এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা ও পরিণাম : এক সুবিশাল মানবিক সংকট যা ভারতকে আটকাতে হবে

ঐতিহাসিক বিতর্ক ও বিভাজনের বিভিন্ন পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী সকল অসমিয়া জনগণই আশা করেছিলেন যে, জাতীয় নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত তালিকার ঘোষণা তাদের দুশ্চিন্তার নিরসন ঘটিয়ে স্বস্তি ও সমাপ্তির বোধ নিয়ে আসবে। তার বদলে, নাগরিক পঞ্জির ঘোষণা রাজ্যে বিভাজনের রাজনীতিকে নবজীবন প্রদান করেছে, এবং অসমের  কোন অংশের মানুষকেই  দুশ্চিন্তামুক্ত করেনি।

১৯,০৬,৬৫৭ জন মানুষ এনআরসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় নি। ফলে এই ১৯ লক্ষাধিক মানুষ স্বেচ্ছাচারী ও পক্ষপাতযুক্ত একটি  নির্মম আমলাতান্ত্রিক ও আইনী প্রক্রিয়ার অধিনস্থ হল। তদুপরি, সেই প্রক্রিয়ার অন্তে যদি তারা নাগরিক হিসেবে মান্যতা পেতে অক্ষম হয় তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। রাষ্ট্রহীনতার ভীতি তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়।

যে ৩,১১,২১,২০৪ জন মানুষের নাম চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাদেরও শান্তি নেই। উচ্চতম আদালতে এনআরসি মামলার মূল আবেদনকারী, অসম পাবলিক ওয়ার্কস (এপিডব্লিউ) ঘোষণা করেছে যে, তালিকায় “অবৈধ অনুপ্রবেশকারী”দের নাম থেকে গিয়েছে এই অভিযোগে তারা এনআরসি তালিকাকে সম্পূর্ণভাবে খতিয়ে দেখার আবেদন নিয়ে উচ্চতম আদালতে যাবে। অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু)ও জানিয়েছে যে তারা আরো অনেক কম মানুষের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাশা করেছিল তাই উচ্চতম আদালতে ৩০% তালিকা খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়ে আবেদন করবে। বর্তমান অসম সরকারের অন্যতম সহযোগী অসম গণ পরিষদ (অগপ)ও বলেছে যে, উচ্চতম আদালতের এই তালিকা পর্যালোচনা করা উচিত কারণ বিপুল “অবৈধ অনুপ্রবেশের’ যে বর্ণনা তারা ছড়িয়েছিল তার সঙ্গে এত কম সংখ্যক এনআরসি বহির্ভুতের সংখ্যা সাযুজ্যপূর্ণ নয়।

ইত্যবসরে বিজেপি নেতা ও অসমের অর্থমন্ত্রী হিমম্ত বিশ্ব শর্মা উচ্চতম আদালতে পুনরায় খতিয়ে দেখার দাবিতে রাজ্য সরকারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য আসু ও এপিডব্লিউ-র প্রতি আবেদন করেছে। শর্মা এও বলেছে যে, তাদের দল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের (সিএবি) পরবর্তীতে হওয়া জাতীয় এনআরসি-তে অসমকে অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন করবে। সিএবি মুসলমানদের বিরুদ্ধে এনআরসি-কে ঘসা-মাজা করার এক বিজেপি পদ্ধতি।

পুনরায় খতিয়ে দেখা-চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্তদের আবার এক যাতনাকে অবশ্যই প্রত্যাখ্যান ও প্রতিরোধ করতে হবে। কিন্তু পুনরায় খতিয়ে দেখাকে বাদ দিলেও চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্তরা এখনো বিপন্ন ও অসহায় অবস্থায় রয়েছে। শর্মা যেমন বলেছেন, চূড়ান্ত এনআরসি তালিকায় নাম থাকলেও “সন্দেহজনক বিদেশী’দের ফরেইনার্স’ ট্রাইব্যুনালে (এফটি) পাঠানোর ক্ষমতা রাজ্য সীমান্ত পুলিশের আছে।

পুরো এনআরসি প্রক্রিয়াটিই গরিব-বিরোধী, জন-বিরোধী পক্ষপাতিত্বে ভরপুর। অসমের অধিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত না করে তা ব্যাহত করে এনআরসি প্রক্রিয়াকে গতিদানকারী উচ্চতম আদালত ক্রমাগত গোলপোস্ট পাল্টাতে ও নতুন নতুন বাধা সৃষ্টি করতে থাকে। ফলাফল অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। লক্ষ লক্ষ হতদরিদ্র ও সর্বাধিক অসহায় মানুষজন দেখতে পায় যে, তাদের বাদ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ওই বাধা অতিক্রমের দৌড়ে তাঁরা পরাস্ত হয়েছে। বংশজরা অন্তর্ভুক্ত হলেও বিপুল সংখ্যক মহিলা ও শিশু তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।

যারা বাদ পড়েছে বা যারা অন্তর্ভুক্ত হলেও যাদের নাগরিকত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন তাদের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে? সরকার অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যে আবেদন সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাদ পড়াদের নাগরিক অধিকার সঙ্কুচিত হবে না। কিন্তু আক্রান্ত জনেদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল (এফটি)-এর আবেদন প্রক্রিয়া নিয়ে ভীত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথমত, বিপুল সংখ্যক আবেদনকারীদের জন্য বর্তমান এফটি-র সংখ্যা খুবই নগণ্য, যেখানে আবেদনকারীদের ১২০ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হবে। ওই আবেদন জমা করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব বাদ পড়া ব্যক্তিদের, রাষ্ট্রের কোনো দায়িত্বই নেই।

অধিকন্তু, এফটি-গুলির দায়িত্ব বিচার বিভাগীয় প্রশিক্ষণহীন আইনজীবীদের উপরে রয়েছে, যেগুলি পক্ষপাতিত্ব ও ঔদাসীন্যের জন্য কুখ্যাত। এটি প্রতিভাত হয়েছে যে, এফটি সমূহ আদতে কে কত বেশি “উইকেট নিতে পারে” (অর্থাৎ কে কত বেশি ব্যক্তিকে বাদ দিতে পারছে) এই প্রতিযোগিতায় নেমেছে। প্রায় ২০ লক্ষ ব্যক্তির (এবং সম্ভবত আরো বেশি যদি সীমান্ত পুলিশ এনআরসি তালিকায় থাকা মানুষদের এফটি-তে পাঠায়) ভাগ্য ওইরকম আধা বিচার বিভাগীয় এফটি সমূহের হাতে তুলে দেওয়া যায় না, যেগুলি খাপ পঞ্চায়েতের থেকে খুব একটা ভালো নয়। অন্ততপক্ষে ওই সমস্ত মানুষজনের জন্য একটি দৃঢ় বিচার বিভাগীয় বন্দোবস্ত থাকা প্রয়োজন, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তির আইনী ও উপকরণের সাহায্য পাওয়া নিশ্চিত করা  এবং সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটির সময়ে মানসিক সাহায্য ও নৈতিক সমর্থন দেওয়ার জন্য রাষ্ট্র দায়বদ্ধ থাকবে।

এতাবৎকাল পর্যন্ত এফটি কর্তৃক গণ্য ‘সন্দেহজনক ভোটার’ বা ‘বিদেশীরা’ অনির্দিষ্টকালের জন্য “ডিটেনশন ক্যাম্পগুলিতে” দিন কাটাচ্ছে, যে ক্যাম্পগুলির অবস্থা অমানবিক এবং কোনো অর্থেই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের থেকে ভালো নয়। জানা যাচ্ছে যে, চূড়ান্ত এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়া এবং এফটি সমূহের দ্বারা বিদেশী হিসেবে গণ্যদের রাখার জন্য সরকার বিশাল বিশাল নতুন ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করছে। ডিটেনশন ক্যাম্পগুলি এক নিষ্ঠুরতা এবং অসাংবিধানিক- যেগুলি রয়েছে সেগুলিকে বন্ধ করে দিতে হবে ও নতুন তৈরি করার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারী করতে হবে।

১৯৭৯ সালে সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় কমিটি অসমের ছাত্র ও যুবদের প্রতি এক আহ্বানে অসমের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টিকারী কর্মহীনতা ও অসমান উন্নয়নের বিষয়ে অসম আন্দোলনকে ধাবিত করার জন্য তরুণ জনগণের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছিল। পরামর্শ দিয়েছিল যে, অসমের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক অনন্যতা ও স্বাধিকার বজায় রাখার উপায়, এবং এক শ্রেণীর বাঙালী বুদ্ধিজীবীর সাংস্কৃতিক আধিপত্যের ঔপনিবেশিক পরম্পরার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, দরিদ্র অভিবাসী ও  দেশান্তরীদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হতে পারে না। কমিটি সচেতন করেছিল যে, ওই রূপ বিভাজনের মধ্য দিয়ে কেবল সাম্রাজ্যবাদী ও দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীলরাই লাভবান হবে, অসমীয়া জনগণ নয়। আজ, সেই আবেদনের মর্মবস্তু আরো বেশি প্রাসঙ্গিক, যখন এনআরসি-উত্তর ভীতি ও সন্দেহের পরিমন্ডলে  শাসক বিজেপি তার ফ্যাসিবাদী প্রকল্পের রাজনৈতিক লভ্যাংশ আদায়ে তৎপর হয়ে উঠেছে।

দেশের বাদবাকি অঞ্চলের জন্য অসমের অভিজ্ঞতা এক সাবধানবাণী হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। একদিকে বিজেপি স্বীকার করছে যে, অসমের সুদীর্ঘ এনআরসি প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ ছিল, অন্যদিকে তারা সেই এনআরসি-কে দেশের বাকি অংশে ব্যাপ্ত করতে চাইছে। যেখানে অসমে ওই অনুশীলন এক বিশাল মানবিক সঙ্কটের সৃষ্টি করেছে, ওই প্রক্রিয়াকে একটি রাজ্যেও প্রয়োগ করার কোনো ভিত্তিই নেই।

বিজেপির এনআরসি চক্রান্তকে চিহ্নিত ও প্রত্যাখ্যান করার জন্য জনগণকে সচেতন করতে এবং অসমে এনআরসি-এফটি প্রক্রিয়ায় অসহায় ব্যক্তিতে পর্যবসিত হওয়া প্রত্যেক মানুষের পাশে নিঃশর্ত সংহতিতে দাঁড়ানোর জন্য সারা দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষ ও আন্দোলনকে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।

(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)

খণ্ড-26
সংখ্যা-28