আজকের দেশব্রতী : ১৭ মার্চ ২০২২ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati_17_03_22

 Deucha Solidarity Day

বিপর্যয়কর কয়লাখনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত গ্রামবাসীদের সমর্থনে রাজ‍্যজুড়ে গ্রামে, শহরে, ব্লকে, জেলায় সংহতি ও প্রতিরোধ প্রদর্শন বিভিন্ন গণসংগঠন, নাগরিক সংগঠন, পরিবেশ আন্দোলন, কালেক্টিভ, মঞ্চ, ব‍্যক্তিবর্গ ও উদ্বিগ্ন পাখিকুলের যৌথ উদ‍্যোগে।

বীরভূম জেলার দেউচা-পাঁচামীতে খোলামুখ কয়লাখনি করার সরকারী সিদ্ধান্ত এলাকার গ্রামবাসীদের প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। ইতিমধ‍্যে দুইদফায় পুলিশের মামলা ও হামলা নেমেছে। গ্রামবাসীদের প্রতিরোধ আরও তীব্র হয়েছে। আসুন তাঁদের পাশে সংহতিতে দাঁড়াই।

আমরা এই কয়লাখনি প্রকল্পকে সর্বঅর্থে বিপর্যয়কর বলে মনে করি। ১২ বর্গ কিলোমিটারের বেশি ক্ষেত্র জুড়ে এক কিলোমিটার (খনির চূড়ান্ত গভীরতা দাঁড়াবে ১,২০০ মিটার) গভীরতার খোলা খাদান হবে! কয়লার ওপরে আছে ২৪৫ মিটার পুরু অত‍্যন্ত শক্ত ব‍্যাসল্ট পাথরের আস্তরণ। অবিশ্বাস‍্য এক প্রকল্প! এই খোলা খাদান চরম ক্ষতিগ্রস্ত করবে প্রকল্প এলাকা সহ চারপাশের বিস্তীর্ণ এলাকার মাটি, মানুষ, সমাজ, নদী, কৃষি, জলস্তর ও পরিবেশকে। এখানে কয়লা খুবই নিম্ন মানের, এরদ্বারা বায়ু দূষণের মাত্রাও বেশি। আর, এই ধরণের খনিতে অত‍্যন্ত কম কর্মসংস্থান হয়। বস্তুত অন‍্যান‍্য খোলামুখ খনি অঞ্চলের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে, প্রস্তাবিত দেউচা-পাঁচামী এলাকায় কৃষিকাজ ও পাথর শিল্পে বর্তমানে যত মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয় তার দশভাগের একভাগও হবে না কয়লাখনিতে। অন‍্যদিকে, এত বিপুল পরিমাণ কয়লা পোড়ালে তীব্র কার্বন নিঃসরণের ফলে ত্বরান্বিত হবে বিশ্ব উষ্ণায়ন, বাড়বে বঙ্গোপসাগরের জলস্তর, তীব্রতর হবে জলবায়ু সংকট, বিপন্ন হবে সুন্দরবন ও কলকাতা সহ সমস্ত উপকূলবর্তী গ্রাম ও নগর।

গ্রামবাসীরা একত্রিত হয়ে ‘বীরভূম জমি জীবন জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভা’ গঠন করে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজ‍্যস্তরে বিভিন্ন সংগ্রামী সংগঠন ও ব‍্যক্তি ঐক‍্যবদ্ধ হয়ে ‘দেউচা-পাঁচামী কয়লাখনি প্রকল্প বিরোধী উদ‍্যোগ’ চালাচ্ছে। গ্রামবাসীদের প্রতিরোধের সংহতিতে এবং এই বিপর্যয়কর প্রকল্প বাতিলের দাবিতে আগামি ২৫ মার্চ রাজ‍্য জুড়ে ‘দেউচা সংহতি দিবস’ সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এই উদ‍্যোগের পক্ষ থেকে।

২৫ মার্চ বিশ্বব‍্যাপী ‘ক্লাইমেট একশান ডে’ সংগঠিত করেন বহু দেশের বহু উদ্বিগ্ন মানুষ। দেউচা-পাঁচামীর এই কয়লাখনির প্রশ্নটি জলবায়ু সংকটের সাথে প্রত‍্যক্ষ সম্পর্কিত। গ্রামবাসীদের প্রতিরোধের পাশে দাঁড়াতে, আমাদের আগামি প্রজন্মগুলোর ভবিষ‍্যতের পাশে দাঁড়াতে আসুন বাংলা জুড়ে ২৫ মার্চ ‘দেউচা সংহতি দিবস’ সংগঠিত করি আমরা। যত বেশি সম্ভব গণসংগঠন, সামাজিক সংগঠন বা ব‍্যক্তিবর্গকে সামিল করে এইদিন বিভিন্নভাবে সংহতি ও প্রতিরোধ প্রদর্শন করে সমাজে ও সরকারের কাছে বার্তা দিই আমরা।

 Assembly Election Results

উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, গোয়া এবং মণিপুর — এই চারটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতায় ফিরেছে। পাঞ্জাবে, কংগ্রেসের মূল‍্যে তো বটেই, আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে অকালি দলের মূল্যে, পরিবর্তনের জনপ্রিয় মেজাজের একমাত্র সুবিধা পেয়েছে এবং জিতেছে আম আদমি পার্টি। এটি পরিবর্তনের জনপ্রিয় প্রত্যাশার গভীরতাকে প্রতিফলিত করে, যা পাঞ্জাবের কৃষক আন্দোলনের দ্বারা নতুনভাবে উদ্দীপিত হয়ে উঠেছিল।

উত্তরাখণ্ডে, নির্বাচনের কয়েক মাস আগে বিজেপি তার মুখ্যমন্ত্রী বদল করে এবং তিনিও নির্বাচনে হেরে যান। কিন্তু উপদলে বিভক্ত কংগ্রেস কোনও জোরালো নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা খাড়া করতে ব‍্যর্থ হয় আর বিজেপি কয়েকটি আসন হারিয়েও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখে। গোয়াতে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে অল্প দূরত্বে ২০টি আসন নিয়ে একক বৃহত্তম দল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে এবং মহারাষ্ট্রবাদী গোমন্তক পার্টি এবং তিনজন নির্দল বিধায়কের সমর্থনে সরকার গঠন করবে।

উত্তরপ্রদেশে, বিজেপি নেতারা এবং প্রার্থীরা প্রকাশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার, উস্কানিমূলক বক্তৃতা এবং এমনকি ভোটারদের হুমকি প্রদান করে আদর্শ আচরণবিধিকে উপহাস করেছে। আর নির্বাচন কমিশন নীরব দর্শক হয়ে থেকেছে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও, সমাজবাদী পার্টি-রাষ্ট্রীয় লোকদল জোটের ভোট ও আসন বৃদ্ধি রাজ্যে জনতার ক্রমবর্ধমান অসন্তোষকে দেখিয়ে দেয় যদিও ভোটে তা সম্পূর্ণরূপে প্রতিফলিত হয়নি। বিরোধী ভোটের বিভাজন এবং রাজ্যজুড়ে বিএসপি’র ভোটের বিশাল অংশ তাদের পক্ষে যাওয়ায় বিজেপি স্পষ্টতই উপকৃত হয়েছে।

যদিও বিজেপি কৃষি আইন বাতিল করে কৃষক আন্দোলনের প্রভাবকে সীমিত করতে পেরেছিল, তথাপি মুজাফ্ফরনগর দাঙ্গার অনেক অপরাধীর পরাজয় স্বস্তিদায়ক।

আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে গত পাঁচ বছরে, বিশেষ করে মহামারীর সময়কালে ইউপি’তে একটি গতিশীল এবং সংগ্রামী বিরোধী দলের অভাব ছিল। সিএএ-বিরোধী আন্দোলন, কৃষকদের আন্দোলন এবং কর্মসংস্থান ও ন্যায়বিচারের জন্য যুব, কর্মচারী ও প্রকল্প কর্মীদের সংগ্রাম প্রকৃত বিরোধীর ভূমিকা পালন করেছিল। এটা প্রত্যাশিত যে এই নির্বাচনের ফলাফল ইউপি বিধানসভার অভ‍্যন্তরে আরও সক্রিয় এবং গতিশীল বিরোধী দল এবং রাস্তায় জনগণের দাবিতে আরও জোরালো আন্দোলনের পথ খুলে দেবে।

বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে উৎসাহিত হয়ে মোদী সরকার এবং সঙ্ঘ-বিজেপি বাহিনী তাদের ফ্যাসিবাদী আক্রমণকে আরও জোরদার করবে। গণতন্ত্রের শক্তিকে বৃহত্তর ঐক্য ও দৃঢ়তর সংকল্পের সাথে এই আক্রমণকে মোকাবিলা করতে হবে।

- কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন

Insult to Bengal

বাবুল সুপ্রিয় এবার তৃণমূল প্রার্থী বালিগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচনে।

পশ্চিমবাংলায় ‘আয়ারাম-গয়ারাম’ রাজনীতির বাজারে এখন দাঁও মারছে তৃণমূল। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে ফায়দা লুটছিল বিজেপি। তখন তৃণমূলের একঝাঁক মাফিয়া-দুর্নীতিবাজ সাংসদ-বিধায়ক ভিড়েছিল বিজেপিতে।  ক্ষমতার আভ্যন্তরীণ খেয়োখেয়ির কারণে আর বিজেপির হাতছানিতে। তথাপি বিজেপির কাছে অধরা থেকে গেল বাংলার ক্ষমতা দখল। তারপর থেকে ঘটছে বিপরীতমুখী দলবদলুর ঘটনা — বিজেপি থেকে তৃণমূলে যাওয়ার। প্রথম প্রথম ফেরানো শুরু হয় বিজেপির টিকিটে হেরো প্রাক্তন তৃণমূলীদের। তারপরে আর অচ্ছ্যুৎ থাকছে না বিজেপির কেউকেটারা। প্রসঙ্গত আপাতত সবচেয়ে দর ওঠা ‘ঘোড়া’ বাবুল সুপ্রিয়। একটু ফিরে দেখা যাক। ‘বাম-ডান’ নানারঙের একের পর এক দল ধরা-ছাড়া বাংলার এক বলিউডি অভিনেতা ২০২১-এর নির্বাচনের আগে ‘ছোবল’ মারতে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে নাম লিখিয়েছিলেন। সেটা যেমন বাংলার শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ মেনে নেয়নি, তেমনি দরকষাকষির সংঘাতে বিজেপি ছাড়া বলিউডি গায়ককে তৃণমূলে নেওয়ার বাজি বাংলার বিবেক কখনও মন থেকে মেনে নিতে পারে না। তৃণমূল নিজেকে ‘নির্ভেজাল ধর্মনিরপেক্ষ’ দাবি করলেও ধরা পড়ে যাচ্ছে তার জালিয়াতি জুয়াচুরি। এই সেদিন পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী বিজেপির কট্টর প্রতিভু হয়ে থাকা গায়ক তৃণমূলে জায়গা পেয়ে গেলেও তার চরিত্র পাল্টে যায় না। বরং এই ঘটনায় উন্মোচিত হচ্ছে তৃণমূলের চোরা আপসকামী অবস্থান। বাবুলকে মনোনীত করা আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের উদার ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক সমাজ, বিশেষত সেখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনতা কিছুতেই মেনে নেবে না। তাদের কার্যত অপমান করা হল। কারণ, ২০১৮-র মার্চে আসানসোলে সংঘটিত দাঙ্গার রাজনীতির দগদগে স্মৃতি মোছার নয়। যে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আগ্রাসনে বর্ণনাতীত ধ্বংসকান্ডের তান্ডব চলেছিল, এক ইমামের তরুণ তাজা ছেলের জীবন কেড়ে নিলেও ঐ গভীর শোকাহত ইমাম সাম্প্রদায়িক সংঘাতের অবসানের আবেদনে অটল ছিলেন, দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। আগুন জ্বালানোয় বিজেপির হাত ছিল, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল, ভোটের মেরুকরণের জিগির তুলতে — ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্রে বিজেপির উপর্যুপরি দখল রাখতে। ঐ অভিযানে সাংসদ বাবুলই ছিলেন বিজেপির মূল পান্ডা, যার ভূমিকা ছিল হিন্দুত্ববাদী মাফিয়ার মতোই। ফিরে দেখার ক্যামেরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে নিয়ে গেলে কী মনে পড়ায়! বাবুল সেখানে সদলবলে গিয়েছিলেন জবরদস্তি হিন্দুত্বের রাজনৈতিক শক্তিপ্রদর্শন করতে, তার ফলে সম্মুখীন হয়েছিলেন ছাত্রদের প্রতিবাদী ঘেরাওয়ের, ফ্যাসিস্ত প্রতিক্রিয়ায় প্রগতিবাদী ছাত্রসমাজকে ‘দেখে নেওয়া’র হুমকি দিয়েছিলেন, তার পরিত্রাতা হিসেবে হাজির হয়েছিলেন খোদ রাজ্যপাল ধনকড়। ঘটনাপ্রবাহ আরও গড়ায়।

বাংলার ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে মূল রণধ্বনি উঠেছিল ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে রুখে দাও! সেটা সম্ভবও হয়েছে। সফল হয়েছে এমনকি টালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রেও, যেখানে বিশেষত টলিউড কাঁপাতে বিজেপি প্রার্থী করেছিল বলিউড নাম ভাঙানো বাবুলকে। বিজেপির প্রার্থীকে টালিগঞ্জ কেন্দ্রের ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক চেতনা পরাজিত করে জবাব দিয়েছে। অথচ বছর না ঘুরতে তাঁকেই আবার বালীগঞ্জ কেন্দ্রে উপনির্বাচনে প্রার্থী করে দিল তৃণমূল! বালীগঞ্জ কেন্দ্রের নাগরিক সমাজের ব্যাপকাংশ ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দল বিজেপিকে রেয়াত করে না। সেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসবাস সংখ্যাগতভাবে উল্লেখযোগ্য। এই কেন্দ্রের লাগোয়া পার্কসার্কাস অঞ্চলে লাগাতার সংঘটিত হয়েছে সিএএ-এনআরসি বিরোধী “শাহীনবাগ” ধাঁচের আন্দোলন। এই সবকিছুর বিপরীতমুখী হয়ে টালিগঞ্জে হারানো প্রার্থীকে এবার বালীগঞ্জে প্রার্থী করার ‘সঠিকতা’র প্রমাণ দিতে উঠেপড়ে লাগবে। সবই ‘মাননীয়া’র অনুপ্রেরণায়। কিন্তু ক্ষমতার ঔদ্ধত্যে করা এইসমস্ত পদক্ষেপ টালীগঞ্জ-বালীগঞ্জের নাগরিক চেতনার বিরোধী — বাংলার ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক মনোভাবকে অপমান করার সমার্থক। এ বরদাস্ত করার নয়।

Putin’s Ukraine War

দু’সপ্তাহব্যাপী হামলার পরও পুতিনের ইউক্রেন-যুদ্ধ কমার কোনও লক্ষণ নেই। ইউক্রেনের বেশ কিছু অংশে গোলাবর্ষণ আরও তীব্র, আরও ব্যাপক হয়েছে। সাধারণ মানুষের হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে বাস্তুত্যাগী শরণার্থীর স্রোত। ইউক্রেনে চলছে বিপুল ধ্বংস তাণ্ডব। ইউক্রেন সেনাসূত্রে জানা গেছে, রাশিয়ারও সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র — উভয় দিক থেকেই বড় রকম সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যুদ্ধে আর্থিক এবং মানবিক ক্ষতি যেহেতু বেড়েই চলেছে, ঐ অঞ্চল জুড়ে তো বটেই, তার বাইরেও তার প্রভাব পড়ছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে তিনদফা কথাবার্তা চললেও এখনও পর্যন্ত কোন যুদ্ধ বিরতি ঘটেনি, স্থায়ী শান্তির জন্য কোনও কূটনৈতিক কাঠামো গড়ে ওঠা তো বহু দূরের কথা।

আর আমাদের ভারতে, পুতিনের ইউক্রেন-যুদ্ধ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মোদী সরকারের চরম ব্যর্থতাকে নির্লজ্জভাবে প্রকট করে তুলেছে। ‘মোদী জমানায় বিশ্বের দরবারে ভারত কী সাংঘাতিক উচ্চতায় পৌঁছেছে’ — আরও কয়েকটির মধ্যে অন্যতম এই আকাশ কুসুম দাবিটিকে কেন্দ্র করে মোদী সরকারের আত্মগরিমা প্রচার আবর্তিত হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদী সবচেয়ে বেশিবার বিদেশ ভ্রমণে গেছেন। আর এখন ইউক্রেন-সংকটে ভারতের বিদেশনীতিকে কার্যত পক্ষাঘাতগ্রস্ত মনে হচ্ছে; ভারত এই প্রশ্নে রাষ্ট্রসঙ্ঘে বারবার বিরত থাকার মতো ভূমিকাটুকুই নিতে পেরেছে মাত্র! আরও দুশ্চিন্তার ব্যাপার হল — ইউক্রেনে ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি ছেলে-মেয়ে পড়তে গেছে — ইউক্রেন সরকারের ২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী মোট ৭৬,০০০ ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ২০,০০০ জনই ভারতীয়। আর মোদী সরকার তাদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতে ও সময়মত ওদের ফিরিয়ে আনতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

রাশিয়ার ইউক্রেন-আগ্রাসনের ক্রমবর্ধমান হুমকির মধ্যে ভারতীয় দূতাবাস থেকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম যে নির্দেশ দেওয়া হয়, তাতে যে ভারতীয়দের থাকা ‘অনাবশ্যক’ তাদের সাময়িকভাবে ইউক্রেন ছাড়তে বলা হয়েছিল। পরের দিন, এক নির্দেশিকায় বলা হয় ‘ভারতে ফিরে যেতে ইচ্ছুক’ ভারতীয়দের ‘পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে কমার্শিয়াল ফ্লাইটের টিকিট পাওয়া গেলে বুক করে নিতে’। দু’দিন পর, তিনটি বিশেষ এয়ার ইন্ডিয়া উড়ানের কথা ঘোষণা করা হল যেগুলোর টিকিটের দাম যথেষ্ট বেশি। সেই সময় দূতাবাস থেকে যখন সমস্ত পড়ুয়াকে ইউক্রেন ছাড়তে বলা হল, ইউক্রেনের আকাশ পথ তখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং ইউক্রেন থেকে সরাসরি উড়ান আর সম্ভবপর ছিল না। ছাত্রছাত্রীদের তখন বলা হল সম্ভবপর যে কোনও উপায়ে প্রতিবেশী দেশগুলিতে পৌঁছাতে। তাদের বিন্দুমাত্র জানা ছিলনা, যে খাবার আর পানীয় জল ছাড়া জমে যাওয়া ঠাণ্ডায় দীর্ঘ পথ হাঁটার পর এশিয়া, আফ্রিকা এবং মধ্য প্রাচ্যের অন্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ওদেরও অনেককে স্টেশন থেকে এবং সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দেবে বর্ণবিদ্বেষী নিরাপত্তা রক্ষীরা!

সরকার যদিও ইউক্রেনে আটকে থাকা ভারতীয় ছাত্রদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে বা সময়মত ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের মানসিক যন্ত্রণাকে নিজের কাজে লাগাতে কিন্তু কসুর করেনি! সেই আতঙ্ক আর কষ্টের আখ্যানকে এক ‘ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’ প্রচারাভিযানে রূপান্তরিত করা হয়েছে এবং উত্তরপ্রদেশে দীর্ঘ সময় ধরে চলা বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে কাজে লাগানো হয়েছে। ছাত্রদের সরিয়ে আনার প্রক্রিয়ার নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন গঙ্গা’! চারজন মন্ত্রীকে পাঠানো হয়েছে সেই কাজ ‘দেখভাল’ করার জন্যে! যখন বাস্তবে ছাত্রছাত্রীদের রেল স্টেশনে এবং এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর জন্যে পরিবহনের ব্যবস্থা করা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দেশগুলির সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে তাদের নিরাপদে সরিয়ে আনাকে নির্লজ্জভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে। দক্ষিণ ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরা অভিযোগ করেছে যে ইউক্রেন থেকে ফেরার যাত্রীতালিকা থেকে তাদের নাম সরিয়ে সেখানে উত্তর ভারতের ছাত্রছাত্রীদের নাম ঢুকিয়েছিলেন ভারতীয় দূতাবাসের আধিকারিকরা। আর একাজে তাদের সাহায্য করেছিলেন বিএপিএস স্বামীনারায়ণ সংস্থার সদস্যরা। এটি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা যেটি প্রবাসী হিন্দুত্ববাদীদের বিশ্বব্যাপী সংগঠন-জালের একটি প্রভাবশালী অংশ।

যে সব ছাত্রছাত্রী ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে তাদের বিপন্নতার কথা বর্ণনা করেছে বা সামাজিক মাধ্যমে ভিডিও শেয়ার করে সাহায্যের আবেদন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘ বাহিনী নির্দ্বিধায় কুৎসা প্রচার চালিয়েছে। মানসিক আঘাতে জর্জরিত সেইসব ছাত্র ছাত্রীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা বিশেষ সুযোগপ্রাপ্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে এবং ভারতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় তারা অকৃতকার্য হয়েছে। এমনকি যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চলে থেকে সরিয়ে আনার ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার দায়ও তাদের উপরেই চাপানো হয়েছে। কর্ণাটকের এক বিজেপি নেতা খারকিভে গোলাবর্ষণে নিহত কর্ণাটকের ছাত্র নবীন শেখরাপ্পার দেহ ফিরিয়ে আনার দাবি পর্যন্ত অগ্রাহ্য করেছেন। তার যুক্তি-মৃতদেহ বিমানে যে জায়গা নেবে সেখানে আটটি জীবিত ছাত্রের জায়গা হতে পারে। (কী অবাস্তব এবং হৃদয়হীন দাবি! বিমানের হোল্ডে মৃতদেহ বহন করা হয়)। এটা সবাই জানে ভারতে ডাক্তারি পড়ার ব্যয় ক্রমাগত বেড়ে নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার জন্যই ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরা ইউক্রেনে পড়তে যেতে বাধ্য হয়। যে সময়টা তাদের ভারত সরকারের সাহায্য দরকার ছিল, তারা পেল চূড়ান্ত উপেক্ষা আর অপমান!

ইউক্রেনের উপর পুতিনের অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়াকে মোদী সরকারের নিন্দা করতে অস্বীকার করা আসলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রশ্নে সরকারের এক পক্ষাঘাতগ্রস্ত নীতিকেই আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়। মোদী সরকারের ইজরায়েল ও আমেরিকার সঙ্গে রণকৌশলগত ভাগীদারি ক্রমশ বাড়তে থাকায়, ভারত প্যালেস্তিনীয় স্বার্থকে সমর্থন জানানো বন্ধ করে দিয়েছে। আর এখন রাশিয়াকে চটানোর ভয়ে, এক সার্বভৌম দেশ হিসাবে ইউক্রেনের অস্তিত্বের সমর্থনে পাশে দাঁড়াতে সরকার অস্বীকার করছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রশ্নে ভারতের বিরত থাকাকে ভারতের বিদেশ নীতির নিরপেক্ষতা বা আন্তর্জাতিক রণক্ষেত্রে ভারতের আমেরিকা থেকে দূরে থাকার লক্ষণ হিসেবে দেখা ভুল হবে। আমেরিকার বিশ্ব-আধিপত্যের ছকের প্রতি মোদীর ভারতের রণকৌশলগত অধীনতা বহুগুণ বেড়ে গেছে। এই সংকট মুহূর্তে রাশিয়ার প্রতি ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে অন্তর্নিহিত রয়েছে এক উগ্র দক্ষিণপন্থী ‘বলিষ্ঠ নেতা’ হিসাবে পুতিনের প্রতি সঙ্ঘবাহিনীর নীরব শ্রদ্ধাও! আর ভারত-পাক বিবাদের ক্ষেত্রে এক আদর্শ মাপকাঠি হিসাবে এই যুদ্ধ সঙ্ঘীদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, সেজন্যও তারা এই অন্যায় যুদ্ধের মহিমাকীর্তন করতে উৎসাহী!

রাশিয়ায় আরও বেশি বেশি সংখ্যায় মানুষ অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করার দাবিতে পুলিশী দমনপীড়ন এবং সরকারের অতি দেশভক্তিসঞ্জাত উগ্র-জাতীয়তাবাদকে উপেক্ষা করে পথে নামছে। তারা রাশিয়ার জাতীয় স্বার্থ আর যুদ্ধবাজ পুতিনের ভয়ঙ্কর নীতি (যা এই সংকটজনক পরিস্থিতিকে চরম সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেবে) আর প্রতিবেশীর উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেশবাসীর অসন্তোষ দমন করার স্বৈরাচারী ছকের মধ্যে, ফারাক করেছেন। ভারতে আমাদেরও মোদী সরকারের অদূরদর্শী দৃষ্টির বিপরীতে অন্য এক নীতি কাঠামোর মধ্যে ভারতের নিজের স্বার্থকে দেখতে হবে। যখন একটি বৃহৎ শক্তি এক প্রতিবেশীকে বোমা ফেলে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে, ভারতের উচিত শেষোক্তটির সার্বভৌম অস্তিত্ব এবং তার আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকারের সমর্থনে পাশে দাঁড়ানো। পুতিনের ইউক্রেন যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হলে তা গোটা বিশ্বে তেলের দাম বাড়িয়ে দেবে, পৃথিবী জুড়ে খাদ্যের হাহাকার ডেকে আনবে, আর অস্ত্রের দৌড় এবং পৃথিবীব্যাপী অশুভ ভাগবিন্যাস সহ প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্রতর করবে। এই সংকট মুহূর্তে ভারতকে একটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত বিদেশ নীতি আঁকড়ে চলতে দেওয়া যায়না। অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করা ও শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য ভারতের এক অতি সক্রিয় ভূমিকা এই মুহূর্তের দাবি!

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৮ মার্চ ২০২২)

International Women's Day

রাজ্যে রাজ্যে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়েছে সমতা, মুক্তি এবং জীবন জীবিকার সংগ্রামকে জোরদার করার লক্ষ্যে — ঘৃণা, নিপীড়ন, ধর্মান্ধতা, সংকীর্ণতা এবং পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে, ভালোবাসা ও সহোদরাবোধ জাগ্রত করার লক্ষ্যে এবং ইউএস-ন্যাটোর আগ্রাসী ষড়যন্ত্র ও ইউক্রেনে যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির জন্য।

বিহার, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ছত্তিসগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ, পাঞ্জাব, কর্ণাটক, আসাম, কার্বি আংলং, পুদুচেরি, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লী এবং অন্যান্য প্রদেশে মহিলাদের কনভেনশন, প্রতিবাদ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মিছিল সংগঠিত হয়েছে। দিল্লী এবং ঝাড়খন্ডে আশা প্রকল্পের কর্মীরা তাঁদের শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি ও স্থায়ীকরণের দাবিতে মিছিল করেন। সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি তাঁদের নিম্নলিখিত বিবৃতি প্রদান করেন।

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস আমাদের স্মরণ করায় নাগরিক অধিকার অর্জন করার বিপ্লবী ঐতিহ্য এবং সাহস জোগায় আমাদের সমস্যার গভীরে মূল কারণগুলি অনুসন্ধানের জন্য। এই দিনটি মহিলাদের অর্থনৈতিক অধিকার, সামাজিক মর্যাদা এবং রাজনৈতিক ন্যায়বিচারের সংগ্রামী প্রতীক চিহ্নের মতো। শ্রমজীবী মহিলাদের সংগ্রামের থেকে শক্তি সঞ্চয় করে এই দিনে মহিলারা বিশ্বের দেশে দেশে সংগঠিত আন্দোলন করেছেন সাম্রাজ্যবাদ এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির জন্য, জীবন-জীবিকার জন্য এবং অনেক বিজয় অর্জনও করেছেন।

কিন্তু বর্তমানে নারী বিরোধী শাসনে আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে অর্জিত অধিকার আজ বিপদের মুখে, তাই এই লুঠেরাদের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে মহিলারা আন্দোলন করছেন তাঁদের অধিকারকে রক্ষা করার জন্য। পুঁজিবাদ-ধর্মীয়-সামন্ততান্ত্রিক কুচক্রীরা মিলিতভাবে তাদের সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ করছে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের চেতনা এবং মর্মবস্তুকে ধ্বংসের লক্ষ্যে। আমাদের দেশে শ্রমবিরোধী, নারী বিরোধী যে শ্রম আইন সরকার পাশ করেছে শ্রমজীবী মহিলারা লড়াই করছেন তার বিরুদ্ধে। অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পের কর্মীরা আন্দোলন করছেন সরকারি কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি ও ন্যূনতম মজুরির জন্য। স্বনির্ভর গ্রুপ এবং ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়া মহিলারা তাঁদের ঋণ মকুব এবং সুদের হার কমানো, জীবিকার ট্রেনিং এবং বাজার ও অন্যান্য সুবিধার জন্য দাবি নিয়ে আন্দোলন করছেন।

আজ যখন দেশে মহিলারা চাকরি বা অন্যান্য অধিকার দাবি করছেন, নিজের ইচ্ছামতো জীবন যাপন করতে চাইছেন তখন এই সংকীর্ণমনা শাসকরা যারা মহিলাদের মাতৃসমা বলে পূজা করার ভাণ করেন, দলিত নিপীড়ন করেন, মহিলাদের ওপর হিংসা এবং দমন-পীড়ন চালান তারাই আবার সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে এই সমস্ত কার্যকলাপের বৈধতা দেন। স্কুল, কলেজে, অফিসে, কারখানায়, অন্যান্য কাজের জায়গায় ভেদাভেদ, যৌন নির্যাতন এবং মহিলাদের প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা করা হয় এবং অনেক ছলচাতুরি, কৌশল ব্যবহার করে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার মহিলাদের কণ্ঠরোধ করেন। আজ উৎপীড়ক ও অপরাধীদের সুরক্ষা দেওয়া হয় যা প্রমাণ করে মহিলাদের মধ্যে সংগ্রামী চেতনার যে বিকাশ হচ্ছে তাকে স্তব্ধ করে দেওয়া।

International Women's Day in india

সরকার কত নির্লজ্জভাবে মহিলা উৎপীড়কদের সুরক্ষা দেন তার সাম্প্রতিক উদাহরণ হল ধর্ষক-খুনি ‘বাবা’ রাম রহিমের জেলমুক্তি এবং তাকে জেডপ্লাস সুরক্ষা দিয়ে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র ভোট নিশ্চিত করার।

সম্প্রতি কর্ণাটকে স্কুল এবং কলেজে মহিলাদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হয়। কিছু সংকীর্ণমনস্ক ছাত্র হিজাব পরিহিতা এক ছাত্রীকে ঘিরে ধরে এবং গেরুয়া শাল উড়িয়ে জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিয়ে হয়রান করে। এই ধৃষ্টতা অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক কাজ। হিন্দু ছাত্রছাত্রীরা যদি চুলের বিনুনি বা খোঁপা বাঁধতে পারে, মহিলারা যদি বিন্দি, সিঁদুর, বালা বা শিখ ছাত্ররা যদি পাগড়ি পরতে পারে তাহলে হিজাব পরলে ধর্ম নিরপেক্ষতা কিভাবে লঙ্ঘিত হবে? বাস্তবে এটাই হল মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক অপরাধ। শুধু কর্ণাটকের মন্ত্রী বিধায়করাই নন, দেশের বিভিন্ন জায়গার বিজেপি-আরএসএস নেতারা এই ঘটনায় উস্কানি দিয়েছেন। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ, মহিলারা একে সমর্থন করেননি এবং তাঁরা বুঝেছেন হিজাব ইস্যু আসলে মনুবাদী পিতৃতান্ত্রিকদের একটি মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িক চক্রান্ত যার মাধ্যমে মুসলিমদের পৃথকীকরণ করা যায় অনেকটা অস্পৃশ্যতা বা বর্ণবৈষম্যতার মতো।

আজ দেশে মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, গ্যাসের দাম আকাশছোঁয়া, যার আঁচ কৃষক, শ্রমিক, মহিলা, গৃহবধূ প্রত্যেকেই অনুভব করছেন, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি, অপরাধ, দুর্নীতি যখন বেড়েই চলেছে তখন সরকার চিন্তিত হয়ে পড়ছে জনগণ প্রশ্ন করবেন এবং উত্তরও দাবি করবেন। তাই তারা ক্রমাগত চেষ্টা করছে কীভাবে জনগণকে মুসলিম বিরোধিতায় ফাঁসিয়ে দেওয়া যায়। জনগণের দুর্দশার বিনিময়ে সরকার খোলাখুলি আম্বানি, আদানির মতো মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। তাই এই ঘৃণা, বিদ্বেষ, সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে ভালোবাসা, সহোদরাবোধ, মুক্তির জন্য স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের এই বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভেদজনক রাজনীতিকে পরাস্ত করুন।

সম্প্রতি ইউক্রেনকে রাশিয়া আক্রমণ করে সেখানকার জনগণকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অবিলম্বে রাশিয়া আক্রমণ বন্ধ করুক এবং যুদ্ধের সমাপ্তি হোক এই আমাদের দাবি। আমেরিকা ও ন্যাটোর কাছে আমাদের দাবি তারা তাদের অপ্রত্যক্ষ সম্প্রসারণবাদী ষড়যন্ত্র বন্ধ করুক, কারণ যুদ্ধের ফলে ধ্বংস এবং সাধারণ মানুষের দুর্দশা ছাড়া কিছুই লাভ হয় না।

সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি ৮ মার্চ ২০২২ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সারা ভারতে মিছিল, মিটিং-এর মাধ্যমে ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসার বিরুদ্ধে দাবি করেছেন কাজ, জীবন জীবিকা, সমতা, ভালোবাসা, সহোদরাবোধ ও মর্যাদার।

anti-war procession

ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ইউক্রেনের ওপর পরমাণু শক্তিধর রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের বিরোধিতা ও সৈন্য অপসারণের দাবি, আমেরিকা-ন্যাটো অক্ষের চলমান যুদ্ধে উস্কানি বন্ধ করা এবং ইউক্রেনে আটকে পড়া ভারতীয় পড়ুয়াদের সরকারি উদ্যোগে নিখরচায় দেশে ফেরানোর দাবি নিয়ে শহরের নাগরিকেরা ১১ মার্চ যুদ্ধবিরোধী মিছিলে সামিল হলেন। মিছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম ক্যান্টিন থেকে শুরু হয়ে হাসপাতাল রোড, হিলকার্ট রোড, সেবক রোড, বিধান রোড পরিক্রমা করে। বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে সামিল ছিলেন পার্থ চৌধুরী, রূপক দে সরকার, অভিরঞ্জন ভাদুড়ি, মুক্তি সরকার প্রমুখ সহ শতাধিক সহনাগরিকেরা।

drastically reduce PF interest

এক বিবৃতিতে এআইসিসিটিইউ’র কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, দিনকয়েক আগে চারটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের ক্ষমতায় আসার পর মোদী সরকার তার দাঁত-নখ আবার বার করল।

কেন্দ্রীয় সরকার আরও একবার শ্রমিক কর্মচারীদের কষ্টার্জিত সঞ্চয়ের উপর বড় ধরনের আঘাত নামালো। তারা পিএফ খাতে সুদের হার ৮.১ শতাংশে নামিয়ে আনল যা গত ৪১ বছরে সর্বনিম্ন! একদিকে, সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দাম, রান্নার গ্যাস, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি নিত্যদিন কল্পনাতীত মাত্রায় যখন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন এই আঘাত আরও বেশি সংকটে ফেলবে সাধারণ মানুষকে।

মোদী সরকার শ্রমিক শ্রেণীর উপর একের পর এক হামলা নামিয়ে এনেছে। ছিনিয়ে নিয়েছে শ্রমিকশ্রেণির বহু সংগ্রামের মাধ্যমে শতাব্দী ব্যাপী অর্জিত নানা অধিকার। গোটা শ্রমিকশ্রেণীকে নিক্ষিপ্ত করেছে নয়া শ্রম দাসত্বে।

নির্বাচনে জয়লাভের পর এবার মোদী সরকার শ্রমজীবী মানুষের উপর হামলাকে আরও তীব্রতর করবে। এই সমস্ত হামলাকে প্রতিহত করতে শ্রমিকশ্রেণিকে আরও প্রত্যয় নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য কোমর বাঁধতে হবে।

ভারতের শ্রমিকশ্রেণির কাছে এআইসিসিটিইউ’র আবেদন — পিএফ সুদের এই বিরাট হ্রাস ও অন্যান্য শ্রমিক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে সমুচিত জবাব দিতে ২৮-২৯ মার্চের সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটকে সর্বাত্মক ভাবে সফল করে তুলুন।

Victory of Sanitation Workers

উড়িষ্যার মঞ্চেশ্বরে রেলে চুক্তি প্রথায় নিয়োজিত সাফাই কর্মীদের লাগাতার সংগ্রামের পর তাৎপর্যপূর্ণ জয়লাভ হয়েছে। ইস্ট কোস্ট রেলওয়ের (ই-কোর) মঞ্চেশ্বর রেল ক্যারেজ রিপেয়ারিং ওয়ার্কশপে জানুয়ারির শেষে ৬৫ জন চুক্তি সাফাই কর্মীকে হঠাৎ কর্মচ্যুত করে চরম দারিদ্র্য ও অনাহারের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। রেলের টেন্ডারের প্রকৃতি পরিবর্তন করে এই কর্মচ্যুতি করা হয়েছে। ১০ বছরের বেশি কর্মে নিযুক্ত ছিলেন এই শ্রমিকরা। কিন্তু তাদের স্থায়ী কর্মীতে রূপান্তরিত না করে মুখ্য নিয়োজক ই-কোরের রেল প্রশাসন এঁদের ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। তাই ই-কোরের প্রশাসকরা তাঁদের ‘পরিষেবা’ টেন্ডার (সার্ভিস টেন্ডার) বদলে ‘ওয়ার্ক’ টেন্ডারে পরিণত করেন। এই বেআইনি স্বেচ্ছাচারী আদেশের বিরুদ্ধে কর্মীরা ওয়ার্কশপের সামনে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ধর্ণায় বসেন — এআইসিসিটিইউ অন্তর্ভুক্ত ‘ঠেকা সাফাই কর্মচারী ইউনিয়ন’এর ব্যানারে।

টেন্ডারের প্রকৃতি পরিবর্তনের ফলে রেল প্রশাসন চেয়েছিল সমাজের অত্যন্ত নিপীড়িত, দরিদ্র শ্রেণী থেকে আসা এই সাফাই কর্মীদের জীবনের বিনিময়ে অতিরিক্ত ৬৩ লক্ষ টাকা মুনাফা করতে। আগের টেন্ডার অনুযায়ী রেল প্রশাসনের খরচ হত ১ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকা প্রতি বছরে, নতুন টেন্ডারের ফলে খরচ কমে গিয়ে দাঁড়াতো বছরে ১ কোটি ২৫ লক্ষ টাকায় — যা আগের তুলনায় বিবেকহীনভাবে ৩৩ শতাংশ কম। ফলস্বরূপ কর্মী সংখ্যাও ৬৫ থেকে কমে গিয়ে ঠেকেছিল ২০ জনে। ৪৫ জন কর্মী কর্মচ্যুত হতেন। ঐ ২০ জন সাফাই কর্মী মাসপ্রতি ২১ দিন যে কাজ পেতেন তাও সরকার নির্ধারিত দিনপ্রতি ন্যূনতম ৫৪৬ টাকার কম মজুরিতে।

এআইসিসিটিইউ’র তরফে কেন্দ্রীয় শ্রম দপ্তরে এই ব্যপারে যোগাযোগ করা এবং লাগাতার আন্দোলনের চাপ দেওয়া হয়। এরফলে শ্রম দপ্তর রেল প্রশাসনকে এই বেআইনি কর্মচ্যুতির অবসান ঘটিয়ে ও পুরাতন টেন্ডারের মাধ্যমে কর্মীদের পুনর্বহালের নির্দেশ দেয়। তবে প্রশাসন তা মেনে নিলেও দু’মাস সময় চেয়ে পুনর্বহালের আশ্বাস দেয়। ইউনিয়ন তা প্রত্যাখান করে এবং অবিলম্বে পুনর্বহালের দাবিতে সংগ্রাম চালিয়ে যায়। অবশেষে মুখ্য ওয়ার্কশপ ম্যানেজার কর্মচ্যুত কর্মীদের পুনর্বহালের দাবি মেনে নেন এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট প্রত্যাহৃত হয়।

Mass beating to death at Samastipur

নীতিশ কুমার বিজেপি'র বিদ্বেষপূর্ণ অ্যাজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সমস্তিপুরের খলিল রিজভি ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ার পরও বাড়ি না ফেরাতে ওনার স্ত্রী ফোনে খলিলের সাথে যোগাযোগ করেন। তাঁদের কথা বলার সময় খলিলের ফোন ছিনতাই হয় এবং ফোন বন্ধ হয়ে যায়। কোনও সুত্র না পেয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি মুসিরঘরারই থানায় একটি নিরুদ্দেশ মামলা দায়ের করা হয়।

১৮ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সন্দেহভাজন বিপুল ঝা-কে গ্রেফতার করে। বিপুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পারে রাজেশ মিশ্র, কিসান ঝা এবং অন্যান্যরা মিলে খলিলকে একটি মুরগি খামারের ভিতরে খুন করে ও তার দেহ পুঁতে দেয়। পুলিশ দেহটি উদ্ধার করে এবং যথাযোগ্যভাবে খলিলের দেহ পুনরায় কবর দেওয়া হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি সমাজ মাধ্যমের একটি ভিডিওতে পরিষ্কার দেখা গেছে খলিলকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে এবং তার দেহ পোড়ানো হয়েছে।
সিপিআই(এমএল)-এর বিধানসভা পরিষদীয় নেতা মেহবুব আলম বলেন, নীতিশ কুমার বিজেপি’র কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেছেন তাই তিনি তাঁর নিজের দলের একজন মুসলিম নেতাকে গণপেটাই-এর হাত থেকে রক্ষা করতে পারলেন না এবং ঐ অপরাধীরা তাঁর নিজেরই দলের গুন্ডা। ঐ গুন্ডারা একজন জেডিইউ বিধায়ক ও বিহার শিক্ষামন্ত্রী বিজয় চৌধুরীর মদতপুষ্ট। জেলা প্রশাসন গণ-পেটাইয়ে হত্যার অভিযোগ নাকচ করে এবং নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে এই ঘটনাকে নিছক উৎপীড়নের মামলা বলে অভিহিত করছেন।

সিপিআই(এমএল)-ইন্সাফ মঞ্চের একটি টীম ইন্সাফ মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক কেয়ামুদ্দিন আনসারির নেতৃত্বে খলিল রিজভির গ্রাম ঘুরারইয়াতে ২৩ ফেব্রুয়ারি পরিদর্শনে যান। তাঁরা খলিলের পরিবারকে ২০ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ এবং পরিবারের একজনকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের দাবি করেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি ইন্সাফ মঞ্চ, সিপিআই(এমএল) এবং আরওয়াইএ একটি প্রতিবাদী সভা করেন।

সমস্তিপুরের গণ-পেটাই-এর দ্রুত বিচার, অপরাধীদের শাস্তির দাবি করলো সিপিআই(এমএল)

২৭ ফেব্রুয়ারি সিপিআই(এমএল)-এর একটি টীম, পলিটব্যুরো সদস্য ধীরেন্দ্র ঝা এবং পরিষদীয় নেতা মেহবুব আলম অকুস্থল সমস্তিপুরের মুসরিঘরারই-এ তদন্তে যান। তাঁরা খলিলের পরিবার এবং রুপাউলি বুর্জ গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর তাঁরা বাসুদেবপুর গ্রামের মুরগী খামারে যেখানে খলিলকে বন্দী করে রাখা হয় ও পরে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় সেই স্থান পরিদর্শন করেন।

A decade of ‘change’ government

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে আমাদের মতো অপেশাদার সমাজ অর্থনীতির লেখকদের পক্ষে আলোচনা ক্রমাগত দুস্কর হয়ে উঠেছে। অতীতে নিয়মিত রাজ্যের অর্থনৈতিক পর্যালোচনা (ইকোনোমিক রিভিউ) প্রকাশিত হত ও তারসাথে প্রকাশিত হত পরিসংখ্যানের টেবিল। বামফ্রন্ট সরকারের শেষের দিকে সেগুলি সরকারি ওয়েবসাইটেও পাওয়া যেত। এখন রাজ্য সরকারের ওয়েবসাইটে ইকোনোমিক রিভিউ রয়েছে ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ ও ২০২০-২১। শেষেরটি নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখা গেল পরিসংখ্যানের পরিশিষ্ট কিছুই নেই। রয়েছে কী কী প্রকল্প চালু করা হয়েছে তার বিজ্ঞাপন। ওদিকে নিতি আয়োগের প্রকাশিত ডিসেম্বর ২০২১’র ‘হেলদি স্টেটস, প্রোগ্রেসিভ ইন্ডিয়া: হেলথ্ ইনডেক্স রাউন্ড ফোর ২০১৯-২০’ নামক প্রতিবেদনে পশ্চিবঙ্গ সরকার কোনো তথ্য দেয়নি বলে সেখানেও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া গেলনা। ফলে জুন ২০১৯ থেকে দুটি পর্যায়ে এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত হওয়া ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ্ সার্ভে ফাইভ বা জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৫ (এনএফএইচএস ৫)-এ প্রকাশিত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কিছু তথ্য নিয়ে দেখতে চাইলাম পশ্চিমবঙ্গের নারী শিশুর স্বাস্থ্য কেমন। এর পাশাপাশি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হ্যান্ডবুক অফ স্ট্যাটিস্টিকস অন ইন্ডিয়ান ইকনোমির উপর ভিত্তি করে রাজ্যের মাথাপিছু আয় ও এনএসএস কর্তৃক করা, কিন্তু অপ্রকাশিত, গৃহস্থের ভোগব্যয় সংক্রান্ত তথ্যের উপর নির্ভর করে রাজ্যের অর্থনৈতিক হাল হকিকতের সামান্য কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করব।

১১ বছর আগে যখন তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছিল তখন শ্লোগান ছিল ‘পরিবর্তন’। মোড়ে মোড়ে হোর্ডিং’এ বহু বিদ্বজ্জনের ছবি ও ‘পরিবর্তন’ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে লাগানো হয়েছিল। পরিবর্তন এলো ক্ষমতায় থাকা শাসক দলের। কিন্তু কী পরিবর্তন এল রাজ্যে। উত্তরটা প্রয়োজন। ‘দূয়ারে সরকার’, ‘দুয়ারে রেশন’, ‘স্বাস্থ্যসাথী’ এসবের দৈনন্দিন বিজ্ঞাপনে চোখ ভরলেও মন ভরেছে কি? সেটা দেখতে গেলে কিছু বিষয় খতিয়ে দেখতে হবে। যতটা তথ্য পাওয়া গেছে তার দিকে চোখ রেখে বামফ্রন্ট ও তৃণমূলের শাসনের তুলনা করা যাক।

মাথাপিছু আয় এবং ক্ষেত্রগত উৎপাদন

১৯৬০ দশকের গোড়া পর্যন্ত মাথাপিছু আয়ের নিরিখে সারা দেশে এরাজ্যের স্থান ছিল তৃতীয়, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের পরে, জাতীয় গড়ের থেকে বেশি। ১৯৮০’র গোড়ায় তা জাতীয় আয়ের সমান হয়ে পড়ে। ১৯৯০’র গোড়ায় মাথাপিছু আয়ে পশ্চিমবঙ্গ সপ্তম স্থানে চলে যায়। ২০০০ সালে দশম ও ২০১১ সালে একাদশতম স্থানে পিছিয়ে যাই আমরা। এক দশক বাদেও সেই পতন থামেনি। আমাদের স্থান এখন চতুর্দশ।

মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধির হার ১৯৯৩-৯৪ থেকে ১৯৯৯-২০০০ এই ছ’বছরে ছিল বার্ষিক ৫.৫ শতাংশ, যেখানে জাতীয় গড় ছিল ৪.৬ শতাংশ। পরবর্তী দশকে জাতীয় গড় বেড়ে হল ৫.৫ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গের গড় কমে দাঁড়াল ৪.৯ শতাংশ। ২০১১-১২ থেকে ২০১৯-২০-তে পশ্চিমবঙ্গের বৃদ্ধির হার আরো কমে ৪.২ শতাংশ হয়েছে। অবশ্য জাতীয় গড়ও কমে ৫.২ শতাংশ হয়েছে। তবে জাতীয় গড়ের সাথে রাজ্যের ফারাকটা বেড়েছে, ০.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ১ শতাংশ হয়েছে। নিচের সারণীতে, নীট উৎপাদন (মাথাপিছু) বৃদ্ধির হার, মোট উৎপাদন (ক্ষেত্রীয়) বৃদ্ধির হারের তুলনা দেওয়া হল পশ্চিমবঙ্গ ও সারা ভারতের মধ্যে।

change or retreat

লক্ষ্যণীয় যে রাজ্যের বৃদ্ধির হার জাতীয় হারের থেকে ১৯৯০’র দশকে বেশি ছিল। বামফ্রন্টের শেষ দশকে তা জাতীয় গড়ের থেকে কমে গিয়েছিল। তারপরে তৃণমূল শাসনেও তা জাতীয় গড়ের থেকে কম রয়েছে। কেবল তাই নয় তা বামফ্রন্টের শেষ দশকের গড়ের থেকেও কম হয়েছে। মনে রাখা দরকার এই আলোচনায় কোভিড১৯-এর সময়কার বছরগুলিকে ধরা হয়নি।

অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির হার তিনটি সময়কালেই সারা দেশের থেকে বেশি। ১৯৯৪-২০০০ সময়কালে গড় বৃদ্ধির হার ৪.২ শতাংশ, যা আলোচ্য তিনটি সময়কালের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু তৎপরবর্তী এই শতকের প্রথম দশকে তা অনেক কমে যায়। তৃণমূল সরকারের সময়ে তা অনেকটা বেড়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে কৃষির বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমছে। তৃণমূলের আমলে ম্যানুফাকচারিং ও পরিষেবাক্ষেত্রের বৃদ্ধির হার কমেছে ও তা ভারতের থেকে অনেকটাই কম। পরিষেবা ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট আমলের সাফল্য অনেক বেশি একদিকে বৃদ্ধির হার দুই অঙ্কে পৌছেঁছিল, অপরদিকে তা সারা দেশের তুলনায় বেশ খানিকটা বেশি ছিল।

ফলে একথা বলা যায় রাজ্যে উথপাদন বৃদ্ধির নিরিখে তৃণমূল যদি কোনো পরিবর্তন এনে থাকে, তা এক নেতিবাচক পরিবর্তন।

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা-৫’ রিপোর্ট। রিপোর্ট অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা কেমন দেখা যাক।

সাক্ষরতা ও বিদ্যালয় শিক্ষা

পশ্চিমবঙ্গে ওই সমীক্ষা হয়েছিল ২১ জুন ২০১৮ থেকে ৮ অক্টোবর, ২০১৯ পর্যন্ত, কোভিডের অনেকটাই আগে। ফলে লকডাউন কোভিড এগুলির প্রভাব পড়েনি। সারা ভারতে তা চলে ১৭ জুন ২০১৯ থেকে ৩০ জানুয়ারি ২০২০ এবং ২ জানুয়ারি ২০২০ থেকে ৩০ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত, দু’দফায়। ফলে সেক্ষেত্রে কোভিডের প্রভাব পড়েছে ও তা নেতিবাচক হওয়াই স্বাভাবিক। ওই সমীক্ষার প্রকাশিত তথ্য অনুসারে সারা ভারতের মহিলা সাক্ষরতার (৭১.৫ শতাংশ) তুলনায় এরাজ্যের সাক্ষরতা (৭২.৯ শতাংশ) বেশি। তবে পুরুষদের ক্ষেত্রে দেশ (৮৪.৪ শতাংশ) রাজ্যের (৮০.২ শতাংশ) তুলনায় এগিয়ে আছে।  কিন্তু ১০ বছরের বেশি বিদ্যালয়ে গিয়েছে এমন নারীর শতাংশ রাজ্যে মাত্র ৩২.৯ শতাংশ যা দেশের ৪১ শতাংশের তুলনায় অনেকটাই কম। পুরুষদের ক্ষেত্রেও রাজ্যের হার (৪৬.৭ শতাংশ) দেশের (৫৭.১ শতাংশ) থেকে অনেক কম।

কম বয়সে বিবাহ ও গর্ভধারণ

কম বয়সে বিবাহের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ কয়েক যোজন পিছিয়ে আছে। ২০-২৪ বছরের মহিলাদের মধ্যে ৪১.৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ১৮ বছরের কমে বিয়ে হয়েছে এই রাজ্যে যা সারা দেশের ২৩.৩ শতাংশের প্রায় দ্বিগুণ। সমীক্ষার সময়ে ১৫-১৯ বছর বয়স্ক নারীদের মধ্যে ১৬.৪ শতাংশ গর্ভবতী বা সন্তানবতী ছিল; এক্ষেত্রেও সারা দেশের তুলনায় আমরা বেশ পিছিয়ে আছি। ওই হার সারা দেশে ৬.৮ শতাংশ। এরাজ্যে নাবালিকাদের মধ্যে গর্ভধারণের হার ৮.১ শতাংশ, সারা দেশে ৪.৩ শতাংশ। ফলে কন্যাশ্রীর ফল কী হয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে।

রক্তাল্পতা

৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের ক্ষেত্রে রক্তাল্পতায় ভুগছে ৬৯ শতাংশ শিশু (সারা ভারতে ৬৭.১ শতাংশ)। ১৫-৪৯ বছর বয়স্ক নারীদের মধ্যে রক্তাল্পতা রয়েছে এই রাজ্যে ৭১.৪ শতাংশের, দেশে তা রয়েছে ৫৭ শতাংশের ক্ষেত্রে। ১৫-১৯ এই বয়ঃগোষ্ঠিতেও ৭০.৮ শতাংশের রক্তাল্পতা রয়েছে যা দেশের ৫৯.১ শতাংশের তুলনায় বেশি। পুরুষদের ক্ষেত্রেও রাজ্যে রক্তাল্পতার হার অনেক বেশি সারা দেশের তুলনায়; ১৫-১৯ বছরের ক্ষেত্রে ৩৮.৭ শতাংশ (সারা দেশে ৩১.১ শতাংশ) ও ১৫-৪৯ বছরের মধ্যে ৩৮.৯ শতাংশ (সারা দেশে ২৫ শতাংশ)।  রক্তাল্পতার এই ভয়াবহ হার উদ্বেগজনক। আগেই বলা হয়েছে যে রাজ্যের ক্ষেত্রে পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা কোভিড১৯’র সংক্রমণের বছর খানেক আগেই করা হয়েছে। ফলে কোভিড১৯-এর পরে এই ভয়াবহতা আরো কতটা বেড়েছে তা অনুমেয়।

- অমিত দাশগুপ্ত

Failed to identify the culprits

অপরাধের যে কোনো ঘটনায় তদন্তের লক্ষ্য থাকা উচিত মূলত দুটো — অপরাধে জড়িতদের এবং অপরাধের উদ্দেশ্যকে খুঁজে বার করা। এটা সফল হলে ন্যায়বিচার লাভ সম্ভব হয়, অপরাধীদের শাস্তি পাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র এবং বিভিন্ন আন্দোলনের সক্রিয় মুখ ২৮ বছর বয়স্ক আনিস খানের ১৮ ফেব্রুয়ারি রহস্যজনক হত্যার তদন্তে গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট-এর তদন্তের লক্ষ্যও আপাতভাবে নিশ্চয় এটাই ছিল। আনিস খানের মৃত্যুর পরপরই অপরাধীদের খুঁজে বার করা এবং তাদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন জোরালো হয়ে উঠলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তদন্তের প্রশ্নে সিট গঠন করেন এবং সিট ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন। আনিসের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলনগুলো চলছিল সেগুলো ‘গণতান্ত্রিক নয়’ বলে সেগুলোকে তিনি হেয় করেন। এবং আনিসের বাবা ও পরিবারের সদস্যদের রাজ্য পুলিশের হাতে তদন্তে অনাস্থা প্রকাশ করে সিবিআই তদন্তের দাবি জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, সিট-এর তদন্ত হবে নিরপেক্ষ এবং কোনোকিছু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হবে না। তিনি অতএব সিটের তদন্তে আস্থা রাখার আহ্বান জানান। তাঁর সুনির্দিষ্ট মন্তব্য ছিল, “প্রকৃত ঘটনা কী তা আমরা জানি না, কিন্তু খুব শীঘ্রই আমরা সত্যিটা খুঁজে বার করব। কোনো শিথিলতা গ্ৰাহ্য করা হবে না। সরকার খুবই কঠোর।” সিট গঠন হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি, এবং একেবারে ১৫ দিনে না হলেও ১৯ দিনের মাথায় সিটের রিপোর্ট মুখবন্ধ খামে আদালতে জমা পড়েছে। শুরুতেই তদন্তের লক্ষ্যের যে কথা উল্লিখিত হয়েছে, সিট তাদের তদন্তে সেই লক্ষ্য পূরণে কতটা সফল হয়েছে? আনিসের মৃত্যুর জন্য কারা দায়ী, সিট কি তাদের চিহ্নিত করতে পেরেছে? সিট কি সত্যিই কাউকে আড়াল করার চেষ্টা করেনি?

বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে আনিসের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাটা এরকম। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতের পর পুলিশ পরিচয়ে চারজন (একজনের গায়ে পুলিশের উর্দি ছিল আর তিনজনের পরনে ছিল জলপাই রঙের পোশাক) আনিসদের বাড়িতে ঢোকে। একজন বন্দুকের ডগায় আনিসের বাবা সালেম খান ও অন্যান্যদের একতলায় আটকে রাখে, বাকি তিনজন উঠে যায় তিনতলায়। এরপর কিছু একটা ধপ করে পড়ার শব্দ হয়, এবং উপরে উঠে যাওয়া তিনজন নিচে নেমে এসে বন্দুকধারীকে বলেন, “স্যার, কাজ হয়ে গেছে।” ঐ চারজন ‘কাজ’ সারার পর চলে গেলে বাড়ির লোকজন আনিসের রক্তাক্ত দেহকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেন, এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। পুলিশ এটাকে ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’ বলে চালানোর চেষ্টা করলেও আনিসের পরিবারের লোকজনদের কাছে এটা প্রশ্নহীন হত্যা, তিনতলার ছাদ থেকে ফেলে দেওয়াতেই যে আনিসের মৃত্যু হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ তাদের নেই।

ঘটনাবলীর বিকাশ থেকে জানা গেছে, ঘটনা ঘটার পর আনিসের বাড়ি থেকে থানায় ফোন করা হলেও থানা থেকে কোনো পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়নি। আনিসের মৃত্যুর পরদিন স্থানীয় থানা ও জেলার পুলিশ অফিসাররা বলেন, গতরাতে পুলিশ আনিসদের বাড়িতে যায়নি। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে আনিসদের বাড়িতে পুলিশের যাওয়ার এই অস্বীকৃতি যে নিছক মিথ্যাচার ছিল, ঘটনাবলীর পরবর্তী বিকাশে তার প্রমাণ মেলে। আনিস কাণ্ডে যুক্ত থাকার জন্য সিট দুজনকে গ্ৰেপ্তার করে — এদের একজন হোমগার্ড কাশীনাথ বেরা ও অন্যজন সিভিক ভলান্টিয়ার প্রীতম ভট্টাচার্য। এরা দু’জন সাংবাদিকদের সামনেই বলেন — আমতা থানার ওসি দেবব্রত চক্রবর্তীর নির্দেশেই তাঁরা সেদিন আনিসদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাঁদের ওপর ওপরতলার চাপ আছে বলেও তাঁরা জানান। সিট আরো দুজনকে সাসপেন্ড করেছে কর্তব্যে অবহেলার জন্যে, অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইনস্পেক্টর নির্মল দাস ও কনস্টেবল জিতেন্দ্র হেমব্রেমকে। এরা সে রাতে পেট্রল ডিউটিতে ছিলেন। সিটও অতএব স্বীকার করেছে যে, ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে পুলিশ আনিসদের বাড়িতে গিয়েছিল। কিন্তু তারা কারা?

আনিসের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে অবজ্ঞা করতে মমতা ব্যানার্জি আনিসের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠতার উল্লেখের কৌশল নেন, “টিভিতে মুখ দেখানোর জন্য যাঁরা যাচ্ছেন (আনিসদের বাড়িতে) তাঁরা জানেন না যে আনিস আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখত এবং নির্বাচনে আমাকে সাহায্যও করেছিল”। কিন্তু তাঁর এই মন্তব্যের সমর্থনে কোনো তথ্য সামনে আসেনি, বাস্তব বরং এর বিপরীতটা হওয়ারই সাক্ষ্য দেয়। আনিস ছিল সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের এক সক্রিয় মুখ। সে স্থানীয় হাসপাতাল ও নার্সিং হোমগুলোর দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। এবারের, অর্থাৎ, ২০২১’র বিধানসভা নির্বাচনের আগে সে আইএসএফ’এ যোগ দিয়েছিল। বিধানসভা নির্বাচনে তার এলাকা থেকে টিএমসি তুলনায় কম ভোট পাওয়ায় স্থানীয় তৃণমূল নেতারা তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিল বলেও সংবাদ সূত্রে জানা গেছে। আনিসের সক্রিয় কার্যকলাপে স্থানীয় কায়েমি স্বার্থের একটা অংশ খুব স্বাভাবিকভাবেই অসন্তুষ্ট ছিল। আনিসের বাবা সালেম খান যে স্থানীয় কয়েকজন পঞ্চায়েত নেতার গ্ৰেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন, সেই দাবি একেবারে কারণবিহীন বলা যাবে না। আর, অনিষ্টের আশঙ্কা বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, আনিস অধিকাংশ রাতে বাড়িতে থাকত না। কিন্তু ১৮ ফেব্রুয়ারির রাতে সে যে বাড়িতেই ছিল, সেই খবর পুলিশের স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রেই পাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়ার নয়।

মমতা ব্যানার্জি দ্রুতই সত্যিটাকে খুঁজে বার করার প্রতিশ্রুতি দিলেও সেই সত্যির নাগাল সিট পায়নি। সাধারণ জনগণের কাছে আনিসদের বাড়িতে যাওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান পাওয়াটা তেমন কঠিন মনে না হলেও বাঘা-বাঘা অফিসাররা (সিটের মধ্যে পুলিশের ডিজিপি এবং সিআইডি’র অফিসাররা রয়েছেন) কেন প্রকৃত অপরাধীদের সন্ধান পেলেন না, আনিসকে তিনতলা থেকে নিচে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল কিনা তার ঠাওর করতে কেন পারলেন না, আনিসের মৃত্যুর পিছনে রাজনীতির যোগ থাকার সন্ধানকে কেন তাঁরা এড়িয়ে গেলেন, তা বুঝতে পারাটা আমাদের পক্ষে দুষ্করই হচ্ছে। যে প্রশ্নটা সঙ্গতভাবেই জোরালো হয়ে সামনে আসছে তা হল, ঘটনা ঘটার পরই আমতা থানার ওসি দেবব্রত চক্রবর্তীকে কেন তড়িঘড়ি ছুটিতে পাঠানো হল? কেন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল না? রাজ্য জানিয়েছে, ফৌজদারি আইনের ১৬১ ধারা অনুসারে তাঁর বয়ান রেকর্ড করা হয়েছে। আদালতের বিচারপতি প্রশ্ন তুলেছেন, ঐ আইনের ধারা ১৬৪ অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তাঁর গোপন জবানবন্দি নেওয়া হল না কেন? ওসিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আনিসদের বাড়িতে কাদের পাঠানো হয়েছিল তার সন্ধানের সম্ভাবনা কি খুব দুরূহ ছিল? আরও জানা গেছে, সিট ১০ মার্চ আদালতে রাইফেল জমা দেয়, সম্ভবত সেই রাইফেল যা তাক করে আনিসের বাবা ও অন্যদের বাড়ির নিচে আটকে রাখা হয়েছিল। সেই রাইফেল কার হাতে ছিল সেটা জানতে না পারাটা হেঁয়ালি বলেই মনে হচ্ছে।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, আনিস খানের মৃত্যুর পিছনে সত্যিটা বেরোলে হাওড়া জেলার পুলিশের কিছু কর্তা থেকে স্থানীয় রাজনীতির কিছু কেষ্টবিষ্টুর কয়েদে স্থান হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সিটের তদন্তের ফলাফলে এই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়েই দেখা দিচ্ছে। সিটের তদন্ত যেন গভীরে প্রবেশ না করে ওপর-ওপর আঁচর কেটেই ক্ষান্তি দিচ্ছে, একেবারে নিচুতলার দু’একজন কর্মীকে গ্ৰেপ্তার ও সাসপেন্ড করে তাদের কাজের বাহাদুরি জাহির করছে। গোটা ঘটনা থেকে এই সংকেতটা জোরালো হচ্ছে যে, রাজনৈতিক নির্দেশেই পুলিশ একটা প্রাণঘাতী কাজে লিপ্ত হল, রাজনৈতিক অভিসন্ধিতে ব্যবহৃত হল। আনিসের বাবা জানতেন, জেলার পুলিশ আর শাসক টিএমসি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ, আর তাই রাজ্য পুলিশের তদন্তে সত্যের উন্মোচন অধরা থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাই তাঁকে তাদের তদন্তে অনাস্থা প্রকাশের দিকে নিয়ে যায়। সিটের তদন্তের পরিণামে যেন সালেম খানের আশঙ্কা অভ্রান্ত হওয়ারই আভাস।

- জয়দীপ মিত্র

Horrible conditions in prisons

শিক্ষা থেকে বাণিজ্য — করোনাকালে করুণ-গাথা দেশের প্রায় সব ক্ষেত্রেই। তবে লকডাউন-পর্ব তো বটেই, সমগ্র কোভিডকালে সারা দেশে সামগ্রিক অপরাধ কিছুটা কমেছে। কিন্তু কারাগারের অন্তরালের অবস্থাটা ঠিক কেমন? অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো জেলখানার অন্দরের অবস্থা কোভিডকালে আরও ভয়াবহই হয়েছে। বন্দিদের বিচার-প্রাপ্তি থেকে স্বাস্থ্য পরিষেবার সুযোগ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বন্দিদের আদালতে হাজিরা অনিয়মিত হওয়ায় দেশের সব প্রান্তেই জেলখানা উপচে পড়ছে। ভিডিয়ো কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে শুনানির ব্যবস্থা নেই বেশিরভাগ সংশোধনাগারেই। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকাশিত ‘প্রিজন স্ট্যাটিস্টিকস ইন্ডিয়া (পিএসআই) ২০২০’ রিপোর্টে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
গত কয়েক বছর ধরে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো সারা দেশের জেলখানাগুলির হালহকিকত রিপোর্ট আকারে প্রকাশ করে। সর্বশেষ পিএসআই প্রকাশিত হয়েছে ডিসেম্বরে। সেই রিপোর্টে ২০২০’র জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের তথ্য রয়েছে। ২০২০’র মার্চেই ঘোষিত হয়েছিল লকডাউন। ফলে বছরের প্রথম তিনমাস বাদ দিলে তথ্যের প্রায় পুরোটাই করোনাকালের। সেই সময়ে জেলগুলিতে বন্দির সংখ্যা বেড়েছে দেড় শতাংশ। যাঁদের সিংহভাগই বিচারাধীন। তাঁদের অধিকাংশ আদালতে পৌঁছতেই পারেননি। রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০তে বন্দিদের আদালতে আসা কমেছে ৬৫ শতাংশ। স্বাস্থকেন্দ্রে যাওয়ার হার কমেছে ২৪ শতাংশ।

‘ইন্ডিয়া জাস্টিস রিপোর্ট’ (আইজেআর) নামে এক অ-সরকারি সংস্থা কারাগার এবং বন্দিদের তথ্য নিয়ে কাজ করে। সর্বশেষ প্রকাশিত পিএসআই রিপোর্টের সঙ্গে গত বছরগুলির তথ্য-পরিসংখ্যানের তুলনা করে এই সংস্থা দেখিয়েছে, ২০১৯-এর থেকে ২০২০-তে পরিস্থিতি খারাপই হয়েছে। ২০১৯-এর তুলনায় ২০২০ সালে বন্দিদের আদালতে হাজিরা এক-তৃতীয়াংশ কমেছে। ২০১৯ সালে সাড়ে ৪৪ লক্ষ বন্দি আদালতে গিয়ে বিচার প্রার্থনা করেছিলেন। পরের বছর সেই সংখ্যা সাড়ে ১৫ লক্ষে নেমে আসে। স্বাস্থ্য পরিষেবাতেও ছবিটা উদ্বেগের। ২০১৯ সালে যেখানে ৪ লক্ষ ৭৭ হাজার বন্দি স্বাস্থ্য পরিষেবা পেয়েছিলেন, বন্দির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পরেও, পরের বছর সেই সংখ্যা ৩ লক্ষ ৬৩ হাজারে নেমে এসেছে। এই সময়ে চিকিৎসা কর্মীদের কারাগারে পরিদর্শনও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। ২০১৯ সালে সারা দেশে ২৫ হাজার ৫২৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী জেলে গিয়ে পরিষেবা দিয়েছিলেন। পরের বছর সেই সংখ্যা ছিল ২০ হাজারের কিছু বেশি। ২০১৯এ প্রায় ১৬ হাজার আইনজীবী এবং স্বেচ্ছাসেবী জেলে গিয়ে বন্দিদের সঙ্গে আইনি সহায়তা নিয়ে কথা বলেছিলেন। পরের বছর সেই সংখ্যা অর্ধেক হয়েছে। ‘ইন্ডিয়া জাস্টিস রিপোর্ট’এর সম্পাদক মাজা দারুওয়ালার মন্তব্য, “অতিমারীর সময়ে কারাগারগুলির অবস্থা আরও ভয়াবহ হয়েছে। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও বন্দিদের সামগ্রিক অবস্থার উন্নতি হয়নি”।

- এই সময়, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২

4 million more people have died in Covid in India

২০২১ সালের শেষে ভারতের সরকারী হিসাব অনুযায়ী কোভিড১৯-এ মৃত্যুর সংখ্যা ৪ লক্ষ ৮৯ হাজার। দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত সমীক্ষা রিপোর্ট অনুসারে, ১ জানুয়ারি ২০২০ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২১-এর মধ্যে ভারত’ই বিশ্বের সর্বাধিক সংখ্যক কোভিড১৯ মৃত্যুর জন্য দায়ী। সমীক্ষা অনুসারে, ভারতে রিপোর্ট করা সংখ্যার চেয়ে ৪০ লক্ষ বেশি মানুষের কোভিড১৯-এর কারণে মৃত্যু হয়েছে। এই সময়কালে কোভিড১৯-এর কারণে বিশ্বব্যাপী মোট মৃত্যুর ২২.৩ শতাংশ ঘটেছে ভারতে।

১ জানুয়ারি ২০২০ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২১-এর মধ্যে কোভিড১৯-এর কারণে বিশ্বব্যাপী মোট ৫৯.৪ লক্ষ মৃত্যুর রিপোর্ট করা হয়েছে। সমীক্ষা অনুমান করেছে যে সেই সময়ের মধ্যে কোভিড১৯ মহামারীর কারণে বিশ্বব্যাপী ১.৮২ কোটি লোক মারা গেছেন। অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি দক্ষিণ এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং পূর্ব ইউরোপে।

এই সময়কালে, কোভিড১৯ মহামারীর কারণে অতিরিক্ত মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে, ভারত (৪০.৭ লাখ) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১১.৩ লাখ) সবচেয়ে এগিয়ে। এই সময়ের মধ্যে আরও পাঁচটি দেশে অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়েছে — সেগুলি হল রাশিয়া, মেক্সিকো, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তান। এই সাতটি দেশ ২৪ মাসের সময়কালে কোভিড১৯-এর কারণে বিশ্বব্যাপী অতিরিক্ত মৃত্যুর অর্ধেকের জন্য দায়ী।

ল্যানসেট রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের ৩০টি রাজ্যের মধ্যে অতিরিক্ত মৃত্যুর ক্ষেত্রে ভিন্নতা অত্যন্ত বেশি। ১ জানুয়ারি ২০২০ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত, ভারতের আটটি রাজ্যে অতিরিক্ত মৃত্যুর হার প্রতি ১ লক্ষ লোকের মধ্যে ২০০ জনের চেয়ে বেশি ছিল। এই রাজ্যগুলি হল উত্তরাখণ্ড, মণিপুর, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাব এবং কর্ণাটক। বিপরীতভাবে, অরুণাচল প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, সিকিম, রাজস্থান, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ এবং গোয়ায় অতিরিক্ত মৃত্যুহার ছিল প্রতি ১ লক্ষ লোকের মধ্যে ১২০ জনের চেয়ে কম।

ভারতের সাতটি রাজ্যে ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত ২ লক্ষের বেশি মৃত্যু হয়েছে৷ এইগুলি হল পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, বিহার, উত্তরপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্র। কোভিড১৯ মহামারীর কারণে অতিরিক্ত মৃত্যুর হারে ভারত বিশ্বে সর্বোচ্চ নয়, কিন্তু ভারতের বিশাল জনসংখ্যার কারণে ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী অতিরিক্ত মৃত্যুর ২২.৩ শতাংশের জন্য ভারতই দায়ী ছিল।

- নিউজ ক্লিক, ১১ মার্চ ২০২২

maternal mortality rate increased

২০১৯ সালের জন্য জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রতি ১ লক্ষ জীবিত বাচ্চা প্রসবের ক্ষেত্রে মাতৃ-মৃত্যুর সংখ্যা ১০০-তে নামিয়ে আনা। সর্বশেষ বুলেটিন অনুসারে, ২০১৯ সালে মাতৃ-মৃত্যুর হার (এমএমআর) কমে ১০৩-এ দাঁড়িয়েছে। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী জাতীয় স্তরের এমএমআর ছিল প্রতি ১ লক্ষ জীবিত বাচ্চা প্রসবের ক্ষেত্রে ১১৩।

তবে, পশ্চিমবঙ্গ, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড এবং ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্যগুলিতে এমএমআর এই সময়ে আরও খারাপ হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার এবং মধ্যপ্রদেশের মতো জনবহুল রাজ্যগুলি তাদের এমএমআরে যথাক্রমে ৩০, ২৩, ১৯ এবং ১০ পয়েন্ট হ্রাসের সাথে বড় উন্নতি দেখিয়েছে। উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও এই রাজ্যগুলিতে এখনও এমএমআর  অনেক বেশি রয়েছে।

মাতৃ-মৃত্যু হল একটি প্রধান স্বাস্থ্য নির্দেশক যা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রতি ১ লক্ষ জীবিত বাচ্চা প্রসবের ক্ষেত্রে মাতৃ-মৃত্যুর সংখ্যা দেখায়। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের মতে, “গর্ভাবস্থায় বা গর্ভাবস্থার সময়কাল এবং স্থান নির্বিশেষে, গর্ভাবস্থা বা এর ব্যবস্থাপনার কারণে বা তার ক্রমবর্ধমান কোনো কারণে, গর্ভাবস্থায় বা গর্ভধারণের ৪২ দিনের মধ্যে একজন মহিলার মৃত্যু হল মাতৃ-মৃত্যু। কিন্তু আকস্মিক বা আনুষঙ্গিক কারণ থেকে মৃত্যু হলে তা ধরা হয় না।”

জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত উন্নয়নের লক্ষ্য হল বিশ্বব্যাপী মাতৃ-মৃত্যুর হার ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি ১ লক্ষ জীবিত বাচ্চা প্রসবের ক্ষেত্রে ৭০-ের কম করা। ভারত এখন ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম বলে মনে করা হচ্ছে।

সর্বনিম্ন এমএমআর সহ শীর্ষ রাজ্য হল কেরালা, যা নাটকীয়ভাবে ৪৩ থেকে ৩০-এ উন্নীত হয়েছে। কেরালার পরে রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু এবং মহারাষ্ট্র। উল্লেখযোগ্যভাবে, এই রাজ্যগুলির কোনওটিই কেন্দ্রীয় ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি দ্বারা শাসিত নয়৷

অন্যদের মধ্যে, ২০১৯ সালে মধ্যপ্রদেশে মাতৃ-মৃত্যুর হার ১০ পয়েন্ট কমে ১৬৩ হয়েছে। স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসআরএস) অনুসারে, ২০১৭ সালে মধ্যপ্রদেশে এমএমআর ছিল ১৭৩। পশ্চিমবঙ্গে এমএমআর উদ্বেগজনকভাবে ১১ পয়েন্ট বেড়ে ২০১৭ সালের ৯৮ থেকে ২০১৯ সালে ১০৯ হয়েছে।

- নিউজ ক্লিক, ১৪ মার্চ ২০২২

Deucha-Panchami coal project

প্রকল্পের ভূগোল

বীরভূম জেলার মহম্মদবাজার ব্লকের দেউচা-পাঁচামী এলাকায় এই কয়লাখনি হবে। জেলা সদর সিউড়ি থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে। ১৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পশ্চিমে। নিকটবর্তী রেল স্টেশন মল্লারপুর।

  • ১২ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে খোলামুখ খাদান হবে। মোট ১০টি মৌজার ১৯টি গ্রাম এই খনিগহ্বরে বিলীন হয়ে যাবে। ৪,৩১৪টি পরিবারকে উচ্ছেদ হতে হবে, মোট ২১,০০০ জনকে। এরমধ্যে ৯,০৩৪ জন আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের (৪৩ শতাংশ)। এছাড়া আছেন এসসি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। এগুলো সরকারি হিসাব। অনেকে বলছেন সব মিলিয়ে প্রায় ৭০,০০০ মানুষকে উচ্ছেদ হতে হবে।
  • এখানে এমন বহু মানুষ আছেন যারা এরআগে অন্য কোনও ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পে উচ্ছেদ হয়ে এখানে এসে বসবাস করছেন এবং সরকারের খাতায় তাঁদের অনেকের নাম নাই। বহু মানুষ আছেন যাদের জমি জায়গার কাগজপত্র নাই।
  • এখান দিয়ে বয়ে গেছে দ্বারকা নদী। নদীর ওপর আছে ১৭ লক্ষ কিউবিক মিটার আয়তনের দেউচা ব্যারেজ। দক্ষিণে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে ময়ুরাক্ষী নদীর ওপর তিলপাড়া ব্যারেজ ও ৩০ কিমি দূরে বক্রেশ্বর উষ্ণ প্রস্রবণ, পশ্চিমে মাসাঞ্জোর বাঁধ এখান থেকে ৩৭ কিলোমিটার।
  • প্রকল্প এলাকাকে সরকার দুটো ভাগে ভাগ করেছে। প্রথম ভাগ দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙ্গা ২.৬ বর্গ কিলোমিটার। দ্বিতীয় ভাগ দেউচা-পাঁচামী ৯.৭ বর্গ কিলোমিটার।
  • প্রথম ভাগে প্রথমে খনন শুরু হবে। এখানে পড়বে দেওয়ানগঞ্জ, হরিণসিঙ্গা, কেন্দাপাহাড়ি, নিশ্চিন্তপুর, তেতুলবাঁধ, পাথরচাল, তালবাঁধ ও হারমাডাঙ্গা।
  • দ্বিতীয় ভাগের গ্রামগুলি হল, বাহাদুরগঞ্জ (দেউচা), আলিনগর, মকদমনগর, কাবিলনগর, সালুকা, মথুরাপাহাড়ি, গোবরবাথান, বারমেসিয়া, সাগরবান্দি, পাথরপাড়া ও শালডাঙ্গা। সমগ্র প্রকল্পটির সরকারি নাম দেউচা-পাঁচামী-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙ্গা কয়লাখনি।

ইতিহাস

  • এখানে কয়লার কথা বহু আগে থেকেই জানা ছিল। ১৯৮০-র দশক জুড়ে বেশ কয়েকবার ভারতের ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা দপ্তর কিছু কূয়ো খুঁড়ে নিরীক্ষা চালিয়েছিল। কিন্তু কোল ইণ্ডিয়া লিমিটেড এখানে খনি করতে কখনও সম্মত হয়নি।
  • ২০১১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার আরও ৫৮টি ব্লকের সাথে এই কয়লা ব্লকটিও নিলামের কথা ঘোষণা করে। ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ এবং কর্ণাটক সরকারকে একযোগে কয়লা উত্তোলনের জন্য প্রস্তাব দেয়, বেঙ্গল বীরভূম কোলফিল্ডস লিমিটেড নামে একটি সংস্থা তৈরি করা হয়। কিন্তু লাভজনক হবেনা ভেবে সকলে পিছিয়ে যায়।
  • শেষে পশ্চিমবঙ্গ পাওয়ার ডেভেলাপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড (ডব্লিউবিপিডিসিএল)-এর সাথে কেন্দ্রীয় সরকারের চুক্তির মাধ্যমে রাজ্য সরকার এই প্রকল্প হাতে নেয়। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার কয়লাখনিতে ১০০ শতাংশ বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের ছাড়পত্র দিয়ে রেখেছে।
  • ৯ নভেম্বর ২০২১ মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় এই প্রকল্পের ঘোষণা দেন। সরকার ৩৫,০০০ কোটি টাকা খরচ করবে বলে জানান তিনি, যারমধ্যে ১০,০০০ কোটি টাকা পুনর্বাসনে খরচ করা হবে।
Some information about Deucha-Panchami

ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষার তথ্য

১৯৮৮-৮৯ সালে ভারতের ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা (জিএসআই) প্রকাশিত রিপোর্ট, ২০১৬ সালে বিহার সরকারকে দেওয়া জিএসআই’এর তথ্য এবং ডব্লিউবিপিডিসিএল’এর একটি প্রেজেন্টেশন থেকে দেখা যাচ্ছে,

  • দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙ্গা ব্লকে ৩টি স্তরে এবং দেউচা-পাঁচামী ব্লকে ৪টি স্তরে কয়লা আছে। দেওয়ানগঞ্জের স্তরগুলির গভীরতা ১২ মিটার থেকে ৩৮০ মিটার, পাঁচামীর দিকে ১৩৫ মিটার থেকে ৮৫০ মিটার। কয়লার স্তরগুলির বেধ ৫ মিটার থেকে ৮০ মিটার এবং সবচেয়ে পুরু স্তরগুলি আছে সবচেয়ে বেশি গভীরতায়।
  • এখানে জমা থাকা কয়লার মান অত্যন্ত নিম্ন। তারমধ্যে অপেক্ষাকৃত ভালো মানের কয়লা আছে সবচেয়ে নিচের স্তরটিতে। এই স্তরটি আছে ৪২০ মিটার থেকে ১,০০০ মিটার গভীরতার মধ্যে।
  • সমগ্র এলাকাতেই কয়লার স্তরের ওপরে আছে অত্যন্ত শক্ত আগ্নেয়গিরিজাত পাথরের স্তর। ভূতাত্বিক পরিভাষায় এই ব্যাসল্টের স্তরের নাম রাজমহল ট্র্যাপ। এই ব্যাসল্ট পাথরের স্তর ৯০ মিটার থেকে ২৪৫ মিটার পুরু।
  • সব কয়লা তুলতে হলে খোলা খাদানের চূড়ান্ত গভীরতা হবে প্রায় ১,২০০ মিটার। ১২ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে এক কিলোমিটার গভীর খোলামুখ খাদান খোড়া হবে।

২০১৬ সালে বিহার সরকারকে দেওয়া জিএসআই’এর তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে,

  • এখন পর্যন্ত বিভিন্ন গভীরতার সর্বমোট ৩৬টি কূয়ো (বোরহোল) খনন করা গেছে। কোথায় কীভাবে কয়লা আছে তার সুস্পষ্ট চিত্র পেতে আরও ৮০টি কূয়ো খোড়া দরকার।
  • এত গভীর থেকে সুড়ঙ্গ কেটে কয়লা তোলার কারিগরি বর্তমানে দুনিয়ায় নেই। শক্ত ব্যাসল্ট ভেদ করে কূয়োগুলো খুড়তেও বিদেশি প্রযুক্তি লাগবে। খোলামুখ খনি এখানে তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব, কিন্তু বাস্তবে খুবই কঠিন।
  • ব্যাকফিলিং, অর্থাৎ খোড়া অংশ আবার বুজিয়ে দেওয়ার কাজ, সম্ভব হবে কেবলমাত্র খনির জীবনের একদম শেষ ভাগে গিয়ে। অর্থাৎ বিপুল পরিমান ওভার বার্ডেন ঢিবি করে রাখার জন্য খনির বাইরে আরও জায়গা দরকার হবে। পরিবহনের জন্য রেল, রোড ও অন্যান্য পরিকাঠামো নির্মাণে জমি নিতে হবে।
  • এখানকার কয়লা-স্তরের বেধ অস্বাভাবিক বেশি, এক জায়গায় দুটি স্তর মিশে গিয়েছে। এত পুরু স্তরবিশিষ্ট খনি কোথাও নেই। পুরু স্তরের ক্ষেত্রে খননের সময় কয়লাতে আগুন লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেড়ে যায়।

মাটির তলায় তলায় সুরঙ্গ করে মাল কেটে বের করে আনার পদ্ধতিতে এখন আর খনিকাজ হয় না। এখন হয় খোলামুখ খনি। ওপেন কাস্ট মাইনিং প্রজেক্ট বা সংক্ষেপে ওসিপি। ওপর থেকে সমস্ত কিছু সরিয়ে দিয়ে — বাড়িঘর গাছপালা, রাস্তাঘাট, মানুষ, পাখি, মাটি, পাথর — সবকিছু উপড়ে খুড়ে তাড়িয়ে অন্যত্র ডাম্প করে তলার মাল চেঁছে নিয়ে যাওয়ার নাম খোলামুখ খনি। খনিবিদরা ওপরের এই সবকিছুকে বলেন ওভার বার্ডেন বা ওপরের বোঝা। ওভার বার্ডেনের মধ্যে যদি মানুষের বসতিও থাকে তখন সেই প্রকল্পকে ওঁরা বলেন গ্রিনফিল্ড প্রজেক্ট। দেউচা-পাঁচামী-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙ্গা খোলামুখ কয়লাখনি প্রকল্প বহু হাজার মানুষকে অন্যত্র ডাম্প করবে, তাই ওদের পরিভাষায় এটি একটি সবুজক্ষেত্র প্রকল্প। খোলামুখ খনির সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব অনেক বেশি। ডব্লিউবিপিডিসিএল’র প্রেজেন্টেশনে বলা হচ্ছে যে তারা সামাজিক প্রভাব সমীক্ষা করেছে যদিও তা অসম্পূর্ণ, এলাকার মোট গ্রামের অর্ধেকও কভার করা যায়নি। এই অসম্পূর্ণ সমীক্ষা-রিপোর্টটিও সরকার এখনও জনসমক্ষে আনেনি এবং পরিবেশ সংক্রান্ত কোনওরকম সমীক্ষাই সরকার এখনও করেনি, কোন আইন বলে সরকার জমি নিতে শুরু করেছে তাও কদাপি জানায়নি।

Impact of Deucha-Panchami coal mine

‘পরিবেশ’ বলতে বোঝায় জল, মাটি ও বাতাস এবং এসবের নিজেদের মধ্যে ও এসবের সাথে মানুষের ও অন্যান্য সমস্ত জীবজগৎ ও অণুজীবজগতের সামগ্রিক পারস্পরিক সম্পর্ক ও বৈশিষ্ট্যসমূহকে। কয়লাখনি পরিবেশকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। কোল ইণ্ডিয়ার পক্ষ থেকে বিশেষ জোর দিয়ে বলা হয়েছে কয়লাখনির পরিকল্পনা রচনার আগেই পরিবেশ সংক্রান্ত প্রভাব খতিয়ে দেখতে হবে। কিন্তু দেউচা-পাঁচামী প্রকল্পে সরকারের পক্ষ থেকে পরিবেশ সংক্রান্ত কোনওরকম সমীক্ষাই করা হয়নি। তবু আমরা পরিবেশ বিজ্ঞানীদের তোলা প্রশ্নগুলি সাধারণ বুদ্ধিতে বিবেচনা করে দেখতে পারি এবং অন্যান্য খোলামুখ খনি অঞ্চলের অভিজ্ঞতা খতিয়ে দেখতে পারি। বহু হাজার মানুষ উচ্ছিন্ন হবে এবং উচ্ছেদ হবে বহু ধরণের স্তন্যপায়ি ও অন্যান্য পশু ও পাখি। বিপুল পরিমাণ গাছ-গাছালি হারিয়ে যাবে, এবং নষ্ট হয়ে যাবে বিশাল পরিমাণ ক্ষেতের মাটি বা ‘টপ সয়েল’ যা বহু যুগ ধরে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠে। এইসব তাৎক্ষণিক ও স্থানীয় প্রভাব ছাড়াও বিস্তীর্ণ এলাকার বাস্তুতন্ত্র, কৃষি, জল ও আবহ মণ্ডলে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। বায়ু দূষণের প্রভাব রামপুরহাট, বোলপুর, সিউড়ি সমেত অনেক দূরের শহরেও পৌঁছবে।

খনি লাগোয়া সব গ্রামগঞ্জ বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে

খনি লাগোয়া বসতি থেকে ধীরে ধীরে সরে যেতে হবে সকলকে। ব্যাসল্ট পাথর সরাতে মুহুর্মুহু ব্লাস্টিং বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ এবং ভূকম্পন জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে। চারপাশে জমে উঠবে ওভার বার্ডেনের ধূলো-বালির পাহাড়। মাটির তলা থেকে উঠে আসা মাটি-পাথরের সাথে মিশে থাকা বিভিন্ন বিষাক্ত ও ধাতব যৌগের কণা বৃষ্টিতে ধুয়ে ছড়িয়ে পড়বে বহুদূর পর্যন্ত, বিষিয়ে তুলবে ভূপৃষ্ঠ ও জলাধার। গবাদি পশু সহ সমস্ত পোষ্য ও অন্যান্য জীবকুলকে বিপন্ন করে তুলবে। খোলামুখ খনি যত গভীর হবে তত নেমে যেতে থাকবে ভূগর্ভস্থ জলস্তর, টিউবওয়লে আর খাবার জল পাবে না গ্রামবাসীরা। সামাজিক জীবনও আর আগের মতো থাকবে না। সস্তায় জমিজমা বেচে দিয়ে পালিয়ে বাঁচতে হবে। পাশের জেলা পশ্চিম বর্ধমানের রাণীগঞ্জ কয়লাখনি এলাকার দিকে তাকালেই এই হাহাকার স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়।

ঝাড়খণ্ডের কয়লাখনি এলাকার একটি সমীক্ষার রিপোর্ট

ঝাড়খণ্ডের রামগড় জেলায় চাহরি কয়লাখনির আশপাশের গ্রামগুলিতে চালানো একটি সমীক্ষার সদ্য প্রকাশিত রিপোর্ট আমাদের সামনে আছে। এখানকার বাতাস, মাটি ও জলের নমুনা সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে,

  • বাতাসে সবচেয়ে মারাত্মক ধরণের দূষক কণা ‘পিএম২.৫’র তীব্রতা এইসব গ্রামগুলিতে ভারত সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া বিপদসীমাকে পেরিয়ে গেছে। বাতাসে ম্যাঙ্গানিজ, নিকেল, সিলিকনের মতো বিষক্রিয়া সম্পন্ন ভারী ধাতব কণার পরিমাণও স্বাস্থ্যসীমা পেরিয়ে গেছে।
  • মাটিতে আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, নিকেল ও ভ্যানাডিয়ামের মতো ধাতুকণার পরিমাণ মানুষের স্বাস্থ্য ও বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক মাত্রায় জমা হয়েছে।
  • জলে অ্যালুমিনিয়াম, লোহা ও ম্যাঙ্গানিজ সহ বিভিন্ন কঠিন কণা এবং ক্রোমিয়াম ও নিকেলের মতো বিষাক্ত কণা এমন মাত্রায় পাওয়া গেছে যে সেই জল ভারতের স্ট্যাণ্ডার্ড অনুযায়ী পানীয় হিসেবে গ্রহণীয় নয় এবং সমস্ত জলজ প্রাণীর পক্ষেও বিপজ্জনক।

এই সমীক্ষা রিপোর্টে কয়লাখনির চারপাশের গ্রামগুলির জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে বলা হচ্ছে,

  • শ্বাসকষ্ট, পেশী ও হাড়ের সমস্যা, চর্মরোগ, পায়ের তলা ফেটে যাওয়া ও চুল পড়ে যাওয়া এইসব গ্রামগুলিতে সাধারণ রোগ হিসেবে হাজির হয়েছে।
  • এইসব শারীরিক সমস্যাগুলি দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। জ্বলুনি হচ্ছে, কিন্তু ছোঁয়াচে নয়। অর্থাৎ রোগগুলি জীবাণু-ঘটিত নয় বরং পরিবেশ বিষিয়ে যাওয়ার ফল।
  • শ্বাসকষ্ট, কাশি বা বুকের ভেতর অস্বস্তি হওয়ার কেসগুলি থেকে বোঝা যায় যে খনি উদ্ভুত দূষিত বাতাসে তাঁরা ক্রমাগত শ্বাস নিচ্ছেন।
  • চর্ম, চোখ, চুল ও পায়ের পাতার সমস্যাগুলি থেকে একথা বলা যায় যে দূষিত পদার্থের সংস্পর্শে থাকতে হচ্ছে।
  • কম বয়সীদের মধ্যে পেশী ও হাড়ের বিবিধ সমস্যা বিশেষ চিন্তার বিষয় এবং সে বিষয়ে ধ্যান দেওয়া খুব জরুরি।

এই ধরনের সমীক্ষা ও তা থেকে বেরিয়ে আসা সত্য নতুন কিছু নয়। এলাকা জুড়ে খোলামুখ কয়লাখনির বিষাক্ত প্রভাব চর্চিত ও পরীক্ষিত সত্য। কয়লা খনন, পরিশোধন ও দহন — এই পুরো প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপই যে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক ও অধিবাসীদের জন্য ও বাস্তুতন্ত্রের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর তা সর্বজনবিহিত সত্য। দেউচা-পাঁচামী-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিঙ্গা কয়লাখনি প্রকল্পের ধ্বংস সাধনের মাত্রা অনেক বেশি হবে, মূলত এই খোলামুখ খাদানটির অবিশ্বাস্য গভীরতা, ব্যপ্তি ও ভূতত্ত্বের কারণে।

coal mine on the environment of the area

দেউচা ব্যারেজ, তিলপাড়া ব্যারেজ ও ম্যসাঞ্জোর ব্যারেজ এবং দ্বারকা নদীর অস্তিত্ব সংকট হতে পারে

দেউচা ব্যারেজ কি টিকে থাকবে? থাকলেও তার জল কি ব্যবহারযোগ্য থাকবে? প্রস্তাবিত খনির গায়েই দ্বারকা নদীর ওপর দেউচা ব্যারেজ। দক্ষিণে ১৪ কিলোমিটার দূরে ময়ুরাক্ষী নদীর ওপর তিলপাড়া ব্যারেজ এবং পশ্চিমে ৩৭ কিলোমিটার দূরে ম্যাসাঞ্জোর। গভীর গর্তে বিস্ফোরণের ফলে জলাধারগুলির দেওয়ালের সহন ক্ষমতা হ্রাস পায়। এবিষয়ে গবেষণাপত্র আছে। দেউচা প্রকল্পের ক্ষেত্রে এই প্রভাব অনেকগুণ বেশি হওয়ার কথা এর অস্বাভাবিক গভীরতা ও শক্ত পুরু পাথরের স্তরের কারণে। ব্যাসল্ট পাথরের বিপুল পুরু স্তর চূর্ণ করতে উচ্চ ক্ষমতার বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে বছরের পর বছর। মাটির অনেক গভীরে এই বিস্ফোরণ ঘটবে। অনেকটা পরিধি পর্যন্ত তীব্র মাত্রার ভূমিকম্প ঘটাবে। দেউচা, তিলপাড়া ও ম্যাসাঞ্জোরে তার প্রভাব কী দাঁড়াবে?

ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভ জল উৎসে মারাত্মক প্রভাব পড়ে

মারাত্মক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে জলের উৎসগুলির ওপর। ভূপৃষ্ঠের জল এবং ভূগর্ভস্থ জল, উভয়ের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। খনিকার্যের বর্জ‍্য মিশ্রিত জল উপচে বা চুঁইয়ে আসা, ভূমি ক্ষয়ে যাওয়া, জলের তলদেশে বিভিন্ন ভারী গুঁড়ো থিতিয়ে আস্তরণ তৈরী হওয়া, খনিজাত অ‍্যসিড প্রবাহ, জলস্তর নেমে যাওয়া, জলচক্র ও বৃষ্টিপাতের সাম‍্য অস্থির হয়ে পড়া ইত‍্যাদি কারণগুলিকে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। এসবের মধ‍্যে অ‍্যসিড প্রবাহ সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব সৃষ্টিকারী। জলের উৎসের ওপর সবচেয়ে মারাত্মক, বহু দূর ব‍্যাপী বিস্তৃত এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে খনিজাত অ‍্যসিড প্রবাহ। খনির যে কোন অংশ থেকে যে কোনোভাবে সালফেট যুক্ত পদার্থ বাতাস ও জলের সংস্পর্শে এলে সালফিউরিক অ‍্যাসিড তৈরি হয়। এই অ‍্যসিড মিশে যায় ভূপৃষ্ঠের জলে, খাল বিল নদী নালার মাধ‍্যমে ছড়িয়ে পড়ে নামোর দিকে বহু দূর পর্যন্ত। সমস্ত জলজ প্রাণী তো বটেই, কৃষির ওপরও তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। সমস্ত খনন কাজেই এইভাবে অ্যাসিড প্রবাহ ঘটে। খোলা খাদানের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি হয়। দেউচা-পাঁচামী’র ১২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ১ কিলোমিটার গভীর গর্ত খুড়ে যে বিপুল পরিমাণ বর্জ‍্যের পাহাড় চারপাশে জমা হবে সেখান থেকে বৃষ্টির জলধারা বেয়ে, হাওয়ায় উড়ে দ্বারকা নদী আর দেওচা ব্যারেজের ক্যানেল বরাবর অ্যাসিড প্রবাহ বীরভূম ও মুর্শিদাবাদের কৃষি-জীবনকে কত বছর ধরে ক্ষতগ্রস্ত করতে পারে তা ভেবে দেখা দরকার।

বিস্তীর্ণ এলাকায় জলসংকট দেখা দেবে

ভূগর্ভস্ত জলও দূষিত হয়ে পড়ার নানারকম সম্ভাবনা থাকে যেগুলি ভূপৃষ্ঠের জলের ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম। কিন্তু তাৎক্ষণিক বড় সংকট দেখা দেবে জলস্তর নেমে যাওয়ায়। খনিগর্ত ভূগর্ভস্থ জলস্তরকে (ওয়াটার টেবিল) ছেদ করলে জল জমা হতে থাকে। খনিগর্তে জমা এই জল ছেঁচে বের করা হয়। শুধু ছেঁচে শেষ হয়না, শুষে বের করতে হয়। অর্থাৎ একটার পর একটা জলস্তরকে শেষ করতে করতে গভীরে যাবে এই খোলা খাদান। চারপাশের এলাকার ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যেতে থাকবে। খনিবিদেরা এই ঘটনাকে ইংরেজিতে বলেন ‘ড্র-ডাউন’। কত বড় পরিধি জুড়ে এই অধপতন হবে তা নির্ভর করে ওই অঞ্চলের উদস্থিতি ও ভূতত্ত্ব এবং খনির আকার আকৃতির ওপর। দেউচা-পাঁচামী এলাকার পাথর খাদান সংলগ্ন গ্রামগুলিতে জলস্তরের এই অধপতন এখনই দেখা যায়। পাথর খাদান হয় মূলত ভূপৃষ্ঠে উঁচু হয়ে বেরিয়ে আসা পাথুরে এলাকায় (তাই এলাকার চলতি ভাষায় এইসব খাদানকে ‘পাহাড়’ বলা হয়)। তাতেই দেখা যায় গ্রামের টিউব-ওয়েলে জল আসে না; আরও গভীর লেয়ার থেকে সাব-মার্শিবল পাম্প দিয়ে কিছুক্ষণ জল তোলার পর ঘণ্টা দুয়েক বন্ধ রাখলে তবেই আবার জল পাওয়া যায়। এক কিলোমিটার গভীর যে কয়লা খাদান করবে বলছে, তা কত দূর দূর পর্যন্ত গ্রামগঞ্জে জলসংকট ঘটাবে সেসব এখনও ভেবেই দেখেনি সরকার, সমীক্ষা করে তা জনসমক্ষে আনা তো অনেক দূরের কথা।

South 24 Parganas District Conference

গত ১৩ মার্চ সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ১১তম দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল জেলা সদর বারুইপুরে।

জেলার আরো প্রত‍্যন্ত অঞ্চলে পার্টি কাজের বিকাশের লক্ষ‍্যে এবং গতিরুদ্ধতায় পড়ে যাওয়া অঞ্চলে রাজনৈতিক গতি প্রদানের উদ্দেশ‍্যে বিদায়ী জেলা কমিটি বারুইপুরে জেলা সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেয়। সোনারপুর-বারুইপুরের ছোট ছোট আন্দোলনের সফলতাগুলোই বিদায়ী জেলা কমিটিকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায‍্য করেছে। জেলা সম্মেলন সফল করে তুলতে বারুইপুরের গণতান্ত্রিক মানুষের অক্লান্ত সহযোগিতাও চোখে পড়েছে। ৭০ দশকের প্রবীণ ও  আজকের নবীন প্রজন্মের যারা লড়াইয়ে আগুয়ান তাদের সবাই বিপুল উৎসাহে এই সম্মেলনে সামিল হয়েছেন।

সম্মেলন স্থানের নামকরণ করা হয়েছিল সম্প্রতি পুলিশের পোশাক পরিহিত গুন্ডাদের দ্বারা নিহত লড়াকু ছাত্র আনিস খান নগর, বারুইপুর।

শহীদ স্মরণ অনুষ্ঠানে রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন বর্ষীয়ান শিশির চ‍্যাটার্জী, শহীদ বেদীতে মাল‍্যদান করেন সম্মেলনে রাজ‍্য কমিটির পর্যবেক্ষক বাসুদেব বসু, বিদায়ী জেলা সম্পাদক সহ এরিয়া/লোকাল কমিটি ও গণসংগঠনের সম্পাদকরা, অতিথি প্রবীর দাস, বাবুন চ‍্যাটার্জী, সৌমিত্র বসু প্রমুখ অনেকে।

শতাধিক প্রতিনিধি ও অতিথিদের উপস্থিতিতে নদীয়ায় তৃণমূলী গুন্ডাদের হাতে নিহত প্রান্তিক কৃষক শহীদ কমরেড বানের সেখ সভাগৃহে সম্মেলন শুরু হয়। উস্থির শহীদ কমরেড হরেন মন্ডল মঞ্চে সম্মেলন পরিচালনা ও স্টিয়ারিং করলেন ৭৫ শতাংশ তরুণ প্রতিনিধিরা। প্রতিনিধিদের মধ‍্যে মহিলাদের উপস্থিতি ভালোই ছিল। মোট ২১ জন বক্তব‍্য রাখেন, যাদের মধ্যে ৪ জন মহিলা, ২ জন ছাত্রী, যুবদের থেকে বক্তব‍্য রাখেন ৫ জন।

সম্মেলনের শুরুতে ব‍্যবস্থাপক কমিটির আহ্বায়ক প্রতিনিধি বর্ষীয়ান কমরেড শিশির চ‍্যাটার্জী সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের সম্বোধিত করে বক্তব্য রাখেন। রাজ‍্য কমিটির পর্যবেক্ষক বাসুদেব বসু বলেন, ফ‍্যাসিবাদী বিজেপি স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ‍্য দিয়ে অর্জিত সংবিধানকে ধ্বংস করে মনুসংহিতা রচিত হিন্দুত্বের সংবিধান বাস্তবায়িত করতে চাইছে, ক্রোনি ক‍্যাপিটালিজিমের সেবা করতে চাইছে। তার বিরুদ্ধে সমস্ত শক্তিকে ঐক‍্যবদ্ধ করতে হবে। রাজ‍্যে তৃণমূলের দুর্নীতি, দলবাজি ও দমনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান রাখেন তিনি।

‌শ্রমজীবী যুব প্রতিনিধি তীব্র ভাষায় জেলা কমিটির দুর্বলতা যা তার মনে হয়েছে তা তুলে ধরেছেন। ক্ষেতমজুর ঘর থেকে আসা মহিলা প্রতিনিধি ২ জন, ১০০ দিনের মজুরি প্রদানে দুর্নীতি বন্ধ করা এবং বছরে ২০০ দিন কাজ ও ৬০০ টাকা দৈনিক বেতনের দাবিতে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেন। শ্রমিক প্রতিনিধি বলেন লকডাউনের পর দর্জী শিল্পে সংকট নেমে এসেছে এই অজুহাতে বড় বড় পোষাক শিল্পের মালিকরা দর্জি শিল্পের শ্রমিকদের অধিকার হরণ করে চলেছে। এদের পাশে শাসক ও বিরোধী দলগুলো কেউ নেই। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে ইউনিয়ন গড়ে তোলার জন‍্য। একজন মহিলা প্রতিনিধি বলেন পূজালী বজবজের একটা বড় অংশে অন‍্য বামপন্থীদের কোনও কর্মসূচিই দেখতে পাচ্ছি না। শুধুমাত্র বামশক্তি হিসাবে আমাদের কার্যকলাপ যা চলছে তাকে আরো বৃদ্ধি করতে হবে। নবাগত দুজন ছাত্রী কমরেড খসড়ার ওপর বলেন নরেন্দ্রপুর থানার পুরুষতান্ত্রিক কায়দায় যেভাবে মহিলাদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে তা খসড়ায় আরো ভালো করে বিবরণ দিতে হবে। অসংগঠিত শ্রমিক প্রতিনিধি বলেন শহরতলী বিষ্ণুপুর সাতগাছিয়া, বজবজ, মহেশতলা জুড়ে যেভাবে কৃষিজমিকে অকৃষিতে পরিণত করে প্রোমোটিং করছে তা ক্ষতিকারক, আগের সরকারের আমলে শুরু হলেও বর্তমান শাসক তৃণমূলের জমানায় তার দাপাদাপি ভয়ংকর, পরিবেশেরও ক্ষতি হচ্ছে। সরকারী নিয়োগে দুর্নীতি লাগাম ছাড়া। বিশেষ করে সোনারপুর বারুইপুরের ছাত্র যুব ও সোনারপুরের পৌরসভার প্রার্থী কমরেড বলেন আমরা নতুন কাজ করতে গিয়ে দু’একজনকে নিয়মিত দেখতাম মনে হতো পার্টিটা ছোট। আজ দেখছি আমরা অনেকে আছি। বিগত সম্মেলন থেকে এবার প্রতিনিধি সংখ‍্যা বেশি ও মেজাজ ছিল তুঙ্গে।

যুব কমরেড সাংস্কৃতিক কর্মী সেখ সাবিরের গণসঙ্গিত, বাচিক শিল্পী ছাত্রী কমরেড শ্রাবণী নাথের আবৃত্তি এবং বর্ষীয়ান লেখক কমরেড কৌনিক সেন (মোহন মন্ডল)-র স্বরচিত কবিতা সম্মেলনকে সমৃদ্ধ করে। আগের রাতে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সম্মেলনে উপস্থিত হতে না পারার বেদনা থেকে সম্মেলনের সফলতা কামনা করে এবং আগামী ২৩ মার্চ শহীদ-ঈ-আজম ভগৎ সিং’এর শহীদ দিবস ছাত্র-যুব-সাংস্কৃতিক-সাংস্কৃতিক সংস্থা যাতে মিলিতভাবে বড় করে উদযাপন করে তার আহ্বান রেখে বার্তা পাঠান কমরেড দেবাশীষ মন্ডল। প্রতিনিধিরা বলেন জুট, কৃষি নানা বিষয় এবং সংগঠনকে ব্রাঞ্চ/লোকাল/এরিয়া কমিটিগুলো নিয়মিত ও শক্তিশালী করতে হবে না হলে বর্তমান শাসকদের নানা হামলা মোকাবিলা করা যাবেনা। আগামীদিনে আন্দোলনকে জোরালো করতে লক্ষাধিক টাকার তহবিল গড়ে তোলার আহ্বান রাখা হয়।

বিদায়ী সম্পাদক তার জবাবী ভাষণে বলেন বৃহত্তর সমাজে যখন গণতন্ত্র প্রতিমুহূর্তে ধূলায় লুন্ঠিত হচ্ছে, তখন পার্টির মধ‍্যে নেতৃত্বকে সমালোচনা করার পরিবেশকে উন্নত করতে হবে। তা যতই তীক্ষ্ণ, তীব্র হোক না কেন। সমালোচনা যে করে সে পার্টির বিকাশ চায়, সেই কমরেডই আত্মসমালোচনায় দৃষ্টান্ত তৈরী এবং নিজের দায়িত্ব কতটা পালন করলেন তার হিসাব আগে দেওয়ার মানসিকতা রাখেন। সমস্ত সংযোজনী-সংশোধনী সহ খসড়া সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।

বিদায়ী কমিটি ১৭ জনের কমিটির প্রস্তাব রাখে এবং তা গৃহীত হয়। প্রস্তাবিত কমিটি সদস‍্যদের নামের তালিকা ও সম্পাদক সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত হন। পুর্ননির্বাচিত সম্পাদক কিশোর সরকার তার সংক্ষিপ্ত বক্তব‍্যে বলেন, সামনের দিন জোর লড়াই। আসুন সমস্ত পার্টি সদস্যদের ঐক‍্যবদ্ধভাবে পার্টির পরিচালনায় জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলার শপথ নিই। তাই আজই সম্মেলনের শেষে ২৮-২৯ মার্চ দেশব‍্যাপী ধর্মঘটের আহ্বান নিয়ে রাজপথে মিছিল হোক। আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মধ‍্য দিয়ে সম্মেলন শেষ হয়। ধর্মঘট সফল করার আহ্বান নিয়ে সম্মেলনের হল থেকে বারুইপুর স্টেশন পর্যন্ত মিছিল হয়।

Calcutta District Conference

উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে সম্পন্ন হল সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কলকাতা ১৪তম জেলা সম্মেলন। ভবানীপুর-কালীঘাট এলাকার জনপ্রিয় প্রয়াত কমরেড অরূপ চ্যাটার্জি (রূপা) নামাঙ্কিত সভাগৃহ (তপন থিয়েটার), কমরেড মিহির রায়চৌধুরী-বরুণ ঘোষ মঞ্চে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন শুরু হওয়ার আগে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পতাকা উত্তোলন, শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও শহীদ স্মরণ করা হয়। পতাকা উত্তোলন করেন এলাকার জনপ্রিয় বর্ষীয়ান কমরেড রমানাথ দাস (ছোটনদা)। রাজ্য কমিটি সদস্য অনিমেষ চক্রবর্তী, বাসুদেব বোস, জেলা সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী, নীতীশ রায়, নিত্যানন্দ ঘোষ সহ একে একে জেলা কমিটির সদস্যবৃন্দ মাল্যদান করেন।

নীতীশ রায়ের উদ্বোধনী গণসঙ্গীত ও রাজ্য কমিটির পর্যবেক্ষক অনিমেষ চক্রবর্তীর উদ্বোধনী ভাষণের পর প্রতিনিধি অধিবেশন শুরু হয়। রাজ্য পর্যবেক্ষক রাজ্য পরিস্থিতি তুলে ধরে পার্টির রাজনৈতিক অবস্থানকে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, বিগত বিধানসভা নির্বাচন নিছক রাজ্য স্তরে আটকে থাকেনি, তা রীতিমতো সর্বভারতীয় এক পরিঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। আসাম, বিহারের পর এই রাজ্যটাকেও দখল করতে বিজেপি’র সর্বভারতীয় নেতৃত্ব মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অন্যান্য রাজ্যও অধীর আগ্রহ নিয়ে এই রাজ্যের ফলাফলের উপর নজর রাখতে শুরু করে। আমাদের পার্টি তখন এই মারাত্মক বিপদকে রোখার উপরই প্রধান জোর দেয়, সেই অভিমুখেই পরিচালিত হয় আমাদের কর্মকৌশল। বিজেপি’র সেই আশু বিপদকে ঠেকানোর পর এবার আমাদের এই রাজ্য সরকারের ক্রমে উন্মোচিত হয়ে পড়া জনবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। তবে, মোদী-মমতাকে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ গণ্য করে সিপিআই(এম)-র অনুসৃত কর্মকৌশলের সাথে স্পষ্ট পার্থক্য রেখা টেনেই।

বিদায়ী জেলা কমিটির সম্পাদক অতনু চক্রবর্তী খসড়া প্রতিবেদন সম্মেলনে পেশ করেন। রাজ্যে বিজেপি’র রাজনৈতিক-সাংগঠনিকভাবে যে ধারাবাহিক ক্ষয় শুরু হয়েছে, তার বিরুদ্ধে ও বিপ্রতীপে বামেদের প্রধান বিরোধী দল হিসাবে সামনে আসার অভিমুখে উঠে আসার কর্তব্য কর্ম প্রতিবেদনে রাখা হয়েছে।

বিগত কয়েকবছর কোভিড গোটা দেশ-দুনিয়া জুড়ে যে মারাত্মক আঘাত হেনেছে অর্থনীতি-স্বাস্থ্য ব্যবস্থা-শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে, তাকেই খসড়ার প্রস্থান বিন্দু করে নতুন কয়েকটি ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করেছে আগামী কাজের লক্ষ্যে। কলকাতা পার্টির গুরুতর গণবিচ্ছিন্নতা কাটাতে প্রতিটি পার্টি কমিটি ও কাঠামোকে ওয়ার্ড ভিত্তিক কাজের ধারাকে দৈনন্দিন অনুশীলনের অঙ্গ হিসাবে নেওয়া, এক বা একাধিক ওয়ার্ডকে চিহ্নিত করে ধারাবাহিক কাজের পরিকল্পনা করার লক্ষ্যেই ব্রাঞ্চগুলোকে আগামীদিনে কাজ করতে হবে। এর পাশাপাশি, কলকাতার নাগরিক, পরিবেশগত সমস্যার উপর কলকাতা ভিত্তিক এক নাগরিক সনদ সূত্রবদ্ধ করার কাজ আগামী জেলা কমিটিকে করতে হবে।

মিড ডে মিল-সাফাই কর্মী-পরিবহন ক্ষেত্রকে সংগঠিত করার উপর জোর রেখে, ক্রমশ বেড়ে চলা ইনফর্মাল কর্মীদের ইউনিয়ন ভুক্ত করতে খসড়া জোর দিয়েছে।

কোভিডে সবচেয়ে বেশি সংকটাপন্ন মহিলা সমাজ অস্বাভাবিক হারে যেভাবে উৎখাত হয়েছেন শ্রমবাজার থেকে, যেভাবে তাঁদের মজুরি কমিয়ে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে, তার উপর বিশেষ কর্মসূচির কথা বলা হয়েছে খসড়ায়। কলকাতার ভগ্নপ্রায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যা কোভিড চোখে আঙুল তুলে দেখালো, তার বিপরীতে জনস্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনও সামনে এসেছে। কোভিড শিক্ষাক্ষেত্রে যে অকল্পনীয় হারে ডিজিটাল বিভাজন সৃষ্টি করল, তার বিপরীতে পদক্ষেপ ও দাবি-দাওয়া তৈরি করতে হবে।

এবারের খসড়া বিশেষ জোর দিয়েছে কলকাতার আতঙ্কজনক পরিবেশের উপর। জলবায়ু-পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিকে অ্যাজেন্ডা হিসাবে সামনে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সম্মেলন। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক শিক্ষাশিবির সংগঠিত করা, সামাজিক মাধ্যমের প্রচারকে তীব্রতর করার উপর গুরুত্ব প্রদান, গণসংগঠনগুলোর ন্যূনতম ১০ শতাংশ সদস্যকে পার্টি সদস্যে রূপান্তরিত করা, মহিলা ও তরুণ প্রজন্মকে পার্টিতে বেশি করে নিয়ে আসা প্রভৃতি দিকগুলোর উপর খসড়া জোর দিয়েছে।

৩০ জন প্রতিনিধি, যারমধ্যে ৬ জন মহিলা, প্রতিবেদনের উপর বক্তব্য রাখেন। খোলামেলা পরিবেশে সমালোচনা, বিবিধ পরামর্শ, নানান নতুন দিক থেকে প্রতিবেদনকে আলোকপাত করার এক চমৎকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সম্মেলনে বজায় ছিল।

বিদায়ী কমিটির সম্পাদক বিতর্কগুলোর সারসংকলন করে সমালোচনাগুলো গ্রহণ করেন, কমিটির নানান ব্যর্থতার জন্য আত্মসমালোচনা করেন, এবং সবশেষে প্রতিবেদনটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

পরিবেশ জীবন জীবিকা ও সার্বিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী দেউচা-পাঁচামী কয়লাখনি প্রকল্প বাতিল, আনিস হত্যা ও নরেন্দ্রপুরে পুলিশী নির্যাতন এবং দোষী পুলিশ অফিসারদের শাস্তির দাবিতে, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অবসান ও শান্তির সপক্ষে এবং আসন্ন ২৮-২৯ মার্চ সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটকে সর্বাত্মকভাবে সফল করা — সম্মেলনে এই চারটি উত্থাপিত প্রস্তাব ও সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

সবশেষে সম্মেলন সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে ২১ জনের নতুন কমিটি যারমধ্যে মহিলা সদস্য সংখ্যা ৫ এবং জেলা সম্পাদক হিসাবে অতনু চক্রবর্তী পুনরায় নির্বাচিত হন।

সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মোট ৬৫ প্রতিনিধি, ২২ জন পর্যবেক্ষক ও অতিথি। মোট মহিলা প্রতিনিধি ছিলেন ১৭। সম্মেলন স্থলে দু’টি স্মারকস্তম্ভ করা হয় কালীঘাট চেতলা অঞ্চলের চার শহিদ কমরেড সর্বানী বসু, রঞ্জিত সাহা, পরিতোষ মুখার্জি (ফটিক) এবং পল্টু ভট্টাচার্য’র স্মরণে।

চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী, মমতা ঘোষ, দিবাকর ভট্টাচার্য, রণজয় সেনগুপ্ত, রতন রায় — এই পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সভাপতিমন্ডলী সম্মেলন পরিচালনা করেন, এবং সভাপতিমন্ডলীকে সাহায্য করেন তিন সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটি — তরুণ সরকার, অভিজিত সরকার এবং অনন্যা চক্রবর্তী।

আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

Burdwan_E District Conference

গত ১০ মার্চ পুর্বস্থলী শ্রীনাথ সদনে পঞ্চদশ পুর্ব বর্ধমান জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল জেলা কমিটির প্রয়াত সদস্য কমরেড সুনীল বসু নামঙ্কিত নগর ও শ্যামাপদ রায়, শান্তনু বক্সী ও তিনকড়ি ভট্টাচার্য সভগৃহ এবং কমরেড মলিনা ভট্টাচার্য, মীরা ব্যানার্জী ও কণা সরকার নামাঙ্কিত মঞ্চে। পতাকা উত্তোলন ও শহীদ বেদীতে মাল্যদান এবং শহীদ স্মরণে  নিরবতা পালনের মধ্যে দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের পরে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। সম্মেলন পরিচালনা করেন জেলা কমিটি সদস্য রফিকুল ইসলাম। জেলা সম্পাদক সলিল দত্ত সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক সুচনা করেন। পাঁচজনের সভাপতিমন্ডলী ও তিনজনের স্টীয়ারিং কমিটি গঠন হয়। সভাপতি মন্ডলীর সভাপতি নির্বাচিত হন অন্নদাপ্রসাদ ভট্টাচার্য। উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের রাজ্য সম্পাদক বাবুনি মজুমদার ও শিল্পী মেঘনা মজুমদার। উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন সম্মেলনের রাজ্য কমিটির পর্যবেক্ষক তপন বটব্যাল। বিদায়ী সম্পাদক তাঁর খসড়া প্রতিবেদন পাঠ করার পর পলিট ব্যুরো সদস্য  কার্তিক পাল বক্তব্য রাখেন। তারপর প্রতিনিধিদের বক্তব্য শুরু হয়। ২০ জন প্রতিনিধি প্রতিবেদনের উপর মতামত রাখেন। বিদায়ী সম্পাদকের জবাবী ভাষণের পর সংযোজন সংশোধনী সহ প্রতিবেদন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। পর্যবেক্ষক কমিটি নির্বাচন পর্ব পরিচালনা করেন। সর্বসম্মতিতে ২৫ জনের নতুন জেলা কমিটি নির্বাচিত হয়।  সলিল দত্ত জেলা সম্পাদক  হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন।

West Burdwan District Conference

বর্ধমান জেলা দুটো ভাগে ভাগ হওয়ার পর পশ্চিম বর্ধমান জেলার প্রথম সম্মেলন কমরেড রবিন ঘোষ ও কমরেড মীরা সান্যাল নগর এবং কমরেড ব্রিজবিহারী পান্ডে ও কমরেড ধূর্জটিপ্রসাদ বক্সী মঞ্চ, আসানসোল বার এসোসিয়েশন হলে অনুষ্ঠিত হয়। স্বদেশ চ্যাটার্জী দ্বারা রক্তপতাকা উত্তোলন করার মধ্যে দিয়ে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। প্রদীপ ব্যানার্জি, সন্ধ্যা দাস ও বাবুরাম দাস — এই তিনজন সদস্য নিয়ে সভাপতিমন্ডলী গঠিত হয়। উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন অনুপ মজুমদার। এরপর রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদারের উদ্বোধনী বক্তব্যের পর সম্মেলনের মূল কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। প্রতিনিধিদের উদ্দেশে খসড়া প্রতিবেদন পাঠ করেন বিদায়ী জেলা সম্পাদক সুরেন্দ্র কুমার। ১১ জন মহিলা সহ মোট ৬৪ জন প্রতিনিধি এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। রাজ্য কমিটি থেকে পর্যবেক্ষক ছিলেন বাবলু ব্যানার্জি এবং অতিথি ছিলেন কার্তিক পাল। সবশেষে ১ জন মহিলা সহ মোট ১৩ জনের জেলা কমিটি নির্বাচিত হয় এবং নবনির্বাচিত জেলা কমিটি সুরিন্দর কুমারকে সম্পাদক পুনর্নির্বাচিত করে। আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘটে।

conference in Cooch Behar district

কুচবিহার শহরের ফিল্ম সোসাইটি হলে ৫ মার্চ সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ১৩তম কুচবিহার জেলা কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ৫৯ জন কর্মী উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনের প্রারম্ভে পতাকা উত্তোলন করেন বর্ষীয়ান নেতা মেহের আলি। সমস্ত শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। সম্মেলনে পার্টির রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, রাজ্য কমিটি সদস্য বাসুদেব বসু বক্তব্য রাখেন। রাজ্য কমিটি সদস্য চঞ্চল দাস উপস্থিত থাকেন। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী জেলা আলিপুরদুয়ার থেকে বর্ষীয়ান নেতা সুশীল চক্রবর্তী, সুনীল রায় বক্তব্য রাখেন। সম্মেলনে প্রতিবেদন পেশ করেন বাবুন দে। প্রতিবেদনের উপর ১১ জন বক্তব্য রাখেন। প্রতিবেদন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ার পর আগামী ২ বছরের জন্য ১১ জনের জেলা লিডিং টিম গঠিত হয়। মুকুল বর্মন সম্পাদক নির্বাচিত হন। সম্মেলনের শেষে সন্ধ্যাবেলা শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড় দেশবন্ধু বাজারের সামনে আগামী ২৮-২৯ মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘটের সমর্থনে পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। পথসভায় বক্তব্য রাখেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, বাসুদেব বসু, মুকুল বর্মন, শ্যামল ভৌমিক, বিপ্লব দাস প্রমুখ।

aicctu all india strike
খণ্ড-29
সংখ্যা-11