গত ২০ জুলাই, দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় স্মারক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় বই-চিত্র সভাঘরে। এই সভায় “আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া সাংস্কৃতিক দীনতা ও পিঠ বাঁচানো চালাকি” নিয়ে বলেন বামপন্থী চিন্তক ও যশস্বী সাহিত্যিক কিন্নর রায় তাঁর অনুপম স্বকীয়তায়। একক গানে ছিলেন সংহিতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সুগ্রন্থিত গানের অসাধারণ সম্ভার নিয়ে।
সভার শুরু হয় নবান্ন-সম্পাদক গণশিল্পী নীতিশ রায়ের “বন্ধু রে” গানটি দিয়ে। আলোচনার শুরুতে অন্যতম আয়োজক প্রাবন্ধিক নিত্যানন্দ ঘোষ আলোচকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কিন্নর রায় দিলীপ ব্যানার্জী প্রসঙ্গে তাঁর বৌদ্ধিক দীপ্তির সঙ্গে অত্যন্ত সংবেদনশীল, মানবিক হৃদয়-ঐশ্বর্যের কথা তুলে ধরেন। সেই জের টেনে মূল আলোচনায় এসে তিনি বলেন রাষ্ট্র কীভাবে সমস্ত অতীত ঐতিহ্য মুছে ফেলে এক ভয়ের বাতাবরণ গড়ে তুলছে বেপরোয়া স্বেচ্ছাচারিতায়, অবাধ হিংস্রতায়। শুধুমাত্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে মানুষকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। কোভিডএর সময় লক ডাউন, ভ্যাকসিন নিয়ে চলেছে অকথ্য অনাচার। চলেছে লুঠ। সাধারণ মানুষের জীবনের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, চাকরির অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সহ সমস্ত সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার নিয়ে প্রতিদিন টানাটানি করা হচ্ছে। মানুষের মধ্যে ধর্মনিয়ে বিদ্বেষ বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে। হিন্দু রাষ্ট্র চাই। তাই খৃস্টান ও সংখ্যালঘুদের উৎখাতের প্রস্তুতি চলছে। এদিকে আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্যে মানুষ অনাহারে ধুঁকছে। তিনি বলেন,আমরা এমন একটা প্রতারিত সমাজে বাস করছি। প্রতারণা করছি নিজের সাথে। দ্বিচারিতা করছি নিজের সাথে। এমনকি সাহিত্য, গান, নাটক, সিনেমাতেও এই দ্বিচারিতা চলছে। হিংস্র হয়ে উঠছি আমরা ভিতরে ভিতরে। অন্যদিকে আপোসকামী। গল্পে রেল পুলিশের অত্যাচারের কথা বললেও রাজ্য পুলিশের কথা বলি না। অন্যায়ের প্রতিবাদে প্রয়োজনীয় স্বাক্ষর দিতে আমাদের দ্বিধা। ভুলে থাকি আমাদের প্রতিবাদী কবি সরোজ দত্তের কথা। মুখে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কথা বলি, কিন্তু সুযোগ খুঁজি বড় বাজারি পত্রিকায় লেখা ছাপানোর। সাংস্কৃতিক জগতেও পচন ও স্খলন চলছে। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে, মাইলাই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সেদিন সমস্ত মানুষ পথে নেমেছিল। আজ যুদ্ধ বিরোধী আবেগ কোথায়? শিশির ভাদুড়ী পদ্মপুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কিন্তু জাতীয় নাট্যমঞ্চের জন্য সারাজীবন চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। আজ কোথায় কল্লোল, তীর, মানুষের অধিকার-এর মতো নাটক? পোস্ট ট্রুথ-এর যুগে আমরা আপাত সরল, আপাত মিথ্যার মধ্যে ডুবে আছি। আমাদের বর্তমান শাসকরা গোয়বলসীয় কায়দায় মিথ্যাকে ‘সত্যি’ করে তুলছে। আমরা নির্বাক! ক্ষমতার কাছে শিরদাঁড়া বিকিয়ে গেছে আমাদের! প্রতিদিন নগ্ন হই ক্ষমতার কাছে! তাই বিসমিল্লার মত সুরসাধক যিনি দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়ে বিশ্বনাথ মন্দিরের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সানাই বাজিয়ে যেতেন, যে বাজনা শুনে আবালবৃদ্ধবনিতা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তাঁকে অনুসরণ করতো মন্ত্রমুগ্ধের মতো, সেই সাধকের বাড়ি আমরা রক্ষা করতে পারিনি! আমরা রক্ষা করতে পারিনি বাবরি মসজিদ! আমরা এক সময় আওয়াজ তুলেছি-দুনিয়ার মজদুর এক হও! আজ ভুবনগ্রামে নিজের সবকিছুই হারিয়ে ফেলছি। আমরা সাহসের সঙ্গে ছোট ছোট প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলে অশোক স্তম্ভের ঐ বিকৃত সিংহের হিংস্র মুখব্যাদান আমাদের দেখতে হত না! অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে ছিলেন প্রতিভাময়ী সুকন্ঠী সংহিতা। তিনি রবীন্দ্রনাথ থেকে অনায়াসে যেতে পারেন জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’য় কিংবা গণসংগীতের উদ্দীপনায় অথবা নিজের কথায় নিজের সুরে গাওয়া একান্ত বিভোরতায়। শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধতার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়েও রেশ রেখে যায়।