৩০ জানুয়ারী ২০২০ আজকের দেশব্রতী পত্রিকার বিশেষ বৈদ্যুতিন সংখ্যা-৩
pghosh

 

গান্ধীজীর ৭৩ তম হত্যা দিবসে সাম্প্রদায়িক বিভেদের রাজনীতির বিরুদ্ধে বামপন্থী বিভিন্ন দল ও কংগ্রেসের
যৌথ সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ

 

সম্পাদকীয়

মুর্শিদাবাদ জেলার জলঙ্গী থানার অন্তর্গত সাহেবনগর অঞ্চলের স্থানীয় মানুষজন সিএএ, এনআরসি ও এনপিআর ইত্যাদির বিরোধিতায় প্রতিবাদ আন্দোলন করছিলেন। শান্তিপূর্ণ এই প্রতিবাদের উপর তৃণমূলী দুষ্কৃতীদের নির্বিচার গুলি ও বোমাবর্ষণ চলল। দুজন প্রতিবাদকারীর মৃত্যু হল। উত্তরপ্রদেশ আসাম কর্নাটকের পর বিরোধিতায় হত্যার তালিকায় যুক্ত হলো বাংলার নাম। উত্তরপ্রদেশ আসাম কর্নাটক – এই তিনটি রাজ্যই বিজেপি শাসিত। এনআরসি, এনপিআর, সিএএ ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের ওপর লাঠি গুলি টিয়ারগ্যাস চালানো, পুলিশ গ্রেপ্তার ও হয়রানি দেশবাসীর কাছে অজানা তথ্য নয়। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত প্রতিবাদরত মহিলাদের হুমকি দিয়েছেন আর তার দলের সাংসদরা নেতারা বোমা-গুলি ছাড়া কথাই বলতে পারছেন না।

কিন্তু সিএএ বিরোধিতায় বহু টালবাহানার পর বিধানসভায় প্রস্তাব গ্রহণ করলেও নাগরিকত্বের প্রশ্নে আন্দোলনের অধিকার একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার দলের হাতেই কুক্ষিগত করার ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতি হিসেবে তৃণমূলীদের হাতে মুর্শিদাবাদে প্রাণ গেল দুই নিরীহ প্রতিবাদকারীর। হত্যার যথাযথ কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই। গণআন্দোলনের উপর দমনপীড়নের আমরা তীব্র নিন্দা করি এবং দুষ্কৃতীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই। বাংলার বামপন্থী গণতান্ত্রিক মানুষ পশ্চিমবাংলাকে উত্তরপ্রদেশে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করবে।

 

দিল্লীর ভোটারদের কাছে বিজেপি শুধু সাম্প্রদায়িক এবং স্বৈরতান্ত্রিক গরলই ওগরাচ্ছে

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয় ২৮ জানুয়ারি ২০২০)

পাঁচ বছর আগের প্রজাতন্ত্র দিবসে, দিল্লীর গত বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বারাক ওবামা তাঁর অতিথি ও বন্ধু হওয়ার বড়াই করেছিলেন, দশ লাখি স্যুটকেও জাহির করেছিলেন যার সমস্ত স্থানে সুতোর কারুকাজে তাঁর নাম খোদাই করা ছিল। ২০২০র প্রজাতন্ত্র দিবসে নরেন্দ্র মোদীর অতিথি হয়েছিলেন ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি জাইর বোলসোনারো। এই বোলসোনারো বর্ণবাদী, নারী বিদ্বেষী এবং সমকামী বিদ্বেষী ঘৃণাভরা বাচনিকতার জন্য কুখ্যাত; সামরিক একনায়কতন্ত্র ও গণহত্যাকে মর্যাদাপূর্ণ করে তোলা এবং আমাজন ঘনবর্ষণ বনাঞ্চলের ব্যাপক এলাকা ধ্বংস করার জন্যও তিনি কলঙ্কিত। কোনো রাষ্ট্রের প্রধান যে ধরনের মানুষদের সঙ্গে মাখামাখি করেন সেটা দিয়েই তাঁর পরিচয় বোঝা যায়। আন্তর্জাতিক জনমত আজ যে মোদীকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্বৈরনায়কদের অন্যতম রূপে গণ্য করছে, সেই ব্যাপারটায় যৌক্তিকতা প্রদান করছে তাঁর অতিথি নির্বাচনের ধরনটা।

ব্রাজিল এবং ভারতের জনগণ যথাক্রমে বোলসোনারো এবং মোদীর হাত থেকে তাঁদের দুই গণতন্ত্রের রক্ষায় মরণ-বাঁচন লড়াই চালাচ্ছেন। স্বৈরাচারী এবং ধর্মান্ধ এনপিআর, এনআরসি, সিএএ-র কবল থেকে প্রজাতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করা এবং সংবিধানের মূল্যবোধের পুনরায় আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০২০র প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারতে এবং বিদেশের দূতাবাসগুলিতে শক্তিশালী প্রতিবাদ দেখা গেছে। লণ্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনে ভারতীয় এবং দক্ষিণ এশীয় প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে সঙ্গতভাবেই যোগদান করেন ব্রাজিলের ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনকারীরা। দিল্লীর শাহিনবাগে রাধিকা ভেমুলা জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় হাজারো মানুষ যোগ দেন।

আসন্ন নির্বাচনে মোদী ও তাঁর দলের দিল্লীর ভোটারদের কি দেওয়ার আছে তার সংকেতও মিললো বোলসোনারোকে প্রধান অতিথি হিসাবে বেছে নেওয়ার মধ্যে। এবার আর “উন্নয়ন” ও “সুশাসন” উপহার দেওয়ার কোন ভড়ং নেই। মোদীর বিমুদ্রাকরণ বিপর্যয় সৃষ্ট অর্থনীতির ধ্বংসাবশেষ যখন ভারতীয় জনগণের মাথায় ভেঙে পড়ছে, মোদী এবং শাহ তখন মন্ত্রী ও দলের সাংসদদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যাতে তারা দিল্লীর ভোটারদের খোলাখুলিভাবে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও হিংসা বিলোতে পারেন।

অমিত শাহ দিল্লীর ভোটারদের এমন ক্রোধে ইভিএম-এর বোতাম টিপতে বলেছেন যাতে শাহিন বাগের মহিলারা বিদ্যুতের “তড়িতপ্রবাহকে” অনুভব করতে পারে। বিজেপি মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর এক নির্বাচনী সভায় প্রকাশ্যেই শ্রোতাদের কাছে “বিশ্বাসঘাতকদের গুলি করে মেরে ফেলার” আহ্বান জানান, এবং ঐ কথা বলে তিনি পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেন যে, বিরোধী নেতৃবৃন্দ এবং সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদকারীদের তিনি বিশ্বাসঘাতক বলেই গণ্য করেন। বিজেপি সাংসদ প্রবেশ ভার্মা দিল্লীর ভোটারদের এই কথা স্বীকার করতে বলেন যে, মোদী ও শাহ তাঁদের সেই সম্প্রদায়ের হাত থেকে রক্ষা করছেন যে সম্প্রদায়ের লোকজন শাহিন বাগ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হিন্দুদের ঘরে ঢুকে মেয়েদের ধর্ষণ করবে ও মানুষদের খুন করবে। সম্ভবত এই ধরনের ঘৃণাভরা কথার ফলস্বরূপই বন্দুক হাতে দুজন লোক ক্ষয়ক্ষতি ও সহিংস নাশকতা চালানোর উদ্দেশ্যে শাহিন বাগে ঢোকে।

ইতিমধ্যে, প্রায় এক মাস আগে এবিভিপি-র যে সমস্ত ক্যাডার জেএনইউ-র ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের ওপর হিংস্র সশস্ত্র আক্রমণ চালায়, দিল্লী পুলিশ তাদের একজনকেও গ্ৰেপ্তার করতে অস্বীকার করেছে। তবে তারা কিন্তু জেএনইউ-র এক ছাত্রের দায়িত্বজ্ঞানহীন এক ভাষণকে “দেশদ্রোহ” বলে গণ্য করে তার পিছু ছুটে তাকে ধরেছে, এবং তাকে এনপিআর-এনআরসি-সিএএ বিরোধী শাহিন বাগের ও দেশব্যাপী প্রতিরোধের “নেতা” হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। নারীদের নেতৃত্বে চালিত দিল্লী ও ভারতের জনগণ কিন্তু ঘৃণা ও হিংসার এই লাগামছাড়া বর্ষণের মুখে অবিচলিত রয়েছেন। দিল্লীর নির্বাচনে এবং ভারতবর্ষে যাতে ঘৃণাকে পরাস্ত করে ভালোবাসা, বিবেকের বিক্রম, সংবিধানের সামূহিক মলিকানা, এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অধিকার ও গণতন্ত্রের ইস্যুগুলো জয়লাভ করতে পারে সেটা সুনিশ্চিত করতেই তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

 

৭ম রাজ্য বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরামের সম্মেলন ও তার বার্তা

নবেন্দু দাশগুপ্ত

bcmf

 

২৬ জানুয়ারী ২০২০ প্রজাতন্ত্র দিবস এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত 'বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরাম' (বিসিএমএফ)-এর সপ্তম সম্মেলন চাঁপদানিতে অনুষ্ঠিত হল। পলতা ঘাটে জমায়েত, ওখান থেকে জাতীয় পতাকা সহ লাল পতাকা নিয়ে মিছিল সম্মেলনের সভাস্থলে পৌঁছাল। অস্থায়ী শহীদবেদীতে জাতীয় তেরঙ্গা পতাকা তোলেন কমরেড ধ্রুবদাস শূর, লাল পতাকা উত্তোলন করেন কমরেড শ্যামল বাগ এবং শহীদ ও প্রয়াত কমরেডদের স্মৃতিতে নীরবতা পালন করা হয়। এরপর প্রতিনিধিরা মিলিতভাবে সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করে প্রয়াত কমরেড ব্যোমকেশ ব্যানার্জী সভাগৃহ ও কমরেড রামবাবু পাশোয়ান মঞ্চে প্রবেশ করে। কমরেড মেঘ্না মজুমদার ও বাবুনি মজুমদার 'কাগজ নেহি দেখাঙ্গে' সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়।

মিছিলের জমায়েত গান্ধীজীর মূর্তির পাদদেশে। চারিদিকে ফুলের মালা দিয়ে সাজানো হয় গান্ধীজীর বেদী। ২৬ জানুয়ারি, ১৫ আগস্ট আমরা যা দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম তা হল তারস্বরে মাইক বাজিয়ে দেশভক্তি প্রচার কিন্তু এবার তা শোনা গেল না। জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন দল বা দল বিহীন প্রচার নো এনপিআর, নো এনআরসি, নো সিএএ ব্যানার ঝোলানো। এই পরিস্থিতির ছাপ সম্মেলনও দেখা যায়।

বিসিএমএফ সাধারণ সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেন। এই প্রস্থাবনায় যে বিষয়ের উপর জোর দেওয়া হয়েছে – ১. মোদী সরকার-২ ক্ষমতায় আসার পর কেন্দ্রীয় সরকার শ্রমিকদের উপর আক্রমণ তীব্র করেছে। ৪৪টি শ্রম আইনকে বাতিল করে ৪টে লেবার কোডের প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে মজুরি কোডকে আইনে পরিবর্তন করেছে। অন্য দুটি কোড সংসদের স্ট্যান্ডিং কমিটিতে আছে, সংসদে পেশ করার অপেক্ষায়। 'ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন কোড বিল ২০১৯' এর মাধ্যমে শ্রমিকদের অবাধ ছাঁটাইয়ের ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য লোকসভায় পেশ করা হয়েছে। চলতি যে আইনগুলি ছিল – 'ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্ট ১৯২৬' 'ইন্ডাস্ট্রিয়াল এমপ্লয়মেন্ট (স্ট্যান্ডিং অর্ডার) অ্যাক্ট ১৯৪৬' এবং 'ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপুট অ্যাক্ট ১৯৪৭'-সেগুলিকে বাতিল করা হল।

এই অসহণীয় পরিস্থিতিতে চটকলে কর্মরত ২১টি ইউনিয়ন রাজ্য সরকারের কাছে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে ২২ দফা দাবি সনদ পেশ করে। রাজ্য সরকার ত্রিপাক্ষিক মিটিং করা নিয়ে টালবাহানা করতে থাকে। তখন ইউনিয়নগুলো ১৩ মার্চ থেকে লাগাতার ধর্মঘটের নোটিশ জারি করে। এই সময় শ্রমমন্ত্রী তড়িঘড়ি করে ত্রিপাক্ষিক মিটিং ডেকে কয়েকটি ইউনিয়নকে দিয়ে এক অসম মজুরি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন। বিসিএমএফ সহ ৮টি বামপন্থী ইউনিয়ন এর প্রতিবাদে অসম মজুরি চুক্তিতে স্বাক্ষর না করে ত্রিপাক্ষিক মিটিং ছেড়ে বেরিয়ে আসে। এই চুক্তিতে নিউ এন্ট্র‍্যান্টদের দৈনিক মজুরি বৃদ্ধি যেখানে ১১২ টাকা সেখানে ৮০ শতাংশ শ্রমিকের মজুরিবৃদ্ধি হয়েছে দৈনিক মাত্র ২ টাকা এবং হাজিরা ভাতা মাত্র ৫০ পয়সা। চুক্তিতে স্বাক্ষর না করার জন্য শ্রমিকরা ইউনিয়নের উপর আস্থা জ্ঞাপন করেন।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ইউনিয়নগুলির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটছে। এই সময় চটকল ইউনিয়ন এবং শ্রমিকদের সাথে তার সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস হয়ে চলছে। পুরানো মজুরি কাঠামোর সাথে যুক্ত শ্রমিক যারা মজুরির উপর ৪১.৯৭% ফ্রীঞ্জ বেনিফিট পান তাদের সংখ্যা কমতে কমতে ২০ শতাংশের নীচে এসে দাঁড়িয়েছে। আগামীতে তা শূন্য শতাংশে দাঁড়াবে। নতুন (নিউ এন্ট্রান্ট) যারা কাজে ঢুকেছেন তাদের একটা অংশের নাম মাস্টার রোলে থাকা সত্ত্বেও ফ্রীঞ্জ বেনিফিটের আংশিক সুবিধা পান। ফল স্বরূপ এই শ্রমিকরা নিজেদের মিল ছেড়ে অন্য মিলে বেশি টাকা মজুরির জন্য কাজ করতে চলে যায়। এই ক্ষেত্রে শ্রমিকরা প্রতিদিন এক মিল থেকে আরেক মিলে নগদ মজুরির দরকষাকষি করে কাজে ঢোকেন। দিনের শেষে নগদ মজুরি হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরেন, মিল কর্তৃপক্ষ এই শ্রমিকদের কোন সামাজিক সুরক্ষা দেয় না। এই ধরনের ফ্লেক্সিবেল শ্রমিক সব মিলে ছেয়ে গেছে। রেগুলার শ্রমিক থেকে তুলনামূলকভাবে এরা মজুরি বেশি পান। কিন্তু এদের কোনো সামাজিক সুরক্ষা নেই, 'হায়ার এণ্ড ফায়ার' নীতিতে নিযুক্ত হন। এরা মিলে ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক রাখে না। দ্বিতীয়ত যারা পুরানো শ্রমিক বেশিরভাগেরই অবসরের বয়স হয়ে গেছে তাই তারা ইউনিয়নের কাজের ঝুকি নিতে চান না। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মিল কর্তৃপক্ষ সব মিলেই অলিখিতভাবে ঠিকাদারি প্রথা চালু করে দিয়েছে। নতুন প্রবণতা - এস৪ লুম আসার পর মিলগুলিতে মহিলা শ্রমিক নিয়োগ বাড়ছে। এখানে মহিলাদের যৌন নিরাপত্তার অভাব থাকছে। ইউনিয়নকে নতুন ভর্তি শ্রমিক, ফ্লেক্সিবেল ও মহিলা শ্রমিকদের অধিকার আদায় ও রক্ষার জন্য ইউনিয়নভুক্ত করতে না পারলে চটকল শ্রমিকরা নিজেরাই সব ধরনের সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হবেন এবং ইউনিয়নও কাগুজে সংগঠন হয়ে পড়বে। বিসিএমএফ ৭ম রাজ্য সম্মেলন পশ্চিমবঙ্গের চটকল শ্রমিকদের কাছে এই বার্তা দিচ্ছে ইউনিয়ন পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হোন, আর্থিক, সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।

কেন্দ্রীয় সরকারের কর্পোরেট তোষণ ও শ্রমিক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে এআইসিসিটিইউ সহ ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ১২ দফা দাবিতে ৮ জানুয়ারি ২০২০ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছিল। চটকলে বিসিএমএফ সহ ২২টি ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় ইউনিয়নের ১২ দফা দাবি সাথে চটকল শ্রমিকদের ৮ দফা দাবি যুক্ত করে সাধারণ ধর্মঘটে অংশ নিয়েছে। বিসিএমএফ-এর সাথে যুক্ত শ্রমিকরা সব হামলাকে উপেক্ষা করে ধর্মঘটে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। ধর্মঘট সফল করার জন্য রাজ্য সম্মেলন শ্রমিকদের অভিনন্দন জানাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় সরকার সারাদেশে এক ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে। কাশ্মীরে ৩৭০ ও ৩৫(ক) ধারা বাতিল, এনপিআর, এনআরসি সবার মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ - এর মাধ্যমে নাগরিকত্বের সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হচ্ছে। এক ভয়ঙ্কর বিভাজনের রাজনীতির মুখোমুখি চটকল শ্রমিক সহ দেশবাসী। বিভাজন করানো হচ্ছে ধর্ম, ভাষা ও বর্ণের ভিত্তিতে।

বিসিএমএফ-এর রাজ্য সম্মেলন চটকল শ্রমিকদের কাছে আবেদন করছে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য এগিয়ে আসুন, নিজেদের দাবিগুলিকে আদায় করার জন্য ব্যাপক শ্রমিক ঐক্য গড়ে তুলুন।

দাবি সমূহ

১. ন্যূনতম ২১০০০ টাকা মজুরি ও ১০০০০ টাকা পেনশন দিতে হবে।
২. সম কাজে সম বেতন চাই।
৩. এস ৪ (চিনে তৈরি লুম)-এর ম্যান মেশিন রেশিও এবং মজুরি ঠিক করতে হবে।
৪. চটকল চুক্তি ২০১৯ রিভিউ করতে হবে।
৫. হাজিরা ইনসেনটিভ সমহারে সবাইকে দিতে হবে।
৬. অবিলম্বে অবসর প্রাপ্ত শ্রমিকদের গ্র‍্যাচুইটি দিতে হবে
৭. মহিলা শ্রমিকদের উপর যৌন হেনস্থা বন্ধ করার জন্য আভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি (internal complaints committee) গঠন করতে হবে।
৮. সব ধরনের শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে।
৯. মিলের কোয়ার্টার বাসযোগ্য করতে হবে।
১০. শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের জন্য কর্মস্থলে পরিবেশ ও বায়ুদূষণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে।
১১. সিএএ, এনআরসি, এনপিআর মানছি না।
১২. এনডিএ সরকার দমন পীড়ন বন্ধ কর। সমস্ত রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি দিতে হবে।
১৩. গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংবিধান রক্ষার লড়াইয়ে শামিল হোন।

সম্মেলন পরিচালনা করার জন্য ৮ জনের সভাপতিমণ্ডলিতে ছিলেন কৃষ্ণা বেহারা, বটকৃষ্ণ দাস, মাজাহার খান, মহ. জহিম, সত্যনারায়ণ মাঝি, সমীর মজুমদার, তপন ঘোষ এবং মহ. ইসরাফিল। সম্মেলনে ১৪ টি মিলের সম্পাদক সহ বেশ কয়েকজন প্রতিনধি বক্তব্য রাখেন। সম্মেলনে ১৩১ জন প্রতিনিধি এবং অতিথি ও পর্যবেক্ষক ৩৫ জন মোট ১৬৬ জন উপস্থিত ছিলেন। এ আই সি সি টি ইউ রাজ্য সম্পাদক কমরেড বাসুদেব বসু স্বাগত ভাষণ দেন। সব শেষে সর্বসন্মতিতে নবেন্দু দাশগুপ্ত সভাপতি, অতনু চক্রবর্তী সাধারণ সম্পাদক এবং দেবব্রত ভক্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সহ ৪৬ জনের রাজ্য পরিষদ নির্বাচিত করেন। আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের পরিবেশনের মাধ্যমে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

 

সংসদ  আক্রমণ  নিয়ে  নতুন  তদন্তের  দাবি  অত্যন্ত  প্রাসঙ্গিক

জয়ন্ত মিত্র

কাশ্মীর পুলিশের ডিএসপি দাবিন্দার সিং যেদিন হিজবুল মুজাহিদিন-এর দুই সন্ত্রাসবাদী সহ গ্রেপ্তার হলেন, এবং যে উদ্দেশ্যে ঐ সন্ত্রাসবাদীদের দিল্লী যাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছিল সে কথা জানাজানি হল, প্রশ্নটা – বা, বলা ভালো দাবিটা – তার পরপরই উঠল। ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বরের সংসদ আক্রমণের তদন্ত যে ভাবে চালানো হয়েছিল, এবং সেই আক্রমণের অন্যতম চক্রান্তকারী হিসাবে আফজল গুরুকে অপরাধী সাব্যস্ত করে সুপ্রিম কোর্ট যে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিল, তা নিয়ে সংশয় জোরালো ভাবেই মাথা চাড়া দিয়েছিল। আফজল গুরুকে ফাঁসিতে ঝোলানোর পরও প্রশ্নগুলোকে চিরতরে চাপা দিয়ে দেওয়া যায়নি, ঐ সিদ্ধান্তের ন্যায্যতা বারবারই প্রশ্নের মুখে পড়ছে। প্রশ্ন উঠেছিল – আফজল গুরু কি সত্যিই সংসদ আক্রমণের চক্রান্তে যুক্ত ছিলেন, নাকি দাবিন্দার সিং তাকে ঐ আক্রমণে এক বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করে নিয়েছিল? আজ দাবিন্দারকে গ্রেপ্তারের পর সংসদ আক্রমণের তদন্ত এবং আফজল গুরুর ফাঁসি নিয়ে এর আগে ওঠা প্রশ্নগুলোর যথার্থতাই শুধু জোরালো হয় নি, সন্ত্রাস দমন নিয়ে সরকারি ভাষ্যের বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নহীন বলেও পরিগণিত হচ্ছে না। সংসদ আক্রমণ নিয়ে নতুন করে তদন্তের দাবি তাই যথেষ্ট সংগত বলেই প্রতিপন্ন হচ্ছে।

দাবিন্দার কিভাবে সংসদ আক্রমণ নিয়ে নতুন তদন্তের দাবিকে প্রাসঙ্গিক করে তুলছে, তার কাজকর্মের খতিয়ান থেকে তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। গত ১১ জানুয়ারি কাশ্মীরের কুলগাম জেলার মিরবাজারে দাবিন্দারের গাড়িকে আটকানো হয়, গাড়িতে নভিদ বাবা ও আলতাফ নামে দুই হিজবুল মুজাহিদিন জঙ্গি এবং তাদের সহায়তাকারী এক আইনজীবীকে পাওয়া যায়। সন্ত্রাসবাদী এই নভিদ বাবার মাথার দাম ছিল ২০ লক্ষ টাকা। গাড়ি দাবিন্দার নিজেই চালাচ্ছিল। পুলিশের ডিএসপি তার গাড়িতে জঙ্গিদের নিয়ে যাচ্ছিল কেন? দাবিন্দারের কৈফিয়ত হিসেবে যা প্রকাশ পেয়েছে তা হল – সে কখনও বলেছে, ১২ লক্ষ টাকার বিনিময়ে সে ওদের কাশ্মীরের বাইরে বার করে দিচ্ছিল, কখনও আবার বলেছে যে ওদের আত্মসমর্পণ করাতে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এই অজুহাতগুলো অতুল গোয়েল ও অন্যান্য পুলিশ কর্তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি (অতুল গোয়েল হলেন কাশ্মীর পুলিশের ডিআইজি, যিনি দাবিন্দারের গ্রেপ্তারি ও তার বাড়িতে তল্লাশি চালানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন)। জঙ্গিদের নিয়ে যাওয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য হিসাবে এটাই প্রকাশ পেয়েছে যে – দাবিন্দার ওদের চণ্ডিগড় নিয়ে যাচ্ছিল যাতে তারা সেখান থেকে দিল্লী গিয়ে দিল্লী বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রজাতন্ত্র দিবসে জাতীয় রাজধানীতে সন্ত্রাসবাদী হামলা চালাতে পারে। পুলিশের যে কর্তারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তাদের কাছেই সে এই পরিকল্পনার কথা ফাঁস করেছে বলে প্রকাশ পেয়েছে। দাবিন্দারের ওপর বেশ কিছুদিন ধরে নজরদারি চালানো এবং নির্দিষ্ট খবর পাওয়ার পরই যে কাশ্মীরের বর্তমান সর্বোচ্চ পুলিশ কর্তারা তার গাড়ি আটকে ছিলেন এবং তার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছিলেন তা বলাই বাহুল্য। দাবিন্দারের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ ৩টে একে-৪৭ রাইফেল, ৫টা গ্রেনেড ও আরো কিছু অস্ত্রশস্ত্র বাজেয়াপ্ত করেছে। এগুলো কাদের কাজে লাগত তা যে কেউই অনুমান করে নিতে পারেন। দাবিন্দারের গ্রেপ্তারির পর আশেপাশে কান পাতলেই এ কথাগুলো শোনা যাচ্ছে – কফিন ক্রয় কেলেঙ্কারি নিয়ে বাজপেয়ী সরকার যখন কাঠগড়ায় তখন সংসদ আক্রমণের ঘটনা ঘটল। রাফাল বিমান ক্রয় কেলেঙ্কারি নিয়ে মোদী সরকার যখন কাঠগড়ায় এবং তারা নির্বাচনের মুখোমুখি হচ্ছিল তখন পুলওয়ামায় ভারতীয় জওয়ানদের ওপর সন্ত্রাসবাদী হামলা হল। আর আজ যখন বিপুল মাত্রার বেকারি, বিপর্যস্ত অর্থনীতি এবং নাগরিকত্ব ও সংবিধানের ওপর আক্রমণ নিয়ে সরকার কাঠগড়ায়, তখন দাবিন্দার সিং প্রজাতন্ত্র দিবসে সন্ত্রাসবাদী হানার পরিকল্পনায় জড়িত বলে অভিযুক্ত হল। অন্ন-বস্ত্রের দাবিকে প্রশমিত করতে সবসময় সীমান্তে যুদ্ধের বাজনা বাজাতে হবে তার কোনো মানে নেই, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদী হামলাও এখন শাসকদের কাছে সংকট থেকে উদ্ধারের এক অনুকূল মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

দাবিন্দারের কর্মজীবনে উন্মোচিত হওয়া তার কুকীর্তির বৃত্তান্তের মধ্যে রয়েছে -- সন্ত্রাস দমন শাখা স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপে (এসওজি) যোগদানের পর জোর করে টাকা আদায় ও দুর্নীতির অভিযোগে তাকে এসওজি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়; কাশ্মীরের প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর লড়ি ভর্তি কাঠ সে ছিনতাই করে; এক মাদক বিক্রেতার কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা চরস সে নিজেই বিক্রি করে দেয়; মুসলিম যুবককে অপহরণ করে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করার পর সেটিকে সংঘর্ষ হত্যা বলে চালায়; গত বছর কাশ্মীরে এক ডজন বাঙালি ও বিহারি শ্রমিকের হত্যাতেও সে জড়িত ছিল; আরো জানা গেছে, তার সহায়তাতেই নভিদবাবু ২০১৮র ডিসেম্বর থেকে ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জম্মুতে নির্বিঘ্নে ছিল। এগুলো কিন্তু কর্মজীবনে পদোন্নতিতে এবং বিভিন্ন সম্মানজনক কর্মকাণ্ডের অংশীদার হওয়ার পথে দাবিন্দারের কাছে কোন বাধা হতে পারেনি। কশোভতে শান্তিরক্ষী দলে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল; কয়েক মাস আগে বিদেশ থেকে যে দলটি কাশ্মীর পরিদর্শনে আসে তাদের আপ্যায়নের দলের সদস্যও তাকে করা হয়। এছাড়া, পুলওয়ামার পুলিশ লাইনে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে সন্ত্রাসবাদী হামলার মোকাবিলার জন্য তাকে ২০১৮র স্বাধীনতা দিবসে সাহসিকতার  রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও দেওয়া হয় (এখন অবশ্য সে পুরস্কার কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে সরকারের তরফে জানানো হয়েছে)। খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে – দাবিন্দারের পিছনে বড় খুঁটি না থাকলে কি তার পক্ষে এমন দাপট দেখানো সম্ভব হত? পিছনে থাকা ওপরওলা হিসাবে কারা দাবিন্দারকে নির্দেশ দিচ্ছিল এবং কাদের নির্দেশ সে বাস্তবায়িত করছিল? নেপথ্যে থাকা সেই সব মাথা কারা? তারা শুধু কাশ্মীরে নয়, দিল্লীতেও নিশ্চয় আছে? নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের একেবারে ওপরতলাতেও কি তাদের কারো অবস্থান? দাবিন্দারের গ্রেপ্তারি কি তাদের অস্বস্তিতে ফেলেছে? দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই তাদের মুখোশের উন্মোচন কি জরুরি নয়?

সংসদ হামলার ঘটনায় আফজল গুরু যে দাবিন্দারের চক্রান্তের শিকার হয়েছিল তার সাক্ষ্য বহন করছে জেল থেকে তার উকিলকে লেখা আফজল গুরুর চিঠি। নিজের হাতে  উকিল সুশীল কুমারকে লেখা সেই চিঠিতে আফজল জানিয়েছিল – “একদিন আলতাফ আমাকে দাবিন্দার সিং -এর কাছে নিয়ে গেল। দাবিন্দার সিং আমাকে বলল যে, তার জন্য ছোট একটা কাজ আমায় করে দিতে হবে, আর তা হল আমি যেহেতু দিল্লী ভালো করে চিনি তাই একটা লোককে আমায় দিল্লী নিয়ে যেতে হবে এবং তার জন্য একটা ভাড়া বাড়ি খুঁজে দিতে হবে। আমি ঐ লোকটাকে চিনতাম না, কিন্তু আমার সন্দেহ হল যে সে কাশ্মীরী নয়, কেননা সে কাশ্মীরী ভাষায় কথা বলছিল না। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম, দাবিন্দার যা বলত আমাকে তা করতেই হত। আমি তাকে দিল্লী নিয়ে গেলাম। একদিন সে আমাকে বলল যে সে একটা গাড়ি কিনতে চায়। আমি ওকে কারোল বাগে নিয়ে গেলাম‌। ও একটা গাড়ি কিনল। এরপর দিল্লীতে ও বিভিন্ন লোকের সঙ্গে দেখা করত এবং আমরা দুজনেই, আমি আর মহম্মদ নানা সময়ে দাবিন্দার সিং -এর কাছ থেকে ফোন পেতাম।” আফজল গুরুর এই কথা সত্যি না কল্পিত তা নিয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। সুপ্রিম কোর্টও বোধকরি সংসদ আক্রমণে আফজল গুরুর জড়িত থাকার প্রত্যক্ষ কোন প্রমাণ না পেয়ে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর রায়ে “সমাজের সামূহিক ন্যায়বোধকে তুষ্ট করার” যুক্তির অবতারণা করেছিল। এইভাবে একটা নিরপরাধ লোককে কি প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল? সরকারও কি তা জানত না – না হলে ফাঁসি দেওয়ার মাত্র দু-ঘন্টা আগে তাকে ফাঁসির কথা জানানো হল কেন? তিহার জেলের মধ্যেই তাকে কবর দেওয়া হল কেন? তার পরিবারকে তার দণ্ডের কথা জানিয়ে তার দেহ তাদের হাতে তুলে দেওয়া হল না কেন? বিজেপি তার ফাঁসির জন্য চাপ সৃষ্টি করে ফাঁসির দাবিতে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করছিল, আর সুপ্রিম কোর্টও বোধ হয় এর মধ্যেই “সামূহিক ন্যায়বোধ”-এর আকাঙ্খাকে খুঁজে পেয়ে তাকে “তুষ্ট করার” পথে গিয়েছিল। ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আফজলকে যখন ফাঁসি দেওয়া হয় কেন্দ্রে তখন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার, এবং তারাও আফজলের ফাঁসি নিয়ে নিজেদের পিঠ চাপড়ে ছিল।

দাবিন্দারের গ্রেপ্তারির পর তার উকিলকে লেখা চিঠিতে আফজল গুরুর কথাগুলো আজ লক্ষণীয় তাৎপর্যে মণ্ডিত হয়ে সামনে আসছে। যে মহম্মদ সংসদ আক্রমণে নেতৃত্ব দিল এবং পুলিশের গুলিতে মারাও গেল, আফজল গুরুর কথা অনুযায়ী তাকে তার কাছে তো দাবিন্দার সিং-ই পাঠিয়েছিল। অতএব, এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে আফজলকে বোড়ে হিসাবে দাবিন্দারের কাজে লাগিয়ে নেওয়া নিয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। আজ যখন সংসদ হামলার তদন্তের দাবি নতুন করে উঠছে, সরকার কি সমস্ত সংশয়ের নিরসনে নতুন তদন্তের পথে এগোবে? প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, কাশ্মীর পুলিশের প্রধান দাবিন্দারকে সন্ত্রাসবাদী হিসাবে বিচারের পক্ষে মত দিলেও সরকার নাকি এই তদন্তের ভার এনআইএ-র হাতে দিচ্ছে। অনেকেই এর মধ্যে গোটা ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেওয়ার এক অভিসন্ধি রূপে দেখতে পাচ্ছেন। কারণ, এনআইএ-র বর্তমান প্রধান হলেন ওয়াই সি মোদী যিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এবং গুজরাটে অমিত শাহকে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়া থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন। ওয়েব পত্রিকা ওয়্যার-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সিদ্ধার্থ ভরদরাজন “কাশ্মীরের পুলিশ অফিসার দাবিন্দার সিং-এর সন্ত্রাস সংযোগ সম্পর্কে শ্রীযুক্ত ডোভাল-এর উদ্দেশে কয়েকটি প্রশ্ন” শীর্ষক নিবন্ধে বলেছেন, “আমাদের জানানো হয়েছে যে এই ঘটনার তদন্ত সম্ভবত করবে এনআইএ। আমি আন্তরিকভাবেই চাই যে ওরা যেন তা না করে, কারণ, ওদের কর্মকৃতির খতিয়ান নিতান্তই সাদামাটা। ভারতের পক্ষে যেটা একেবারেই কাম্য নয় তা হল একটা ধামাচাপা দেওয়ার অথবা জোড়াতালির তদন্ত – যে ধরনের তদন্ত এনআইএ প্রধান ওয়াই সি মোদী চালিয়েছিলেন যখন তিনি সিবিআই-তে ছিলেন এবং তাঁর ওপর হরেন পাণ্ডে হত্যার তদন্তের দায়িত্ব পড়েছিল। এটা (দাবিন্দারের সন্ত্রাস সংযোগ – লেখক)  এমনই এক ব্যাপার যাতে অত্যধিক স্বচ্ছতার দিক থেকে বিচ্যুত হওয়ার প্রয়োজন সরকারের রয়েছে।” অতএব, এনআইএ-কে দিয়ে নয়, সরকার নিরপেক্ষ কোন সংস্থাকে দিয়ে দাবিন্দারের সন্ত্রাসবাদী সখ্যর তদন্ত হোক, নতুন করে তদন্ত হোক ২০০১ সালের সংসদ হামলার।

 

কোন বিধ্বংসী ঝড়ের মুখে ভারতের অর্থনীতি?

সুদীপ্ত মণ্ডল

লেখক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, আইআইএম আহমেদাবাদ, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি বিভিন্ন বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানে যুক্ত থাকার পর বর্তমানে ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিক রিসার্চ (NCAER) সংস্থায় ডিস্টিংগুইশড ফেলো হিসাবে যুক্ত আছেন।

ভারতের অর্থনীতি যে একটা ঈর্ষণীয় রকমের চমৎকার জায়গায় রয়েছে, এই কথা ইন্টারন্যাশনাল মনিটেরি ফান্ডের তদানীন্তন প্রধান ক্রিস্টিন ল্যাগার্ড খুব বেশিদিন আগে বলেননি। বিশ্বের মুখ্য অর্থনীতিগুলির মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতহারে বাড়তে থাকা অর্থনীতি হিসাবে ভারত ছিল অন্যান্য প্রতিশ্রুতিবান এবং আর্থিকভাবে উদীয়মান দেশগুলির কাছে ঈর্ষার পাত্র, আর এই নিয়ে আমরা সকলেই যথেষ্ট উল্লসিতও ছিলাম। সেই ঈর্ষার আসন থেকে বর্তমানের এ অন্ধগলিতে পৌঁছতে খুব বেশিদিন সময় আমাদের লাগেনি।

মাত্র দেড় বছর সময়ের মধ্যে বৃদ্ধির হার ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষের চতুর্থ কোয়ার্টারে ৮.১ শতাংশ থেকে ২০১৯-২০-র দ্বিতীয় কোয়ার্টারে ৪.৫ শতাংশে পড়ল। এই সময়ের মধ্যে শিল্পের বৃদ্ধির হার পড়ল ৫.৩ শতাংশ থেকে মাত্র ০.৫ শতাংশে, আর কৃষিতে বৃদ্ধির হার হল মাত্র ২.১ শতাংশ। শিল্প উৎপাদন সূচকের মাসিক পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, এই মন্দা দ্বিতীয় কোয়ার্টার ছাড়িয়ে স্থায়িত্বের আভাস দিচ্ছে। এক বছর আগের তুলনায় অক্টোবর ২০১৯-এ উৎপাদিত দ্রব্যের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে ৩.৮ শতাংশ। খনিশিল্প ও উৎপাদনে মূল্যযুক্তির পরিমাপে যথাক্রমে ৮ এবং ২.১ শতাংশ ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সবথেকে শোচনীয় পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন শিল্পে, যা সঙ্কুচিত হয়েছে ১২.২ শতাংশ।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের এতটা সঙ্কোচন বিশেষ দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে, কারণ বিদ্যুৎ সমস্ত ধরনের উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সাধারণ উপাদান, এবং সেই কারণেই কোনও দেশের অর্থনৈতিক ক্রিয়াশীলতা সম্বন্ধে ধারণা করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক। বিদ্যুতের মতো হাল আমদানিরও, যা কী না আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। আলোচ্য সময়কালে আমদানি পড়েছে ১৩.২ শতাংশ। রপ্তানি কমলেও তার হ্রাসের হার আমদানির তুলনায় কম, যার থেকে ধারণা করা যেতে পারে – ভারতের ক্ষেত্রে মন্দার হার তার সঙ্গে ব্যবসারত দেশগুলির তুলনায় কিছু হলেও বেশি। সাম্প্রতিক কালে মোট চাহিদা মাপার ক্ষেত্রে সবথেকে নির্ভরযোগ্য সূচক ব্যক্তিভিত্তিক ভোগব্যয়ের বৃদ্ধির হার মাত্র ৫.১ শতাংশ, যা এক বছর আগে এই সময়ে ছিল ৯.৮ শতাংশ। তবে সবচেয়ে ভীতিপ্রদ সম্ভবত স্থায়ী সম্পদে বিনিয়োগের ছবি। ২০১৯-২০ সালের দ্বিতীয় কোয়ার্টারে এই বিনিয়োগে বৃদ্ধির হার মাত্র ১ শতাংশ, যা মাত্র এক বছর আগেও ছিল ১০.২ শতাংশ। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (সিএমআইই)-র তথ্য অনুযায়ী বেকারত্ব রয়েছে ৫ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে।

এ-হেন সর্বব্যাপী অধোগতির বিষণ্ণ সময়ে তুলনামূলক মূল্যস্থিতি হয়তো একমাত্র সান্ত্বনা। এপ্রিল-মে সময়কাল থেকে কনজিউমার প্রাইস ইন্ডেক্স বা ভোক্তা মূল্যসূচক রয়েছে ৩ শতাংশের নিচে। নভেম্বর মাসে অবশ্য এই সূচক ছুঁয়েছে ৫.৫ শতাংশ, যা কী না গত বছরের নভেম্বরে ২.৩ শতাংশের থেকে দ্বিগুণের বেশি, আর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্থির করা ৬ শতাংশের সর্বোচ্চ সীমার বিপজ্জনক রকমের কাছাকাছি।

আমরা কি তবে স্ট্যাগফ্লেশন বা নিশ্চলতা-স্ফীতির মত একটা দুঃস্বপ্নের কালের দিকে এগিয়ে চলেছি, যেখানে বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি দুইই বিপদসীমার ওপরে? চার দশক ধরে একটা মোটের ওপর স্থিতিশীল অবস্থা রক্ষা করার পরে সত্তরের দশকের জ্বালান তেলের যোগান-বিপর্যয়ের পর প্রথম বিশ্বের দেশগুলির সামষ্টিক অর্থনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব সঙ্কট দেখা দেয়, যখন মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব দুইই পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করে। মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের ভারসাম্য বা ব্যস্তানুপাতিক সম্বন্ধ দেখাবার ফিলিপ্স কার্ভ অন্তর্হিত হয়, এবং কনসেনসাস তত্ত্ব এই নতুন বিভ্রান্তির পরিবেশে পালাবার পথ পায় না। যাই হোক, আমাদের সামনে মূল প্রশ্ন আপাতত এই যে, সামষ্টিক অর্থনীতির নীতি প্রণয়নকারীদের হতবুদ্ধি করে ভারতের অর্থনীতি এই একই ভাবে স্ট্যাগফ্লেশনের পথে যাচ্ছে কি না।

সৌভাগ্যক্রমে, মূল্যের ওঠানামার দিকে তন্নিষ্ঠ নজর রাখলে বোঝা যাচ্ছে যে অতটা অসহ অবস্থায় আমরা এখনও পৌঁছইনি। ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির অবস্থাকে কোনোরকম সাধারণীকরণ দিয়ে বোঝা অসম্ভব। সাম্প্রতিক মুদ্রাস্ফীতির জন্য সম্পূর্ণত দায়ী খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, যা এই নভেম্বরে গত বছরের তুলনায় বেড়েছে ১০ শতাংশ – গ্রাম ও শহরাঞ্চলে যথাক্রমে ৮.৮ ও ১২.৩ শতাংশ। খাদ্য ছাড়া অন্যান্য জিনিসের নিরিখে মুদ্রাস্ফীতির হার নভেম্বরে ছিল মাত্র ২.৮ শতাংশ। একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, খাদ্যদ্রব্য-জনিত মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে মূলত এই কটি কারণে – শাকসবজির দামে ৩৫.৬ শতাংশ বৃদ্ধি, পেঁয়াজের জোগানে ঘাটতি, এবং প্রোটিনের মূল্যবৃদ্ধি। ডালের দাম বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ, সঙ্গে মাছ-মাংস ও ডিমের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৯.৪ ও ৬.২ শতাংশ। অন্যান্য খাদ্যের দাম বেড়েছে মোটের ওপর ৩ থেকে ৪ শতাংশ।

খুব সাঙ্ঘাতিক কোনও বিপদ ঘটে না গেলেও দামের ওঠাপড়ায় একটা অস্থিরতা অবশ্যই আছে। মুদ্রাস্ফীতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বেঁধে দেওয়া ৬ শতাংশ সীমার কাছাকাছি চলে আসার প্রতিক্রিয়ায় মনেটরি পলিসি কমিটির (এমপিসি) সুদের হার কমানো স্থগিত রাখা সঠিক সিদ্ধান্ত। খাদ্যদ্রব্যজনিত মুদ্রাস্ফীতির ছায়া যদি অন্যান্য ক্ষেত্রেও হাত বাড়ায় এবং সমস্যা গভীরতর করে, এমপিসিকে হয়ত সুদের হার কিছুটা বাড়িয়ে মূল্যবৃদ্ধির মোকাবিলা করতে হতে পারে। আর্থিক নীতি দিয়ে হয়ত মুদ্রাস্ফীতির মোকাবিলা সম্ভব, কিন্তু রাজস্ব নীতি অবলম্বন করে স্বল্প সময়ে চাহিদা বাড়ানোর কাজটা খুবই কঠিন, বিশেষত দীর্ঘ সময়ের সংস্কারের সুফল যখন আপাতত নাগালের বাইরে। চাহিদা বাড়াতে চাই সরকারি ব্যয়ে একযোগে অনেকটা বৃদ্ধি। কিন্তু এই বর্ধিত ব্যয়কে যুঝতে যে ধরনের রাজস্ব পরিচালন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সে বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছার অভাব স্পষ্ট (এ নিয়ে ১৭ অক্টোবর ২০১৯ তারিখের মিন্ট পত্রিকায় আমার একটি নিবন্ধ আছে)। এর ফলে রাজকোষ ঘাটতি (fiscal deficit)-র লক্ষ্যমাত্রা তুলনায় বেশি আয়ত্তে আসতে পারে। তবে সরকারি খাতে ঋণের প্রয়োজন এমনিতেই বেশি থাকার কারণে আরও ঋণ হয়ত বেসরকারি উদ্যোগে লগ্নীকে পিছু হটতে বাধ্য করতে পারে, যার পরিণাম হতে পারে চাহিদার আশানুকূল বৃদ্ধি না হওয়া। অর্থাৎ, এই অবস্থা থেকে মুক্তির কোনও সরল পন্থা আপাতত চোখে পড়ছে না।

যেখানে অর্থনৈতিক সঙ্কটের ওপর নজর দেওয়া উচিত, সরকার সেখানে ব্যতিব্যস্ত থাকছেন রাজনৈতিক বিষয়গুলি নিয়ে। বিপুল জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় আসার ঔদ্ধত্য এবং রাম মন্দির বিষয়ে অনুকূল রায় বিজেপিকে তার নির্বাচনে প্রতিশ্রুত হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডাকে প্রাধান্য দিতে উৎসাহিত করেছে। আর্টিকল ৩৭০ রহিতকরণের অব্যবহিত পরেই আমরা দেখলাম নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ)। জাতীয় পঞ্জীকরণের প্রস্তুতিও তুঙ্গে। এর নিয়ে আমাদের দেশের মুসলমান নাগরিকেরা সন্ত্রস্ত। হিন্দুত্বের সব আপন করে নেওয়া, শান্তিপ্রিয় বিবেকও এ নিয়ে যথেষ্ট আলোড়িত। সারা দেশের পথে পথে বিক্ষোভরত আমাদের ছাত্রেরা, আর সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষও এই বিষয়ে মোটের ওপর একজোট। এমতাবস্থায়, দেশের অর্থনীতির তরী যখন টলোমলো, সরকারের এই যুদ্ধং দেহি এবং অনমনীয় মনোভাব আমাদের কোথায় নিয়ে যায় সেটাই এখন দেখার।

নিবন্ধটি ইংরেজিতে কিছুটা পরিবর্তিত রূপে ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে মিন্ট পত্রিকায় প্রকাশিত


ভয় হতে তব অভয় মাঝে

আশীষ লাহিড়ী

২০১৯ সালের মে মাসে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যেসব কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন, এবং সংসদের দুই কক্ষে নিজেদের সংখ্যার জোরে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সেইসব কর্মসূচির বাস্তবায়নে যেভাবে উঠেপড়ে লেগেছেন, সেগুলো প্রকারান্তরে দলটির আজন্মলালিত হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডাগুলিই কিনা, এই প্রশ্ন উঠেছে। কেন্দ্র সরকারের সমালোচকরা যা বলছেন, অর্থাৎ সত্যিই কি হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের প্রক্রিয়া সূক্ষ্মভাবে শুরু হয়ে গেল? নাকি আমাদের ভয়টা অমূলক? আমরা কি আসলে সব বিষয়ে অতিপ্রতিক্রিয়া দিচ্ছি অর্থাৎ যাকে বলে ওভাররিঅ্যাক্ট করছি?

আমি অবশ্য মনে করি, ভয় পাওয়ার কারণ অবশ্যই আছে। তবে সরাসরি এই প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে একটি সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কথা বলেই শুরু করি। সম্প্রতি একটি বিশেষ কাজে চন্দননগর গিয়েছিলাম, সেখান থেকে আমারই এক তরুণ বন্ধুর সাথে ট্রেনে বসে গল্প করতে করতে হাওড়া ফিরছিলাম৷ সিরিয়াস কোনও আলোচনা নয়, এমনিই ঠাট্টা-ইয়ার্কি, হাসি-মশকরা করছিলাম। ঠিক সেই সময়, আমাদের পাশে বসা আরেকটি ছেলে, তাঁকে ছেলেটিই বলছি… কারণ তাঁর বয়স বোধকরি বছর পঁয়ত্রিশের বেশি নয়, সুদর্শন, কথাবার্তায় বোঝা যায় সুশিক্ষিতও, সে হঠাৎ বলে উঠল— “আচ্ছা, আপনাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, এই যে চারপাশে যা ঘটছে, তা সম্ভবত আপনাদের পছন্দ হচ্ছে না… আপনাদের ঠিক মনে হচ্ছে না… তাই না?” আমি একটু অবাকই হলাম। তাকে প্রশ্ন করলাম, এইসব বলতে সে ঠিক কী বোঝাচ্ছে৷

– “হ্যাঁ, মানে এইসব বলতে এই এনআরসি, সিএএ…!”

– “অবশ্যই। শুধু আমি কেন, কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের লোকই এইসব পছন্দ করছে বলে তো মনে হয় না।”

– “ঠিক এইখানেই কথা! আপনারা কিছু বলার আগে একটু ভালো করে জানুন ব্যাপারটা কী হচ্ছে। আপনারা কি এ বিষয়ে যথেষ্ট পড়াশুনো করে কথাগুলো বলছেন?”

এই থেকেই নানান তর্ক উঠে পড়ল। তর্কের একটা পর্যায়ে এসে আমি তাকে বললাম আমরা যদি এই পুরো বিষয়টিকে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে না বসাই, তাহলে কেউই হয়তো যথেষ্ট গভীরে গিয়ে বিষয়টির তাৎপর্য অনুভব করতে পারব না। এবং এক্ষেত্রে সেই ইতিহাসের সূত্র হলেন সাভারকর। সাভারকার বলেছিলেন যে এই দেশে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তবে তিনি নিজেকে নাস্তিক বলতেন, ধর্মের পথে হাঁটতেন না, তিনি তাঁর কথাবার্তায় বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় দিয়েছেন, প্রাচীনকালে হিন্দুদের সমাজে কী কী ভুলভ্রান্তি হয়েছিল, তিনি তা নিয়ে অনেক সমালোচনা করেছেন, অথচ আশ্চর্যজনকভাবে, এই তিনিই রাষ্ট্রটাকে একটি হিন্দুরাষ্ট্র বানাবার করার কথা বলেছিলেন। পাশাপাশি তিনি হিন্দুদের সংজ্ঞা দিচ্ছেন এইভাবে, যাদের পুণ্যভূমি এই ভারতবর্ষ তারাই প্রকৃত হিন্দু। সোজা বাংলায় বললে, মুসলিমরা প্রকৃত অর্থে ভারতীয় নয়, খ্রিস্টানরা তো নয়ই। খ্রিস্টানদের সংখ্যা এদেশে নগণ্য, অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে ভয় পাওয়ানোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে হিন্দুরাষ্ট্রের ভিত্তি। স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতে এই কথাগুলো এতদিন তাত্ত্বিক ধুম্রজালের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল, অবশ্য হ্যাঁ.. কখনও কখনও আমরা দেখেছি একদল লুম্পেন এসে বাবরি মসজিদ ভেঙে দিয়েছে, কখনও আমরা দেখলাম যে গুজরাটে বেছে বেছে মুসলমান নিধন করা হল, কিন্তু তারপর আবার যেন ধীরে ধীরে একটা প্রগতিশীলতা ও মূলস্রোতের দিকে ফিরে আসার একটা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে… এরকমটাই চলছিল।

কিন্তু এইবার, এই ২০১৯ সালে পৌঁছে আমরা দেখলাম, এই সমস্ত লক্ষণ ও উপসর্গগুলি যেন একটা পরিণতির দিকে, একটা culmination-এর দিকে চলে যাচ্ছে… যে হিন্দুরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হবেই… come what may। তাতে কে কী বলল, কে মরল, কে বাঁচল, দেশের অর্থনীতির হাল কী হল, কারও কিচ্ছু জানার দরকার নেই, কারও কিছু যায় আসে না… শুধু ওই এক সিঙ্গল-পয়েন্ট অ্যাজেন্ডা… হিন্দুরাষ্ট্র যার কথা সাভারকর বলে গিয়েছিলেন, আজ সেই হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার দিন এসে গেছে। এমনকি মাত্র কদিন আগে সুপ্রিম কোর্টেও অযোধ্যার রামমন্দিরের স্বপক্ষে রায় বের করে নেওয়া গেছে৷ এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, সেদিন ট্রেনে ছেলেটির সঙ্গে ঠিক এই ইস্যুতেও জোর বিতর্ক হয়েছিল। সেই ছেলেটি বলছিল, “সুপ্রিম কোর্ট, দেশের সবচেয়ে বড় সাংবিধানিক অথরিটি, তাকে তো আপনাকে মানতে হবে।” “হ্যাঁ, আমি তো তাকে মানছি। এবং মানছি বলেই সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে আমি ব্যথিত। কারণ এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি ভারতের সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন।” আমি তাঁকে আরও বললাম, সংবিধান লঙ্ঘন করার কথা বলা হচ্ছে এই কারণে, যে সুপ্রিম কোর্ট একদিকে স্বীকার করে নিচ্ছেন যারা বাবরি মসজিদ ভেঙেছে তারা অন্যায় করেছে, কাজটা চরম অপরাধ, পরক্ষণেই আবার অপরাধীদের পক্ষেই রায় দিচ্ছেন, একই নিঃশ্বাসে সেই অপরাধী পক্ষের হাতেই ওখানকার মালিকানা তুলে দিচ্ছেন এবং তাদের ওইস্থানে মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিচ্ছেন। এর স্বপক্ষে যুক্তি কী? না এখানেই ভগবান রাম জন্মেছিলেন, এটা নাকি দেশের সংখ্যাগুরু হিন্দুদের বিশ্বাস।

তাহলে কী দেখলাম আমরা? আমরা দেখলাম, দেশের যারা মেজরিটি, যেহেতু তারা বিশ্বাস করে যে অযোধ্যার ওই ঘটনাস্থলের তলায় একটা মন্দির ছিল, যার কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই। অর্থাৎ যে সুপ্রিম কোর্ট ন্যায়নীতির কথা বলে, সংবিধানের কথা বলে, হিংসা পরিহার করে, এ ক্ষেত্রে সেসবের পরোয়া না করে, খোদ সর্বোচ্চ আদালতকে দিয়েই শিলমোহর মারিয়ে এটা দেখিয়ে দেওয়া গেল যে ভারতের সংবিধানও যদি হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের পথে বাধা হয়ে আসে, তবে সে বাধাও অতিক্রম করার মতো ক্ষমতা এরা অর্জন করে ফেলেছে। এটা কি ভয় দেখানো নয়? আর এনআরসি বা সিএএ প্রসঙ্গে একটা কথা বারবার বলার চেষ্টা হচ্ছে, এর ফলে ভারতীয় মুসলিমদের কোনও সমস্যা হবে না। বারবার এভাবে বলাটাও বেশ সন্দেহজনক, ঠিক যেমন আমাদের সেই প্রবাদটা — ‘ঠাকুরঘরে কে? আমি তো কলা খাইনি’র মতো শোনাচ্ছে। কেন, বারবার আলাদা করে ‘মুসলমানদের কোনও ভয় নেই’ একথাটা বলতে হচ্ছে কেন? আজকের কাগজেই তো দেখলাম, সরকারপক্ষের একজন নেতা-মন্ত্রী খোলাখুলি বলছেন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে মুসলিম ব্যাতীত অন্য ধর্মের মানুষজন এলে তাদের আশ্রয় দেওয়া হবে, কিন্তু যদি কোনও মুসলিম এদেশে আসে তাহলে তাকে নিয়ে ওদের কোনও মাথাব্যথা নেই। তার মানে এই প্রত্যেকটা জিনিসকে আমি যদি এককথায় নামিয়ে আনি, এটা হচ্ছে সংখ্যালঘু মুসলমানকে ভয় দেখানোর একটা ব্যাপক বর্ণাঢ্য কর্মসূচি। যে ভয়টা এতদিন শুধুমাত্র রাজনীতির দিক থেকে ছিল, এখন আইনও সেই ভাষায় কথা বলতে শুরু করল।

এই যে দেশজুড়ে একটা ভয়ের আবহ তৈরি হল, এবং এতে করে দাঁড়াল এই জিনিসটা, যে মুসলমানদের তো ভয় পাওয়ানো হচ্ছেই, এছাড়াও যারা এই জিনিসটা মেনে নিচ্ছেন না, যারা মনে করছেন বর্তমান সরকারের এই মতাদর্শ দ্বারা আমাদের সংবিধানের মূল নীতি লঙঘন করা হচ্ছে, মানবিকতার উল্লঙ্ঘন করা হচ্ছে, তাদেরও ভয় দেখানো হচ্ছে। অর্থাৎ এটা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, আমরা যা বলছি তা যদি বিনা প্রশ্নে, অক্ষরে অক্ষরে মেনে না নেওয়া হয়, একটা সময়ের পর আপনাদের ওপর আঘাত আসবে। আপনি একজন আর্বান নকশাল হিসেবে চিহ্নিত হবেন। রামচন্দ্র গুহ-র মতো একজন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, তাঁকে অবধি টেনেহিঁচড়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তা তিনি কী বলেছেন? তিনি শুধু এইটুকু কথা বলেছেন, চারপাশে যা হচ্ছে তা একটি গণতান্ত্রিক সরকারের লক্ষণ নয়, তা একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের লক্ষণ। এই সাধারণ কথাটা বলার জন্য রামচন্দ্রের মতো একজন অ্যাকাডেমিকের যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে তো আমরা যারা সাধারণ নাগরিক, যাদের রামচন্দ্র গুহ-র মতো গ্ল্যামার নেই, মাথার পেছনের হেলো-টা নেই, এমন অগণিত মানুষ যারা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন, তাদের সঙ্গে কী হতে পারে সহজেই অনুমেয়। তাদের তো রীতিমতো রাস্তায় ফেলে পেটানো হবে, ধরে জেলে নিয়ে যাওয়া হবে, উত্তরপ্রদেশে যেমন হচ্ছে। তার মানে ব্যাপারটা এসে দাঁড়াচ্ছে এই জায়গায়, যে তোমরা যদি আমাদের এই কর্মসূচির সঙ্গে সম্পূর্ণ অর্থাৎ শতকরা একশো ভাগ, নিরানব্বই ভাগও নয়, সহমত না হও, তাহলে তোমাদের জন্য খুব দুর্দিন আসছে। এই কথাটা খুব পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আইনের দিক থেকে, রাজনীতির দিক থেকে, প্রচারমাধ্যমের দিক থেকে, শিক্ষাক্ষেত্রে, যে যেখানে এতটুকু dissent দেখাচ্ছেন (অন্য যে শব্দটা, decent, সেটা তো দেশ থেকে উঠেই গেছে, শুধু dissent-টাই টিঁকে আছে), তাদের পুরোপুরি বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে আমাদের পুরোপুরি সমর্থন না করলে তোমরা বাঁচতে পারবে না।

এই ভয়ের আবহটা তো তৈরি করে দেওয়া হয়েছেই, এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসার তেমন কোনও লক্ষণ কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। পাশাপাশি, এর ভালো দিক যেটা, সেই যে মাও সে তুং-এর কথাটা, যেখানেই অত্যাচার, সেখানেই প্রতিরোধ, ঠিক সেভাবেই আজ এই ইস্যুটাকে কেন্দ্র করে যেভাবে সাধারণ মানুষ, ছাত্রসমাজ একজোট হয়েছেন, রুখে দাঁড়িয়েছেন, পথে নেমে প্রতিবাদ করছেন, এটাও মস্ত বড় একটা জিনিস। কিন্তু তার ফলে, ও পক্ষ, যারা ভয়টা চাপিয়ে দিয়েছিলেন, তারা যে কিছুটা পিছিয়ে এসেছেন এমন তো কোনও লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। তার মানে সারা দেশে এতগুলো লোক একজোট হয়ে যে প্রতিবাদটা করছে, সেটাও তারা খুব একটা পরোয়া করেন না৷ অর্থাৎ এর পেছনে একটা গায়ের জোরের ব্যাপার রয়েছে, যা এরা দেখিয়েই চলেছেন। মাঝখান থেকে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছু বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা বলে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রী সেদিন বললেন যে ২০১৪-র পর থেকে এনআরসি নিয়ে নাকি মন্ত্রীসভায় কোনও আলোচনা হয়নি। ডাহা মিথ্যে। সংসদে দাঁড়িয়ে খোদ অমিত শাহ সারা দেশের এনআরসি কার্যকর করার কথা ঘোষণা করেছেন। ২০১৯-এই প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ভাষণে ‘উইপোকা’ ‘ঘুষপেটিয়া’ প্রসঙ্গ বারবার এসেছে। আজ যে তাঁরা সত্যিই এই ইস্যুতে পিছু হটলেন, তার লিখিত প্রমাণ কই? এনআরসি-র প্রথম ধাপ যে এনপিআর বা ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার, সেটা তো এখন দেশের বহু রাজ্যে চালু আছে। আসলে প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এইসব বিভ্রান্তিমূলক কথা বলে সাধারণ মানুষের মনে ভয় ও অনিশ্চয়তার আবহটাই আরও জোরদার করছেন। এই বিভ্রান্তিমূলক অস্বচ্ছ কথাবার্তার জন্য, কথা ও কাজের অমিলের জন্যেই সরকারকে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। অথচ কোনওরকম অস্বস্তিকর প্রশ্ন করলেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উত্তর না দিয়ে ঘুরিয়ে বলছেন, সরকারের উপর ভরসা রাখুন। আসলে এখানে শ্রী শাহ ঠিক মানুষের ভরসা চাইছেন না, সম্মতি চাইছেন। সুকুমার রায়ের সেই ছড়াটির মতো বলতে চাইছেন, ‘ভয় পেও না, ভয় পেও না, তোমায় আমি মারব না’৷ অথচ, পরক্ষণেই চোখ পাকিয়ে কামড়ে দেবেন বলে ভয় দেখাচ্ছেন। এই ভয়টাই সরকারের আসল চেহারা।

সেদিন বই-চিত্র-এ একটি অনুষ্ঠানে বন্ধুবর চন্দন চ্যাটার্জির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ওঁদের দিল্লিতে বাঙালিদের নিয়ে একটি সংগঠন রয়েছে। চন্দন বলছিলেন, তিনি নিজে অসমে গিয়ে দেখে এসেছেন, ওখানে বাঙালিদের ওপর কী অমানুষিক অত্যাচার নামিয়ে আনা হয়েছে। অজস্র ডকুমেন্ট যদি একজনের কাছে না থাকে, তাহলে সে যেকোনও মুহূর্তে বিপদের পড়ে যেতে পারে — এইরকম একটা ভয়ের আবহে সেখানকার বাঙালিকে প্রতিনিয়ত বাঁচতে হচ্ছে।

পাশাপাশি, আরেকটা প্রতিযুক্তি তোলার চেষ্টা হচ্ছে৷ যারা সরকারের নীতির সমর্থন করছেন, তারা বলছেন, ওদেশ থেকে মুসলিমরা আসতে যাবে কেন? আর এলেই বা আমরা তাদের গ্রহণ করবই বা কেন? বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান প্রধানত ইসলামি রাষ্ট্র, ওখানকার হিন্দুরা অত্যাচারিতরা হয়ে এলে বরং আশ্রয় দেওয়ার দরকার আছে৷ এর উত্তরে একটা কথাই বলবার, যে ইতিহাসকে বাদ দিয়ে কি কোনও কিছু বিচার করা যায়? আর আপনারা বলছেন, এইটা বাংলাদেশ, এটা পাকিস্তান, আর এটা ভারতবর্ষ, কিন্তু আসলে এটা তো ভারতীয় উপমহাদেশ, একটা সময়ে যা অখণ্ড ছিল। সেদিন ব্রিটিশরা যে খেলাটা খেলে গেল, আমরা স্বাধীনতার এতদিন পর সেই নোংরা খেলাটাই চালিয়ে যাচ্ছি। নানারকম যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু আমরা ভুলে যাচ্ছি যে দেশটা আসলে একসময় একটাই দেশ ছিল। কোনও এক সকালে নিজেদের ক্ষমতার পিঠে ভাগ করতে গিয়ে নেতারা দেশটাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিলেন, সাধারণ মানুষেরা কী চায় তা জানার কোনও চেষ্টা না করেই। এই যে ধর্মের ভিত্তিতে দেশটা ভাগ করা হল, দেখা গেল যে সেটা টেঁকে না, টিঁকলে পাকিস্তানকে আর ভেঙে দু-টুকরো হতে হত না। তাই ধর্মের ওপর ভিত্তি করে একজন মানুষ নাগরিক না বেনাগরিক, দেশি না বিদেশি, এই বিচারধারাটা আমাদের বর্জন করতে হবে৷ ইতিহাসে প্রমাণিত যে এটা সম্ভব নয়। আর সেইজন্যই একটা ভুল জিনিসকে, একটা মিথ্যে জিনিসকে যদি গায়ের জোরে চাপাতে হয়, তাহলে একটা ভয়ের আবহ তৈরি করতেই হবে৷ এখন ঠিক তাই হচ্ছে।

এখানে আরও একটা কথা আছে। দেশভাগের সময় যে মুসলমানেরা দ্বিজাতিতত্ত্ব মানলেন না, এ দেশের মানুষকে বিশ্বাস করে যারা এদেশেই থেকে গেলেন, এতদিন পর বিজেপি সরকার তাদের মনের মধ্যে ভয় ঢোকাতে শুরু করল, যে তারা শুধুমাত্র মুসলমান বলেই অন্যদের থেকে আলাদা করে চিহ্নিত। বিদেশ থেকে যিনি আসছেন, তাকে আমরা বিদেশি বলে না ডেকে হিন্দু বা মুসলিম বলে ডাকছি। অর্থাৎ তৎক্ষণাৎ আমরা বুঝিয়ে দিচ্ছি, এ দেশে যে সংখ্যালঘুরা আবহমানকাল ধরে আছেন, তাদেরকে আমরা কিছুটা অন্যচোখে দেখছি। এরা ঠিক ভারতীয় নয়, এরা যেন ভারতীয়দের মধ্যে একটি বিশেষ সম্প্রদায়, যাদের আমরা আলাদা করে সনাক্ত করে রেখেছি। এই কথাটা হয়ত এত স্পষ্ট করে আজ বলা হচ্ছে না, কারণ মোদি-শাহরা তো ধাপে ধাপে এগোচ্ছেন হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে, এই কথাগুলো হয়তো আজ থেকে দু-বছর পর বলা হবে। ওরা একটা একটা করে হার্ডল টপকে টপকে এগোচ্ছেন। যেমন, সুপ্রিম কোর্ট আজ বাবরি মসজিদ নিয়ে যে রায় দিয়েছেন, সেটা কি আমরা কোনোদিন কল্পনা করতে পেরেছিলাম যে এ জিনিস সম্ভব হবে? ব্যাপারটা এরকম দাঁড়াল যে, যারা ভেঙে দিল তাদেরই হাতে একটা উপহার তুলে দেওয়া হল। তারপরে বলা হচ্ছে, দেখো, আমরা কত মহৎ যে মুসলিমদেরও দু-এক একর জমি দিচ্ছি। এটা খুব আশ্চর্যের যে এরপরেও ভারতবর্ষের মুসলমানরা কিন্তু বিদ্রোহ করেননি, তারা কী অসামান্য পরিণতিবোধের পরিচয় দিয়েছেন যে তারা বুঝেছেন যে এর পেছনে এমন একটা নোংরা জিনিস কাজ করছে যে একে প্রশ্রয় দিলে আখেরে ভারতবর্ষেরই ক্ষতি হবে। তাদের ওপর যে এত বড় একখানা অবিচার হল, তা সত্ত্বেও তারা কোনও দাঙ্গাহাঙ্গামা করেননি, কেউ কেউ অন্যভাবে প্রতিবাদ করেছেন, সে তো আমাদের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে দেশের মুসলিম সমাজের এই বিচক্ষণতা কী একটা আশ্চর্যের বিষয় নয়?

পক্ষান্তরে, আমরা কী করছি! আমরা সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের স্বরে বলছি, দেখো বাবা, আমরা মাথা গুণতিতে অনেক, তোমরা কম, অর্থাৎ বেশি ট্যান্ডাই ম্যান্ডাই করতে যেও না, মাথা ফাটিয়ে দেব, সোজা বাংলায় এরকম বার্তা-ই কি আমরা দিচ্ছি না? আরেকটা সমস্যার কথাও খুব কুৎসিত আকারে উঠে আসছে। বলার চেষ্টা হচ্ছে, হ্যাঁ বিজেপি দলটা হয়তো বা সাম্প্রদায়িক, কিন্তু সিএএ, নির্দিষ্টভাবে এই ধারাটা মোটেই সাম্প্রদায়িক নয়। কারণ এই আইনটার ফলে হিন্দুদের মধ্যে যারা তথাকথিত নিম্নবর্গ তাদের একদল লাভবান হবে। অর্থাৎ হিন্দুদের মধ্যে যারা দলিত যেমন নমঃশূদ্র বা মতুয়া সম্প্রদায়, সিএএ তাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে। এর ফলে কী হল, হিন্দু নিম্নবর্গ ও মুসলমান, এই দুইয়ের মধ্যে একটা চমৎকার ভেদরেখা তৈরি করে দেওয়া গেল। এবং কেউ কেউ ইতিমধ্যে সেই টোপটা গিলে বসে আছেন৷ অর্থাৎ বিভাজনের রাজনীতিকে একটা চরম জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে; হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিরোধ, হিন্দুদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ, এবং হিন্দু দলিত ও মুসলমান নিম্নবর্ণের মধ্যেকার বিরোধ। এইবার, একটা রাষ্ট্র যদি এতগুলো বিরোধ নিয়ে চলতে চায়, তাহলে তার হাতে তো ভয় দেখানো ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। তাই ভয়ের আবহটা তারা এমনভাবে তৈরি করেছে। তাছাড়া সেই ভয়টা টপকে এদের রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করা যাবে, সেই লক্ষণটা কিন্তু এখনও নেই। যদিও প্রতিবাদের স্বর দিনকে দিন জোরালো হচ্ছে।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯-এই ছটা রাজ্যে বিজেপি সরকারের পতন হয়েছে। বিজেপির শেষের ঘণ্টা মৃদুস্বরে হলেও বাজতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতির মধ্যে দিয়ে এই যে পাঁচ বছর অন্তর সরকারের পরিবর্তন হয়, তাতে আসল জিনিসটা কি সত্যিই বদলাচ্ছে? কারণ হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিটা বিজেপি-আরএসএস যে মাত্রায় করছে তা অভূতপূর্ব হলেও, এই রাজনীতি যে আগে কখনও আমাদের দেশে হয়নি, তা তো নয়। বাবরি মসজিদ নিয়ে এই খেলাটা তো কংগ্রেস আমলেই শুরু হয়েছে। বাবরি মসজিদের বিতর্কের তালা খুলেছেন রাজীব গান্ধি। বাবরি মসজিদ যখন ভাঙা হচ্ছে, তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাও, অর্থাৎ তখনও দেশের মাথায় কংগ্রেস সরকার। তাই গভীরভাবে দেখলে, সকল রাজনৈতিক দল বাদ দিয়েও এর একটা শ্রেণিগত ব্যাখ্যা আছে, যেখানে এদেশের উচ্চবর্ণ হিন্দুরা দেশটাকে শুধুমাত্র নিজেদের দেশ বলে মনে করছে, এবং যে রাজনৈতিক দলই সরকার তৈরি করুক না কেন, দু হাতে পুঁজিপতিদের কাছে দেশটাকে বিক্রি করে দিচ্ছে, ঋণ দিচ্ছে, কর ছাড় দিচ্ছে, নানারকম সুযোগসুবিধে দিচ্ছে৷

আজকে পুঁজিপতিরা দেখছেন যে তারা নিজেরা হিন্দু হোন বা না হোন, হিন্দুত্ববাদের রাজনীতির কারবারিদের যদি তারা সমর্থন করেন, তাহলে আখেরে তাদেরই লাভ এবং এ দেশে বেশ আরামে থাকা যাবে। ফলে, এইভাবে ধর্মীয় বিভাজনের ইস্যুর দিকে সাধারণ মানুষকে ব্যস্ত রেখে রাজনীতিবিদ ও পুঁজিপতিরা দেশটার বিপুল সম্পদ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিচ্ছেন৷ বিনিময়ে হিন্দুত্ববাদীরা পুঁজিপতিদের অর্থের একটা বিপুল শক্তিকে নিজেদের পাশে পেয়ে যাচ্ছেন, এটা তাদের জন্যও একটা বড় লাভ। ফলে সমস্যাটা যে সেই চিরকেলে হ্যাভস আর হ্যাভ-নটসদের সমস্যা, সেটাকে সাফল্যের সঙ্গে হিন্দু বনাম মুসলিম ইস্যুতে বদলে দেওয়া যাচ্ছে। তাই খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আমরা আজ লক্ষ না করে পারছি না, প্রতিবাদের সামনের সারিতে ছাত্ররা আসছেন ঠিকই, কিন্তু শ্রমিক বা কৃষকেরা কি সেভাবে আসছেন? কেন আসছেন না? আসছেন না তার কারণ হয়তো তাদের মধ্যে কোথাও একটা বিভ্রান্তির বীজ রোপন করা গেছে, বিশেষ করে, আমার ধারণা কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে। কৃষকরা যেহেতু মাটির অনেক কাছাকাছি, তারা ধর্মেরও অনেক কাছাকাছি। এ হিন্দু, এ মুসলিম, এ অচ্ছুৎ– এই ভাবনাটা তাদের মধ্যে চারিয়ে দেওয়া গেছে, প্রতিবাদটা তাই হয়তো ততখানি আসছে না তাদের কাছ থেকে। এবং প্রতিবাদ ওই স্তর থেকে না উঠে এলে কিন্তু এই শাসকের মতাদর্শকে প্রকৃতপক্ষে হটানো যাবে না। ছাত্রেরা এগিয়ে এসেছেন, বুদ্ধিজীবীরা এগিয়ে এসেছেন, বড় আনন্দের কথা, সাহসের কথা, কিন্তু শ্রমজীবীদের আমরা টেনে আনতে পারছি কি? পারছি না কেন? এই যে দেশজুড়ে যে ভয়ের আবহটা তৈরি করা হয়েছে, সেটাকে রুখতে হলে, যারা ভয় দেখাচ্ছেন, ভয়টা তাদেরকেই ফেরত দিতে হলে, দেশের শ্রমজীবী মানুষদের একটা বড় অংশকে আমাদের বিরোধিতার পাশে পেতে হবে৷ যতদিন সেটা না হচ্ছে, ধর্মীয় বিভাজনের এই ন্যারেটিভকে শুধুমাত্র সংসদীয় রাজনীতি ও সরকার বদলের সমীকরণ দিয়ে পরাজিত করা যাবে না৷

[লেখাটি চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম নামক ইন্টারনেটের কাগজ থেকে গৃহীত]

 

সমন্বয়ের ভারত ও সুফি আন্দোলন

সৌভিক ঘোষাল

মূলত হিন্দু ধর্মের ভেতর থেকে ভক্তি আন্দোলন যেমন সমাজের মধ্যেকার ঐক্যের সন্ধান করেছিল,তেমনি ইসলাম ধর্মের ভেতর থেকে এই কাজ করেছিল সুফি আন্দোলন। সুফি মতবাদের উদ্ভব আরবে। কিন্তু এই মতবাদের উদ্ভবের সময় বিভিন্ন ভারতীয় দার্শনিক প্রস্থানের গভীর প্রভাব তার ওপর পড়েছিল। সুফি মতবাদের ওপর ইসলামের পাশাপাশি যোগদর্শন, উপনিষদ ও বৌদ্ধ মতাদর্শের প্রভাবের কথা এর আলোচকেরা বিস্তারিতভাবে বলেছেন। সেই নিরিখে জন্মমুহূর্ত থেকেই ভারত ভূখণ্ডের সঙ্গে এই ভাবধারার একটি আত্মিক সংযোগ আছে।

সুলতানি সাম্রাজ্য স্থাপনের ফলে মুসলমানদের মধ্যে ভোগবিলাস ও ঐশ্বর্যের উন্মাদনা দেখা যায়। অনেকেই মনে করতে থাকেন ইসলাম তার মূল শিক্ষা থেকে সরে যাচ্ছে। ইসলামের নৈতিক অবক্ষয় ও অধঃপতন লক্ষ্য করে কয়েকজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান মর্মাহত হন। তাঁরা রাষ্ট্রের সঙ্গে সর্বপ্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করতে মনস্থ করেন । এঁদের অনেকেই ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের ভালবাসার বন্ধনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এঁদের চিন্তাধারাই সুফি মতাদর্শ হিসেবে জনপ্রিয়তা প্রায়। খ্রীষ্টীয় নবম দশম শতক ছিল এই মতবাদের উদ্ভব ও বিকাশের প্রথম পর্ব। ভারতে ইসলামের রণনৈতিক বিজয়ের আগে থেকেই সুফিরা এদেশে চলে আসেন।

সুফিদের মতবাদ ও ইসলামের আদর্শ থেকে চলতি ইসলামিক সংস্কৃতির সরে যাওয়া বিষয়ক সমালোচনা গোঁড়া মুসলমানদের মনপূত হয়নি । তাঁরা সুফিদের ইসলাম বিরোধী বলে মনে করেন এবং তাদের ওপর বেশকিছু আক্রমণও নেমে আসে। ফলে সুফিরা ক্রমশ নির্জনে ধর্মচর্চা করতে শুরু করেন । এঁরা একজন পীর বা শেখের অধীনে এক একটি ধর্ম সংগঠন গড়ে তোলেন । সংগঠনের সদস্যদের বলা হত ফকির বা দরবেশ।

ভারতের বিখ্যাত সুফি সাধকদের মধ্যে প্রথমদিকে অর্থাৎ একাদশ শতকে যারা এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন শাহ রুমি, নথর শা,গনজ বকশ প্রমুখ। গনজ বকশকে অনেকে ভারতের সর্বপ্রথম সুফি সাধক বলে মনে করেন। শাহ রুমি ১০৫৩ সালে বাংলায় এসেছিলেন। ময়মনসিংহের নেত্রকোণায় তাঁর সমাধি রয়েছে। নথর শাহ দাক্ষিণাত্যে সুফি মতবাদ নিয়ে যান। মাদ্রাজের ত্রিচিনপল্লীতে তাঁর সমাধিক্ষেত্র তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। এই যুগে বাংলায় আগত সুফি সাধকদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন বাংলাদেশের সিলেটের শাহজালাল ইয়ামেনি। তিনি ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় আসেন। মরক্কোর তাঞ্জানিয়াবাসী বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবন বতুতা ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা পরিভ্রমণে এসে শাহজালালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তার মতে, শাহজালাল ইয়ামেনি ছিলেন তার সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষদের একজন।

দ্বাদশ শতাব্দী থেকে ভারতে সুফি সাধকদের ঢেউ আছড়ে পড়ে। আসমুদ্র হিমাচলে সুফি সাধকরা ছড়িয়ে পড়েন৷ যারা এই সময় ভারতে এসেছিলেন তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন চিশতি ও সুহারবর্দি সম্প্রদায়। ভারতে অন্য যে দুটি প্রধান সুফি সম্প্রদায়ের ধারাটির বিকাশ পরবর্তীকালে হয় সে দুটি হল মদানি ধারা ও ফিরদৌসি ধারা।

ভারতবর্ষে সুফিদের ধারাগুলির অঞ্চলভিত্তিক প্রভাব ছিল। যেমন দিল্লী ও দোয়াব অঞ্চলে চিশতি; সিন্ধু,পাঞ্জাব ও মুলতানে সুরাবর্দি এবং বিহারে ফিরদৌসি ধারার প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য। চিশতি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খাজা মইনউদ্দিন চিশতি । তিনি মহম্মদ ঘুরির সময়ে মধ্য এশিয়া থেকে ভারতবর্ষে আসেন ও আজমিরে বসবাস করতেন। চিশতি সাধকদের মধ্যে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার নাম সর্বপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। বিখ্যাত কবি আমির খসরু ও ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরানি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন । হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন।

সুরাবর্দি সম্প্রদায়ের সুফিরা পাঞ্জাব, মুলতান ও বাংলায় প্রভাবশালী ছিলেন। এই সম্প্রদায়ের সাধকদের মধ্যে শেখ শিহাবউদ্দিন সুরাবর্দি ও হামিদউদ্দিন নাগরি ছিলেন প্রধান। এই সম্প্রদায়ের সাধকেরা চিশতিদের মতো দারিদ্র ও কৃচ্ছ সাধনের জীবনাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। সন্ন্যাসীর জীবনও এদের লক্ষ্য ছিল না । এঁরা রাষ্ট্রের অধীনে ধর্মীয় উচ্চপদ গ্রহণ করতেন।

ওই সময়ে একটি নতুন সম্প্রদায় ভারতবর্ষে বিকাশ লাভ করে। এই সম্প্রদায়ের নাম কাদেরিয়া। এই নতুন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা ছিলেন সৈয়দ আবদুল কাদির। ইনি ১০৭৮ খ্রিষ্টাব্দে বাগদাদের জীলান নামক স্থানে জন্মগ্রহন করেন। এই কারণে এই সাধক আবদুল কাদির জীলানী নামে পরিচিত। আবদুল কাদির জীলানী ছিলেন পন্ডিত, সুবক্তা এবং একজন জগদ্বিখ্যাত সাধক; ইনি ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে মৃত্যুবরণ করেন। আবদুল কাদির জীলানী ভারতীয় উপমহাদেশে অত্যন্ত সুপরিচিত হলেও কখনও ইনি ভারতবর্ষে আসেননি। তাঁর এক বংশধর সৈয়দ মুহাম্মদ ঘৌথ গীলানী ১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন ও কাদেরিয়া সম্প্রদারের ভিত স্থাপন করেন। সৈয়দ মুহাম্মদ ঘৌথ গিলানী উত্তরভারতে রাজপুতনার উছ নগরে সুফিকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। ইনি ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে ভারতবর্ষে আরও একটি সুফি সম্প্রদায় প্রবেশ করে। এই সম্প্রদায় নকশাবন্দী সম্প্রদায় নামে পরিচিত। এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তুর্কীস্থানের খাজা বাহাউদ্দীন নক্বশ বনদ। ইনি ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। ভারতবর্ষে নকশাবন্দী সম্প্রদায়ের আদিগুরুর নাম: খাজা মুহাম্মদ বাক্বী বিল্লাহ। তিনিই তুর্কিস্থান থেকে নকশাবন্দী সম্প্রদায়ের মতবাদ ভারতবর্ষে নিয়ে আসেন। খাজা মুহাম্মদ বাক্বী বিল্লাহ ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে মৃত্যুবরণ করেন। এর আগেই অবশ্য চতুর্দশ শতাব্দীতে ভারতে আরেকটি সুফি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। বদিউদ্দিন শাহ মদার এই ধারাকে জনপ্রিয় করে তোলেন এবং তার নামানুসারেই এই ধারা মদারী সম্প্রদায় নামে পরিচিত হয়।

সুফিরা মনে করতেন প্রেম ও ভক্তিই ঈশ্বরপ্রাপ্তির একমাত্র পথ। আচার অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় অনুশাসনের পরিবর্তে ত্যাগ ও বৈরাগ্যর ওপরেই তাঁরা তাদের মতবাদে জোর দিয়েছেন। ত্যাগ ও বৈরাগ্যই তাঁদের মতে প্রকৃত মুক্তির পথ। সর্বধর্মসমন্বয়, জীবে প্রেম ও সম্প্রীতি ছিল সুফিদের আদর্শ। ভারতবর্ষে সুফিরা ইসলামের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। সুফিরা বারবার বলেছেন অনেক উলেমাই কোরানের ভুল ও বিকৃত ব্যাখ্যা করছেন এবং ইসলামের গণতান্ত্রিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাছেন।

সুফিদের ধার্মিক ও অনাড়ম্বর জীবন,ঈশ্বর ভক্তি এবং নির্জনে সন্ন্যাসীর জীবনাদর্শ হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এদেশের অনেক মানুষের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছিল। ভক্তি আন্দোলনের কবীর,নানক প্রমুখদের মতোই সুফি প্রচারকেরাও হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মগত ব্যবধান কিছুটা লুপ্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইসলামের সাম্যের আদর্শে উলেমাদের চেয়ে সুফিরা বেশি জোর দিতেন বলে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ বিশেষত কৃষক ও কারিগরেরা সুফিদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল।

সুফি মতবাদ ও ভক্তিবাদের মধ্যে অনেক বিষয়েই মিল ছিল। ঈশ্বরের কাছে আত্মনিবেদন ও ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন উভয় আদর্শেই স্বীকৃত ছিল। উভয় সম্প্রদায়ই বিশ্বাস করত যে গুরু অথবা পিরের সাহচর্য আত্মার মুক্তির পক্ষে বিশেষভাবে সহায়ক। মধ্যযুগের ভারতে তুর্কী আক্রমণ পরবর্তী সময়ে ধর্মের ভেদাভেদ ও জাতপাতের ভেদাভেদের ওপরে উঠে সমন্বয়ের ভারতীয় ঐতিহ্যটি মজবুত করার পেছনে এই দুই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিরাট ভূমিকা ছিল। আজকের ভারতবর্ষে বিভেদকামী শক্তির অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সমন্বয়ের ভাবধারার প্রয়োজন যখন নতুন চেহারায় আত্মপ্রকাশ করছে, তখন ভারতীয় ঐতিহ্যের অন্যতম ভিত্তি এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলিকে ফিরে দেখা,তা থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করা একটি জরুরী কাজ।

 

ভোজপুরে  কিসান  সংঘর্ষ  যাত্রা  থেকে  সেচ  ব্যবস্থা,  বাঁধ  নির্মাণ  এবং  জল  সংরক্ষণের  দাবি  উঠল

সারা ভারত কিসান মহাসভার নেতৃত্বে ২০ জানুয়ারি ভোজপুরে এক কিসান সংঘর্ষ যাত্রা সংগঠিত হয়। যাত্রা শুরুর আগে প্রয়াত জননেতা কমরেড রাম নরেশ রাম-এর মূর্তিতে মাল্যদান করা হয় এবং তারারি বিধানসভা কেন্দ্রের সিপিআই(এমএল) বিধায়ক কমরেড সুদামা প্রসাদ সমবেত জনগণের সামনে বক্তব্য রাখেন। এরপর যাত্রা চলাকালীন কিরকিরি, সন্দেশ এবং ভোজপুরের পাবানায় জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর যাত্রা পিরোতে পৌঁছলে ডঃ রাম মনোহর লোহিয়ার মূর্তিতে এবং জগদীশপুরে স্বাধীনতা সংগ্ৰামী বাবু কুনওয়ার সিং-এর মূর্তিতে মাল্যদান করে প্রয়াত জননায়কদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। যাত্রা এরপর উত্তরদহ পৌঁছলে সেখানে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।

সমস্ত স্থানেই যথেষ্ট উদ্দীপনা দেখা যায় এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কৃষক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে শ্লোগান তোলা হয়। বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত জনসভাগুলিতে কিসান মহাসভা এবং সিপিআই(এমএল)-এর বিশিষ্ট নেতারা বক্তব্য রাখেন। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন রাজারাম সিং, বিশ্বেশ্বর যাদব, রামাধর সিং, কৃপা নারায়ন সিং, রাজেন্দ্র প্যাটেল, সুদামা প্রসাদ, চন্দ্রদীপ সিং এবং অরুণ সিং। বক্তাদের কথা থেকে এই বক্তব্যই উঠে আসে যে, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার মন্দির-মসজিদ, সিএএ-এনআরসি-এনপিআর-এর মতো সাম্প্রদায়িক ও বিভেদমূলক ইস্যুগুলি দিয়ে কৃষি সংকট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্থরতার মতো বিষয়গুলি থেকে জনগণের দৃষ্টিকে সরিয়ে দিতে চাইছে।

নেতৃবৃন্দ জানান, নীতীশ কুমার জল-জীবন-হরিয়ালি প্রকল্পের প্রচার নিয়ে কোটি-কোটি টাকা অপচয় করছেন, অথচ অপচয় করা টাকার চেয়ে অনেক কম ব্যয়ে কাডবান বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করা যেত। সিএএ-এনআরসি-এনপিআর নিয়ে নীতীশ কুমার জনগণের সঙ্গে এক চতুর খেলা খেলছেন – তিনি একদিকে সিএএ-কে সমর্থন করছেন, আবার এনআরসি-র বিরোধিতা করছেন আর এনপিআর নিয়ে মুখে কুলুপ আঁটছেন। অবিলম্বে সিএএ-এনআরসি-এনপিআর বাতিলের দাবি জোরালো ভাবেই উঠে আসে।

যাত্রা ২১ জানুয়ারি বক্সার জেলার ব্রহ্মপুর ব্লকের বরাদহ গ্ৰামে পৌঁছালে যাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয় এবং সেখানে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। যাত্রা আরো এগিয়ে চললে বাগেন গোলা, কেসাথ ও নওয়ানগরে পথসভা করা হয়। এর পরের জনসভা অনুষ্ঠিত হয় রোহতাস জেলার মালিবাগে। এখানে সুদামা প্রসাদ বলেন, জল-জীবন-হরিয়ালি প্রকল্প দরিদ্র-বিরোধী এবং কৃষক-বিরোধী; এই প্রকল্পের জন্য এখনও পর্যন্ত প্রায় ১০০০০ দরিদ্র মানুষকে সরকারি জমি থেকে উচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। শষ্য চাষে চাষিদের ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হলেও সরকার উদাসীন থাকছে। তিনি আরো বলেন, জল-জীবন-হরিয়ালি প্রকল্পে ২৪৫২৪ কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে, অথচ মাত্র ৪৫০০ কোটি টাকাতেই কাডবান বাঁধের নির্মাণ হয়ে যেত। নীতীশ কুমার কিন্তু এই ব্যাপারটায় কোনো আমল দিচ্ছেন না। ইন্দ্রপুরী জলাধার হল সবচেয়ে বড় জলসঞ্চয় প্রকল্প যা মাটির নীচে জলস্তরের বৃদ্ধি ঘটাবে, পরিবেশের সুরক্ষা করবে এবং বিহারের জনগণকে জল যোগাবে।

রাজারাম সিং বলেন, সরকার 'লিফট ইরিগেশন'-এর মাধ্যমে গঙ্গার জল পাটনা থেকে গয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে, কিন্তু এটা একেবারেই আজগুবি ভাবনা, কেননা, গয়ার অবস্থান পাটনা থেকে ৫৯ মিটার উঁচুতে আর কাডবান রয়েছে গয়ার থেকে ৩১ মিটার নীচুতে। কাডবান বাঁধ নির্মাণ হলে সেখান থেকে অনায়াসেই গয়াকে জল সরবরাহ করা যাবে।

যাত্রা থেকে কৃষকদের কাছে আহ্বান জানানো হয় – ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করে বিহারের সবচেয়ে পুরনো সেচ প্রকল্পকে রক্ষা করুন; বিহার বিধানসভার সামনে ৫ মার্চ যে ধর্ণা সংগঠিত হবে তাতে অংশগ্রহণের আবেদনও কৃষকদের কাছে জানানো হয়। সিএএ-এনআরসি-এনপিআর বাতিলের দাবিতে ২৪ ফেব্রুয়ারির বিধানসভা চলো কর্মসূচিকে ব্যাপকভাবে সফল করে তোলার আহ্বানও যাত্রা থেকে জানানো হয়।

 

ছক ভাঙছে

অঙ্কিত

ঋক-মতে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারীই হল ব্রাক্ষ্মণ।

সমাজের ঐতিহ্য ও পরম্পরার নামে পুরুষতান্ত্রিক ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে বাংলায় সরস্বতী পুজোর পৌরহিত্যের ভার কাধেঁ তুলে নিয়েছিলেন বাংলার মেয়েরা। পশ্চিম বর্ধমিনের ভাদুবালা বিদ্যাপীঠের এহেন পরিকল্পনায় ঘাবড়ে গিয়ে স্থানীয় বিজেপির সংঘী বাহিনী হামলা চালালো স্কুলে। মাঝপথে পুজো থামিয়ে “পুরুষ পুরোহিত”-কে দিয়ে পুনরায় করানো হল পুজো। হুমকি দেওয়া হল ছাত্রীদের ঘরে গিয়ে। প্রধান শিক্ষক জইনুল হক কে পুজোর সময় তাড়িয়ে দেওয়া হল বিদ্যাপীঠ থেকে। ঘটনায় পুলিস বাবাজীরা নির্বিকার দর্শক। বাংলার এই ঘটনা কোথাও গিয়ে মিশে যাচ্ছে কেরলের শবরীমালার সাথে। প্রজাতন্ত্রের কুচকাওয়াজে মহিলা সেনানায়িকার নেতৃত্বের আড়ম্বর কে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে সমাজের নীচু তলায় ঘটে চলা এই রকম অসংখ্য ঘটনা। বাংলার অন্যত্র অবশ্য সমস্ত চাপিয়ে দেওয়া “পরম্পরা”-কে ভেঙে মহিলারা পৌরহিত্য করেছেন বাগদেবীর। যেমন মালদহের চন্দ্রমোহন হাই স্কুলের আদিবাসী কিশোরী রোহিলা হেমব্রম। প্রধান শিক্ষক পাশে বসে তাকে পৌরহিত্যের তদারকি করে দেন। সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা এতদিন যাদের “ছোঁয়া”-তেই শুচিতা না নষ্ট হতো পুজোর আজ তাদেরই এইজনের পৌরহিত্যে পূজিতা হলেন দেবী। শুচিতা পেল সংবিধানের ১৫ নং ধারা।  ঘটনা ও প্রবাহমানতা দেখে মনে পড়ে আজ থেকে ১৯০ বছর পূর্বে জন্মানো এক শিক্ষিকার কথা -“ওঠো জাগো শিক্ষিত হও। সমস্ত পরম্পরা ভেঙে স্বাধীন হও। ”— সাবিত্রী বাঈ ফুলে।
      

গ্রামীণ দরিদ্র ও শ্রমিকরা সিএএ-এনপিআর-এনআরসি চায় না, তাদের দাবি ভূমিহীন ও বাসস্থানহীনদের জন্য জাতীয় পঞ্জি করা হোক! বাসস্থানের অধিকারকে বুনিয়াদি অধিকার হিসেবে ঘোষণা করতে হবে!

এআইআরএলএ সমস্ত নাগরিকের কাছে আবেদন জানিয়েছে, ভূমিহীন এবং বাসস্থানহীন জনগণের জন্য জাতীয় পঞ্জি তৈরির দাবি করুন এবং তাদের জন্য বাসস্থানের অধিকারকে বুনিয়াদি অধিকার রূপে ঘোষণার লক্ষ্যে লড়াই করুন।

এআইআরএলএ-র সাধারণ সম্পাদক এক বিবৃতিতে বলেছেন, মোদী সরকার শ্রমিক এবং দরিদ্রদের মাথার ওপর বিপর্যয়ের খাঁড়া ঝুলিয়ে রেখেছে। ক্রমবর্ধমান মূল্য স্ফীতির চাপে পরিবারগুলো চূর্ণ হচ্ছে; এরই সাথে বেড়ে চলা বেকারি শ্রমিকদের আত্মহত্যাকে বাড়িয়ে তুলেছে। আম্বানি-আদানিদের মত বিত্তশালী পুঁজিপতিদের সুবিধা করে দিতে সকলের জন্য ন্যূনতম মজুরি ও পেনশন সুনিশ্চিত করার সাংবিধানিক দায়িত্বকে পরিহার করা হচ্ছে। বাসস্থানের অধিকারকে অস্বীকার করা হচ্ছে এবং সারা দেশেই দলিত, আদিবাসী ও দরিদ্রদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে।

কমরেড ধীরেন্দ্র বলেছেন, বাসস্থানের অধিকারকে বুনিয়াদি অধিকার করার দাবিতে সারা দেশেই প্রচারাভিযান চালানো হচ্ছে, এবং সংসদের বাজেট অধিবেশনের আগেই এই লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে গণ স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি পাঠানো হবে। প্রচারাভিযানে মূল যে দাবিগুলো উঠে এসেছে সেগুলো হল:

১। দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীনদের একটি জাতীয় তালিকা তৈরি করতে হবে; এর জন্য যে সমীক্ষা প্রয়োজন তা চালাতে হবে অথবা ২০২১-এর জনগণনায় এই বিষয়টির ওপর জোর দিতে হবে।

২। বাসস্থানের অধিকারকে বুনিয়াদি অধিকার করতে হবে এবং দেশের প্রতিটি পরিবারকে কম করে ৫ ডেসিম্যাল বাস্তু জমি দিতে হবে।

৩। জল-জমি-জঙ্গলের ওপর আদিবাসী/মূল বাসীদের অধিকারে যে কোনো ধরনের কারচুপিকে অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। পেসা আইনকে কঠোরভাবে রূপায়িত করতে হবে এবং গ্ৰাম সভার অনুমোদন ছাড়া কোন ধরনের বন জমি অধিগ্রহণ করা চলবে না।

৪। সংবিধান-বিরোধী সিএএ-এনআরসি-এনপিআরকে অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নিতে হবে।

কমরেড ধীরেন্দ্র আরো বলেন, খেয়ালখুশি মত নাগরিকদের বেছে নেওয়ার লক্ষ্যে সংবিধানের বুনিয়াদি কাঠামোয় পরিবর্তন আনার অশুভ প্রয়াস দেখা যাচ্ছে, আর তাই এর বিরুদ্ধে লড়াই করাটা সারা দেশের কাছে, দেশের সমস্ত দরিদ্র ও গ্ৰামীণ মজদুরদের কাছে একান্তই জরুরি। আমাদের সংবিধান প্রতিটি নাগরিককেই সমান অধিকার দিয়েছে এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকারও সব নাগরিককে দিয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির এমনই পরিহাস যে দেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশই আজও ভূমিহীন ও গৃহহীন। আজও বহু মানুষকেই খোলা আকাশের নীচে অথবা প্ল্যাটফর্মে, সেতুর নীচে অথবা পার্কে দিন কাটাতে হচ্ছে। গ্ৰামাঞ্চলে বহু পরিবারকেই গবাদি পশু সহ এক কামরার ঘরে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। গ্ৰামীণ দরিদ্র এবং মজদুরদের সংগঠন হিসেবে এআইআরএলএ এই দাবিগুলোকে সরকারের নজরে আনতে চায় যাতে সেগুলো সরকারের আরাধ্য কাজের অন্তর্ভুক্ত হতে এবং বাজেটে গুরুত্ব পেতে পারে। তিনি সরকারগুলোর কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, তারা যেন দলিত, আদিবাসী এবং বঞ্চিত অংশগুলির স্বার্থ রক্ষায় আন্তরিকভাবে কাজ করে এবং সংবিধানে বিধৃত নির্দেশক নীতিগুলোকে রূপায়িত করে।

এর আগে এআইআরএলএ-র দেওয়া অন্য একটা বিবৃতিতে বলা হয়, “জল-জঙ্গল-হরিয়ালি প্রকল্পে শুধুমাত্র বিহারেই ৫০ লক্ষ মানুষের মাথায় বন থেকে উচ্ছেদের খাঁড়া ঝুলছে। সরকারের আসল লক্ষ্য হল দরিদ্রদের জীবিকা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকারের বাইরে রাখা। এই সমস্ত ইস্যুতে বেড়ে চলা প্রতিবাদকে দুর্বল করে তুলতে এবং আরএসএস-এর এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ওরা এখন জনগণের নাগরিকত্বের জন্মগত অধিকারের ওপর আক্রমণ হানছে। যে সংবিধান দেশের বঞ্চিত অংশগুলির জন্য সমান অধিকার দিয়েছে, এটা সেই সংবিধানের বুনিয়াদি কাঠামোর ওপরই আক্রমণ। সিএএ-এনআরসি-এনপিআর দরিদ্র, গৃহহীন এবং পরিযায়ি শ্রমিকদেরই সবচেয়ে বেশি ধাক্কা দেবে।

“আমাদের বুঝতে হবে, যে সরকার আমাদের জমি, বাসস্থান, রেশন, কাজ এবং পেনশন থেকে বঞ্চিত করছে, তারাই এখন নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে। আসামের এনআরসি-র অভিজ্ঞতা সবার কাছেই একটা দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। যে ১৯ লক্ষ মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে ১৪ লক্ষ শুধু হিন্দুই নয়, এদের অধিকাংশই ভূমিহীন, দরিদ্র, দলিত, আদিবাসী এবং অন্যান্য পশ্চাদপদ জাতের জনগণ। আমাদের তাই এগিয়ে এসে এনআরসি-র বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদে যোগ দিতে হবে।

“সরকার জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জির (এনপিআর)  কাজ শুরু করতে যাচ্ছে এবং এই বলে জনগণকে প্রতারিত করছে যে, এনপিআর-এর সঙ্গে এনআরসি-র কোনো যোগ নেই। মিথ্যা বলতে অভ্যস্ত সরকার এই মিথ্যাচারটাকে স্থায়ী করতে চাইছে; এনপিআর আসলে এনআরসি-র প্রথম ধাপ। গোটা ব্যাপারটাকে সামগ্ৰিকতায় দেখলে বোঝা যাচ্ছে, সিএএ-এনআরসি-এনপিআর মোদী-শাহ সরকারের এক অখণ্ড প্রকল্প যার বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার প্রতিবাদ জানাতে হবে। এটা দেশের স্বার্থের বিরোধী এবং প্রতিটি নাগরিক, বিশেষভাবে দরিদ্রদের কাছে বিপুল সমস্যা ও দুর্ভোগের সৃষ্টি করবে।

“মোদী-শাহ সরকারের উদ্দেশ্যে হল সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে হিটলারের মত ফ্যাসিবাদী শাসন এবং মনুবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যেখানে ধনী ও ওপরতলার অংশই কর্তৃত্ব করবে। গ্ৰামে ও পঞ্চায়েত স্তরে ঐক্যবদ্ধ প্রচার চালিয়ে এই ষড়যন্ত্রটাকে আমাদের রুখতে হবে এবং সংবিধান, দেশ ও গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।”

 

image 3

নৈহাটি স্টেশন চত্বরে সংবিধান বাঁচাও দেশ বাঁচাও কর্মসূচী, ২৬ জানুয়ারী ২০২০

খণ্ড-26