কবিতা যখন প্রতিবাদের শাণিত হাতিয়ার

পাঞ্জাবী কবিরা কাশ্মীরের সাম্প্রতিকতম পরিস্থিতি নিয়ে ভাবনায় এক নতুন মাত্রা যোগ করলেন — কবিতার মাধ্যমে।

“এই পাঞ্জাবে এখন সবচেয়ে সাড়াজাগানো বিষয় হল কাশ্মীরের প্রতি সমর্থন প্রকাশের ধারাবাহিকতা। গত ১৫ সেপ্টেম্বরের বিশাল ‘বিকেন্দ্রীয়ীভূত’ প্রতিবাদ সমাবেশে তা শেষ হয়ে যায়নি, যে প্রতিবাদকে সরকার দমিত করার চেষ্টা চালিয়েছিল প্রস্তাবিত কৃষক ছাত্র ও অন্যান্য সংগঠনের জাঠার অনুমোদন বাতিল করে। পাঞ্জাবে এখন কোন অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হয় না কবিদের কবিতার উচ্চারণ ব্যতিরেকে।” বললেন রাজ্যের মালওয়া অঞ্চল থেকে কবি রাজবিন্দর মীর।

তিনি তার অধুনাতম একটি কবিতা থেকে কঠোর শব্দবন্ধ-বদ্ধ একটি স্তবক এই প্রতিবেদককে শোনালেন। কাশ্মীরে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী নেতাদের কাশ্মীরী মহিলাদের উদ্দেশে চরম অসম্মানজনক উক্তিকে বিরোধিতা করে লেখা কবিতাটি।

তিনি বলে চলেন “কবিতার প্রতিরোধে তাৎক্ষণিক ফল মেলে না। এর উদ্দেশ্য হল, শ্রোতার অবচেতন মনে একটা গভীর ছবি খোদাই করে দেওয়া। কবিদের এই অমোঘ শব্দগুলো প্রতিধ্বনিত হয় এমনকি কয়েক শতাব্দী পরে যখন কোনো অঞ্চল বা স্থানের ইতিহাস লেখা হয় তখনও। রাজনৈতিক তত্ত্ব বা নীতিতে যে বোধ বা মনোবৃত্তি চর্চিত হয় তার প্রথম প্রকাশ ঘটে কবির কবিতায়। তাই উপদ্রুত কোনো এলাকায় রাজনৈতিক ঘটনার কাব্যিক উন্মোচন অবশ্যই হওয়া উচিত” মীর বললেন।

তার আরেকটি কবিতা থেকে কয়েকটি পংক্তি শোনালেন —
“সবতোঁ খুবসুরত আওরতঁ কাশ্মীর চ্ নেইঁ, মণিপুর চ্ নেইঁ তে দান্তেওয়াড়া চ্ নেইঁ
দুনিয়া দে সবতোঁ খুবসুরত মর্দভি কাশ্মীর দে নেইঁ, মণিপুর দে নেইঁ তে দান্তেওয়াড়া দে নেইঁ—”

বাংলা অনুবাদ:
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী-পুরুষেরা আছে
কাশ্মীরে, মণিপুরে, দান্তেওয়াড়ায়
তারাই সেই মানুষ
যারা অতিক্রম করে চলেছে
কঠিনতম এক জীবন
আর স্বপ্নের জীবনকে ছুঁতে
এখনও লড়ে চলেছে এক কঠিন লড়াই —

“এটা বোঝা খুব জরুরি যে পাঞ্জাবী কবিতা কখনও শাসক শ্রেণীর প্রশস্তি গায়নি — এটাই তার অনন্যতা। এই ঐতিহ্য চলে আসছে সেই বাবা ফরিদ, বুলে শাহ এবং ওয়ারিস শাহ থেকে যারা তাদের সময়ের অনেক অস্বস্তিকর সত্যকে তুলে ধরেছেন তাদের সহজ কবিতায়। পাঞ্জাবের কবিতা ঐতিহাসিকভাবে স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের কথা বলেছে।” বললেন লুধিয়ানার জগবিন্দর যোধা, আরেক জনপ্রিয় কবি।

তিনি জোরের সাথে বললেন, পাঞ্জাবীরা যা বলেন তা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই বলেন।

“আমরা দেখেছি কীভাবে পাঞ্জাব দেশের মধ্যে একটা শীর্ষে থাকা রাজ্য থেকে হোঁচট খেয়ে একেবারে উল্টে পড়েছে, এখন কোনো কোনো সূচকের নিরিখে এমনকি মধ্যপ্রদেশ ও ঝাড়খণ্ডেরও নিচে চলে এসেছে। রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। যুবসমাজ নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। আর রাজ্যের অর্থনীতি ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। এসব কিছুর মূল কারণ পাঞ্জাবের প্রতি কেন্দ্রীয়ের নীতি আর বেশ কয়েক বছর ধরে রাজ্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া কেন্দ্রীয়ীয় শাসন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি কাশ্মীর আমাদের আর কাশ্মীরীরাও, তারা আমাদের ভাই। একইসঙ্গে তাদের, কাশ্মীর সম্পর্কে যা ভাবা হচ্ছে সে ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে।”

তার নীচে উদ্ধৃত কবিতাটি খুব জনপ্রিয়:

“আধা জিসম পঞ্জাব হ্যায় মেরা আধা হ্যায় কাশ্মীর
শালা ওয়াখ নাহ্ হোঁ স্বামী আজম তে ইজহার”

বাংলা অনুবাদ: আমার শরীরের অর্ধেক পাঞ্জাব আর অর্ধেক কাশ্মীর আমার বন্ধু আজম আর ইজহার থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করে এমন কোনো শক্তি পৃথিবীতে নেই আর

“এ বছর আমরা কাশ্মীরী আপেলের স্বাদ পাইনি। তার অর্থ কাশ্মীরী আপেল উৎপাদক আর ব্যবসায়ীরা কষ্টে আছেন। কাশ্মীরী মানুষের যন্ত্রণা সারা দেশের জনসাধারণের কাছে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। সম্প্রতি আমি ধর্ম শালার ম্যাকলিয়ডগঞ্জে গিয়েছিলাম। যে মুহূর্তে আমি বললাম যে আমি পাঞ্জাব থেকে আসছি, সঙ্গে সঙ্গে এক কাশ্মীরী দোকানদার আত্মপরিচয় দিয়ে দোকান খুলে দিলেন।” বললেন যোধা।

এমন নয় যে, পাঞ্জাবের কবিরা এখন হঠাৎ কাশ্মীরীদের বিপর্যয়ে ব্যথিত হয়ে কলম ধরতে শুরু করেছেন। তারা অনেক বছর ধরেই এটা করছেন,তবে সোজা কথা হল — এখন এটা তুঙ্গে পৌঁছেছে। বিপ্লবী কবি জগশীর জিদার উদ্দেশে সেই শব্দরাজি যা কয়েক বছর আগে কাশ্মীর নিয়ে লেখা হয়েছিল,তা এখনও পাঞ্জাবের প্রত্যন্তে ছোট ছোট গ্রামে গঞ্জে শোনা যায়। নির্মম সত্য বলার সময় তিনি তথাকথিত সুমার্জিত পরিশীলিত শব্দে রেখে ঢেকে বলার লোক ছিলেন না। জনশ্রুতি এটাই। তিনি লিখেছেন:
“তাইনু ধাক্কে নাল ঘর ভিচ ভাসানা
জম্মু কাশ্মীর দি তরহ্—”
বাংলা অনুবাদ: (একটি ছেলে একটি মেয়েকে শাসাচ্ছে)
“আমি তোমাকে জোর করে বিয়ে করব
জম্মু ও কাশ্মীরের মতো —”

গত বছর চণ্ডীগড়ের কবি মনু কান্ত কাঠুয়ার ধর্ষণ-হত্যার বলি ছোট্ট মেয়েটির স্মরণে এক মর্মস্পর্শী কবিতায় তীব্র কশাঘাত হেনেছিলেন তাদের যারা ধর্ষকদের বাঁচাতে ব্যস্ত ছিল।

তার অনেক কবিতার একটি:

“পার্টি-সদস্যপদের নতুন নতুন
নিয়ম-বিধি তৈরি হচ্ছে যেমন ১৭ জানুয়ারির (ঘটনায়)
নতুন প্রবেশার্থীকে প্রশ্ন:
“ক’টা মেয়েকে ধর্ষণ করেছ আর খুন করেছ?”

আরেকটি কবিতায় তিনি ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সম্পর্ককে তুলে ধরেছেন:

“একটা সময়ে একটা কিংবদন্তী
জন্ম নেবে
কাশ্মীরে গ্রীষ্মাবকাশ কাটিয়ে
ঘরে ফেরা ভারতীয় পর্যটক
তার স্বজন-বন্ধুদের বলবে—
‘কাশ্মীর উপত্যকায় হিমালয়ের কোলে দাঁড়িয়ে তুমি যখন প্রিয়জনের নাম ধরে ডাকবে
গোটা কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে
প্রতিধ্বনিত হবে তার নাম (কাঠুয়া ধর্ষণের শিকার সেই মেয়েটির নাম) —”

মীর বললেন “কাশ্মীরে যা ঘটে চলেছে,তার বিরুদ্ধে কবিতার প্রতিরোধ ক্রমশ বাড়বেই। অক্টোবরের শেষে জলন্ধরে গদরপন্থীদের স্মরণে তিনদিনব্যাপী যে মেলার অনুষ্ঠান হবে, সেখানে আশা করা যায় বেশ কিছু কবি উপত্যকা নিয়ে তাদের সাম্প্রতিকতম রচনাগুলি পেশ করবেন।”
পাঞ্জাবের কবিরা কাশ্মীরের জন্য লিখছেন — রাজীব খান্না

‘দি সিটিজেন’ ১৪ অক্টোবর ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত।
- ভাষান্তর : জয়ন্তী দাশগুপ্ত

খণ্ড-26
সংখ্যা-37