প্রতিবেদন
বিপুল করছাড় দেশকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে

এ যেন এক ভানুমতীর খেল। রূপকথার ঘুমন্ত রাজকন্যাকে সোনার কাঠির স্পর্শে যেন অবশেষে জাগিয়ে তোলা। গত ১১ মাসের মধ্যে এক দিনে সবচেয়ে বড় পতন ঘটিয়ে ৩ সেপ্টেম্বর সেনসেক্স খুইয়েছিল ৭৭০ পয়েন্ট। ২০ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী কর্পোরেট কর এক ধাক্কায় ৩০ শতাংশ থেকে ২২ শতাংশে নামিয়ে আনায় যেন দেওয়ালির রোশনাই ছড়িয়ে পড়ল ঝিম মেরে থাকা বাজারে। এই ঘোষণার পর সেনসেক্স এক ধাক্কায় বাড়ল ১,৯২১.১৫ পয়েন্ট। এর আগে, ২০০৯ সালের ১৮ মে তারিখে তা বেড়েছিল ২,১১১ পয়েন্ট। একদিনেই লগ্নিকারীদের সম্পদ বাড়ল ৬.৮ লক্ষ কোটি টাকায়। যে টাকার দাম ডলারের নিরিখে ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়, সেই মূল্য ও ডলার পিছু বেড়ে হয়েছে ৭০.৯৪ টাকা। এবার, এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক, অর্থমন্ত্রী কি কি উপহার নিয়ে হাজির হয়েছেন কর্পোরেটদের দরবারে :

* বড় মাপের সংস্থাগুলোকে এতদিন সেস-সারচার্জ মিলিয়ে দিতে হতো ৩৪.৯৪ শতাংশ কর্পোরেট কর। এখন দিতে হবে ২৫. ১৭ শতাংশ।

* নতুন কারখানা খুলতে তৈরি সংস্থার জন্য ও কর্পোরেট কর ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হলো ১৫ শতাংশ।

* বাজেটে বিদেশি সংস্থাগুলোর শেয়ার বাজারে মুনাফার উপরে বাড়তি সারচার্জের বোঝা চাপানো হয়। কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী তার কিছুটা প্রত্যাহার করেন। আজ আরও এক দফা প্রত্যাহার করা হয়। অতি ধনীদের জন্য বাজেটে যে কর ধার্য করার প্রস্তাব ছিল, সেখান থেকেও পিছিয়েছে সরকার।

* অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে শিল্পমহল ১ লক্ষ কোটি টাকার স্টিমুলাস দাওয়াই চেয়েছিল। অর্থমন্ত্রী আরও উদার হয়ে তাদের দিলেন ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকা। কর্পোরেট কর কমানোয় নতুন করে প্রতি বছর দেশের ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হবে। তাই, আহ্লাদে আটখানা শিল্পমহল এই ঘোষণাকে ‘মিনি বাজেট’ হিসাবে ঘোষণা করছেন।

* অর্থমন্ত্রক বলেছে, কিছুদিন আগে কেন্দ্র রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে যে ১.৭৬ লক্ষ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে, ওই টাকা এই সব খরচ সামলাতে বিরাট ভূমিকা রাখবে। অর্থাৎ, কর্পোরেটকে ঢালাও আর্থিক ছাড় দিতে শীর্ষ ব্যাঙ্কের এই টাকাটার দিকেই এতদিন নজর ছিল মোদী সরকারের।

কর্পোরেটকে ঢালাও ছাড় দিয়েছে সরকার :

২০০৪-০৫ সালে চিদাম্বরম অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন কর্পোরেট কর ৩৫ থেকে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এবার যে ছাড় দেওয়া হলো, তা আমাদের জিডিপি-র এক শতাংশ। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে রাজ্য সরকারগুলো তাদের ভাগের যে ৪২ শতাংশ রাজস্ব পেয়ে আসতো, এই কর ছাড়ের ফলে প্রতি বছর তারা খোয়াবে ৬১ হাজার কোটি টাকা।

কর্পোরেট কর ছাড়ের এটাই প্রথম উদাহরণ নয়। ২০০৫ থেকে ২০১৫, এই দশ বছরে বাজেটে মাত্র তিনটি খাতে, অর্থাৎ, কর্পোরেট ইনকাম ট্যাক্স-এক্সাইজ ডিউটি-কাস্টমস ডিউটি বাবদ ছাড় দেওয়া হয়েছিল ৪২ লক্ষ কোটি টাকা! বাজেটে ‘স্টেটমেন্ট অফ রেভেনিউ ফোরগন’ শিরোনামে এই বিপুল ছাড়ের কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। মোদী সরকার আসার পর ওই ফোরগন (যার অর্থ হচ্ছে ছাড়) শব্দটা তুলে দেওয়া হলো এই জন্য যে, ওই শব্দটি ক্ষতিকারক প্রভাব তৈরি করবে। বদলে তারা লিখতে শুরু করলো “দ্য স্টেটমেন্ট অফ রেভেনিউ ইম্প্যাক্ট অফ ট্যাক্স ইন্সেন্টিভস্ আন্ডার দ্য সেন্ট্রাল ট্যাক্স সিস্টেম’’। এই ছাড়ের বিপুল পরিমাণ টাকায় অনায়াসে ১০৯ বছর ধরে নরেগার কর্মসূচি ভালোভাবে চালিয়ে নেওয়া যেত। মোদী আসার এক বছরের মাথায় এই ছাড়ের মাত্রা বেড়ে গেল বহু গুণ। ২০১৬ সালেই মোদী সরকার কর্পোরেটদের ছাড় দিল ৫,৫১,০০০ কোটি টাকা !! সেই সময়, অর্থাৎ, ২০১৬ সালে বাজেট পেশের আগে যে আর্থিক সমীক্ষা পেশ করা হয়, তাতে বলা হয়েছিল, ভারতের ধনীরা বছরে এক লক্ষ কোটি টাকার ভর্তুকি আত্মসাৎ করে নেয় যা নাকি বরাদ্দ থাকে গরিবদের জন্য। সেই সময়কার মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রাহ্মনিয়াম প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ভারতের মানব সম্পদ বিকাশের স্বার্থে সরকার এমনকি ধনী চাষিদের ও কর ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসুক, সম্পত্তি কর প্রবর্তন করা হোক, ধাপে ধাপে কর্পোরেট করে ছাড় দেওয়াটার অবসান ঘটুক। ২০০৮-র বিশ্বব্যাপী মন্দা বা গ্লোবাল মেল্টডাউন আসার পর থেকে প্রতি বছর শিল্প মহল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে স্টিমুলাস প্যাকেজ হিসাবে পেয়ে আসছে ৪.৫ লক্ষ কোটি, ১০ বছরে যার পরিমাণ ১৪.৫ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু এত বিপুল ছাড়, সুযোগ সুবিধা সত্ত্বেও চাঙ্গা হলো না অর্থনীতি, বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে কর্মহীনতা সবচেয়ে মারাত্বক হয়ে মাথা চাড়া দিল, চলতি ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির গতি এক ধাক্কায় গোত্তা মেরে ৫ শতাংশ হারে নেমে এলো। তার অনেকদিন পর শীর্ষ ব্যাঙ্কের গভর্নর রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, তাঁদের তরফে এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে পূর্বাভাস ছিল বৃদ্ধির হার হবে ৫.৮ শতাংশ। কিন্তু অন্ধ-বধির বৃদ্ধির হার’কে জাতীয়তাবাদী আবেগে ভাসানো গেল না। সে, রাষ্ট্রীয় নীতিকারদের মুখ পুড়িয়ে নিজের নিয়মে নেমে গেল ৫ শতাংশে।

কিন্তু, ৫ শতাংশের এই জাতীয় আয়ের হিসাব কতটা বিশ্বাসযোগ্য? ২০১৬ সালে নোট বন্দী হয়, যাকে বহু অর্থনীতিবিদ বিরাট এক আর্থিক বিপর্যয় বলে চিহ্নিত করেন। উৎপাদনের ক্ষেত্রেও তা বিরাট ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। যে ইনফর্মাল ক্ষেত্র জাতীয় আয়ে ৪৫-৫০ শতাংশ অবদান রাখে, সেই ইনফর্মাল ক্ষেত্রে প্রায় ৮৫ শতাংশ কাজ লোপাট হয় নোটবন্দীর পর। এত বড় বিপর্যয়ের পরও মোদী সরকারের তরফ থেকে জানানো হলো যে, ২০১৬-১৭-তে আর্থিক বৃদ্ধি হয়েছে এই দশকে সর্বোচ্চ ৮.২ শতাংশ হারে! সমস্ত ক্ষেত্রে ফেক বা মিথ্যা ছড়ানোর ব্যাপারে এই সরকার রীতিমতো দস্তুর হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই দাবিকে চ্যালেঞ্জ জানায় মোদী সরকারের প্রাক্তন মূখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রাহ্মনিয়াম। তিনি রীতিমতো গবেষণা করে দেখান, ২০১১-১২ থেকে ২০১৬- ১৭ পর্যন্ত আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল ৪.৫ শতাংশের আশেপাশে। কোনোমতেই সরকারি পরিসংখ্যানে দেখানো ৭ শতাংশ নয়। ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট, আমেদাবাদের দুই অর্থনীতিবিদ দেখান, ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ এই বৃদ্ধির হার ৫ থেকে বড় জোর ৫.৫ শতাংশ।

আমাদের প্রথম মহিলা অর্থমন্ত্রী একসময়ে দাবি করেছিলেন, ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার আমেরিকা ও চীনকেও নাকি ছাপিয়ে গেছে। সে নিয়ে কম রঙ্গ-রসিকতা হয়নি। দেশের বর্তমান আর্থিক হাল নিয়ে শুরু হলো নানান বর্ণনা। কেউ নাম দিলেন ‘মন্দার দিকে এগিয়ে চলা,’ কেউ বললেন ‘ডাউনটার্ণ’ বা ‘শ্লো ডাউন’, কেউ কেউ বলতে লাগলেন, ‘স্ট্রাকচারাল’ সংকট, আবার কেউ বা বললেন ‘সাইক্লিকাল ডাউনটার্ণ’। নীতি আয়োগ, প্রধান মন্ত্রী দপ্তরের আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদ এবং শীর্ষ ব্যাঙ্ক অর্থনীতির হালত সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করার পর অর্থমন্ত্রী এর দায় চাপালেন নবীন প্রজন্মের উপর। তবে একটা ব্যাপারে তাঁকে অবশ্যই ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। তিনি হলেন মোদী মন্ত্রীসভার প্রথম গুরুত্বপূর্ণমন্ত্রী যিনি অবশেষে মুখের কুলুপ খুলে অর্থনীতির বেহাল দশা নিয়ে মন্তব্য করলেন, আর, এই প্রথম, দেশের বিরাট আর্থিক বিপর্যয়ের জন্য সংখ্যালঘুদের দাঁড় করাননি কাঠগড়ায়!

মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক

পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে দ্রুত বিকাশশীল ভারতীয় অর্থনীতির যে ফানুস ওড়ানো হয়েছিল তা আজ ফেটে চৌচির। সরকারি পরিসংখ্যানই জানালো এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকে দেশের জাতীয় আয় বেড়েছে যৎসামান্য ৫ শতাংশ হারে (যদিও তা বিতর্কিত) — বিগত ছ’ বছরে যা সর্বনিম্ন। গাড়ি, ভোগ্যপণ্য, উৎপাদন, পরিকাঠামো — অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বহু ক্ষেত্রেই এখন সংকটের কালো মেঘের ঘনঘটা। শুধু আগস্ট মাসেই শেয়ার বাজার থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তুলে নিয়েছে ৫,৯২০ কোটি টাকা। আর, আগস্টেই, কারখানার উৎপাদন কমেছে ১৫ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। জুলাইয়ে দেশের ৮টি প্রধান পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ২.১ শতাংশ। ডলারের নিরিখে বিপুল পতন হয় টাকার। ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের সিদ্ধান্ত ও রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কের শেয়ারকে চাঙ্গা করতে পারলো না। অর্থনীতিতে এত রক্তক্ষরণ, এত বিপর্যয়, কিন্তু দেশের রাজাধিরাজ একটিও রা কাড়লেন না। চুপ তাঁর প্রধান সেনাপতি। অন্য ইস্যুকে সামনে এনে অর্থনীতির এই বিপর্যয় থেকে আম জনতার মুখ ঘোরাতেই ওই ধূর্ত যুগল নানা দুরভিসন্ধি আঁটছে।

প্রথম দিকে, মোদী সরকার সমস্ত সূচকগুলোকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে বলতে থাকলো যে ‘নতুন ভারতবর্ষ’ বেসরকারি সংস্থাগুলোর তৈরি করা ভোগ্যপণ্য বেশী ব্যবহার করছে, তাই বিপুল মাত্রায় কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে গিগ কেন্দ্রিক অর্থনীতির ক্রমপ্রসারমান ইনফরমাল ক্ষেত্রে। যা সরকারি পরিসংখ্যান এখনও সবটাকে ফুটিয়ে তুলতে পারছে না। কিন্তু, কিছুদিন যেতে না যেতেই খবর এলো যে উবের-জোম্যাটোর মতো গিগ কেন্দ্রিক পেশায় ছাঁটাই শুরু হয়েছে।

এই সংকটের নেপথ্য কারণ কি?

অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট ভাষণে বলেছিলেন, “ভারতের কর্পোরেটরা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। তাঁরাই হচ্ছে জাতির সম্পদসৃষ্টিকারী। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে চললে আমরা লাভবান হবো, ধারাবাহিক জাতীয় আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যাব।’’ কিন্তু বাস্তব কি বলছে?

এনএসএসও-এর তথ্য (কর্মসংস্থান সম্পর্কিত) থেকে জানা যায়, ২০১১-১২-তে সমগ্র শ্রমশিবিরের ৪৬৭.৭ মিলিয়ন ব্যাপকভাবে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৭- ১৮-তে ৪৬১.৫ মিলিয়নে নেমে আসে। অথচ, সরকারের পরিসংখ্যান বলছে, সেই সময় ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল ৭ শতাংশের অধিক। অর্থাৎ, এই ছ’বছরে বাড়তি কর্মসংস্থান তো দুরস্থান, প্রায় ৬.২ মিলিয়ন কাজ লোপাট হয়েছে। যে রূঢ় বাস্তবটি সামনে এলো তা হচ্ছে, ভারতের বহু বিজ্ঞাপিত আর্থিক বৃদ্ধি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি, অর্থমন্ত্রী কর্পোরেটদের যতই পিঠ চাপড়ে দরাজ সার্টিফিকেট দিক না কেন।

বর্তমানে গভীর আর্থিক সংকটের পেছনে রয়েছে বিপুল সংখ্যক মানুষের ক্রয় ক্ষমতার নিদারুণ সংকোচন, অত্যন্ত কম আয় ও ক্রমে বেড়ে চলা বৈষম্য। এনএসএসও-র তরফ থেকে ২০১৭- ১৮-র জন্য প্রকাশিত পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভেথেকে উঠে আসা তথ্য এটাই দেখাচ্ছে যে ভারতের অর্থনীতি এক গভীর কাঠামোগত সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে।

আসল সমস্যাটা হলো, দেশের মানুষ বেশি কেনাকাটা করতে পারছে না, কারণ তাঁরা খুবই কম আয় করছে। গাড়ি বিক্রির ভাঁটা তো আছেই, ব্রিটানিয়া বিস্কুট সংস্থার শেয়ার হোল্ডারদের বার্ষিক বৈঠকে সংস্থার কর্ণধার বলেন যে সাধারণ মানুষ এখন ৫ টাকার বিস্কুট কেনার আগেও দশবার ভাবছে। ভারতে কাজের বাজার শোভন কাজের সুযোগ তৈরি করছে না। গোটা পৃথিবীর মধ্যে তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা এ দেশে সর্বোচ্চ। যারা হণ্যে হয়ে কাজ খুঁজছে, কাজের বাজারে। কর্মরত এবং কর্মপ্রার্থীর হার, যাকে এনএসএসও সংজ্ঞায়িত করেছে লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট বলে, তাতে দেখা যাচ্ছে, এই হার ২০১১-১২ এবং ২০১৭-১৮-র মাঝে ৫৪.৯ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৪৯.৮ শতাংশ। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ কর্মী স্বনিযুক্ত বা ক্যাজুয়াল। ৫২.২ শতাংশ স্বনিযুক্ত কর্মীরা যা আয় করেন তাতে টেনেটুনে কোনো রকমে তাঁরা দিন গুজরান করেন। উপরের তথ্য থেকে আরও জানা যায়, মোট শ্রমশক্তির যে ২৫ শতাংশ নিয়মিত বেতন বা মজুরি পাচ্ছেন, তাঁরাও ক্রমে ক্রমে বিপন্ন হয়ে পড়ছেন। ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮-র মধ্যে এই অংশটির পরিমাণ ৬৪ থেকে বেড়ে ৭১ শতাংশ হয়েছে। নিয়মিত ধরনের কাজের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাঁরাও মাসে উপার্জন করছেন ১০ হাজার টাকার কম। গ্রামাঞ্চলের অবস্থা আরও করুণ। সেখানে ৫৫ শতাংশের অধিক নিয়মিত কাজের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা প্রতি মাসে ১০ হাজারের কম উপার্জন করেন। আগে এই স্তরের কর্মীদের কাজের প্রশ্নে সুরক্ষা ছিল। কিন্তু, এনএসএসও-এর পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে অ-কৃষিক্ষেত্রের সাথে যুক্ত ৭১ শতাংশ নিয়মিত কাজের সাথে যুক্ত কর্মীদের নেই কোনো লিখিত চুক্তি আর ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮-এর মধ্যে এদের কাজের প্রশ্নে অনিশ্চয়তা দিন কে দিন অনেক বেড়ে চলেছে। এরা সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প থেকেও পুরোপুরি বঞ্চিত।

আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে আসার হাত ধরেই নেমে এসেছে দেশে পারিবারিক সঞ্চয়ের হার। এই হার ২০১৭-১৮-তে নেমে এসেছে ১৭ শতাংশের ঘরে। আগে যা ছিল ২৩ শতাংশ।

ক্রমে বেড়ে চলা কর্মহীনতা, অত্যন্ত স্বল্প আয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে কোনোমতে দিন গুজরান করছে। ক্রয়ক্ষমতাহীন বিপুল এই জনসংখ্যা তাই ভোগ্যপণ্য কিনছেন অত্যন্ত সীমিত হারে। গ্রামাঞ্চলে যা আরও তীব্রতা পেয়েছে। এবারের আর্থিক সমীক্ষাও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে শ্রমজীবীদের ন্যুনতম মজুরি বৃদ্ধি, সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করে যা মোদী সরকার তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়।

বিপুল কর্পোরেট কর ছাড়ের পর উল্লসিত শিল্পমহল এবার আরও চাপ বাড়াতে বলছে, এইটুকু করলেই চলবে না। জমি অধিগ্রহণের সমস্ত জটিলতার অবসান ঘটাতে হবে। আরও ঢালাও, সর্বাত্মক, সংস্কার করতে হবে। তবেই নাকি ঘটবে আর্থিক সমৃদ্ধি, তরতর করে দেশ এগিয়ে যাবে মোদীর ৫ লক্ষ কোটি ডলার অর্থনীতির দিকে। আর, বিপুল এই কর ছাড় যে আগামীদিনে ঘনিয়ে তুলবে রাজস্ব ঘাটতি তা বেশ কিছু অর্থশাস্ত্রীরা বলতে শুরু করেছেন। লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সের অধ্যাপক মৈত্রীশ ঘটক বলেছেন, “দেশ যখন গভীর মন্দার মুখে দাঁড়িয়ে, তখন কর্পোরেটদের জন্য এই কর ছাড় আসলে ধনীদের জন্য পুনর্বণ্টন।"

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প কর্পোরেটদের স্বার্থে বিপুল কর ছাড় দিয়েছে। এই পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করেছেন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ পল্ ক্রুগমান। নিউইয়র্ক টাইমস্-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধ “দ্য ট্রাম্প ট্যাক্স কাট : ইভেন ওয়ার্স দ্যান ইউ হ্যাভ হার্ড"-এ তিনি বিস্তারিত ভাবে দেখিয়েছেন, কর ছাড় আমেরিকার অর্থনীতিতে সমূহ ক্ষতি ডেকে এনেছে। তিনি বলেছেন, “যে মূল বিষয়টা বোঝা দরকার তা হলো, বিশ্বায়িত কর্পোরেট ব্যবস্থায়, আমাদের সহ, যে কোনো দেশের কর্পোরেট সেক্টার প্রধানত বিদেশীদের নিয়ন্ত্রণাধীন। এগুলো, বিদেশীরা সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে কর্পোরেশনের মাধ্যমে, কারণ এখানে কর্পোরেশনগুলো বিদেশের সাবসিডিয়ারি অথবা ঘুরপথে, কারণ, এখানে বিদেশীরা মার্কিনী স্টকগুলো কুক্ষিগত করেছে। তাই, যে কোনো কর্পোরেট কর ছাড়ের সিংহভাগ বিদেশে চলে যায়, সামান্য একটা অংশ পড়ে থাকে এ দেশে। এতে, দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে কোনো কাজেই লাগে না। তাই, কর ছাড় আমেরিকাকে আরও গরীব করেছে। ধনী করা তো দূরে থাক।" তিনি আরও বলেছেন, কর ছাড়ের এই মাশুল অর্থনীতি অন্য পথে উশুল করে নেবে। সাধারণ মানুষের উপর করের বোঝা বাড়িয়ে, বা জনগণের জন্য যে সমস্ত সামাজিক কল্যানমূলক প্রকল্পগুলো চালু রয়েছে সেগুলোকে কাটছাঁট করে।

ক্রোনি পুঁজিবাদের স্বার্থেগোটা দেশের অর্থনীতিকে মোদী জমানা একেবারে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত করল।

খণ্ড-26
সংখ্যা-31