৯২ বছর বয়সে পার্টির বর্ষীয়ান সদস্য কমরেড রবি মুখোপাধ্যায় প্রয়াত হয়েছেন মঙ্গলবার, ১ আগস্ট। কোভিড জয় করলেও দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন, কষ্ট পাচ্ছিলেন বার্ধক্যজনিত রোগে।
৩ আগস্ট ক্রিকরো পার্টি অফিসে তাঁর মরদেহে ফুলমালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল সহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ। ছিলেন রবিদার দুই পুত্র সুমিত ও সন্দীপ, পুত্রবধু সোমা ও অন্যান্য বন্ধুরা। আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে, মিছিল সহকারে এনআরএস মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে রবিদার মৃতদেহ দান করা হয়।
তাঁর জ্যাঠা ছিলেন অনুশীলন দলের বিপ্লবী। আর দাদু ছিলেন জমিদার। কুলীন বংশের এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই রবিদার বেড়ে ওঠা। অধুনা বাংলাদেশের কনকসার গ্রামে, নিজের মামাবাড়িতে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায়, দুর্ভিক্ষ পীড়িত বাংলাদেশ থাকতে না পেরে, বাবাকে হারিয়ে, মা-দুই ছোট ভাই আর একমাত্র বোনকে নিয়ে এপারে চলে আসেন। প্রথমে নেতাজির ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগ দেন, কলকাতায় গান্ধী এবং নেহরুর জনসভায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। সেখান থেকে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ছত্রছায়ায় আসেন, পার্টি সদস্যপদ লাভ করেন। রাজনৈতিক কাজের হাতে খড়ি হয় শ্রমিকদের নিয়ে। একইসঙ্গে শুরু করেন পণ্ডিত যশরাজের কাছে মার্গ সংগীতের তালিম নেওয়া। সেই চর্চার সূত্রে পার্টির সাংস্কৃতিক শাখায় জড়িয়ে পড়েন। এস ইউ সির শিবদাস ঘোষের সঙ্গে কিছুদিন টিটাগর জুট মিলে যৌথভাবে ট্রেড ইউনিয়নের কাজ করেন। পার্টি ভাগের সময় সিপিআই থেকে যোগ দেন সিপিএমে। তারপর ঘটে নকশালবাড়ি, আর তার ভিত্তিতে রবিদার ধ্যানজ্ঞান হয় নতুন পার্টি, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআই(এমএল)। কাজ করতেন ডালহৌসি অফিসপাড়া ইউনিটে। পুলিশের নজরে পড়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে বাধ্য হন। সেখান থেকে আন্দোলনের ঝটিকা কেন্দ্র গ্রামাঞ্চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি ছেড়ে সর্বক্ষণের কর্মী হন।
তারপর সংগ্রামে ধাক্কা নেমে আসার পর নানা কারণে রবিদার পার্টি জীবনে সাময়িক বিচ্ছিন্নতা আসে। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে ফের মার্গ সঙ্গীতেই ফিরে আসার চেষ্টা করেন মন ভালো রাখতে। না, সেদিকে বেশিদিন মন টেঁকেনি। ১৯৮০-র দশক আইপিএফের হাত ধরে নতুন করে ফিরে আসেন রাজনৈতিক জীবনে। নিজেকে যুক্ত করেন সিপিআইএমএল (লিবারেশন)-এর সঙ্গে । তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাননি, সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-জড়তা ঝেড়ে ফেলে সক্রিয় হলেন সংগ্রাম ও সংগঠন গড়ে তোলার কাজে। চুক্তিবদ্ধ কর্মচারীদের ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে জেনারেল ইন্সিওরেন্স কোম্পানিতে ঐতিহাসিক আন্দোলন গড়ে তোলা, শেষপর্যন্ত কর্তৃপক্ষকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করা – কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারিদের মধ্যে পার্টির গণভিত বাড়াতে সাহায্য করেছিল।
সংগ্রামী বামপন্থী রাজনীতির লোক হলেও পাড়ায়, এলাকায় রবি মুখোপাধ্যায়ের একটা সামাজিক পরিচিতি ছিল। নাগরিক আন্দোলন, জলাশয় বাঁচানোর আন্দোলন, সমবায় আন্দোলন, ক্লাব সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আন্তরিক উদ্যোগ নিতেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে অবাধে মিশে যেতে পারতেন। ব্যবহারে বিনয়ী, রসিক, মিশুকে, আড্ডাবাজ কিন্তু রাজনৈতিক অবস্থানে অবিচল রবিদা ছিলেন আমাদের আজীবন পার্টি সদস্য। শেষ জীবনে বার্ধক্যজনিত দূরারোগ্য ব্যাধির যন্ত্রণা ভুলতেন আতসকাঁচ দিয়ে দেশব্রতী পড়ে। খুব কাছ থেকে একাধিকবার কমরেড চারু মজুমদার, কমরেড সরোজ দত্তদের সান্নিধ্য পাওয়া প্রজন্মের একজন ছিলেন রবিদা।
বড় দুর্দিনে চলে গেলেন। রেখে গেলেন পরিবার-পরিজন, বৃহত্তর পরিবার-সম প্রিয় পার্টি আর লাল টুকটুকে স্বপ্ন।
কমরেড রবি মুখোপাধ্যায় লাল সেলাম।