প্রতিবেদন
“... তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও...”
stand by as a human

ওরা কারা? রাজধানী কলকাতার বুকে নিত্য চলমান প্রত্যেকটি মানুষের মনে এ প্রশ্ন উঁকি দিয়ে চলেছে অবিরত। প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য কেউ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে, কেউ ব্যস্ততার মাঝে এক পলক তাদের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের গতিতে ফিরে যায়। আর যাদের মনে ওদের নিয়ে অজস্র প্রশ্ন তারা কেউ কেউ সামনে এগিয়ে আসে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য। ওরা কারা? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যই আজ আমি কলম ধরেছি। আমিও ওদেরই একজন।

আমাদের পরিচয়? আমরা সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের খেটে খাওয়া কৃষক, শ্রমিক দিন আনতে পান্তা ফুরোনো দিনমজুরের সন্তান। কিন্তু আমাদের বর্তমান পরিচয় ‘আন্দোলনকারী’। এই সাধারণ ছেলে-মেয়েরা কেন আন্দোলনকারী হয়ে উঠল সে সম্পর্কে অনেকের মনে অজস্র প্রশ্ন, কৌতুহল রয়েছে।

আজ থেকে পাঁচ বছর আগের কথা। কারো বয়স শেষের দিকে, কেউ মাঝামাঝি বয়সের,কেউ বা সদ্য এমএ, বিএড পাস করা। সকলের চোখে, সকলের বুকে বাসা বেঁধেছে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন! শিক্ষক। যে শিক্ষক সমাজ গড়ার কারিগর। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আজ সেই হবু শিক্ষকরা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত পড়ে থাকে রাস্তায়। বিদ্যালয় নয়, রাস্তাই যেন ওদের স্থায়ী ঠিকানা হয়ে উঠেছে। জীবিকার তাগিদে, দু’মুঠো অন্নসংস্থানের সন্ধানে রাস্তায় পড়ে থাকতে থাকতে তারা হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনদের। কেউ হারিয়েছে তাদের বৃদ্ধ বাবা-মা, কেউ বা হারিয়েছে গর্ভে তিলে তিলে বেড়ে ওঠা সন্তানকে। আজ তারা হতাশ হয়ে ভাবে শিক্ষকতার স্বপ্ন দেখাই যেন তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।

২০১২ সালের পর দীর্ঘ চার বছর অতিক্রান্ত হয়ে অবশেষে এলো সেই স্বপ্নের ২০১৬। হবু শিক্ষকদের পরম প্রাপ্তি। সরকারের তরফে ঘোষণা করা হল বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের সংবাদ। ২০১৬ সালে যথানিয়মে পরীক্ষা হল। এরপর এখানেই যেন ধীরে ধীরে সবকিছু থমকে যেতে লাগলো। কিন্তু হবু শিক্ষকরা নাছোড়বান্দা। শুরু হল আন্দোলন। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হল আন্দোলনের মাধ্যমে। এরপর শুরু হল নিয়োগ প্রক্রিয়া। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দেখা গেল অজস্র অসঙ্গতি, দুর্নীতি। গেজেট অমান্য থেকে শুরু করে, কখনো রাঙ্ক জাম্প, কখনো বা মেধা তালিকায় নাম না থাকা প্রার্থীদের নিয়োগ দিয়ে, মেধা তালিকায় নাম থাকা যোগ্য প্রার্থীদের নানাভাবে বঞ্চিত করা হল।

stand by as a human being_0

 

বঞ্চনার প্রতিবাদে ২০১৯ সালে কলকাতার মেয়ো রোডে প্রেসক্লাবের সামনে যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চের ব্যানারে শুরু হল অনশন আন্দোলন। ২৯ দিনের লড়াই’এর প্রত্যেকটি দিন ছিল আন্দোলনকারীদের জীবনে অপরিহার্য। প্রতিদিন নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা। হবু শিক্ষক-শিক্ষিকারা জেনেছে লড়াই কত কঠিন। অথচ এ লড়াই তাদের কাম্য ছিলো না। প্রায় এক মাস খোলা আকাশের নীচে, কখনো তারা ভরা আকাশ, কখনো মেঘলা আকাশ, কখনো বা বজ্রবিদ্যুৎ যুক্ত বৃষ্টিস্নাত আকাশের নীচে কাটিয়েছে রাতের পর রাত। আবার দিনের বেলায় গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহ। প্রশাসনের তরফ থেকে ছিলনা কোনো সহায়তা। মাথার উপরের ত্রিপলের ছায়ার আশ্রয় টুকু কেড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু তবুও তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিপর্যয়কে হার মানিয়ে নিজেদের হকের দাবিতে অনড় থেকেছে। মহিলাদের জন্য ছিল না কোনো শৌচালয়, ছিলনা পানীয় জলের ব্যবস্থা। কেউ কেউ তাদের দুধের শিশুকে নিয়ে রাস্তায় নর্দমার পাশে রাত কাটায়। হবু শিক্ষকদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছিল চরম উৎকন্ঠায়।

সমাজের সুধীজন, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে বাংলার আপামর জনসাধারণ সেদিন আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অবশেষে দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান। দীর্ঘ ২৯ দিনের আন্দোলনে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বঞ্চিত প্রার্থীদের বঞ্চনার কথা স্বীকার করে স্কুল সার্ভিস কমিশনকে ঘুঘুর বাসা আখ্যা দিয়ে, সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিয়ে কমিশন এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে পাঁচজন প্রতিনিধি দল গঠন করার নির্দেশ দেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই লকডাউনের অন্ধকারে কমিশনের তরফ থেকে সেই পাঁচ প্রতিনিধি দলকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বঞ্চিত প্রার্থীরা হতাশ হয়নি, তারা তাদের যোগ্য দাবী নিয়ে আবার ঘুড়ে দাঁড়ায়। সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্কের ৫নং গেটের সামনে ১৮৭ দিনের আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলন ১৮৭ দিনের কেন? কারণ মহামান্য আদালতের নির্দেশ থাকা সত্বেও ১৮৭ দিনের মাথায় এক দুর্যোগের রাত্রে পুলিশ-প্রশাসন আন্দোলনকারীদের উপর চালায় অকথ্য অত্যাচার, মহিলাদের উপর শুরু হয় নির্যাতন। তাদের পোশাক আশাক, ব্যাগপত্র খাবার-দাবার সবকিছু রাস্তায় বৃষ্টির জলের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। এর কিছুদিন পর ১০ আগস্ট বঞ্চিত প্রার্থীরা অবৈধ নিয়োগের অজস্র তথ্য কমিশনের চেয়ারম্যান’এর সামনে তুলে ধরেন। চেয়ারম্যান শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর প্রেস কনফারেন্সে তাদের বঞ্চনার কথা স্বীকার করে ৪০ দিন সময় চেয়ে নেন। কিন্তু আবারও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায় “কেউ কথা রাখেনি, কেউ কথা রাখে না”। চেয়ারম্যান কথা দিয়ে কথা না রাখার প্রতিবাদে আবার শুরু হয় আন্দোলন। বঞ্চিত প্রার্থীরা মহামান্য আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী আবার ৮ অক্টোবর থেকে মেয়ো রোডের সামনে গান্ধী মূর্তির পাদদেশে আন্দোলনরত। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বঞ্চিত প্রার্থীরা ছুটে এসেছেন কলকাতার বুকে। এখানেও মহিলাদের জন্য নেই কোনো শৌচাগার, নেই পানীয় জলের ব্যবস্থা। রোদ-ঝড়-জল-বৃষ্টি এছাড়াও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাথায় নিয়ে তারা তাদের দাবিতে অনড়। দীর্ঘ আড়াই বছর তারা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে, কখনো বা গারদের পিছনে। রাস্তা থেকে কবে রাজ্যের অভিভাবিকা তথা মাননীয়া তাদের বিদ্যালয়ে পাঠাবেন সেই আশায় তারা দিন গোনে। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় কিন্তু তাদের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। সমাজ গড়ার কারিগররা, সমাজের কাছে প্রশ্ন রাখে, শিক্ষকতার স্বপ্ন দেখা কি তাদের অপরাধ?

সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে বঞ্চিত হবু শিক্ষকদের আবেদন আপনারা আমাদের লড়াইয়ে পাশে থাকুন। পরিশেষে তাই কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলা যায় –

“মানুষ বড়ো কাঁদছে,
তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও
মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।”

- পিয়া, (আন্দোলনকারী, যুব-ছাত্র অধিকার মঞ্চ)

খণ্ড-28
সংখ্যা-40