সিদ্ধান্ত
কেন্দ্রীয় কমিটির সার্কুলার

২৫-২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ রাজস্থানের ঝুনঝুনুতে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের প্রারম্ভে বর্ষীয়ান ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও উত্তর প্রদেশ রাজ্য কমিটির সদস্য কমরেড হরি সিং (২৫ সেপ্টেম্বর সকালে যিনি প্রয়াত হন), ভোজপুরের বরগাঁও পঞ্চায়েতের জনপ্রিয় মুখিয়া কমরেড অরুণ সিং (যিনি বিজেপি মদতপুষ্ট সামন্ত শক্তির হাতে নিহত হন), নাগপুরের কমরেড সন্ধ্যা (যিনি ছিলেন মহারাষ্ট্রে দীর্ঘদিনের কর্মী), পশ্চিম চম্পারনের কমরেড ভোলা ওরাঁও (যিনি কলকাতা কনভেনশন থেকে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান)সহ অন্যান্য যে সমস্ত পার্টি সদস্য মে’১৯ এর শেষ ভাগে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কমিটি মিটিং-এর পরবর্তীকালে প্রয়াত হয়েছেন – তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সভার মূল আলোচ্য বিষয়সমূহ এবং গৃহীত সিদ্ধান্তগুলির সারসংক্ষেপ নিম্নে বর্ণিত হল।

অর্থনৈতিক মন্দার মোকাবিলা : মোদি সরকারের ক্রমবর্ধমান কর্পোরেটমুখী ও জনবিরোধী আর্থিক নীতিমালা এবং নোটবন্দি ও জিএসটির মতো যুক্তিহীন আর্থিক পদক্ষেপগুলির পরিণামে অর্থনীতি এক গভীর মন্দার কবলে। অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে মন্দার প্রভাব পড়েছে এবং মন্দার সর্বনাশা ঘুর্ণিপাকের প্রবল ধকলের সিংহভাগই সহ্য করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে – যেখানে বিক্রয় কমে যাচ্ছে ও উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে এবং পরিণাম হিসেবে কাজ হারানো ও আয় কমে যাওয়ার ঘটনা বাড়ছে এবং বাজারে চাহিদা আরও হ্রাস পাচ্ছে। কর্মসংস্থান গড়ে তোলা এবং আয় ও চাহিদাকে চাঙ্গা করার লক্ষ্যে উন্নয়ন খাতে সরকারী ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকার অর্থনীতির উত্থান ঘটাতে পারে কিন্তু তা না করে মোদি সরকার কর্পোরেট ট্যাক্সে ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকার বিপুল ছাড় ঘোষণা করেছে ও সেই সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে বেসরকারীকরণ ও ছাঁটাই-এর বড়সড় পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই পটভূমিতে, সাধারণ জনগণের আশু ত্রাণের দাবিতে আমরা সহ সিপিআই(এম), সিপিআই, আরএসপি ও ফরওয়ার্ড ব্লক ১০-১৬ অক্টোবর ২০১৯ দেশব্যাপী প্রতিবাদ গড়ে তোলার যৌথ আহ্বান জানিয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটি মিটিং-এর পরপরই কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির যৌথ কনভেনশন থেকে ৮ জানুয়ারী এক দিনের সারা ভারত ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। ধর্মঘটের আহ্বানকে বৃহৎভাবে সফল করার লক্ষ্যে সমগ্র পার্টিকে অতি অবশ্যই জোরদার প্রচার ও প্রস্তুতি গড়ে তুলতে হবে।

কর্মচ্যুতির শিকার হয়েছেন যাঁরা তাদের আশু ত্রাণ, কর্মসংস্থান ও জীবনধারণ উপযোগী ভাতা, কৃষকদের জন্য ত্রাণ এবং সাধারণ জনগণের বর্ধিত ন্যুনতম মজুরি ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রশ্নে শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রাম ও জঙ্গী গণসমাবেশের এক সুবিশাল ঢেউ সৃষ্টির পরিস্থিতি পেকে উঠছে। ইতিমধ্যেই আমরা বেশ কয়েকটি বড় বড় ধর্মঘট সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছি যেমন প্রতিরক্ষা কর্মীদের পাঁচ দিনব্যাপী ধর্মঘট, কয়লা শ্রমিকদের এক দিনের কর্মবিরতি এবং রেল ও অন্যান্য কয়েকটি সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সংগ্রাম। এই সমস্ত সংগ্রামগুলিতে আমাদের ভূমিকা এবং উদ্যোগকে অবশ্যই বাড়িয়ে তুলতে হবে এবং অর্থনৈতিক সংকটের সমস্ত বোঝাটাই সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার মোদি সরকারের অভিসন্ধির বিরুদ্ধে ব্যাপকতর সংহতি ও জনপ্রিয় সমাবেশ ঘটাতে আমাদের চেষ্টা চালাতে হবে। আমাদের এটাও মনে রাখা উচিত যে সঙ্ঘ-বিজেপি বাহিনী তাদের সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানোর কর্মকাণ্ডে এমনকি ভীড় হিংসাতেও (মব লিঞ্চিং) সংকটদীর্ণ জনগণকে সামিল করাতে চেষ্টা জারি রাখবে। সুতরাং শ্রেণী ঐক্য ও জনগণের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমাদের প্রচারকে সুস্পষ্ট ভাবে আমাদের চলমান অর্থনৈতিক সংগ্রামগুলির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তুলতে হবে।

কাশ্মীর সংহতি অভিযান – বিজেপির মতে, অপারেশন কাশ্মীর হল মোদি-২ জমানায় এখনও অবধি শ্রেষ্ঠ সাফল্য। কোনো সন্দেহ নেই, সাধারণ জনগণের বিশাল অংশই কাশ্মীর অবশেষে সম্পূর্ণত ভারতের অচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠছে – এই ভাবনায় ভেসে যান এবং মোদি সরকারের এই স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপের আমরা যে তীব্র বিরোধিতা করি, শুরুর দিকে, তার স্বপক্ষে বেশি মানুষকে আকৃষ্ট করা বেশ কঠিনই ছিল। কিন্ত বর্তমানে যখন কাশ্মীর উপত্যকায় ব্যাপক মাত্রায় গণতান্ত্রিক অধিকারহরণ ও গণ অসন্তোষ বৃদ্ধি পাওয়ার এবং ভারতের সাথে কাশ্মীরের সংযুক্তি বিষয়ক ঐতিহাসিক ও সাংবিধানিক শর্তগুলি ভারত সরকার কর্তৃক একতরফা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলে বিরোধিতা সম্পর্কে বেশি বেশি সংখ্যক মানুষ সজাগ হচ্ছেন তখন কাশ্মীর সংহতিতে আমাদের প্রচারের গ্রহণযোগ্যতাও উল্লেখনীয়ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিকতর সংখ্যায় মানুষ এখন কাশ্মীর সম্পর্কিত মোদির পদক্ষেপকে (বিশেষ করে অমিত শাহ কর্তৃক হিন্দিকে ভারতের সরকারী ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার আহ্বান এবং এক দলীয় শাসনের তুমুল কোলাহলের মাঝে) যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ওপর আঘাত হিসেবে দেখতে সমর্থ হয়েছেন। পাঞ্জাবে আমরা মোদির কাশ্মীর নীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী গণঅসন্তোষ এবং কাশ্মীরী জনগণের প্রতি দৃঢ় সংহতিবোধকে প্রত্যক্ষ করেছি।

আমরা মোদি সরকারের অপারেশন কাশ্মীরের সাহসী, তৎপর ও বিশ্বাসযোগ্য প্রত্যুত্তর হাজির করেছি। কাশ্মীর প্রশ্নে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় অখণ্ডতা সম্পর্কিত সঙ্ঘ-বিজেপি মডেলের দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত যে ‘জনপ্রিয়’ অভিমত তাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে আমাদের অবশ্যই দ্বিধা করলে চলবেনা। বিজেপি ও মোদি-শাহ সরকারের কাছে কাশ্মীর এক মস্ত সাফল্য এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের ডাহা ব্যর্থতা ও অসংখ্য জনমোহিনী প্রতিশ্রুতি পূরণে তাদের অপদার্থতাকে ঢেকে রাখতে এটিকে তারা কোমর বেঁধে প্রচারে নিয়ে যাবে।

এ কারণেই আমাদের সমস্ত সমর্থক ও সাধারণ জনগণকে কাশ্মীর প্রশ্নে সংবেদনশীল করে তোলাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মীরকে কেবলমাত্র ভৌগলিক অঞ্চল, লোভনীয় ভূ-সম্পত্তি (কাশ্মীরী নারী সমেত) হিসেবে দেখার সঙ্গে সঙ্গে কাশ্মীরের জীবন্ত মানুষগুলিকে দমন করার জন্য বিজেপির যে ফ্যাসিবাদী দৃষ্টিভঙ্গী তাকে সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত করতে হবে। জাতীয় অখণ্ডতার নামে, বিজেপি কাশ্মীরকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে এবং কাশ্মীর বিতর্ককে আন্তর্জাতিক বিষয় করে তুলেছে যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বারংবার ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনের কথা বলতে শোনা যাচ্ছে। ৫ আগস্ট থেকে বস্তুত এক পুলিশ রাষ্ট্রের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন যে কাশ্মীরী জনগণ তাঁদের প্রতি সংহতি জানাতে আমরা ৩ অক্টোবর কাশ্মীর সংহতি দিবস উদযাপন করব।

বিজেপির এনআরসি ফন্দিকে প্রতিহত করা – আসাম চুক্তি রূপায়নের এক পন্থা হিসেবে এবং আসামে অনুমিত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের সমস্যা সমাধানের জন্য এনআরসি ধারণাটির উদ্ভব। এ কারণেই এই ধারণাটি আসামে ব্যাপক সামাজিক ও রাজনৈতিক সমর্থন লাভ করে। কিন্ত এখন এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে বিজেপি ভারত জুড়ে তার সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটানোর মহাপ্রকল্পের এক হাতিয়ার হিসেবে এনআরসি-কে অস্ত্র রূপে ব্যবহার করতে চেয়েছে। আসামে এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়া প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের যে গঠনবিন্যাস সেটি বিজেপির ফন্দির সাথে মানানসই নয় আর তাই এ থেকে পরিত্রাণের জন্য সঙ্ঘ-বিজেপি শিবির নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলকে প্রয়োগ এবং দেশজুড়ে ১৯৫১ সালের তালিকার ভিত্তিতে এনআরসি-কে আপডেট করতে চাইছে। স্বভাবতই এর ফলে আসামকে আরও এক বার এনআরসি-র যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়ার মুখোমুখী হতে হবে। এনআরসি-র বর্তমান তালিকা থেকে বাদ পড়ে যাওয়া মানুষদের এবার বিদেশী ট্রাইবুনালের মতো আধা বিচারবিভাগীয় সংস্থার দ্বারস্থ হতে হবে। আর ট্রাইবুনালগুলিতে সরকারপন্থীদের আধিক্য থাকার ফলে বাদ পড়া মানুষদের নিরপেক্ষ ও ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা থাকবে যৎসামান্য। সুতরাং বিদেশী ট্রাইবুনাল প্রক্রিয়ার শেষে অবধারিতভাবেই জনগণের এক বিপুল অংশকে বিদেশী বলে ঘোষণা করা হবে।

এনআরসি ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয় এবং এ সম্পর্কে বাংলাদেশের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই বলে ইতিমধ্যে একাধিকবার মোদি সরকার বাংলাদেশ সরকারকে আশ্বাস দিয়েছে। সুতরাং এ থেকে স্পষ্ট যে ভারতে বসবাসকারী তথাকথিত বাংলাদেশীদের বাংলাদেশে সম্ভাব্য প্রত্যর্পণের বিষয়ে সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। এর দ্বারা সঙ্ঘ-বিজেপি প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত রাজনৈতিক কর্মসূচি ও উদ্দেশ্য পুরোপুরি উন্মোচিত হয়ে যায়। এনআরসি-র লক্ষ্যই হল, দরিদ্র জনগণের এক বিশাল অংশকে বিদেশী হিসেবে চিহ্ণিত করা, মানবাধিকারের মৃত্যুপুরী বন্দি শিবিরে তাদের নিক্ষেপ করার মাধ্যমে তাদের সর্বপ্রকার হয়রানি, অবমাননা ও হিংসার মুখে ঠেলে দেওয়া এবং কোনো অধিকার বিবর্জিত কয়েদখানার শ্রমিকের মতো শ্রমশক্তিকে সস্তায় লুটে নেওয়া। সুতরাং, বিজেপি বা আসু-অগপ ধরনের শক্তিগুলি আসামে যেভাবে (এনআরসির) পুনঃসমীক্ষার দাবি করছে তার বিরোধিতা সমেত আমাদের দেশব্যাপী এনআরসি-র ধারণার দৃঢ় বিরোধিতায় দাঁড়াতে হবে। আসামে আমাদের বাদ পড়ে যাওয়া মানুষের পাশে দৃঢ় ভাবে দাঁড়তে হবে, বিদেশী ট্রাইবুনালের পক্ষপাতদুষ্ট ব্যবস্থাপনাকে উন্মোচিত করতে হবে, সাথে সাথে ন্যায়বিচারকামী বাদ পড়ে যাওয়া মানুষদের সহায়তা প্রদান করতে হবে; সমস্ত বন্দি শিবির বন্ধ করার দাবি জানাতে হবে এবং এনআরসি-র নামে জনগণকে কোনো প্রকারের রাজনৈতিক ও সামাজিক আক্রমণের নিশানা বানানোর বিরোধিতা করতে হবে।

কেন্দ্রীয় কমিটির বিশেষ সার্কুলার অনুশীলন প্রসঙ্গে – কলকাতা কনভেনশন পশ্চিমবঙ্গে পার্টির মনোবলের যথেষ্ট মাত্রায় বৃদ্ধি ঘটিয়েছে এবং বিভিন্ন ফ্রন্টে উৎসাহব্যাঞ্জক উদ্যোগকে উন্মুক্ত করেছে। অন্যান্য রাজ্যগুলিরও বেশ কিছু অঞ্চল থেকে এমনি সদর্থক সাড়া পাওয়া গেছে। কিন্ত অনেক জায়গাতেই সংগঠনগতভাবে কলকাতা কনভেনশনের আহ্বানকে কিম্বা ওয়ার্কশপে আলোচিত ভাবনাগুলি সমেত কেন্দ্রীয় কমিটির বিশেষ সার্কুলারে জোর দেওয়া বিষয়গুলিকে আয়ত্ত করা ও সেই অনুযায়ী সাড়া দেওয়া সম্ভব হয়নি। অন্যান্য কর্তব্যকর্মের মধ্যে বিশেষ সার্কুলার পার্টি কমিটিগুলি ও নেতৃত্বকারী কমিটিগুলির সদস্যদের বিশেষত কেন্দ্রীয় কমিটি ও রাজ্য কমিটি সদস্যদের।

৯ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বর সময় পর্বে বড় মাত্রায় গ্রামসভাগুলি সংগঠিত করার ক্ষেত্রে মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান রেখেছিল। এই বিশেষ কাজটির প্রতি কেন্দ্রীয় কমিটি আর একবার সমগ্র পার্টির দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি নিশ্চিতভাবেই আমাদের রাজনৈতিক প্রচার, সাংগঠনিক সমাবেশ ক্ষমতা বৃদ্ধি, গণসংগঠনগুলির সদস্য ও অনুদান সংগ্রহ ও পার্টি মুখপত্রের প্রচার অভিযানের মতো অন্যান্য কর্মসূচীগুলির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার মূল চাবি কাঠি।

আজকের জটিল সন্ধিক্ষণে যখন আমরা ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলির উত্তরোত্তর হামলার সম্মুখীন (ফ্যাসিবাদী নজরদারি ও হিংসার নিরিখে কিম্বা ফ্যাসিবাদী প্রচারের গোলাবর্ষণের বিচারে) তখন জনগণের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগকে সর্বতোভাবে আরও মজবুত করতে হবে। এর জন্য আমাদের অফিস কেন্দ্রিক ও অথবা বাড়িতে বসে কর্মসম্পাদনের বর্তমান ধরনটির নির্ণায়কভাবে বদল ঘটাতে হবে এবং নিয়মিত যদি গ্রামসভাগুলি সংগঠিত হতে থাকে আমাদের কাজের পদ্ধতির বদল ঘটাতে তা সহায়ক হতে পারে। গ্রামবৈঠকগুলি সাধারণ রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার যথার্থ ক্ষেত্র বা মঞ্চ প্রস্তুত করে দেয় যা ইস্যুভিত্তিক ও কর্মসূচীকেন্দ্রিক আমাদের সাধারণ আন্তক্রিয়া থেকে একেবারেই ভিন্ন চরিত্র সম্পন্ন – যেখানে আমাদের সমর্থক ও তাদের পরিবারের মহিলা ও তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি সমেত সকল সদস্যদের সামিল করা যায়। সাধারণত আমাদের সাংগঠনিক ব্যাবস্থার মাধ্যমে আমরা যে সমস্ত রিপোর্ট সংগ্রহ করি সেগুলি তৃণমূলস্তরের অনেক ঘটনা ও প্রবণতা চিহ্নিত করতে সক্ষম হয় না – অথচ সেগুলিকেই আমাদের আয়ত্ত করা ও নিষ্পন্ন করা প্রয়োজন। উচ্চতর কমিটিগুলির নেতারা গ্রামসভাগুলিতে হাজির থাকলে তাঁরা এই সমস্ত লক্ষণ বা ইঙ্গিতগুলিকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবন করতে পারেন – যার মাধ্যমে সমগ্র পার্টির সামাজিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ, অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ আরও সমৃদ্ধ হতে পারে। ‘জনগণের কাছে চলো’ এই অভিযানের অঙ্গ হিসেবে, শ্রমিক শ্রেণীর মহল্লাগুলিতে অথবা পৌর ওয়ার্ডগুলিতে শহরাঞ্চলের পার্টি কমিটিগুলির সভা সংগঠিত করা উচিত।

গণসংগঠনগুলির সম্মেলন : ৯-১০ নভেম্বর হায়দরাবাদে এআইএসএ-র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এবারই প্রথম হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে এআইএসএ প্রতিদ্বন্দিতা করে। এই প্রথম দক্ষিণের কোনো স্থানে এআইএস-এর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সমগ্র পার্টিকে এআইএসএ-র বিস্তার ঘটাতে সহায়তা করতে হবে এবং সর্ব ভারতীয় সম্মেলনের আগে জেলা ও রাজ্য সম্মেলনগুলি সম্পন্ন করতে হবে। ৯ ফেব্রুয়ারী রাজস্থানের উদয়পুরে এআইপিডব্লিউএ-র সম্মেলনের পরিকল্পনা রয়েছে এবং কলকাতার নিকট উত্তর ২৪ পরগনার শিল্পাঞ্চলের নৈহাটিতে ১-৩ মার্চ ২০২০ এআইসিসিটিউ-র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এই সমস্ত সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ অভিযান চলছে। এই সমস্ত গণসংগঠনের সদস্য সংগ্রহ ও সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য সর্বস্তরের পার্টি কমিটিগুলিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

যুক্ত মোর্চা চরিত্রের প্রচার মঞ্চ সম্পর্কে – পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলায় আদিবাসী মঞ্চের ভালো প্রভাব ও পরিচিতি গড়ে উঠেছে। উড়িষ্যার রায়গড়া-কোরাপুট অঞ্চলেও নিয়মিত অনুশীলন জারি আছে। ঝাড়খন্ড, গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের কিছু কিছু আদিবাসী এলাকায় আমাদের উপস্থিতি রয়েছে। উত্তরপ্রদেশ ও আসামে আমাদের কিছু কাজের এলাকা আছে। এই সমস্ত অঞ্চলগুলিতে আদিবাসী মঞ্চগুলি গড়ে তোলার কথা ভাবা যেতে পারে এবং ধীরে ধীরে সেগুলিকে সর্ব ভারতীয় কোনো সমন্বয় বা সারা ভারত মঞ্চে উন্নীত করা যেতে পারে।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও দলিতদের ন্যায়বিচারের দাবিতে সংগ্রামের প্রচার মঞ্চ হিসেবে ইনসাফ মঞ্চের যথেষ্ট প্রাসঙ্গিকতা ও সম্ভাবনা রয়েছে। বিহার ও ঝাড়খন্ডের কিছু জেলায় কাজ অব্যাহত রয়েছে। আরও কয়েকটি জেলায় (মঞ্চের) কাজ করার পরিস্থিতি বিদ্যমান। সর্বভারতীয় ভিত্তিতে এই কাজকে সমন্বিত করার পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। সমস্ত রাজ্য কমিটিকে যথাযথ যোগাযোগের বিষয়ে কমরেড সেলিম ও কেন্দ্রীয় দপ্তরকে অবহিত করতে হবে।

পূর্ববর্তী আলোচনা অনুসারে, বিগত জাতীয় কাউন্সিল মিটিং-এ এআইপিএফ-কে পুনর্গঠন করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলের পরিবর্তে এখন থেকে কেবল গণসংগঠনগুলি ও ব্যক্তিবর্গ এআইপিএফ-এর অন্তর্ভুক্ত হবে। এআইপিএফ-এর স্বেচ্ছামূলক অথবা কর্মীভিত্তিক সদস্যপদ প্রদান করা যাবে, কোনো গণসদস্য সংগ্রহ করা যাবে না। সর্বভারতীয় ভিত্তিতে ও কিছু কিছু রাজ্যে সময়ান্তরে নেওয়া কর্মসূচীগুলি বজায় রাখার সাথে সাথে আমাদের বেশ কিছু জেলাতেও এআইপিএফ-এর ইউনিট খোলা প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতায়, যুক্তরাষ্ট্রবাদ ও গণতন্ত্রের ওপর ক্রমাগত হামলা প্রতিহত করতে এটি এক প্রচার মঞ্চ হিসেবে কার্যকরী হতে পারে। সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের বর্তমান পরিস্থিতিতে বৈচিত্র্যময় নানা রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত ধারার সমাজকর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের সাথে আন্তক্রিয়া চালানো ও সমন্বয় গড়ে তোলার এক অন্তর্বর্তীকালীন ফ্যাসি-বিরোধী মঞ্চ হিসেবেও এটি ভূমিকা রাখতে পারে। সম্ভাবনাময় জেলাগুলিতে এআইপিএফ-এর সংগঠন গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত কমরেডদের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।

খণ্ড-26
সংখ্যা-32