ঘটনা ও প্রবণতা

সুপ্রীম কোর্টের এক প্রবীণ আইনজীবী কালীস্বরণ রাজ মনে করেন, সুপ্রীম কোর্টের রায়ে যে বিবেচনার প্রতিফলন ঘটল তাতে মিলল না সংবিধান অনুযায়ী সত্যিকারের ন্যায়বিচার, বরং উৎসাহিত করা হল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ঘোর-দক্ষিণমুখী রূপান্তরের রাজনীতিকে। রাজের মতে, “আমরা বেড়ে উঠছি সংখ্যাগরিষ্ঠের অতি-দক্ষিণ রাজনৈতিক পরিমন্ডলে, যা কিনা বিদ্যমান সাংবিধানিক মতাদর্শের সাথে একেবারেই মানানসই নয়। তাই বর্তমান রায় এলো আইনের শাসন ও ধর্মনিরপেক্ষতা সহ সাংবিধানিক নীতিমালার বিরুদ্ধে যেন এক বিরাট মুষ্ঠ্যাঘাত হিসেবে।” রাজ প্রসঙ্গত আরও বলেন, ‘‘অযোধ্যা রায়ের সবচেয়ে বড় প্রহসন হল, আদালত যে কার্যকলাপকে অন্যায় ও বেআইনী সাব্যস্ত করল তাকেই আবার মর্যাদার আসনে বসালো।” রাজের আরও বক্তব্য হল, “ক্রিয়াশীল গণতন্ত্রে যেহেতু আইনের শাসনই মূল বৈশিষ্ট্য তাই ভীড় হিংসা বা যে কোনো গুন্ডামীকে কিছুতেই পার পাইয়ে দেওয়া উচিত নয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গলদটা থেকেছে গোড়ায়, আইনের শাসন সংক্রান্ত ধ্যানধারণায়।”

দি টেলিগ্রাফ, ১১ নভেম্বর ২০১৯

 

পশ্চিমবঙ্গ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দুটি ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করা হবে। রাজ্য সরকার বলছে, এর সাথে নাকি এনআরসি-র কোনো সম্পর্ক নেই। এই বন্দীশিবির বানানো হবে বিভিন্ন অভিযোগে ধৃত বিদেশী বন্দীদের জন্য। একটি শিবির তৈরি হবে ঠিক হয়ে গেছে নিউ টাউনে, আরেকটির জন্য জমি দেখা হচ্ছে বনগাঁ অঞ্চলে। বিজেপি নেতারা বাংলার জনমানসে ভীতি-সন্ত্রাস ছড়াতে প্রচার করছে বিজেপি এখানে ক্ষমতায় এলে এনআরসি করা হবে। রাজ্যের সংশোধনাগার বিভাগীয় মন্ত্রী ঊজ্জ্বল বিশ্বাসের কথা হল, এর সাথে এনআরসি-র কোনো সম্পর্ক নেই। এই বন্দীশালা তৈরী করা হচ্ছে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশে আন্তর্জাতিক বিধিনিয়ম অনুসারে বিভিন্ন ফৌজদারী অভিযোগে বিদেশী ধৃতদের কারান্তরীণ করে রাখার জন্য। সরকারি সূত্র দাবি করছে গতবছর বেআইনী অনুপ্রবেশ সহ বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেপ্তার করা মোট বিদেশীর সংখ্যা ছিল ২৫০। তার মধ্যে রাজ্য সরকার ব্যবস্থা করে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়েছে ১৪০ জনকে। এখন ১১০ জনকে রাখতে হবে, তাই নতুন জেলখানা বানানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। যাই হোক, সময়ে সব সত্য নিশ্চয় প্রকাশ হবে। সংবাদ মাধ্যমে সূত্র ভাসছে ধৃত বন্দীদের বেশি অংশ সাব-সাহারান আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর। প্রশ্ন হল, এ সম্পর্কে সন্দেহের নিরসন করতে রাজ্য সরকার আজ পর্যন্ত কোনো শ্বেতপত্র প্রকাশ করল না কেন? বন্দীদের কোন কোন স্বদেশে প্রত্যর্পণের বন্দোবস্ত করে ফেরত পাঠানো হয়েছে সেইসব তথ্য প্রকাশ করা হল না কেন?

দি টেলিগ্রাফ, ১৫ নভেম্বর ২০১৯

 

উড়িষ্যা সরকারের বিদ্যালয় ও গণমাধ্যম বিভাগ প্রচারিত এক পুস্তিকায় দাবি করা হয়েছে, “গান্ধীজী মারা গিয়েছিলেন ... ঘটনাক্রমে এক দুর্ঘটনাবশত।” ‘বিরোধীদল হিসেবে কংগ্রেস উড়িষ্যা বিধানসভায় ইস্যুটি উত্থাপন সহ বিস্ময় প্রকাশ করে প্রশ্ন তোলে বিজু জনতা দল মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে মহিমান্বিত করে দেখাতে চায় কিনা। দাবি করে এব্যাপারে নবীন পটনায়েককে কারণ দর্শাতে এবং নিঃশর্তে ক্ষমা চাইতে হবে।’

এই তথ্য প্রসঙ্গে বিজেডি সদস্যরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিজেডি বিধায়করা সভাঘরে চুপ করে বসে থাকেন, কোনোরকম বিতর্কে জড়াননি। স্পীকার সরকারপক্ষকে নির্দেশ দেন বিবৃতি দেওয়ার জন্য।

দুই পৃষ্ঠার ঐ পুস্তিকাটির সর্বশেষ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, “১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি গান্ধীজী নয়া দিল্লীর বিড়লা হাউসের সামনে মারা যান এক দুর্ঘটনাবশত।” বিরোধীদলের বক্তব্য হল ‘বিজেপির সঙ্গে বিজেডির আঁতাতই মনে হয় গান্ধীজীকে যে হত্যা করা হয়েছিল সেটা উড়িষ্যা সরকারের স্বীকার করার ব্যাপারে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিজেডির একজন বিধায়ক অবশ্য মুখ খোলেন। তিনি বলেন, ‘গান্ধীজীকে যে হত্যা করা হয়েছিল সেই সত্যকে কেউ বিকৃত করতে পারে না। (পুস্তিকায় যা প্রকাশ করা হয়েছে) এই ধরনের কাজ বিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিষ ছড়াচ্ছে।’

উড়িষ্যা সরকারের শিক্ষামন্ত্রী অগত্যা বলেন,’ পুস্তিকাটি প্রত্যাহার করা হবে। কি করে এমনটি ঘটল তা তদন্ত করে সরকারের বিবৃতি দেওয়া হবে।’

দি টেলিগ্রাফ, ১৬ নভেম্বর ২০১৯

 

শিক্ষাবিদরা আহ্বান জানালেন অযোধ্যা রায় পর্যালোচনার সরব হওয়ার জন্য। বহু শিক্ষাবিদ, লেখক, শিল্পী কলাকুশলী এবং একজন স্থাপত্য বিশেষজ্ঞ যিনি অযোধ্যা মামলায় সুন্নী ওয়াকফ বোর্ডের সাক্ষী হিসাবে ছিলেন, এরা সকলে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে আহ্বান রেখেছেন সুপ্রীম কোর্ট অযোধ্যার বিতর্কিত এলাকা সংক্রান্ত নিস্পত্তিকরণের মামলায় রাম মন্দির নির্মাণ করতে বলে হিন্দুদের অধিকারকে উর্দ্ধে তুলে যে রায় দিয়েছে তার পর্যালোচনার দাবিতে মুখর হতে। এই বিবৃতি প্রকাশ করেছে সফদর হাসমি মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, এতে স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা ১০৩ জন। এদের মধ্যে আছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ সি পি ভামরি ও জয়া হাসান, অর্থনীতিবিদ প্রভাত পটনায়েক, সি পি চন্দ্রশেখর ও জয়তী ঘোষ, ইতিহাসবিদ ডি এন ঝা, ইরফান হাবিব ও শিরীন মুসভি, সাংবাদিক অন্তরা দেব সেন, সুকুমার মুরলীধরণ,আনন্দ্ সহায় ও পামেলা ফিলিপোস, থিয়েটার শিল্পীএম কে রায়না, এন কে শর্মা ও কেভল অরোরা এবং প্রাক্তন আমলা ওয়াজাহাত হবিবুল্লা, জে এন ইউ-র অধ্যাপিকা সুপ্রিয়া বর্মা।

দি টেলিগ্রাফ, ১৭ নভেম্বর ২০১৯

 

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্প্রতি ঝাড়খন্ড বিধানসভা নির্বাচনে প্রচার উপলক্ষে বড় গলা করে বললেন, জনজাতিদের জন্য যা কিছু করেছে কেবল বিজেপি। তিনি স্মরণ করালেন, অটল বিহারী সরকার জনজাতিদের জন্য আলাদা একটা মন্ত্রক গঠন করেছিলেন ১৯৯৯ সালে। তারপর মোদী সরকার এসে উপজাতি পরিবারগুলোর জন্য চালু করেছে “বন ধন বিকাশ যোজনা”। অমিত শাহ আরও বলেন, স্বাধীনতা পাওয়ার পর ৭০ বছর ধরে আদিবাসীরা কংগ্রেস শাসন থেকে কেবল উপেক্ষাই পেয়ে এসেছে। কংগ্রেস আমল আদিবাসীদের দিয়েছে শুধু ‘আঁধার আর অশিক্ষা’, বনাঞ্চল কেটে গরিব আদিবাসীদের তাদের বসত ভূমে বসবাস করার অধিকারের প্রশ্নে প্রভূত বঞ্চনা করেছে। অন্যদিকে, বিজেপি ক্ষমতায় এসে আদিবাসীদের দিয়েছে ‘উজালা, শিক্ষা এবং ঘর’। এছাড়া দিয়েছে বিদ্যুৎ ও শৌচাগারের সুবিধা। অমিত শাহের কথা হল, ‘এইসমস্ত প্রকল্প ও কর্মসূচী গরিব আদিবাসী ও পশ্চাদপদ সম্প্রদায়গুলিকে উপকৃত করেছে। জনজাতি বিকাশ কর্মসূচী মোদী সরকারের কাছে খুবই বড় আকারে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়।’

দি টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া, ১৭ নভেম্বর ২০১৯

 

দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি রামদেবের পতঞ্জলি প্রডাক্টের সমস্ত পণ্যদ্রব্য বয়কটের ডাক দিয়েছে। কারণ দলিত, আদিবাসী সম্প্রদায়, মুসলিম ও দ্রাবিড় আন্দোলনের পথপ্রদর্শক পেরিয়ারের অনুগামীরা মিলে “বৌদ্ধিক সন্ত্রাসবাদ” ছড়ানোর জন্য দায়ী বলে রামদেব অভিযোগ তুলেছে।

সারা ভারত আম্বেদকার মহাসভা, অখিল ভারত পশ্চাদপদ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কর্মচারি ফেডারেশান এবং ভীম আর্মি সংগঠন রামদেবের বিবৃতিকে ধিক্কার জানিয়ে বলেছে, উনি হলেন মনু স্মৃতির প্রচারক যা জাতিব্যবস্থারই আচার সংহিতা। রামদেবের পাল্টা বিবৃতিতে প্রতিবাদী পশ্চাদপদ সংগঠনগুলির পক্ষে স্বাক্ষরকারী নেতৃবৃন্দ বলেন,” রামদেব যা সব শব্দ উল্লেখ করেছেন তা বরদাস্ত করা হবে না। তিনি যে একজন মনুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী তার স্বরূপ তিনি নিজেই উন্মোচিত করেছেন। আমরা তাই তার পতঞ্জলি মার্কা সমস্ত পণ্যদ্রব্য বয়কটের ডাক দিয়েছি।” একথা জোরের সাথে বলেন আম্বেদকার মহাসভার সভাপতি অশোক ভারতী, তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের। তাঁর সংগঠন ডাক দিয়েছে পতঞ্জলির পণ্যদ্রব্য রাস্তায় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিন। দলিত অধিকারের জন্য সংগ্রামী আরেকটি সংগঠন ভীম আর্মির কর্মচারি ফেডারেশনের সভাপতি ওয়ামান মেশরাম দাবি করেন, রামদেবকে ক্ষমা চেয়ে বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। ভীম আর্মির মুখপাত্র কুশ আম্বেদকার বলেন, “বাবামশাই প্রকাশ্যে দলিত ও পেরিয়ারের কোটি কোটি অনুগামীদের অসম্মান করেছেন। আরএসএস-এর মতোই বাবা ধর্মীয় বিশ্বাসের পাল্টা বিকল্প যে কিছু থাকতে পারে তা বিশ্বাসই করেননা। তাই আমরা তার সমস্ত পণ্যদ্রব্য বয়কট করার কথা বলছি।”

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ই ভি রামস্বামী পেরিয়ার (১৮৭৯-১৯৭৩) ছিলেন একজন সমাজকর্মী ও চিন্তানায়ক, যিনি দ্রাবিড় জনতার আত্মমর্যাদার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর লেখা বই ‘রামায়ণ’ : প্রকৃতই মহাকাব্যটির এক বিকল্প আখ্যান রচনায় ঋদ্ধ। তিনি তাঁর উপস্থাপনায় দেখানোর চেষ্টা করেছেন ব্রাহ্মণ্যবাদী সংষ্কৃতির উত্তরের সাথে অ-ব্রাহ্মণ্যবাদী দক্ষিণের সংঘাতের বিষয়টিকে।

দি টেলিগ্রাফ, ১৮ নভেম্বর ২০১৯

খণ্ড-26
সংখ্যা-37