হুগলী জেলায় ‘গ্রামে চলো’ জনসংযোগ অভিযান : এক মাইল ফলক ছোঁয়ার অপেক্ষা

গত প্রায় ন’দশ মাস হুগলী জেলার গ্রামাঞ্চলে আমাদের কাজের এলাকাগুলিতে আদিবাসী জনগণের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলার কাজটিতে ভালো সাফল্য আসছে। প্রায় হাতে গোনা যে কটি গ্রামে রাজনৈতিক অস্তিত্ব কোনোমতে বেঁচেছিল তার বাইরে বেশ কিছু নতুন এলাকায় আদিবাসী জনগণের মধ্যে উৎসাহব্যাঞ্জক সাড়া পেয়ে নিশ্চিতভাবেই গ্রামাঞ্চলের সংগঠক ও কর্মীদের মধ্যে সক্রিয়তা অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩০ জুলাই গণকনভেনশনের বিপুল সাফল্য ও ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির ‘গ্রামে চলো’ আহ্বান দীর্ঘদিনের জড়তাকে কাটিয়ে অপেক্ষাকৃত পরিকল্পিত ও নতুন উদ্যোগের সূচনা ঘটিয়েছে।

এক সাথে অনেক কাজের পরিবর্তে কৃষি ও গ্রামীণ শ্রমিকদের সমস্যাগুলিকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন ব্লকে গ্রামসভাগুলি সংগঠিত করা শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন কার্যত বন্ধ হয়ে থাকা ‘১০০ দিনের কাজের প্রকল্প’ ফের চালু করা, ভূমিহীনদের বাস্তু জমি সহ গৃহ নির্মাণের ব্যবস্থা, সকলের জন্য খাদ্য সুরক্ষা, ১০০ ইউনিট পর্যন্ত বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ, অর্ধেক দামে রান্নার গ্যাস সরবরাহ ইত্যাদি বিষয়গুলি গ্রামসভায় চর্চা হয়। কিন্ত এই গ্রামসভাগুলি, অনেকক্ষেত্রেই, গ্রামের গরিবদের বড় অংশকে সামিল করতে বা তাদের মধ্যে সাড়া জাগাতে পারছে — একথা বলা যাবেনা।

গ্রামসভাগুলি কেন এখনও যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারছেনা?

গ্রামসভাগুলি প্রধানত অনুষ্ঠিত হচ্ছে আদিবাসী অধ্যুষিত পল্লীগুলিতে। নিশ্চিতভাবেই আদিবাসী জনগণ, বিশেষত মহিলারা সভাগুলিতে ভাল সংখ্যায় জমায়েত হচ্ছেন। মহিলাদের বড় মাত্রায় অংশ গ্রহণের কারণ একাধিক। আদিবাসী মহিলারা কঠোর পরিশ্রমী, চিরাচরিতভাবেই তাঁদের সমাজে নারীদের স্থান পুরুষদের থেকে নীচে নয় এবং তাঁরা যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করেন। দ্বিতীয়ত, কৃষিতে নানাবিধ যন্ত্রের প্রচলন বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষিকাজে এখন মজুর লাগে কম এবং এই মজুরদের আধিকাংশই মহিলা। ফলে আদিবাসী মহিলারা গ্রামে থাকেন আর পুরুষদের বেশিরভাগই অন্যান্য মেহনতের কাজে অন্যত্র চলে যান। আদিবাসী কৃষকদের ছোট একটা অংশ এখনও নেশার শিকার এবং মূলত পরিবারের মহিলাদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল।

স্বাভাবিকভাবেই, যে সব জায়গায় আদিবাসী মহিলারা ভালোমাত্রায় অংশ নিচ্ছেন সে সব জায়গায় গ্রামসভাগুলি বেশ সফল বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্ত যেখানে আদিবাসীদের মধ্যে এখনও তেমন পৌঁছানো যায়নি সেখানে গ্রামীণ গরিবদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত কম এবং গ্রামসভাগুলি প্রায়শ ফ্যাকাসে। আবার আদিবাসী মহিলাদের প্রাণবন্ত জমায়েতের গ্রামসভাগুলিতে তাঁদের পরিচিতি ও মর্যাদার সঙ্গে যুক্ত-এমন কিছু বিষয়েই আলোচনা আবদ্ধ থাকছে, কৃষি শ্রমিকদের সার্বিক সমস্যাগুলি চর্চিত হচ্ছে না।

অবশ্যই আদিবাসী মঞ্চের উদ্যোগে যে কাজগুলি চলছে সেগুলিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। একটা প্রতিকূল সময়ে এই মঞ্চের পতাকাতলে জেলার বেশ কয়েকটি ব্লকে (কমপক্ষে ৪টি ব্লক) আদিবাসীদের যে স্বতস্ফূর্ত জমায়েত ঘটছে গ্রামসভাগুলিতে তার প্রতিফলন ঘটা স্বাভাবিক। আদিবাসীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত বড় সংগঠনগুলির প্রতি বিভিন্ন কারণে সাধারণ আদিবাসী জনতার মধ্যে যে অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে সেখান থেকে সিপিআই(এমএল), কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি ও কিষাণ সভার নতুন উদ্যোগে তাঁরা নবতর আশা খুঁজে পাচ্ছেন। বামফ্রন্ট জমানার শেষদিকে ভূমি সংস্কারের কাজকে মধ্য পর্বেই গুটিয়ে ফেলার ফলে আদিবাসী জনগণের মধ্যে বামপন্থীদের প্রতি আকর্ষণ যেভাবে হ্রাস পেয়েছিল তারই সুযোগে মমতা ব্যানার্জীর সরকার লোকশিল্পী ভাতা প্রদানের মাধ্যমে টিএমসির প্রভাব বাড়িয়ে তোলে।কিন্ত পরবর্তীতে নতন করে আরও মানুষকে (বা শিল্পী গ্রুপকে) শিল্পীভাতা না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ আদিবাসী জনগণ আমাদের মঞ্চের ডাকে সাড়া দিতে থাকেন। এখন তাঁদের পাখীর চোখ এই লোকশিল্পী ভাতা। এ নিয়ে একাধিক জেলা প্রোগ্রাম, ব্লক প্রোগ্রাম হয়েছে, নবান্ন অভিযানও হবে। কিন্ত এই একটিমাত্র ইস্যুতে যে উৎসবের মেজাজ চিরস্থায়ী হতে পারে না। সরকার প্রতারণা করতে পারে এবং লড়াই ছাড়া দাবি আদায় হয় না — এই কথাগুলি বার বার তুলে ধরা দরকার। কিন্ত দরখাস্ত জমা পড়ার হিড়িকে এই কথাগুলি পিছনে চলে যাচ্ছে।

সেদিক থেকে গ্রামসভাগুলিতে লোকশিল্পী ভাতার সঙ্গে সঙ্গে আধিকার আদায়ের বাকি বিষয়গুলিকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে ভালই দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে।

অস্মিতা বা আত্মপরিচিতির প্রশ্নের সঙ্গে বৃহত্তর শ্রেণীদাবিগুলিকে মেলানোর প্রচেষ্টা চলছে ...

hg adivasi

 

আদিবাসী (মূলত সাঁওতাল জনজাতি) সংস্কৃতির স্বীকৃতি লাভ — শিল্পীর মর্যাদাই হোক কিম্বা অলচিকিতে পড়াশোনার অধিকার নিয়ে ‘আদিবাসী আধিকার ও বিকাশ মঞ্চের’ প্রোগ্রামে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা বেশ কিছু তরুণ বক্তা চোখে পড়ছে। নিজের নিজের এলাকার বাইরে বিভিন্ন গ্রামসভায় এদের বক্তা হিসেবে তুলে ধরলে সামগ্রিক আন্দোলন আরো সমৃদ্ধ হতে পারে। গ্রামসভাগুলির মুখ্য উদ্যোক্তা থাকছে কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি (আয়ারলা), প্রধানত চর্চার বিষয় থাকছে ‘১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে’ কাজের দাবিতে ‘৪-ক’ ফর্ম ভরাট করা। এক এক স্থানে গ্রামসভাগুলিকে সফল করার জন্য বাড়ি বাড়ি জনসংযোগ,চিঠি বিলি,পোস্টারিং ইত্যাদির মধ্যদিয়ে গ্রামে একটা সাড়া ফেলার চেষ্টা চলছে।একটিক্ষেত্রে পার্টির সংশ্লিষ্ট ব্লক সম্পাদক সহ স্বয়ং পার্টির জেলা সম্পাদক সভার আগের দিন দুপুর থেকে স্থানীয় কর্মীদের নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরেছেন। সভার দিন পার্শবর্তী এলাকা থেকে আদিবাসী মহিলাকে এনে মুখ্য বক্তার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আদিবাসীদের সুনির্দিষ্ট দাবির পাশাপাশি তিনি ১০০ দিনের কাজের অচলাবস্থা, মজুরিবৃদ্ধির বিষয়েও বক্তব্য রেখেছেন। এই প্রক্রিয়ায় গণআন্দোলনের কর্মী হিসেবে হয়ে ওঠার প্রাথমিক ধাপগুলি পার হওয়া যায়।

অনেক গ্রামসভায় দেখা গেছে, নেতারাই ভাষণ দিয়ে চলেছেন। গ্রামবাসীদের বক্তব্য শোনা হয়েছে নামমাত্র। এই দুর্বলতাগুলিকে চিহ্নিত করে জনগণের মুখ থেকে শোনার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ফলও মিলছে। উঠে আসছে পানীয় জলের সমস্যার কথা, নিকাশি নালা সংস্কার, প্রতিবন্ধী ভাতা না পাওয়া, চালু বার্ধক্যভাতা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যার কথা।

গ্রামসভা হচ্ছে, কিন্ত কোনো গ্রাম কমিটি তৈরি হচ্ছে না — এই ত্রুটি দূর করে পুনরায় গ্রামসভা আহ্বানেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে একাধিক ক্ষেত্রে। একটি গ্রামে পর পর দুবার ব্যর্থহওয়ার পর তৃতীয় দফায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রায় ৬০ জনকে দিয়ে ‘৪-ক’ ফর্মফিল আপ করা গেছে। কিন্ত তা আর পঞ্চায়েতে জমা পড়েনি। সিদ্ধান্ত হয়েছে, পঞ্চায়েত ডেপুটেশনের দিন স্থির করে সকাল থেকে মূল সংগঠক ছুটি নিয়ে ডেপুটেশনকে সফল করে তুলবেন। বেশি জমায়েত না হোক, কর্মসূচি থেকে পিছিয়ে আসা চলবে না।

আনুষ্ঠানিকতার বদলে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সাফল্য আসে বেশি প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে মাঝে মাঝে ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে (যেমন আগস্টের ১৬, ২০ ও ২৬ তারিখ যথাক্রমে পান্ডুয়া, বলাগড় ও ধনেখালিতে)। কিন্ত প্রায়শ তার পর আর সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয়নি। বিপরীতটাই করা উচিত। কোনো না কোনো নির্দিষ্ট ইস্যু নিয়ে একটি ব্লকে এবার পর পর তিন বার যাওয়া হয়।

কিছু সমস্যার যেমন সমাধান হয় তেমনই প্রশাসনও যথাসম্ভব নমনীয় হতে শুরু করে। এই প্রসঙ্গে কৃষক সংগঠনের (এআইকেএম) নেতার ভূমিকা খুব উল্লেখযোগ্য। ‘আদিবাসী মঞ্চের’ উদ্যোগে তিনি যেমন পুরোমাত্রায় সামিল হন তেমনি ব্লক জুড়ে একের পর এক আদিবাসী পল্লীতে তিনি কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। আদিবাসী জনগণও ক্রমেই উৎসাহিত হতে থাকেন। একটা অঘোষিত প্রতিনিধিত্বমূলক ডেপুটেশনে সহজেই ১৫০ জন সামিল হয়ে যান। বিডিও নড়েচড়ে বসেন। ছুটির দিনেও প্রশাসনের আধিকারিক সমস্যা সমাধানে (পানীয় জল ও জল নিকাশির সমস্যা) এলাকায় সরেজমিন তদন্তে আসেন। এই অনুশীলনের মধ্যদিয়ে যে গ্রামসভা অনুষ্ঠিত হয় তাতে গ্রামের সব অংশের দরিদ্র মানুষ সোৎসাহে অংশ নেন। এই শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা সমগ্র জেলায় ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। নতুন কর্মীরা উঠে আসছেন। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এদের রাজনৈতিকভাবে গড়ে তোলাই ‘গ্রামে চলো’ বা জনসংযোগ অভিযানের আসল সার নির্যাস।

খণ্ড-26
সংখ্যা-30