খবরা-খবর
জেলায় জেলায় ক্ষেতমজুর গ্রামীণমজুর-কৃষক সংগঠনের বিক্ষোভ

পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম, গ্রামান্তরে অস্হিরতা বেড়েই চলেছে। ৪/৫ মাস আগে গ্রাম বাংলার ঐক্যবদ্ধ ক্রোধ প্রতিফলিত হয়েছিল ভোটবাক্সে — তৃণমূল কংগ্রেসের স্বৈরাচারী শাসন, বেলাগাম তোলাবাজি আর সিন্ডিকেট রাজের বিরুদ্ধে। এই অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে ‘অধরা’ বাংলাকে দখলের স্বপ্ন দেখছেন নরেন্দ্র মোদী, দিলীপ ঘোষরা।

এই যখন আমজনতার আর্থিক পরিস্থিতি,যখন বিপর্যস্ত রুজি-রোজগার, ঠিক সময়েই বাংলা প্রত্যক্ষ করছে এনআরসি নিয়ে আসামের লাখো, লাখো মানুষের দুর্দশা। একই সাথে শুনছে ফ্যাসিস্ট দিলীপ ঘোষ, অমিত শাহদের মদমত্ত হুঙ্কার, ‘বাংলায় এনআরসি হচ্ছেই’! দিলীপ বাবুদের হিসাব ছিল,’ওরা বিধর্মী, বাংলাদেশী, বিদেশি; ওদের হটিয়ে দিলেই তোমার কাজ মিলবে, সম্পত্তি মিলবে’এই ফ্যাসিস্ট যুক্তিতে মানুষকে বিভক্ত করা, বিষাক্ত করা, ফ্যাসিস্ট উন্মাদনায় সক্রিয় করা। কিন্তু তেমন উন্মাদনা যে সৃষ্টি হচ্ছে না, তার বড় কারণ আসামের অভিজ্ঞতায় বাংলা জুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এনআরসি আতংক। আসামে চাওয়া হচ্ছে ৫০ বছর আগেকার দলিল! আর বাংলার অধিকাংশ পরিবারের পুরানো দলিলপত্র সংরক্ষণের ঐতিহ্য খুব কম। মেহনতি মানুষের প্রায় প্রতিটি পরিবারে ভোটার লিস্ট, আধার কার্ড, রেশন কার্ডে নাম, ঠিকানা, বয়স, ফটো ইত্যাদিতে নানান ভুল; বাস্তুর রেকর্ড নেই লাখ লাখ মানুষের। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এই রাজ্যে বিশেষত আদিবাসীরা এমনকি দলিতদেরও উল্লেখযোগ্য একাংশ নানা জায়গা ঘুরে শেষে থিতু হয়েছেন কোন মৌজায়। এঁদের পুরানো কাগজপত্র কোথায়! কিন্তু নেটের দৌলতে এমনকি আদিবাসী পাড়াতেও যে নানা খবর পৌঁছে যাচ্ছে! আতংকগ্রস্ত মানুষ। এক এক করে আত্মহত্যা করেছেন ১৭ জন দিশেহারা মানুষ। এই বাংলাতেই! বিজেপির আসল উদ্দেশ্য নিয়েই সন্দিহান হয়ে উঠছেন মানুষ। প্রতিবাদে শুরু হচ্ছে রাস্তায় নামা।

এর সাথেই এগিয়ে চলেছে, উচ্চকিত হচ্ছে বাংলার আদিবাসী জনসমাজের জাগরণ বার্তা, সামনে আসতে মরিয়া আদিবাসী সাংস্কৃতিক স্বাভিমান, সাংস্কৃতি ও ভাষার কার্যকর সরকারী স্বীকৃতির ক্রমবর্ধমান আকাঙ্ক্ষা।

সাম্প্রতিক সময়ে ঐক্যবদ্ধ হতে, দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মরিয়া আশা, অঙ্গনওয়ারি, মিড-ডে-মিল কর্মীরাও। বারে বারে পথে নামছেন ওঁরা।

nd2

 

পরিস্থিতির এই বড়সড়ো পরিবর্তনকে সামনে রেখে গত ২৫ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলায় ২/৩ দিন ধরে চলতে থাকা নিম্নচাপজনিত তুমুল বর্ষার মধ্যে,প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশকে জয় করে, প্রতিবাদি জনগণ ও সংগঠকদের প্রবল ইচ্ছাশক্তিতে সংগঠিত হল জেলায়, জেলায় মিছিল সহ ডিএম ডেপুটেশন। সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি সহ অবিলম্বে ১০০ দিনের কাজ চালু করো, ১০০ দিনের পরিবর্তে ২০০ দিনের কাজ চাই, লোকপ্রসার নিয়ে টালবাহানা করছো কেন? রাজ্য সরকার জবাব দাও, এন আর সি মানছি না, আসাম থেকে শিক্ষা নাও, পশ্চিমবঙ্গে এনআরসির চক্রান্ত রুখে দাও, আবাস যোজনায় প্রত্যেকের ঘর চাই, প্রত্যেক ৬০বছর বয়স্ক মানুষকে ও প্রত্যেক বিধবার সামাজিক সুরক্ষা ভাতা সুনিশ্চিত করতে হবে, মিড-ডে-মিল কর্মীদের কাজের নিরাপত্তা ও সম্মানজনক বেতন সুনিশ্চিত করো, অবিলম্বে পাট্টাহীনদের পাট্টা দাও, আদিবাসী হোষ্টেল বন্ধ করা চলবে না, বনাঞ্চলের জমি থেকে আদিবাসী উচ্ছেদ বন্ধ করো, ফসলের ন্যায্য মূল্য সুনিশ্চিত করো, সহায়ক মূল্যের চেয়ে কমদামে ফসল কেনাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে ঘোষণা করতে হবে ইত্যাদি শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে হুগলি, বাঁকুড়া, বর্ধমান, নদীয়া, মুর্শিদাবাদের জেলা সদরের রাজপথ।

bk

 

বাঁকুড়া শহরের লালবাজার থেকে মিছিল বের হয়। ডিএম দপ্তরে আসার পথে মিছিল ছিল শ্লোগানে শ্লোগানে মুখর। নেতৃত্ব দেন আয়ারলার রাজ্য নেতা বাবলু ব্যানার্জি, কিষান মহাসভার বৈদ্যনাথ চিনা, এআইসিসিটিইউর ফারহান, আদিবাসী মঞ্চের সুধীর মুর্মু প্রমুখ। ডেপুটেশনে ৫ জনের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন আয়ারলার জেলা সম্পাদক রামনিবাস বাস্কে। ডেপুটেশনে শেষে কোন প্ররোচনা ছাড়াই স্বয়ং জেলাশাসক দাঁড়িয়ে থেকে সিজ করেন আন্দোলনরত মানুষের প্রচার মাইক। আন্দোলনরত উপস্থিত চার শতাধিক জনতাও সোচ্চার হয়ে ওঠেন। জানিয়ে দেন দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন আরো জোরদার করা হবে।মাইক কেড়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না।

মুর্শিদাবাদ জেলার মিছিল শুরু হয় বহরমপুরের গির্জার মোড় থেকে। মিছিল শেষে ডেপুটেশনে নেতৃত্ব দেন কমরেড রাজীব রায়, অপূর্ব লাহিড়ী, রবি মন্ডল, মঞ্জুর সেখ ও রবিউল হোসেনকে নিয়ে গঠিত ৫ জনের এক প্রতিনিধি দল।

bdn

 

বর্ধমানে মিছিল শুরু হয় বর্ধমান ষ্টেশন চত্বর থেকে। বৃষ্টি ভেজা অবস্থায় মিছিল ডিএম দপ্তরে পৌঁছায়। ডেপুটেশনে ছিলেন কিষান মহাসভার রাজ্য সভাপতি অন্নদাপ্রসাদ ভট্টাচার্য,আয়ারলা রাজ্য সভাপতি সজল পাল, জেলা সম্পাদক আনসারুল আমান মন্ডল,সংগঠক কমরেড শিবু সাঁতরা ও শ্রীকান্ত রানা।

nd

 

তুমুল বৃষ্টি উপেক্ষা করে নদীয়ার কৃষ্ণনগরে ডি এম দপ্তরের সামনে চলে বেলা ১২টা থেকে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান বিক্ষোভ কর্মসূচী। বক্তব্য রাখেন কিষান মহাসভার রাজ্য নেতা কৃষ্ণ প্রামানিক, আয়ারলার জেলা সম্পাদক কাজল দত্তগুপ্ত, এআইসিসিটিইউ রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বসু, কৃষক নেতা আলতাফ হোসেন, জীবন কবিরাজ, পার্টির জেলা সম্পাদক সুবিমল সেনগুপ্ত প্রমুখ। সভা পরিচালনা করেন আর ওয়াই এর সন্তু ভট্টাচার্য। ডিএম দপ্তরে ডেপুটেশন শেষে দাবিগুলি সম্পর্কে ডিএমের লিখিত বক্তব্য সংগঠনকে প্রেরণের প্রতিশ্রুতি আদায় করা হয়।

কমরেড শরৎ সিংহদের নেতৃত্বে ব্লক স্তরে ডেপুটেশন সফল হয় দার্জিলিং জেলাতে। দক্ষিণ ২৪ পরগণায় গত ৭ সেপ্টেম্বর বারুইপুর মহকুমা প্রশাসককে এই সকল দাবিতে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। হাওড়ায় ৩০ সেপ্টেম্বর সংগঠিত হয় বাগনান ব্লক ডেপুটেশন।

hg

 

হুগলির মিছিল ও ডেপুটেশনে উপস্থিত ছিলেন সহস্রাধিক মানুষ। সকাল থেকে চলতে থাকা তুমুল বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই তাঁরা উপস্থিত হয়েছিলেন চুঁচুড়া জেলা সদরে। সুসজ্জিত দীর্ঘ মিছিল প্রায় তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ডিএম দপ্তরে ডেপুটেশনে উপস্থিত হয়। নেতৃত্বে ছিলেন কৃষক নেতা মুকুল কুমার,তপন বটব্যাল, আদিবাসী মঞ্চের জেলা নেতা পাগান মুর্মু, বিশ্বনাথ সরেন, সরস্বতী বেসরা, আরতি হাঁসদা, শুকুমনি মান্ডি আয়ারলা জেলা নেতা নিরঞ্জন বাগ, গোপাল রায়, সজল দে, শৈলেন মাঝি, সজল অধিকারী প্রমুখ।

খণ্ড-26
সংখ্যা-31