আজকের দেশব্রতী : ৩ মার্চ ২০২২ (অনলাইন সংখ্যা)
ajker_deshabrati_3_march-22

Protests in Siliguri

রাশিয়া ইউক্রেন থেকে হাত ওঠাও!
অবিলম্বে সামরিক আগ্রাসন বন্ধ কর!

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন ও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া অবিলম্বে বন্ধ করার দাবিতে, যুদ্ধের উস্কানিদাতা মার্কিন-নেটোর বিরুদ্ধে ও শান্তির সপক্ষে ১ মার্চ শিলিগুড়ি শহরে এক মিছিল হিলকার্ট রোড পরিক্রমা করে হাসমি চকে এসে শেষ হয়। মিছিলের শেষে বক্তব্য রাখেন পার্টির রাজ্য কমিটি সদস্য বাসুদেব বসু। মিছিলে নেতৃত্ব দেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার, দার্জিলিং জেলা সম্পাদক পবিত্র সিংহ, জেলা কমিটি সদস্য শরৎ সিংহ, মোজাম্মেল হক, মুক্তি সরকার, মীরা চতুর্বেদী, শ্বাশ্বতী সেনগুপ্ত, সুমন্তি এক্কা, কৃষ্ণপদ সিংহ, গৌরী দে প্রমুখ।

সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার বলেন, অবিলম্বে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন বন্ধ করা সহ ইউক্রেন থেকে নিঃখরচায় সুরক্ষিতভাবে ভারতীয় ছাত্রদের দেশে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব দেশের সরকারকে নিতে হবে। পাশাপাশি আমেরিকা এবং নেটোকে যুদ্ধে উস্কানি দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

Kolkata are abuzz with demands for justice

গতকাল আরেকবার উত্তাল কলকাতার রাজপথ। ছাত্র আন্দোলনের নেতা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আনিস খানের হত্যার ঘটনায় বিচার চেয়ে বাম ছাত্র-যুব সংগঠনগুলির ডাকে (এআইএসএ, এসএফআই, এআইএসএফ, আরওয়াইএ, ডিওয়াইএফআই ও অন্যান্য সংগঠন) ১ মার্চ শিয়ালদহ এবং হাওড়া থেকে কলেজ স্ট্রীট পর্যন্ত মিছিল হয় এবং কলেজ স্ট্রিটে সমাবেশে যোগ দেন বহু মানুষ; বুঝিয়ে দেন শাসকের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে, সমস্ত হামলা-মামলা অতিক্রম করে আন্দোলন চলবে। মিছিল এবং সমাবেশে আইসা’র কমরেডদের ফ্ল্যাগ-চাইনিজ-ব্যানার-প্ল্যাকার্ড সহযোগে উজ্জ্বল উপস্থিতি নজরে এসেছে অনেকেরই। সমাবেশে আইসা’র পক্ষ থেকে রাজ্য সভাপতি নীলাশীষ এবং আরওয়াইএ’র  রাজ্য সম্পাদক রণজয়ের সংগ্রামী বক্তব্যে উঠে এল তৃণমূল সরকারের একের পর এক স্বৈরাচারী আচরণের ইতিবৃত্ত — নরেন্দ্রপুরে আইসা কর্মীদের গ্রেপ্তারি, দেউচা-পাঁচামীতে রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন, আনিসের হত্যা — সবকিছুর ইঙ্গিত একদিকেই — ২০২১’র বিধানসভা নির্বাচনে বাংলার মানুষের গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়ের দাবিতে এবং ফ্যাসিবাদী বিপদ ও কর্পোরেট রাজের বিরুদ্ধে জনমতকে এই তৃণমূল সরকার কোনোভাবেই মান্যতা দিতে প্রস্তুত নয়। মিছিলের ব্যানারে অক্ষরে অক্ষরে এই সরকারের আমলে সংখ্যালঘু অংশের মানুষের দুর্দশার স্বরূপ তুলে ধরা হল মানুষের কাছে। গতকালের মিছিল ও সমাবেশে আন্দোলনকারীদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট কথা উঠে এলো একটাই — আনিস খানের হত্যার ঘটনায় সুবিচার, বাম আন্দোলনের কর্মীদের মুক্তির দাবির লড়াই, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই একই সুতোতে বাঁধা এবং বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ের তীব্রতা বাড়বে দিন দিন, প্রত্যেকদিন আন্দোলনের আগুন জ্বলুক বিরামবিহীন।

demanding justice for Anis's murder

ছাত্রনেতা আনিস খানের হত্যার বিচার, পুলিশ মন্ত্রীর পদত্যাগ, দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি ও সমস্ত বন্দীদের মুক্তির দাবিতে কলকাতায় গত ১ মার্চ আইনজীবীদের এক মিছিল সংঘটিত হয়। হাইকোর্টের ‘বি-গেটে’ বিকেলে জমায়েত হয়ে মিছিল শুরু হয়, সেখান থেকে ধর্মতলায় এসে সংক্ষিপ্ত সভার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। এআইএলএজে, এআইএলইউ, এলএসজেএইচআর সংগঠনের সদস্য সহ অন্যান্য প্রগতিশীল আইনজীবীরা এই মিছিলে সামিল হন। মিছিলে উপস্থিত ছিলেন বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য, সুজয় ভট্টাচার্য, দিবাকর ভট্টাচার্য, রবিলাল মৈত্র, অরিন্দম ভট্টাচার্য, অভিজিৎ দত্ত, মিহির ব্যানার্জী, সব্যসাচী চক্রবর্তী, শামিম আহমেদ, সুপ্রিয় রায় চৌধুরী প্রমুখ। লইয়ার্স ফর ডেমোক্রেসী’র ব্যানারে এই কর্মসূচি করা হয়। মিছিল শেষে বক্তব্য রাখেন রবিলাল মৈত্র, দিবাকর ভট্টাচার্য, মিহির ব্যানার্জী, অরিন্দম ভট্টাচার্য প্রমুখ। বক্তারা জানান অবিলম্বে দাবিগুলির মীমাংসা না হলে রাজ্যব্যাপী আইনজীবীদের আন্দোলন আরো তীব্রতর করা হবে।

Power selection-edi

‘খেলা হবে’ প্রচারের ষোলোকলা পূর্ণ হল। প্রত্যাশার পারদ চড়িয়ে দখল অভিযান সারা হল। ১০৮টি পুরসভার মধ্যে ১০২টিতে ক্ষমতা কায়েম হল, ৯৪ শতাংশ হাসিল। ওয়ার্ড কব্জায় এসে গেছে ১৮৬৬টি, শতাংশের হিসেবে ৮৭। ৩৩টি পুরসভা পরিণত হল বিরোধীশূন্য। ৩৯টি পুরসভায় নেই প্রধান প্রধান বিরোধী দল। ভোট জুটেছে ৬৩ শতাংশ। তবে বেঁকে বসা 'নির্দল' প্রার্থীরা পেয়ে গেছে ১২১টি ওয়ার্ড এবং ৮টি পুরসভায় ‘দ্বিতীয়’ স্থান, যা বস্তুত দলবিহীন কোন প্রবণতা নয়, টিএমসি-রই গোষ্ঠীসংঘাতের পরিণাম। জেলাগত সবসেরা অনুগত চমক দেখিয়েছে দলনেত্রীর বিশেষ আশীর্বাদধন্য নেতা চালিত বীরভূম, পকেটে ৯৩টি ওয়ার্ডের ৯২টি। এসব হল ‘সবুজ সুনামী’ কেমন আছড়ে পড়েছে সেটা ওপর থেকে বুঝে নেওয়ার তথ্যসমগ্র। এই সুবাদে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মায় শাসকদলের সর্বময় কর্ত্রী আরও একবার জাহির করলেন, এই ফলাফল ‘মা-মাটি-মানুষের’ আশীর্বাদ ঝরে পড়ার পরিঘটনা। সাফাই গাইলেন দলের দিক থেকে ‘সামান্য কিছু অপ্রীতিকর’ ঘটনায় জড়িয়ে পড়া হয়েছে মাত্র! তাও বিরোধীদের প্ররোচনায়! ভাবের ঘরে চুরি করে গিলিয়ে দিতে চাইলেন, স্থানীয় ও বহিরাগত আটসাঁট বেঁধে ছল-বল-কৌশল প্রয়োগের ঘটনার লেশমাত্র ছিল না। কিন্তু কাদা না থাকা নাগরিকের সাদা মনে এইমাত্রায় জয় হাসিল মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। কেউ পূর্বাভাস দাবি করেননি, এবারের পৌরভোটে টিএমসি-র আধিপত্যে উল্লেখযোগ্য ধস নামার সম্ভাবনা ছিল। আবার এটাও নয় যে, যে হারে শাসকদল জয়ের নজীর কায়েম করল সেটা তাদের পক্ষের-বিপক্ষের উভয় হিসেবেই ধরা ছিল। বস্তুতপক্ষে সেটা না থাকাই নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষমতার মদমত্ততার শিকার করে তোলে। যে ‘সামান্য গোলযোগ’-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে যাবতীয় অভিযোগ নস্যাৎ করা হচ্ছে, তা হল মিডিয়ায় ধরা পড়া দৃশ্যমান খন্ডচিত্র মাত্র, যে অপরাধে মিডিয়ার লোকেদেরও রক্ত ঝরেছে শাসক ভৈরববাহিনীর তান্ডবে। চিন্তাশীল নাগরিকের চর্চায় উঠেছে শাসকদলের ‘সুনামী’ তৈরির আরও বড় আকারে আয়োজনের কথা। রাজ্য নির্বাচন কমিশন থেকেছে নির্বিকার, পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক নিষ্ক্রিয়, পাড়ার নাগরিকদের নজরে ধরা পড়েছে শাসকদলের ক্যাম্পে ক্যাম্পে প্রচুর অচেনা নানা বয়সী নারী-পুরুষের ভিড়। হেনস্থা ও আক্রমণ করা হয়েছে এমনকি বিরোধীদলের মহিলা প্রার্থীকে। এবং জবরদস্তি ছাপ্পা ভোট করানো হয়েছে ভুতুরে ভোটারবাহিনী দিয়ে। পরিষেবা প্রদানের বিজ্ঞাপনী প্রচার ও বক্তৃতাবাজি করেও যে অর্থবল-পেশীবলের এত দাপাদাপি, তার চাঁদমারি হল যে কোনও উপায়ে পৌরসভার ক্ষমতা দখল। পৌর ক্ষমতা মানে যত ‘উন্নয়ন’ ও ‘পরিষেবা’র প্রকল্প তত দুর্নীতি-দলতন্ত্র-গোষ্ঠীতন্ত্র। কামিয়ে নেওয়া-দেওয়ার রীতিরই রমরমা। যখন নাগরিক পুরবাসীদের পরিষেবা প্রদান উপলক্ষ আর দলকে ভোটে-কাটমানিতে ‘লিড’ দেওয়াই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, তখন রীতিনীতি চুলোয় যায়, মরীয়া হয় আগ্রাসী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রবণতা ও চরম গোষ্ঠীসংঘাত। এরই পরিচয় পাওয়া গেল টিএমসি-র এতো জয়জয়কার ও তথাকথিত বহিস্কৃতদের এতো বড় সংখ্যায় প্রার্থী হওয়া ও জিতে যাওয়ার মধ্যে।

অন্যদিকে, ৪টি পৌরসভার পরিচালন ক্ষমতা নির্ণয় ঝুলন্ত অবস্থায় থাকছে, যেখানে পাড়ায় তৃণমূল পরিচিতির ‘নির্দল’দের আসনসংখ্যাই নিস্পত্তি না হওয়ার কারণ। এর কি পরিণতি হয় সময়ে বোঝা যাবে।

ওয়ার্ড আসন ও মোট প্রাপ্ত ভোট শতাংশের নিরিখে বামেদের বিজেপির চেয়ে এগিয়ে থাকতে পারা স্বাগত। বিজেপির পিছিয়ে পড়া ও বিধানসভা পরবর্তী ক্রমাবনতির পরিঘটনা লক্ষ্যণীয়। তেমনি দার্জিলিং পৌরসভায় হামরো পার্টির সাফল্য ছিনিয়ে নেওয়া কি পার্বত্য জাতিসত্ত্বার মধ্যে নেতৃত্বের পুরোনো জীর্ণ অপদার্থ ঘরানার ছকগুলো পরিত্যাগ করে নতুন নেতৃত্বের জন্য আগ্রহী হওয়ার সংকেত দিচ্ছে?

demanding the punishment

লোক দেখানো তদন্তে আস্থা নেই

‘সিট’এর তদন্তে আমাদের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই! অত্যন্ত শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বরে জানালেন আনিসের বাবা সালেম খান। নেহাত আদালতের নির্দেশ, তাই তিনি সেটাকে মান্যতা দিয়েছেন। ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের প্রতিশ্রুতি কতটা রূপায়িত হয় সেটাই তিনি দেখতে চান। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের এক প্রতিনিধিদল নিহত আনিস খানের গ্রাম সারদা দক্ষিণ খানপাড়ায় গেলে তার বাবা ও পরিবার পরিজনেরা একথা জানালেন। গ্রামে ঢোকার পথে কারও কোনও কৌতুহল বা প্রশ্ন নয়, বরং প্রতিটি মানুষ আনিসের বাড়ির দিকনির্দেশ করে জানান দিচ্ছিলেন বাইরে থেকে যারাই আসুন, তারা স্বাগত! গ্রামবাসীরা সকলেরই সহযোগিতা চান। দেখা গেল গোটা গ্রাম ঐক্যবদ্ধভাবে আনিসের নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার চাইছে। তাদের বাড়ির নির্মীয়মান তিনতলার উপরে গিয়ে দেখা গেল, ঘরের জানালা করার জন্য তৈরি উন্মুক্ত জায়গা থেকে তাকে নীচে ফেলে দেওয়া হয়েছিল বধ্যভূমিতে। না, সেখানে উপর থেকে নিচে আদৌ কোনও রেন পাইপ নেই। বোঝা গেল, পালাতে গিয়ে মৃত্যুর তথাকথিত আষাঢ়ে গল্পটা! শোনা গেল, বাবার চোখের সামনে তিনতলা থেকে ছেলেকে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে ফেলে হত্যার নির্মম পুলিশী বর্বরতার ঘটনা।

পার্টির প্রতিনিধিদলে ছিলেন, রাজ্য কমিটি সদস্য জয়তু দেশমুখ, হাওড়া জেলা সম্পাদক দেবব্রত ভক্ত, রাজ্য নেত্রী ইন্দ্রাণী দত্ত, ছাত্র নেতা স্বর্ণেন্দু মিত্র, শ্রমিক নেতা এলএন ব্যানার্জী প্রমুখ।

আমতা থানার পুলিশই যে আনিস খানের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এ বিষয়ে গোটা গ্রাম একশো শতাংশ নিশ্চিত। আমাদের গ্রামে বাইরের কোনও সমাজবিরোধী ঢুকে খুন করতেই পারে না — জানালেন গ্রামের ক্লাবে জড়ো হওয়া যুবকেরা। খানপাড়া আব্দুল আজিজ ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আলেফ সেখ বললেন, বড়ো মাছকে ছেড়ে ছোট মাছকে ধরা হলো! থানার ওসিকে ছুটিতে পাঠানো হলো। ওনার অর্ডারেই তো সিভিক পুলিশ এসেছিল, তাহলে ওসিকে এ্যারেস্ট করা হলো না কেন? পাঁচ সাত বছরের একটা বাচ্চা ছেলেও বলে দেবে তদন্তের নামে কি হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে সিভিক পুলিশ প্রীতম ভট্টাচার্য, হোমগার্ড কাশীনাথ বেরা। ক্লাবের সামনে উপস্থিত আরেকজন যুবক আফজেল বললেন, আর কারও প্রাণ যাতে কেড়ে নেওয়া না হয় সে জন্যই আমরা চাই এই খুনের পেছনে যারা রয়েছে সেই পরিকল্পনাকারী ও খুনীদের শাস্তি! সকলেই বললেন, গতকাল রাত দুটোর সময় কাউকে না জানিয়ে দেহ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয়বার ময়না তদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল কেন বলুন তো! আদালতের আদেশ মেনে যে কোনও একজন বিচারকের উপস্থিতিতে দেহ তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল না কেন? উলুবেড়িয়া সংশোধনাগারে টিআই প্যারেডে সাধারণ পোশাকে কয়েকজনকে সনাক্ত করার জন্য দাঁড় করানো হয়৷ অথচ আনিসের বাবার মাথায় যারা আগ্নেয়াস্ত্র ধরেছিল তারা পুলিশের পোশাক পরা ছিল। স্বভাবতই সনাক্ত করা আদৌ সম্ভব হয়নি, জানালেন সালেম খান। এসবের মধ্য দিয়েই বোঝা যায় তদন্তের নামে কী ঘটছে। সেই রাতে পুলিশ বাহিনী এলে গ্রামের মানুষ জেগে ওঠে, প্রবল বাধার মুখে পুলিশ ফিরে যেতে বাধ্য হয়। পরে উপস্থিত হয়ে যান স্থানীয় বিডিও, যার মুখে মদের গন্ধ পাওয়া যায় বলে গ্রামবাসীরা অনেকেই জানালেন।

The village of Anis is united

অন্যান্য আরও যে বিষয়গুলি জানা গেল তা হল, আনিস সমগ্র আমতা ও পার্শ্ববর্তী বাগনান এলাকায় তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানুষকে সমাবেশিত করতে শুরু করেছিল। কিছুদিন আগে বাগনান এলাকায় একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। ঘটনাক্রমে সংখ্যালঘু মানুষেরা বড় সংখ্যায় ঘর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আনিস সেসময় সাহসের সাথে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ায়। তাদের বাড়িতে ফেরত নিয়ে আসে। তখন শাসক দলের পক্ষ থেকে তাকে জানে মেরে ফেলা হবে বলে জানানো হয়। গতমাসে ২৩ জানুয়ারি গ্রামে নিজের পাড়ার ক্লাবে আনিস একটি রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে। সেটাকেও তৃণমূল ভেঙ্গে দেয়। তখনও আনিসকে খুনের হুমকি দেওয়া হয়। দুবারই আনিস এবিষয়ে স্থানীয় থানায় লিখিতভাবে অভিযোগ জানায়। অর্থাৎ ঐ এলাকায় রাজনৈতিক জমি হারিয়ে তৃণমূল জনপ্রিয় হয়ে ওঠা একজন সংখ্যালঘু যুবক আনিসকে টার্গেট করে। বলাবাহুল্য, সংখ্যালঘু প্রাধান্যের এই এলাকায় কোনও জনপ্রিয় সংখ্যালঘু যুবক রাজনৈতিকভাবে তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে এটা শাসকদলের মাতব্বরদের আতঙ্কিত করে তুলেছিল। তাই আনিসের হত্যা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে জানা গেল। হাওড়া জেলা গ্রামীণ পুলিশ সুপারের কাছে গ্রামবাসীরা ডেপুটেশনে গেলে তিনি প্রথমে বলেন, ওসিকে যে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে সেটা নাকি তিনি জানতেন না। পরক্ষণেই তিনি আমতা আমতা করে উল্টোসুরে বলে ওঠেন তিনি জানতেন।

রাজ্যের বুকে স্বৈরশাসনে গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরা, বিরোধীপক্ষকে নিকেশ করে দেওয়ার যে নীতি তৃণমূল নিয়েছে, আনিস খানের হত্যা তারই ফলশ্রুতি বলেই প্রতিনিধি দলের দৃঢ় অভিমত।

প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে এইদিন এক প্রেস বিবৃতিতে দাবি তোলা হয়,

• আনিস খানের হত্যাকান্ডের বিচারবিভাগীয় তদন্ত চাই।
• অভিযুক্ত আমতা থানার ওসিকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে।
• রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে জনপ্রিয় যুবনেতা আনিস খানকে পরিকল্পিতভাবে পুলিশ দিয়ে হত্যা করা হল কেন, তৃণমূল জবাব দাও।

Deputation to the Minister in wb

২৮ ফেব্রুয়ারি এআইসিসিটিইউ, সিআইটিইউ, সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে পরিবহন ভবন অভিযান করা হয় এবং মন্ত্রীকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। প্রায় দুই সহস্রাধিক পরিবহন শ্রমিক এই কর্মসূচিতে সামিল হন। ডেপুটেশন প্রতিনিধিত্বকারী দলে ছিলেন এআইসিসিটিইউ’র পক্ষে দিবাকর ভট্টাচার্য, সিআইটিইউ’র পক্ষে সুভাষ মুখার্জি, আইএনটিইউসি’র পক্ষে মৃণাল বসু, এআইটিইউসি’র পক্ষে নওল কিশোর শ্রীবাস্তব প্রমুখ। ডেপুটেশনে পরিবহন শিল্পে ক্রমবর্ধমান অরাজকতা, দুর্নীতি, শ্রমিকদের উপর নামিয়ে আনা কালাকানুন ও যাত্রিদের হয়রানির বিষয়গুলিকে উল্লেখ করা হয়। বিশেষত রাজ্য সরকারি পরিবহন শিল্পের শত শত শ্রমিক কর্মচারিদের বেআইনি ছাঁটাই প্রত্যাহার, ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের পুনর্বহাল সংক্রান্ত ত্রিপাক্ষিক চুক্তিকে মান্যতা দেওয়া, শ্রমিক কর্মচারিদের কো-অপারেটিভের টাকা ফেরত দেওয়া, চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করা এবং সমস্ত কন্ট্রাক্ট বা এজেন্সি শ্রমিকদের স্থায়ীকরণের দাবি জানানো হয়। পরিবহন মন্ত্রী সমস্ত বিষয়গুলিকে সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বস্ত করেন।

সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার থেকে মিছিল শুরু হয়। পুলিশ মিছিলের গতিরোধ করলে গনেশ চন্দ্র এভিনিউ অবরোধ করে সভা শুরু হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন দিবাকর ভট্টাচার্য্য, গৌরাঙ্গ সেন (এআইসিসিটিইউ), সুভাষ মুখার্জি (সিআইটিইউ), মৃণাল বসু (আইএনটিইউসি), নওলকিশোর শ্রীবাস্তব (এআইটিইউসি) প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন এআইসিসিটিইউ নেতা প্রবীর দাস, স্বপন রায় চৌধুরী, অশোক সেনগুপ্ত, বিশ্বরঞ্জন সরকার, সুশান দেবনাথ ও বর্ষীয়ান নেতা অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী প্রমুখ। বক্তারা সভার মধ্য দিয়ে রাজ্য সরকারকে হুঁশিয়ারি দেন — দ্রুত বিষয়গুলির নিষ্পত্তি না করা হলে আগামীদিনে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

The charge sheet was handed over

নরেন্দ্রপুর থানায় নৃশংস অত্যাচারের অভিযোগপত্র ২৮ ফেব্রুয়ারি মহিলা কমিশনে দেওয়া হল সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির নেতৃত্বে। অভিযোগের ভিত্তিতে কমিশন বারুইপুর এসপি’কে ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে এবং নরেন্দ্রপুর ওসি’র সঙ্গে মুখোমুখি সমস্ত কথোপকথন ও অভিযোগের উত্তর চাওয়ার জন্য বৈঠক ডাকা হবে বলে জানিয়েছে। প্রত্যেকটা অত্যাচারের হিসেব চাওয়া হয়েছে সমিতির পক্ষ থেকে। মহিলা কমিশনে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে — ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ নরেন্দ্রপুর থানায় পুলিশের সংগঠিত নৃশংস অত‍্যাচারের ও মেয়েদের যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে প্রতিকারের দাবিতে এই চিঠি।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ নরেন্দ্রপুর থানার পুলিশ একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারী নারী ও পুরুষদের নৃশংসভাবে মারধর করে মিথ‍্যা মামলা দিয়েছে। পুলিশ সম্পূর্ণ বেআইনি ও অপরাধমূলক কাজ করেছে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারদের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। পুলিশ যে অপরাধগুলি সংগঠিত করেছে তা হল,

১) থানা হেফাজতে নিয়ে তিনজন মহিলাকে (চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরি, সৌমি জানা ও বর্ষা বড়াল) শারীরিক অত‍্যাচার ও যৌন হেনস্থা করে পুলিশ। অত‍্যন্ত নারীবিদ্বেষী গালি দিতে দিতে কয়েকজন পুরুষ পুলিশ এঁদের মেঝেতে ফেলে বুকে ও তলপেটে বারবার লাথি মারে এবং ‘খানকি’ বলে সম্বোধন করে ‘তোদের দেখাচ্ছি’ বলে হুমকি দেয়। হুমকি দেওয়ার সময় পুরুষ পুলিশেরা নিজেদের জামা তুলে ধর্ষণের ইঙ্গিত করছিল।

২) ঋতুস্রাবের জন‍্য স‍্যানিটারি ন‍্যাপকিন দিতে অস্বীকার করে পুলিশ। প্রথমবার গ্রেপ্তার হওয়ার পর চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরির ঋতুস্রাব শুরু হয়েছিল। তিনি মহিলা পুলিশের কাছে স‍্যানিটারি প‍্যাড চাইলেও তা দিতে অস্বীকার করে পুলিশ। রাত্রি সাড়ে নটা নাগাদ মুক্তি পেয়ে বাইরে বেরনোর সাথে সাথে পুলিশ আবার মারতে মারতে থানার ভেতর নিয়ে যায়। এই সময়ও তিনি স‍্যানিটারি ন‍্যাপকিন চেয়ে পাননি। রক্তক্ষরণের কথা বলে পুলিশের কাছে আকুতি জানানোর পরও তাঁকে গালিগালাজ সহ লাথি মারে পুলিশ।

৩) থানার বাইরে মারার সময়ও মেয়েদের রেপ-থ্রেট দেয় পুলিশ। উপরোক্ত তিন মহিলাকে লাথি মারার সময় বারবার যৌন হেনস্থামূলক গালি ও ভেতরে নিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছিল পুলিশ। থানায় তোলার আগে মারধর চলাকালীন সেকেন্ড অফিসারের বারংবার নির্দেশ ছিল মহিলাদের পা টেনে ‘মাঝে’ মানে যৌনাঙ্গে মারতে। উপরোক্ত তিনজন মহিলা ছাড়াও আরেকজন ছাত্রী সায়নি সাহাকে মারার সময় একজন পুরুষ পুলিশ নির্দেশ দিচ্ছিল ছাত্রীটির নিম্নাঙ্গে লাঠি চালোনোর। পুলিশ সায়নির নিম্নাঙ্গে লাঠি চালায়।

৪) থানায় তোলার আগে বারংবার মহিলাদের শরীর নিয়ে কটুক্তি করা হয়, চুল ছোট বলে সৌমি জানাকে বলা হয় — ‘ছেলে না মেয়ে, বুকে মারব না নিচে’! মহিলাবিদ্বেষী ভাষায় বারংবার উক্তি করা হয়।

৫) থানার বাইরে এবং হেফাজতে নিয়ে মহিলা ও পুরুষদের নৃশংসভাবে মারে পুলিশ। প্রতিনিয়ত হুমকি দেওয়া হতে থাকে ‘গুলি করে দেব’। সমস্তটা করে পুরুষ পুলিশ। বারংবার সৌমি জানা অনুরোধ করেন তার ইউটিআই আছে, বুকে পেটে যৌনাঙ্গে না মারতে, কিন্তু প্রতিনিয়ত চলে আক্রমণ, লাঠি, লাথি যৌনাঙ্গ, তলপেট, বুক লক্ষ্য করে। ফোনের পাসওয়ার্ড দিতে না চাওয়ায় মুখে পেটে ক্রমাগত চলে লাথি। প্রসঙ্গত মহিলাদের প্রত্যেককে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে তিন তলায় থানায় তোলা হয়েছিল। পুরুষ পুলিশ অফিসারদের অত্যাচারের পর আসেন মহিলা অফিসার নেহা। ক্রমাগত মহিলাদের মারতে মারতে বলতে থাকেন “কি করতে পারবি, মানুষই নয় তোরা, কোনও অধিকার নেই তোদের”।

৬) অকথ্য নির্যাতনের পর ইউটিআই’এর ব্যাথা শুরু হলে পুলিশরা বলে, এরা নেশা করে, নেশা করতে পাচ্ছে না বলে এরকম করছে। অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ চলে, হসপিটাল নিয়ে যাওয়ার পথে নির্দেশ দেওয়া হয় সারা রাস্তা জোর করে বসিয়ে রাখতে। সেল থেকে বেরও করেন ২ জন পুরুষ অফিসার। দায়িত্বে থাকা মহিলা অফিসার কোথায় ছিলেন জানা যায়নি।

৭) রাতে কয়েকজন ছাড়া কর্তব্যরত প্রত্যেক পুলিশ অফিসার হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরেছিলেন এবং প্রতিনিয়ত গালিগালাজ চলতে থাকে।

৮) মহিলা সেলের মধ্যে সিসিটিভি লাগানো ছিল এবং মহিলাদের বাধ্য করা হয় ইউরিন করতে ওভাবেই।

৯) ‘মেডিক‍্যাল ফিট’এর জাল সার্টিফিকেট বানায় পুলিশ। চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরিকে গভীর রাতে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু কোনরকম পরীক্ষা না করে আগে থেকে লেখা ফিট সার্টিফিকেটে নাম বসিয়ে পুলিশকে দেওয়া হয়। আহত ব‍্যক্তি এর প্রতিবাদ করায় ওখানেই তাকে মেরে দেওয়ার হুমকি দেয় পুলিশ। বাকিদের কারও মেডিক‍্যাল টেস্ট করায়নি পুলিশ। সৌমি জানার ইউরিনারি ট্র‍্যাক ইনফেকশন হয়। বারবার সেকথা বলায় তাঁকে পুলিশ হেনস্থা করে এবং শেষে হাসপাতালে নিয়ে জোর করে কোভিড ওয়ার্ডে ঢুকিয়ে দেয়। শারীরিক অবস্থার এতই অবনতি হয় তার যে স্যালাইন দিতে হয়, কোর্টে পেশ করার সময় অজ্ঞান হয়ে যান তিনি।

১০) সকলের স্মার্ট ফোনের সমস্ত ভিডিও ও ছবি জোর করে মুছে দেয় পুলিশ। পাসওয়ার্ড দিতে অস্বীকার করায় একজন মেয়ের বুকে লাথি মারে পুলিশ।

নরেন্দ্রপুর থানার পুলিশ যা করেছে তা এই রাজ্যের পুলিশী ব‍্যবস্থার অত‍্যন্ত উদ্বেগজনক চেহারা তুলে ধরেছে। মেয়েদের বার বার যৌনাঙ্গে, বুকে, তলপেটে আঘাত করা, ধর্ষনের হুমকি দেওয়া, গালাগালি দেওয়া হয়। গণআন্দোলনের কর্মীদের ওপর এই ধরনের অত্যাচার চালালো এই রাজ্যের পুলিশ।

পুলিশের এই ধরনের ব্যবহারের আমরা তীব্র বিরোধিতা করছি। আমরা দাবি করছি মহিলা কমিশন এর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিক। ভারপ্রাপ্ত অফিসার ও সেকেন্ড অফিসার সহ সমস্ত দোষী পুলিশদের অবিলম্বে শাস্তি হওয়া উচিত। থানায় জেন্ডার সেন্সিটাইজেশন চালাতে হবে, মহিলাদের জন্য স‍্যানিটারি ন‍্যাপকিনের ব্যবস্থা রাখতে হবে, মহিলা বন্দীদের জন্য পরিস্কার শৌচালয় রাখতে হবে। থানার শৌচালয়কে সিসিটিভি’র আওতায় রাখা চলবে না।

মহিলা সমিতির এই ডেপুটেশনে প্রতিনিধি দলে ছিলেন ইন্দ্রাণী দত্ত, অর্চনা ঘটক, মিতালি বিশ্বাস, চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী ও সৌমি জানা।

Women candidates

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন হুগলি জেলায় উত্তরপাড়া-কোতরং এবং কোন্নগর — দুটি পৌরসভা নির্বাচনে চারজন মহিলা প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মনোনীত করেছিল। প্রচার অভিযানে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকার সুবাদে যা দেখলাম এবং শিখলাম তা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

আমাদের পার্টি ‘টিপিকাল’ সংসদসর্বস্ব বা চলতি কথায় ভোটবাজ পার্টি নয়। আমরা নির্বাচন লড়ি গণসংযোগ বাড়ানো, মানুষের কথা শোনা, তাঁদের সমস্যা ও অভিযোগগুলো বোঝা এবং সেইমতো আগামী আন্দোলনের কর্মসূচি তৈরি করা, তাঁদের মধ্যে পার্টির রাজনীতি নিয়ে যাওয়া, জিততে পারলে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকে, জিততে না-পারলে বাইরে থেকে মানুষের উন্নয়ন, পরিষেবা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য কাজ করা আর বৃহত্তর গণআন্দোলনে সামিল করা — এরকম একগুচ্ছ লক্ষ্য নিয়ে। সুতরাং আমাদের কাজ ভোটের পরেই শেষ হয়ে যাবে না। বরং মহিলা সমিতি ও পার্টির কাজের বিকাশে একটা নতুন পর্যায়ের সূচনা ঘটাতে হবে, তা সে যে আকারেই হোক।

পার্টির চারজন মহিলা প্রার্থীর মধ্যে দু’জন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে আর দু’জন সাধারণ আসনে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রধান প্রচার সামগ্রী ছিল পার্টির ও মহিলা সমিতির তরফে পৃথক দুটি লিফলেট।

কোন্নগরে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৬ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী সুলতা রায় মেহনতি পরিবারের সদস্য। পার্টির নানা কর্মসূচিতে সামিল হন‌ এবং এলাকায় পরিচিত মুখ।‌ এই ওয়ার্ডে গত নির্বাচনে যিনি দাঁড়িয়েছিলেন তিনি অসুস্থ হওয়ার কথা শুনে সুলতা নিজে এগিয়ে এসে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব দেন। তিনি পাশের ওয়ার্ডের বাসিন্দা, অতএব নিজের এবং পরিবারের বা প্রতিবেশিদের একটি ভোটও পাবেন না জেনেও এবং ভোটে দাঁড়ানোর কোনও অভিজ্ঞতা না থাকলেও তিনি দ্বিধা করেননি। বরং তিনি ঘরে ঘরে প্রচার করার সময় একজন অভিজ্ঞ রাজনৈতিক কর্মীর মতোই মূল মূল বক্তব্য তুলে ধরছিলেন।

উত্তরপাড়া-কোতরং পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডে (অসংরক্ষিত) প্রার্থী ছিলেন সুদীপ্তা বসু। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় থেকেই শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন, অংশ নিয়েছেন যুব ও মানবাধিকার আন্দোলনেও। এলাকায় খুবই পরিচিত মুখ। দেশভাগের ফলে ছিন্নমূল পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষটি গবেষণার বিষয় হিসেবেও দেশভাগকেই বেছে নিয়েছেন। এখন তাঁর মাথায় ঘুরছে লাইনের ধারে বস্তির ছেলে-মেয়েদের পড়ানোর পরিকল্পনা।

উত্তরপাড়া-কোতরং পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের (অসংরক্ষিত) প্রার্থী কৃষ্ণা পাল পার্টির ও মহিলা সমিতির স্থানীয় নেত্রী। অঞ্চলের বিভিন্ন সমস্যায় ও নারী নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনায় হস্তক্ষেপের মধ্যে দিয়ে এলাকায় বিশেষত মহিলাদের মধ্যে তাঁর ভালো পরিচিতি আছে। প্রচারাভিযানে তিনি কখনও প্রচার করেছেন কখনো কমরেডদের সাথে নিয়ে, আবার কখনো একা — তাতে কোনোরকম দ্বিধা দেখা যায়নি।

উত্তরপাড়া-কোতরং পৌরসভার মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৩ নম্বর ওয়ার্ডে পার্টি মনোনীত প্রার্থী ছিলেন দুর্গা‌ রায়। মেহনতি পরিবারের মানুষ, পার্টির প্রতি অগাধ আস্থা, শান্ত স্বভাবের দুর্গা অত বলিয়ে কইয়ে না হলেও নির্দ্বিধায় সঙ্গীসাথীদের সাথে ঘরে ঘরে প্রচারের সামনের সারিতে থেকেছেন।

শাসকদল টিএমসি’র প্রবল প্রচারের বিরুদ্ধে সিপিআই(এমএল) প্রার্থীরা জনগণের হাজারো অমীমাংসিত সমস্যা ও বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার কথা তুলে ধরেন। একজন ছাড়া বাকি প্রার্থীরা রাজনৈতিক প্রচারে তেমন অভ্যস্ত না হলেও তাঁরা সাবলীলতা ও আন্তরিকতায় মানুষের মনকে ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। সাংসারিক বা পেশাগত দায়িত্ব সামলেই এঁরা মৌখিক প্রচার ছাড়াও দেয়াল লিখন, পোস্টারিং, পথসভা, লিফলেট বিলি এবং নিয়মিত নির্বাচনী কাজের পরিকল্পনায় পার্টির আলোচনায় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিয়েছেন। সব কাজই‌‌ তাঁরা দুবেলা শুরু থেকে শেষ দিন, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্লান্তিহীনভাবে চালিয়ে গেছেন।

সবচাইতে বড় যে শিক্ষা বা উপলব্ধি এই কর্মকাণ্ড থেকে উঠে এসেছে তা হল, এমনকি সাধারণ মহিলা কর্মীরাও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারেন, যদি তাঁরা কিছুটা অন্তত পরিসর পেতে সহযোগিতা পান, তখন তারা নিজেরাও নিজেদের পরিসর করে নিতে উজাড় করে দিতে পারেন। পরস্পরের হাত ধরে পার্টির নেতৃত্বে যারা নির্বাচনে লড়লেন, তাঁরা আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তোলার কাজ করতে চান।

- চৈতালি সেন

bandh against land mafias

একই পরিবারের তিনজনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার জন্য ভূমি-মাফিয়াদের বিরুদ্ধে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ডাকে ১৬ ফেব্রুয়ারি দ্বারভাঙ্গায় সর্বাত্মক বনধ্ হয়। প্রধান দাবি ছিল,

১) দ্বারভাঙ্গার পুলিশ সুপার এবং থানা ইনচার্জের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় মামলা দায়ের করা।
২) পীড়িত পরিবারের প্রত্যেককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া।
৩) ভূমি-মাফিয়া শিবকুমার ঝা’কে দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে।
৪) আরেকটি ঘটনায় পুর্খোপট্টিতে ২ বালিকাকে ধর্ষণ এবং খুনের জন্য দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে। সমস্ত বিরোধী দল এই বনধ্কে সর্বতোভাবে সমর্থন করে।

ঘটনার সুত্রপাত, ৯ ফেব্রুয়ারি চল্লিশ বছর ধরে বসবাসকারী রিতা ঝা’এর পরিবারের ওপর ভূমি-মাফিয়া শিবকুমার ঝা জমির বিবাদের জেরে পাশবিকভাবে আক্রমণ করে এবং ৮ মাসের গর্ভবতী পিঙ্কি ঝা ও তার ভাই সঞ্জয় ঝা’কে জীবন্ত পুড়িয়ে দেয়। প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব ঘটে। দ্বারভাঙ্গা মহারাজার এই জমিতে বিগত ৪০ বছর ধরে বসবাসকারী রিতা ঝা মহারাজার পরিবারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী বসবাস করছেন। কিন্তু ভূমি-মাফিয়া শিবকুমার ঝা জবরদস্তি তার নামে এই জমি নথিভুক্ত করে। বিবাদ পাটনা হাইকোর্ট অবধি গড়ায়। পীড়িতের পরিবার থানায় গেলে কোনও মামলা নথিভুক্ত করতে পুলিশ অস্বীকার করে। পরে একটি জেসিবি বুলডোজার দিয়ে ঐ বসতবাড়ি ভেঙে দিয়ে আগুন ধরানো হয়।

বাহাদুর ব্লকের পুর্খোপট্টিতে দুটি তরুণী পাশের গ্রামে ঘাস সংগ্রহ করতে গেলে তাদের ধর্ষণ করে হত্যা করা হয় এবং একটি গর্তে ফেলে দেওয়া হয়। পুলিশ কোন পদক্ষেপ করেনি। উল্টে প্রশাসন বলে ওরা জলে ডুবে মারা গেছে। এই ঘটনায় সিপিআই(এমএল) জনসভা করে ১৫ ফেব্রুয়ারি।

পরের দিন বনধে্ দ্বারভাঙ্গার ইনকাম ট্যাক্স চক্ অবরুদ্ধ থাকে প্রায় ৪ ঘন্টা, অন্যান্য দল এবং সমাজকর্মীরা অবরোধে অংশ নেন। জাতীয় সড়ক বহুক্ষণ অবরোধ করা হয়। এছাড়া লাহেরিয়াসরাই টাওয়ারে সম্পূর্ণ বনধ্ হয়। হায়াঘাট বাজারের রাস্তা, তারালাহি, বাহাদুরপুরের দ্বারভাঙ্গা-সমস্তিপুর রোড অবরুদ্ধ থাকে। বনধে্র ইস্যুতে সিপিআই(এমএল)-এর নেতৃত্ব বলেন, প্রধান অপরাধী কপিলেশ্বর সিং এখনো অধরা এবং দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুরো ঘটনার সাথে জড়িয়ে গেছে দ্বারভাঙ্গার পুলিশ সুপার। তাই দাবি তোলা হয়েছে দ্বারভাঙ্গার পুলিশ সুপার, থানা ইনচার্জ, সিটি ইন্সপেক্টর এবং কপিলেশ্বর সিং এদের সকলের নামে ৩০২ ধারায় মামলা রুজু করতে হবে।

পার্টি নেতৃত্ব আরও বলে, শিবকুমার ঝা’কে গ্রেপ্তার করা হয়নি কারণ তিনি বিজেপি-জেডিইউ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীদের নেকনজরে আছেন। পীড়িত পরিবারের প্রত্যেককে ২৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং নীতীশ সরকারকে সতর্ক করেন যে শিবকুমার ঝা’এর বাড়ি বাজেয়াপ্ত করতে হবে নতুবা জনগণই তার বাড়ির দখল নেবে, এই দাবিও করে পার্টি নেতৃত্ব। নেতৃত্ব আরও বলে পুর্খোপট্টির দুজন বালিকার ধর্ষক ও হত্যাকারীদেরও এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। দ্বারভাঙ্গার এসএসপি এই অপরাধে জড়িত আছেন। পুরো ঘটনার জন্য উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করতে হবে। পার্টি বিধানসভার অন্দরে এই ঘটনাগুলির জন্য আওয়াজ ওঠাবে।

Why was 'Bihar' written in Urdu deleted

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের বিহার রাজ্য সম্পাদক কুণাল, বিহার বিধানসভায় অশোক স্তম্ভের ওপর প্রতীক চিহ্নে উর্দু ভাষায় লেখা ‘বিহার’ লেখাটি মুছে দেওয়ার কড়া নিন্দা করে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন এটি বিজেপি’র পরিকল্পিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার মর্মে আঘাত।

তিনি বলেন, বিহার বিধানসভায় বিজেপি কোটায় স্পীকার হওয়া বিজয় সিনহার কোনও অধিকার নেই ‘বিহার’ প্রতীক চিহ্নে কোনভাবেই কোন কারচুপি করার। উক্ত প্রতীক চিহ্নের যে অংশে উর্দুতে ‘বিহার’ লেখা আছে তা মুছে ফেলা হয়েছে। এইভাবে প্রতীক চিহ্নটির বিজেপিকরণ করা হচ্ছে।

কুণাল বলেন, প্রতীকে ‘স্বস্তিক’ চিহ্ন বসানো হয়েছে, কিন্তু এটি হিটলারের ফ্যাসিস্ট জমানার রাষ্ট্রীয় প্রতীক। আমাদের দাবি, হয় পুরনো প্রতীক চিহ্ন ফিরিয়ে আনুন অথবা পুরনো প্রতীকের পরিবর্তে অশোক চক্র ব্যবহার করুন।

on the verge of ridiculous repetition

আবার তারস্বরে শিল্পায়নের বাদ্যি বাজানো শুরু হলো। যে শিল্পায়নের ভাঙা রেকর্ড রাজ্যবাসী শুনেছিলেন বাম জমানার পড়ন্ত বেলায়, সেই সুরের সাথে তদানিন্তন বিরোধী নেত্রী ও আজকের মুখ্যমন্ত্রীর কতই না মিল!

বাংলা নাকি হবে আগামী দিনে বিনিয়োগের গন্তব্যস্থল — বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি আরও বলেছেন, “সামাজিক সব কাজ আমরা করেছি, এবার শিল্প-কর্মসংস্থান-পরিকাঠামোই সরকারের লক্ষ্য। … স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পরিকাঠামোতে অনেক কাজ হয়েছে।” তিনি আর কী কী দাবি করেছেন, দেখে নেওয়া যাক।

১) গত দশবছরে শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগ হয়েছে ৪.৫ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু কোনও কোনও শিল্পে, তা থেকে গেল অনুচ্চারিত। কর্মসংস্থানই বা কতটা হল, এই বেয়াড়া প্রশ্নেরও কোনও উত্তর নেই। নেই, সেই সমস্ত কর্মক্ষেত্রে যারা কাজ পেয়েছেন, তাঁদের বর্গ, কাজের চরিত্র, মজুরির পরিমাণ, ইত্যাদি ইত্যাদি।

২) মাননীয়া জানিয়েছেন, উক্ত বিনিয়োগের মধ্যে ৩.৪২ কোটি টাকার ঋণ জোগানো হয়েছে মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে। এখানেও বলা হলো না যে সেই ঋণ পাওয়ার পর আদৌ ওই সংস্থগুলো মুখ তুলে দাঁড়িয়ে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে পারল কিনা। মাননীয়ার জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, ৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ক্ষুদ্র ছোট মাঝারি শিল্পের মন্ত্রী নারয়াণ রাণে লোকসভায় জানিয়েছেন যে, ২০২১ অর্থবর্ষে গোটা দেশে অতিমারির থাবায় বন্ধ হয় ৬৭ শতাংশ ক্ষুদ্র ছোট মাঝারি শিল্প, (যদিও ওই শিল্পের সাথে যুক্ত উদ্যোগপতিদের দাবি, সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি)। মুখ্যমন্ত্রী ওই সংস্থায় ঋণ জোগানের সংবাদ দিয়েছেন সংবাদমাধ্যমকে। কিন্তু রূঢ় বাস্তব হল, মাত্র ৩৬ শতাংশ সংস্থার কপালে ঋণের শিকে ছিঁড়লেও হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি শেষ পর্যন্ত মাথা তুলতে পারে, অধিকাংশই বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার আগ্রহ অধিকাংশ সংস্থাগুলোর ছিল না এই কারণে যে, বাজারে চাহিদার চলতে থাকা নাছোড় মন্দা তাদের উৎপাদিত পণ্যের বিক্রীবাট্টার ক্ষেত্রে বিরাট এক অনিশ্চয়তা ডেকে এনেছে। গোটা দেশ জুড়েই হাজার হাজার ক্ষুদ্র ছোট মাঝারি শিল্প সংস্থাগুলো যে সবচেয়ে বিপর্যস্ত হয়েছে, তা এমনকি আন্তর্জাতিক নানা সংস্থা (যেমন আইএলও) দেখিয়েছে। একথা জানিয়েছেন ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান মাইক্রো অ্যান্ড স্মল মিডিয়াম ইন্ডাস্ট্রিসের সভাপতি অনিমেষ সাক্সেনা।

৩) মুখ্যমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, দেশীয় শিল্পই তাঁর সরকারের লক্ষ্য। পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং শিল্প বান্ধব পরিস্থিতি তৈরিতে তিনি বদ্ধপরিকর। কিন্তু, এরই সূত্র ধরে উত্তর পাওয়া যায় না তবে রাজ্যের সাবেক শ্রমঘন দেশীয় শিল্প চটকলগুলো তাঁর উপর্যুপরি তিনবারের মুখ্যমন্ত্রীত্বে কেন এই সংকটাদীর্ণ অবস্থায় দিন গুজরান করছে? কেনই বা কাঁচা পাটের রেকর্ড ফলন হওয়া সত্ত্বেও কাঁচা পাটের অভাবে ঘোর অতিমারির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার হামলায় বন্ধ হল প্রায় ১৫টি চটকল, কর্মচ্যুত হলেন প্রায় ৭০ হাজার শ্রমিক? স্রেফ কেন্দ্রীয় সরকারের উপর দায় ঠেলে কেনই বা পার পেতে চাইছেন এই সমস্যা থেকে?

মুখ্যমন্ত্রী বিমানবন্দর ও পরিকাঠামোর উন্নয়ন, অন্ডালে কার্গো সুবিধাদান, তাজপুরের বন্দর নিয়ে দরপত্র ডাকা (যেখানে নাকি বিনিয়োগ হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা), দেউচা-পাঁচামী ও জঙ্গলমহলে নাকি বিনিয়োগ হবে যথাক্রমে ৩০ হাজার কোটি ও ৭২ হাজার কোটি টাকা, আবেদনের দু’মাসের মধ্যে জমি বরাদ্দ, স্থানীয় সব প্রশাসনে অভিন্ন ফি-নীতির গল্প শুনিয়েছেন। অশোকনগরে তেল, গ্যাস পাইপলাইন, দিঘায় কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন, চর্মশিল্প, সাইকেল তৈরির কারখানা, স্কুলের পোশাক তৈরির জন্য বিদ্যুৎচালিত তাঁত ইত্যাদি ইত্যাদি ... ফর্দের যেন আর শেষ নেই। দেউচা-পাঁচামীতে ‘স্বেচ্ছায়’ জমিদাতাদের তো ‘সব পেয়েছির দেশে’ পৌঁছে দেওয়ার বিরাট ফানুস উড়িয়েছেন। আর রূপকথা শেষ করেছেন, দুষ্টু লোকেদের সবক শেখানোর হুমকি দিয়ে। শিল্পায়নের পথ আগলে ‘অন্যায্য বিরোধিতা’ তাঁর সরকার ‘বরদাস্ত’ করবে না। অর্থাৎ, কোনটা ন্যায্য আর কোনটা অন্যায্য — এবার থেকে সরকারই তার সংজ্ঞা নিরূপণ করে দেবে। এমনকি, তিনি ঠিক করে দিয়েছেন সংগ্রামের রূপও। রাস্তা অচল নিষিদ্ধ। শিল্পায়নের এই নব্য সাধনায় তিনি ঠিক করে দিয়েছেন সংবাদমাধ্যম কী ধরনের সংবাদ পরিবেশন করবে। শিল্প বৈঠকের মঞ্চ থেকেই তিনি ফরমান জারি করলেন, যে সমস্ত সংবাদমাধ্যম সরকারের ইতিবাচক বা পজিটিভ দিক তুলে ধরবে, তারা পাবেন সরকারি আর্থিক সাহায্য, বিজ্ঞাপন। আনিস খান হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ প্রতিবাদের রিপোর্ট ছাপানোর জন্য উষ্মা প্রকাশ করে রাজ্যে ‘আইন শৃঙ্খলা’ সংক্রান্ত এই ছবি তুলে ধরার জন্য তিনি রীতিমতো ধমক দিয়েছেন সংবাদমাধ্যমকে। “এখানে ব্যবসা করবেন, আবার আইন শৃঙ্খলার সমস্যা তুলে ধরবেন, দু’টো একসঙ্গে চলবে না” — এই হল তাঁর নিদান। তিনি স্পষ্ট বুঝিয়েই দিলেন, শিল্পায়নের যূপকাষ্ঠে বলি দিতে হবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে, সংবাদমাধ্যমকেও চলতে হবে পোষ মেনে। রাষ্ট্রের ইশারা অনুযায়ী।

যে কর্মসংস্থানের খুড়োর কল দেখিয়ে তিনি এই শিল্পায়নের গপ্পো ফেঁদেছেন, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে না বহু প্রশ্নের উত্তর। প্রথম প্রশ্ন, রাজ্যের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব সমাধানের প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত রাজ্য সরকারের বিভিন্ন আধা সরকারি দপ্তরে বা স্বশাসিত সংস্থায় শূন্য পদ ভরাট করা। কোভিডের দু’বছরে স্রেফ প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রায় ২.৫ লক্ষ শূন্য পদে নতুন কর্মপ্রত্যাশীদের নিয়োগ করাটা কেন কর্মসংস্থানের প্রকল্পে পড়বে না? কেন্দ্রে মোদী সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কেন বিলুপ্ত করা হল ৫.৫ লক্ষ সরকারি পদ? ১ লক্ষ ৩৯ হাজার খালি পড়ে থাকা ‘গ্রুপ ডি’ পদে কেন লোক নিয়োগ করা হচ্ছে না, যা নিয়ে প্রায় রোজ আন্দোলন হচ্ছে?

বাস্তব এটাই, মমতা সরকার শ্রমের বেপরোয়া ইনফর্মালকরণ অভিযানে নেমেছেন আর তারই নির্মম পরিণতি হচ্ছে সরকারি দপ্তরে মাত্র ৫,০০০ টাকার বিনিময়ে স্নাতকদের নিয়োগের সরকারি ঘোষণা, কলকাতা ও বেঙ্গল পুলিশে যথাক্রমে ৪৫ হাজার ও ৭৫ হাজার শূন্য পদ থাকা সত্ত্বেও চলছে সিভিক পুলিশের ঢালাও নিয়োগ। বিশেষ করে কোভিডের পর ভারতবর্ষের শ্রম বাজারে এসেছে পশ্চাদমুখী এক আতঙ্কজনক পরিবর্তন — অকল্পনীয় হারে বেড়ে গেছে ইনফর্মাল শ্রমিকদের সংখ্যা — কোভিডের আগের তুলনায় কম মজুরিতে যারা কোনোরকম সামাজিক সুরক্ষা ছাড়াই নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

অসংগঠিত শ্রমিক বা ইনফর্মাল সেক্টরে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যেও রয়েছে স্তর ভেদ — জাতপাত ও ধর্মের ভিত্তিতে। সবচেয়ে ধনী রাজ্য থেকে শুরু করে গরিব রাজ্য নির্বিশেষে তপশিলি জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণির থেকে আগত শ্রমিকরাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত! “হু কেয়ারস্ ফর লেবার” (কৃষ্ণা রাম, শিবানি যাদব, ইপিডব্লিউ ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ পত্রিকায় প্রকাশিত) এক গবেষণালব্ধ ও মনোজ্ঞ প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে, সমস্ত রাজ্যগুলোর শ্রমিকদের মধ্যে মোট ৬০-৮০ শতাংশই হলেন তপশিলি জাতি এবং ওবিসি অন্তর্ভুক্ত যারা ন্যূনতম মজুরি পান না। এরমধ্যে পশ্চিমবাংলা সহ দিল্লী-গুজরাট-পঞ্জাব-তামিলনাড়ু-মধ্যপ্রদেশ-উত্তরপ্রদেশে ৭০ শতাংশেরও বেশি শ্রমিক পাননা বিধিবদ্ধ ন্যূনতম মজুরি। উক্ত প্রবন্ধ এটাও দেখিয়েছে, সমস্ত সামাজিক স্তরগুলোর মধ্যে দলিত/আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে আগত শ্রমিকরাই সবচেয়ে বেশি শোষিত — মাথাপিছু দৈনিক যে ন্যূনতম মজুরি অদক্ষ শ্রমিকদের প্রাপ্য, এরা তার থেকেও পান অনেক কম। আর, ২ কোটি ২ লক্ষ শহুরে ইনফর্মাল শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি থেকেও পাচ্ছেন অনেক কম টাকা! তপশিলি জাতি, উপজাতি ও ওবিসি থেকে আগত শ্রমিকরা অন্য শ্রেণী-সম্প্রদায় থেকে আসা শ্রমিকদের তুলনায় অনেক কম মজুরি পাচ্ছেন।

বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেউচা-পাঁচামীতে প্রস্তাবিত কয়লাখনি প্রকল্পে অত্যন্ত কম মজুরিতে নিয়োগ করা হবে আদিবাসী মজুরদের — মমতার স্বপ্নের প্রকল্পে — আর, যাকে শিল্পায়নের প্রলেপ দিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে। কর্পোরেট স্বার্থের নতুন সেবক হয়ে এপ্রিলের প্রস্তাবিত শিল্প সম্মেলনের মঞ্চে তাই মমতা নতুন কলেবরে নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটাতে আবির্ভূত হতে চলেছেন।

বিগত কেন্দ্রীয় বাজেট ভাষণের সময় দেশের অর্থমন্ত্রী তাঁর গোটা বক্তৃতায় ‘কাজ’ ও ‘কর্মসংস্থানের’ মনিমুক্ত ছড়িয়েছিলেন। কিন্তু, একবারের জন্যও সম্পদসৃষ্টিকারী শ্রমিক বা মজুরদের নামোল্লেখ করেননি। এটা কেন্দ্রীয় সরকারের মূল মতাদর্শগত অবস্থানকেই প্রতিবিম্বিত করে। তার আগে মোদীও তাঁর বক্তৃতায় ব্যাখ্যা করেন, দেশের পরিকাঠামো থেকে শুরু করে শিল্প বিকাশের জন্য তাঁর সরকার কী বিপুল বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এরফলে শিল্প বিকাশ ঘটবে, যার হাত ধরে আসবে কর্মসংস্থানের বিপুল জোয়ার!

ধন্য আশা কুহকিনী!!

আরও বেশি বিনিয়োগ, আরও বেশি শিল্প, তারসাথে পাল্লা দিয়ে নতুন কর্মসংস্থানের এই আষাঢ়ে গল্প ভারতবাসী শুনে আসছে দশকের পর দশক ধরে। উপর তলায় সম্পদ সৃষ্টি ও শিল্প হলে তা নিচুতলায় চুঁইয়ে পড়ার এই তত্ত্ব যে বহুকাল আগেই পরিত্যক্ত হয়েছে, তা আমাদের নীতিকারেরা আজও স্বীকার করেন না। শুধু অবাক লাগে, বিজেপি বিরোধিতায় যিনি নিজেকে গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগণ্য মনে করেন, সেই মমতা আজ মোদীর সেই আর্থিক ন্যারেটিভকে আকঁড়ে এই রাজ্যের আর্থিক বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের মরীচিকা দেখাচ্ছেন, নতুন নতুন পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও প্রকল্পই যেন আবার মরা গাঙে তুলবে প্রবল জোয়ারের প্লাবন!

মমতা সরকার এখন পা বাড়িয়েছেন শিল্প স্থাপনের পথে। ঠিক যে পথে পা বাড়িয়ে ৩৪ বছরের বাম সরকার কর্পোরেটমুখী স্বার্থকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজের পায়ে কুড়ুল মারে।

আজ কি ইতিহাসের সেই প্রহসনময় পুনরাবৃত্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলা?

- অতনু চক্রবর্তী

choose from 3 GDP growth rates

২০২২-২৩ সালের জিডিপি বৃদ্ধির হার কত হবে বলে অনুমান করছে মোদী সরকার?

বছরের এই সময়ে এরকম প্রশ্ন শেয়ার বাজার, শিল্পপতি-ব্যবসায়ী, অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অবশ্যই চর্চিত হতে থাকে। ওই অনুমিত জিডিপি বৃদ্ধির হারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও সম্যক আলোচনা করেন অর্থনৈতিক-পরিসংখ্যানবিদরা। সাধারণত, চলতি বছরের (২০২১-২২) অর্থনৈতিক সমীক্ষা (যা কেন্দ্রীয় বাজেট পেশের একদিন আগে পেশ করা হয় ও যার কথা কেন্দ্রীয় বাজেটে উল্লেখিত হয়) পরবর্তী আর্থিক বছরের জন্য জিডিপি বৃদ্ধির একটি আনুমানিক পরিমাণ পেশ করে। ওই অনুমানই বাজেটে প্রতিফলিত হয় কারণ সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টাই সমীক্ষাটি পেশ করেন; এবং তিনি হলেন ভারত সরকারের অর্থমন্ত্রকের অধীন অর্থনীতি বিষয়ক বিভাগের প্রধান। ফলে অর্থমন্ত্রক যখন অর্থনৈতিক সমীক্ষার পরদিন বাজেট পেশ করে তখন তাদের মন্ত্রকের অধীন বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত জিডিপি বৃদ্ধির হারকেই মেনে নেবে বলে অনুমান করা যেতে পারে। এছাড়াও নামে স্বশাসিত রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রয়েছে যাদের গুরুত্বপূর্ণ মানিটারি পলিসি কমিটি বাজেট পেশের এক সপ্তাহের মধ্যেই মিটিং করেন সুদের হার ও অন্যান্য আর্থিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। তারাও জিডিপি বৃদ্ধির ও মুদ্রাস্ফীতির আনুমানিক হার সম্পর্কে দৃষ্টিপাত করে। যেহেতু সরকার একটিই তাই সকলেই একই হারে জিডিপি বৃদ্ধির কথা বলবে ও মুদ্রাস্ফীতি সংক্রান্ত অনুমানও একই হবে এটা ধরাই যেতে পারে।

কিন্তু ২০২২-২৩ʼর জিডিপি বৃদ্ধির হার সংক্রান্ত অনুমান দেখিয়ে দিচ্ছে যে সরকারটি এতই অস্বচ্ছ যে সেটির বাঁ-হাত কী করছে সে সম্পর্কে ডান-হাত অবহিত নয়। ৩১ জানুয়ারি পেশ করা অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে শুরু করে ১০ ফেব্রুয়ারি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘোষণা, এই ১১ দিনে ৩ রকম জিডিপি বৃদ্ধির হার সরকারের বিভিন্ন দফতর বা প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া গেছে, যেগুলি ৬.৬ শতাংশ থেকে ৮.৫ শতাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত।

২০২১-২২ʼর অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২-২৩ʼর ৩১ জানুয়ারিতে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার (স্থিরমূল্যে জিডিপি বৃদ্ধির হার) ৮ থেকে ৮.৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে বলে অনুমান করেছিল। পরবর্তীতে বাজেট পেশের সময়ে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে চলতি মূল্যে (স্থিরমূল্যে বৃদ্ধির হার+ মুদ্রাস্ফীতির হার) জিডিপি বৃদ্ধির হার ১১.১ শতাংশ হবে বলে অনুমান করেন। ১০ জানুয়ারি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার গভর্ণর শক্তিকান্ত দাস ২০২২-২৩ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার ও জিডিপি বৃদ্ধির হার যথাক্রমে আনুমানিক ৪.৫ শতাংশ ও ৭.৮ শতাংশ বলে ঘোষণা করেন। যদি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমানে ২০২২-২৩ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার ৪.৫ শতাংশ (মুদ্রাস্ফীতির হার অনুমানে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অধিকতর দক্ষ) ও অর্থমন্ত্রীর বাজেট পেশকালীন চলতি মূল্যে জিডিপি বৃদ্ধির হারকে ১১.১ শতাংশ ধরা হয়। তাহলে অর্থমন্ত্রীর হিসেব অনুযায়ী স্থিরমূল্যে জিডিপি বৃদ্ধির হার হবে ২০২২-২৩ সালে ৬.৬ শতাংশ।

ফলে ১১ দিনের মধ্যে সামনের বছরের জিডিপি বৃদ্ধি বিষয়ে ৩টি অনুমান পাওয়া গেল। অর্থনৈতিক সমীক্ষায় ৮ থেকে ৮.৫ শতাংশ; বাজেটে ৬.৬ শতাংশ ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমানে ৭.৮ শতাংশ।

আগে হিন্দু বৃদ্ধির হার বলে একটি কথা চালু ছিল। এখন হিন্দুত্ব বৃদ্ধির হার, যেখানে একই সঙ্গে গোটা কয়েক অপশন থাকবে। মাথায় কাপড় পরা বা না পরার ক্ষেত্রে মুসলিম ছাত্রীদের পছন্দের স্বাধীনতা না থাকলেও, জিডিপি বৃদ্ধির হারের সরকারি অনুমানের ক্ষেত্রে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে যুক্ত সকলকে।

আধ্যাত্মিক গুরুর কাছে গোপন তথ্য প্রদান গোপনীয়তা ও সততা লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য করা যায় না — এনএসইʼর প্রাক্তন মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক চিত্রা রামকৃষ্ণের যুক্তি!

ভারতের অর্থনৈতিক বন্দোবস্তে হিন্দুত্বের তথা আধ্যাত্মিকতার উপস্থিতি কত প্রবল হয়েছে তা শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবির সাম্প্রতিক একটি তদন্তের থেকে বোঝা যেতে পারে। ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ এনএসইʼর মুখ্য প্রশাসনিক অফিসার (সিইও) পদে থাকা চিত্রা রামকৃষ্ণের প্রশাসনিক অবহেলার তদন্ত করতে গিয়ে সেবি দেখতে পায় যে, তিনি নিয়মিত এনএসইʼর কাজকর্ম সংক্রান্ত ইমেইল এক ‘অজানা’ ব্যক্তিকে পাঠিয়েছেন। প্রশ্নের উত্তরে চিত্রা জানিয়েছেন যে ওই অজানা ব্যক্তি একজন ‘আধ্যাত্মিক শক্তি’ যার কাছ থেকে তিনি ২০ বছর ধরে পথনির্দেশ গ্রহণ করেছেন। সেবির তদন্তে এও প্রকাশ পেয়েছে যে, ওই ‘আধ্যাত্মিক’ গুরুর প্রভাবেই চিত্রা মূলধনী বাজারে কোনো অভিজ্ঞতাহীন একজন ব্যক্তিকে মাঝারি স্তরের কর্মকর্তা হিসেবে অন্যান্য অভিজ্ঞ এনএসই কর্মকর্তাদের থেকে বেশি বেতনে নিজের উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। সেবির তদন্তকারীদের বক্তব্য অনুসারে চিত্রা মূলত ওই ততাকথিত গুরুর একজন পুতুল হিসেবে কাজ করতেন।

সবথেকে উপাদেয় ও আশ্চর্যের কথা হল যে, চিত্রা রামকৃষ্ণ তাঁর কাজের যাথার্থকে প্রতিষ্ঠিত করতে যুক্তি দিয়েছেন যে, কোনো আধ্যাত্মিক ব্যক্তির কাছে এক্সচেঞ্জের গোপন তথ্য প্রদান করে তাঁর থেকে উপদেশ ও দিকনির্দেশ নেওয়াকে গোপনীয়তা ও সততা লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য করা যায় না।

বোঝাই যাচ্ছে, রামরহিম, আশারাম বাপু, নিত্যানন্দ, সদগুরু, চিন্ময়ানন্দদের প্রভাবে ‘হিন্দুত্বের ভারত’ কী হতে চলেছে।

- অমিত দাশগুপ্ত

super-rich have increased

অতিমারীর মারে ভারতে কাজ ছুটে যায় লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবি মানুষের। তার কত শতাংশ কাজ ফিরে পেয়েছেন কেন্দ্রের মোদী সরকার তার কোনও হিসাব এখনও করেনি। এই কাজে গুরুত্ব দিয়ে হাত দিচ্ছে না। কোন যে তাগিদ রয়েছে তাও বোধগম্য হচ্ছে না। তবে মধ্যবিত্ত স্তর থেকে অর্থনৈতিক অবস্থার ক্রমাবনতি নিম্নবিত্তের শতাংশকে ক্রমেই বিপুলতর করে চলেছে। আর গরিবের অংশও বাড়ছে। বেড়ে চলেছে গরিবদের মধ্যে গরিবতম অংশ। কর্মহীনতা, অনিয়মিত মজুরি, মজুরি হ্রাস — এগুলোই এই সময়ে গরিবী বেড়ে যাওয়ার মূল মূল কারণ।

পক্ষান্তরে, এদেশে ২০২১ অর্থবর্ষ শেষে এসে অতি উচ্চ নিট ব্যক্তিগত আয় তথা সম্পদের অধিকারী অতি-ধনী বর্গের বৃদ্ধি হয়েছে ১১ শতাংশ। বিশ্ব প্রেক্ষিতে এই বর্গের বৃদ্ধি ঘটেছে যেখানে ৯.৩ শতাংশ, সেখানে ভারতীয় বাস্তবতায় সেটা আরও ছাপিয়ে গেছে। এক আন্তর্জাতিক পরিচিতি সম্পন্ন কনসালটিং ফার্মের তৈরি এক বিশ্ব ধনসম্পদ সংক্রান্ত রিপোর্ট কার্ডে উপরোক্ত তুলনামূলক বৃদ্ধির তথ্য পরিসংখ্যান উল্লেখ হয়েছে। তাতে উল্লেখ হয়েছে, কোটিপতিদের জনসংখ্যাগত দিক থেকে ভারতের ধনাঢ্য বর্গ রয়েছে বিশ্বে তৃতীয় শীর্ষতম স্থানে। মার্কিন মুলুক ও চীনের ঠিক পরে। এই মাত্রায় ধনকুবেরদের সংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭৪৮ ও চীনে ৫৫৪, আর ভারতে ১৪৫। ভারতের অভ্যন্তরে এই অংশের সম্পদ অধিকারিদের সংখ্যাগত আধিক্য সবচেয়ে বেশি মুম্বইয়ে, তারপরে যথাক্রমে রয়েছে হায়দ্রাবাদ, পুণে ও দিল্লীতে। এছাড়া স্টার্ট আপ পুঁজির যে হারে দ্রুতগতির বৃদ্ধি ঘটছে ও উক্ত পুঁজির রাজধানী হয়ে উঠছে বেঙ্গালুরু তাতে মনে করা হচ্ছে দু-তিন বছরে চলে আসতে পারে মুম্বইয়ের ঠিক পরেই, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থানে!

অসাম্যের ব্যবধান ক্রমাগত বেড়ে চলার অর্থব্যবস্থা আরও গেঁড়ে বসছে বিশ্ব চরাচরে, চেপে বসছে ভারতে।

growing deprivation and inequality of the Kovidkal period

বিশ্বের দারিদ্র সূচক নিয়ে ১৯৪২ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে উল্লেখযোগ্য কাজ করে আসছে অক্সফ্যাম। সম্প্রতি তাদের একটি নতুন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, যা দেখিয়ে দিচ্ছে যে কোভিড পরিস্থিতি ও তার মোকাবিলায় বিভিন্ন নব্য উদারনৈতিক সরকারের নীতিমালা কীভাবে সমাজের বুকে বিদ্যমান অসাম্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। চার্লস ডিকেন্স-এর ‘হার্ড টাইমস’ উপন্যাসের শুরুর একটি বাক্যকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে এই রিপোর্ট লিখেছে এই কোভিড সময়কালও এক শ্রেণির মানুষের জন্য হয়ে উঠেছে ‘বেস্ট অব টাইমস’ এবং এক শ্রেণির মানুষের জন্য ‘ওয়ার্স্ট অব টাইমস’। কোভিড সময়কালে আরো অন্তত ১৬ কোটি লোক নতুন করে দারিদ্র কবলিত হয়েছেন। অন্যদিকে এই সময়কালেই আবার প্রতি ছাব্বিশ ঘন্টায় একজন করে মানুষ নতুন করে বিলিয়নেয়ার হয়েছেন।

সরকারী সাহায্য ও ভ্যাক্সিনের বন্টনের ক্ষেত্রেও অনেক অসাম্য থেকেছে নানা দেশে। কোভিডের প্রথম স্রোতে আমেরিকায় সেখানকার কালো মানুষেরা ও আদিম অধিবাসীরা সাদা মানুষদের তুলনায় বেশি সংখ্যায় মারা গিয়েছিলেন। কোভিডকালে ব্রিটেনের বাংলাদেশী বংশদ্ভূতদের মৃত্যুর হার ছিল সেখানকার সাদা মানুষদের পাঁচগুণ।

বিশ্বজুড়েই লকডাউন নীতিমালা যে শ্রমজীবী মানুষদের অন্যদের তুলনায় বেশি সমস্যায় ফেলেছে তার অনেক পরিসংখ্যান অক্সফ্যামের এই রিপোর্টে উঠে এসেছে। বিভিন্ন দেশেই আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই কোভিড দিনকালে আগের চেয়েও বেশি করে স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের গড় আয়ুও আগের চেয়ে কমেছে।
অক্সফ্যামের এই রিপোর্ট ইএমএফ (ইন্টারন্যাশানাল মানিটারি ফান্ড)-এর চাপানো কৃচ্ছসাধন নীতিমালা ৭৩টি দেশকে কীভাবে সঙ্কটে ফেলেছে — তারও নানান ছবি তুলে ধরেছে। ঋণ সঙ্কটে পড়ে কৃচ্ছসাধন নীতিমালার ফলে এই দেশগুলির অধিকাংশই সরকারী স্বাস্থ্য পরিষেবার বরাদ্দে ব্যাপক কাটছাঁট করতে গত কয়েক বছরে বাধ্য হয়েছিল। সরকারী স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্কোচন এই সমস্ত দেশে কোভিড মৃ্ত্যুহারকে ভয়াবহ করে তুলেছে। বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিসেবাখাতে ব্যয়বৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশ আর কোভিড মৃত্যুহারকে বাড়িয়েছে ৪.৯ শতাংশ।

বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় সামগ্রীর যোগান কোভিড পর্বে যত কমেছে, ততই বেড়েছে মহিলা, শিশু ও বিভিন্ন দুর্বল গোষ্ঠীর ওপর নানাপ্রকারের বঞ্চনা ও হিংসার ঘটনাবলী। এই রিপোর্ট জানিয়েছে কোভিডকালে মহিলাদের ওপর হিংসার ঘটনা ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মহিলাদের খুন করার ঘটনা এই পর্বে অনেকটাই বেড়েছে। ব্রিটেনে মহিলাদের ওপর এই সময়ে খুনের ঘটনার হার আগের চেয়ে তিনগুণ হয়েছে। রূপান্তরকর্মীদের খুনের ঘটনা বেড়েছে ৬ শতাংশ। ইজরায়েলে মহিলাদের খুনের ঘটনা বেড়েছে ৯ শতাংশ।

ভ্যাক্সিন বন্টনের ক্ষেত্রেও বিশ্বজুড়ে দেখা গেছে অসাম্যের ছবি। ভ্যাক্সিনের ৮০ শতাংশই পেয়েছে জি-২০ ভূক্ত দেশগুলি। নিম্ন আয়ের দেশগুলি সব মিলিয়ে পেয়েছে মাত্র ১ শতাংশ ভ্যাকসিন। এর কারণ হিসেবে অক্সফ্যাম রিপোর্ট দায়ী করেছে ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানিগুলির নীতিমালা ও মুনাফার প্রতি একচক্ষু নীতিকে। এই রিপোর্ট এও দেখিয়েছে বিভিন্ন ফার্মা কোম্পানি এই সময়কে কাজে লাগিয়ে কীভাবে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। মর্ডানা বা ফাইজারের মতো কোম্পানি তাদের ভ্যাক্সিনের দাম উৎপাদন ব্যয়ের ২৪ গুণ ধার্য করে রেখেছে। অতিকায় ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানিগুলি কীভাবে তাদের মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য দরিদ্র দেশ ও মানুষদের বঞ্চিত করেছে, এই রিপোর্ট তার করুণ অমানবিক চিত্রকে স্পষ্ট করেছে। অথচ বায়ো অ্যান্ড টেক-এর মতো কোম্পানি জার্মানির জনগণের টাকায় পুষ্ট হয়ে তাদের ভ্যাক্সিন বানিয়েছিল, কিন্তু দরিদ্র দেশগুলির এক শতাংশ মানুষও তাদের ভ্যাকসিনের সুবিধে নিতে পারেনি অত্যাধিক দাম ধার্য করার জন্য।

অতিমারি মোকাবিলার জরুরী প্রয়োজনের দিনেও ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানিগুলি তাদের মুনাফাসর্বস্ব নীতি থেকে সরে এসে ভ্যাক্সিন বানানোর কৃৎকৌশল অন্যদের সরবরাহ করতে সম্মত হয়নি। এই রিপোর্ট বলেছে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অন্তত একশোটি কোম্পানি আরএনএ ভ্যাক্সিন বানাতে পারার জায়গায় ছিল, কিন্তু এর প্রয়োজনীয় কৃৎকৌশল তাদের সরবরাহ না করায় তারা তা বানাতে সক্ষম হয়নি। কোটি কোটি মানুষ এরফলে উন্নত পরিসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

এরই বিপরীতে এই রিপোর্ট কিউবার উজ্জ্বল ভূমিকাকেও চিহ্নিত করেছে। দেখিয়েছে কিউবা শুধুই যে নিজের দেশের লোককে ভালোভাবে ভ্যাক্সিন দিতে পেরেছে তা নয়, তারা ভিয়েতনাম, ভেনিজুয়েলা, ইরানেও ব্যাপকভাবে ভ্যাক্সিন সরবরাহ করেছে।

growing deprivation and inequality

ভারতের পরিস্থিতি সম্পর্কে এই রিপোর্ট যে চিত্র তুলে ধরেছে এইবার সেইদিকে নির্দিষ্টভাবে তাকানো যাক। মার্চ ২০২০ থেকে নভেম্বর ২০২১ — এই সময়কালের মধ্যে ভারতের ৮৪ শতাংশ জনগণের আয় কমেছে বলে অক্সফ্যাম রিপোর্ট জানিয়েছে। অন্যদিকে এই সময়কালেই ভারতের অতি ধনীরা আরো ধনী হয়েছেন। বিলিয়নেয়ারদের সংখ্যা এই সময়কালে ১০২ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪২। জনগণের ওপর যেমন একদিকে অপ্রত্যক্ষ করের বোঝা বেড়েছে, তেমনি অন্যদিকে কমেছে কর্পোরেট ট্যাক্স-এর অংশভাগ।

মধ্য আয়ের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারত সরকার স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কতটা কম ব্যয় করে তা এই রিপোর্ট তুলে ধরেছে। ব্রাজিল জিডিপি’র ৯.৫১ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকা ৮.২৫ শতাংশ, চিন ৫.৩৫ শতাংশ, রাশিয়া ৫.৩২ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করে। তুলনায় ভারতের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় মাত্র ৩.৫৪ শতাংশ। ভারতে স্বাস্থ্যখাতে কম ব্যয়ের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী দরিদ্র ও প্রান্তিক বর্গের মানুষজন। এই রিপোর্ট জানিয়েছে ভারতের একজন দলিত মহিলার গড় আয়ু একজন উচ্চবর্ণ মহিলার চেয়ে ১৫ বছর কম। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের তুলনায় আদিবাসী জনগণের গড় আয়ু ৪ বছর কম।

একই চিত্র শিক্ষাখাতে ব্যয়বরাদ্দতেও। ব্রাজিল জিডিপি’র ৬.১ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকা ৬.৮ শতাংশ, রাশিয়া ৪.৭ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করলেও ভারতে এই ব্যয় দীর্ঘদিন ধরেই ঘোরাফেরা করছে ৩ শতাংশের মধ্যেই। একে ৬ শতাংশে উন্নীত করার দীর্ঘকালীন দাবি পূরণে সরকার কোনও আগ্রহই দেখাচ্ছে না।

শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিসেবা পাবার ক্ষেত্রে ভারতের ধনী ও দরিদ্র অংশর মধ্যে যে দুস্তর পার্থক্য এটা সকলেরই জানা। অক্সফ্যাম রিপোর্ট সুনির্দিষ্ট তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছে যে ভারতের ৯৮ জন বিলিয়নেয়ার-এর ওপর শতকরা ১ শতাংশ অতিরিক্ত কর আরোপ করলেই ভারতের স্কুলশিক্ষা, সাক্ষরতা কর্মসূচি ও আয়ুষ্মান ভারতের মতো স্বাস্থ্য কর্মসূচির সাত বছরের যাবতীয় ব্যয় উঠে আসবে।

ভারত ও বাংলার প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমে অক্সফ্যামের এই গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট নিয়ে সেভাবে আলোচনা হয়ইনি। তার কারণও অস্পষ্ট নয়। নয়া উদারনৈতিক শাসনের সঙ্গে কর্পোরেট মিডিয়ার ঘনিষ্ট গাঁটছড়া এইসমস্ত বিষয়কে আড়াল করতেই চায়। সংগ্রামী শক্তি ও জনগণের নিজস্ব প্রচারাভিযানকেই দায়িত্ব নিয়ে সামনে আনতে হবে সরকারী ও কর্পোরেট নীতিমালার সঙ্গে অসাম্য ও তার ক্রমবৃদ্ধির ঘনিষ্ট সম্পর্ককে।

- সৌভিক ঘোষাল

bank money in the hands of corporate entities

কর ফাঁকি দিয়ে অপরিমেয় কালো টাকার অধিকারে ভারতীয় কর্পোরেটদের প্রভাবশালী অংশ যেমন পারদর্শী হয়েছে, সেরকমই ঋণের মাধ্যমে ব্যাঙ্ক অর্থের আত্মসাতেও তারা তাদের মুন্সিয়ানার পরিচয় কম দেয়নি। ঋণ পরিশোধে কর্পোরেটদের একাংশের অনাগ্ৰহ যেমন ব্যাঙ্কের ‘এনপিএ’ বা অনুৎপাদক সম্পদকে ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে চলেছে, ঋণ নিয়ে তার আত্মসাতে উন্মুখ কর্পোরেটদের সংখ্যাটাকেও আবার কমতে দেখা যাচ্ছে না। বিজয় মাল্য, নীরব মোদী, মেহুল চোক্সিরা কিভাবে ব্যাঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে সে সমস্ত আখ্যান আমাদের অজানা নয়। এখন আবার সেই তালিকায় আর একটা সংযোজন ঘটল, উন্মোচিত হল সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক জালিয়াতির আখ্যান। এবারের কেলেঙ্কারির কেন্দ্রে রয়েছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেদের রাজ্য গুজরাতের জাহাজ নির্মাণ সংস্থা এবিজি শিপইয়ার্ড কোম্পানি, গুজরাতের সুরাত ও দহেজ থেকে তারা তাদের কর্মকাণ্ড চালাত। নয়-নয় করে ২৮টা ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তারা নিয়েছিল ২২,৮৪২ কোটি টাকার ঋণ, তার পুরোটাই অপরিশোধিত থেকেছে। এই সমস্ত কীর্তিকলাপে যারা মাতে তাদের প্রায় সবাইকেই শাসক শিরোমণিদের ঘনিষ্ঠ বলে দেখা যায়। আলোচ্য কেলেঙ্কারির নায়ক এবিজি শিপইয়ার্ডের প্রধান ঋষি কমলেশ আগরওয়ালও মোদী ঘনিষ্ঠ বলে কানাঘুষো আওয়াজ উঠেছে।

ঋষি কমলেশ আগরওয়ালের এবিজি শিপইয়ার্ড ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ পেয়েছিল এরকম, আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক ৭,০৮৯ কোটি; আইডিবিআই ব্যাঙ্ক ৩,৬৩৯ কোটি; এসবিআই ২,৯২৫ কোটি; ব্যাঙ্ক অফ বরোদা ১,৬১৪ কোটি; পিএনবি ১,২৪৪ কোটি; এবং অন্যান্য (যারমধ্যে এলআইসি’ও রয়েছে) ৬,৩৩১ কোটি। বিভিন্ন ব্যাঙ্ক দরাজ হস্তে যাদের এত ঋণ দিয়ে দেয়, তাদের রাজনৈতিক সংযোগ যে যথেষ্ট শক্তিশালী তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয়। এবিজি শিপইয়ার্ড ঋণের জন্য আবেদন জানালে তা জাহাজ ও জাহাজের যন্ত্রাংশ নির্মাণেই ব্যয়িত হওয়ার কথা। কিন্তু সংবাদ সূত্রে জানা যাচ্ছে, কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা অন্তত ৯৮টা সহযোগী সংস্থা খুলে সেগুলোতে প্রাপ্ত ঋণের অর্থ সরিয়ে নেয়। সহযোগী কোম্পানিগুলো থেকে টাকা আবার পাচার হয় বিদেশে, সেখানে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কেনা হয় এবং ঋণের টাকাকে অন্যান্য আর্থিক কর্মকাণ্ডে লাগানো হয়। নির্মাণ কাজে লাগানোর জন্য যে ঋণ দেওয়া হয়েছিল, সেই বিপুল পরিমাণ টাকা এইভাবে তছরুপ করা হল, নির্মাণ ব্যতীত অন্য উদ্দেশ্যে লাগানো হল, তহবিলের চরম অপব্যবহার ঘটল। কোম্পানির কার্যকলাপ দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে — অনেকে আবেদন করে ঋণ না পেলেও এবিজি শিপইয়ার্ডের ক্ষেত্রে ঋণপ্রাপ্তি এত অনায়াস হলো কিভাবে? প্রদত্ত ঋণ ঠিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা তার যাচাই করাটা কি ঋণদাতাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না? যে ২৮টা প্রতিষ্ঠান থেকে ঋষি কমলেশ আগরওয়াল ও কোম্পানির অন্যান্য পরিচালকরা নির্মাণ কাজের জন্য ঋণ নিলেন, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর একটাও কেন প্রদত্ত অর্থের ব্যয় যথার্থ পথে হচ্ছে কিনা এবং ব্যাঙ্কও প্রতারণার শিকার হচ্ছে কিনা তার পরখ করতে সক্রিয় হলো না? রাজনৈতিক প্রভাবই কি সেই লক্ষ্যে প্রতিবন্ধক হয়েছিল? তদন্ত শুরু হতেই বা বিলম্ব ঘটল কেন?

তদন্তের শুরুতে বিলম্ব হয়েছে কিনা তার বিচার করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, এসবিআই প্রথম অভিযোগ সিবিআই’এর কাছে দায়ের করে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসের গোড়ায়, আর সিবিআই তার পরিপ্রেক্ষিতে এফআইআর প্রক্রিয়া শুরু করে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির গোড়ায়। এবং তারপর ১২ ফেব্রুয়ারি গুজরাত, মহারাষ্ট্র সহ কয়েকটা রাজ্যের ১৩টা স্থানে সিবিআই তল্লাশি চালায় ও কিছু নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করে। কয়েকদিন আগের ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন জানিয়েছে, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সিবিআই ঋষি কমলেশ আগরওয়ালকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং অন্য অভিযুক্ত পরিচালকদের সন্ধান তারা পেয়েছে। তাহলে ঋষি কমলেশ আগরওয়ালের দেখা পেলেও সিবিআই তার গ্ৰেপ্তারিকে এড়িয়ে গেছে। এসবিআই’এর অভিযোগ দায়ের এবং সিবিআই’এর পদক্ষেপের মাঝে দু’বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হওয়াটা তো তদন্তের আন্তরিকতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে। এসবিআই’এর প্রথম অভিযোগ দায়েরের পর সিবিআই’এর কিছু বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া এবং আরো ন’মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পর এসবিআই’এর দ্বিতীয় অভিযোগ দায়ের — কালক্ষেপণের উদ্দেশ্যেই কি এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়া হয়েছিল? সিবিআই’এর কাছে এসবিআই’এর দায়ের করা অভিযোগের একটা অংশও যথেষ্ট কৌতূহলের উদ্রেক করে। অভিযোগপত্রে এসবিআই উল্লেখ করেছে যে, “বিশ্ব জোড়া সংকট জাহাজ নির্মাণ শিল্পে এইদিক থেকে প্রভাব ফেলে যে, পণ্যের চাহিদা এবং মূল্যে হ্রাস ঘটে এবং পরবর্তীতে পণ্য পরিবহণের চাহিদারও অবনমন ঘটে। কিছু জাহাজ এবং জলযানের বরাত বাতিল হওয়ার ফলে নির্মিত পণ্য জমে যায়। ফলস্বরূপ সক্রিয় পুঁজির ঘাটতি দেখা দেয় এবং ক্রিয়াশীল চক্রের বৃদ্ধি ঘটে, যারফলে নগদের ও আর্থিক সমস্যা তীব্রতর হয়ে ওঠে।” সম্পূর্ণরূপে প্রতারক ও জালিয়াত একটা কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়বস্তু হিসাবে জাহাজ শিল্পে সংকটের এই উল্লেখ অভিপ্রেত উদ্দেশ্যকে, কোম্পানির অনাচারের বিরুদ্ধে যথার্থ পদক্ষেপ গ্ৰহণকে কিভাবে সহায়তা করতে পারে? কোম্পানির আর্থিক প্রতিকূলতার জন্যই তাকে ঋণ দেওয়া হয়েছিল — এই অজুহাতই কি এসবিআই সমস্ত ব্যাঙ্কের পক্ষে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে? প্রতারক কোম্পানিকে বাছবিচারহীনভাবে যথেচ্ছ ঋণদানের ভ্রষ্টাচার থেকে নিজেদের পিঠ বাঁচাতেই কি ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের জাহাজ শিল্পে সংকটের ব্যাখ্যার এই অবতারণা?

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ বলেছেন, ব্যাঙ্ক অর্থের প্রতারণার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্ৰহণে, অর্থাৎ, অভিযোগ দায়ের করতে ৫২ থেকে ৫৬ সপ্তাহ লেগে যায়। তিনি আরও বলেছেন, ইউপিএ জমানাতেই, ২০১৩ সালেই নাকি এবিজি শিপইয়ার্ডের নেওয়া ঋণ অনুৎপাদক সম্পদে পরিণত হয়েছিল। বিলম্বে ব্যবস্থা গ্ৰহণের অভিযোগকে খণ্ডনের উদ্দেশ্যে এই মন্তব্য করা হলেও এই অভিযোগকে পুরোপুরি খারিজ করা যাবে? ঋণ ইউপিএ আমলে ২০১৪’র আগে দেওয়া হলেও এবং ২০১৩ সালের নভেম্বরে এনপিএ’র পরিচায়ক হয়ে উঠলেও আর্ণেস্ট ও ইয়ং’এর ফরেনসিক অডিট রিপোর্ট জানিয়েছে, জালিয়াতি সংঘটিত হয় ২০১২ থেকে ২০১৭’র মধ্যে (অর্থাৎ, কিছুটা মোদী জানাতেই) এবং প্রদত্ত ঋণ এনপিএ বলে ঘোষিত হয় ২০১৬ সালের জুলাই মাসে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে আরও জানা যাচ্ছে, ঋণ অপরিশোধিত থাকায় কোম্পানির বিরুদ্ধে লিকুইডেশন প্রক্রিয়া (কোম্পানিকে দেউলিয়া ঘোষণার মাধ্যমে তার সম্পদ বিক্রি করে যতটা সম্ভব ঋণ পরিশোধ) শুরু হয় ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে। এরপরও কোম্পানির ওপর নজর কেন্দ্রীভূত করে সিবিআই’এর পদক্ষেপ গ্ৰহণে পাঁচবছর লেগে যাওয়ার কোনো যুক্তিগ্ৰাহ্য ব্যাখ্যা কী থাকতে পারে? ঋষি আগরওয়ালের সঙ্গে মোদীর ঘনিষ্ঠতার কথা ওঠাতেও নির্মলার আসরে নামা। কিন্তু কংগ্ৰেস এই অভিযোগ তুলেছে যে, নরেন্দ্র মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় ২০০৭ সালে এবিজি শিপইয়ার্ডকে ১,২১,০০০ বর্গমিটার জমি দিয়েছিলেন এবং সেই জমির বাজার দর বর্গমিটার প্রতি ১,৪০০ টাকা হলেও মোদী সরকার জমি দিয়েছিলেন প্রতি বর্গমিটার ৭০০ টাকা দরে, যার জন্য ক্যাগ তাদের রিপোর্টে রাষ্ট্রীয় তহবিলের ক্ষতির বিনিময়ে ঋষি আগরওয়ালের কোম্পানিকে পক্ষপাতিত্ব দেখানো নিয়ে মন্তব্য করেছিল; ঋষি আগরওয়াল মোদীর ভাইব্র্যান্ট গুজরাত অনুষ্ঠানে নিয়মিত যোগ দিতেন এবং মোদী তাঁকে ২০১৩ সালে (যে বছর ঋষি আগরওয়ালদের নেওয়া ঋণ এনপিএ হয়ে গিয়েছিল বলে সীতারামণ বলেছেন) দক্ষিণ কোরিয়া নিয়ে যান। এই তথ্যকে অসত্য ঘোষণা করে নির্মলা সীতারামণ তাকে কি অস্বীকার করতে পারবেন? অতএব, কোম্পানির মাথার সঙ্গে মোদীর ঘনিষ্ঠতার জন্যই ব্যবস্থা গ্ৰহণে বিলম্বের অভিযোগকে একেবারে ভিত্তিহীন বলা যাবে না।

শাসক-ব্যবসায়ী ঘনিষ্ঠতা নরেন্দ্র মোদী জমানার আবিষ্কার করা কোনো বন্দোবস্ত নয়। মোদী জমানার আগেও তার অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু এই জমানায় কর্পোরেট প্রীতির ব্যাপকতা ও প্রকটতা আগের সমস্ত জমানাকে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদে সাঙাতি দোস্তির পৃষ্ঠপোষকতাও বেপরোয়া হয়ে উঠে আশঙ্কাজনক মাত্রা নিয়েছে। এনপিএ ক্রমবর্ধমান এবং ব্যাঙ্কের খাতা থেকে কর্পোরেট ঋণ মুছে ফেলার পরিমাণও বেড়ে চলেছে (মোদী জমানাতেই ব্যাঙ্কের খাতা থেকে ঋণ মুছে ফেলার পরিমাণ হল ১০ লক্ষ ৭২ হাজার কোটি টাকা!)। মোদী জমানা কর্পোরেটকুলের কাছে এমন কোনো কঠোর বার্তা দিতে পারেনি যা তাদের ব্যাঙ্ক ঋণকে লুটের সামগ্ৰী বলে গণ্য করা থেকে বিরত করতে পারে। রাষ্ট্রীয় তথা জনগণের সম্পদের কর্পোরেট লুন্ঠনকে এই জমানায় যেমন স্বাভাবিক ব্যাপার করে তোলা হচ্ছে, তারই সাথে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়াকেও গতিশীল করা হচ্ছে। গোটা প্রক্রিয়াটাকে বিপরীতমুখী করতে হলে এই জমানার অপসারণ ছাড়া জনগণের কাছে অন্য কোনো বিকল্প থাকতে পারে না।

- জয়দীপ মিত্র

Bangadarshan

ভোরের আবছা কুয়াশায় গন্ধটি ঝাপটা মারিয়াছিল। চূত মুকুলের গন্ধ! কাকতালীয়ভাবে দিনটি ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের সেই দিনটিতেও কী এমনই আম্র মুকুলের মাদকতাময় গন্ধ আর ভোরের কুয়াশা গায়ে মাখিয়া জড়ো হইয়াছিলেন প্রতিবাদীরা ঢাকার রাজপথে!

আ মরি বাংলা ভাষা!
'ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়
বাংলার নদী-মাঠ-ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার
কেঁদেছিল পায় —'

এমন নিগূঢ় রোমান্টিকতার কোমল বেদনামাখা রূপকল্প বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষায় সম্ভব! এ ভাষা বিদ্রোহ প্রতিবাদ প্রতিরোধেরও ভাষা! এই ভাষাই কিশোর হৃদয়ে দেশপ্রেমের বীজ বোনে! এক গ্রীষ্মের দুপুরে কিশোর দাদাটি ছোট বোনের হাতের লেখার খাতায় লিখিয়াছিল, “ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান/আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দিবে কোন বলিদান?”। অশ্রুতপূর্ব পংক্তি দুইটি মনে গাঁথিয়া গিয়াছিল। কিন্তু দাদা কেন ঐ কথা লিখিয়াছিল? তাহার উত্তর কয়েক বছর বাদে মিলিয়াছিল। সত্তরের দশকে বাংলার যৌবন শ্রমিক-কৃষকের রক্ত ঘামের ঋণ, কাকদ্বীপের অহল্যা মা, নকশালবাড়ির শহীদ সপ্ত কন্যাসহ বিভিন্ন আন্দোলনের অজস্র শহীদের রক্তঋণ শোধ করিতে জীবন আহুতি দিয়াছিল। এই বাংলার মাটি কম আন্দোলন দেখে নাই! আন্দোলনকারীদের রক্তে বার বার সিঞ্চিত হইয়াছে এই মাটি!

গণতন্ত্রের পীঠস্থান সেই ঐতিহ্যের মাটিতে আজ কীসের চাষ হইতেছে? হিংসার, অসহিষ্ণুতার, সন্ত্রাসের? গত ১৮ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে পুলিশের পোশাকে আসা চার ব্যক্তির উপস্থিতিতে বাড়িতে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের নৃশংশ হত্যার ঘটনা শিহরিত করে।

‘দালালের কাছে আত্মসমর্পণ’ অপেক্ষা ‘মৃত্যুকে আলিঙ্গন’ করা শ্রেয় মনে করিয়াছিল প্রতিবাদী তরুণটি! সেই আঠাশ বর্ষীয় আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আজ ‘প্রতিবাদী বাংলার’ মুখ! আনিস খান! প্রতিটি অন্যায়কেই যে প্রতিবাদযোগ্য মনে করিত। দলমত বিচার সেখানে অন্তরায় হয় নাই। সেই আনিসের হত্যার বিচারের দাবিতে গোটা ছাত্র সমাজ উত্তাল হইয়াছে। দলমত ধর্ম বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে। আনিসের অপরাধ-সে সংবিধান স্বীকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার, পরিসর, চর্চা চাহিয়াছিল! জীবন দিয়া সে তাহার অঙ্গীকার রাখিয়া গেল! মাথা সে নত করে নাই!

তাহারও আগে এক মানবাধিকার ও সমাজকর্মী সংগঠকের প্রতি পুলিশি হেনস্থার প্রতিবাদে বিক্ষোভরত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু পড়ুয়াসহ রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করিয়া অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। ছাত্রীদের যৌন হেনস্থাসহ অশ্রাব্য অকথ্য গালি দেওয়া হয়।

এই নির্যাতন, আনিস-হত্যা ও তাহার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ পড়ুয়াদের ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি পুলিশের ব্যবহার একটি প্রশ্নকে অনিবার্য করিয়াছে। মাননীয়ার পুলিশের সহিত দিল্লীর বা উত্তর প্রদেশের পুলিশের আদৌ কি কোনও ফারাক আছে?

আমাদের প্রশাসনিক প্রধান কলা শিল্প সাহিত্যের প্রবল অনুরাগী! সম্প্রতি তিনি এক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আসিয়াছিলেন। স্বভাববিরুদ্ধ সহিষ্ণুতায় বিশিষ্ট জনের বক্তব্য শুনিলেন, শিশুর উদ্যমে প্রবল বিক্রমে ডঙ্কা বাজাইলেন, বালিকার সারল্যে অক্লান্ত হাতে অন্তত ডজনখানেক বইয়ের আবরণ উন্মোচন করিলেন! (মঞ্চে তখন বই লইয়া যেরূপ কাড়াকাড়ি পড়িয়া গেল, দেখিয়া যে কোনও কলমজীবী ঈর্ষাতুর হইতেই পারেন!) অতঃপর তিনি বাংলা ভাষার বৈভব ও গৌরব লইয়া যাহা বলিলেন, তাহা কি অন্তর হইতে বলিলেন? তবে তাহার পুলিশ বাহিনী এত কুৎসিত, এত অশ্লীল ভাষা কেন প্রয়োগ করে শিক্ষার্থী ও গণ আন্দোলনের কর্মীদের প্রতি? তাহাদের অস্ত্র এত জিঘাংসু কেন? রাজনীতির অঙ্গনটি প্রতিমুহূর্তে এত অশালীন কুমন্তব্যে কলুষিত হইতেছে কেন? একজন ‘ভাষাপ্রেমী’ প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে তাহার দায়িত্ব নাই কলুষমুক্ত করিবার? নাঃ, আজ আর তাহার আয়ত্তে নাই। সমগ্র রাজ্যটিকে বিরোধীশূন্য করিতে গিয়া সে কৌশল এখন বুমেরাং হইয়া উঠিয়াছে। দলের মধ্যে অজস্র ‘নির্দল’ উপদল! বাহুবলে পেশীবলে ভর করিয়া তাহারা পুরভোটে লড়িয়াছে এবং অনেকেই জিতিয়াছে। এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনরা এখন দলের মাথাব্যথা!

শহর গ্রামে পরিস্থিতি ক্রমশ অসহনীয় হইয়া উঠিয়াছে। ‘সহজপাঠ’ হাতে লইয়া বিস্ময়বিহ্বল শিশু দেখিতেছে, পাড়ার কোনও দাদা বা কাকার সহিত দাদা বা বাবা সুন্দ-উপসুন্দের মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ। বহিরাগত কেহ মায়ের কেশাকর্ষণ করিতেছে, বস্ত্রাঞ্চল টানিতেছে! সবই ‘রাজনীতির’ কারণে! শাসকদলের বর্ষীয়ান নেতা অত্যন্ত সঠিকভাবে বলিয়াছেন, সীমিত পরিসরের মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই! ‘ক্ষমতা লিপ্সা’! কারণ রাজনীতি এখন ‘ব্যবসা’, পুরসংস্থাগুলি ‘কামধেনু’! যত পার লুটিয়া লও!

কিন্তু মাননীয়া, ঐ ক্রন্দনরত শিশুটির কী হইবে, হয়তো যে অনাথ হইয়াছে, আপনার ‘বিরোধীশূন্য’ রাজনীতির কল্যাণে? কিংবা দলীয় ‘নির্দলের’ মরিয়া দ্বন্দ্বে?

পাঠক ভাবিতেই পারেন-এ কেমন হইল? শুরু তো হইয়াছিল বাংলা ভাষা নিয়া! সবিনয়ে বলি — রাজনীতি ভাষাবিচ্ছিন্ন নহে। ভাষাই তো রাজনৈতিক চেতনার, আন্দোলনের, কর্মকাণ্ডের বাহন! সেই ভাষা যদি বিপন্ন হয়, রাজনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার!

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

real situation in the coal mine area

গত ৫ ফেব্রুয়ারি একটি সোশাল মিডিয়া গ্রুপ থেকে দলের সাথীদের সঙ্গে নিয়ে বীরভূমে প্রস্তাবিত কয়লাখনি এলাকার চারটি গ্রাম দেওয়ানগঞ্জ, হরিনসিঙ্গা, কেন্দ্রপাহাড়ি ও সগেলেতে বাস্তব পরিস্থিতি দেখা, জানা ও পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম। প্রথমেই বলে রাখি ওখানের সিংহভাগ বাসিন্দা সাঁওতাল আদিবাসী ও কিছু মুসলিম। তাঁরা কিন্তু কেউ কয়লাখনি চান না। চারটি গ্রাম ঘুরে কোনো কয়লাখনি সমর্থককে আমরা খুঁজে পাইনি। সবাইকে ডেকে জিজ্ঞাসা করছিলাম তারা সরকারি প্যাকেজে খুশি কিনা, বা এলাকায় কয়লা খনি চান কিনা। তাঁরা কিন্তু কেউ কয়লা খনি চান না, এবং শুধু প্যাকেজ কেন, কোনো কিছুর বিনিময়েই তাঁরা নিজেদের বাড়ি ঘর, ভিটা মাটি ছাড়তে রাজি নন। তাঁরা এমনও জানিয়েছেন যে দরকারে তাঁরা জীবন দেবেন তবুও গ্রামের মাটি, চাষ জমি ছাড়বেন না। এবং অবশ্যই উনারা পুরো আদিবাসী সমাজ, সাঁওতাল সমাজ ও আদিবাসীপ্রেমী, মানবপ্রেমী সহৃদয় ব্যক্তিদের সাহায্য প্রার্থনা করেছেন নিজেদের বাঁচানোর তাগিদে।

খুবই অবাক হয়েছিলাম ওখানে চারদিকে চাষজমি দেখে। জিজ্ঞাসা করছিলাম যে খবরে বেরিয়েছে এখানে চাষবাস হয় না, কিন্তু আমরা তো দেখছি চারদিকে চাষজমি? উনারা খুব অবাক হয়ে বলেছেন যে উনারা যা বলেন, বা ওখানের যা বাস্তব পরিস্থিতি সেগুলো মিডিয়া দেখাচ্ছে না! অনেক মিডিয়া নাকি উনাদের গ্রামে গেছে কিন্তু বাস্তব ও সঠিক খবর বাইরে আসেনি! এই কারণে কিছু গ্রামে আমরা অপ্রত্যাশিত কিছু অভিযোগের শিকার হয়েছি যে আমরাও হয়তো সত্য প্রকাশ করবো না। কিন্তু আমরা কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রেখেছি। যা সত্য তাই আমাদের সোশাল মিডিয়া গ্রুপের মাধ্যমে দেখিয়েছি, যা আমাদের দর্শকরা ইতিমধ্যে দেখেছেন।

আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে বলতে চাই যে ওখানে শুধু চাষবাসই হয় বলবো না, খুব ভালো চাষবাস হয়। উনারা বেশিরভাগ পরিবারই দুবার চাষ করেন। ধান ছাড়াও অন্যান্য শস্য দানা, সর্ষে চাষ হয় যা আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি এবং যে কেউ এই এলাকায় গিয়ে দেখে আসতে পারেন। এত সুন্দর আদিবাসী গ্রাম, এত ভালো ও শান্তিপ্রিয় মানুষদের জীবন এইভাবে কয়লাখনির নামে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ভাবতেও পারছি না। কি সুন্দর সব ঘরবাড়ি বানিয়ে আদিবাসীরা শত বছর ধরে বসবাস করছেন, উনাদের গ্রাম ও উনাদের দেখেও ভালো লাগে। চাষজমি, বাগান, গবাদিপশু, ধর্মীয় জাহের থান, মাঝিথান ও পরস্পরের সাথে সুন্দর ও হার্দিক সম্পর্ক নিয়ে, এবং সর্বোপরি শতাব্দী প্রাচীন সামাজিক মাঝিআরি নিয়ে জীবন যাপন করছেন ওখানের মানুষজন, কোন অপরাধে নিজেদের শান্তির বাসা ছাড়বেন, এটা এই অধম প্রতিবেদকেরও প্রশ্ন?

আমরা ওখানের বাসিন্দাদের সাথে যখন কথা বলেছিলাম, উনাদের চোখ ছল হতে দেখেছি। কিন্তু এরসাথে মনে জোর, চোখে আগুনও লক্ষ্য করেছি। উনারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে কোনোভাবে নিজের গ্রাম ছেড়ে যাবেন না, কোনোভাবেই না। উনাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে, তাই এই মুহূর্তে আন্দোলন ছাড়া উনাদের উপায় নেই। উনাদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম যে সরকার তো বলছে এখানে কয়লাখনি করবেন, যদি কয়লাখনি হয় কি করবেন? উনারা বলেছেন উনারা যেভাবেই হোক আটকাবেন এবং কোনোভাবেই খনি হতে দেবেন না।

আর একটি কথা না বলে পারছি না যে একটি গ্রামে কিছুদিন আগে শাসক দলের কয়লাখনি সমর্থনে মিছিলে গ্রামের মহিলারা বাধা দেওয়ায় তাঁদের মারধর করার অভিযোগ যে মিথ্যা নয় সেটাই উনারা বলেছেন। এবং উনাদের বিরুদ্ধে নেশা খেয়ে মাতলামি করার যে অভিযোগ করা হয়েছে তা যে সম্পূর্ণ মিথ্যা সেটা উনারা আমাদের জানিয়েছেন।

আর একটি কথা না বলে পারছিনা যে ওখানের কিছু গ্রামে আমরা মাঝি বাবাদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে ওই এলাকার একসময়ের আদিবাসী গাঁওতার আদিবাসী দরদি নেতা সুনীল সরেন ও রবিন সরেন ওখানে একাধারে ভগবান ও সুপ্রীমকোর্ট! কিছু মাঝিবাবা খনি বিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে গ্রামবাসীদের সম্মতি আদায়ের চেষ্টা করলেও সরেন শাসনের চোখ রাঙানিতে সেই কাজও অসমাপ্ত থেকে গেছে। উনাদের অনুমতি ছাড়া নাকি ওখানের গাছের পাতাও নড়ে না! ওই এলাকা ও পার্শবর্তী গ্রামের মাঝি বাবারা এবং অনেক ব্যক্তি নিজেদের নাম ও পরিচয় দিতে ভয় পেয়েছেন। এবং নাম বললেও প্রকাশ করতে বারণ করেছেন। ওই এলাকার আদিবাসী ও মুসলিমরা কোন পরিস্থিতিতে আছেন নিশ্চয় পাঠক অনুধাবন করতে পারবেন। অসহায় আদিবাসীদের এক সঙ্গীন মুহূর্তে বীরভূমের কয়লাখনি এলাকার বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম।

- রাজীব বাস্কে, ঝাড়গ্রাম

(২০ ফেব্রুয়ারি বীরভূম জমি জীবন জীবিকা ও প্রকৃতি বাঁচাও মহাসভার ডাকে দেওয়ানগঞ্জে প্রতিবাদী সমাবেশ সংগঠিত হওয়ার পর গ্রামবাসীদের ওপর যে পুলিশ-শাসকদল যৌথ বাহিনীর সন্ত্রাস নামে সেই প্রেক্ষিতে প্রতিবেদকের দেওয়া ফেসবুক পোস্ট থেকে প্রতিবেদনটি সংগৃহীত)

The structure of the traditional justice system

সান্তাড়রা নিজস্ব এবং স্বতন্ত্র এক পরম্পরাগত শাসন ব্যবস্থার দ্বারা ব্যক্তিজীবন ও সমষ্টিজীবনে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হন। এই পরম্পরাগত শাসন ব্যবস্থার নাম হল মাঁঝি ব্যবস্থা বা পঞ্চজন ব্যবস্থা। ব্যাপক অর্থে মাঁঝি ব্যবস্থারই অপর নাম হল রাষ্ট্রব্যবস্থা। তাঁদের এই শাসন ব্যবস্থাকে নিজস্ব ও স্বতন্ত্র বলা হয়েছে এইজন্য যে, এটি সারিধর্মের ধর্মগ্রন্থ জমসিম বিন্তি ভিত্তিক যে সকল অলিখিত বিধি বিধান নির্দিষ্ট রয়েছে সেই বিধি বিধান বা অনুশাসন অনুসারে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ জমসিম বিন্তি ভিত্তিক সান্তাড়দের শাসনব্যবস্থায় নিজস্ব পরম্পরাগত সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় বিধান ও প্রতিবিধান রয়েছে। তাঁদের এই পরম্পরাগত মাঁঝিব্যবস্থা তথা রাষ্ট্রব্যবস্থায় একদিকে যেমন প্রশাসনিক বিভাগ রয়েছে, অন্যদিকে তেমনি বিচার বিভাগও রয়েছে।

সান্তাড়দের যে পঞ্চজন গ্রামীণ ব্যবস্থার কথা আমরা জেনেছি সেই মড়ে হড় বা পঞ্চজন শাসন ব্যবস্থার বহুবিচিত্র কার্যাবলীর মধ্যে অন্যতম একটি কাজ হল বিচারকার্য। তাঁরা একদিকে ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক দায়িত্ব ও কার্যাবলী পালন করেন ও অপরদিকে প্রশাসনিক এবং বিচার বিভাগীয় কার্য পরিচালনা করেন। বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁদের পরম্পরাগত ত্রিস্তরবিশিষ্ট বিচারালয় বা পরিষদ রয়েছে। তাঁদের ত্রিস্তরবিশিষ্ট বিচার ব্যবস্থার প্রথম পর্যায়ের বিচার ব্যবস্থা হল পঞ্চজন বিচার ব্যবস্থা এবং এরজন্য একটি পরিষদ রয়েছে যার নাম হল মাঁঝি বাইসি বা মাঁঝি পরিষদ। সান্তাড়রা বিচারালয় বা পরিষদকে বাইসি বলেন। মাঁঝিব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা অপর দুটি অর্থাৎ দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের বিচারালয় হল পারগানা বাইসি বা পারগানা পরিষদ এবং ল-বির বাইসি বা ল-বির পরিষদ।

মাঁঝি বাইসি এবং মাঁঝি বিচারালয় হল সকল পরিষদের আদি, মৌল এবং ভিত্তিস্বরূপ। মাঁঝি বাইসিতে গ্রামের মাঁঝি তথা মাঁঝিহাড়াম, পারগানা বাইসিতে পারগানা এবং ল-বির বাইসিতে সেঁন্দরা নায়কে সভাপতিত্ব করেন। মাঁঝি বিচারালয় বা পরিষদটি প্রতিটি সান্তাড় গ্রামে বিদ্যমান এবং এটি প্রত্যেক গ্রামের মাঁঝি হাড়ামের সভাপতিত্বে গ্রামের মাঁঝিথানে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এখানে উক্ত পাঁচজন পদাধিকারী ব্যক্তিগণ এবং গ্রামের প্রতিটি পরিবারের প্রধান অথবা প্রাপ্ত বয়ষ্ক পুরুষ অংশগ্রহণ করে থাকেন। পারগানা বাইসির ক্ষেত্রে কতকগুলি গ্রামের মাঁঝিদের নিয়ে পারগানা একটি পারগানা বাইসি বা পরিষদ গড়ে তোলেন এবং তাঁর সহকারী হিসেবে একজন দেশ-মাঁঝিকে নিযুক্ত করেন। ডব্লিউ জি আর্চার তাঁর ট্রাইবাল ল অ্যান্ড জাস্টিস গ্রন্থে বলেছেন যে, পাঁচজন মাঁঝি তথা পাঁচটি গ্রাম নিয়ে একটি পারগানা পরিষদ গঠিত হয়ে থাকে। যদিও পাঁচটির অধিক গ্রামের মাঁঝি নিয়েও পারগানা পরিষদ গঠিত হতে পারে। পারগানা বাইসিতে পারগানার অধীনে থাকা সমস্ত গ্রামের জনসাধারণ পরিষদের বিচারকার্যে অংশগ্রহণ করেন এবং সহযোগিতা করেন। এই দুটি পরিষদের ঊর্ধ্বে আরও একটি সর্বোচ্চ, চূড়ান্ত বিচারালয় বা পরিষদ রয়েছে যেটি হল ল-বির পরিষদ। এই ল-বির পরিষদ বিভিন্ন নামে পরিচিত যথা — ল-মহল, ল-বির সেঁন্দরা, সেঁন্দরা বাইসি ইত্যাদি।

সান্তাড়রা বিচারকার্য শুরু করার প্রারম্ভে সম্মিলিত ও উপবিষ্ট সকলের মাঝখানে একটি জলপূর্ণ ঘটি স্থাপন করেন। জলপূর্ণ ঘটি স্থাপনের প্রতীকী অর্থ হল বিচার সর্বদাই শান্তিমূলক হবে। অর্থাৎ বিচার কার্যের প্রধান লক্ষ্য হবে সমস্যার বা ঘটনার শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা করা। কখনই কারোর ধ্বংস বা বিনাশ কাম্য নয়, বরং শান্তি প্রতিষ্ঠাই হল প্রধান লক্ষ্য। বিচার বিভাগীয় অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সকলেই মাটিতে বসবেন অথবা যদি চাটাই থাকে তাহলে সকলেই চাটাইয়ের উপরে বসবেন। এখানে সকলেই সমান বলে গণ্য হন এবং একজন ব্যক্তির বক্তব্যকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। মাঁঝি, পারগানা বা সেঁন্দরা নায়কে সভাপতিত্ব করেন ঠিকই, কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সকলের মতামতই গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়ে থাকে।

মাঁঝি বাইসিতে মাঁঝির সভাপতিত্বে উক্ত পাঁচজন পদাধিকারী এবং গ্রামের প্রতি পরিবারের প্রবীণ অথবা প্রাপ্ত বয়ষ্ক পুরুষেরা বিচারকার্যে অংশগ্রহণ করে গ্রামীণ ও সামাজিক সমস্ত ধরনোর সমস্যা ও বিষয়ের আলোচনা ও তার মীমাংসা দ্বারা তাঁরা একটি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হন। বিশেষত তাঁরা মূল্যবোধ, নৈতিক দায়-দায়িত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা পরম্পরাগত বিধান ও প্রতিবিধানের সাহায্যে বিচারকার্য সম্পাদন করে থাকেন। এই মাঁঝি বাইসি গ্রাম প্রশাসনের জন্য বিধি প্রণয়ন থেকে শুরু করে সাধারণের কল্যাণের স্বার্থে প্রথাগত বিধি প্রয়োগ করে থাকে। যদি কেউ আচরণবিধি ভঙ্গ করে বা প্রথাগত নিয়ম লঙ্ঘন করে তাহলে তার বিরুদ্ধে মাঁঝি পরিষদ আইনি ব্যবস্থার প্রয়োগ করে থাকে।

মাঁঝি পরিষদে যে সকল সমস্যা বা বিষয়ের সমাধান হয় না, সেগুলি উচ্চ পরিষদ তথা পারগানা পরিষদে উত্থাপিত হয়। এখানেও উপরিউক্ত বিধান প্রতিবিধানের নিরিখে পারগানা পরিষদ অধীনস্ত গ্রামগুলির সর্বসাধারণের কল্যাণের স্বার্থেই বিচার করা হয়। এখানে পরিষদে অংশগ্রহণকারী সকল ব্যক্তির সম্মতি থেকে একটি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

পারগানা পরিষদে যে সকল সমস্যার সমাধান হয় না, সেগুলি সর্বোচ্চ পরিষদ তথা ল-বির পরিষদে উত্থাপিত হয়। এখানে পদাধিকারী ব্যক্তিবর্গ ও জনসাধারণ সকলেই সমমর্যাদার সাথে একই ভূমিতে উপবিষ্ট হন। তবে, এখানে পদাধিকারী ব্যক্তিবর্গের তুলনায় সাধারণ ব্যক্তিগণই সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের অধিকারী বলে পরিগণিত হন এবং তাঁদের গুরুত্বই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এখানে পদাধিকারী ব্যক্তিবর্গ কেবলমাত্র সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে জনসাধারণকে সাহায্য করেন।

- সুব্রত টুডু

In memory of Comrade Anup Ambuli

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হলেন পার্টির ঘনিষ্ঠ  দরদী কমরেড অনুপ আম্বুলি। ৭০’র শেষ দিকে উত্তর ২৪ পরগণা জেলার অশোকনগরে একসারি যুব ছাত্রদের সাথে তিনিও পার্টিতে যুক্ত হন। ধাক্কার পর ঐ এলাকায় নতুন করে পার্টিকে গড়ে তোলার নানাবিধ কর্মকান্ডে তিনি সংগঠকের ভূমিকা নেন। পরবর্তীতে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে কলকাতার দক্ষিণ শহরতলি ও বজবজ এলাকায় জুট শ্রমিকদের মধ্যে বেশ কয়েক বছর তিনি কাজ করেন। সর্বদাই হাসিখুশী এক রসিক মানুষ ছিলেন তিনি। অফুরন্ত জীবনীশক্তি ছিল তার সহজাত! কখনই কোনও নৈরাশ্য তাকে আচ্ছন্ন করে রাখতে পারতো না, ছিল সকলের প্রতি আন্তরিক বন্ধুতা, মানুষের সাথে মিশে যাওয়ার দক্ষতা। এজন্যই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সকলের প্রিয়জন। পরবর্তীতে তিনি সাংসারিক জীবনে ফিরে যান। দীর্ঘ কর্মজীবন তার কেটেছে ভুবনেশ্বরে, এক বেসরকারি কোম্পানির চাকরিতে। সেখানেও পার্টির সাথে একটা সম্পর্ক রেখে চলতেন। এবছর ডিসেম্বরের শেষ দিকে কলকাতায় এসে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তারপর কোমর্বিডিটি অসুস্থতায় কলকাতার বেসরকারি এক হাসপাতালে তাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। অবশেষে গত ২৭ জানুয়ারি ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ে। রাজারহাটে ক্যানসার হাসপাতালের ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন রোগটা নিরাময়ের বাইরে! বাস্তবে সেটাই সত্যি হয়ে উঠলো! আমাদের অনেকেরই প্রিয় দুলাল, অনুপ আম্বুলি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। বেশ কিছুদিন কলকাতার হাসপাতালে থাকার পর তাঁকে ভুবনেশ্বরে এআইএমএস’এ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই ঘটে তাঁর জীবনাবসান। কমরেড দুলাল আম্বুলির স্মৃতি বেঁচে থাকবে চিরকাল, তাঁকে জানাই লাল সেলাম।

== সমাপ্ত ==

খণ্ড-29
সংখ্যা-9