‘ভারতীয় গণতন্ত্র নিয়ে আশা ও আশঙ্কা’ অমর্ত্য সেনের সাক্ষাৎকার
( ৬ অক্টোবর ২০১৯ যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউইয়র্কার সাময়িকীতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন-এর এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্য নিউইয়র্কার-এর স্টাফ রাইটার আইজাক চটিনার। ঐ সাক্ষাতাকারের কিঞ্চিৎ সংক্ষেপে এখানে প্রকাশ করা হল।)

আইজাক চটিনার: আপনি তো ভারত বিভাগের সময় থেকে নিয়মিতভাবে দেশটি সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন ...

অমর্ত্য সেন: ভারত বিভাগের অনেক আগে থেকেই রাখি। আমার বিদ্যালয়ের পড়াশোনা ব্রিটিশ আমলের ভারতে।

আইজাক চটিনার: ব্রিটিশ ভারতের স্মৃতিগুলো কী?

অমর্ত্য সেন: ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির পন্থাগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করতাম, সে কথা খুব মনে পড়ে। কাকা, মামা, কাকাতো ও মামাতো ভাইদের স্মৃতি, তাঁদের জেল খাটার স্মৃতি। তাঁদের কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল; ব্রিটিশরা তখন এটাকে বলত ‘প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন’। এ জন্য নয় যে তাঁরা কোনো অপরাধ করেছিলেন; বরং এই জন্য যে তাঁদের কারাগারে আটকে রাখা না হলে তাঁরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জন্য ভয়ংকর কিছু করতে পারেন। তাঁরা ভয়ংকর কিছু করেছেন, এমন কোনো প্রমাণের দরকার হতো না।

এ বিষয়ে আমার ঠাকুরদার সঙ্গে কথা হতো, সেসব মনে পড়ে। তিনি বলতেন, ‘তোমার কি মনে হয়, এই প্রিভেন্টিভ ডিটেনশনের ব্যবস্থা থেকে ভারত কখনো মুক্তি পাবে?’ তিনি বলতেন, ‘স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত না। সে জন্য আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে।’ দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু কংগ্রেস দল প্রথমেই প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন চালু করে। অবশ্য তারা এটাকে একটু নমনীয় করে। তবে এখন এটা অত্যন্ত কঠোর। বেআইনি কর্মকাণ্ড (নিবর্তন) আইন নামে একটা আইন ভারতে আছে। এ বছর সেটা সংশোধন করে সরকারকে এমন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যে সরকার কোনো প্রমাণ ছাড়াই, বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ছাড়াই কোনো ব্যক্তিকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করতে পারবে। আমরা একটা স্বাধীন দেশ হওয়ার পরেও যে এটা ঘটতে পারে, তা আমি কখনো ভাবিনি।

আইজাক চটিনার: আপনার কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারত বিভাগের স্মৃতি আছে?

অমর্ত্য সেন: হ্যাঁ। দেশবিভাগের কথা মনে আছে, যুদ্ধের কথা মনে আছে; হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কথা মনে আছে। আমি ঢাকার ছেলে, যে শহরটা এখন বাংলাদেশের রাজধানী। অবশ্য পড়াশোনা করেছি পশ্চিমবাংলায়; মাতামহের পরিবারের সঙ্গে আমি পশ্চিমবঙ্গেই থেকে যাই। পড়াশোনা করি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গড়ে তোলা প্রগতিশীল বিদ্যাপীঠ শান্তিনিকেতনে। বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সহিংসতা তেমন ছিল না। এমনকি ১৯৩৭ সালের নির্বাচনেও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো জয়ী হয়েছিল। কিন্তু ১৯৪০–এর দশকের শুরুর দিকে দেশবিভাগের পক্ষের শক্তিগুলোর প্রভাব বেড়ে যায়। আমার মনে হয়, মুসলিম লিগ প্রথমবারের মতো নির্বাচনে জিতেছিল ১৯৪৬ সালে, স্বাধীনতার ঠিক আগের বছর।

আইজাক চটিনার: ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময় আপনার পরিবার কোথায় ছিল?

অমর্ত্য সেন: আমার বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। খুব ভালো কয়েকজন অধ্যাপক তাঁর সহকর্মী ছিলেন। তাঁদের একজন ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু (এস এন বোস), যিনি বোসআইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিকসের জন্য পরিচিতি লাভ করেছিলেন। আমার বাবা ছিলেন রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক। ১৯৪৬ সালে পাঁচ-ছয়জন অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন, কারণ সেখানে এত বেশি দাঙ্গাহাঙ্গামা ও অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল যে ক্লাস প্রায় হতোই না। বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কিছুদিন অন্য কাজ খোঁজেন, তারপর দিল্লি চলে যান, দিল্লির ভূমি উন্নয়ন কমিশনার নিযুক্ত হন। তারপর তিনি পশ্চিমবঙ্গের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।

আইজাক চটিনার: আপনার কখন মনে হয়েছিল যে আপনি ভারত ছাড়তে চান?

অমর্ত্য সেন: দু-একটা জায়গা ছিল যেখানে পড়তে যাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল আমার। কেমব্রিজ তার একটা। সেই যুগে কেমব্রিজ অর্থনীতিতে বেশ ভালো ছিল, বিশেষত ট্রিনিটি কলেজ। আমি সেখানে ভর্তি হওয়ার জন্য দরখাস্ত করি, কিন্তু প্রথমে তারা আমাকে নেয়নি। তারপর কেউ একজন বেরিয়ে গেলে শেষ মুহূর্তেতারা আমাকে ডাকে। অনেক বছর পরে আমি যখন ওই কলেজ থেকে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করি, তখন কলেজ কর্তৃপক্ষ আমার ভর্তির ঘটনাটা স্মরণ করে। অর্থনীতি ও রাজনীতির প্রতি আমার সব সময়ই আগ্রহ ছিল। আগ্রহ ছিল গণিতের প্রতিও। কিন্তু কেমব্রিজের অর্থনীতি বিভাগে তখন গণিত বেশি ছিল না।

আইজাক চটিনার: আপনার কি মনে হয়, আপনি যখন অন্য বিষয়ের দিকে চলে গেলেন, তখন গণিত ও বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহটা আপনার কাজে লেগেছিল?

অমর্ত্য সেন: হ্যাঁ, আমার তা মনে হয়। আর সেই সময়ে কেমব্রিজ অর্থনীতি ও নিও-ক্ল্যাসিক্যাল অর্থনীতির মধ্যে যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, তাতে ট্রিনিটি কলেজের যে একটা বিশিষ্ট অবস্থান ছিল, সেই ক্ষেত্রেও গণিত আর বিজ্ঞানের একটা সহায়ক ভূমিকা ছিল। আইজাক নিউটন, ফ্রান্সিস বেকন সহ অনেকেই ট্রিনিটি কলেজের ছাত্র ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, নেতৃস্থানীয় মার্ক্সবাদী অর্থনীতিবিদ মরিস ডবসও সেখানে পড়াশোনা করেছেন। আন্তনিও গ্রামসির ঘনিষ্ঠ বন্ধুপিয়েরে স্রাফা, যিনি ভিন্ন ধরনের মার্ক্সীয় চিন্তার প্রতিনিধি ছিলেন, তিনিও ছিলেন ট্রিনিটি কলেজের ছাত্র। আবার সেখানকার জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ডেনিস রবার্টসন ছিলেন অত্যন্ত রক্ষণশীল। কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল বেশ ভালো। এ বিষয়টা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল।

আইজাক চটিনার: সেই সময় আপনার রাজনীতি কী ছিল?

অমর্ত্য সেন: বামপন্থী। ঠিকভাবে বললে, মধ্যপন্থী বাম। একটা অদ্ভুত অবস্থা ছিল আমারা মার্ক্সবাদী না হয়েও মার্ক্সীয় চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলাম। মার্ক্সের ১৮৪৮ সালের ম্যানাস্ক্রিপ্টস আমার ভালো লেগেছিল। ভালো লেগেছিল তাঁর জার্মান আইডিওলজি; ১৮৭৫সালে লেখা তাঁর ক্রিটিক অব গোথা প্রোগ্রাম। আর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতির দিকটা দেখলে, আমার মনে হতো, এই ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদেরই আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণকিছু দেওয়ার আছে। কিন্তু অন্যদিকে তাদের রাজনৈতিক তত্ত্বের অভাবটা আমাকে সব সময়ই পীড়িত করত। জন কেনেথ গ্যালব্রেইথ যেমন বলেন, রাজনৈতিক বিরোধিতা প্রয়োজন, যেটাকে তিনি বলেছিলেন, ‘কাউন্টারভেইলিং পাওয়ার’ বা ক্ষমতার ভারসাম্য। কমিউনিস্টদের ভাবনায় ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়টি নেই।

কলকাতায়, যেখানে আমার পড়াশোনার শুরু, সেখানে ছাত্রজীবনে দেখেছি, ছাত্রদের একটা বিরাট অংশ দরিদ্র, বঞ্চিত, অস্পৃশ্য, দলিতদের স্বার্থে কথা বলত। এটা আমার খুব ভালো লাগত। কিন্তু রাজনৈতিক বিরুদ্ধ বুর্জোয়া গণতন্ত্র, তাতে সমাজ-সংগঠনের সমস্যার পূর্ণ চিত্র ধরা পড়ে না।

তো আমি ছিলাম বামপন্থী; আবার একই সঙ্গে সবকিছু নিয়েই আমার মধ্যে বেশ সংশয় কাজ করত। আমি নিকোলাই বুখারিনের লেখা অনেক পড়েছি; তারপর হঠাৎ শুনতে পেলাম যে বুখারিন সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে আসছিলেন এবং তিনি সে কথা স্বীকার করেছিলেন, তারপর আমেরিকান পর্যটক জন গুন্টার বললেন, তিনি সেখানে গিয়েছিলেন, তখন এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে তাঁকে নির্যাতন করা হয়নি। মনে আছে, আমার সহপাঠীরা আমাকে বলেছিল, ‘তুমি যদি এসব কথা বিশ্বাস করো, তাহলে অবিশ্বাস করার কিছুই থাকবে না।’ স্তালিনের একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বুখারিনকে নির্যাতন করা হয়েছিল, তিনি গুপ্তচরবৃত্তি ও দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধ স্বীকার করেছিলেন এবং সে জন্য তাঁকে ১৯৩৮ সালে আরও কয়েকজন বিশিষ্ট বলশেভিক নেতার সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসে নিকিতা ক্রুশ্চভ যখন স্তালিনের সমালোচনা করে বক্তৃতা করেন, তখন আমি একটুও অবাক হইনি।

তো আমার উপলব্ধি হয় যে আমি কোনো পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক ধারার অন্তর্ভুক্ত হব না। আমি সিদ্ধান্ত নিই, মার্ক্সীয় বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া ভাবনা ও ধারণাগুলোর সঙ্গে অন্যান্য ধারার রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনার সংমিশ্রণের ভিত্তিতে আমাকে চলতে হবে। অ্যাডাম স্মিথের অর্থনৈতিক ও দার্শনিক ভাবনার প্রচণ্ড প্রভাব পড়েছিল আমার ওপর। তারপর জন স্টুয়ার্টমিল। আমাকে আমার নিজের আগ্রহের বিষয়গুলোর সঙ্গে এই সবকিছুর সংমিশ্রণ ঘটাতে হয়েছে। গণিতের পাশাপাশি সংস্কৃত ছিল আমার প্রিয় বিষয়। আমি ধ্রুপদি সংস্কৃত জানতাম, সেসবের মধ্যে লোকায়তও ছিল, যা কিনা বস্তুবাদী ঘরানার জিনিস। অর্থাৎ, আমার ওপর নানা ধারার, নানা ধরনের চিন্তাভাবনার প্রভাব পড়েছিল। প্রাচীন সংস্কৃতের যে বিদ্যা আমি পেয়েছিলাম, তার সঙ্গে যাকে বলে বামপন্থী বা প্রগতিশীল ইউরোপীয় চিন্তাভাবনা, আমার মননে সেটার বেশ ভালো সংমিশ্রণ ঘটেছিল।

(ক্রমশ:)

খণ্ড-26
সংখ্যা-39