খবরা-খবর
হাওড়ায় বিষমদে গণমৃত্যুর তথ্যানুসন্ধান করল সিপিআই(এমএল)
CPIML seeks information

(৭ জনের টীম বিষমদ কান্ডে মৃত ব্যক্তিদের পরিবার, প্রতিবেশী ও মালিপাঁচঘরা থানার আইসি-র সাথে কথা বলে তৈরি করেছেন এই রিপোর্ট)

গত ১৯ জুলাইয়ের রাতটা হাওড়ার মালিপাঁচঘরা থানার অন্তর্গত গজানন বস্তি এলাকার মানুষের কাছে এখন দুঃস্বপ্নের অন্য নাম। মূলত বিহার-উত্তরপ্রদেশ থেকে কাজের খোঁজে আসা কয়েকশো পরিবারের অস্থায়ী ঠিকানা এই বস্তি। আর পাঁচটা বস্তির মতোই এখানেও নিকাশি অবস্থার হাল চরম বেহাল, স্থানীয় পরিবারগুলোর প্রায় প্রত্যেকটিই অর্থনৈতিক দিক থেকে ভীষণভাবে বিপর্যস্ত এবং সারাদিন চরম খাটুনির পরে বাড়ি ফিরে দেশি মদের নেশা করা এক স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছিল এখানে। যেখানে তাদের ন্যূনতম রেশন নেই, স্বাস্থ্য পরিষেবা নেই, মুটে-মজদুরি খাটার মতো পেশারও কোনও নিশ্চয়তা নেই – সেখানে হয়তো খুব স্বাভাবিকভাবেই এই কঠোর বাস্তব থেকে নিজেকে খানিকক্ষণ বিচ্ছিন্ন রাখার তাগিদে থেকেই হয়তো কেউ কেউ শুরু করেছিলেন নেশা করা। তারপর যা হওয়ার তাই হয়েছে। প্রত্যেকদিনের এই অবিরত আবর্তেই চলতে থাকে গজানন এবং এদের মতো আরোও অনেক বস্তির জীবনচক্র।

আপাত শান্ত এই এলাকার সমস্ত নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল গত ১৯ জুলাই থেকে।

স্বপন দাস পেশায় স্থানীয় লোহার কারখানায় ঠিকামজুর। অন্যদিনের মতো এ দিনও তিনি তার বাড়ির থেকে দুপা দূরে গত ৪০ বছর ধরে চলা মদের বেআইনি ঠেকে গিয়ে কিছু সময় কাটিয়ে সবে বাড়ি ফিরেছেন। বাড়িতে টলমল পায়ে ঢুকতে ঢুকতেই শুনতে পেলেন তার মেয়ে (যে এইবার উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে) ফর্ম ফিলআপ করেছে কলকাতার এক কলেজে। স্বপন দাস নিজে কখনও স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি, তার মনের মধ্যে আনন্দ আর দুশ্চিন্তা একসাথেই ভর করেছিল কিনা তা আর জানার উপায় থাকেনি। সেই রাত্রেই খিচুনি উঠে তার একমাত্র মেয়ে স্নেহার সামনেই কাতরাতে কাতরাতে নিথর হয়ে যায় তার দেহ। অনেক আকুতি মিনতির পরে এক প্রাইভেট ডাক্তার এসে ১০০০ টাকার বিনিময়ে লিখে দেন স্বপন দাস মৃত। “মদ খেয়ে মরেছে” – এই কারণে কার্যত এক অসহায় মহিলা ও তার মেয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে নিকটাত্মীয়েরা !!

সেই রাতেই একের পর এক ঘরে আলো জ্বলে উঠতে থাকে। হাহাকার আর কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ।

তিন বছর ও দেড় বছরের দুই শিশুকে ফেলে রেখে মারা গেলেন ২০ জুলাই রাত্রে নীতীশ সিং। বিহার থেকে জনমজুরির কাজে আসা ‘বিস্কুট লাল’ (এই নামেই সে পরিচিত) এর দেহ পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্যাকেট বন্দী করে ছাপরা জেলায়।

সরকারি হিসাব বলছে মৃতের সংখ্যা ৯, বেসরকারি হিসাবে সংখ্যাটা মোটেই ৯ নয়।

স্বপন দাসের স্ত্রীর দাবি তার স্বামীর দেহের সামনে তাকে কাঁদার সময়টুকু দেয়নি আমাদের উর্দীধারী পালোয়ানেরা! পোস্টমর্টেম না করেই তড়িঘড়ি সালকিয়া বাঁধাঘাটে অন্ত্যেষ্টি শেষ করা হয় তার।

এখনও বার্নিং ঘাটের একটা স্লিপ ছাড়া কোনও সরকারি নথি পাননি তার স্ত্রী। নীতীশ সিং-এর ভাইয়ের দাবি হাসপাতাল ও সৎকার বাবদ ১৫০০০ টাকা খরচ করার পরেও পুলিশ তার ভাইয়ের দেহ পাড়ায় আনতে দেয়নি। ছোটো ছোটো দুটো শিশু যারা সবেমাত্র হাঁটতে শিখেছে তারা টলমল পায়ে আজকেও এঘর ওঘর খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের বাবা কে।

ওই বস্তির ওই নকল দেশী মদের ব্যাবসা চালাতো প্রতাপ নামে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ এক স্থানীয় গুণ্ডা। ঘটনার পরে সে সহ আরোও কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে। শাসকদলের ও পুলিশের পরোক্ষ প্রশ্রয়ে দিনের পর দিন নকল মদ বানিয়ে ভাটির ব্যবসা চলতো রমরমিয়ে। তার খেসারত দিত হল এতোগুলো পরিবারকে, মানুষকে তাদের জীবন দিয়ে। এখনও প্রায় ৪০ জন মৃত্যুর সাথে লড়ছেন সত্যবালা/হাওড়া জেনারেল হাসপাতালে!!

অনুসন্ধান শেষে প্রতিনিধিদল গিয়েছিল ঘটনাস্থল থেকে ২০০ মিটার দূরত্বে থাকা হাওড়া মালিপাঁচঘরা থানায়। সেখানে আই সি-র সাথে বিস্তারিতভাবে কথা হয় অনুসন্ধানকারী দলের রিপোর্টনিয়ে। এই ঘটনায় পুলিশ কিছুটা ব্যাকফুটে রয়েছে। ১৯/২০ জুলাই রাতে পুলিশের ভূমিকা, ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বপন দাসের দেহ সৎকারের প্রসঙ্গে আইসি জানান হাসপাতালের ডাক্তার নাকি ময়নাতদন্তের জন্যে না লিখলে সেটা করা যায়না। অনুসন্ধানকারী দল পরিস্কারভাবে ক্ষোভের কথা আইসিকে জানাতে তিনি অনুরোধ করেন এরকম কোনও অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট পরিবার এসে থানায় এফআইআর দায়ের করতে চাইলে তিনি সহযোগিতা করবেন। আইসি-র সামনে কেসের ডিটেলস সহ অন্যান্য নানা বিষয়ে আমাদের ও স্থানীয়দের অসন্তোষ এর কথা তুলে ধরা হয়। আইসি কথা দেন যে আর এই মদের ভাটি চলতে দেওয়া হবে না। তিনি অনুসন্ধানকারী দলের দাবি মেনে থানার কমিউনিটি ডেভলপমেন্টে কর্মসূচির মাধ্যমে এলাকায় নেশামুক্তির প্রচার করবেন ও দরকারে এলাকার যুবদের এই কর্মসূচিতে যুক্ত করবেন বলেন। পার্টি প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর আর্থিক ক্ষতিপূরণ/পিতাহারা ছেলে/মেয়েদের বিনামূল্যে স্কুল/কলেজে ভর্তি ও পড়াশোনার জন্যে সরকারি সাহায্যের দাবি স্বামীহারা মহিলাদের স্বনির্ভর করে তোলা ও সরকারি ভাতার দাবি নিয়ে জেলাশাসকের কাছে স্মরকলিপি জমা দেওয়া হবে।

সরকারি সাহায্যের দাবিতে লড়াই জারি রাখার পাশাপাশি আইসা হাওড়া জেলা কমিটি বিষমদে প্রয়াত স্বপন দাসের মেয়ে স্নেহা দাসের কলেজে ভর্তী ও পড়াশোনার সমস্ত খরচের দায়িত্ব নেয়। এই অঙ্গীকার করা হয়েছে। পরিবারগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে যাতে এখনও দায়ের হয়নি এমন মামলাগুলো থানায় নথিবদ্ধ হয়। অনুসন্ধানকারী প্রতিনিধি টীমে ছিলেন পরিতোষ ব্যানার্জি, কল্যাণী গোস্বামী, অঙ্কিত মজুমদার, রতন দত্ত, প্রণব মন্ডল, এ কে গুপ্তা, ও কার্তিক পান্ডে।

- অঙ্কিত

খণ্ড-29
সংখ্যা-29