ভাল্লিয়ামাল ও কোডারিয়াপার দেবীর সন্তান কমরেড শনমুগারাজের জন্ম হয়েছিল ১৯৫৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর তামিলনাড়ুর দিন্দিগুল জেলার সন্নিকট অট্টানচাত্রামের আরাসা পিল্লাই গ্ৰামে। তিনি সারা পার্টিতে কমরেড এনকে নটরাজন নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি স্কুলের পাঠ সমাপ্ত করেন অট্টানচাত্রামে। স্নাতোকত্তর স্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করেন পালানি আন্দাভার কলেজ অব আর্টস এন্ড কালাচার বিদ্যায়তনে। কলেজে পড়ার দিনগুলিতে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করতেন দর্শন ও রাজনৈতিক বিষয়ের সুগভীর চর্চায়। গান্ধীবাদী দর্শন, বিবেকানন্দর শিক্ষা ও জেসি কুমারাপ্পার ধারণাগুলি সম্পর্কে অধ্যয়ন করেন।
কারাটুপট্টির কমরেড মুথুরাজের সান্নিধ্যে বিপ্লবী রাজনীতি, চারু মজুমদার এবং মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। ১৯৮০’র দশকের গোড়ায় তিনি পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হন। এরআগে তিনি কিছুদিন সংবাদপত্রে সাংবাদিকের কাজও করেছেন। নীলগিরি জেলার পণ্য উৎপাদনের বাগিচাগুলিতে শ্রমিকদের সংগঠিত করার মধ্যে দিয়ে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মীর জীবন শুরু করেন। তীব্র নিপীড়নের সময়কালে তিনি কোয়েম্বাটুরের কারখানা শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করেছেন। তিনি তামিলনাড়ুর নামাক্কাল, ইরোড, সালেম ও ধরমপুরি জেলায় সম্পাদক ও নানান পদমর্যাদায় দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তিনি নামাক্কাল ও ইরোড জেলার কুমারাপালায়াম ও পাল্লিয়াপালায়াম অঞ্চলে নিপীড়িত পাওয়ারলুম শ্রমিকদের জঙ্গি সংগ্ৰাম সংগঠনে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন। তাদের মধ্যে পার্টি গঠনেও তিনি সফল হয়েছিলেন। তিনি রাজ্য সম্পাদক হিসাবে এবং বিপ্লবী ট্রেড ইউনিয়ন কাজে প্রতিশ্রুত এআইসিসিটিইউ’র অন্যতম সর্বভারতীয় নেতা হিসাবেও অনুশীলনে অবদান রেখেছেন। অসংগঠিত শ্রমিকদের মধ্যে তিনি সরল ও সাদাসিধে জীবন কাটিয়েছেন, জীবন ও জীবিকার জন্য তাদের সংগ্ৰামে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিতেও তাদের নিয়ে এসেছেন।
কোয়েম্বাটুর জেলায় তিনি বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের সংগঠিত করেছেন, কয়েকটা ইউনিয়ন গড়ে তুলেছেন এবং এআইসিসিটিইউ’র পতাকাতলে প্রিকল শ্রমিকদের জঙ্গি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সাধারণ জনগণ এবং শ্রমিকদের চালানো সংগ্ৰামের জন্য বেশ কিছু মমলায় অভিযুক্ত হন এবং জেলেও যান। কমিউনিস্ট কর্মী হিসাবে জনগণের জন্য ভালোবাসা এবং শ্রেণী সংগ্ৰামের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার ছিল অপরিসীম। জনগণ, শ্রমিক এবং পার্টি ক্যাডারদের কাছ থেকে পেয়েছেন নিরতিশয় ভালোবাসা।
কমরেড নটরাজনকে সবাই এনকে বলেই ডাকত, আর তিনি দীর্ঘদিন ধরে পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য ছিলেন। রাজ্য পার্টিতে ২০১৯ সালে কিছু সমস্যা দেখা দেয় এবং তাঁকে তখন রাজ্য পার্টির সম্পাদক করা হয়। ২০২০ সালে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। ২০২২ সালের ২৬-২৭ নভেম্বর ত্রিচিতে অনুষ্ঠিত রাজ্য সম্মেলনে তিনি সর্বসম্মতিক্রমে রাজ্য সম্পাদক হিসাবে পুনঃনির্বাচিত হন। রাজ্যে ২৮টা জেলায় পার্টির বিস্তারে তিনি নেতৃত্ব দেন। তিনি বাম ঐক্যের প্রতি প্রভূত গুরুত্ব আরোত করেন এবং ফ্যাসি-বিরোধী এজেন্ডায় বাম, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিগুলোকে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালান। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাটনায় অনুষ্ঠিত হতে চলা পার্টি কংগ্ৰেসকে সফল করে তোলার জন্য তিনি সারা রাজ্যে ঘোরাঘুরি করছিলেন। কমরেডদের বারবার বলা সত্ত্বেও তিনি নিয়মিত ওষুধ খেতে ভুলে যেতেন। গত ১০ ডিসেম্বর (যেদিন ছিল মানবাধিকার দিবস) পার্টির দিন্দিগুল জেলা বৈঠকে ভাষণ দেওয়ার সময় বিকাল ৪টা নাগাদ তাঁর শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। একটা বেসরকারি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁকে দিন্দিগুল সরকারি মেডিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কমরেডদের যথাসাধ্য প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সন্ধ্যা প্রায় ৬টার সময় আমরা কমরেড এনকে’কে হারাই। গোটা পার্টির কাছেই বিশ্বাস করাটা এখনও শক্ত হচ্ছে যে কমরেড এনকে আর নেই।
গত ১১ ডিসেম্বর বিকাল ৪টার সময় তাঁর নিজের গ্ৰাম আরাসাই পিল্লাইপট্টিতে তাঁকে দাহ করা হয়। পার্টির রাজ্য নেতৃবৃন্দ, আন্দোলনের কর্মীরা এবং বাম ও প্রগতিবাদী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ তাঁর প্রতি দরজ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
সিপিআই(এম)-এর রাজ্য সম্পাদক কমরেড কে বালকৃষ্ণান তাঁর গ্ৰামে যান এবং কমরেড এনকে’র প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। তিনি বাম ঐক্যের প্রতি কমরেড এনকে’র অঙ্গীকারবদ্ধতার প্রশংসা করেন এবং রাজ্যের বাম, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিজেপি-বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার তাঁর প্রচেষ্টার সমাদর করেন।
পিইউসিএল’এর অন্যতম সর্বভারতীয় সম্পাদক কমরেড বালোমুরুগণ কমরেড এনকে নটরাজনের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘকালের আন্তরিক সংযোগের স্মৃতিচারণা করেন এবং আন্দোলনের স্বর্থে তাঁর নিষ্ঠা ও দৃঢ় অঙ্গীকারের তারিফ করেন।
প্রিকল শ্রমিকদের নেতা কমরেড নটরাজন, এলটিইউসি’র জয়প্রকাশ এবং কোয়েম্বাটুর কর্পোরেশনের পূর্বতন কাউন্সিলর ভেল মুরুগানও তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কয়েক শত জনগণের উপস্থিতিতে তাঁর শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়।
তাঁর স্বপ্ন ছিল হাজার হাজার পার্টি সদস্য হবে, গণসংগঠনের সদস্য হবে লক্ষ লক্ষ, পার্টি অনেক বড় আকার নেবে। আসুন, আমরা তাঁর স্বপ্ন পূরণ এবং তাঁর আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথ নিই।
কমরেড এনকে লাল সেলাম।