আজকের দেশব্রতী : ২১ জানুয়ারী ২০২১ (অনলাইন সংখ্যা)
ijjjkolddare

কোলকাতা, ১৮ জানুয়ারী, ২০২১: তিনটি কৃষি আইন বাতিল এবং নারী কৃষিজীবীদের জমি, খাদ্য এবং মজুরির অধিকারকে সুনিশ্চিত করার দাবিতে ১৮ জানুয়ারী কোলকাতায় ধর্মতলার ওআই চ্যানেলে “অন্নদাতাদের সঙ্গে বাংলা” লাগাতার ধর্না মঞ্চে অনুষ্ঠিত হল মহিলা কৃষক-মজুর বিধানসভা। ১৮ জানুয়ারী মহিলা কিষাণ দিবস উপলক্ষ্যে অখিল ভারতীয় কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতি ও রাজ্যের বিভিন্ন নারী/নারীবাদী সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে নারী কৃষিজীবীদের এই বিশাল জমায়েত হয়। উপস্তিত ছিলেন প্রায় ৪০টি কৃষক, মজুর ও নারী/নারীবাদী সংগঠনের নেতৃত্বও।

নেত্রী বক্তারা বলেন: প্রাগৈতিহাসিক যুগে নারীরাই প্রথম কৃষিকাজ শুরু করেছিলেন। নারীর হাতে বোনা বীজ দিয়েই প্রথম চাষাবাদের প্রচলন হয়েছে। এবং বর্তমানেও কৃষিক্ষেত্রে জমিতে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বীজ রোপন, ফসল ফলানো থেকে শুরু করে ফসল কাটার পরে সেটিকে প্রক্রিয়াজাত করে ঘরে তোলার ক্ষেত্রে নারীরাই প্রধান ভুমিকায় থাকে। মেয়েরা ক্ষেতে খামারে নিরবে কাজ করে যায়, কৃষি-বন-মৎস্য চাষে আমাদের ব্যাপক মাত্রায় অংশগ্রহণ থাকলেও আমাদের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না। আমরা অদৃশ্য হয়েই থেকে যাই। চাষির পরিবারের একজন মহিলা পরিবারকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রতিদিন তথাকথিত বাড়ির কাজে ৮ থেকে ১৬ ঘন্টা ব্যয় করে। বাড়ির পুরুষেরা যখন মজুরি উপার্জন করে তখন তাদের ‘বাড়ির কাজ’ করতে হয়। যার মধ্যে রয়েছে জ্বালানি সংগ্রহ, ঘর রক্ষণাবেক্ষণ, মাছ এবং বুনো ফল সংগ্রহ করা, শিকড় এবং পাতা সংগ্রহ করা, ছাগল, হাঁস, গরু এবং মুরগী পালন, ধান সিদ্ধ প্রভৃতি। এরপরেও জমিতে আগাছা পরিষ্কার থেকে জমির যাবতীয় কাজ মহিলাদের প্রায় বিনা মূল্যে করতে হয়। এমনকি মেয়েরা যখন অন্য লোকের জমিতে ক্ষেতে মজুরের কাজ করেন তখন পুরুষদের চেয়ে বেশি পরিশ্রমী হলেও তাদের অনেক কম মজুরি দেওয়া হয়। জীবন-জীবিকা এবং জমির  জন্য সব লড়াইয়ে সর্বদা মেয়েরা সামনের সারিতে থেকেছি। লড়াইয়ের ময়দানে তাদের বিশাল অবদান থাকা সত্ত্বেও কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার মতো সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দিল্লির কৃষক আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহনকে অপমান করে বললেন “কেন নারী এবং প্রবীণদের এই প্রতিবাদে রাখা হচ্ছে?” বয়স্ক ও নারীদের ‘ঘরে ফেরত পাঠানোর’ কথা উল্লেখ করে বললেন তিনি ভবিষ্যতে এই ব্যাপারে অর্ডার পাশ করতে পারেন। এই ঘোষণা মহিলাদের সাংবিধানিক অধিকারের উপর আক্রমণ। নারীরা স্বতস্ফুর্ত ভাবেই এই আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, নতুন কৃষি আইনগুলি যে নারী কৃষকদের অধিকার ও অস্তিত্বকে আরও বহুগুণ বিপণ্ন করে তুলবে, তা বুঝেই তাঁরা আন্দোলনে আছেন। প্রধান বিচারপতির এই কথা নারীদের প্রান্তিক এবং অদৃশ্য করে রাখার এক সচেতন প্রয়াস।

মহিলা কৃষক-মজুর বিধানসভা নিম্নলিখিত রেজোলিউশনগুলি বিস্তারে আলোচনার পর সর্বসম্মতিতে পাস করেন:

রেজোলিউশন-১: আমরা প্রধান বিচারপতির এই ঘোষণাকে ধিক্কার জানাই। আমাদের দাবি প্রধান বিচারপতিকে এই কথা বলার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।

রেজোলিউশন-২: কৃষিতে নারীদেরও কৃষক বলে স্বীকৃতি দিতে হবে। কৃষিতে নারীদের শ্রমের সঠিক মুল্য দিতে হবে।  পারিবারিক শ্রমকে কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, যা আজও অদৃশ্য বা ‘নো ওয়ার্ক’ বলে গণ্য করা হয়। আমরা আরও দাবি করি যে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সমান কাজের জন্য ন্যায্য ও সমান মজুরি দেওয়া হোক।

রেজোলিউশন-৩: তিনটি কৃষিআইন অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। আমরা দাবি জানাই সার্বজনীন রেশন বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। যাতে প্রত্যেকে খাদ্যশস্য, ডাল, তেল, ডিম, আলু এবং অন্যান্য সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস পায়।

রেজোলিউশন-৪: কৃষি আইনগুলির বাতিল করে এমন আইন পাস করুন যা মহিলাদের সমস্ত কৃষি সম্পত্তির যৌথ মালিক করে তোলে। জমিতে মহিলাদের অধিকার দেওয়ার জন্য এফআরএ (FRA) বাস্তবায়ন করুন।

রেজোলিউশন-৫: আমরা কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে আমাদের সকল উৎপাদনে এমএসপি এবং গ্যারান্টেড বিকেন্দ্রিত সংগ্রহ কেন্দ্র চাই।

রেজোলিউশন-৬: নিশ্চিত করুন যে এমএসপি গণনা করার সময় কৃষিতে সমস্ত শ্রমিকের শ্রমের যথাযথ মূল্য যোগ করা হবে। সমস্ত কৃষিশ্রমিককে উপযুক্ত মজুরি দেওয়া হবে তা নিশ্চিত করতে হবে।

রেজোলিউশন-৭: এই আইনটি বাতিল করুন এবং আমাদের গ্রামেই আরও বেশি করে কাজের ব্যবস্থা করুন যাতে বাইরে কাজের সন্ধানে না যেতে হয়।

রেজোলিউশন-৮: আমরা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এবং মহিলাদের দেওয়া সমস্ত লোন মকুব করার দাবি করছি। লোন দেবার সময় আমাদের কাছ থেকে কোনরকম কাট মানি বা কমিশন নেওয়া চলবে না। সরসারি নিয়ম মেনে লোন দিতে হবে।

ফাইনাল রেজোলিউশন: তিনটি কৃষি আইন বাতিল করতে হবে। সমস্ত  ফসলের জন্য উৎপাদন খরচের অন্তত ১.৫ গুণ এমএসপি ঘোষণা করতে হবে। সমস্ত গ্রাম পঞ্চায়েত গুলিতে বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে ফসলের বিকেন্দ্রীভূত বিক্রয়ের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। এটি কেন্দ্র সরকার পরিচালিত হতে হবে।সভা শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর প্রায় ৫০০ মহিলা ধর্মতলা থেকে শিয়ালদহ মশাল মিছিল করেন।

- অখিল ভারতীয় কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতি (AIKSCC) পশ্চিমবঙ্গ শাখা এবং
বিভিন্ন নারী/নারীবাদী সংগঠনের পক্ষ থেকে জারি করা বিবৃতি।

বিস্তারিত রিপোর্ট
 

gggdrr

দিল্লির সিংঘু, টিকরি বর্ডারে গড়ে উঠেছে কৃষকদের কমিউন। যেখানে পুরুষেরা শিখে নিয়েছে কি করে রুটি বানাতে হয়, ছোট শিশুরা হাতে হাতে কাজ করছে মা/বাবার সাথে। ভগৎ সিং-এর নামে লাইব্রেরী তৈরি হয়েছে, সেখানে আন্দোলনের ফাঁকে চলছে নানা বই পড়া। দিল্লিতে আন্দোলনে আসার আগে পাঞ্জাব হরিয়ানার মহিলারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে রসদ সংগ্রহ করেছেন। পাঞ্জাব-হরিয়ানায় বিয়েবাড়ির সঙ্গীত হয়ে উঠেছে মোদি-শাহ বিরোধী গান। সুদূর মহারাষ্ট্র থেকে আসা ১৫০-২০০ টাকায় ক্ষেত মজুরি করা আদিবাসী মেয়ে সবিতা গুঞ্জল মহারাষ্ট্র থেকে দিল্লি ৭৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে দিতে মোদী আম্বানির বিরুদ্ধে গান বেঁধেছে। দিল্লির বর্ডারে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জসবির কাউর সহ অন্যান্য কৃষক নেত্রী। এরা সবাই এক নয়া ইতিহাস রচনা করছেন।

অথচ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দিল্লির কৃষক আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণকে অপমান করে বললেন “কেন নারী এবং প্রবীণদের এই প্রতিবাদে রাখা হচ্ছে?” বয়স্ক ও নারীদের ‘ঘরে ফেরত পাঠানোর’ কথাও তিনি উল্লেখ করেন। পরে কৃষক আন্দোলনের মামলার শুনানির সময়ে আইনজীবী এপি সিং মহিলা এবং প্রবীণদের সরিয়ে নেবার কথা বললে বোবদে এপি সিং-এর বক্তব্যকে তারিফ করে বলেন যে তিনি দেখবেন যাতে এই অর্ডার পাশ করানো যায়। এই এপি সিং হলেন সেই কুখ্যাত ব্যক্তি যিনি ‘নির্ভয়া মামলা’য় ধর্ষকদের পক্ষের উকিল ছিলেন, যিনি বারবার নির্ভয়ার চরিত্রকে দায়ি করে ধর্ষকদের নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করে গেছেন। বিজেপি শাসিত মনুবাদী ব্যবস্থায় ক্ষমতায় থাকা পুরুষেরা এক সুরে কথা বলে। গত ১৪ জানুয়ারী মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহান বলেছেন নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই মেয়েদের উচিত বাইরে যাবার আগে নিজেদের নাম থানায় রেজিস্টার করে যাওয়া যাতে পুলিশ নজর রাখতে পারে তার গতিবিধির উপর। এই ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’! মেয়েদের পায়ে বেড়ি পরানোর গৈরিক জমানা!

কিন্তু প্রধান বিচারপতির এই ‘স্বনিযুক্ত অভিভাবকত্ব’ দেশের কৃষাণীরা খারিজ করে দিয়েছেন। মেয়েদের নিজেদের ইচ্ছেমতো জীবনযাপনের সম্পূর্ণ অধিকার আছে। মেয়েদের আন্দোলন থেকে সরে যেতে বলা আসলে মহিলাদের সাংবিধানিক অধিকারের উপর আক্রমণ। কৃষি আইন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কৃষিজীবীদের জন্য ক্ষতিকর এটা বুঝেই নারীরা স্বতস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে সামিল হয়েছেন, এগিয়ে নিয়ে গেছেন। প্রধান বিচারপতির এই নির্দেশ নারীদের শ্রমকে প্রান্তিক এবং অদৃশ্য করে রাখারই এক সচেতন প্রয়াস।

প্রাচীন যুগে নারীরাই প্রথম কৃষিকাজ শুরু করেছিল। বর্তমানেও কৃষিক্ষেত্রে বীজ বপন থেকে শুরু করে ফসল কাটার পরে সেটিকে প্রক্রিয়াজাত করে ঘরে তোলার প্রতিটি পদক্ষেপে নারীরাই প্রধান ভুমিকায় থাকেন। ভারবর্ষের জমি-জীবিকার লড়াইয়ের দিকে তাকালে দেখতে পাবো – মেয়েরা সর্বদা সামনের সারিতে থেকেছে। তেভাগা, তেলেঙ্গনা, নকশালবাড়ির লড়াইয়ে মেয়েদের অবিস্মরণীয় আত্মবলিদান সে কথাই বলে। সেই সব আন্দোলনে কৃষক মহিলারাই গ্রামে গ্রামে প্রতিরোধ গড়ে তুলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। মনে করুন সিঙ্গুর–নন্দীগ্রামের মেয়েদের কথা যারা শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে পুরুষদের আগে এসে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ২০১৫ সালে মুন্নারে চা বাগানের মহিলা শ্রমিকেরা একাই লড়াই করে মালিকশ্রেণীকে বাধ্য করেছিলো ৮.৩৩ শতাংশ হারে বোনাস এবং ১১.৬৭ শতাংশ এককালীন বাড়তি ভাতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করতে। এনআরসি, সিএএ বিরোধী আন্দোলনে মহিলারাই ফ্যাসিস্ত সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

কৃষিকাজে কৃষাণীদের অবদানকে শ্রদ্ধা জানাতে ১৮ জানুয়ারী মহিলা কিষাণ দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দিল্লির আন্দোলনকারীরা। ঐ দিন দিল্লির সিংঘু , টিকরি, গাজিপুর বর্ডার সহ সারা দেশের সাথে পশ্চিমবঙ্গেও পালিত হল মহিলা কিষাণ দিবস। এই দিন মহিলাদের সংগঠিত প্রতিবাদ আরেকবার প্রমাণ করলো মনুবাদী পিতৃতান্ত্রিক শাসকরা যতই মেয়েদের ঘরে ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করুক মেয়েরা সেই শিকল ভেঙ্গে বারবার বেরিয়ে আসবে।

dddg

 

দিল্লিতে চলমান কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে এআইকেএসসিসি সংগঠনের উদ্যোগে কলকাতার ধর্মতলায় ওয়াই চ্যানেলে ‘অন্নদাতাদের সংহতিতে বাংলা’ – এই ব্যানারে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচী চলেছে। সেই ধর্ণামঞ্চেই  এআইকেএসসিসি, আইপোয়া, শ্রমজীবী মহিলা সমিতি, এআইআরডব্লিউও, এমএসএস, জয় কিষাণ আন্দোলন – সহ বিভিন্ন নারী সংগঠনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হল ‘মহিলা কৃষক–মজুর বিধানসভা’। সামিল হয়েছিলেন বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কৃষক ও কৃষিমজুর মহিলারা। কৃষি আইন বাতিল, মহিলাদের কৃষক হিসাবে স্বীকৃতি, কৃষিজীবী মহিলাদের খাদ্য, স্বাস্থ্য এবং সম মজুরি, জমির যৌথ মালিকানা, ঋণ মুক্তি, সমস্ত ফসলের জন্য উৎপাদন খরচের অন্তত ১.৫ গুণ এমএসপি (ন্যূনতম সহায়ক মূল্য) ঘোষণা  করার দাবি জানিয়ে দশটি প্রস্তাবনা পেশ করা হয়।

বিধানসভা পরিচালনার ক্ষেত্রে মঞ্চে স্পিকারের দায়িত্বে ছিলেন সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্ত। ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্বে ছিলেন জয় কিষাণ সংগঠনের রত্না পাল, এআইআরডব্লিউও-র শিখা সেন রায় এবং পশ্চিমবঙ্গ শ্রমজীবী মহিলা সমিতির অমৃতা দে।

প্রস্তাবনার বিষয়ে বিভিন্ন সংগঠন থেকে মহিলারা বক্তব্য রাখেন। শ্রমজীবী মহিলা সমিতির নমিতা হালদার বলেন “আমরা মেয়েরা কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করি, ক্ষেত মজুরি করি, এই আইন এলে জমি পুঁজিপতিদের হাতে চলে যাবে। চুক্তি চাষ হবে। ফলে আমরা কাজ হারাবো, কাজের ন্যায্য দাম পাবো না। দঃ ২৪ পরগণার গ্রামে একটি কোম্পানি মেয়েদের বাধ্য করছে ফুল চাষ করতে, কিন্তু ফুল চাষ করে লাভ হয় না। ধান, কড়াই, শস্য চাষে কিছুটা লাভ হয়। তাই আমরা মনে করি এই আইন এলে মেয়েদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে। কারণ ছেলেরা কাজে বাইরে চলে গেলে আমরাই জমি লিজ নিয়ে চাষ করি।” ভাঙড় থেকে আসা জাহানারা বিবি বলেন, “যে সব মহিলাদের স্বামী ছেড়ে যায় বা মারা যায় তারা অনেকেই দিন মজুরি করে সংসার চালায়। আমাদের কাজ ঠিক মতো হয় না, এই আইন এলে কোল্ড স্টোরেজে শস্য মজুত রেখে দাম বাড়িয়ে দেবে। আমরা গরিব মহিলারা তখন কি করে খাবো?”

সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে রাজ্য নেত্রী কাজল দত্ত এবং মিড ডে মিল কর্মী অঞ্জনা মন্ডল বক্তব্য রাখেন। কাজল দত্ত বলেন মহিলাদের শ্রমকে সবসময় অদৃশ্য করে রাখা হয়, মহিলাদের ‘কৃষকের’ মর্যাদা দেওয়া হয় না। আমাদের লড়াই করে সেই অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে। অঞ্জনা মন্ডল বলেন কোভিড মহামারীর জন্য লকডাউনের সময় মেয়েরা কাজ হারিয়েছেন, জমির ফসল বিক্রি হয়নি, তাই যে মেয়েরা লোন নিয়েছিলেন তাদের ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা নেই। সেই জন্য সরকারের সেই ঋণ মকুব করে দেওয়া উচিত।

এছাড়াও সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, নিখিল বঙ্গ মহিলা সংঘ, পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতির থেকে বক্তব্য রাখেন রাজ্য মহিলা নেতৃত্ব।

সুন্দরবন থেকে সমাবেশে যোগ দিতে আসা মহারানী সর্দার ও মায়া সর্দার গানে গানে সরকারের নানা নির্যাতন এবং শোষণে গরিব মানুষের দুর্দাশার কথা ফুটিয়ে তোলেন।

প্রস্তাবনা পেশ শেষ হলে সমাবেশে উপস্থিত মহিলারা হাত তুলে এবং করতালিতে সমর্থন জানিয়ে সেটি পাশ করেন। মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয় এই প্রস্তাবনার কপি দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। সভা শেষে মহিলাদের এক মশাল মিছিল ধর্মতলা থেকে মৌলালী আসে। জ্বলন্ত মশাল হাতে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত মহিলারা বুঝিয়ে দিলেন কৃষিতে, শ্রমে, আন্দোলনে মহিলারা ছিলেন, আছেন, থাকবেন।

– মিতালি বিশ্বাস  

condedd

অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ তহবিল সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো। আর, ভারতের রাষ্ট্রপতি ঐ মন্দির নির্মাণ তহবিলে অর্থদান করলেন। যে পদে আসীন হতে শপথ নিতে হয় সংবিধান নির্দেশিত “ধর্মনিরপেক্ষতা” অনুসরণ করতে প্রশ্নাতীত অনুগত থাকার, রামনাথ কোবিন্দ পাঠ করেন সেই শপথবাক্য, শুধু তাই নয়, একই শপথ পাঠ করিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সদস্যদেরও, সর্বোচ্চ রাষ্ট্রপ্রধান সেই সবকিছুকে পরিণত করলেন ছেঁড়া কাগজে। এই সাংবিধানিক লঙ্ঘন হল এমন এক সময়ে যখন ভারতের গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক দিবস উদযাপন দোড়গড়ায়। রাষ্ট্রপতির এই ধর্মীয় পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ, যা বাস্তবে পৃষ্টপোষকতারই স্বার্থবাহী, ধিক্কারযোগ্য স্খলনেরই নির্দিষ্ট প্রকাশ। বিগত ২০২০-র জানুয়ারী থেকে গোটা দেশ প্রত্যক্ষ করে আসছে দুই সম্পূর্ণ বিপরীতের সংঘাত। একদিকে কেন্দ্রের মোদী সরকার সংবিধানের একের পর এক এমন সব সংশোধনের পদক্ষেপ শুরু করে যা সরকার ও সংবিধানের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ণ করে। নাগরিকত্বের প্রশ্নে বৈষম্য ও বিভাজনদুষ্ট এনআরসি-এনপিআর-সিএএ প্রবর্তনের অপপ্রয়াস, কাশ্মীরি জনগণের সাত দশকের স্বতন্ত্র স্বায়ত্ততার অধিকার সংযুক্ত ৩৭০ ধারা খারিজ করা ইত্যাদি হল সেই ন্যক্কারজনক পরিঘটনার পরিচয়। এইসমস্ত রাষ্ট্রীয় অপরাধ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমন্ডলের সাম্প্রদায়িকীকরণকে আরও মদত যোগায়। তাতে বাতাস যোগায় উপরন্তু সুপ্রীম কোর্টের চূড়ান্ত পক্ষপাতদুষ্ট অযোধ্যা রায়। বাবরি মসজিদ ধ্বংস করাটা অপরাধ হয়েছিল স্বীকার করেও কোর্ট আদেশ দিয়ে দেয় ধ্বংসস্তূপের ওপরই মন্দির নির্মাণের! সরকার ও সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের এই যুগলবন্দী সংখ্যাগুরুবাদী আচরণে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার বারবার হয়েছে বিপন্ন। এক সেনা অধিনায়ককেও দেখা গিয়েছিল হিন্দুত্বের কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করতে। রাজ্যে রাজ্যে রাজ্যপালদের হিন্দু আচার-পার্বণে মেতে ওঠার প্রবণতা বাড়ছে সংবিধানকে অস্বীকার করে। বিপরীতে, ২০২০-র জানুয়ারী থেকেই গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধে জারিত দেশবাসী জারি রেখেছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের প্রয়াস। এই অভিযাত্রায় গত ২৬ জানুয়ারী উঠেছিল গণতন্ত্র ও সংবিধান বাঁচাও শপথ নেওয়ার জনজোয়ার। বিগত অতিমারী ও লক ডাউনের নজিরবিহীন কঠিনতম বছরে আরও বেশ কিছু নতুন নতুন দাবি-শ্লোগানের সংযোজন-সমন্বয়ের মাধ্যমে অব্যাহত রয়েছে লড়াইয়ের এই ধারা। একবছর আগে যার মডেল মুখ ছিল শাহীনবাগ আলোড়ন, এখন কিষাণ আন্দোলন। যে রাষ্ট্রপতি আজ রামমন্দির নির্মাণে অর্থদান করছেন, তাঁর কাছে সমান নাগরিকত্বের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিতে মোদী সরকারের উদ্যত হওয়া কোন মাথাব্যথার কারণ নয়, তিনি কৃষি ও কৃষক স্বার্থ বিরোধী তথা কর্পোরেট স্বার্থসর্বস্ব তিনটি কৃষি আইনেও কত সহজে অনুমোদন দিয়ে দেন!!! এর পরে আর বুঝতে বাকি থাকে না বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধানের ভূমিকা হিন্দুত্ব, মোদীরাজ ও কোম্পানিরাজের পক্ষপাতিত্বে ভরা।ইতিমধ্যে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ তহবিল সংগ্রহ অভিযানকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হতে শুরু করেছে সাম্প্রদায়িক হুমকি ও আক্রমণ। অর্থ সংগ্রহের এই কর্মসূচী চলবে গোটা দেশজুড়ে দেড়মাস। তার জেরে পরিস্থিতি বিপজ্জনক হচ্ছে রাজ্যে রাজ্যে। দুই বিজেপি শাসিত রাজ্য গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশে মন্দির-পন্থীদের মিছিল বের হচ্ছে লাঠি-তরোয়াল-ঝোলা হাতে। আক্রান্ত ও রক্তাক্ত হচ্ছে সংখ্যালঘু এলাকা। গুজরাটে মৃত্যু হয়েছে ঝাড়খন্ড থেকে কাজে যাওয়া এক পরিযায়ী শ্রমিকের। আহতের ও ঘরবাড়ি ভাঙচুর হওয়ার সংখ্যা অনেক। একই ভাবে সাঙ্ঘাতিক অবস্থা তৈরি হয়েছে মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী, ইনদওর, মন্দসৌরে। ‘জয় শ্রীরাম’ আর ‘ভারত মাতা কী জয়’ ধ্বনি তুলে রক্ত ঝরানো, সন্ত্রস্ত করা ও অর্থসম্পদ সংগ্রহ হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে সামনে বিধানসভা নির্বাচন। বিজেপি খুবই আগ্রাসী। তাই এখানেও হিন্দুত্বের উন্মাদনার আগুন নতুন করে লাগানোর অপচেষ্টা দেখা দিতে পারে। রামমন্দিরের নামে টাকা তোলার অভিযানে সন্ত্রাস নামাতে পারে আরএসএস-বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। গত বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার আগে-পরে গঙ্গার দু’পাড়ের শিল্পাঞ্চলে হামলা সংঘটিত হয়েছিল সংখ্যালঘুদের ওপর। আবার বিধানসভা নির্বাচনকে নিশানা করে গ্রাম-গঞ্জে-শহর-শিল্পাঞ্চলে নেমে পড়েছে বিজেপি-আরএসএস। ওদের উদ্দেশ্য, রাজনীতির সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ। পরিবেশকে হিন্দুত্বের বিদ্বেষ-বিভাজনে বিষিয়ে দিতে ওরা অপচেষ্টা চালাচ্ছে বহুরকমভাবে। ঘৃণার বিষবাস্প ছড়াচ্ছে মতপার্থক্যের বাক স্বাধীনতাকে দাবিয়ে রাখতে। বিজেপির তৈরি ‘দেশদ্রোহী’ সংজ্ঞায়-সোরগোলে বিরুদ্ধমতকে চাপা দেওয়ার প্রয়াস প্রকট। মুক্তবুদ্ধি চর্চার, চিন্তাশীল ও স্বাস্থ্যকর তর্ক-বিতর্কের এবং মানবিক ঔদার্যের উত্তরাধিকার যে বাংলার বৈশিষ্ট্য, সেই পরিবেশ ধ্বংস করতে বেপরোয়া বিজেপি শিবির। তার জন্য হিংস্র ফাঁদ পাতা, প্ররোচনা দেওয়া, খোঁচানো শুরু হয়ে গেছে। হুমকিতে আক্রান্ত হচ্ছেন বিদ্বৎসমাজ, নাগরিক সমাজ ও শিল্পসাহিত্য সমাজের পরিচিতজনরা। এমনকি নানা অজুহাতে যৌনগন্ধী আক্রমণের ভয় দেখানো হচ্ছে নির্ভীক যুক্তিবাদী অভিনেত্রীদের। ওঠানো হচ্ছে ‘গোলি মারো … ...’ আওয়াজও। বিজেপির পাতা ফাঁদে জড়িয়েছে টিএমসি। তার বদলার নামে সুযোগ নিচ্ছে বিজেপি। যে কোনো বিরোধিতাকে উড়িয়ে দাও, ধ্বংস কর—এটাই বিজেপির দৌরাত্ম্য। পাশাপাশি, দুঃসাহস দেখাচ্ছে  বাম ভোট রামপন্থীদের দিতে ডাক দেওয়ার !

এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই একমাত্র বিষপ্রতিষেধক। সামিল হতে হবে সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে।

gaaaarr

অর্ণব গোস্বামী — ভারতের কুখ্যাত ‘গোদী মিডিয়া’র সেই ভয়ঙ্কর কুচুটে মুখপাত্রটি — অবশেষে নিজের ঔষধে নিজেই ধরাশায়ী! ‘গোদী মিডিয়া’ — সংবাদ মাধ্যমের একটি ধারা যা শুধু গণতন্ত্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের/সরকারের হয়ে কাজই করে না, ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলোর সঙ্গে অশুভ গোপন আঁতাতের মাধ্যমে চব্বিশ ঘণ্টা ঘৃণা ও মিথ্যা ছড়ানো, সত্যকে বিকৃত করা এবং যে কোনও বিরোধিতাকে কুৎসিতভাবে চিত্রিত করার উদ্দেশ্যে প্রচার যুদ্ধে হিটলারের ঝটিকাবাহিনীর শাণিত ক্ষিপ্রতায়, চাতুর্যে কাজ করে যায়। অনেকদিন ধরে এই ব্যক্তিটি মেল ও কথোপকথনের (চ্যাট) বাছাই করা তথ্য ফাঁসকে কাজে লাগিয়ে মোদী-শাহ রাজ এবং সঙ্ঘ বাহিনীর হয়ে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ চালিয়ে যাচ্ছে। হোয়াটস্অ্যাপ কথোপকথনের সময় সে নিজেও বুঝতে পারেনি যে ওটা তাকেই একদিন ঐ পর্যায়ে টেনে নামাবে এবং স্বঘোষিত ‘নির্ভীক সৎ সাংবাদিকের’ ছদ্মবেশের আড়ালে তার মজ্জায় মজ্জায় নির্লজ্জ বিবেকহীন ক্ষমতা-দালালের আসল চেহারাটা উন্মোচিত করে দেবে।

আইন অবশ্য তাকে ধরে ফেলার চেষ্টাটা শুরু করেছে ইদানিং। মহারাষ্ট্র পুলিশ ২০২০’র নভেম্বরে তাকে ২০১৮’র এক আত্মহত্যায় প্ররোচনা মামলায় মূল অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেপ্তার করে। ইন্টিরিয়র ডিজাইনার অন্বয় নায়ক এবং তার মা ২০১৮তে আত্মঘাতী হন। তার আগে অর্ণব গোস্বামী ও রিপাবলিক টিভি-র বিরুদ্ধে, তাদের প্রাপ্য বকেয়া ৫•৪০ কোটি টাকা না মিটিয়ে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ জানিয়ে গেছেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট, সাম্প্রতিক কালে সাজানো মিথ্যা অভিযোগ এবং দানবীয় আইনের শিকার সমস্ত সাংবাদিক, লেখক, আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মীদের জামিনের আবেদন খারিজ করে দিচ্ছে, কিন্তু বিপরীতে অর্ণব গোস্বামীকে তারা দারুণ তৎপরতায় জামিন মঞ্জুর করেছে।

রিপাবলিক টিভি যখন ভারতে তাদের রুটিনমাফিক বিদ্বেষ ও মিথ্যা ফেরি করেও পার পেয়ে গেছে, তাদের হিন্দি চ্যানেল ‘রিপাবলিক ভারত’কে ব্রিটিশ টিভি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অফকম “পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ ভাষণ, এবং পাকিস্তানি জনসাধারণের প্রতি মর্যাদাহানিকর ও অভদ্র আচরণের” জন্য জরিমানা করেছে। কিন্তু এখানে ভারতে, আমরা এখন জানি অর্ণবের রিপাবলিক টিভি কীভাবে  ভারতের টিভি রেটিং এজেন্সি ব্রডকাস্ট অডিয়েন্স রিসার্চ কাউন্সিল (বিএআরসি)-এর সঙ্গে সুপরিকল্পিত ধারাবাহিক গোপন আঁতাতের সুবিধা ভোগ করে চলেছে! বিএআরসি’র প্রাক্তন সিইও পার্থ দাশগুপ্ত, অধুনা সামনে আসা টিআরপি (টেলিভিশন রেটিং পয়েন্টস) কেলেঙ্কারির সূত্রে বর্তমানে জেলবন্দি। আর মুম্বাই পুলিশ, ২০১৭ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে অর্ণব গোস্বামী ও পার্থ দাশগুপ্তার মধ্যে হোয়াটস্অ্যাপ কথোপকথনের ৫০০ পাতার যে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট পেশ করেছে, তার দরুন আমাদের কাছে এখন রয়েছে রিপাবলিক টিভি-র কাজকর্ম সম্পর্কে বিস্ফোরক সব তথ্য।

অর্ণবের এইসব খোশগল্প শুধু যে রিপাবলিক টিভি এবং বিএআরসি’র মধ্যে গোপন আঁতাত তথা রিপাবলিক টিভি-র বাণিজ্যিক সুবিধার্থে ভারতের টিআরপি তথ্যভাণ্ডারে অন্যায় হস্তক্ষেপের বিষয়টি তুলে ধরেছে তাই-ই নয়, মূল পাণ্ডা হিসেবে অর্ণবের যে ব্যবস্থাপনায় মোদী-শাহ কোম্পানি লাগাতার অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে তার অবয়বগত একটা নিখুঁত বিশ্লেষণও ধরা পড়েছে।

অর্থনীতিগত দিক থেকে দেখলে, এই টিআরপি কেলেঙ্কারিকে মনে হবে, “ভেতরের লোকের দেওয়া তথ্য” সুপরিকল্পিতভাবে সুদক্ষ চাতুর্যে কাজে লাগানোর ভিত্তিতে যেসব কেলেঙ্কারি হয়েছে — যেমন ভারতের কুখ্যাত শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি বা ব্যাঙ্ক জালিয়াতি — তার থেকে বেশি কিছু নয়। কিন্তু এটাই সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রা পেয়ে যায় যখন আমরা বুঝতে পারি যে এই “ভেতরের তথ্য”-র সঙ্গে সরকারের সর্বোচ্চ স্তরের সামরিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা জড়িয়ে আছে, যখন অর্ণব গোস্বামীকে পুলওয়ামার মর্মন্তুদ ঘটনাকে “আমাদের দারুণ জেতা যুদ্ধ” বলে উল্লেখ করতে শুনি বা যখন আমরা বুঝে ফেলি যে অর্ণব গোস্বামীর কাছে বালাকোট বিমান আক্রমণ বা ৩৭০ ধারা বিলোপের মতো গোপন সরকারী তথ্য সম্পর্কেও আগাম খবর থাকে! এটা ভেবে আরও দুশ্চিন্তা হয় যে এনআইএ (ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি) কৃষক আন্দোলনের নেতাদের নিশানা করতে ব্যস্ত, অথচ অর্ণবের আলাপচারিতায় জাতীয় নিরাপত্তা উল্লঙ্ঘনের যেসব স্পষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে সেগুলো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হচ্ছে!

আমেরিকায় ট্রাম্প-অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায় গোটা দুনিয়া  সবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ট্রাম্পের শয়তানি জমানার দ্বিতীয়বার ফিরে আসার ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে আমেরিকার মুক্তির ব্যাপারে একটা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। অর্ণবের আড্ডায়(আলাপে) ধরা পড়েছে – কীভাবে ভারতে তার উল্টোটাই ঘটছে, কীভাবে জনমত তৈরি ও সুকৌশলে পাল্টে দেওয়ার উদ্দেশ্যে গোয়েবলসীয় গোদী মিডিয়া এবং হিটলারি মোদী রাজ একজোট হয়ে পুলওয়ামা ও বালাকোটের মতো ঘটনাগুলোকে চরম বিবেকহীনতায় কাজে লাগাচ্ছে। মোদী নির্লজ্জভাবে পুলওয়ামার শহীদদের নাম করে যখন ভোট চাইছিল, ঠিক তখনই অর্ণব ওর চ্যানেলের দর্শক বাড়ানো এবং সঙ্ঘী প্রচারযন্ত্র হিসেবে চ্যানেলটাকে আরও জোরালো করে তোলার জন্য নির্মম বিবেকহীনতায় তাদের মৃত্যুকে কাজে লাগাচ্ছিল। ভারতে গণতন্ত্রের লড়াইকে, সংবাদমাধ্যমের প্রভাবশালী অংশ, বিশেষ করে দূরদর্শন এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুষ্কর্মের এই অশুভ আঁতাতের মোকাবিলা করেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

অর্ণবের কথোপকথন ইউপিএ জমানার কুখ্যাত রাদিয়া টেপের থেকেও বেশি বিস্ফোরক এবং ক্ষতিকর। রাদিয়া টেপ ছিল সাংবাদিককুল এবং কর্পোরেট লবির লোকজন যারা মন্ত্রী পর্যায়ের নিয়োগ ও নীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিল তাদের সম্পর্কে। আর অর্ণবের আলাপচারিতা হল সংবাদমাধ্যমকে কর্পোরেট আগ্রাসন এবং ফ্যাসিবাদী প্রচার যুদ্ধের একটি হাতিয়ারে রূপান্তরিত করা সম্পর্কে। মোদী সরকারের ধ্বংসাত্মক কৃষি আইনের বিরুদ্ধে চলমান কৃষক আন্দোলন এই গোদী মিডিয়াকে আদানি-আম্বানি কোম্পানি রাজের এবং স্বৈরাচারী মোদী সরকারের সঙ্গে সঙ্গে আরেক মূল প্রতিবন্ধক হিসাবে চিহ্ণিত করেছে। এই টিআরপি কেলেঙ্কারির নতীজা আইনি পথে শেষ পর্যন্ত যাই হোক না কেন, অর্ণব-চ্যাটকে কর্পোরেট শক্তি, স্বৈরতন্ত্রী সরকার এবং আক্রমণাত্মক পার্টিজান মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্য, ন্যায় ও গণতন্ত্রের সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কার্যকরী হাতিয়ার হিসাবে অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে।

(এমএল আপডেট, সম্পাদকীয়, ১৯-২৫ জানুয়ারী, ২০২১)    

aaaaddar

কোম্পানি রাজের স্বার্থে কৃষকের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে দিল্লী সীমান্তে কৃষকের অবস্থান আন্দোলন প্রায় পঞ্চাশ দিন পেরিয়ে এল। সরকারের সাথে কয়েক দফা এর মধ্যে কৃষক নেতাদের বৈঠক হয়েছে। এই সব ব্যর্থ বৈঠকের মধ্য দিয়ে একটাই বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। সরকার এই কৃষক প্রতিরোধের ফলে যথেষ্ট কোণঠাসা এবং লাঠি-গুলি চালিয়ে এই আন্দোলনকে দমন করার বিকল্প এই মুহূর্তে বিজেপির মতো চূড়ান্ত দমনকারী সরকারের কাছেও খোলা নেই। তাই আলাপ আলোচনার একটা ভান বজায় রাখা আর অপেক্ষা করা কবে কৃষক ধৈর্য্য হারাবে বা ক্লান্ত হয়ে পড়বে, কবে কৃষকের ঐক্যে ফাটল ধরবে, মনোবলে টান পড়বে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সরকারের সে গুড়ে বালি।
সরকারের হয়ে এবার মাঠে নেমেছে সর্বোচ্চ আদালত। সাময়িক স্থগিতাদেশ জারি করে কোর্ট বলেছে এ স্থগিতাদেশ কৃষি আইনের উপর নয়, কৃষি আইনের বাস্তবায়নের উপর। কিন্তু এই স্থগিতাদেশের সাথে আদালত এটাও বলেছে যে এই পর্যায়ে পুরনো ন্যূনতম সমর্থন মূল্য প্রণালী জারি থাকবে আর এই আইনের ফলশ্রুতি হিসেবে কোন কৃষকই জমি হারাবে না। তবে সরকার যে বলছিল যে নতুন আইনের সাথে এমএসপির কোনো সম্পর্ক নেই, আর পুরো ব্যাপারটাই নিছক ফসল সংক্রান্ত, জমি হারাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না? কোর্টের এই স্পষ্টীকরণে সরকারের বক্তব্য আরও সন্দেহজনক হয়ে উঠল না কি?

কোনো আইন সংবিধানসম্মত কিনা তা বিচার করার এক্তিয়ার অবশ্যই সর্বোচ্চ আদালতের রয়েছে। কিন্তু স্থগিতাদেশে আইন সম্পর্কে কোনো কথাই বলেনি সুপ্রিম কোর্ট। পুরো আদেশটাই এসেছে সরকার ও আন্দোলনরত কৃষকদের মধ্যে বর্তমান সংঘাতে যবনিকাপাত কী করে ঘটানো যায় সেই প্রচেষ্টা থেকে। সরকারের বদলে কৃষকদের বলা হলো কোর্ট কর্তৃক ঘোষিত চার সদস্যের কমিটির কাছে নিজেদের অভিযোগ তুলে ধরতে। কমিটিকে বলা হলো দু-মাসের মধ্যে কোর্টের কাছে আলোচনার রিপোর্ট পেশ করত। অর্থাৎ বল এখন কমিটি ও কোর্টের কোর্টে। সরকার যেভাবে পুঁজিপতিদের ঋণ মকুব করে দেয়, সেভাবেই কোর্ট কি এবার সরকারের দায়িত্ব মকুব করে দিল?

কোনো আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার যদি জনগণের বিরোধিতার সম্মুখীন হয় তাহলে সেই বিরোধ মোকাবিলার দায়িত্ব সেই সরকারেরই। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের কথাবার্তা যদি আটকে যায় তাহলে সেই কথাবার্তাকে ফলপ্রসূ করানোর জন্য পরামর্শ দেওয়া যেতেই পারে, কিন্তু সরকারকে সেই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে পুরো ব্যাপারটা আদালতের নিজের হাতে তুলে নেওয়াটা কি আদৌ সংবিধানসম্মত? সরকার, সংসদ ও আদালত, এই তিন স্তম্ভের মধ্যে ক্ষমতা ও দায়িত্বের যে সুষ্ঠ বন্টনের উপর ভিত্তি করে সংবিধান মেনে গণতন্ত্র পরিচালিত হওয়ার কথা, সেই মূল ব্যাপারটাই কি সুপ্রিম কোর্ট এবার গুলিয়ে দিতে শুরু করেছে?

সুপ্রিম কোর্ট কৃষকদের বলেছে সাময়িক স্থগিতাদেশ ও কমিটি গঠনকেই প্রতিবাদের জয় হিসেবে মেনে নিতে। মোদী সরকার বলছে কৃষকেরা আইন না বুঝে নাকি বিভ্রান্ত হয়ে প্রতিবাদে নেমেছে। তাই আলোচনার নামে কৃষকদের ক্লাস নেওয়ার চেষ্টা করেছে সরকারের মন্ত্রীরা। এবার ক্লাস শুরু হলো আন্দোলন নিয়ে। সুপ্রিম কোর্ট চায় না মহিলা, বৃদ্ধ ও শিশুরা অবস্থান আন্দোলনে অংশ নিক। এক উকিল যিনি বলেছিলেন নির্ভয়ার মার কাছে জানতে চাওয়া উচিত অত রাতে মেয়ে দিল্লীর রাস্তায় কী করছিল, বলেছিলেন নিজের মেয়ে বা বোনের প্রাক-বৈবাহিক সম্পর্কের খবর পেলে পুরো পরিবারের সামনে নিজের খামারবাড়িতে পেট্রোল ঢেলে তাকে পুড়িয়ে মারবেন, এবার তিনি সুপ্রিম কোর্টকে জানালেন যে তাঁর মক্কেল কৃষক সংগঠন নাকি কথা দিয়েছে যে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা সবাই বাড়ি ফিরে যাবে। সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে ধন্যবাদ জানালেও সংশ্লিষ্ট কৃষক সংগঠনটি এই তথ্যকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। কৃষকেরা এবার ১৮ জানুয়ারী গোটা দেশ জুড়ে কৃষক রমণীদের প্রতিবাদের ডাক দিয়েছেন।

সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশের সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়টি হল চার সদস্যের নবগঠিত কমিটি। যে চার জন সদস্যকে কোর্ট বেছে নিয়েছে তাদের দুজনের পরিচয় কৃষি অর্থশাস্ত্রী হিসেবে আর অন্য দুজন হলেন দুই কৃষক সংগঠনের নেতা। কিন্তু এঁদের সকলের সাধারণ পরিচয় হলো এঁরা মোদী সরকারের কৃষি নীতি ও নতুন কৃষি আইনের কট্টর সমর্থক। কমিটির প্রথম বৈঠক এখনও হয়নি, কিন্তু কমিটির একজন মনোনীত সদস্য বিবৃতি দিয়ে কমিটি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। ভূপিন্দার সিং মানের এই সরে আসা নিছক তথ্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বিবৃতিটিও যথেষ্ট অর্থবহ। মান বলছেন তিনি এমন কিছু করতে চান না যাতে কৃষক এবং পাঞ্জাবের স্বার্থ বিপন্ন হয়। নিজের অবস্থান স্পষ্ট করার সাথে সাথে কমিটি সম্পর্কেও এই মন্তব্য যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ। মান-এর এই মন্তব্যকে আমরা মিলিয়ে নিতে পারি মন্ত্রী নীতিন গডকারির সাম্প্রতিক এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের সাথে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার ‘আইডিয়া এক্সচেঞ্জ’ শীর্ষক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে সাম্প্রতিক কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে গডকারির বক্তব্য খুব স্পষ্ট। তাঁর মতে মূল সমস্যা হলো ভারতে অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন এবং বাজার দরের চেয়ে বেশি এমএসপি। ফলে সরকারের কাছে সমাধানসূত্র হলো খাদ্যশস্য উৎপাদন কমিয়ে এনে জৈব ইন্ধন উৎপাদনে জোর বাড়ানো। সোজা কথায় ধান গম চাষের বদলে ইথনল উৎপাদনে মনোযোগী হওয়া। কৃষক যখন কোম্পানির ইচ্ছে, হিসেব এবং নির্দেশ মতো চুক্তিচাষিতে পরিণত হবে তখন কৃষির চরিত্র কী হবে সে ব্যাপারে যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ এই ইশারা।

কৃষি আইনের ঘোষিত উদ্দেশ্য কৃষককে স্বাধীনতা দেওয়া, কৃষকের আয় বাড়ানো। কিন্তু সবুজ বিপ্লবের একদা বহু প্রশংসিত ঘাঁটি পাঞ্জাবের অভিজ্ঞ কৃষকের গডকারির ঐ ‘আসল কথা’ বুঝতে অসুবিধে হয়নি। কৃষিতে আদানি আম্বানির কোম্পানি রাজ প্রতিষ্ঠা মানে কৃষকের শেষ স্বাধীনতাটুকু কেড়ে নিয়ে তাকে কোম্পানির ভাড়াটে বানিয়ে দেওয়া। মূল্য নির্ধারণ ও শস্য ক্রয়ের প্রক্রিয়া থেকে সরকারের সরে যাওয়া মানে কৃষকের ইচ্ছে মতো মূল্য নির্ধারণ ও শস্য বিক্রয় নয়, বাজারের নিয়ম অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ ও কেনাবেচা। আর গডকারি ঠিকই বলেছেন বাজারের দাম এমএসপি বা সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম সমর্থন মূল্য থেকে গড়ে যথেষ্ট কম। যে বাজারে কোম্পানি ক্রেতা আর কৃষক বিক্রেতা সেখানে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে বাজার বিক্রেতা নয়, ক্রেতার কথাতেই চলবে। আর তাই পাঞ্জাবের পোড় খাওয়া কৃষক ‘স্বাধীনতা ও আয় বৃদ্ধির’ ছেঁদো প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পা দিতে নারাজ।

ভারতীয় কৃষিতে আজ পর্যন্ত চোখে পড়ার মত সাফল্য বলতে সবুজ বিপ্লবের কথাই আলোচিত হয়েছে। আর স্বাধীন ভারতে আত্মনির্ভরতার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব বলতে আমেরিকার গমের উপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ওঠা। এই কৃতিত্বের মূলে পাঞ্জাব। সবুজ বিপ্লবের মডেল আজ অবশ্যই গভীর সংকটে – প্রাকৃতিক পরিবেশের অবনতি, জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান কৃষি খরচ, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানাবিধ বিপদ সংকেত কৃষি বিকাশের নতুন মডেলের দাবি জানাচ্ছে। মোদী সরকারের নয়া কৃষি আইনে এই বিকল্প পথের অনুসন্ধানের লেশমাত্র নেই। যা আছে তা হল কৃষিকে বৃহৎ ব্যবসায় রূপান্তরিত করার মরিয়া প্রচেষ্টা। তার ফলে আদানি আম্বানির মুনাফার পাহাড় আরও উঁচু হবে, আর খাদ্যশস্যের ব্যাপারে আমরা হয়তো আবার আমদানি নির্ভর হয়ে পড়ব। ক্ষুধার প্রতিযোগিতায় ভারত হয়তো আরও কয়েক ধাপ নীচে নেমে যাবে। কৃষির সঙ্গে যুক্ত ব্যাপক জনগণের দারিদ্র্য হয়ে উঠবে গভীরতর।

তাই দিল্লী সীমান্তের কৃষকের আন্দোলন আজ আর রাজধানীর সীমানায় আটকে নেই। সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে বাঁচাতে ও কৃষক আন্দোলনকে ঠেকাতে যাই ফন্দি আঁটুক, দেশের ব্যাপক মানুষ আজ কৃষকের সাথে। কোম্পানি রাজের বিরুদ্ধে, কৃষকের সাথে; মোদী সরকারের গুন্ডামির বিরুদ্ধে, সংবিধানের পথে গণতন্ত্রের সাথে – এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসে এটাই আসমুদ্র হিমাচল ভারতবাসীর মনের কথা। কৃষক জিতলে দেশ জিতবে, আমরা সবাই জিতব। তাই লড়তেই হবে, ছিনিয়ে আনতেই হবে জনগণের জয়।

- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য    

avvvaa

দিল্লির কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে সারা ভারত কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির (AIKSCC) পশ্চিমবঙ্গ শাখার ডাকা তিনদিন ব্যাপি অবস্থানে ২০ জানুয়ারীর প্রথম দিনে যোগ দিলেন পশ্চিমবাংলার কৃষক জনগণ, অবস্থানে সংহতি জানাতে ছাত্র-যুব-মহিলা-শ্রমিক তথা বাংলার সর্ব স্তরের মানুষ সামিল হলেন। হুগলি, বর্ধমান, নদীয়া জেলার সারা ভারত কিষাণ মহাসভা ও আয়ারলার অন্তর্ভুক্ত ক্ষেতমজুর ও কৃষকেরা এই অবস্থানে যোগদান করেন। শিয়ালদহ ও হাওড়া থেকে আসা মিছিল ভরিয়ে তুলেছিল রাণী রাসমণি রোডের দুটি চ্যানেল। অবস্থান মঞ্চ থেকে বিজেপি সরকারের কৃষক বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে ২৬ জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লিতে প্রস্তাবিত ট্রাক্টর রয়্যালির দিনেই পশ্চিমবাংলাতেও ট্রাক্টর টিলার নিয়ে জেলায় জেলায় ক্ষেতমজুর ও কৃষকদের মিছিলের কর্মসূচী ঘোষিত হয়। কমরেড কার্তিক পাল, অমল হালদার সহ কৃষক নেতাদের নিয়ে গঠিত সভাপতিমন্ডলী অবস্থান স্থলে সভার কাজ পরিচালনা করেন। সারা ভারত কৃষাণ মহাসভার পক্ষ থেকে কমরেড তপন বটব্যাল বক্তব্য রাখেন, তিনি কৃষি ও কৃষকের সর্বনাশা তিনটি কৃষি আইন অবিলম্বে বাতিলের দাবির প্রতি পূর্ণ সহমত জ্ঞাপন করেন, মোদি সরকারের বিপর্যয়কারী নীতিমালার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আহ্বান রাখেন। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কৃষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও জয় কিষাণ আন্দোলনের নেতা যোগেন্দ্র যাদব এবং সারা ভারত কৃষক সভার সভাপতি অশোক ধাওয়ালে বক্তব্য রাখেন।

ddgggvvva

চলমান কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানাতে এবং এ রাজ্যে কৃষক জনগণের প্রধান শত্রু বিজেপির বিরুদ্ধে সজাগতা অভিযানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গত ১৬ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত হলো এক প্রচার যাত্রা। ধবুলিয়া ব্লকের বিভিন্ন এলাকায় এই প্রচার যাত্রা গ্রামাঞ্চল পরিক্রমা করে। ধুবুলিয়া অঞ্চলের হাসাডাঙ্গা, বাহাদুরপুর, ভক্তিনগর, পন্ডিতপুর, বনগ্রাম সহ বিভিন্ন গ্রামগুলিতে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখা, প্রচারপত্র বিলি করা, জনগণের সাথে কথা বলা প্রভৃতির মধ্য দিয়ে  নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা জনসংযোগ অভিযান সংগঠিত করে। কোম্পানিরাজের বিরুদ্ধে কৃষকের পক্ষে, মোদী রাজের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের পক্ষে, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বে-রোজগারি নীতির বিরুদ্ধে, কর্মসংস্থানের দাবিতে, ১০০ দিনের কাজের দাবিতে ফেস্টুনে সুসজ্জিত প্রচার গাড়ি ব্যাপক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিজেপি সরকার ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণে কৃষকদের চরম বঞ্চিত করছে, ১০০ দিনের কাজের বরাদ্দ কমিয়ে দিয়ে কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পকে প্রায় তুলে দেওয়ার চক্রান্ত করছে, সার-বীজ-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি চাষিদের উপর সংকটের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে – এ বিষয়গুলি বক্তব্যে তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি রাজ্য সরকারের দুর্নীতি দলবাজি ও উন্নয়নের নামে মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে প্রচার করা হয়। পরিক্রমায় অংশগ্রহণ করেন পার্টির নদীয়া জেলা সম্পাদক সুবিমল সেনগুপ্ত, জেলা কমিটি সদস্য জীবন কবিরাজ, সন্তু ভট্টাচার্য, ধুবুলিয়া এরিয়া কমিটির সদস্য বেলা দে, শংকর রায় প্রমূখ।

gaarrrr

পান্ডুয়া ব্লকের তিন্না আদিবাসী পাড়ায় এআইপিডব্লিউএ-র উদ্যোগে মহিলা কিষাণ দিবস উপলক্ষ্যে এক কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে আদিবাসী জনগণের অধিকার আন্দোলন ও ঋণমুক্তি আন্দোলন থেকে উঠে আসা অগ্রণী কর্মীরা এই সভায় সামিল হন। আর অবশ্যই, খেতমজুরদের মজুরি বৃদ্ধির প্রশ্নে, পঞ্চায়েতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন তথা বিভিন্ন গণআন্দোলনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দীর্ঘদিনের পুরানো মহিলা কর্মীরাও এই কর্মীসভায় উপস্থিত ছিলেন। গরিব কৃষক ও খেতমজুর ঘর থেকে উঠে আসা সংখ্যালঘু ও দলিত সম্প্রদায়ের মহিলারাই ছিলেন কর্মীসভার সিংহভাগ। কর্মীসভায় মোদী সরকারের জনবিরোধী তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে রাজধানী দিল্লীকে অবরুদ্ধ করে রাখা কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানানো হয়। এই গৌরবময় কৃষক সংগ্রামে ইতিমধ্যেই যেসব কিষাণ-কিষাণী নিহত হয়েছেন তাঁদের প্রতি কর্মীসভায় শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। একই সঙ্গে মহিলাদের সম্মান ও অধিকারগুলি মোদী জমানায় যেভাবে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে তার বিরুদ্ধে কর্মীসভায় প্রতিরোধে জেগে ওঠার শপথ নেওয়া হয়। কর্মীসভা পরিচালনা করেন অ্যাপোয়া রাজ্য সম্পাদক চৈতালি সেন। এছাড়াও কর্মীসভায় বক্তব্য রাখেন সরস্বতী বেসরা, চন্দনা মন্ডল ও শিপ্রা চ্যাটার্জী।

sssr

গত ১০ জানুয়ারী হুগলির সুলেখা লজে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে পরিচয় পত্র ও বিবাহের শংসাপত্র দেখানোর পরেও চিত্রশিল্পী তৌসিফ হক ও তাঁর স্ত্রী জয়ন্তী বিশ্বাসকে ঘর ভাড়া না দিয়ে হেনস্থা করা হয়। ঘটনার পরে সামাজিক সংগঠন এআইপিএফের তরফে একটি তথ্যানুসন্ধানী দল কয়েকদিন আগেই ঐ লজে যায়, হোটেলের মালিক ও ম্যানেজারের দেখা পাওয়া যায়নি। তাঁরা থানায় গেলে বলা হয় যে তৌসিফ ও জয়ন্তী নাকি স্রেফ পরিচয়পত্র দেখাতে না পারায় তাঁদেরকে ঐ লজ রুম দেয়নি। আজ ছাত্র সংগঠন আইসা, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি ও এআইপিএফের এক প্রতিনিধি দল চুঁচুড়া থানায় এর বিরুদ্ধে ডেপুটেশন দিয়ে দাবি জানায় যে, অবিলম্বে প্রকৃত ঘটনাকে গুরুত্ব সহকারে সামনে এনে ঐ লজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথমে কিছুটা অগ্রাহ্যের সুরে কথা বললেও ভারপ্রাপ্ত অফিসার দীর্ঘক্ষণ কথা বলার পরে প্রতিবাদীদের সাথে সহমত হন ও আশ্বাস দেন যে তাঁরা কয়েকদিনের মধ্যেই ঘটনাটির দ্বিতীয়বার বিশদে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন এবং ফলাফল সংগঠনগুলোকে জানাবেন। এরপরে ঐ সংগঠনের সদস্যরা ক্রমান্বয়ে থানার সামনে, চুঁচুড়া ঘড়ির মোড়ে এবং উপরোক্ত সুলেখা লজের সামনেই প্রতিবাদে স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ দেখান। সংগঠনগুলোর তরফে বক্তব্য রাখেন আইসার হুগলি জেলা সম্পাদক সৌরভ রায়, প্রগতিশীল মহিলা সমিতির রাজ্য নেত্রী চৈতালী সেন ও মিতালী বিশ্বাস। ডেপুটেশনের প্রতিনিধিদলে এঁদের সাথে ছিলেন এআইপিএফের কল্যাণ সেন ও সনৎ রায় চৌধুরী। উপস্থিত ছিলেন চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরি, এআইপিএফের সংগঠক সুদর্শন বসু, যুব সংগঠক অতনু পাল, আইসার কর্মী রণজয়, ত্রিশিতা, সম্রাট, শ্রমিক সংগঠক গোপাল পাল, উত্তম পাত্র সহ আরো অনেকে।

ddd

গত ১৩ জানুয়ারী কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে,কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে গোটা দেশের সাথে দঃ ২৪ পরগণার বাখরাহাট এবং বজবজ গ্রামে প্রতিবাদ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। বজবজ গ্রাম লোকাল কমিটির উদ্যোগে বজবজ গ্রামে এবং বিষ্ণুপুর-সাতগাছিয়া লোকাল কমিটির উদ্যোগে বাখরাহাট স্কুল মোড়ে তিনটি কৃষি আইনের প্রতিলিপি পোড়ানো হয়। বজবজ গ্রামে পার্টির জেলা নেত্রী দেবযানী গোস্বামী, অঞ্জনা মাল, লোকাল কমিটির নেতা শ্যামসুন্দর গোস্বামীর নেতৃত্বে বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং কৃষি আইনের প্রতিলিপি পোড়ানো হয়। বাখরাহাটে এআইকেএম জেলা সম্পাদক দিলীপ পাল, লোকাল সম্পাদক নিখিলেশ পালের নেতৃত্বে বাখরাহাট স্কুল মোড় অবরোধ করে কৃষি আইনের প্রতিলিপি জ্বালানো হয়। কর্মসূচীতে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন দিলীপ পাল। স্লোগান ওঠে “নকশালবাড়ির লাল আগুনে কৃষি আইন জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও”, “মোদী হঠাও, কৃষি-কৃষক-দেশ বাঁচাও”।

vvarrvar

কালা কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দিল্লিতে চলমান কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে ১৯ জানুয়ারী এআইপিএফ এবং আইসা বারাসাত কোর্ট চত্তরে প্রতিবাদ অবস্থান কর্মসুচী পালন করে। এই জেলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহের অন্যতম নেতা শহিদ তিতুমীরের নামাংকিত (জন্ম ২৭ জানুয়ারী ১৭৮২) মঞ্চে অবস্থান শুরু হয় দুপুর ১২টায়। মোদি সরকারের কৃষি আইনের বিরোধিতা ছাড়াও, শ্রম কোড বাতিল, নয়া শিক্ষানীতি-২০২০ এবং বিদ্যুৎ বিল-২০২০ বাতিলের দাবিও বিভিন্ন বক্তার ভাষণে উঠে আসে। একই সঙ্গে এই কথাও বলা হয় যে বিজেপির মতন বিপর্যয় সৃস্টিকারী শক্তি কোনোভাবেই যাতে পশ্চিমবাংলায় কোনো মতেই ক্ষমতায় আসতে না পারে সে বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে। অবস্থান মঞ্চে বক্তব্য রাখেন এআইপিএফ-এর পক্ষে দেবজ্যোতি মজুমদার, আয়ার্লার সম্পাদক অজয় বসাক, আইপোয়ার শোভনা নাথ, আইসার অন্নেষা রায়, সৌরভ কাঞ্জিলাল, গণআন্দোলনের সংগঠক নীলকন্ঠ আচার্য্য, জয়ন্ত সিনহা। র‌্যাপ পরিবেশন করে আইসার অনীক, আবৃত্তি করেন শিক্ষক কম মহিউদ্দিন, শোভনা নাথ। সভার শুরুতে গণ সংগীত গেয়ে শোনান কমরেড বাবুনি। সমগ্র মঞ্চ পরিচালনা করেন আইসার পক্ষ থেকে কমরেড তপু সরকার। সন্ধ্যা ৬ টায় অবস্থান কর্মসূচী শেষ হয়।

vbraddd

ক’দিন পর পেশ করা হবে সাধারণ বাজেট। আর, একে কেন্দ্র করেই এখন যাবতীয় আলাপ আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে অর্থনৈতিক দুনিয়ায়। যেহেতু ভারতের বাজেট আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রেও গুরুত্ব বহন করে, তাই আন্তর্জাতিক মহল ও নিবিড় পর্যবেক্ষণ করছে দেশের আর্থিক গতিপ্রকৃতির উপর। বলাই বাহুল্য, যে মোদী সরকার  ডাহা মিথ্যা ও অসত্য ভাষণকে তার শাসন প্রণালীর এক অভিন্ন প্রকরণ বানিয়ে ফেলেছে, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও সেই মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর দপ্তর থেকে। বলা হচ্ছে, এবার ভারতীয় অর্থনীতি নাকি ইংরাজির আদ্যাক্ষর ভি-র মতোই আবার পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠার মুখে দাঁড়িয়ে। কিন্তু নির্মম বাস্তবটা ঠিক কি?

এই নভেম্বর মাসে দেশের শিল্পোৎপাদন ১.৯ শতাংশ হারে সংকুচিত হয়ে ঋণাত্বক ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে দু’মাসের ব্যবধানের পর। সরকারী তথ্য দেখাচ্ছে, এর প্রধান কারণ ম্যানুফ্যাকচারিং ও খনি, এই দু’টি ক্ষেত্রের দুরাবস্থা। যে ম্যানুফাকচারিং ক্ষেত্র শিল্পীয় উৎপাদন সূচকে ৭৭.৬৩ শতাংশ অবদান রাখে, ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকাল অফিস বা এনএসও-র সদ্য প্রকাশিত তথ্য দেখাচ্ছে, সেই ক্ষেত্রটি নভেম্বর মাসে সংকুচিত হয়েছে ১.৭ শতাংশ হারে। ওই নভেম্বর মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলেও খনি সংকুচিত হয়েছে ৭.৩ শতাংশ হারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কোভিড-১৯-এর দরুণ শিল্প উৎপাদন গত বছর মার্চে ১৮.৭ শতাংশে নেমে যায় আর আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত ঋণাত্বক ক্ষেত্রেই বিচরণ করে।

কদিন আগে সেন্টার ফর মনিটারিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমইআই) কর্মসংস্থান সম্পর্কিত যে তথ্য প্রকাশ করেছে তা রীতিমতো আতংকজনক। তাদের তথ্য দেখিয়েছে, ডিসেম্বর ২০১৯-র সাপেক্ষে গত বছর ডিসেম্বরে ১.৭ কোটি কাজ হারিয়ে গেছে ভারতে শ্রম বাজার থেকে। ২০২০-২১ এ অক্টোবর – ডিসেম্বরের মধ্যে গত বছরের সাপেক্ষে ২.৮ শতাংশ কাজ হারিয়ে যায়। ডিসেম্বরে কর্মহীনতার হার ৯.১ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বরের ৬.৭ শতাংশ থেকে অনেক বেশি আর সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো শহুরে কর্মসংস্থানের নিদারুণ হাল। নভেম্বর মাসে যে কর্মহীনতার হার ছিল ৬.২ শতাংশ, তা মাত্র একমাসের মধ্যেই অর্থাৎ ডিসেম্বরে বেড়ে দাঁড়ায় ৯.২ শতাংশ। শহুরে তরুণ, বিশেষ করে মহিলা আর বেতনভুক কর্মীরাই সবচেয়ে বেশি কাজ হারিয়েছেন। যাবতীয় প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, লকডাউন ও আর্থিক বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন মহিলারা। সমগ্র শ্রমশক্তির মাত্র ১১ শতাংশ মহিলা হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে কর্মহীনতার হার ৫২ শতাংশ!!

সরকারী তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, এই অক্টোবরেই মনরেগা প্রকল্পে কর্মপ্রার্থির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৯১.৩ – যা প্রমাণ করে অন্য জায়গায় বিশেষত শহরে কাজ না থাকায় ভিড় বাড়ছে গ্রামাঞ্চলে। লকডাউন পর্যায়ে শহর থেকে গ্রামমুখী হওয়ার এই যে উল্টো স্রোত বা রিভার্স মাইগ্রেশন, তা আজও বন্ধ হয়নি। গ্রামীণ ক্ষেত্রে এই অত্যাধিক শ্রমশক্তির চাপ আর্থিক নিয়মেই গ্রামীণ মজুরিকে টেনে নীচের দিকে নামিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে যে শহরের ইনফর্মাল সেক্টরগুলো এখনো নাছোড় স্থিতাবস্থায় চলছে, ফলে শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা এখনও দেখা যাচ্ছে না। এটাই উন্মোচিত করে মোদী সরকারের ঝুঠা দাবি, যে আবার চাঙ্গা হচ্ছে ক্ষুদ্র ছোট মাঝারি শিল্প বা কর্মসংস্থানের অবস্থা, যা আমাদের অর্থনীতির ক্ষেত্রে ভালোই প্রাধান্য রেখে চলে।

দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত গ্রামীণ মজুরি সারা দেশেই সংকুচিত হয়েছে। মোট ১৮ রাজ্যের মধ্যে মাত্র ৫টি রাজ্যের পাওয়া তথ্য (এ রাজ্যের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি) থেকে জানা যাচ্ছে (পঞ্জাব-হরিয়ানা-কেরল-অসম-ত্রিপুরা) সেপ্টেম্বর ২০২০-তে প্রকৃত মজুরির হার ছিল গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে কম। কেন্দ্রীয় সরকারের লেবার ব্যুরো জানাচ্ছে, এই নিম্নমুখী পতন বেশ কিছুদিন যাবত অব্যাহত থাকবে।

জেএনইউর অধ্যাপক ও অর্থশাস্ত্রী অরুণ কুমার বলেছেন, চলতি অর্থবছরে দেশের অর্থনীতি সংকুচিত হবে ২৫ শতাংশ হারে। এর কারণ হিসাবে তিনি দেখিয়েছেন, অসংগঠিত ক্ষেত্র, যা,আমাদের দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশ অবদান রাখে, এখনো ধুঁকছে, জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে যে পরিষেবা ক্ষেত্র, তার পুনরুজ্জীবনেও তেমন কিছু লক্ষণ চোখে পড়ছে না।

হ্যাঁ, কিছু মাত্রায় আর্থিক পুনরুদ্ধার হচ্ছে বৈকি। তবে এই পুনরুদ্ধার হচ্ছে নতুন করে বিরাট অসাম্য, আর্থিক বৈষম্যের হাত ধরে। আমরা আগের একটি সংখ্যায় এ বিষয়ে ব্যাখ্যা রাখি। প্রখ্যাত অর্থশাস্ত্রী প্রভাত পট্টনায়েক হালে তাঁর একটা প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে বিভিন্ন সংস্থা তার উৎপাদন খরচকে কমাতে কর্মী ছাঁটাই করছে, অবশিষ্ট কর্মীদের বেতন বা মজুরিতে হাত দিয়েছে। যে সমস্ত কর্মীদের (স্থায়ী চরিত্রসম্পন্ন বেতনভুক কর্মী) এতোদিন সহজে ছেঁটে ফেলা যেতো না, বা যাদের বেতন বাজারের ওঠা নামার ভিত্তিতে নির্দ্ধারিত হতো না, তারাই এবার কর্মচ্যুত হলেন। তাঁদের বেতনকে সংকুচিত করা হলো। উল্লেখিত সিএমইআই-র রিপোর্ট সেই কথাই বলছে। এই পর্যায়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলো যে মুনাফা অর্জন করেছে তা এই পথে। অর্থাৎ, একদিকে শ্রমসময়ের হ্রাস ঘটিয়ে মজুরি হ্রাস আর অপরদিকে মজুরি বা বেতনের হ্রাস। পাশাপাশি কর্মী কমিয়ে উৎপাদন খরচ কমানো। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তার রিপোর্টে দেখিয়েছে, এইভাবেই কর্পোরেট সংস্থগুলো খরচ কমিয়ে মুনাফা অর্জন করছে। আর মুনাফা বা সরকারের নানা তোফা পকেটে পুরলেও তারা বিনিয়োগ ততদিন করবে না যতদিন না পর্যন্ত বাজারে চাহিদা বাড়বে। এটাও প্রভাত পট্টনায়েক দেখিয়েছেন, যে কর্পোরেট সংস্থাগুলো তুলনামূলকভাবে অধিক শ্রমনিবিড়, তার তুলনায় কম শ্রমনিবিড় সংস্থাগুলোর আর্থিক বৃদ্ধি ভাল।

ছাঁটাই রোধ, মজুরিকে সংরক্ষিত করাটা এখন গুরুত্বপূর্ণ দাবি হয়ে সর্বত্র সামনে আসছে। বলা যায়, এটা এক বিশ্বজনীন দাবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে “# ফাইট ফর ২৫ ডলার মিনিমাম ওয়েজ পার হাওয়ার একটা মঞ্চ হিসাবে আবির্ভূত হয় যা আজ রীতিমতো জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তারা নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বাইডেনের কাছে তাঁর কার্যভার গ্রহণের প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে যে কাজ সম্পন্ন করার দাবি তুলেছে তা বিগত ১০ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থমকে থাকা ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করে ঘন্টায় ১৫ ডলার করা, (যা প্রাক নির্বাচনী পর্বে বাইডেন প্রতিশ্রতি দেন) মজুরি সংরক্ষণ, সামাজিক সুরক্ষা, ইউনিয়ন গঠনের অধিকার।

যে অসাম্যের রাস্তা ধরে দেশের অর্থনীতি আবার পুনরুদ্ধারের গতিপথ শুরু করেছে প্যান্ডেমিক পরবর্তী পর্বে, তাকে উলটো পথে ঘোরানোই আজ জনগণের দাবি। কর্পোরেটদের স্বার্থে অনুসৃত নীতিমালা নয়, জনগণের স্বার্থ বহনকারী নীতিই রূপায়ন করতে হবে, আর এই লক্ষ্যেই চলমান কৃষক আন্দোলন নিত্যদিন নতুন নতুন উদাহরণ তৈরি করছে।

- অতনু চক্রবর্তী    

vvvavar

৯ জানুয়ারী, ২০২১-এ বিজেপির নেতৃত্বে “এক মুঠো ভাত” অভিযান শুরু করেছে, যেখানে প্রেসিডেন্ট শ্রী নাড্ডা চাষি পরিবারগুলির কাছে এক মুঠো ভাতের ভিক্ষা চাইছে। এই প্রবল ভণ্ডামিতে আমরা স্তম্ভিত। খবরের কাগজ বলছে এই চাল থেকে অভুক্ত মানুষের জন্য গণ-আহারের ব্যবস্থা হবে।

শ্রী নাড্ডা সেই রাজনৈতিক দলের প্রেসিডেন্ট যারা কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় এবং এই মুহূর্তে ৫১২.৯৪ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার নিয়ে বসে আছে সেই সরকার। খারিফ ফসল এখনও সংগ্রহ চলছে এবং আগামী কিছু দিনে এই পরিমাণ আরও বাড়বে। তার বা তার দলের লোকের, বাংলা বা বলা যায় পুরো দেশের লোককে খাওয়ানোর জন্য কি মুঠোভর্তি চাল চাওয়ার দরকার আছে? বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার যে কাজ ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’-র আওতায় লকডাউনের মধ্যে শুরু হয়েছিল এবং নভেম্বর ২০২০-তে যা হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়, দরকার তো ছিল সে যোজনার পরিধিকে আরও প্রসারিত করা। তার দল তো স্বচ্ছন্দে তা করতে পারত। এই যোজনার ভেতর, রাষ্ট্রীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের অন্তর্ভুক্ত এরাজ্যের সব কার্ডহোল্ডার, অর্থাৎ ৬০১৮৯৩৮৪ জন, বা পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ৬৭ শতাংশ, প্রতি মাসে পরিবার পিছু ৫ কেজি খাদ্যশস্য  ও পরবর্তীতে ১ কেজি করে ডাল পাচ্ছিল।

লোকের দুর্দশা লকডাউন ওঠার পরেও কমেনি এবং অর্থব্যবস্থা আরও খারাপ দিকে যাচ্ছে, তাই কেন্দ্রীয় সরকারের বিনামূল্যে রেশনের পরিষেবা হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়ার কারণ বোঝা যাচ্ছে না। ‘হাঙ্গার ওয়াচ স্টাডি’ যার অন্তরিম ফল বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক গণ অধিকার দিবসের প্রাক্কালে, ৯ ডিসেম্বর ২০২০-তে। তাতে দেখা যাচ্ছে সারা দেশের মানুষ খাবার না পেয়ে ভোগান্তিতে আছেন। পশ্চিমবঙ্গে ‘রাইট টু ফুড অ্যান্ড ওয়ার্ক ক্যাম্পেইন’-এর চালানো সমীক্ষা, যা ২০টি জেলা থেকে ২৯০৬টি পরিবারের মধ্যে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে করা হয়েছিল, তাতে দেখা যায় বিনামূল্যে রেশন দেওয়া বন্ধ হওয়ার আগেও অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। লকডাউনের আগে খেতে না পাওয়া পরিবারের তুলনায় এই পর্বে খেতে না পাওয়া পরিবারের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সমীক্ষার সময় দেখা যায় যে বিগত ৩০ দিনে ১৮.৭৪ শতাংশ পরিবার না খেয়েই ঘুমাতে বাধ্য হয়েছে এবং ৪৫ শতাংশ পরিবার খাবারের জন্য ধার নিতে বাধ্য হয়েছিল। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন তারা খাবারে ডাল ও শাকসবজির পরিমাণ কমাতে বাধ্য হয়েছেন, ৮০.৩ শতাংশ মানুষ খাবারে মাছ, ডিম ও মাংসের পরিমাণ কমাতে বাধ্য হয়েছেন। ২৬ শতাংশ মানুষের মতে আগামী ৬ মাসে অবস্থা আরও বেশি খারাপ হতে চলেছে।

তাই শ্রী নাড্ডা একমুঠো চাল চেয়ে ভুখা লোককে খাওয়ানোর নাটক বন্ধ করলেই ভালো হয়। তার যদি সত্যিই ভোট চাওয়ার থেকে ক্ষুধা নিবারণের ইচ্ছা বেশি হয় তাহলে তিনি তাঁর প্রধানমন্ত্রীকে বলে যে পাহাড়প্রমাণ খাদ্যশস্য গুদামে জমা আছে তা দিয়ে ভুখা মানুষকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করুন।

বিজেপির এই অভিযানের আরও একটি কারণ হতে পারে বিজেপি নেতারা কৃষকদের ঘরে ঘরে গিয়ে নতুন কৃষি আইনের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে চান। এ আরও একটি ধাপ্পা – যে কৃষকরা তাদের সরকারের দোরগোড়ায় বসে রয়েছেন তাঁদের সাথেই কি প্রথমে কথা বলা যায় না? যে সরকার বা রাজনৈতিক দল সত্যিই কৃষকদের ভালো চায় এবং তাদের সাথে আলোচনায় যেতে চায়, তারা দিল্লীর ঠাণ্ডায় কম্পমান কৃষকদের সাথেই প্রথমে আলাপ-আলোচনা করবে। ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দিকে দৃকপাত করলেও ভালো হয়, কারণ পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ চাষির এই দামে কোনো লাভ থাকে না এবং তারা কেন্দ্রীয় সরকারের ধার্য করা হাস্যকর দামের চেয়ে খোলা বাজারেই শস্য বেচতে বাধ্য হন।

ধাপ্পাবাজির এই সময়ে পশিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকারের ‘দুয়ারে সরকার’ অভিযানও আমাদের সামনে আছে। ভোটের ঠিক আগে এই সরকার আমাদের দুয়ারে এসে পড়েছে, যেখানে বিগত দুবার ভোটে জিতে এসে তারা হয় আমাদের কথা উপেক্ষা করে গেছে নয় জণগণের পয়সা চুরি করেছে। শুধু তাই নয়, আইনিভাবে প্রতিকারের সব রাস্তাকেই এই রাজ্য সরকার সমানে লঘু করেছে – খাদ্য সুরক্ষা আইন প্রণীত হওয়ার ৭ বছর পরেও খাদ্য নিগম তৈরি হয়নি; মনরেগার আওতায় কাজের  সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার পর্ষদটি শুধু নামেই আছে; জেলাস্তরে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের আওতায় অভিযোগ নিরসনের জন্য যে অধিকারী থাকার কথা তার কেউ নামই শোনেনি; অভিযোগ শোনা ও তার সাপেক্ষে কাজ করা ও উত্তর দেওয়ার জন্য বিভিন্ন আইন অনুসারে নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত থাকা সত্ত্বেও অপ্রয়োজনীয় দেরী ও বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়না সরকারের দরজায় গেলে।

পরবর্তী স্তরের রাজনৈতিক দলগুলির কাছে আমাদের আবেদন – এই ধাপ্পাবাজি বন্ধ হোক; তার পরিবর্তে লোকের সমস্যার কথা  শোনা হোক এবং তার সাপেক্ষে কাঠামোগত এবং দীর্ঘস্থায়ী সমাধান আনা হোক। শুরুয়াতে, আরও অন্তত ছয় মাসের জন্য ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’ আবার শুরু করা হোক।

(রাইট টু ফুড অ্যান্ড ওয়ার্ক ক্যাম্পেইন পশ্চিমবঙ্গ কর্তৃক প্রচারিত বিবৃতি)    

srevva

কথামুখ

আগামী ২৩ জানুয়ারী নেতাজীর ১২৫তম জন্মদিন পালনের জন্য গত মাসের ২১ তারিখে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গড়ার কথা ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিমন্ত্রক। কিন্তু ৯ জানুয়ারী ২০২১ সরকারের গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে দেখা গেল শাহকে সরিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজেই এই কমিটির চেয়ারম্যানের পদে বহাল হয়েছেন। (সূত্র: আনন্দবাজার, ১০.১.২১)। ভারতীয় রাজনীতিতে অবহেলিত বাংলার তথা বঙ্গবাসী সর্বজনের ভালবাসার এই প্রবাদপ্রতিম আইকনের প্রতি এহেন প্রীতির কারণ কী? কারণ ভোট বড় বালাই। পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ঢাকে কাঠি পড়েছে এবং বিজেপি-আরএসএস এইবার ছলেবলে কৌশলে, যে কোনো মূল্যে পশ্চিমবঙ্গ-বিধানসভা ভোট জেতার খোয়াব দেখছে। এছাড়াও আদানি-আম্বানি-মিত্র গুজরাটি বাণিয়াদের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি নরেন্দ্র মোদী শুধুমাত্র ভোটে জিতে বাংলায় ক্ষমতা কায়েম করার জন্য এক্ষণে বাংলার ‘ঘরের ছেলে নরেন’ হয়ে উঠতে চাইছেন। ওদের সমস্যা হোলো, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছাড়া বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে বিজেপি-আরএসএসের সেরকম কোনো বৌদ্ধিক প্রতিনিধিত্ব নেই। থাকার কথাও নয়। বাংলার সামাজিক সাংস্কৃতিক বাতাবরণে ওদের চরম ব্রাহ্মণ্যবাদী মনুস্মৃতি প্রকরণ কিংবা ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ অবধারণা ঠিক খাপ খায় না। সেই দূর্বলতা অতিক্রম করার জন্য এই মুহূর্তে বিজেপি-আরএসএসের প্রধান প্রচেষ্টা হোলো বাঙালীর সমস্ত সাংস্কৃতিক আইকনকে, তাদের সাথে খাপ খায় কিংবা না খায় ওসব বিচার না করে, ভড়ং-সর্বস্ব মুর্তিপূজার এক প্রতিবেশ সৃষ্টি করা, যা কিনা পরবর্ত্তীতে ওদের নির্বাচনী ফয়দা দিতে পারে। এ লক্ষ্যে ওদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার খামতি নেই। ১২ জানুয়ারী বিবেকানন্দর জন্মদিবসে এই বিকৃত উদাহরণের প্রকৃষ্ট প্রমাণ দেখা গেল। এবার ওদের প্রস্তুতি বাংলায় ২৩ জানুয়ারী উদযাপনের জন্য। স্বয়ং মোদী নিজেই কোমর বেঁধেছেন। আজন্ম অসাম্প্রদায়িক সুভাষ চন্দ্র বসুকে নিয়ে নরেন্দ্র মোদীরা মূর্তিপূজার এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের জন্য নেহেরু-গান্ধী পরিবারের সাথে তাদের যে জেহাদ তাতে বিশেষ মাত্রা দেবার জন্য। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজীর ভূমিকার ক্ষেত্রে গান্ধী-নেহেরু গাটবন্ধনের যে খচখচে অবস্থান আছে তাকে ধুনো দিয়ে, উসকে দিয়ে, নেতাজীর প্রতি বাঙালী আবেগকে সুড়সুড়ি দিয়ে নির্বাচনি ফয়দা তোলার জন্যই নরেন্দ্র মোদী ব্যাটেলিয়নের নেতাজীকে সম্বর্ধিত করার এই মেকী আয়োজন। না হলে মোদী-বিজেপি-আরএসএস ব্রিগেডের সাথে নেতাজীর দেশপ্রেমিক তত্ত্ব-অনুসন্ধানের কণামাত্র যোগ নেই। এ প্রশ্ন নিয়ে আমরা পরবর্ত্তীতে আলোচনা করব। এক্ষণে আমরা দেখি ভারত, জাতি ইত্যাদি নিয়ে মোদী-বিজেপি-আরএসএসের ভাবনা ও অবস্থানটি কী?

গোলয়ালকর ও তার ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড’

“অতএব শুধুমাত্র ঐ আন্দোলনগুলোই সত্যকারের ‘জাতীয়’ যে আন্দোলনগুলো হিন্দুত্বে বিশ্বাস রেখে সমসময়ের অসাড়তা বা জড়তা কাটিয়ে পুনঃনির্মাণ, পুনরুজ্জীবন এবং বন্ধনমুক্তির লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। তারাই শুধুমাত্র জাতীয়বাদী দেশপ্রমিক যাঁরা হিন্দু জাতি ও বর্ণকে মহিমান্বিত করার আকাঙ্ক্ষাকে হৃদয়-অন্তরে স্থান দিয়ে, ঝাঁপিয়ে পড়ে কর্মে এবং লক্ষ্যে পৌঁছোনোর জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালায়। জাতীয়তার প্রয়োজনের সাপেক্ষে অন্যান্য সমস্তরা হয় দেশদ্রোহী এবং শত্রু, না হলে দয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখলে অপগন্ড ছাড়া কিছু নয়”। [আরএসএসের দ্বিতীয় স্বরসংঘচালক মাধবরাও সদাশিবরাও গোলয়ালকর -পৃষ্ঠা-১০০] অস্যার্থ; ১৮৫৭র জাতীয় মহাবিদ্রোহ, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বাঘা যতীন, বিনয়-বাদল-দিনেশ, চট্টগ্রাম ও সূর্য সেন, ভগৎ সিং, যতীন দাস, আসফাকুল্লা, রামপ্রসাদ বিসমিল, এমনকি রাসবিহারী, নেতাজী সব্বাই, প্রত্যেকটি আন্দোলন আরএসএসের ভাবনায় ‘অপগন্ডো’ দেশদ্রোহী ছাড়া কিছু নয়। একমাত্র এ প্রশ্নে তাদের ছক সত্য। এই ছকে দেওয়া পোগ্রাম অনুসারেই চলছে মোদী-অমিত শাহ-মোহন ভাগবতের আরএসএস-বিজেপি। বিমুদ্রাকরণ; কাশ্মীরের ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি; উচ্চতম ন্যায়ালয়কে কাজে লাগিয়ে রামমন্দির নির্মাণ; দাভোলকর, পানসারে, কালবুর্গী, গৌরী লঙ্কেশ হত্যা; ভীম কোরগাঁও মামলা; গো-রক্ষক বাহিনী; জয় শ্রীরামের নামে মব লিঞ্চিং; দলিত হত্যা; ধর্ষণ সংস্কৃতি; তাৎক্ষণিক তিনতালাক আইন; লাভজিহাদ আইন ইত্যাদি ইত্যাদি যা কিছু আজকের এই ব্রাহ্মণ্যবাদী ফ্যাসিস্ট ভারতে কার্যকর হচ্ছে সবই আরএসএস-প্রমুখ সাভারকর, হেডগেওয়ার, গোলয়ালকর, গডসেদের বিশ্বদৃষ্টি সঞ্জাত। এখন আরএসএস-বিজেপির একমাত্র কাজ-নাগপুরের সদর দপ্তর থেকে নিরন্তর সুভাষ-সাভারকার সম্পর্ক নিয়ে ভুলে ভরা, অনৈতিহাসিক অত্যন্ত আজেবাজে তথ্য সামাজিক প্রচার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া। ওরা কখনো ঘুণাক্ষরেও উল্লেখ করে না, বৃটিশকে মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পাওয়া গদ্দার সাভারকারের নেতৃত্বেই নেতাজীকে রোখার জন্য বৃটিশ সৈন্যবাহিনীতে যেচে অংশগ্রহণ করেছিল ‘হিন্দু মহাসভা’ ও ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’র সদস্যরা। যুদ্ধের পরিণতিতে পরাজিত আজাদ হিন্দ ফৌজকে জনে জনে নির্দিষ্ট করে কোতল করার দায়িত্বও হাতে তুলে নিয়েছিল বৃটিশ সিপাহি হিসাবে কর্মরত, ‘হার মেজেষ্টি’র অনুগত ‘হিন্দু মহাসভা’ ও ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’র সদস্যরা। ১৫.০১.২০২১ এর আনন্দবাজার পত্রিকার উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধে রবীন্দনাথকে আত্মসাৎ করার প্রাণান্তকর সঙ্ঘী প্রচেষ্টার অপরিসীম অনৈতিক উদ্যোগের কথা বলতে গিয়ে সেমন্তী ঘোষ যথার্থই উল্লেখ করেছেন – “আজকের নব্য বিজেপি বিশেষজ্ঞরা, যারা মোদী ও অন্যান্য অবাঙালি নেতাদের রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি ‘সাপ্লাই’ দেন, তাঁরা কেবল প্রথম দিককার স্বদেশি যুগের লেখাপত্রের মধ্য থেকেই সন্তর্পণে এটা-ওটা বেছে নেন, ভুলেও তাঁরা কালান্তর প্রবন্ধাবলি, কিংবা গোরা বা ঘরে-বাইরে উপন্যাসের পাতা খুলেও দেখেন না। অথচ সেখানেই কিন্তু এ সব বিষয়ে সবচেয়ে বিশদ আলোচনা আছে”। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াতেই প্রচার চালাচ্ছে বিজেপি ও সংঘ পরিবার। তাই সাধু সাবধান।

স্বদেশ, দেশ ভাবনা ও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু

নাতিদূর সাম্প্রতিক কালে অমর্ত্য সেনের একটি উক্তি দিয়েই এই পর্যায়ের ব্যাক্ষা শুরু করা যাক। ২৩ জানুয়ারী, ২০১৬-তে নেতাজী ভবনে এক বক্তৃতায় অমর্ত্য সেন বলেন – “ন্যায় ও ন্যায়বিচারের প্রতি নেতাজীর কল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গি আজও প্রগাঢ়ভাবে অনুকরণীয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে নেতাজীর এই দৃষ্টিভঙ্গি অসম্পন্ন হিসাবেই থেকে গেছে এবং ভারত সরকারও এই দৃষ্টিভঙ্গিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছুই করেনি। আজকের সরকার তো এ প্রশ্নে ভূমিকা রেখেছে আরও কম”। তিনি আরও বলেন, “আমরা এখন এমন এক অবস্থায় যেখানে নেতাজীর কল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গি দেশ ও জীবনের ক্ষেত্রে সবিশেষ প্রয়োজন। এই মুহূর্তে এই দেশে সাম্প্রদায়িকতাকে এমনভাবে বেশিবেশি করে সৃষ্টি করা হচ্ছে যাতে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি বিবেচিত হচ্ছে একটি খারাপ শব্দ হিসাবে”।

সাম্প্রদায়িকতা ও নেতাজী

সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মন্ত্রশিষ্য। বাংলার রাজনীতিতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অসাম্প্রদায়িক অবস্থান অত্যন্ত সুবিদিত। সেই রাজনৈতিক পরম্পরার দায়বদ্ধ অংশীদার হিসাবে সুভাষ প্রথম থেকেই যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতার অবিচল বিরোধী থেকেছেন। ভারতীয় জীবনধারা থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প উৎপাটিত করার বিষয়ে তাঁর নিজস্ব ভাবনা ছিল। ১৯২৫ হল দাঙ্গাবাজ মানসিকতার হিন্দু প্রতিনিধিদের নিয়ে গড়া ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’র প্রতিষ্ঠাবর্ষ। যেহেতু বাংলায় হিন্দু ও মুসলমান জনসংখ্যা ছিল সমান সমান সেই কারনেই নবসৃষ্ট রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘর প্ররোচনায় ১৯২৫-২৭ এর কালপর্বে সারা বাংলা জুড়ে একের পর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়। সুভাষ তখন গ্রেপ্তার হয়ে মান্দালয় জেলে। সেই পর্যায়ে জেলের মধ্য থেকেই সুভাষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্যর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা সুভাষচন্দ্র, একমাত্র সুভাষচন্দ্রই তাঁর স্বল্পকালীন কংগ্রেসের সভাপতি থাকার কালে, পার্টির মধ্যে হিন্দুমহাসভা ও মুসলিম লীগের সভ্যদের কংগ্রেসের সদস্য হওয়ার অধিকার বাতিল করার উদ্দেশ্যে সার্কুলার জারি করেন। ১৯৪৩ সালে ২১ অক্টোবর, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ‘আর্জি হুকুমৎ-এ-আজাদ হিন্দ’ ঘোষণা করেছিলেন। সেই দিনে হিন্দুস্তানী ভাষায় এই শব্দ চয়নের সূদূরপ্রসারী তাৎপর্যের ঐতিহাসিক অভিব্যাক্তি ওদের বোধের বাইরে। চরম ব্রাহ্মন্যবাদীদের প্রতিভূ মোদী-অমিত শাহ-ভাগবৎ কোম্পানিরা এই অসাম্প্রদায়িক উচ্চারণের মর্মবস্তু গ্রহণ করতে অক্ষম।

নেতাজী এবং সমাজবাদ

নেতাজী রিসার্চ ব্যুরো, কোলকাতা সম্পাদিত সুভাষ চন্দ্র বসুর ‘ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল, ১৯২০-১৯৪২’ বইটি পড়লে আমরা দেখি রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী প্রবণতার তীব্র বিরোধী ছিলেন নেতাজী। অন্যদিকে সোভিয়েত ঘরানার সাম্যবাদও তাঁর সর্বৈব পছন্দের বিষয় ছিল না। তবু তিনি তাঁর মতো করে এক বামপন্থী সমাজবাদে বিশ্বাস করতেন। ১৯৩৯ সালের ২৯ এপ্রিল কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার আগে পর্যন্ত কংগ্রেসের মধ্যেও তিনি তাঁর মতো করে সমাজবাদী ধারণার চর্চা করতেন এবং অবশ্যই তা ছিল আরএসএস-বিজেপির হিন্দুত্ববাদী দর্শনের তীব্র বিরোধী। ১৯৩৯ সালের ৩ মে তিনি ফরোয়ার্ড ব্লক প্রতিষ্ঠা করলেন। ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে কাবুলে আত্মগোপন করে থাকাকালীন লিখিত দলিলে নেতাজী ঘোষণা করেছিলেন –

“ফরোয়ার্ড ব্লক চায় –
১) পূর্ণ জাতীয় স্বাধীনতা এবং সেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আপসহীন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম।
২) সম্পূর্ণ আধুনিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
৩) দেশের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য বিজ্ঞানসম্মত পন্থায় ব্যাপক শিল্পোৎপাদন।
৪) উৎপাদন ও বন্টন ব্যাবস্থায় সামাজিক মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ।
৫) ধর্মীয় উপাসনার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা।
৬) সকলের জন্য সমান অধিকার।
৭) ভারতীয় সমাজের সব শ্রেণীর ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা।
৮) স্বাধীন ভারতে ‘নববিধান’ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সাম্য ও ন্যায় বিচার নীতির প্রয়োগ”।
[নির্বাচিত ভাষণ সংগ্রহঃ প্রথম খন্ড/২০৭]

উপসংহারের পরিবর্তে

পাঠক, এখনও কি মনে হয় মোদী-অমিত শাহরা আজাদ হিন্দ ফৌজের টুপি পড়লেই সুভাষ-অনুগামী হয়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনা আছে? কখনই নয়। নেতাজীর সেকালেও ছিল না, একালেও নয়। প্রায় দুই মাস হতে চলল, সংসদে অনীতিনিষ্ঠভাবে পাশ হয়ে যাওয়া কর্পোরেট স্বার্থবাহী কৃষক-বিরোধী বিল সম্পূর্ণরূপে বাতিলের দাবিতে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের কৃষকরা দিল্লি সীমান্তে এই তীব্র শীতে পৃথিবীর বৃহত্তম প্রতিবাদী জমায়েতে শান্তিপুর্ণভাবে অবস্থান করছেন, ৫০-এর অধিক কৃষক এই আন্দোলনে ইত্যবসরে শহীদের মৃত্যুবরণ করেছেন, এই অমানবিক মোদী-অমিত শাহ সরকারের কোনো হেলদোল নেই। আগামী ২৩ জানুয়ারী দেশমাতৃকার উজ্জ্বল সন্তান নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মদিনে সারা ভারত কিষাণ সংঘর্ষ সমিতি ‘আজাদ হিন্দ কিষাণ দিবস’ পালনের ডাক দিয়েছে। সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যরা মূলত ছিলেন ভারতের কিষাণ। তাঁদের উত্তরসূরিরা আজ রাস্তায় কদম কদম এগিয়ে চলছে। এরাই নেতাজীর যথার্থ প্রতিনিধি। ভারতের বুকে বিপর্যয় নামিয়ে আনা ‘মোদী-অমিত শাহ-বিজেপি-আরএসএস’ নয়। প্রাদেশিক নির্বাচনের প্রাক্কালে পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে এই সার সত্য বুঝতেই হবে। সাবধান শিয়রে শমন।

-- সিতাংশু চক্রবর্ত্তী    

ggggdddrj

রাজ্যের প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক, মাদ্রাসাগুলিতে দীর্ঘ ১৮ বছর মিড-ডে-মিল প্রকল্পে কর্মরত আড়াই লক্ষ রন্ধন কর্মী। করোনা মহামারী, লকডাউনের দিনগুলিতে অন্যান্য ফ্রন্টলাইন কর্মীদের মতো এই কর্মীরাও মিড-ডে-মিল বিলি করেছেন। এমনকি করোনা আক্রান্ত পরিবারের শিশুদের পরিবারে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। বিভিন্ন রাজ্যে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন, এমনকি মৃত্যুও ঘটেছে।

দিল্লীর বিজেপি সরকার ২০১৪ ক্ষমতায় এসে এই কর্মীদের জন্য ৫০০ টাকা ভাতা বাড়ানোর সিন্ধান্ত নেন। কিন্তু, প্রথম পাঁচ বছর ক্ষমতায় সেটা কার্যকরী করেননি। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে ২০১৯ সাল থেকে গোটা মিড-ডে-মিল প্রকল্পকেই বেসরকারীকরণ ও এনজিও’দের হাতে তুলে দেবার পরিকল্পনা করে, কিছুক্ষেত্রে সফল হয়। আবার আসাম, বিহার সহ কয়েকটি রাজ্যে প্রতিরোধের ফলে পিছু হটে। একইসাথে বিজেপি সরকার এই প্রকল্পে তার বরাদ্দ ৯০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬০ শতাংশ করে দেয়। বর্তমানে রন্ধন কর্মীদের মাথা পিছু মাসিক ১,৫০০ টাকার কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ১,০০০ টাকা।

কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, গোয়া সহ আরো কিছু রাজ্য নিজ তহবিল থেকে ২,৫০০ থেকে ৫,৫০০ টাকা পর্যন্ত ভাতা দেন। যদিও এই ভাতা ১২ মাস কাজ করে ১০ মাস পেয়ে থাকেন।

২০১৮ সাল থেকে একাধিক ইউনিয়ন শ্রম সম্মেলন থেকে দিল্লির রাজপথে শ্রমিকের স্বীকৃতি, ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষার দাবি তুলে আসছেন। কিন্তু বর্তমান বিজেপি, কর্পোরেট সেবায় এতই মশগুল যে এই দরিদ্র শ্রমজীবীদের কথা তাদের কানেই পৌঁছয় না।

পশ্চিমবঙ্গের রন্ধন কর্মীরা ২০০৭ সাল থেকে তাদের দাবি নিয়ে সোচ্চার। ব্লক, পৌরসভা, পঞ্চায়েত, জেলা প্রশাসন সব জায়গায় এই দীর্ঘ বছর বিক্ষোভ, ধর্না, দাবি সনদ পেশ চলেছে। রন্ধন কর্মীদের উপর রাজনৈতিক হামলা, ছাঁটাই, সম্মান আদায় কিছুটা ক্ষেত্রে করা গেলেও মূল দাবিগুলো এখনো আদায় সম্ভব হয়নি।

২০১৯ সালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক বৈঠকে এই প্রকল্প কর্মীদের আয় বাড়ানোর কিছু প্রতিশ্রুতি দেন। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের সাথে মিড-ডে-মিল প্রকল্পকে কিভাবে যুক্ত করা যায় সে পরিকল্পনা বলেন। ঐ বছর ২৯ আগস্ট রন্ধন কর্মীদের সুবিশাল সমাবেশে ও ডেপুটেশনে রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রী প্রতিনিধিদলকে জানান তারা ভাতা বাড়ানোর বিষয়ে ভাবছেন। কিন্তু,আজ অবধি কোন সাড়া নেই। উল্টে তারা বলছেন, টাকা নেই। রাজ্যের মানুষ দেখছেন ক্লাব গুলিকে ৫০,০০০ টাকা বিলি হল। অন্যান্য প্রকল্প কর্মীদের ভাতা বাড়লো, বোনাস দিল। শুধু, গ্রাম-শহরের এই দরিদ্র মহিলাদের জন্যই ভাড়ার শূন্য?

একি, অভাব, না অনিচ্ছা, না প্রতারণা? এই প্রশ্নটার জবাব চাইতেই রন্ধন কর্মীরা আবার নবান্নের অভিমুখে যাত্রা শুরু করবেন। তাই, আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারী (১১ফাল্গুন) হাজার হাজার রন্ধন কর্মী কলকাতায় হাজির হবেন বঞ্চনার জবাব চাইতে। শ্রমিকের স্বীকৃতি, মজুরি বৃদ্ধি, বোনাস প্রভৃতির দাবি আদায়ে এই মহতী অভিযানে বাংলার সমস্ত শ্রমজীবী, গণতান্ত্রিক মানুষের সহযোগিতা তারা কামনা করেন।

- অজয় বসাক   

dddrrr

সিএমডিএমপি-র প্রজেক্ট ডিরেক্টর ১৫ জানুয়ারী ২০২১ এক সার্কুলারে জানিয়েছেন, অতি সম্প্রতি সুপ্রীম কোর্ট এক নির্দেশ দিয়েছে যে, মিড-ডে-মিল প্রকল্পে কর্মরত রন্ধনকর্মী ও সহকারিদের ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ১২ মাসের অতিরিক্ত সাম্মানিক দেওয়া হবে।

উপরোক্ত সূত্রে, মিড-ডে-মিল প্রকল্পে রন্ধনকর্মী ও সহকারিরা বছরে ১০ মাসের সাম্মানিক পেতেন। তবে এই বছর অতিমারির পরিস্থিতিতে, প্রতিমাসে ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে রান্না না করা শুকনো খাদ্য সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি জেলায় রন্ধনকর্মী ও সহকারিরা তাদের পরিষেবা দিয়ে এই প্রকল্প সফল করে তুলেছেন।

মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট গ্রীষ্মাবকাশেও মিড-ডে-মিল দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

আপনাদের অনুরোধ করা হচ্ছে রন্ধনকর্মী ও সহকারিদের অতিরিক্ত ১২ মাসের অতিরিক্ত সাম্মানিক মঞ্জুর করার জন্য।

ttttppp

২১ জানুয়ারী ১৯৮১ কংগ্রেসী গুন্ডাদের ছোঁড়া বোমার আঘাতে নিহত হন প্রশান্ত পাল ও হকার নিমাই দাস। কংগ্রেসী গুন্ডারা ৮০ দশকে উত্তর-মধ্য কলকাতার একের পর এক ছাত্রাবাসে নিজেদের ঘাঁটি বানিয়ে যত অসামাজিক কাজ কর্ম চালিয়ে যেতো। তার বিরুদ্ধে তখন আবাসিকের ছাত্রদের ব্যাপক ক্ষোভ ছিল। রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পর বিভিন্ন গণআন্দোলন শুরু হয়। দানা বাঁধতে থাকে কংগ্রেসী গুন্ডাদের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন।

এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ওইদিন প্রশান্ত পাল সহ গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী ছাত্ররা কংগ্রেসী গুন্ডাদের বিরুদ্ধে শিয়ালদার রফি আহমেদ ডেন্টাল কলেজের গেটের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। অতর্কিতে কংগ্রেসী গুন্ডারা হামলা চালায়। তাদের ছোঁড়া বোমায় সেদিন শহিদের মৃত্যু বরণ করেন প্রশান্ত ও নিমাই দাস।

প্রতি বছরের মতো এ বারও আইসা এই দিনটা যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করে। ডেন্টাল কলেজের সামনে শহিদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে। ১৯৮১-র সেদিনের আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত দিবাকর ভট্টাচার্য ও অতনু চক্রবর্তী উপস্থিত ছিলেন। অতনু তার বক্তব্যে সেদিনের ঘটনা ব্যাখ্যা করে বর্তমানে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ের কর্তব্য তুলে ধরেন। অতনু চক্রবর্তী, বাসুদেব বসু, দিবাকর, প্রবীর দাস, স্বপন রায়চৌধুরী, অশোক সেনগুপ্ত, আইসার রাজ্য সম্পাদক স্বর্ণেন্দু ও জেলা সম্পাদক সৌমেন্দু সহ অন্যান্য আইসা কমরেডগণ উপস্থিত ছিলেন। পরিচালনা করেন অন্বেষা।

tttt

বিশালগড়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির উপর বিজেপি’র প্রত্যক্ষ হামলা ও বাধারঘাটে সিপিআই(এম) নেত্রী রাজ্যসভার সাংসদ ঝর্ণা দাস বৈদ্যের উপর আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানাই। গণতন্ত্রের বধ্য ভূমিতে জঙ্গলরাজ কায়েম করে ত্রিপুরাকে বিরোধী শূণ্য করে তোলার বিজেপি’র এই ফ্যাসিবাদি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আবেদন জানাচ্ছি।

প্রেস বিবৃতি

আজ বিশালগড়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী দলীয় অফিসে মিটিং করতে এসে বিজেপি আশ্রিত সমাজবিরোধীদের দ্বারা পরিকল্পিতভাবে প্রত্যক্ষ হামলার শিকার হলেন। এই কাপুরুচিত হামলার ফলে সভাপতি নিজে, তাঁর গাড়ি চালক, স্থানীয় কংগ্রেস নেতা সুমন লস্কর সহ কয়েকজন কর্মী সমর্থক আহত হন। আহত কয়েকজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সভাপতির গাড়িটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে সমাজবিরোধীরা। আবার বাধারঘাটে দলীয় কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করতে গেলে রাজ্যসভার সাংসদ বাম নেত্রী ঝর্ণা দাস বৈদ্যের উপর হামলা করে বিজেপি। তাতে তাঁর দেহরক্ষী ও কয়েকজন বাম যুব কর্মী আহত হন। আমরা এই ফ্যসিবাদী হামলাগুলির তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। পুলিশের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার নিন্দা করছি। এই দুটি ঘটনায় বিজেপি মদতপুষ্ট সমাজবিরোধীদের আড়াল না করে, তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনানুসারে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সরকারের কাছে দাবি করছি। এই হামলার খুবই পরিষ্কার যে, রাজ্যে আইনের শাসন নেই। জঙ্গলরাজ কায়েম হয়েছে। সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনকে মুখ্যমন্ত্রী ও শাসকদল কুক্ষিগত করে রেখেছে। সর্বস্তরে দলতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে। দল ও প্রশাসন একাকার, যাতে রাজ্যকে বিরোধী শূণ্য করে তোলা যায়। ইতিমধ্যেই গত তিন বছরে ত্রিপুরা গণতন্ত্রের বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে। মতপ্রকাশের অধিকার, নাগরিক অধিকার বিপন্ন। কোন বিরোধী দলের রাজনৈতিক মিছিল মিটিং করার অধিকার নেই। দলীয় অফিস খুলতে গেলে বাঁধা, আক্রমণ, আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া নিত্যদিনের পরিঘটনা। কাজেই আজকের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গণতন্ত্রের বধ্যভূমিতে জঙ্গলরাজ কায়েম করে ত্রিপুরা রাজ্যকে বিজেপি আজ তার ফ্যাসিবাদি পরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবে বিরোধী শূণ্য করে তুলতে চায়। তাই আসুন সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হই। সংবিধান ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলি।

- পার্থ কর্মকার, রাজ্য সম্পাদক, সিপিআই(এমএল), ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি   

gggr4ggdee

ভরতপুর ব্লকে ঋণমুক্তি কমিটির বিক্ষোভ ডেপুটেশন

গত ১৬ জানুয়ারী মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর ব্লকের সীজগ্রামে ঋণগ্রস্ত মহিলাদের নিয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির রাজ্য সভাপতি কমরেড সজল পাল। ৩০ জন ঋণগ্রস্ত মহিলা এই বৈঠকে অংশ গ্রহণ করেন। বৈঠকে এলাকার মাইক্রোফিনান্স সংস্থার এজেন্টদের জুলুম নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনা উঠে আসে। দীর্ঘ লকডাউনের জন্য কাজ বন্ধ হওয়ার কারনে গ্রামের গরিব মেহনতিদের পরিবারের মহিলাদের চরম অর্থনৈতিক সংকট। তার উপর ঋণের বোঝার কারণে জীবন অতিষ্ঠ। বৈঠকে ঠিক হল ১৯ জানুয়ারী ভরতপুর বিডিও অফিসে ডেপুটেশন সংগঠিত করা হবে। সেই মতো ১৭-১৮ জানুয়ারী ২ দিন ধরে ব্লক জুড়ে মাইক নিয়ে গ্রামে গ্রামে প্রচার করা হল এবং ১৯ জানুয়ারী বেলা ১২টার সময় শ’খানেক ঋণগ্রস্ত মহিলাদের উপস্থিতিতে ঋণ মুক্তি কমিটির উদ্যোগে বিক্ষোভ ডেপুটেশন সংগঠিত করা হল। দাবি ছিল –
১) মাইক্রোফিনান্স সংস্থার এজেন্টদের জুলুম নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। মাইক্রোফিনান্স সংস্থার উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার জন্য উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করতে হবে।
২) ঋণের কিস্তি আদায় দুই বছর স্থগিত রাখতে হবে।
৩) গরিবদের ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সমস্ত ধরনের ঋণ মুকুব করতে হবে।

ডেপুটেশনে প্রতিনিধিত্ব করেন কমরেড গুলশান বেগম ও ফজলে আলম।

বহরমপুরে ট্রেড ইউনিয়নের যৌথ কর্মসূচী

মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরের কুঞ্জ ঘাটা বাজারে ১৩ জানুয়ারী বিকাল ৫টায় এআইসিসিটিইউ ও সিটুর উদ্যোগে দিল্লির কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে ও শ্রমিক-বিরোধী কর্পোরেট-স্বার্থবাহী শ্রম আইন বাতিলের দাবিতে পথসভা সংগঠিত করা হয়। সভায় এআইসিসিটিইউ’র পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন কমরেড আবুল কাসেম সেখ। সভা পরিচালনা করেন কমরেড মনভোলা চৌধুরী। ১৭ জানুয়ারী বহরমপুর শহরের টেক্সটাইল মোড়ে আবার যৌথ উদ্যোগে একই ইস্যুতে আইন অমান্য কর্মসূচী সংগঠিত হয়। তিন শতাধিক মানুষ এই বিক্ষোভ কর্মসূচীতে সামিল হয়ে গ্রেফতার বরণ করেন।

কৃষকদের সমর্থনে পার্টির বিক্ষোভ ও সভা

১৯ জানুয়ারী বেলা ২টার সময় ভরতপুর বিডিও অফিসের সামনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে নয়া কৃষি আইন বাতিল ও বিদ্যুৎ বিল-২০২০ বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভসভা অনুষ্ঠিত হয়। বিকাল ৪টার সময় ভরতপুর নতুন রাস্তার সীজগ্রাম মোড়ে সভা হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক কমরেড রাজীব রায়, জেলা কমিটির অন্যতম সদস্য কমরেড অপূর্ব লাহিড়ী, হায়দার সেখ, ফজলে আলম ও যুব নেতা মনভোলা চৌধুরী এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। সভায় ঋণগ্রস্ত মহিলাদের উপস্থিতি ও ব্যাপক সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য।

ddd

কেষ্টপুর অঞ্চলের অন্যতম স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশপ্রিয় বালিকা বিদ্যামন্দির। ৬২ বছরের পুরনো এই উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে বিগত ১৩ জানুয়ারী ছাত্রীরা স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ও রাস্তা অবরোধ করেন। কিছু বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় যে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে অনলাইন ক্লাসের সুবিধার্থে যে মোবাইল ফোন অথবা ট্যাব কেনার জন্য দশ হাজার টাকা আর্থিক সাহায্য প্রতিশ্রুতি মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা করেছিলেন সে বিষয়ে ছাত্রীরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন সে কারণে ১৫.০১.২০২১ তারিখে সেই বালিকা বিদ্যালয়ে আইসা রাজারহাট জোনাল কমিটির তরফ থেকে একটি অনুসন্ধান দল যায় এবং ছাত্রী ও অভিভাবকদের সাথে কথা বলে। ঐ অনুসন্ধান দলে ছিলেন শুভ্রদীপ, শুভদীপ ও দেবযানী। কিন্তু, অনুসন্ধান দলের তদন্তে চমকপ্রদ ভাবে অন্য তথ্য উঠে আসে। অভিভাবক ও ছাত্রীরা বলেন, বৈদ্যুতিন যন্ত্র সামগ্রী(ট্যাব) কেনার টাকার জন্য বিক্ষোভের তথ্য বাস্তব স্কুল কর্তৃপক্ষের রটানো। শুধুমাত্র একজন শিক্ষিকা ও ছাত্রীর বক্তব্য এক্ষেত্রে তুলে ধরা হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। বাস্তবে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রীদের এই শিক্ষাবর্ষে দু’বার করে ভর্তির ফি নেওয়ার অভিযোগে ছাত্রী ও অভিভাবকরা বিক্ষুব্ধ। কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে অভিভাবকদের সাথে কোনো আলোচনা হয়নি, উল্টে বিক্ষোভকারী ছাত্রীদের উচ্চমাধ্যমিকের ফর্ম ফিলাপের জন্য বারবার হয়রানি করা হচ্ছে এবং প্রত্যেকের প্রজেক্ট-এর নম্বরে ফেল করানোর হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। এই লকডাউনের সময় যখন আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে এদেশের সমস্ত মধ্যবিত্ত ও খেটে খাওয়া মানুষের পরিবার তখন অনৈতিকভাবে এক শিক্ষাবর্ষে দু’বার করে ভর্তি ফি নেওয়ার মতো ঘটনা সামনে এল, কলকাতা মহানগরীর উপকণ্ঠে রাজারহাট-ভিআইপি সংলগ্ন এই স্কুলে। যেখানে প্রায় ৩০০-এর কাছাকাছি দ্বাদশ শ্রেণীর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী এই জুলুমের শিকার। কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে অশ্লীল বাক্যবন্ধে ছাত্রীদের তিরস্কারের কথাও ছাত্রীরা অনুসন্ধান দলকে জানান, পাশাপাশি মিডিয়ার একাংশের ভুল সংবাদ পরিবেশনেও তারা বিস্মিত। আইসা’র পক্ষ থেকে ছাত্রী ও অভিভাবকদের এই লড়াইয়ে সবরকম সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও ছাত্র ও বৃহত্তর সমাজে এই ধরনের যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আইসা লড়ছে ও লড়বে।

vvv

. দক্ষিণ কলকাতার বাঘাযতীন এলাকাবাসীর কাছে ১৭ জানুয়ারী প্রিয়জন হারানো বেদনার এক দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনেই কংগ্রেসি সিআরপি-র নির্মম অস্ত্রের আঘাতে প্রকাশ্যে খুন হন, এলাকার কয়েকজন তরুণ। তারা জোতদার ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত শোষণের বিরুদ্ধে সারা দেশজুড়ে চলা ছাত্র-কৃষকের চলমান লড়াইয়ের শরিক ছিলেন। তারা প্রাণের বিনিময়ে সমস্ত বাঘাযতীন এলাকায় সামন্ততন্ত্র ও তার সহায়ক ষড়যন্ত্রীদের বিরুদ্ধে মেহনতি মানুষের একতার যে অনির্বাণ শিখা জ্বালিয়ে গেছিলেন, তা আজও বহ্নিময়।

গত ১৭ জানুয়ারী ২০২১ পার্টির বাঘাযতীন ব্রাঞ্চ ও টালিগঞ্জ কমিটির উদ্যোগে বারোভুতের মাঠ এলাকায় কমরেড শান্তনু ভট্টাচার্যের পরিচালনায় শহিদবেদীতে মাল্যদানের মাধ্যমে শহিদদের স্মৃতিচারণ করে ৩য় বাঘাযতীন ব্রাঞ্চ সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। উপস্থিত ছিলেন যাদবপুর লোকাল কমিটির বাবুন চ্যাটার্জী সহ অন্যান্য নেতৃত্বরাও। ফসল ও জমির উপর কৃষকের অধিকার আদায় তথা কৃষিবিপ্লবের শহিদ কমরেড দিলীপ দাসের অনুজ দীপক দাসের আবেগঘন স্মৃতিচারণে উপস্থিত সদস্যরা কর্পোরেট তোষণকারী এবং কৃষকবিরোধী বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে সারা দেশ জুড়ে মেহনতি মানুষের লড়াইয়ে আরও বেশি করে একাত্ম হওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। কমরেড তমাল চক্রবর্তী বলেন যে এমন বহু নৃশংস হামলা মোকাবিলা করেই পার্টি তার সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে চলেছে। জেলা সম্পাদক কমরেড অতনু চক্রবর্তী ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের বিভিন্ন দিকগুলি উল্লেখ করে প্রতিরোধ গড়ার শপথের কথা বলেন। কমরেড মলয় তেওয়ারি স্মরণ করিয়ে দেন যে ১৭ জানুয়ারী রোহিথ ভেমুলার শহীদ দিবস। তিনি বলেন যে নকশালবাড়ি থেকে ভোজপুরের পথ বেয়ে দলিত গরিব প্রান্তিক মানুষের উত্থানের সাথে সিপিআইএমএল রাজনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত।

. শহিদবেদীতে মাল্যদানের পর গাঙ্গুলিবাগান এলাকায় সম্মেলনের অধিবেশন শুরু হয়। পার্টির জেলা কমিটির তরফে পর্যবেক্ষক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন জেলা সম্পাদক কমরেড অতনু চক্রবর্তী। প্রথমেই রাজ্য স্ট্যান্ডিং কমিটির সার্কুলার পাঠ করা হয় ও তা নিয়ে মতামত বিনিময় হয়, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে কমরেড জেলা সম্পাদকের সাবলীল ব্যাখ্যায় সম্মেলন এগিয়ে চলে। বিদায়ী ব্রাঞ্চ সম্পাদিকা কমরেড চন্দ্রাস্মিতা সহ প্রত্যেক ব্রাঞ্চ সদস্য বিগত বছরে এলাকায় পার্টির কাজ, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে পার্টির প্রচারবৃদ্ধি, বিভিন্ন লোকাল দাবিদাওয়া সংক্রান্ত লড়াইয়ে পার্টির উপস্থিতি, বিবিধ যৌথ কর্মসূচী ইত্যাদী বিষয়ে আলোচনা করেন। চলতি বছরের আসন্ন বিধানসভা ও কর্পোরেশন ভোটকে কেন্দ্র করে পার্টির কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত এলাকায় রুপায়নের বিষয়ে পন্থাগুলির পর্যালোচনা ও প্ল্যানিং নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা চলে। ওয়ার্ড ভিত্তিক পার্টির কাজ বৃদ্ধি, প্রয়োজনে ওয়ার্ড কমিটি গঠন, এলাকার বিভিন্ন বামপন্থী শক্তির সাথে নিবিড় যোগাযোগ বৃদ্ধি, বিভিন্ন বিষয়ে তৃণমূলস্তরে এলাকাভিত্তিক সার্ভে, এইসমস্ত বিষয়ে আলোচনা হয়। এলাকার নিজস্ব দাবিদাওয়া ও সে বিষয়ে সরকারী উদাসীনতাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক প্রচার ও জনমত গঠনে চোখে পড়ার মতো উদ্যোগ নিতে হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৩য় বাঘাযতীন ব্রাঞ্চ সম্মেলনে উপস্থিত সমস্ত সদস্য কমরেড চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরীকে পুনরায় ব্রাঞ্চ সম্পাদিকা হিসাবে মনোনীত করেন। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনতার লড়াইকে তীব্রতর করার ডাক দিয়ে সম্মেলন শেষ হয়।

. সম্মেলনের শেষে সকল সদস্য বাঘাযতীন মোড়ে এক যৌথ প্রচারাভিযানে সামিল হন। ব্যানার, ফেস্টুন, গান ও স্লোগান সমন্বিত এই প্রচারাভিযানে বন্ধুপ্রতিম সংগঠনগুলির তরফে এপিডিআর, অরিজিত মিত্র স্মারক কমিটি, গণতান্ত্রিক উদ্যোগ ও বিভিন্ন ব্যাক্তি বর্গ সামিল ছিলেন। এআইসিসিটিইয়ু’র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কমরেড বাসুদেব বসু এই প্রচারাভিযানে উপস্থিত ছিলেন। তিনটি কৃষিবিল বাতিলের দাবিতে ও সারা দেশজুড়ে চলমান কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে এই প্রচারাভিযান যখন স্থানীয় আই ব্লক এলাকায় পৌঁছায় তখন সারা দেশের সবথকে বড় অন্যায়কারী দল বিজেপি তাদের বিচিত্র শব্দদূষণ সমন্বিত ‘আর নয় অন্যায়’ ট্যাবলো নিয়ে আমাদের প্রচারাভিযানের পথে এসে বাধা সৃশটি করে। উপস্থিত সব গণসংগঠনের সদস্যরা মিলিতভাবে রুখে দাঁড়ান। এলাকার মানুষও আমাদের পাশে দাঁড়ান। দৃশ্যতই বিজেপি গ্যাঙের দিকে ধাবমান আগ্রাসী লাল পতাকার আগুয়ান রূপ দেখে বিজেপি কর্মীরা এলাকা ছাড়েন। এরপর বাঘাযতীন-রানিকুঠি মেইন রোড ধরে একাধিক জায়গায় ধারাবাহিক পথসভা করে পল্লিশ্রী মোড়ে এই প্রচারাভিযান শেষ হয়।

- সংগ্রাম মণ্ডল  

ddare

১৫ ডিসেম্বর কমরেড কমল বসু (কানু) হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাত দু’টোয় প্রয়াত হন।প্রয়াত কমরেড কানু ছিলেন  দেশপ্রিয়নগর ব্রাঞ্চের সদস্য। ৭০ দশক থেকে পার্টির বিভিন্ন কাজকর্মে তিনি যুক্ত ছিলেন। তিনি পেশায় ছিলেন গিটার শিক্ষক ও বাদক। এক সময় তাঁর বাড়ি ছিল পার্টির আশ্রয়স্থল। কমরেড কানু কামারহাটি পৌরসভা নির্বাচনে ২০১০ ও ২০১৫ সালে যথাক্রমে ২৭ এবং ২৮ নাম্বার ওয়ার্ড থেকে পার্টির প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কমরেড কানুর অকাল প্রয়াণে পার্টি হারালো একজন একনিষ্ঠ কর্মীকে। পার্টির পক্ষ থেকে কমরেড কানু বোসের পরিবারকে সমবেদনা জানানো হয়েছে। অন্তিম যাত্রায় শামিল হয়েছেন জেলা পার্টি নেতা সুজিত ঘোষ, অর্চনা ঘটক, সাগ্নিক চক্রবর্তী, অশোক সাহা সহ স্থানীয় পার্টি কর্মীরা।

কমরেড কানু (কমল বসু) লাল সেলাম।

END

খণ্ড-28
সংখ্যা-3