এবারে কি সংরক্ষণ ব্যবস্থাও বিলোপ করবে ওরা?

আরএসএস ঘোষিতভাবেই একটি সংরক্ষণ বিরোধী সংগঠন। কিন্তু কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলকে ব্যবহার করে তারা এই বিষয়টিতে লুকোচুরি খেলে যাচ্ছে। যখন আরএসএস-এর শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্ব সংরক্ষণের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিচ্ছে তখন বিজেপি অথবা এনডিএ জোটের তুলনামূলক ছোট মাপের নেতারা বলছে যে সরকার সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে সমর্থন করে।

মোহন ভাগবত অনেকবারই সংরক্ষণের বিরোধিতা করেছেন। সর্বশেষ গত ১৯ আগস্ট বিবৃতিতে বলেছেন যে, সংরক্ষণের প্রশ্নে অবশ্যই বিতর্ক হওয়া দরকার। আরএসএস প্রধান বলেছেন, “এসসি/এসটি/ওবিসি-দের দেওয়া সংরক্ষণের প্রসঙ্গে খোলা মনে বিতর্ক হওয়া উচিত।”

মোদী সরকারের মাধ্যমে আরএসএস তাদের সুদূরপ্রসারী কার্যাবলীর বহু প্রেক্ষাপটকেই সফলভাবে প্রয়োগ করেছে।

রাজ্য সরকারগুলোকে গো-রক্ষা আইন বানাতে জবরদস্তি করার মাধ্যমে ওরা শূদ্র কৃষকদের গো-চারণ ও গবাদি পশুপালন নির্ভর অর্থনীতি এবং দলিত/আদিবাসী ও মুসলিমদের খাদ্য অর্থনীতির স্থিতাবস্থা নষ্ট করছে।

তিন তালাককে অপরাধ সাব্যস্ত করার আইন প্রণয়ন ও সংবিধানের ৩৭০ ধারার বিলোপ আরএসএসের দীর্ঘমেয়াদী এজেন্ডারই অংশ। এই দীর্ঘমেয়াদী এজেন্ডার অন্যতম প্রধান ইস্যুগুলির মধ্যে রয়েছে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার বিলোপ ঘটানো। অচিরেই আরএসএস সেই অভিমুখে পদক্ষেপ নেবে।

এই যে মোদী ওবিসি ভোটকে বাগে আনতে কাজ করেছিলেন, তিনিই সংরক্ষণ বিলোপ আইন প্রণয়ন করবেন আরএসএসের কাছে অনুগত থাকতে। সেই দিন বেশি দূরে নেই। কংগ্রেসের সাথে যুক্ত সংরক্ষণ বিরোধী বুদ্ধিজীবিরাও এরকম একটা আইনকে সমর্থন করবে। মণীশ তিওয়ারি, জনার্দন দ্বিবেদীর মতো লোকেরা ইতিমধ্যেই সংরক্ষণ বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী জানিয়েছে। ‘মেধা’-র অজুহাতে অনেক তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবিও সংরক্ষণের বিরোধী।

লঘু করে দেখার কোনো বিষয় নেই

মোহন ভাগবত মোটেই হাল্কাভাবে নেওয়ার মতো ব্যক্তি নন। আরএসএস-বিজেপি নেটওয়ার্কে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। তিনি অনেকটা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৌটিল্যের মতো। মৌর্যছিলেন মুরার পুত্র, যে মুরা ছিলেন একজন ঐতিহাসিক শূদ্র/অনগ্রসর সম্প্রদায়ের (ওবিসি) মহিলা। কৌটিল্যের প্রভাবেই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য জাতিপ্রথাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।

আরএসএস কখনও জাতিপ্রথা বা আমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবৈজ্ঞানিক, অমানবিক চরিত্র নিয়ে বিতর্ক তোলার কথা বলেনি। বেদ, রামায়ণ, মহাভারত যেগুলোতে শূদ্র, দলিত, আদিবাসীদের কোনো অধিকার নেই সেগুলোই চর্চার কথা বলে আরএসএস।

জনসমক্ষে ভাগবত কোনোদিন এমনকি হিন্দু ধর্মে উল্লেখিত সমতার কথাও উচ্চারণ করেননি। তিনি কখনও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে মুখ খোলেননি। কখনও এমনটা বলেননি যে হিন্দু ধর্ম থেকে অস্পৃশ্যতা বিলোপ করা উচিত। হিন্দু ধর্মে পুরুষের সাথে নারীর সমানাধিকার পাওয়া উচিত — এমন বিবৃতিও ভাগবত কখনও দেননি। গ্রাম ও শহরাঞ্চলে সব শ্রেণীর ও জাতের শিশুদের জন্য যে সমমানের বিদ্যালয় শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা উচিত — সে বিষয়েও উনি কোনো বিতর্কের আহ্বান করেননি। আমরা জানি যে, বেসরকারী ক্ষেত্রের শিক্ষা পরিকাঠামোয় ইংরেজি ভাষা আর সরকারী স্কুলগুলোতে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার সুযোগ সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যবধান তৈরি করে। জনগণের ঐতিহাসিক লড়াইগুলোর মাধ্যমে অর্জন করা বেশ কিছু অধিকারের বিরুদ্ধেই ভাগবত খোলাখুলি সওয়াল করে থাকেন। হিন্দু ধর্মের ভিতরে ও বাইরে থাকা ব্রাহ্মণ্যবাদী ঝোঁককে উন্মোচিত করে বা জাতিভেদ প্রথার অবসানের পক্ষ নিয়ে ভাগবত কখনও বিবৃতি দেননি। ক্ষেতমজুররা, যাঁদের একটা বড় অংশই দলিত ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ভুক্ত, তাঁদের মজুরি বৃদ্ধির কথা তিনি কখনও বলেন না। কিন্তু তিনি সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে বারংবার ‘গুরুতর আলোচনা’ চেয়েছেন, অবশ্যই এই ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য নয়, বিলোপসাধনের লক্ষ্যেই।

এক নীরব প্রধানমন্ত্রী

যখন ভাগবত সংরক্ষণ বিষয়ে বড়সড় বিবৃতি দেন তখন প্রধানমন্ত্রী মোদী চুপচাপ থাকেন। মোদীর এই মৌনতা আসলে গুরুর নির্দেশকে গ্রহণ করা ছাড়া আর কিছুই নয়। দলের মধ্যে থাকা এসসি, এসটি, ওবিসি-রা পেশিশক্তির কাজটাই করেন এবং প্রকাশ্যে গুরুর নির্দেশের কোনো বিরোধিতা না করার শর্তেই এঁরা সংগঠনে জায়গা পান। তাদেরকে বলা হয় যে আরএসএস জাতিগঠনের কাজ করছে আর আর জাতির স্বার্থ বিভিন্ন অংশের স্বার্থের উপরে।

দলিত, ওবিসি ও আদিবাসীরা কেবল সম্প্রদায়। ব্রাহ্মণ্যবাদী মেরিটওয়ালারা হল জাতি। সবকিছুর পরেও এটাই হিন্দুশাস্ত্রের বিধান, তাই এটাকে বিরক্ত করা যাবেনা। সঙ্ঘীদের মধ্যকার এসসি, এসটি, ওবিসিদের ক্ষেত্রে, সব জাতপাত, সম্প্রদায় ও মহিলাদের সমানাধিকারের থেকে ‘সংখ্যালঘু শত্রু’ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ওবিসি প্রধানমন্ত্রী আলাদা কিছু নন, কারণ সবশেষে তিনি একজন আরএসএসের কার্যকর্তা। যদি সংরক্ষণ বিলোপের বিল উত্থাপন হয় তাহলে প্রধানমন্ত্রীকে এটা পাশ করানোরই চেষ্টা করতে হবে। বিরোধী দলগুলিরও যথেষ্ট সংখ্যক সদস্য আছে যারা এটার পক্ষে ভোট দেবে।

ভাগবতের এই জগন্নাথকে ঠেকানোর কোনো শক্তি শূদ্র, দলিত, ওবিসি সম্প্রদায়ভিত্তিক আঞ্চলিক দলগুলির নেই। বিগত পাঁচ বছরে তথাকথিত সবচেয়ে শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রীর আমলে, সমস্ত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটি ও আইআইএমগুলো সেইসব ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেওয়া হল যারা সংরক্ষণ প্রসঙ্গে ভাগবতের সাথে সহমত। বিজেপি সংরক্ষণের আওতার বাইরে থাকা জাতিগুলোর সংরক্ষণ বিরোধী অনুভূতির আগুনকে জ্বালিয়েছে। মোদী এমন একটা সাংগঠনিক পশ্চাদপট থেকে এসেছেন যা তাদের শিখিয়েছে যে সংরক্ষণ হল মেধার পরিপন্থী। অনেক কমিউনিস্টও এরকম ধারণায় চলেন। জাতিগত অসাম্য জিইয়ে রাখার ক্ষেত্রে অনেক রাজনৈতিক সীমারেখাই মুছে যাবে। যেদিন সংসদে সংরক্ষণ বিল উঠবে সেদিন ভাগবত তার প্রকৃত বন্ধুদের পেয়ে যাবেন। আম্বেদকর ও তাঁর অনুগামীরা পরাজিত হবেন।

এটা আন্তর্জাতিক ইস্যু হবে না

৩৭০ ধারার বিলোপ একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়েছে, কারণ এটি একটি দ্বিপাক্ষিক বিষয় এবং মুসলিমরা এক বিশ্বজোড়া সম্প্রদায়। কিন্তু সংরক্ষণ বিলুপ্ত করে দিলেও তা আন্তর্জাতিক ফোরামগুলিতে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠবেনা। তাদের অবস্থা সম্পর্কে বিশ্বকে জানানোর ইংরেজি জানা শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীকূল বা যোগাযোগ দলিত, ওবিসি ও আদিবাসীদের এখনও পর্যন্ত তেমন নেই যতটা ভারতীয় মুসলিমদেরও। স্যর সৈয়দ আহমদ ও আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সময় থেকেই মুসলিমদের মধ্যে ইংরেজী শিক্ষিত একটি শ্রেণীর লম্বা ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু দলিত ও আদিবাসীদের তেমন নেই।

আরএসএস নিশ্চিতভাবেই সংরক্ষণ বিলোপ করার প্রেক্ষাপট তৈরি করছে। এর মূল ধারণাটি গোলওয়ালকরের লেখা ‘উই, আওয়ার নেশানহুড ডিফাইন্ড’ বইতে আছে — ধ্রুপদী বর্ণব্যবস্থা ধর্মবিধির পুনরুদ্ধার। মহাত্মা গান্ধীও এই পুনরুদ্ধারের পক্ষেই ছিলেন, ঐ ব্যবস্থা বজায় রাখার পক্ষে সবসময় তর্ক করেছেন।

যদি আরএসএস-বিজেপি সংরক্ষণ বিলোপের জন্য উদ্যোগ নিতে শুরু করে তাহলে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ কিছু লোকও তাদের সমর্থন করবে।

আজ আরএসএস/বিজেপি ৩৭০ ধারা বাতিলের পরে নতুন একগুচ্ছ সমর্থক খুঁজে পেয়েছে। এইভাবেই তারা সংরক্ষণ ব্যবস্থার বিলোপের পক্ষেও নতুন কিছু সমর্থক খুঁজে পাবে। বর্তমানে আমরা দলিত, ওবিসি, আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও পরিযায়ী মানুষের অধিকার বিলোপের একটা সময়ে রয়েছি। গণতন্ত্রের এ এক নয়া পর্ব।

কাঞ্চা ইলাইয়া শেফার্ড, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, সামাজিক কর্মী ও লেখক
ওয়েব পোর্টাল থেকে
(ভাষান্তর সৌরভ রায়)

খণ্ড-26
সংখ্যা-27