসর ও নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা। নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য, খাদ্য সুরক্ষা সহ বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্প থেকে সরকার হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। ‘লিঙ্কড ইন অপরচুনিটি ইনডেক্স ২০২১’ বলছে, ৮৫% মহিলা কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার শুধু মহিলা বলে। এর আগে ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ জানিয়েছিল মহিলা-পুরুষ বেতন-বৈষম্যের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত শীর্ষ স্থানে রয়েছে।

এবার তাকাই কেন্দ্রীয় সরকারের বর্তমান আর্থিক বছরের বাজেটে। ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ এবং ‘মাতৃবন্দনা যোজনা’কে ‘সামর্থ্য’ নামে ঢুকিয়ে সামগ্রিক ভাবে মহিলাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ২৫২৬০ কোটি টাকা যা ২০১৯-২০ সালের প্রকৃত ব্যয় ২৬৭৩১ কোটি টাকার থেকেও কম!

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটের আবহে বিজেপি-আরএসএস-এর নির্বাচনী প্রচারে নারী বিদ্বেষের জাতি বিদ্বেষের তীব্র গরল ঝরে পড়ছে। দিলীপ-কৈলাস এবং তাদের অনুগামীরা এমনকি রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে পর্যন্ত কুৎসিততম ভাষায় আক্রমণ করছেন। যে যোগীর রাজ্য ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনে শীর্ষস্থানে রয়েছে, তিনিও প্রচারে এসে বলছেন, এখানে নারীরা অরক্ষিত এবং তারা ক্ষমতায় এসে এখানে ‘লাভ জিহাদ’ বন্ধ করবেন! যার অস্তিত্ব স্বয়ং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও প্রশাসনের কর্তারাই অস্বীকার করেছেন! এরা মসনদে আসীন হলে যে সেটা বাংলার মহিলাদের চরমতম দুর্দিন হবে সেটা বুঝতে এখনও বাকি আছে!

বাংলার মহিলারাও লড়ছেন ঋণমুক্তির দাবিতে, রন্ধনকর্মীদের শ্রমিকের মর্যাদা ও স্বীকৃতির দাবিতে। ব্লকে ব্লকে তারা প্রতিবাদ সংগঠিত করছেন। শহরে বড়মাপের সমাবেশের মধ্য দিয়ে তারা প্রশাসনকে প্রতিবাদের বার্তা দিচ্ছেন। কৃষক আন্দোলনের পাশে তারা আছেন।

তেভাগা-তেলেঙ্গানা-নকশালবাড়ি হয়ে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-মুন্নার হয়ে শাহিনবাগ-সিঙ্ঘু টিকরি গাজিপুর বর্ডার — ভারতীয় নারীর আত্মমর্যাদা অধিকার আর ন্যায়ের দাবির লড়াইয়ে এক অনুপম গৌরবোজ্জ্বল রূপকথা, রূপরেখা!

বাংলার পথে প্রান্তরে, গ্রাম্য পথের আঁকে বাঁকে, কুটিরের আঙিনায়, লোককবির মরমী গানে ছড়িয়ে আছে তেভাগা নকশালবাড়ির শহীদ নারীদের কথা। কী অদম্য মনোবলে হাজার হাজার কৃষকরমণী পরাধীন ও স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রশক্তির নির্মমতম অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন! সেই সংগ্রামী ঐতিহ্যের উত্তরসূরী বাংলার নারী — এটা যেন মনে রাখে মনুবাদী গেরুয়া বাহিনী! আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সংগ্রামী ঐতিহ্য দীর্ঘজীবী হোক!

Manhole Workers' Deathsuffocated to death in Kundghat sewer

কুঁদঘাট, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২১ – পূর্ব পুটিয়ারি ইঁটখোলা মাঠের কাছে নির্মীয়মাণ পাম্পিং স্টেশনের সঙ্গে নিকাশি নালা সংযুক্তি করণের কাজ চলছিল জোর কদমে। পাম্পিং স্টেশনের জলাধারে নিকাশি জল পাঠানোর জন্য প্রায় ২৫ ফুট গভীরে পাতা ৬০ ইঞ্চি পাইপের গেট খুলে দিতে বলা হয় একজন সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ সাফাই কর্মীকে, গভীর ম্যানহোলে নেমে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় কোনো সামগ্রী ছাড়াই। খবরে প্রকাশ পাইপের গেট খোলা মাত্র বহুদিন ধরে জমে থাকা তরল আবর্জনা ও বিষাক্ত গ্যাসের (মিথেন?) স্রোত নিমেষে গ্রাস করে নেয় ওই কর্মীকে। গ্যাসের প্রভাবে অচৈতন্য কর্মী ডুবে মারা যান। কিছুক্ষণ পরে ওই কর্মীর দুই ভাই ও আরও একজন অনভিজ্ঞ শ্রমিক ওই ম্যানহোলে নেমে যান প্রথম শ্রমিককে উদ্ধারের জন্য। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এই তিন জনের একই ভাবে মৃত্যু হয়। ওপরে অপেক্ষায় থাকা আরও তিন কর্মী এরপর সতর্কতার সাথে ম্যানহোলে কিছুটা নেমে আসেন তবে গ্যাসের প্রভাবে অচৈতন্য হওয়ার আগেই কোনোভাবে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন।

রাজ্য সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর ও দমকল বাহিনীর সাহায্যে দ্রুতই ডুবুরি নামিয়ে ম্যানহোল থেকে দেহগুলি উদ্ধার করা হয়। হাসপাতালে চারজনকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। গ্যাসের প্রভাবে আচ্ছন্ন তিনজন আহত ও ভীষণভাবে আতঙ্কিত শ্রমিকদের বাঘাযতীন স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য কোলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকায় নিকাশি ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে কোলকাতা কর্পোরেশনের অধীন কেইআইআইপি (কোলকাতা এনভায়রনমেন্টাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট)-এর মাধ্যমে।

ঘটনার পরে তাৎক্ষণিক ভাবে জানা গেল নিহত তিন ভাই: মহম্মদ আলমগীর (৩৫), জাহাঙ্গীর আলম (২২), সাব্বির হোসেন (১৯) এবং লিয়াকৎ আলি (২০)। আহত হন : সইফুল ইসলাম (২৪), মহম্মদ সলোমন (৩৫), মাহাবুল হক (২২)। এরা সবাই মালদহ হরিশচন্দ্র পুরের তালসুর গ্রামের বাসিন্দা, প্রথমোক্ত তিনজন একই পরিবারের সদস্য, বাবার নাম তুরাব আলি, হত দরিদ্র প্রান্তিক চাষি। ম্যানহোলে ঢোকার সময় এদের কাউকেই সিকিউরিটিবেল্ট বা মাস্ক পড়ানো হয়নি। কোনও ম্যানহোলে কাজের অনেক আগে থেকেই কাছাকাছি ম্যানহোলের ঢাকনাগুলি খুলে রাখা নিয়ম, যাতে জমে থাকা সম্ভাব্য বিষাক্ত গ্যাস বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। ম্যানহোলের মধ্যে কি পরিমান জল আসতে পারে আগাম অনুমান করে তদনুযায়ী ব্যাবস্থা নেওয়া হয়নি। আসলে ঘটনার সময় কোন আধিকারিক বা ইঞ্জিনিয়ার ওখানে ছিলেনই না। যেমন, নিহত সাব্বির ও লিয়াকৎ এই ভয়ঙ্কর বিপদজনক কাজে নতুন, সেটা দেখার লোকই ছিল না। এসব কিছুই দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদার সংস্থার দিক থেকে চরমতম গাফিলতি এবং কেন্দ্রীয় সরকার প্রণীত ‘দ্য প্রহিবিশন অফ এমপ্লয়মেন্ট অ্যাজ ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জারস অ্যান্ড দেয়ার রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাক্ট ২০১৩’-র পরিপন্থী।

কোলকাতা কর্পোরেশনের বোর্ড অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সভাপতি শ্রী ফিরহাদ হাকিম তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা করেন, যদি তাদের অনুসন্ধান রিপোর্টে ঠিকাদার সংস্থার কেউ অভিযুক্ত হন তাহলে তার বিরুদ্ধে এফআইআর করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও জানান যে সংশ্লিষ্ট কন্ট্রাক্টরকে মৃত শ্রমিক প্রতি ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছে। ২৭ ফেব্রুয়ারী এআইসিসিটিইউ, আইপোয়া এবং গণতান্ত্রিক নাগরিক উদ্যোগের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এক ডেপুটেশন টিমকে রিজেন্ট পার্ক থানার ওসি জানান যে তারাও একটি অনুসন্ধানকারী টিম গঠন করেছেন। যদিও অভিযুক্তের নাম তিনি জানাতে চাননি।

২৬ ফেব্রুয়ারি উল্লিখিত তিনটি সংগঠন ছাড়াও পিডিএসএফ, আইসা, এককমাত্রা ও আরও কিছু ছাত্র সংগঠন মিলিত ভাবে কুঁদঘাট মেট্রো স্টেশন থেকে ঘটনাস্থল পর্যন্ত একটি মিছিলের আয়োজন করেন। একটি ছোট সভার মধ্যে দিয়ে কর্মসূচী সমাপ্ত হয়, ‘২১ ডাক, বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলা’ এই ব্যানারকে সামনে রেখে কর্মসূচী, বিক্ষোভ জারি থাকবে। আগামী ৩ মার্চ সেক্সপীয়ার সরণিতে অবস্থিত কেইআইআইপি দফতরের সামনে বেলা ২টোয় গণসংগঠনগুলির এক বিক্ষোভ কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছে। এআইসিসিটিইউ’র সভাপতি অতনু চক্রবর্তী জানালেন যে আগামী ৪ মার্চ শ্রমমন্ত্রীর কাছে ডেপুটেশন ও মেমোরান্ডামে সাফাই কর্মীদের দুর্দশার বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হবে। কর্পোরেশন ও সরকারের বিভিন্ন আধিকারিকের কাছে চিঠি দিয়ে তাদের বক্তব্য জানতে চাওয়া হবে।

গোটা ভারতবর্ষে সাফাই কর্মীরা চরম লাঞ্ছনা ও দুর্দশার মধ্যে বেঁচে আছেন। যেভাবে সরকার প্রণীত নিরাপত্তা বিধিকে ছেঁড়া কাগজে পরিণত করে বেআইনিভাবে ম্যানহোলের কাজে সাফাই কর্মীদের নিয়োগ করে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হলো তার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য আমরা কঠোর শাস্তির দাবি করছি। গোটা ভারতে প্রতি পাঁচ দিনে একজন সাফাই কর্মীর মৃত্যু হয়, এই কাজ এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ। কুঁদঘাটে নিহত সাফাই কর্মীরা সকলেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের, তারা পরিযায়ী এবং তাদের পরিচয় ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জারস। ফলে মনুবাদী বিজেপি’র এই ঘটনায় কোনও হেলদোল নেই। বর্ণ ব্যবস্থার সিঁড়ির একদম নীচের ধাপের মানুষেরা যুগ যুগ ধরে এই পেশায় নিয়োজিত। নিম্নলিখিত দাবির ভিত্তিতে আমাদের লড়াই জারি থাকবে।

১) মৃত শ্রমিকদের প্রত্যেককে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ রাজ্য সরকারকে দিতে হবে।
২) সংশ্লিষ্ট কন্ট্রাক্টরের লাইসেন্স বাতিল ও গ্রেফতার করতে হবে।
৩) কায়িক শ্রম নয়, নর্দমা সাফাই আধুনিক যন্ত্রে করতে হবে।
৪) অস্থায়ী কর্মীদের স্থায়ীকরণ করতে হবে।
৫) সাফাই কর্মীদের আধুনিক সরঞ্জাম দিতে হবে, সামাজিক সুরক্ষা এবং জীবনবীমার আওতায় আনতে হবে।

- শান্তনু  

Election of West BENGALMust stop

রাজ্যে আট দফা বিধানসভা নির্বাচন হবে। এত দীর্ঘ দফা’য় নির্বাচন বোধহয় একটা নজিরবিহীন রেকর্ড। এরকম সিদ্ধান্ত কেন নিতে হল তার কারণটি কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন খোলসা করেনি। যদি এর পেছনে অনুঘটক কারণ জুগিয়ে থাকে বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং দু’চারটি পৌরসভা নির্বাচন অবাধ হতে না পারা, তাহলেও পাল্টা যুক্তি ওঠে। আরও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মুড়ে আরও কম দফায় নির্বাচন সারা সম্ভব নয় কেন? নির্বাচন কমিশনের সদস্য সংখ্যাও তো কম নয়। নিন্দুকেরা টিপ্পনী কাটছে, কেন্দ্রের শাসকদল নিজের পর্যবেক্ষক টিম ও আইটি সেল নামিয়েছে বেশ ভারী সংখ্যায়। তাঁদেরই পর্যবেক্ষণ কি আট দফা নির্ঘন্ট নির্ণয়ের পেছনে অদৃশ্য প্রভাব ফেলেছে! বিজেপি নেতারা হুমকি দিয়ে আসছিলেন ‘এবার নির্বাচন হবে কড়া ব্যবস্থায়’। অতঃপর আয়োজন ব্যবস্থার বহর দেখে বিজেপি উল্লসিত। উৎফুল্ল আরও একজন, রাজ্যের রাজ্যপাল, ক্ষমতায় আসার শুরু থেকেই যিনি পরোক্ষে কেন্দ্রের শাসকদলের সপক্ষে যাবতীয় সক্রিয়তা দেখিয়ে আসছেন। এসব লক্ষণ দেখে সন্দেহ জাগে, তবে কি নির্বাচন পরিচালনায় প্রকৃত নিরপেক্ষতা থাকবে? নাকি ক্ষমতার জোরে যোগসাজশ করে ফায়দা তোলার ফন্দি আঁটছে বাংলা দখলের জন্য মরীয়া হওয়া বিজেপি! শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার নয়।

বিজেপি চালাচ্ছে গোয়েবলসীয় প্রচার — হিটলারী হুমকি। প্রচারের শুরুয়াতটা করেছে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে মেরুকরণের ইস্যূগুলো সামনে এনে। কেন্দ্রের প্রকল্পগুলো রূপায়ণে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলে। তৃণমূল ভাঙিয়ে বিজেপি বাড়ানোর খেলা শুরু হতে নব্য নেতাদের ধরিয়ে দেওয়া হল নানা দুর্নীতি-কেলেঙ্কারীর তুলোধোনার কাজ। ‘সাধু’ সাজতে প্রচারের স্বার্থে নেওয়া হতে থাকল বাংলার মনীষী স্মরণের ধূর্তকৌশল। তারপরে একে একে কতই না কেরদানী প্রদর্শন! হেলিপ্যাড থেকে নেমে নিম্নবর্ণের মানুষের ঘরে গিয়ে সদলবলে ভুরিভোজ সেরে সাড়ম্বরে সমারোহে শোভাযাত্রা। মনে হল চালচোর-কয়লা চোর ধরার তৎপরতা দেখানো দরকার। লেলিয়ে দেওয়া হল সিবিআই। ভুলেও সারদা-নারদ তদন্তের নাম মুখে আনার সাহস হচ্ছে না। কারণ, ঘাঘু-ঘুঘুদের বেশ কিছু এখন তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে, শুধু তাই নয়, তৃণমূল ভাঙার পাকা হাত। আবার তৃণমূলের দেখাদেখি নেওয়া হল টলিউডে গেরুয়া অনুপ্রবেশের পথ। সিএএ-এনআরসি নিয়ে এখনই প্রচারের ঢল নামানোর প্রশ্নে মোদী-শাহরা দ্বিধান্বিত, কি ফল দেবে না দেবে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না, তাই এবিষয়ে প্রচার চালাচ্ছে সাধারণ স্তরে, বলছে ‘ভ্যাকসিন’ শেষ হলেই ‘ক্যা’ শুরু হবে। সমস্ত প্রশ্নের মুখে অমিত শাহ বলছেন মোদীর ওপর প্রশ্নাতীত আস্থা রাখার কথা। আর মোদী বলে চলছেন অন্তঃসারশূন্য ‘আত্মনির্ভর ভারত’ নির্মাণের কথা। যা বস্তুত ধোঁকা দিতেই। পেছন পেছন উড়ে আসছেন উত্তরপ্রদেশের কাপালিক মুখ্যমন্ত্রী ‘যোগী’ আদিত্যনাথ। সকলেই ওয়াকিবহাল, যোগী জমানায় কি সাংঘাতিক সাম্প্রদায়িক-বর্ণবাদী রাজত্ব চলছে, কি সর্বনাশা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব চলছে। তবু ঐ চরম ঘৃণা-বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজ চালক যোগী বাংলায় এসে মিথ্যাচার আর স্বৈরাচারের বান ছোটাচ্ছেন। যোগী যখন গলাবাজী করছেন তাঁর রাজ্যে গুন্ডারাজকে গলি থেকে গারদে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তখনও নৃশংসতার ঘটনা ঘটছে উত্তরপ্রদেশে, খবর আসছে হাথরস থেকে, বারবার গণধর্ষণের শিকার হওয়া নিম্নবর্ণের মেয়ের বাবাকে অভিযুক্ত ধর্ষকের গুলি করে হত্যার ঘটনার। যোগীর মুখে শুধু হিন্দুত্বের ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদে’র সব এজেন্ডা। বাংলায় ক্ষমতায় এলে তৈরি করা হবে ‘লাভ জেহাদ আইন’, বন্ধ করা হবে ‘গো হত্যা ও গরু পাচার’, ‘গো মাংস বিক্রি’র দোকান, ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি রেয়াত না করলে ঠাঁই হয়ত হবে এরাজ্যে, তবে থাকতে হতে পারে গারদে। এসব যেমন ‘হিন্দু সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ চাপিয়ে দেওয়ার উৎস, তেমনি ‘হিন্দু রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ’ তথা ‘হিন্দু রাষ্ট্রবাদ’ চাপানোর অঙ্গ। ভারতীয় ফ্যাসিবাদের উত্থানের এই দুই রূপের সমন্বয় কায়েমের অভিযান চালাচ্ছে আরএসএস-বিজেপি। এই লক্ষ্য হাসিলের উদ্দেশ্য থেকেই পশ্চিমবাংলার অন্দরে কন্দরে আজ বিজেপি হায়েনার হানা।

একে রুখতেই হবে নির্বাচনী রণাঙ্গনে। প্রকৃত গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি অবিচল থাকতে। সাংবিধানিক সব অধিকার রক্ষা করতে। সংকটে জর্জরিত জনগণের জ্বলন্ত দাবিসমূহ আদায় করতে।

War against FarmerDefeat the Modi government's war

মোদী সরকারের বানানো সর্বনাশা কৃষি আইনগুলো বাতিলের দাবিতে ভারতে চলমান কৃষক আন্দোলন চতুর্থ মাসে প্রবেশ করল। এই তিন মাসে এই আন্দোলন বিপুল সৃজনশীল উদ্যম, সাহসিকতা, উদ্ভাবনী শক্তি এবং দৃঢ়তার সাক্ষর রেখেছে। দিল্লীতে কৃষকদের ঢোকার পথে অবরোধ সৃষ্টি করে সরকার অঙ্কুরেই আন্দোলনকে বিনাশ করতে চেয়েছিল, কিন্তু কৃষকরা রাজ্যের সীমানাগুলোর দখল নিয়ে এবং বিশাল এলাকা জুড়ে প্রতিবাদ স্থল স্থাপন করে পাল্টা লড়াইয়ে নামেন। দিল্লীর রামলীলা ময়দানে কৃষকদের তাঁবু ফেলতে না দিয়ে মোদী সরকার রাজধানীকে ঘিরে চারটে প্রতিবাদ স্থলের আবির্ভাবকেই সুনিশ্চিত করে দেয়।

আন্দোলন সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছয় প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন, যেদিন দিল্লীর জনগণ রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে কৃষকদের অবিস্মরণীয় ট্রাক্টর মিছিলকে অভিনন্দিত করেছিলেন। কিন্তু সরকার ও তার বশংবদ গোডি মিডিয়া গোটা মিছিলটাকে পর্যবসিত করে বিচ্ছিন্ন একটা ঘটনায়, যাতে গুটিকয়েক ব্যক্তি লালকেল্লা ময়দানে একটা খালি খুঁটিতে শিখ ধর্মীয় নিশান লাগায়। আন্দোলনটাকে দেশ-বিরোধী নৈরাজ্য ও ষড়যন্ত্র রূপে কলঙ্কিত করে সংবাদ মাধ্যম ঝড় ওঠায়, এবং সরকার যেমন দানবীয় আইনের অধীনে মিথ্যা অভিযোগ দায়েরের তার মার্কামারা অস্ত্রের ওপর ভর করে, তারই সাথে আবার পুলিশী নিপীড়ন ও সংগঠিত গুণ্ডা বাহিনীর যৌথ হানাদারিকেও নামিয়ে আনে। কয়েক ঘন্টার জন্য মনে হয়েছিল যে, সরকার বুঝি বা ভারতীয় কৃষকদের অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানকে বশীভূত করতে সক্ষম হয়েছে।

অসাধারণ দৃঢ়তা দেখিয়ে কৃষক আন্দোলন সংকটের সেই পর্যায় কাটিয়ে ওঠে। উত্তর ভারত জুড়ে বিস্তৃততর ও গভীরতর সমর্থন নিয়ে কৃষক আন্দোলন পুনরায় নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করেছে এবং ভারতের অন্যান্য অংশেও তার অনুরণন আগের চেয়ে আরো জোরালো হয়েই ধ্বনিত হচ্ছে। আন্দোলনের এক শক্তিশালী নেতা হিসেবে রাকেশ টিকায়েতের উত্থান এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা ও রাজস্থানে কিসান পঞ্চায়েতগুলোতে ব্যাপক সংখ্যক কৃষকদের অংশগ্ৰহণ সরকারকে আবারও রক্ষণাত্মক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। পুরোদস্তুর দমন নামিয়ে আন্দোলন দমনের পথকে অসম্ভব করে তুলেছে কৃষকদের ঐক্য ও শক্তি। টিকায়েতের চোখের জলের আবেগময় প্রভাবের মোকাবিলা করতে গিয়ে মোদী ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ এবং ‘কৃষি আইনগুলো ক্ষতিকারক নয়’ বলে এক প্রতারণমূলক আখ্যান ফাঁদার পথে যান।

এই লক্ষ্যেই চালিত হয়েছিল সংসদের উভয় কক্ষে দেওয়া মোদীর দীর্ঘ ভাষণগুলি। তিনি দাবি করেন, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য এবং মাণ্ডিগুলো আগের মতোই চলবে, কৃষি আইনগুলো ফসল বিক্রির ক্ষেত্রে আরো বিকল্প যুগিয়ে কৃষকদের ক্ষমতায়ন ঘটাচ্ছে মাত্র। রাজ্য সভায় তিনি কৃষক নেতাদের এবং কৃষক আন্দোলনের অন্যান্য সমর্থকদের ‘আন্দোলনজীবী’ ও ‘পরজীবী’ বলে ধিক্কার দেন। এ ব্যাপারে কোন সংশয় নেই যে, আন্দোলনকে তিনি ঝামেলা বলে এবং আন্দোলনের নেতাদের অশান্তি সৃষ্টিকারী বলেই গণ্য করেন। এটা বস্তুত ভারতের গণতন্ত্রকে ‘বিরোধী মুক্ত’ করা, অথবা বিরোধী মতকে নিকেশ করে গণতন্ত্রকে স্বৈরতন্ত্রে পরিণত করার তাঁর অভিপ্রায়কে পেশ করার আর একটা পন্থা মাত্র। লোকসভায় তিনি কৃষকদের আন্দোলনকে পবিত্র বলে অভিহিত করলেও রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির মতো ‘অশুচি’ দাবি তোলার জন্য আন্দোলনের তীব্র ভর্তসনা করেন।

স্পষ্টতই, সরকার চায় না যে কৃষকরা অ-কৃষি বিষয় নিয়ে অথবা অ-কৃষক নাগরিকরা কৃষকদের সম্পর্কে কোনো কথা বলুক। অন্যভাবে বললে, এর মধ্যে নিহিত অভিপ্রায়টা হল কৃষকদের বিচ্ছিন্ন করা এবং কৃষকদের সমর্থনে দাঁড়ানো অন্যদের ভয় দেখানো। এই রণকৌশল চূড়ান্ত রূপেই অনুসৃত হয়ে চলেছে। রিহানা এবং গ্ৰেটা থুনবার্গের টুইটগুলোর প্রতি মোদী সরকার যে ন্যক্কারজনক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং তথাকথিত থুনবার্গ টুলকিট ঘটনায় জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলনের কর্মী দিশা রবিকে যে গ্ৰেপ্তার করেছে তা সচল এই রণকৌশলের দুটি ভয়াবহ দৃষ্টান্ত বৈ অন্য কিছু নয়। দিশা রবিকে গ্ৰেপ্তার করে সরকার বোধকরি এক ঢিলে অনেক কিছুকেই নিশানা করছে। এর মধ্যে দিয়ে ভারতের নিজের পরিবেশ আন্দোলনকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে যে, তারা যেন কৃষক আন্দোলনের পাশে না দাঁড়ায় এবং কর্পোরেট স্বার্থের বিরোধিতা না করে।

আমাদের ভুললে চলবে না যে — নয়া শ্রম বিধি, কৃষি আইন এবং পরিবেশ সুরক্ষা বিধিগুলোর বিপর্যয় ঘটানো সবই পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত, সেগুলো ভারতের শ্রমিক, কৃষক ও পরিবেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে কর্পোরেট স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সরকারের একেবারে হালফিলের আইনি বন্দোবস্ত। দিল্লী পুলিশ সমস্ত রীতিকে বিসর্জন দিয়ে যেভাবে বেঙ্গালুরু থেকে পরিবেশ আন্দোলনের এক কর্মীকে গ্ৰেপ্তার করে দিল্লীর জেলে আটক করে, সে কথা বিবেচনা করলে আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, সমস্ত সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণ ও যুক্তরাষ্ট্রীয় রীতিনীতিকে অগ্ৰাহ্য করাটাকে কেন্দ্রীয় সরকার তার স্বভাব করে তুলেছে। দিশা রবির গ্ৰেপ্তারির মধ্যে দিয়ে সবাইকে এই বার্তাই দিতে চাওয়া হল যে, ভারতের কৃষকদের ও ভারতের সংবিধানের বিরুদ্ধে চালানো তাদের যুদ্ধে মোদী সরকার যতদূর ইচ্ছে ততদূর যেতে কোনো দ্বিধা করবে না।

আমরা যারা কৃষকদের সমর্থন করছি এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে আইনের শাসনের সাংবিধানিক ভিত্তিকে রক্ষা করছি, তাদের কাছে চ্যালেঞ্জটা হল মোদী সরকারের শয়তানসুলভ এই রণকৌশলকে পরাস্ত করা। কৃষকদের দিকে বাড়ানো সংহতিকে দুর্বল করে তোলাটা যদি সরকারের অভিপ্রায় হয়, তবে তার প্রত্যুত্তর হবে সংহতিকে আরো জোরদার করে তোলা। সরকার যদি কৃষি আইনগুলো সম্পর্কে প্রতারণামূলক প্রচারের বন্যায় ক্ষুদ্র কৃষকদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তবে আমাদের কাজ হবে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এবং কৃষি শ্রমিকদের সমস্ত অংশের কাছে আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দেওয়া। সরকার যদি মনে করে থাকে যে আন্দোলনটাকে জাট ক্ষমতার প্রর্দশন হিসাবে তুলে ধরে তারা অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠীগুলোকে আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলতে পারবে, তবে আমাদের কাজ হল আন্দোলনের বৃহত্তর সামাজিক বিন্যাসকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা। ভারতে যাঁরাই কর্পোরেট আগ্ৰাসন ও ফ্যাসিবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করছেন, কৃষকদের বিজয় সেই সমস্ত ভারতীয়দেরই বিজয় বলে পরিগণিত হবে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১)   

Comrade Subimal Senguptacomrade Subimal Sengupta

২৭ ফেব্রুয়ারী কৃষ্ণনগর পৌরসভা হলে, দ্বিজেন্দ্র মঞ্চে, সিপিআই(এমএল) লিবারেশানের নদীয়া জেলা সম্পাদক প্রয়াত কমরেড সুবিমল সেনগুপ্তের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। শুরুতে সভা সঞ্চালক জীবন কবিরাজের পরিচালনায় হল ভর্তি উপস্থিত প্রায় সকলেই বিশেষ করে সুবিমলের স্ত্রী, বোন, ভাইঝি, ভাই কমরেড সুবিমলের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন এবং তারপর নীরবতা পালন করা হয়। তারপর বাবুনি মজুমদারের সংগীত পরিবেশন ও কমরেড সুবিমলের ‘জীবনগাথা’ লেখা পাঠ করে শোনানোর মধ্য দিয়ে বক্তব্য রাখা শুরু হয়।

প্রথম বক্তা সিপিআই(এম)-এর বর্ষীয়ান নেতা অশোক ব্যানার্জি গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা বামপন্থীদের যৌথ আন্দোলনে কমরেড সুবিমলের উল্লেখযোগ্য ভূমিকাকে তুলে ধরেন। আরএসপি নদীয়া জেলা সম্পাদক শংকর সরকার সুবিমল সেনগুপ্তের আকস্মিক মৃত্যুকে বামপন্থী আন্দোলনের বড় ক্ষতি হিসেবে তুলে ধরেন। এসইউসিআই(সি)-র অন্যতম নেতা জয়দীপ চৌধুরী সুবিমলের কম্যুনিস্ট গুণাবলির কথা বলেন। সিপিআই(এমএল) লিবারেশানের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কার্তিক পাল সুবিমলের মৃত্যুকে বড় আঘাত হিসেবে তুলে ধরেন, এই ক্ষতি পূরণ করবার জন্য সমস্ত কমরেডদের পার্টি কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণের আবেদন জানান। কমরেড সুবিমলের ভাই সুকমল সেনগুপ্ত (রানা) দাদার রাজনীতি ও তার ব্যাপক সামাজিক পরিচিতির উল্লেখ করে বক্তব্য রাখেন। নবদ্বীপের পার্টি কমরেড তপন ভট্টাচার্য তার লেখা কবিতা পাঠ করে শোনান। বক্তব্য রাখেন এপিডিআর-এর রাজ্য নেতা তাপস চক্রবর্তী, ধুবুলিয়ার সাংস্কৃতিক কর্মী সুজশ চক্রবর্তী। সুবিমলের প্রিয় বন্ধু শংকর দাস মজুমদার তাঁর এভাবে হারিয়ে যাওয়া ধুবুলিয়ার গণতান্ত্রিক মানুষের, সামাজিক মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন নেতা কাজল দত্তগুপ্ত, কৃষ্ণপদ প্রামানিক, বাসুদেব বসু, নবেন্দু দাশগুপ্ত, সুব্রত সেনগুপ্ত, সলিল দত্ত প্রমুখ নেতৃবৃন্দ কমরেড সুবিমল সেনগুপ্তের অসমাপ্ত কাজকে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক পরিধিতে সংগ্রামী গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে বিশেষ করে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান।

সবশেষে, পশ্চিমবঙ্গ গণসাংস্কৃতিক পরিষদের পক্ষ থেকে নীতীশ রায়, বাবুনি মজুমদার ও সুবিমলের বোন অনুসূয়া সেনগুপ্ত ইন্টারন্যাশনাল সংগীত পরিবেশন করার মধ্য দিয়ে স্মরণসভার পরিসমাপ্তি ঘোষণা হয়।

Citizen MarchCitizenship protection journey

নাগরিকপঞ্জি-বিরোধী যুক্তমঞ্চের উদ্যোগে গত ২৬ ফেব্রুয়ারী নদীয়া জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম বেতাই থেকে শুরু হয়েছিল ‘নাগরিকত্ব সুরক্ষা যাত্রা’। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে বেতাই আম্বেদকর কলেজে বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর ও শ্রীশ্রী হরিচাঁদ গুরুচাঁদের প্রতিকৃতিতে ফুলমালায় শ্রদ্ধা জানিয়ে এই প্রচার যাত্রা শুরু হয়। নদীয়া জেলার তেহট্ট, কৃষ্ণনগর, জালালখালি, বাদকুল্লা, বীরনগর, রানাঘাট, কুপার্স ক্যাম্প, ধানতলা, পানিখালি, ট্যাংরাখাল, ভায়না, বগুলা, দত্তফুলিয়া হয়ে এই যাত্রা উত্তর ২৪ পরগনায় ঢোকে ১ মার্চ। উত্তর ২৪ পরগণা জেলার সিন্দ্রানি, হেলেঞ্চা, বনগাঁ, গাইঘাটা, মছলন্দপুর, বাদুরিয়া হয়ে এই যাত্রা আজ ৩ মার্চ বারাসাত পৌঁছায়। পর দিন বাদু, হাতিয়ারা, বাগুইআটি ইত্যাদি অঞ্চলে প্রচার চালানো হয়।

এই যাত্রার মূল উদ্দেশ্য গত দুই বছরের এনআরসি-বিরোধী আন্দোলনের বার্তা আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু, বিশেষত মতুয়া, নমশূদ্রদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। যাত্রা পথে ছোট-বড় মিলিয়ে ২০টি পথসভা হয়েছে উদ্বাস্তু অধ্যুষিত অঞ্চলে, বিলি হয়েছে ২০ হাজারের বেশি তথ্যসমৃদ্ধ একটি লিফলেট। কেন্দ্রীয় সরকারের নাগরিকত্ব নিয়ে দ্বিচারিতা এবং বিভাজনের রাজনীতির বিরোধিতা করে সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছে আবেদন রাখা হয়েছে এনআরসি-এনপিআর, সিএএ-২০০৩ এবং সিএএ-২০১৯ বাতিল করার দাবি তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে অন্তর্ভুক্ত করার।

উদ্বাস্তু মানুষজন ব্যাপকভাবে এই প্রচারে সাড়া দিয়েছেন, যুক্তমঞ্চের দাবিগুলিকে সমর্থন জানিয়েছেন। এই যাত্রার সক্রিয় সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন মতুয়া সমাজের নেতৃত্বের একাংশও। কিছু জায়গাতে বিজেপি-র সদস্যসমর্থকরা যুক্তমঞ্চের প্রচারকদের সাথে রাস্তার মধ্যেই বচসায় জড়িয়ে পড়েন, যদিও কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আসলে এনআরসি-সিএএ-র সমর্থকরা মোদী সরকারের কার্যকলাপের পক্ষে কোন যুক্তিই আর দিতে পারছেনা। আসন্ন নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে। ৫ মার্চ নাগের বাজার থেকে দমদম পর্যন্ত এক পদযাত্রার মাধ্যমে এই নাগরিকত্ব সুরক্ষা যাত্রা সমাপ্ত হবে বলে জানিয়েছেন এনআরসি-বিরোধী যুক্ত মঞ্চের আহ্বায়কেরা।

Convention on the initiative of citizens

এই কনভেনশনটি অনুষ্ঠিত হয় ২৮ ফেব্রুয়ারী। কনভেনশনে বক্তব্য রাখেন অচ্যুত সেনগুপ্ত, সুভাষ মজুমদার, সাংবাদিক অমৃতলাল ঘোষ, স্বর্ণেন্দু মৈত্র। সঙ্গীত পরিবেশন করেন বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী। কনভেনশনের অতিথি বক্তা সুজাত ভদ্র তাঁর দীর্ঘ বক্তব্যে কনভেনশনে গৃহীত প্রস্তাবগুলির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে সমসাময়িক পরিস্থিতিকে জীবন্তভাবে উপস্থাপণ করেন।

কনভেনশন থেকে গৃহীত প্রস্তাব সমূহ
১) কেন্দ্রীয় সরকারের তিনটি কৃষি আইন বাতিল করতে হবে।
২) বিদ্যুৎ বিল ২০২০ বাতিল করতে হবে।
৩) সিএএ, এনআরসি, বাতিল করতে হবে।
৪) সরকারী সংস্থাবেচে দিয়ে কোম্পানিরাজ কায়েমের চক্রান্ত ব্যর্থ করুন।
৫) ডিজেল, পেট্রল, রান্নার গ্যাসের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি চলবে না। কেরোসিনকে রেশন ব্যবস্থা থেকে তুলে নেওয়ার চক্রান্ত চলবে না।
৬) বিধানসভা নির্বাচন যাতে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়, তারজন্য প্রশাসনকে দায়িত্ব নিতে হবে।
৭) বাংলার মনীষীদের রাজনীতির স্বার্থে আত্মসাৎ করে, তাঁদের অপমান করে, বাংলার সংস্কৃতির ধর্মনিরপেক্ষতাকে চুরমার করে ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত ব্যর্থ করুন।
৮) দলত্যাগ করলে জনপ্রতিনিধিকে পদত্যাগ করতে হবে।
৯) জনগণের জীবন, জীবিকা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গণতন্ত্রের দাবিগুলিকে নির্বাচনের আলোচ্য বিষয় করে তুলুন।
১০) ভারতের সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হোন।

Hinduism TulkitWhy no action is being taken against Hindutva-authoritarian toolkit

বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর টেলিগ্ৰাম সামাজিক মাধ্যমে “হিন্দু ইকোসিস্টেম” গোষ্ঠী তৈরি করেন। প্রসঙ্গত, কপিল মিশ্র হলেন সেই কুখ্যাত নেতা যিনি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তাঁর ঘৃণাবর্ষী ভাষণ দিয়ে দিল্লীতে সাম্প্রদায়িক হিংসা উস্কিয়ে তুলেছিলেন, যে ভাষণের মধ্যে “বিশ্বাসঘাতকদের গুলি করে মারো”র আহ্বানও ছিল (“বিশ্বাসঘাতক” আসলে ছিল মুসলিম ও সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদকারীদের বোঝানোর সাংকেতিক শব্দ)। কপিল মিশ্রর “হিন্দু ইকোসিস্টেম” গোষ্ঠী নিয়ে নিউজলন্ড্রি পোর্টাল একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদন তৈরি করে। দু-জন সাংবাদিক ঐ গোষ্ঠীর মধ্যে ঢুকে পড়েন এবং কিভাবে তারা কাজ চালায় তা নিয়ে তদন্ত করেন। ঐ গোষ্ঠী যে মুসলিম, খ্রিস্টান ও শিখ সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিংসা উস্কিয়ে তোলার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে বিষয়বস্তু তৈরি করে প্রচার করে সে সম্পর্কে ঐ দুই সাংবাদিক প্রমাণ জোগাড় করেন। তাঁরা জানতে পারেন, ঐ হিংসা টুলকিটের মধ্যে দিয়ে তীব্রতর করে তোলা হয়, যে টুলকিট বিদ্বেষ ছড়ানোর হ্যাশট্যাগের মধ্যে দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টুইটারে ঝড় তোলে, এবং মানুষের মনকে বিষিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে ভুয়ো ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব ছড়ায়। কপিল মিশ্র টুইটারে তাঁর ঘৃণা ছড়ানোর ইকোসিস্টেমের জন্য খোলাখুলিভাবেই সদস্য নিয়োগ করতে থাকেন। টুইটারে ওঠানো ঘৃণাবর্ষী ঝড়গুলো খোলাখুলিভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, এবং ঘনঘন সেগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা যায়। গ্ৰেটা থুনবার্গ কৃষক প্রতিবাদের প্রবক্তা একটা টুলকিট ব্যবহার করে টুইট করলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহর নিয়ন্ত্রণাধীন দিল্লী পুলিশ তার ভিত্তিতে অবলীলায় এফ আই আর করে, কিন্তু ঐ বিদ্বেষমূলক, হিংসা ছড়ানোর ও বিপজ্জনক ইকোসিস্টেমের বিরুদ্ধে তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি কেন?

নিউজলন্ড্রির রিপোর্টে বলা হয়েছে, “ভারতের বিরুদ্ধে “আন্তর্জাতিক চক্রান্ত” বলে গ্ৰেটা থুনবার্গ-এর টুলকিটকে যে ধিক্কার জানানো হচ্ছে তার পিছনে একটা মূল কারণ হল, কৃষক প্রতিবাদের দিকে মনোযোগ দেওয়ার জন্য কবে অনলাইন ও কবে অফলাইন কার্যকলাপ চালাতে হবে সে সব দিনের উল্লেখ তাতে ছিল। হিন্দুত্ববাদী ইকোসিস্টেমও একই কাজ করে থাকে, তবে, একটা ন্যায়সঙ্গত বিষয়ে সমর্থন জানাতে গ্ৰেটা একটা মাত্র নথি শেয়ার করলেও কপিল মিশ্রর গোষ্ঠী বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণাকে তীব্রতর করে তুলতে প্রতিদিন বহুসংখ্যক নথিকেই শেয়ার করে থাকে। ...

“হিন্দুত্ববাদী ইকোসিস্টেম-এর মতো গোষ্ঠীর মাধ্যমে যে কাজটা করা হচ্ছে তার তাৎপর্য আপনি যদি অনুধাবন করতে না পারেন তবে আমাদের সেটা স্পষ্ট ভাষায় বলতে দিন : ওরা ভুয়ো তথ্য, সম্প্রচার, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে চালানো ঘৃণার উৎস। ওরা সুসংগঠিতভাবে হিন্দু কর্তৃত্ববাদী ও সংখ্যালঘু-বিরোধী বিষয়বস্তু তৈরি করে সেগুলোকে প্রচার করে, এবং সাম্প্রদায়িক ঘৃণা উস্কিয়ে তোলে।

“সাম্প্রদায়িক ঘৃণা উস্কিয়ে তোলার জন্য ২০০০০ লোক পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয়সাধন করে কাজ করে চলেছে; ওদের রেডারে যা কিছুই ধরা দেয় সে সবকেই ওরা ঘৃণায় রঞ্জিত করে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব বানায়, ঘৃণার নেটওয়ার্কে ঈপ্সিত ফল আনার জন্য সেটাকে তাৎক্ষণিকভাবে শেয়ার করতে ছবি, ভিডিও ও ফরোয়ার্ড-এর জোগান মজুত থাকে।”

সংঘের সংগঠনগুলো অনলাইনে যে হাজার হাজার কারখানা খুলে ঘৃণা ছড়ানোর কারবার চালায়, কপিল মিশ্রর কারখানা তার মধ্যে একটা মাত্র। দিল্লীতে ২০২০র ফেব্রুয়ারী মাসে যে মুসলিম-বিরোধী হিংসা চালানো হয়, তার সাথে অনলাইনে প্রচারিত ঘৃণার সরাসরি সংযোগের ভূমিকাকে উন্মোচিত করে আর্টিক্যাল-১৪ পোর্টাল একটা তদন্তমূলক রিপোর্ট তৈরি করে। শ্বেতা দেশাইয়ের তৈরি করা “রাগিণী তেওয়ারি ও বন্ধুদের ঘৃণা সঞ্চারী এডভেঞ্চার” শীর্ষক রিপোর্টে বলা হয়, “দিল্লী পুলিশ দাবি করে থাকে যে, ভারতের শাসক দলের সঙ্গে সংযোগ থাকা হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো ফেব্রুয়ারীর “দাঙ্গা” ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল বলে কোনো প্রমাণ তারা পায়নি। আমাদের তদন্তে কিন্তু যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ উঠে এসেছে, যাতে দেখা যাচ্ছে দাঙ্গা সংঘটনের ঠিক আগের দিনগুলোতে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো ফেসবুকে উস্কানিমূলক উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নিয়েছিল। ফেসবুক ইণ্ডিয়া তাদের নিজেদেরই নীতিমালা প্রয়োগ করতে অনীহা দেখানোয় প্ররোচনা দায়ী বার্তা ও ভিডিওগুলো লাগাতার দেখা দিতে থাকে।” ঐ প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখিত হয়েছে রাগিণী তেওয়ারির তোলা ভিডিওগুলোর কথা, যিনি দিল্লীর জাফরাবাদ ও মৌজপুর এলাকায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী হিংসা উস্কিয়ে তোলার আস্ফালন করেছেন। দাঙ্গাবাজ ভিড়কে চালিত করার যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকলেও দিল্লী পুলিশ রাগিণী তেওয়ারির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। অন্য দিকে তারা সিএএ-বিরোধী আন্দোলনকারী ও নারীবাদী আন্দোলনের কর্মীদের এই অভিযোগের ভিত্তিতে ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত করেছে যে, তাদের হোয়াটসঅ্যাপ গোষ্ঠী নারী নেতৃত্বে চালিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিবাদে যে সমর্থন জানিয়েছে তা ভারত-বিরোধী ষড়যন্ত্রেরই শামিল।

একইভাবে পুরো এক বছর পর দেখা যাচ্ছে, এবিভিপি-র হাঙ্গামাকারী এক ভিড় জেএনইউ-র ছাত্র ও শিক্ষকদের ওপর যে সহিংস হানাদারি চালায়, সেই ঘটনায় দিল্লী পুলিশ এক জনকেও গ্ৰেপ্তার করতে পারেনি। তাদের হামলাবাজি শেষ হওয়ার পর দিল্লী পুলিশ নিরাপদে তাদের জেএনইউ থেকে বার করে নিয়ে যায়, এবং পুলিশ তাদের কাউকেই থামানো বা গ্ৰেপ্তারের চেষ্টা করে না। জেএনইউ-র ছাত্ররা এবং তদন্তকারী সাংবাদিকরা হোস্টেলের ভিতর হাঙ্গামা চালানোর জন্য এবিভিপি নেতা কোমোল শর্মার পরিচিতি ফাঁস করে দিলেও দিল্লী পুলিশ কিছু না জানার ভান করে থাকে।

Environment WorkersAre the activists of the environmental movement being accused

মোদীর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলোই শুধু যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রতিবাদের অধিকারের ওপর আক্রমণ হানছে তাই নয়। যে সমস্ত সাংবাদিক মোদীর দোস্ত আদানির দুর্নীতি জড়ানো ও ফন্দিবাজির বহুবিধ কারবার নিয়ে লেখালেখি করেন, আদানি তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মানহানির মামলা দায়ের করতে থাকেন।

তবে, ২০২১-এর জানুয়ারীর শেষ দিকে আদানি গোষ্ঠী একটা খোলা চিঠি দেয় যাতে তারা একটা ভুল করে বসে, আর সেই ভুলটা হল অরওয়েলিয় ভাষা বৈশিষ্ট্যের উপর ভর করে “মত প্রকাশের স্বাধীনতা” বলতে কি বোঝায় তার ব্যাখ্যা হাজির করা। ঐ চিঠির শিরোনাম ছিল “মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষ্যে খোলা চিঠি”। চিঠিটা আদানির টুইটার হ্যাণ্ডল থেকে টুইট করা হয়।

চিঠিটা শুরু হচ্ছে এই কথাগুলো দিয়ে — ”প্রিয় সহ নাগরিকবৃন্দ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা যে কোন সন্তোষজনকভাবে ক্রিয়াশীল গণতন্ত্রের বুনিয়াদি অধিকার।” এ পর্যন্ত যা বলা হল তাতে আপত্তির কোন কারণ থাকতে পারে না। পরের বাক্যটি সম্ভবত কোনো ব্যাঙ্গ গদ্যকারকে দিয়ে লেখানো হয়েছে, কেননা তার মধ্যে দিয়ে আদানি গোষ্ঠীর নির্মম কর্তৃত্বপরায়ণতার চরম প্রকাশ ঘটতেই দেখা যাচ্ছে। বাক্যটাতে বলা হয়েছে, “ আদানি গোষ্ঠী মত প্রকাশের সেই স্বাধীনতাতেই বিশ্বাস করে যা সত্যকে তুলে ধরে এবং জাতীয় স্বার্থের সিদ্ধি করে।”

পরের অনুচ্ছেদটিতে ব্যাখ্যা করে যা বলা হয়েছে তা হল, বুনিয়াদি অর্থে, “জাতীয় স্বার্থ” আদানি গোষ্ঠীর স্বার্থেরই সমার্থক। মোটামুটি ভাবে, ভারত হল আদানি, আর আদানি হল ভারত। চিঠিতে বলা হচ্ছে, আদানি গোষ্ঠী এমন “গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ পরিচালনা করে যা আমাদের দেশের প্রগতির পক্ষে অপরিহার্য।” চিঠি এরপর জানাচ্ছে, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক যে সমস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান “আদানি গোষ্ঠীর প্রতি বিশ্বাস রেখে এই গোষ্ঠীতে বিনিয়োগ করেছে”, তার মধ্যে দিয়ে তারা “ভারতের প্রতি বিশ্বাস প্রদর্শনের” সাক্ষরই রেখেছে।

চিঠির পরবর্তী অংশের উপ-শিরোনাম দেওয়া হয়েছে “মিথ্যাচার বিপুল ক্ষতি করে”, এবং বিশদে বর্ণনা করা হয়েছে মিথ্যা সংবাদ কিভাবে অনিষ্ট করে এবং আদানি গোষ্ঠী কিভাবে “মিথ্যা প্রচার” এবং “অনলাইনে চালানো কল্পিত প্রচারাভিযানের” এক “বলি” হয়েছে। প্রত্যাশিত ভাবেই চিঠিতে এরপর বলা হচ্ছে, আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যারা প্রচার চালাচ্ছে তারা ভারতের শত্রু। চিঠি দাবি করছে, আদানিদের ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে অনলাইনে চালানো প্রচারগুলো চালাচ্ছে “কায়েমি স্বার্থের লোকজন যাদের লক্ষ্য হল ভারতের রণনৈতিক স্বার্থে অন্তর্ঘাত চালানো।” এর মধ্যে দিয়ে কি কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে? এটা কি দিশা রবি এবং পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠন ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার-এর কর্মীদের বিরুদ্ধে এফআইআর-কে মনে পড়িয়ে দিচ্ছে?

আদানিদের চিঠিতে এরপর বলা হয়েছে, তারা মিডিয়ার লোকজনদের যথেষ্ট সম্মান করে, তবে, তারা আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয় যদি “মত প্রকাশের স্বাধীনতার অছিলায় আমরা আমাদের রাজনৈতিক স্বার্থের অনিষ্ট হতে দেখি।”

শুধু সাংবাদিকদের মুখ বন্ধের জন্যই আদানি গোষ্ঠী মানহানির মামলা করে না -- তাদের চিঠি মোদী সরকারের মানসিকতাকেও উন্মোচিত করছে। মোদী সরকার কেন কৃষি আইনগুলোকে বাতিল করার পথে যাচ্ছে না, বিপরীতে কৃষক আন্দোলনের কর্মী এবং পরিবেশ আন্দোলনের সমর্থকদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ আইন ও ইউএপিএ আইনের অধীনে অভিযোগ দায়ের করছে, তার কারণ হল -- আন্দোলনের এই কর্মীরা যা উন্মোচিত করে দিচ্ছেন তা হল, কৃষি আইনগুলো কিভাবে আদানি গোষ্ঠী ও তাদের মতো লোকজনদের স্বার্থ সিদ্ধি করছে; এবং আদানিদের যে সমস্ত প্রকল্প ভারতে এবং অন্যান্য দেশে বনভূমি ও পরিবেশের ক্ষতিসাধন করছে তার বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রচার গড়ে তুলছেন।

দেখা যাচ্ছে যে, মোদী সরকারের অধীনে গোটা ব্যবস্থাটাই স্যাঙাতি কর্পোরেটদের লুন্ঠন এবং সংখ্যালঘু-বিরোধী ঘৃণা, বৈষম্য ও হিংসাকে উৎসাহিত করে তোলে এবং এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ ব্যক্ত করলে বা প্রতিরোধ গড়ে তুললে তাতে ফৌজদারি অপরাধের রং দেওয়া হয়। আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই গড়ে তুলে মোদী জমানার এই কর্পোরেটপন্থী, আদানি-আম্বানী পন্থী, ঘৃণার মদতকারী টুলকিটের স্বরূপ উন্মোচন করে দিতে হবে।

(লিবারেশন মার্চ ২০২১) 

Naudeep KaurWithdraw the case from Nadip

ফেব্রুয়ারী ২৬-এ দিল্লীর শ্রমিক নেতা নদীপ কৌর হরিয়ানা এবং পাঞ্জাব হাই কোর্টের আদেশে জামিনে মুক্ত হলেন। তাঁর কমরেড শিবকুমার এখনও জেলে।

দিল্লীর কুন্ডলী শিল্পাঞ্চলে মজদুর অধিকার সংগঠনের সদস্য নদীপ কৌর এবং সেই সংগঠনের সভাপতি শিব কুমার। দুজনেই কারখানার শ্রমিক। তাঁরা কুন্ডলী শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অধিকারের দাবিতে লাগাতার লড়াই করেন এবং শ্রমিকদের ন্যায্য বেতনের জন্য ও বেতনের চুরির বিরুদ্ধে ফ্যাক্ট্রি মালিকদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংগঠিত করেন। নদীপ কৌর এবং কুন্ডলীর শ্রমিকরা ধর্ণায় বসেছিলিন তাঁদের চলতি কাজের বেতনের দাবিতে এবং লকডাউনের সময়ের পাওনা বেতনের দাবিতে। লকডাউনের সময় সরকার বেতন দেওয়া জারি রাখতে বললেও পুরো ভারতে যে বিপুল পরিমাণে বেতন চুরি হয়েছে এবং ছাটাই হয়েছে তা সবার কাছে পরিষ্কার। লকডাউনের সময় এই বিপুল বেতন চুরি আমাদের ভারতে ধনী-গরিবের ভেতর ব্যবধান আলাদা স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। এই সময় তাঁরা শ্রমিকদের মধ্যে কৃষকদের সমর্থনে প্রচার শুরু করেন।

১৪ জানুয়ারী কুন্ডলী পুলিশ শ্রমিকদের আক্রমণ করে। উত্তেজনা ছড়ালে নদীপ কৌরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার করার সময় তাকে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হতে হয়। পুলিশ মজদুর অধিকার সংগঠনের লোকদের খুঁজতে থাকে। জানুয়ারী ১৬-তে শিবকুমারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার পরিবারকে জানানো হয় জানুয়ারী ৩১-এ। শিবকুমারের চোখে সমস্যা থাকায় তাকে নিয়মিত দিল্লী এইমসে চিকিৎসার জন্যে যেতে হয়। জেলে বন্দীর পর তার চোখের চিকিৎসাও ব্যহত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবী মীনা হ্যারিস ফেব্রুয়ারী ৬-এ নদীপ কৌরের গ্রেপ্তারি নিয়ে টুইট করেন এবং তার বিরুদ্ধে পুলিশি নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন। নদীপ কৌরের গ্রেপ্তারি জাতীয় রাজনীতিতে ইস্যু হয়ে যায়। কৃষক একতা মোর্চা কৃষক আন্দোলনের সঞ্চালক কমিটি নদীপ কৌরের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল।

নদীপ কৌর ছাড়া পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে পুলিশের দ্বারা হওয়া জাতিবাদী অপমানের কথাও জানান। তাঁকে পুলিশ তাঁর জাতি নিয়ে কটূক্তি ক’রে বলে যে সে এখানে কেন শ্রমিকদের হয়ে আওয়াজ তুলছে, তার কাজ তো ড্রেন পরিষ্কার করা! তাকে গ্রেপ্তারির সময় কিভাবে মারা হয় সেই ব্যাপারও জানান নদীপ। তিনি জানান যে তাদের সংগঠন কয়েক মাস ধরে বেতনের দাবিতে প্রচার এবং প্রতিবাদ চালাচ্ছে। কিন্তু আক্রমণ শুরু হয় কৃষকদের সমর্থনে প্রচার শুরু করার পর। সে প্রশ্ন তোলে যে দেশে কি তাহলে প্যামফ্লেট বিলি করার স্বাধীনতাটুকুও নেই? তিনি জানান যে তাদের হাতে শুধু পতাকা ছিল আর কিছুই নয়। এটাই এখন নিয়ম যে যারাই সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে তারাই দেশদ্রোহী হয়ে যাবে এবং মিথ্যে মামলায় তাকে জেলে পোড়া হবে। কৃষি আইন এবং শ্রমিক আইনে সংশোধনের বিরুদ্ধে সারা দেশ জুড়ে প্রতিবাদ হওয়া উচিৎ বলে তিনি জানান।

তিনি বলেন যে জামিন মানেই লড়াই জিতে যাওয়া নয়। তার বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার মামলা এবং তোলাবাজির মামলা এখোনো চলছে। এখোনো শ্রমিকরা খালি পেটে ঘুমোতে যাচ্ছে সারা দেশে। শিবকুমারের বাবা রাজবীর জানান যে তার ছেলেকেও জেলে মারধোর করা হচ্ছে।

- প্রত্যুষ নন্দী 

Fermer in Delhi BorderBlocked Delhi

অবরুদ্ধ রাজধানী দিল্লি। উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানা সীমানা থেকে লক্ষাধিক কৃষক ৪০ দিনেরও বেশি সময় ধরে হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় বসে আছেন। এঁদের অনেকেই বৃদ্ধ, হিমালয়ের বরফ বাতাস বয়ে আনা উত্তর ভারতের মারাত্মক শীতে ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন দেড়শোরও বেশি কৃষক। কিন্তু দীর্ঘ এই সত্যাগ্রহ আন্দোলনে হিংসার ছোঁয়া ছিল না। গত ২৬ জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লির রাস্তায় ট্রাক্টর মিছিলের সময় হিংসার যে ছবি ধরা পড়েছে, তাতে অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলনকারী কৃষকদের ভূমিকা কতখানি ছিল না নিয়ে সংশয় ধরা পড়েছে দেশে বিদেশের সর্বত্র।

এক বছর আগে এই দিল্লিরই শাহিনবাগে এভাবেই কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করে মাসের পর মাস সত্যাগ্রহে বসেছিলেন একদল মুসলিম বৃদ্ধা ও মহিলা। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের আনা নাগরিকত্ব আইন, সিএএ এবং এনআরসি প্রত্যাহারের দাবিতে শাহিনবাগের সেই আন্দোলনেও হিংসার হুল ফোটাতে কসুর করেনি সরকার পক্ষ। প্রকাশ্য রাস্তায় শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের দিকে লক্ষ করে এক যুবককে গুলি চালাতে দেখেও না দেখার ভান করে দাঁড়িয়েছিল বিশাল পুলিশবাহিনী। সরকার ও পুলিশের প্রবল চাপ, ভয় দেখানো উপেক্ষা করেও নীরব সত্যাগ্রহ আন্দোলন থেকে সরে আসেননি শাহিনবাগের দাদিরা। ভারতের মাটিতে তাঁদের দিকে কুৎসার ঢেউ ধেয়ে এলেও তাঁদের সম্মান জানিয়েছে আমেরিকার বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন।

আরও একশো বছর আগে, ব্রিটিশ সরকারের কুখ্যাত রাওলাট আইন প্রত্যাহারের দাবিতে দেশজোড়া অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত এক গুজরাতি ব্যারিস্টার। সেই আন্দোলনের জেরেই প্রথমবার আমাদের সামনে এল ‘সত্যাগ্রহ’ শব্দটি। ব্রিটিশ পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, তাদের লাঠি গুলির সামনে অবিচল থেকে অহিংসাকে আন্দোলনের সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র করে তুলেছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। কিন্তু একশো বছর আগের এক ৪ ফেব্রুয়ারী বিহারের গোরখপুরের কাছে চৌরিচৌরা থানার পুলিশের আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালনার পাল্টা জবাব দিতে হিংসাত্মক হয়ে ওঠে আন্দোলন। এতদিন ধরে অহিংস আন্দোলনে পুলিশের অত্যাচার সয়ে থাকা জনতার ক্রোধের আগুনে পুড়ে যায় চৌরিচৌরার থানা, মৃত্যু হয় ২২ জন পুলিশকর্মীর। ভয়ঙ্কর এই ঘটনার অভিঘাতে থমকে যায় গোটা অসহযোগ আন্দোলন। ভগ্নহৃদয়ে দিন কয়েক পরে গোটা দেশ থেকে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন খোদ মহাত্মা গান্ধী।

চৌরিচৌরার ঘটনার শতবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টেনে এনেছেন কৃষক আন্দোলনের প্রসঙ্গ। কিন্তু শাহিনবাগ ও চলতে থাকা কৃষক আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছে ৫৬ ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে পৌরুষের দর্প করে বেড়ানো সরকারের হাঁটু কেঁপে যেতে পারে নিরস্ত্র মানুষের নীরব অবস্থানে। গত বছর দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক অশান্তিতে বহু মানুষের মৃত্যুর পর শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের এককথায় উৎখাত করে দিয়েছিল পুলিশ। নতুন করে শাহিনবাগে আর কেউ ধরনায় বসেননি। কিন্তু সরকারের অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী এনআরসি প্রক্রিয়া থমকে গিয়েছে। শাহিনবাগের ফুলকি থেকে দেশজোড়া বারুদে অগ্ন্যুৎপাতের চেহারা দেখে বাহুবলী প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টা নিয়ে আর এগনোর ভরসা পাননি। আপাতত ঠান্ডাঘরে ঠাঁই হয়েছে এনপিআর-এক কাজের। কৃষক আন্দোলনকে কোনও ভাবেই দমাতে না পেরে মরিয়া সরকার এখন কৃষকদের কাছে অনুরোধ করেছে আন্দোলন তুলে নিতে, তার পরিবর্তে দেড় বছরের জন্য কৃষি আইন স্থগিত করতেও রাজি তারা। কিন্তু তাতেও সায় দেয়নি অনড় কৃষক নেতারা। আইন বাতিলের দাবি থেকে একচুলও সরতে নারাজ তাঁরা।

কথায় কথায় বীরত্বের বাহাদুরি দেখানো, পৌরুষের পেশি ফুলিয়ে গলার স্বর সপ্তগ্রামে তুলে দেশভক্তির গান গাওয়া নরেন্দ্র মোদী অমিত শাহের পক্ষে প্রকাশ্যে নমনীয়তা দেখানো কঠিন। তাঁদের এতদিনের সযত্নলালিত সর্বশক্তিমান ভাবমূর্তি বড় ধাক্কা খাবে তাতে। কিন্তু মনে মনে তাঁরা যে আশঙ্কার সিঁদুরে মেঘ দেখছেন তা বুঝতে গণৎকার হওয়ার প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর ইতিহাস বারেবারে প্রমাণ রেখেছে ভুখা, সর্বহারা জনতা যখন পথে নামে তখন শাসকের ভিত টলে যায়। মুসোলিনির ইতালি, চেসেস্কুর রোমানিয়া, এবং গত এক দশকে আরব দুনিয়ার একাধিক স্বৈরশাসকের পতন তার উজ্জ্বল উদাহরণ। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় ঈশ্বরের প্রতিভূ রোমানভ রাজবংশ ছারখার হয়ে গিয়েছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিপীড়িত, নীরবে মার খেয়ে যাওয়া রুশ জনতার ক্ষোভের আগুনে।

গত ছ’বছর ধরে ভারতের রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। ভারতবর্ষের যে বৈচিত্রের ইতিহাস হাজার বছর ধরে আমাদের সভ্যতাকে ব্যতিক্রমী করে রেখেছে, সেই বৈচিত্রকে মুছে দিয়ে, সংখ্যাগুরুর ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস, ভাষাকে বাকি দেশের উপর চাপিয়ে দেওয়ার নির্লজ্জ চেষ্টা হয়ে চলেছে। ভারতবর্ষের ধর্মনিরপেক্ষতার মজবুত তন্তুকে ছিঁড়ে এক ধার্মিক, একদলীয় শাসনের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেশকে। রাজ্যগুলির হাত থেকে সার্বভৌম ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ঠুঁটো করে ফেলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠোমাকেই। সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্তের যুগে মিথ্যা প্রচারের বেসাতিতে আসল ঘটনার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখা অনেকটাই সহজ। কিন্তু তা সত্ত্বেও শাহিনবাগের সময় এবং বর্তমান কৃষক আন্দোলনও আন্তর্জাতিক মহলের নজর টেনেছে। তার অন্যতম কারণ এত দীর্ঘদিন ধরে এত বিরাট আকারের অহিংস সত্যাগ্রহের মনস্তাত্ত্বিক কাঠিন্য।

আমাদের শাসকের বিড়ম্বনা বাড়িয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক পপ স্টার রিহানা ও কিশোরী পরিবেশ আন্দোলনকারী গ্রেটা থুনবার্গের আপাত নিরীহ দু’টি টুইট। ক্যারিবিয়ান দ্বীপের রিহানার টুইটারে ফলোয়ার ১০ কোটি মানুষ। তিনি যদি কোনও একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান তবে তা মুহূর্তের মধ্যে এই গ্রহের কোণায় কোণায় পৌঁছে যেতে পারে। রিহানার এই আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তায় ভর করে আমাদের দেশের কৃষক আন্দোলন গত কয়েক দিনে এমন বহু জায়গায় আলোচিত হচ্ছে, যা গত তিন মাসেও হয়নি। বিজেপি সরকারের হাড়ে কাঁপুনি ধরার জন্য রিহানাই যথেষ্ট ছিলেন। কিন্তু তাদের বিড়ম্বনা চতুর্গুণ হয়ে গেছে গ্রেটা থুনবার্গের আগমনে। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত গ্রেটা সারা বিশ্বে গত কয়েক বছর ধরে আলোচিত নাম। দিল্লি পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করার পরেও অবিচল গ্রেটা শাসকের চোখে চোখ রেখে হিমশীতল গলায় বলে চলেছেন, এখনও তিনি কৃষকদেরই পাশে।

রিহানা ও গ্রেটার এই টুইটের পরেই রে রে করে আমাদের দেশের সরকার পোষিত সেলিব্রিটি মহল নেমে পড়েছে তাঁদের নস্যাৎ করে দিতে। ১৩০ কোটির দেশে ক্রিকেট, টেনিস ও সর্বোপরি বিনোদন জগতে সেলিব্রিটির অভাব নেই। পর্দায় কৃষক সেজে হাততালি কুড়নো অভিনেতার দল কৃষক আন্দোলনের সময় ভুলেও রা কাড়েননি। বরং প্রধানমন্ত্রীর গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে সেলফি তুলতে তাঁরা অনেক বেশি ব্যস্ত। তাঁদের জিম, মেকআাপ রুম, ভ্যানিটি ভ্যান, সমুদ্রের ধারে কোটিক টাকার বহুতলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘণ্টা বাজানো, বিদেশে ছুটি কাটানো জীবনে কোথাও ছন্দপতন ঘটায় না শীতের রাতে খোলা আকাশের নীচে মাসের পর মাস কাটানো অন্নদাতাদের যন্ত্রণা। কিন্তু শাসকের অঙ্গুলিহেলনে দম দেওয়া পুতুলের মতো পিল পিল করে তাঁর রিহানাদের মন্তব্য খণ্ডন করতে মাঠে নেমে পড়েছেন। সেই তালিকায় নবতিপর সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর আছেন, আছেন ১৩০ কোটি মানুষের দেশের জীবন্ত ঈশ্বর সচিন তেন্ডুলকর এবং এই বিজেপি সরকারের স্বঘোষিত মুখপাত্র কঙ্গনা রানাওয়াত বা অক্ষয় কুমার।

সেলিব্রিটিদের পুজো করতে অভ্যস্ত এই দেশে এবারে সেলিব্রিটিদের হিসেবে একটু গোলমাল হয়ে গেছে। তাঁদের এক সুরে, এক ভাষায় টুইট করতে দেখে দেশ জুড়ে ধিক্কার, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ধেয়ে এসেছে উল্কার বেগে। ব্যাপার দেখে আর বেশি রা কাড়তে সাহস পাননি দম দেওয়া সেলিব্রিটির দল। কিন্তু এই বিনোদন জগতের রথী মহারথীরা গত কয়েক বছর ধরে কীসের বার্তা দিচ্ছেন দেশের জনতাকে। অক্ষয় কুমারের প্রায় প্রতিটি ছবিতে তিনি প্রবল পৌরুষের প্রতীক, পর্দায় তিনি আসা মাত্র রক্তের গঙ্গা বয়ে যায়, লাশের স্তূপ জমে ওঠে। অধিকাংশ সময়েই তিনি পুলিশ বা সেনা অফিসারের ভূমিকায়। রাষ্ট্রশক্তির ক্ষমতার এক একটি স্তম্ভ হয়ে একাই তিনি দেশকে রক্ষা করেন। এবং প্রত্যাশিতভাবেই অধিকাংশ সময় তাঁর অস্ত্রের নিশানা মুসলিম জঙ্গি বা অন্য কোনও অপরাধী। অজয় দেবগণও কতকটা একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন পর্দায় গত কেয়ক দশক ধরেই। কঙ্গনার মুখের লাগাম নেই, পর্দায় তাঁর জনপ্রিয়তাতেও। কিন্তু শেষ কয়েকটি ছবিতে তিনিও এসেছেন হিংসার প্রতিভূ হয়েই। ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইয়ের ভূমিকায় তিনি মুসলিম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে পর্দায় রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। সেই ইমেজ থেকে বাস্তবেও বোধকরি বেরিয়ে আসতে পারছেন না তিনি। সামান্যতম প্রতিবাদ দেখলেই, বিন্দুমাত্র বিরুদ্ধস্বর দেখলেই মুন্ডু ভেঙে দেওয়ার নিদান দিচ্ছেন তিনি। ভারতীয় ক্রিকেট বিরাট কোহলির নেতৃত্বে এক নতুন রূপে জন্ম নিয়েছে। এই ভারতীয় ক্রিকেট দল আদ্যন্ত পেশাদার, অত্যন্ত স্বাস্থ্যসচেতন এবং তীব্র পৌরুষের প্রতীক। জাতীয় দলের প্রতিটি সদস্যের মুখে চাপদাড়ি, চোখেমুখে প্রতিপক্ষকে পিষে ফেলার উগ্রতা, মুখে শাণিত গালাগালি। সাফল্যকে নম্রভাবে গ্রহণ করা তাদের ধাতে নেই। তাদের উগ্র আস্ফালনই নাকি তাদের সাফল্যের চাবিকাঠি।

হবেও বা। কিন্তু এই যে তীব্র আস্ফালন, প্রবল পৌরুষ, বিপক্ষকে ছুড়ে, পিষে ফেলার উগ্র আস্ফালনকারী সেলিব্রিটি মহল, তাঁদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কারা? হিমাঙ্কের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া তাপমাত্রায়, খোলা আকাশের নীচে খড় বিছিয়ে রুটি-আচার খাওয়া কৃষক সমাজ। যেখানে সন্ধের পর কোথাও বাজে কাওয়ালি, কোথাও গুরবানির সুরে লঙ্গরে তৈরি হয় গরম গরম রুটি। সেখানে শিখ বৃদ্ধের ক্লান্ত পা ধুইয়ে দেন বহু দূরের গ্রাম থেকে আসা মুসলমান যুবক, শিখ প্রৌঢ়ার পাশে বসে রুটি সেঁকেন উত্তরপ্রদেশের দেহাতি বধূ। এই ভারতবর্ষের মিলনমন্দিরে হিংসার ছায়া কোনও দিনই পড়েনি। এই দেশ বহু শাসকের আগ্রাসন দেখেছে অনেক শতাব্দী ধরে, কিন্তু কালের গহ্বরে তারা সকলেই হারিয়ে গেছে। রয়ে গেছে তাদের ফেলে যাওয়া সৌধের কঙ্কাল। জাতি, ধর্ম, ভাষা, নির্বিশেষে ভারতবর্ষের মূল আত্মা কোনও দিন স্পর্শ করতে পারেনি কোনও স্বৈরাচারীর কলুষিত হাত। আজও পারবে না। ভাড়াটে বাহিনী নামিয়ে, চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে দিয়েও তাই ৫৬ ইঞ্চি ছাতির সর্বশক্তিমান শাসক আজ আড়ালে ঠকঠক করে কাঁপছে। কারণ তাদের হিংসার সামনে সবচেয়ে বড় প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছে কাঁটা বিছানো পথের ওপারে নীরবে বসে থাকা বিপুল জনতরঙ্গের অহিংসা।

- শর্মিষ্ঠা রায়   

Food Securityreduce foodgrain subsidies

গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে বন্টিত খাদ্যশস্যের উপরে ভর্তুকির পরিমাণকে ২০% কমানোর লক্ষ্যে নিতি আয়োগ একটি আলোচনাপত্র প্রকাশ করেছে। সাম্প্রতিক বাজেটে (২০২১- ২) খাদ্যে ভর্তুকির পরিমাণ নির্ধারিত হয়েছে ২.৪৩ লক্ষ কোটি টাকা। যদি নিতি আয়োগের মতকে গ্রহণ করা হয় তাহলে ওই ভর্তুকি বার্ষিক ৪৭২৩২ কোটি টাকা পর্যন্ত কমবে বলে নিতি আয়োগের অনুমান। নীতি আয়োগের প্রস্তাবে খাদ্য সুরক্ষা আইনে (এনএফএসএ) পরিবর্তন ঘটিয়ে গণবণ্টনের মাধ্যমে খাদ্যশস্য পাওয়ার জন্য যোগ্য নাগরিকদের সংখ্যা কমানোর সপক্ষে মতো দিয়েছে। এনএফএসএর বর্তমান রূপে ভারতের গ্রামীণ জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ ও শহুরে জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া মূল্যে খাদ্যশস্য পাওয়ার যোগ্য। ওই ৭৫ শতাংশ-৫০ শতাংশ সূত্র মেনে গণবণ্টনে মূলত দুধরনের সুবিধে প্রদান করা হয়; দেশের দরিদ্রতম নাগরিকদের অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনার মাধ্যমে মাসে পরিবারপিছু ৩৫ কিগ্রা করে খাদ্যশস্য দেওয়া হয়-যার আওতায় রয়েছে ৯.০১ কোটি মানুষ (১ ফেব্রুয়ারীতে), আর অগ্রাধিকার প্রাপ্ত পরিবারের ৭০.৩৫ কোটি মানুষকে জনপিছু মাসে ৫ কিগ্রা করে খাদ্যশস্য প্রদান করা হয়। নীতি আয়োগের প্রস্তাব হল খাদ্যশস্য পাওয়ার যোগ্য গ্রামীণ জনসংখ্যার ও শহুরে জনসংখ্যার অনুপাতদুটিকে কমিয়ে যথাক্রমে ৬০ ও ৪০ শতাংশ করা। তা করা হলে ২৯২০ সালের জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভর্তুকিযুক্ত খাদ্যশস্য পাওযার যোগ্য জনসংখ্যা ৮৯.৫২ লক্ষ কোটি থেকে কমে ৭১.৬২ লক্ষ কোটি টাকা হবে।

গত বছরের বাজেটের সময় কোভিড সংক্রমণের বিষয়ে মোদি সরকারের চিন্তা ছিল না, যদিও ব্রাত্যজনেরা সেদিকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ফলে খাদ্যে ভর্তুকি কমানোর লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল দেশ। ২০১৯-২০ সালের বাজেটে খাদ্য ভর্তুকির বরাদ্দ ছিল ১.৮৪ লক্ষ কোটি টাকা, কিন্তু সংশোধিত বাজেটে সেই বরাদ্দ কমে ১.০৮ লক্ষ কোটি টাকায় নেমে আসে। ২০২০-২১ এর বাজেট বরাদ্দ পূর্বতন বছরের বাজেট বরাদ্দের থেকে প্রায় ৩৮% কমিয়ে ১.১৫ লক্ষ কোটি টাকা করা হয়। সাধারণত প্রকৃত ব্যয় বাজেট বরাদ্দের থেকে আলাদা হয়। যদি ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষের প্রকৃত ব্যয়, ১.৭ লক্ষ কটি টাকাকে মাথায় রাখা হয়, তাহলে ২০২০-২১ এর বাজেট বরাদ্দ মোদি সরকারের প্রথম বছরের ব্যয়ের থেকেও কম। মনে রাখা দরকার মাঝখানে কেটে গেছে ৬ বছর, টাকার দাম কমেছে ফলে প্রকৃত হিসেবে ওই হ্রাস অনেকটাই কম।

সাধারণত খাদ্যশস্যের গণবণ্টনের জন্য ভর্তুকি বাজেটে উল্লেখিত ভর্তুকির তুলনায় বেশিই থাকে কারণ ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (এফসিআই)ও ধার করে যা বাজেটের অন্তর্ভুক্ত করলে ভর্তুকি অনেকটাই বাড়ত। সম্প্রতি ২০২০-২১-এর সংশোধিত বরাদ্দ ও ২০২১-২২এর বাজেট বরাদ্দ হিসেবের সময়ে সামগ্রিক হিসেব করা হযেছে। যেহেতু ২০২০-২১ অর্থবর্ষে কোভিড মহামারী জনিত কারণে প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনায় অতিরিক্ত চাল, গম, ডাল দেওয়া হয়েছিল তাই বর্তমান অর্থবর্ষে ভর্তুকির পরিমাণ ৪.২২ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছায়। ২০২১-২২ সালে ওই ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ করা হয় ২.৪৩ লক্ষ কোটি টাকা। এই অতিমারীর সময়ে ২০২০-২১ সালের ৪.২২ লক্ষ কোটি টাকার তুলনায় ২০২১-২২ এর ২.৪৩ লক্ষ কোটি টাকা অনেকটাই, প্রায় ৪৩ শতাংশ কম। তাই বলাই যেতে পারে খাদ্যে ভর্তুকি কমানোর কাজটি চলছে।

ফলে নীতি আয়োগের ভর্তুকি তুলে দেওয়ার আলোচনাটি কোনো হঠাৎ ভাবনা নয়, অর্থমন্ত্রকের মুখ্য উপদেষ্টা প্রণীত ২০১৯-২০র অর্থনৈতিক সমীক্ষাতে একটি পুরো অধ্যায় বাজারে সরকারি হস্তক্ষেপ কমানো নিয়ে ব্যয় করা হয়েছে। ওই সমীক্ষায় লেখা হয়েছে, “সরকারী নীতির ফলে খাদ্যশস্যের বৃহত্তম সংগ্রাহক ও মজুতদার হিসেবে সরকারের উদ্ভব ঘটেছে -- ফলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাধা প্রাপ্ত হচ্ছে,যার ফলে এফসিআই-এর গুদামে বাড়তি খাদ্য শস্য উপচে পড়ছে, বিপুল খাদ্য ভর্তুকির বোঝা চাপাচ্ছে, খাদ্যশস্যের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ফারাক তৈরি করছে এবং শস্য বৈচিত্র আনয়নের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করছে”। বলা হয়েছে, “এনএফএসএ র আওতায় কেবলমাত্র নীচের ২০% কেই রাখা উচিৎ। এছাড়া আগেও প্রথম মোদি সরকার দ্বারা গঠিত বিজেপি এমপি শান্তাকুমারের নেতৃত্বাধীন কমিটি সুপারিশ করেছিল এনএফএসএকে সংশোধন করে কেবল ৪০% মানুষকে ওই আইনের আওতায় আনার জন্য। আদতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকার নিয়োজিত কমিটিগুলি ‘শ্লট মেশিন কমিটি’ (যেখানে নিয়োগকর্তা যেমনটা চায় তেমনি রিপোর্ট পায়)।

শান্তাকুমার কমিটি, মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, অর্থমন্ত্রক, নীতি আয়োগ প্রমুখ তাবড় বিজ্ঞজন বা তাদের সমাবেশ অনায়াসে খাদ্যে ভর্তুকি কমানো এবং মনে মনে তুলে দেওয়ার কথা বলে কারণ তারা মনে করে যে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সরকারের হস্তক্ষেপ অনুচিৎ। তারা ইচ্ছে করেই ভুলে যায় যে, ভারতে এখনো বিপুল ক্ষুধা ও অপুষ্টি রয়েছে। পুষ্টিহীনতার একটি বড় লক্ষণ অপুষ্ট ও খর্বাকৃতি শিশুর প্রাচুর্য। বিশ্ব ক্ষুধা সূচক, ২০২০ অনুসারে ১০৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৯৪তম, ভারতে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের শীর্ণতা সর্বোচ্চ, ১৭.৩ শতাংশ এবং খর্বাকৃতি শিশুর অনুপাত ৩৪.৭ শতাংশ। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা ৪ অনুসারে ৫ বছরের নীচে থাকা ৩৫.৭ শতাংশ শিশুর ওজন স্বাভাবিকের থেকে কম. ৩৮.৪ শতাংশ খর্বাকৃতি ও ২১ শতাংশ অতি দুর্বল। সামগ্রিক জাতীয় পুষ্টি সমীক্ষা এই পরিস্থিতিকে দীর্ঘকালীন অপুষ্টির সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা সূচক, ২০২০ অনুসারে ভারতের স্থান ১১৩টি দেশের মধ্যে ৭১তম। অক্সফ্যামের খাদ্য প্রাপ্তির সূচকেও ভারতের স্থান ছিল ৯৭তম।

শান্তাকুমার কমিটির সুপারিশকে গ্রহণ করলে শেষ বিচারে ফুড কর্পোরেশনকে তুলে দেওয়াই হত। কমিটির বক্তব্য অনুযায়ী মাত্র ৬% কৃষক ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল বিক্রি করে। অর্থাৎ, ন্যূনতম সহায়কমূল্য অর্থহীন। অন্যদিকে কমিটির বক্তব্য অনুসারে হিসেব করে দেখা গিয়েছে যে, রেশনিং ব্যবস্থার ফাঁক দিয়ে ৪৭% শস্যে চুরি হযে যায় (যদিও বিশ্বব্যাঙ্কের ‘দক্ষিণ এশিয়ায় বৈষম্য মোকাবিলা’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে ভারতের গণ বণ্টন ব্যবস্থায় চুরি বা লিকেজ ২০০৪-০৫ সালের ৫০% থেকে কমে ২০০৭-০৮ এ ৪৪% ও ২০১১-১২ সালে ৩৫%-এ নেমে এসেছিল)। ফলে এমএসপি বা রেশনিং বহুলাংশেই নিরর্থক হয়ে দাঁড়ায়। ও দুটি না থকলে ফুড কর্পোরেশনের (এফসিআই) কোন প্রয়োজন থাকে না। সব মিলিয়ে এমএসপি, রেশন ও এফসিআই এক ধাক্কায় সব কিছুকেই অনাবশ্যক দেখানোই যেন কমিটির উদ্দেশ্য ছিল।

মুক্ত বাজারের অর্থনীতি গত ৩ দশক ধরে দেশে চালু হলেও গত কয়েক বছরের বিজেপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক মোর্চার শাসনকালে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, ইজ অফ ডুইং বিজনেস জাতীয় বিভিন্ন ‘অর্থনৈতিক মুক্তি’র কথা জোরের সঙ্গে উপস্থাপিত হচ্ছে। সরকার যেভাবে সরকারী মালিকানাধীন সরকার পরিচালিত সংস্থার বিরোধিতা করছে তা আগে কখনো হয়নি। সরকারী প্রশাসনিক আমলাদের বিরুদ্ধে সরকারের প্রধান অকর্মণ্যতার অভিযোগ আনছে, সরকারি প্রশাসনে দক্ষতা আনার জন্য যুগ্ম সচিব উপসচিব স্তরে সরাসরি বেসরকারী সংস্থার কর্মীদের নিয়োগ করা হচ্ছে। ২০১৯-২০ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষার উল্লেখিত অধ্যায়ের নাম ছিল ‘বাজারের কার্যকারিতা ক্ষয়যখন সরকারের হস্তক্ষেপে লাভের থেকে ক্ষতি বেশি হয়’। ওই অধ্যায়ের ছত্রে ছত্রে অত্যাবশ্যক পণ্য আইন (ইসিএ) ও তার আওতায় ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রন বা পণ্যের মজুত নিয়ন্ত্রণ, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি), এফসিআই, খাদ্যে ভর্তুকির মতন সরকারী ব্যবস্থা কত খারাপ তার সপক্ষে তথ্য ও তত্ব হাজির করা হয়েছে। বলা হয়, ওই নীতির ফলে অতি-দ্রুত বর্ধমান খাদ্য ভর্তুকির বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। ফলে খাদ্য সুরক্ষার আওতায় সস্তায় খাদ্যশস্য কেবল ২০ শতাংশ মানুষকে দিলেই চলবে বাকিদের ক্ষেত্রে বিক্রয় মূল্য সংগ্রহ মূল্যের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হলেই চলবে। এও বলা হয যে ওই ভর্তুকি যুক্ত খাদ্যশস্য দেওয়ার বদলে ব্যাঙ্ক খাতায় সরাসরি অর্থ পাঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে। যদি তেমনটা হয় তাহলে এমএসপি, খাদ্য শস্য সংগ্রহ, এফসিআই সব কিছুই উঠে যাবে। ওই সমীক্ষা ইঙ্গিত করেছিল ইসিএ তুলে দেওয়ার। সরকার কিন্তু কোভিডের সময়ে তেমনটাই করেছে। ফলে খাদ্যে ভর্তুকি তোলার যে কথা শুরু হয়েছে তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষি পণ্য ও খাদ্যশস্যের বাজারকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে এগুলি সব তুলে দেওয়া আবশ্যিক। কর্পোরেটদের হাতে কৃষিকে তুলে দিতে গেলে মোদি সরকারকে এই এজেন্ডাকে সম্পূর্ণ করতে হবে।

গত কয়েক বছরে সরকার জনকল্যাণমূলক অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ বাতিল করতে উঠে পড়ে লেগেছে। পেট্রল-ডিজেল-কেরোসিনে ভর্তুকি তুলে দেওয়া হয়েছে আগেই। রান্নার গ্যাসেও ভর্তুকি নামমাত্র। রেলের যাত্রী টিকেটের দাম বাড়ানো হচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রকেও বেসরকারীকরণ করা হচ্ছে ক্রমাগত। এমএসপি তোলার প্রক্রিয়াটি কৃষকদের আন্দোলনের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে আছে। শিক্ষা স্বাস্থ্যকেও বেসরকারী পুঁজির কাছে ছেড়েই দেওয়া হয়েছে। সরকার চায় সমস্ত ভর্তুকি তুলে দিতে। কিন্তু জনমতের কথা ভেবে তা কার্যকরী করতে পারছে না। খাদ্যশস্যে ভর্তুকি তুলে দিতে পারলে মোদি সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অভীষ্ট পূর্ণ হয়। কিন্তু তা কৃষক ও সাধারণ ভোক্তাদের জীবন বিপর্যস্ত করবে।

- অমিত দাশগুপ্ত   

Corporate dominance in the economy is Modi's fascist modelCorporate dominance in the economy

স্বাধীন ভারত এতো নির্লজ্জ কর্পোরেট তোষণ এর আগে কখনো দেখেনি। কিছুদিন আগে সংসদে বাজেট ভাষণে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির জন্য খোলাখুলি ব্যক্তিগত পুঁজির পক্ষে সওয়াল ও তাকে বরণ করার ‘গুরুত্ব’ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। আর পাশাপাশি, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্ণধারদের ‘অকর্মন্যতা’ নিয়ে বিদ্রুপ ও শ্লেষ ব্যক্ত করেছেন সংসদের অভ্যন্তরে — কোনো প্রধানমন্ত্রী আজ পর্যন্ত যা করেননি। ইনক্লুসিভ বৃদ্ধির সমস্ত আবরণকে ছিন্নভিন্ন করে এবারের কেন্দ্রীয় বাজেট ভারতের অর্থনীতির উপর কর্পোরেট আধিপত্যকেই সবুজ সংকেত দিয়ে বসলো। এদিকে, কর্পোরেটদের তরফ থেকে নতুন কোনো শিল্পক্ষেত্র গড়ে তোলা বা তাতে পুঁজি বিনিয়োগের কোনো লক্ষণের বদলে উন্নত দেশগুলো থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি ডলার পাম্প করে পাঠানো হলো দেশের স্টক মার্কেটে। এটাকেই প্যান্ডেমিক পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন বলে চালাবার চেষ্টা করছে ক্ষমতার অলিন্দে পোষ মানা আমলাকুল।

এটা আজ স্পষ্ট যে মোদী সরকার এখন কর্পোরেট চালিত বিনিয়োগের মডেলকেই আর্থিক বৃদ্ধি হিসাবে আঁকড়ে ধরতে চাইছে সমস্ত ক্ষেত্রে বিরাট বিপর্যয়কে সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ার পর। আর, আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে পর্যন্ত এটাই হবে তার গতিমুখ।

ব্যক্তিগত পুঁজির পক্ষে এই সরকার তার পক্ষপাতের প্রমাণ দিতে জুলাই-আগস্ট ২০১৯এ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পাস করালো মজুরি বিধি বা ওয়েজ কোড। গোটা অর্থনীতি যখন চাহিদার অভাবে ধুঁকছে আম জনতার সংকুচিত ক্রয়ক্ষমতার দরুন, সেই সময় সাধারণ মানুষের হাতে নগদের জোগানকে বাড়ানোর বদলে ২০১৯ সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি কর্পোরেট করের উপর বিপুল ছাড় ঘোষণা করলো আর তা এতোটাই যা এর আগে কখনো করা হয়নি। বস্তুত, নতুন ম্যানুফ্যাকচারিং সংস্থাগুলোকে মাত্র ১৫ শতাংশ কর্পোরেট কর দিতে হবে — দুনিয়ায় কর্পোরেট কর যে সব দেশ আদায় করে তার মধ্যে সবচেয়ে কম! এরপর অতিমারীর সুযোগে কর্পোরেটদের স্বার্থে মোদী সরকার একের পর এক আইন পাস করালো।

গোটা দেশ যখন অতিমারীর মারাত্বক ছোবলে আক্রান্ত, তখন এই সরকার কর্পোরেটদের অবাধ মুনাফা লোটার সুযোগ করে দিতে ২০২০-র মে মাসের মাঝামাঝি আটখানা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বড় ধরনের কাঠামোগত সংস্কার করে কর্পোরেটদের এই সমস্ত ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশকে আরও ত্বরান্বিত করে। কয়লাক্ষেত্রে উত্তোলন ও বিক্রি করার অনুমতি কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন এতোদিন কয়লা ক্ষেত্রটিকে সরকারী কব্জায় রাখার যে লকডাউন নীতি ছিল, এবার তা আনলক করা হলো। এখানেই সরকার থামলো না। কয়লা ক্ষেত্রে কর্পোরেটদের বিনিয়োগ ও মুনাফাকে সুনিশ্চিত করতে এই শিল্পের পরিকাঠামো উন্নয়নে বিপুল সরকারি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি কার্যত কয়লাশিল্পে জাতীয়করণের অবসান ঘটিয়ে কর্পোরেটদের বিপুল মুনাফা অর্জনের রাস্তা প্রশস্ত করে দিল। কয়লাশিল্পে আটকে না থেকে সমস্ত খনি খুলে দিল কর্পোরেটদের জন্য।

যে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র এতোদিন ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে, সেটাকেও কর্পোরেশন বানানোর পুরো তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। বেসরকারীকরণের লক্ষ্যেই অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিগুলোকে কর্পোরেশনে পরিণত করার একের পর এক পদক্ষেপ নিতে শুরু করলো কেন্দ্রীয় সরকার। বিমান বন্দরগুলোকে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রের হাতে তুলে দেওয়ার পাশাপাশি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোতে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থাগুলো সঁপে দেওয়া হলো ব্যক্তিগত ক্ষেত্রের কব্জায়।

পারমানবিক শক্তি ও মহাকাশ ভিত্তিক পরিষেবার দরজা এই প্রথম উন্মুক্ত হলো কর্পোরেটদের জন্য। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া বিপুল পরিমাণ কর্পোরেট ঋণ আদায়ে বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে যাতে ‘বিব্রত’ না করা হয় তার জন্য ইন্সলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাঙ্করাপ্টসি কোডকে কার্যকর করা থেকে বিরত রাখা হলো জুন মাসের প্রথম দিকেই। এরপর এলো তিন তিনটে কৃষিআইন ও তিনটে শ্রমকোড। সেই কৃষি আইনের বিরুদ্ধে মাসাধিক চলমান কৃষক আন্দোলন আজ নতুন এক প্রবণতা। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই সর্বত্র ব্যাপক চর্চা হয়েছে। স্বাধীনতার পর এই প্রথম শ্রম আইন তৈরি হোল ‘সহজ শর্তে ব্যবসা করার’ বনিয়াদের উপর।

এবারের বাজেট কর্পোরেটদের জন্য দু’হাতে উপঢৌকন এনে দিল। যখন ব্যাপক রাজকোষ ঘাটতি ও আর্থিক সংকটে সরকার জেরবার, তখনো এই বাজেট কর্পোরেট কর-এ হাত দিল না। বাড়ালোনা এক পয়সাও। বরং, জনগণের সম্পত্তি, যেমন রেল-রাস্তা-তেল-গ্যাসপাইপ লাইন-বন্দর-বিমানবন্দর প্রভৃতি পরিকাঠামো ক্ষেত্রগুলো, যা এতোদিন কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর অধীনে ছিল তা ব্যক্তিগত ক্ষেত্রের কাছে তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করলো। আর, এইভাবে, গোটা অর্থনীতিকে কর্পোরেটদের একচেটিয়াকরণের অধীনে আনতে এবারের বাজেট বাড়তি এক হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ালো। বাজেট ১৩টি সেক্টরের ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলোর জন্য ১.৯৭ লক্ষ কোটি টাকা ধার্য করলো উৎপাদন ভিত্তিক ইন্সেন্টিভ প্রকল্পের নামে, আগামী পাঁচ বছরের জন্য।

মুষ্ঠিমেয় কর্পোরেটদের কব্জায় গোটা অর্থনীতিকে তুলে দেওয়ার সাথেই ওতোপ্রোতভাবে যুক্ত দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থহীন করে তোলা। ইন্দিরার জরুরি অবস্থায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমস্ত অধিকার হরণ করা হয়। আর, এবার ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে যে কোন নাগরিকের মতপ্রকাশের একান্ত ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। ধীরে ধীরে গোটা দেশটাই পরিণত হচ্ছে জেলখানায়। শুরু হয়েছে ভারতের কাশ্মীরীকরণ। ঔপনিবেশিক আমলের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন, সামান্য কয়েকটি টুইটের জন্য আদালত অবমাননার চোখ রাঙানি ভারতের যেন নতুন এক স্বাভাবিক। দিন কয়েক আগে সদ্য প্রাক্তন অটর্নিজেনারেল মুকুল রোহতাগি বললেন, দিশা রবিকে রাষ্ট্রোদ্রহ মামলায় গ্রেপ্তার করাটা সংবিধান বিরোধী কাজ হয়েছিল।

এই মোদী সরকারকে সর্বাত্মকভাবে প্রতিরোধ করাটাই আজ পথের দাবি।

- অতনু চক্রবর্তী 

Actors to BJPSwarming in the Padma forest

ঝাঁক ঝাঁক অভিনেতা অভিনেত্রীরা যাচ্ছেন বিজেপি’তে। কারণটা কী? ঘেঁটে যাওয়া রাজনৈতিক পরিমণ্ডল, না দিশাহীনতা, না সুবিধাবাদ? লকডাউনে যাকে দেখা গেল শ্রমজীবী ক্যান্টিনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে, তিনিই সম্প্রতি যোগ দিলেন বিজেপিতে; যিনি লকডাউন পর্বে চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ করলেন বিজেপি’কে, সুবিধাবাদী ট্রেন্ডকে -- তিনিও মানুষকে চমকে দিয়ে যোগ দিলেন বিজেপিতে। নির্বাচনের নামে এ যেন অদ্ভুত এক আইপিএল-এর দলবদল চলছে বাংলায়। কারণগুলো একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক।

চিত্রতারকাদের হঠাৎ করে রাজনীতিতে আসা (বা টেনে আনা) এবং বিধায়ক, সাংসদ বনে যাওয়া -- এটা আমরা তৃণমূল জমানাতেই দেখেছি। বিজেপিও দাবি করতে পারে সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করছে মাত্র, অর্থাৎ গ্ল্যামার দুনিয়াকে ভর করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার উদ্দেশ্যটা নিরীহ। কিন্তু যাইই বলুক, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের থাবায়, রূপোলি দুনিয়াকে তাদের গেরুয়া ছাতার তলায় নিয়ে আসাকে অত সহজভাবে নেওয়া যাচ্ছে না।

পদ্মবনের তারকাদের ভ্রমরগুঞ্জন: “ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা খুব খারাপ, কোভিড-১৯’র কারণে বিশেষ করে। ডবল ইঞ্জিন সরকার হলে সুরাহা হতে পারে”। “ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ পাওয়া, টিঁকে থাকার জন্য শাসকদলের রাজনৈতিক চাপের মধ্যে থাকতে হয় যা অনভিপ্রেত”, আবার উল্টো সুরে কেউ বলেছেন, “এখন সেখানে শাসকদলের নিয়ন্ত্রণ ক্ষীয়মান; অতএব –” ইত্যাদি ইত্যাদি।

গেরুয়া বাহিনী অনেক দিন ধরে বাংলার মসনদকে নিশানা করে রেখেছে এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে। তাদের বুদ্ধি-বিবেচনা, কৌশল অনুযায়ী বাঙালির তথাকথিত ‘মন জয়ের’ চেষ্টার কোনো কমতি নেই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, তারা না জানে বাংলার নাগরিক সংস্কৃতি, না জানে গ্রাম বাংলার শিশিরমাখা মাটির সংস্কৃতি! কিন্তু জনমানসকে বুঝতে গেলে যেমন তার নিজস্ব সংস্কৃতিকে বুঝতে হবে, তেমনি সেই জনমানসকে নিজের ইচ্ছেমত ভেঙে চুরে তৈরি করতে গেলে, সেই সংস্কৃতির ক্ষেত্রকে কব্জায় আনতে হবে। তারা ‘চাপিয়ে দেওয়ার’, ‘দখল করা’র রাজনীতিতেই বিশ্বাসী। তাই সংস্কৃতির সবচেয়ে জোরালো মাধ্যম বাংলার ছোট এবং বড় পর্দার জগতে অনুপ্রবেশের জন্য তারা মুখিয়ে ছিল। টলি-পাড়া! যেখানে বেশ অনেকদিন ধরেই চলছে ক্ষমতা ও টাকার খেলা। সেখানে নীতি-আদর্শের জায়গা নেই, বলাই বাহুল্য।

এই পরিস্থিতিটা একদিনে তৈরি হয়নি। বর্তমান শাসকদলের ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তা যথেষ্ট অস্বস্তিকরভাবে দৃশ্যমান হয়েছে ক্রমশ। সামাজিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অনুষঙ্গেই সেটা এসেছে। এই প্রক্রিয়ার দুটো দিক আছে - একটা পদ্ধতিগত আর একটা ব্যবহারিক অনুশীলনগত। তৃণমূলের বিভিন্ন নেতৃত্ব বিভিন্ন সময় নির্বাচনের প্রেক্ষিতে ভোটদাতাদের পাশাপাশি একটি সমান্তরাল ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেন। তা কি শুধুই পেশীশক্তি? তাহলে ‘খেলা হবে’ জাতীয় ন্যারেটিভ কি জন্য? এই সিস্টেমটার ধারক ছিল সিপিএম। পেশীর জোর তো বটেই, এর সঙ্গে কাজ করে আরও তিনটি ব্যাপার। এক, সামাজিক পুঁজি। যেমন রাতবিরেতে অসুস্থ শিশুর জন্য অটো জোগাড় করে আস্থাভাজন হওয়ার মতো নানা কাজ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘দান-ধ্যানের’ কালচার যা অধিকারের লড়াইকে বহু ধাপ পিছিয়ে দেয়। অ্যাম্বুলেন্স বা রেশনের চাল পাওয়া মানুষের ‘অধিকার’, শাসকদলের দাক্ষিণ্য নয়!

দুই, পৃষ্ঠপোষণ, অর্থাৎ সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের সাহায্য পেতে পার্টির চ্যানেলে যেতে হবে। তিন, নজরদারি। সামাজিক নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে খবর রাখা কে কোন দলের সঙ্গে আছেন এবং বেচাল করলে তার উপযুক্ত শাস্তি। গ্রামের মতো মৌখিক সমাজে নিজের পলিটিকাল আইডেনটিটি সাধারণ মানুষের পক্ষে লুকিয়ে রাখা শক্ত। তৃণমূল এই সংস্কৃতির বাহক। কিন্তু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের বৃহত্তর আন্দোলনের আগে পর্যন্তও, সিপিআই(এম) এই তিন তন্ত্রকেই অটুট রেখেছিল। ফলত রাজনৈতিক মতাদর্শ ও লড়াইয়ের প্রশ্নটা ক্রমশ ‘ক্ষমতার রাজনীতির’ দাপটে আর ‘পাইয়ে দেওয়ার নীতি’র প্রশ্রয়ে গুরুত্ব হারিয়ে একসময় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। তাই মানুষ তথা যুবসমাজ যেরকম তফাৎ খুঁজে পায়নি সিপিএম-তৃণমূলের মধ্যে, সেরকমই এখনও তফাৎ খুঁজে পাচ্ছে না তৃণমূল বা বিজেপির মধ্যে। রাজনীতির গ্রগণযোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে মানুষ তাই জেনেছে -- ফি বছর ‘ভোটে জেতা’। এই নতুন তারকারাও তার ব্যতিক্রম নন।

ভোটের পাটিগণিত ছেড়ে আদর্শের রাজনীতিতে জোর দেননি উপরের কোনও দলই। দুর্বৃত্তায়নের যে সূচনা হয়েছিল মরিচঝাঁপি থেকে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম দিয়ে; তা তৃণমূলের আমলে সংঘটিত হয়েছে ভাঙড়ে, সম্প্রতি কমরেড মইদুলের হত্যা, এসএসসি চাকরি প্রার্থীদের উপর চলা অত্যাচার ইত্যাদি অজস্র উদাহরণে। এবং মাত্রাটা বেড়েই চলছে। নিজেই স্বৈরাচারী চরিত্রে অবতীর্ণ হচ্ছে তৃণমূল। পাশাপাশি ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে কার্যকরিভাবে রুখতে তৃণমূল যত ব্যর্থ হচ্ছে, ততই ‘গণতন্ত্র পুনরদ্ধারের’ নামে বিজেপি এই বাংলায় তার পায়েরতলার মাটিকে আরও মজবুত করেছে।

দ্বিতীয় দিকটা হল, প্র্যাকটিসগত। পশ্চিমবঙ্গ বলতে ‘কোট-আনকোট’ বাঙালিকে বুঝি আমরা। আর বাঙালি বলতে আমাদের কেবল ‘শিক্ষিত, নম্র বা সংস্কৃতিবান’ ভাবমূর্তি, নরম-সরম, সাংস্কৃতিক সফিস্টিকেটেড ইমেজ বুঝি না -- সেটা বুর্জোয়া, উচ্চবিত্তদের তৈরি। তার বাইরে বাংলার ছাত্রযুব-নারী সমাজের একটা লড়াকু দিক আছে। গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া মানুষও চিরকালই লড়াকু। রাজনৈতিক জমি দখলের লড়াইয়ে বাংলার কৃষকদের সঙ্গে পাঞ্জাব, কেরল বা ভারতের অন্য জায়গার কোনও পার্থক্য নেই। কিন্তু এই বার্তা, এই লড়াইয়ের ইতিহাস, যারা শাসকশ্রেণীর দলগুলোর সঙ্গে-প্রভাবে থাকাকে শ্রেয় মনে করেন তাদের কতজনের কাছে পৌঁছায়? বা পৌঁছলেও ‘সুশীল মাপকাঠি’ থেকে বেরিয়ে ‘লড়াই করা’ মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর কথা কতটা ভাবতে পারেন! টলি তারকারাও এই সিস্টেমেরই অংশ। এই সিস্টেম তাদের প্রভাব, প্রতিপত্তি, সামাজিক সম্মান মানে শাসকগোষ্ঠীর দেওয়া সম্মান, অর্থ ইত্যাদি এত কিছু পাইয়ে দেওয়ার মোহে আচ্ছন্ন করে, কোনও কোনও জীবিকার নিরাপত্তার পূর্বশর্তও হাজির করে। আর যারা রাজনীতি বলতে ওই ‘পাইয়ে দেওয়ার নীতিই’ বুঝেছেন তারা শিরদাঁড়া সোজা রাখবেন কি করে? এরসঙ্গে আরও একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া চলে -- তা হলো ‘ডিফেমেশান’। যারা এই মানদন্ড মানবেন না তারা ‘সুবিধাবাদী’ হিসেবে ট্যাগড্ হবেন। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত মানুষ যারা বিজেপি’র নীতির বিরুদ্ধে বলেছেন তাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ে চলেছে ধারাবাহিক কুৎসা। মানুষকে তাদের কথাই শোনানো হবে যারা কেন্দ্রের শাসকদল অর্থাৎ বিজেপি’র অনুগত। তাই কি ঝুঁকিহীন, মসৃণ জীবন পেতে পদ্ম-অনুগামী হওয়া নয়! এই ক্ষেত্রের মানুষগুলোকে বিজেপি’র আজ বড্ড দরকার। ছায়া জগতকে কাজে লাগিয়ে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের রক্তাক্ত নখ-দাঁত আড়াল করা, মানুষের দেশজোড়া প্রতিবাদকে চাপা দিতে নানা কল্পকাহিনীর মোহিনী জাদুর মায়ায় মানুষকে ভুলিয়ে রাখা, আর তার সঙ্গে সাড়ম্বর আয়োজনে নিজের মনুবাদী দর্শনকে সমাজ জীবনে গেঁথে দেওয়া! এই দুরভিসন্ধির প্রয়োজনেই।

এই পুরো ফাঁপা সিস্টেমের বিরুদ্ধে দরকার আদর্শের রাজনীতি যা একমাত্র বামপন্থাই পারে। কিন্তু সে তো দীর্ঘ দৌড়ের ব্যাপার। বাংলার ভাগ্যাকাশে এখন সবচেয়ে বড় বিপদ হল ফ্যাসিবাদী শক্তি বিজেপি’র ধেয়ে আসা। টলিউডেরও শিয়রে সংকট। ছলে-বলে-কৌশলে অনুপ্রবেশ করতে মরীয়া ফ্যাসিবাদী শক্তি। তাই এখন তৃণমূল বিরোধিতায় বিজেপি’র সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না নেমে দরকার বিজেপি’র বিরুদ্ধে শক্তিশালী লড়াই।

- সৌমি জানা   

Social MediaNew Law for Social Media Users

এই মুহূর্তের অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ যে খবর, তা হল কৃষক আন্দোলন প্রায় ৩ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে, এবং এই কৃষক অবস্থানে ইতিমধ্যেই প্রায় ২০০ জন কৃষক মারা গেছেন। এই খবরটা যদি খেয়াল করা যায়, কটা প্রথম সারির দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে? ত, তাহলেও বোঝা যেত, কিন্তু তার বদলে এই কৃষক আন্দোলনের খবর আন্তর্জাতিক মহলে ছড়িয়ে পড়ে। পরিবেশ আন্দোলনের তরুণ মুখ গ্রেটা থুনবার্গথেকে শুরু করে বার্বাডোজের গায়িকা রিহানা এই কৃষক আন্দোলন নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, কেন আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করছি না? এরপরেই সরকার নড়েচড়ে বসে। তড়িঘড়ি সরকারের হয়ে নামিয়ে দেওয়া হয় দেশের বিভিন্ন সেলিব্রিটি থেকে খেলোয়াড় প্রায় সবাইকে। সবাই মোটামুটি প্রায় একই রকমের ধরনের বক্তব্য লেখেন যে কোনও রকম দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে কেন আন্তর্জাতিক মহল থেকে নাক গলানো হবে? এইখানেই সরকার থেমে থাকেনা, তারপর তারা টুইটার এবং ফেসবুককে বলে যে অন্তত ১,৮০০ অ্যাকাউন্ট অবিলম্বে বন্ধ করে দিতে হবে। টুইটার প্রাথমিকভাবে সম্মত হলেও পরে প্রবল চাপে ঐ অ্যাকাউন্ট আবার ফিরিয়ে দেয়। এই শুরু হয় এই বড় প্রযুক্তির সংস্থা টুইটার এবং ফেসবুক সহ অন্যান্য ছোট ছোট খবরের পোর্টালদের কি করে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তার প্রক্রিয়া।

বলা হয়েছে যে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে তাই এই সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করাটা খুব জরুরি। কোনও কোনও মানুষ দেশের সুরক্ষা বিঘ্নিত করছেন এবং তাঁদের চিহ্নিত করা জরুরি। যদি খেয়াল করা যায় তাহলে দেখা যাবে, এর কিছুদিন আগেই দেশের গৃহমন্ত্রক থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়, বলা হয় যে গৃহমন্ত্রক বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করতে চায়, যারা সামাজিক মাধ্যমে কারা ভুয়ো এবং মিথ্যে খবর ছড়াচ্ছেন তা চিহ্নিত করবেন। তারপরেই আসে এই আইন। ভুয়ো খবরের বাড়বাড়ন্ত অবশ্যই চিন্তার কারণ, কিন্তু তা আটকাতে যে আইন কেন্দ্রীয় সরকার আনল তা দিয়ে কি সত্যিই উদ্দেশ্য সফল হবে? যখন আমরা জানি যে শাসকদলের যে আইটি সেল আছে তারা কিভাবে ভুয়ো এবং মিথ্যে খবর ছড়িয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অশান্তি তৈরি করেছে তখন এই আইনে কি আদৌ কোনও লাভ হবে? বলা হয়েছে যে একজন সচিবকে নিযুক্ত করা হবে, এবং ঐ প্রযুক্তির সংস্থা, অর্থাৎ ফেসবুক এবং টুইটারকে সেই সচিবের কাছে জানাতে হবে ভুয়ো খবরের উৎস কি? ধরা যাক জানানো হল যে দিল্লীর দাঙ্গার পিছনে বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রের সক্রিয় মদত রয়েছে এবং তাঁর করা ফেসবুক পোস্টেই দিল্লীতে দাঙ্গা হয়েছে, তখন কি সরকার তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে? নাকি এই আইন করে আসলে গণতন্ত্রের কণ্ঠই রোধ করা হবে?

প্রথমত যা বলা হয়েছে তাতে এমনিতেই বেশ কিছু প্রশ্ন আসছে। ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম, বিনোদনমূলক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম যার পোশাকি নাম ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এবং সামাজিক মাধ্যমকে একই বন্ধনীর মধ্যে ফেলা হয়েছে। এর পিছনে তাহলে কি অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে? ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম কিন্তু ইতিমধ্যেই মুদ্রণ এবং টেলিভিশনের যে প্রচলিত আইন আছে তা মেনে চলে। যার ফলে এই ছোট ছোট ওয়েব পোর্টালের সম্পাদক ও সাংবাদিকেরা ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দায়বদ্ধ। এরসঙ্গে সামাজিক মাধ্যমের একটা গুণগত তফাৎ আছে, সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত কোনও খবরের কোনও সত্যতা কেউ যাচাই করে না, ফলে সেখানে যা লেখা,ছবি বা ভিডিও প্রকাশিত হয়, তার দায় একমাত্র প্রকাশকের, সুতরাং এই বিষয়ে সামাজিক মাধ্যম সংস্থাগুলোরও কোনও দায়িত্ব নেই। ফলে এর মাধ্যম দিয়েই অনবরত ভুয়ো খবর প্রচারিত হয়। তার বিরুদ্ধে এমনিতেই বেশ কিছু স্বাধীন সংস্থা বেশ কিছুদিন ধরে কাজ করছে, সরকারের কি উচিৎ ছিল না, সেই সংস্থাদের সঙ্গে কথা বলে তবে এই ধরনের কোনও আইন আনা? একদিকে মোদী সরকার বলছেন যে তারা গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করার পক্ষপাতী নন, অন্যদিকে একটি টুইট করার জন্য তারা বেঙ্গালুরু থেকে ২১ বছর বয়সী একজন পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী দিশা রভিকে গ্রেপ্তার করে। একদিকে জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর হামলাকারী শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হবার সুবাদে কেউ কেউ বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াবেন, অন্য দিকে কোনও রাজ্যে না ছড়াতে পারে, সেটার জন্যেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হল? সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের পায়ে বেড়ী পরিয়ে কি নরেন্দ্র মোদী পূর্বসূরীকেই অনুসরণ করতে চাইলেন?

- সুমন সেনগুপ্ত   

Bjp's ThreatNow the BJP is starting

গ্রামের নাম চক হিরণ্যবাটি। ব্লক ধনেখালি। আমাদের সিপিআই(এমএল) লিবারেশানের রাজনৈতিক কাজের মানচিত্রে নতুন গ্রাম। ঋণমুক্তির ও পাট্টার দাবি ঘিরে সংযোগ। বিধানসভা নির্বাচনে পার্টি মনোনীত প্রার্থী সংগ্রামী যুবনেতা সজল দে’র সমর্থনে দেওয়াল লেখার কাজ চলছে। এই গ্রামের চকে সব দেওয়াল বিজেপি’র দখলে। আমরা ছোট্ট একটুকরো দেওয়াল চুন করি। কিন্তু আমাদের চুনকাম করা দেওয়াল পাঁক দিয়ে লেপে দিলো বিজেপি! এখনো ক্ষমতায় আসেনি। এখনই আস্ফালন – গ্রামে বিজেপি ছাড়া কেউ থাকবে না। লিবারেশন করলে গ্রামের কলে জল বন্ধ। দেওয়াল দিয়েছো কেন? এরজন্য গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হবে! চমকাচ্ছে-ধমকাচ্ছে বিজেপি। বিজেপি নাকি তৃণমূলের আমলের গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে লড়ছে এবং লড়ে ‘সোনার বাংলা’ গড়বে! এই দিনই এই গ্রামে আমাদের শ্রাবণী, সোমা, রুমাদি, সম্রাট, নন্দলালরা দেওয়াল লিখেছেন। পাশের মুসলিম পাড়ায় মানুষরা ডেকে বলেছেন, “পোষ্টার মেরে যেও”।

Obituary

কমরেড বরুণ ঘোষ

উত্তর কলকাতার বর্ষীয়ান কমরেড, হোশিয়ারি শ্রমিক ইউনিয়নের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড বরুণ ঘোষ আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৩-৪ মার্চের মধ্যরাতে প্রয়াত হয়েছেন উত্তর ২৪ পরগণার অশোকনগরের বাড়িতে।

মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭। তিনি রেখে গেছেন তিন কন্যা ও এক পুত্রকে।

দীর্ঘদিনের পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক বরুণ ঘোষ উত্তর কলকাতার শোভাবাজার এলাকায় খুবই জনপ্রিয় ছিলেন, তার হাত ধরেই ওই এলাকায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশান ও এআইসিসিটিইউ গড়ে ওঠে। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে আমাদের পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়ন হারালো দীর্ঘদিনের এক সৈনিককে।

অশোকনগর থেকে কমরেড বরুণ ঘোষের মরদেহ তাঁর শোভাবাজার বাসভবনে আসার পর সেখানে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হয় তার তৈরি করা ইউনিয়নের সদস্যবৃন্দ, ও এলাকার মানুষেরা। পার্টি ও আইসার পক্ষ থেকে উপস্থিত হন দিবাকর, প্রবীর দাস, অশোক সেনগুপ্ত, অতনু চক্রবর্তী, স্বর্নেন্দু ও সৌমেন্দু মিত্র, সায়নী ও সাম্য। বরুণ ঘোষের নশ্বর দেহের শোকসংবাদ শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় বাগবাজারের কাশী মিত্র ঘাট শ্মশানে।

কমরেড বরুন ঘোষ লাল সেলাম।

কমরেড জামশেদ সেখ

মুর্শিদাবাদ জেলার প্রবীণ পার্টি সদস্য কমরেড জামশেদ সেখ গত ৩ মার্চ প্রয়াত হয়েছেন। রাণীনগর কুপতলা এলাকায় তিনি সবচেয়ে পুরনো কমরেড। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯। ঐ এলাকায় সংগঠন তৈরিতে তাঁর অবদান খুব বেশি। সব মিটিং সম্মেলন আন্দোলন তিনি হাজির থাকতেন। তিনি ছিলেন একজন পার্টিজান। তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী, পুত্র কন্যা সহ অন্যান্য পরিজনদের। তাঁর মৃত্যুতে সিপিআই(এমএল) লিবারেশানের মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটি শোকজ্ঞাপন করেছে।

সমাপ্ত

খণ্ড-28
সংখ্যা-8