সম্পাদকীয়
ডেউচা-পাঁচামী নিয়ে উঠছে পাঁচকথা
Deucha-Panchami

ডেউচা-পাঁচামীতে যেন সিঙ্গুরের পুনরাবৃত্তি না হয় — স্মৃতির স্মরণী বেয়ে আলোচনা বা তর্কটা প্রাথমিকভাবে উঠে গেছে দুই বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ সিঙ্গুর শিক্ষা দিয়েছে দুই পরস্পর বিপরীতের মধ্যেকার সংঘাতের। একটি দৃষ্টিকোণ চায়নি শিল্পায়নের সিঙ্গুর মডেল চাপিয়ে দেওয়া, আরেকটি দৃষ্টিকোণ চায়নি সিঙ্গুর গুটিয়ে যাওয়া। একদিকে ছিল টাটা গোষ্ঠী আর তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকারের আঁতাতের জমিগ্রাসের আগ্রাসন, একহাতে সরকারি ক্ষতিপূরণ ও কর্মসংস্থানের প্রচার-প্যাকেজ, আর অন্যহাতে দমনপীড়ন — এভাবেই চালানো হয়েছিল কর্পোরেটের জোয়াল চাপানো শিল্পায়নের মহড়া; বিপরীতে ছিল সিঙ্গুরের ব্যাপক কৃষক জনতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ, তার সাথে বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির আপন আপন ধারায় লাগাতার লড়াই এবং ফলশ্রুতিতে অসাধ্য সাধন। অবশেষে জয় আসে মানুষের প্রতিরোধের, পরাজিত হয় কৃষি ও কৃষক বিরোধী অবস্থান নেওয়া পক্ষ। পরবর্তী নির্বাচনে শাসনক্ষমতায় আসে ‘পরিবর্তন’ — বুদ্ধদেব সরকারের পতন ও তৃণমূলের ক্ষমতায়ন। টাটাদের অপসারণ, কৃষকদের হাতে জমি প্রত্যর্পণ। তারপর থেকে সিঙ্গুর এজেন্ডা অনেক থিতিয়ে এলেও নানা কারণে পুনরুত্থাপিত হওয়া একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। যাই হোক, সিঙ্গুরের সিঁড়ি বেয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার একদশক বাদে মমতা সরকার ডেউচি-পাঁচামীতে এমন এক খনি শিল্পের প্রকল্প খুলতে যাচ্ছে যা কিঞ্চিৎ হলেও সিঙ্গুরের মেঘকে মনে পড়াচ্ছে। এটা যদিও এখনাবধি ঘোষিত কর্পোরেটজড়িত উদ্যোগ নয়, রাজ্য সরকারের প্রকল্প, অবশ্য সরকার একথাও দিয়ে রাখছে না যে কোনও অবস্থাতেই সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে যাওয়া অথবা কর্পোরেট হস্তান্তর হবে না। পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমকে সামনে রেখে রূপায়ণে এগোনো হচ্ছে; ক্ষতিপূরণ, ঘরবাড়ির পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের প্যাকেজের প্রতিশ্রুতিপত্র রাখা হচ্ছে, বলছে মোট বরাদ্দের পরিমাণ পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকা, তার মধ্যে ক্ষতিপূরণের জন্য বরাদ্দ দশ হাজার কোটি টাকা, পরিবেশগত শংসাপত্র মিলেছে, স্থানীয় নিয়োজিত খাদান শ্রমিকেরা সহ হাজার হাজার বেকার যুবশক্তি জীবিকার কাজ পাবে, আরও অন্যান্য সামাজিক শক্তি কোন কোন বিষয়ে কী কী পাবে তার এক প্রাথমিক ঘোষণাও সরকার রেখেছে, কোটি কোটি টন কয়লা মিলবে, তা দিয়ে নাকি এতো বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা খুলে যাবে যে একশো বছর বিদ্যুতের জন্য অন্যত্র নির্ভর করতে হবে না! তবু প্রশ্নমুক্ত নয়। রাজ্য সরকার বলছে, সিঙ্গুর-ধাঁচে জমি অধিগ্রহণ করবে না, কিছু জমি সরকারি, প্রকল্পের কাজ আগে শুরু হবে সেখান থেকে, তারপরে পরিব্যপ্ত হবে ব্যক্তিগত জমি এলাকার পরিসরে, সমগ্র পরিকল্পিত বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে।

মুখ্যমন্ত্রী যদিও জানিয়েছেন, সরকার জোর করে জমি নেবে না, জমি স্বত্বাধিকারীদের আস্থা অর্জন করেই যা করার করা হবে। আবার তিনি এও শুনিয়ে রাখছেন যে, ‘পনেরশো লোকের’ আপত্তির কারণে প্রকল্প যেন আটকে না যায়। এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে সরকার বুঝিয়ে দিচ্ছে কোনও আপত্তি গ্রাহ্য হবে না। প্রকল্প ক্ষেত্রের অধিবাসীদের আপসে নিয়ে আসার জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় গঠন করা হয়েছে একটা কমিটি। কিন্তু সেটা কোনও অর্থেই কোনও বিশেষজ্ঞদের কমিটি নয়। তার মুখ করা হয়েছে একজন অভিনেতাকে, জনমোহনকরণের উদ্দেশ্যে, তিনি খনি প্রকল্প সংক্রান্ত কোনও অর্থেই বিশেষজ্ঞ নন। তাছাড়া যাবতীয় বিরোধাভাস মীমাংসার জন্য বিশেষ ভরসা করা হচ্ছে তৃণমূলের জেলা নেতা-মাথাদের উপরই। জেলায় দলতন্ত্র চালানো নেতা, দলের বিধায়ক ও পঞ্চায়েতী প্রতিনিধিবর্গ, আর তাদের সবার মাথার উপরে থাকা মাথা, যিনি গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় হুঙ্কার দিয়েছিলেন ‘বোম মেরে উড়িয়ে দাও’, ‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে উন্নয়ন’ — ও মাটিতে প্রকল্প উদ্ধারের ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে সেই ঠিকেদারদের উপর। চিহ্নিত তিন হাজার চারশো একর জমির এক হাজার একর সরকারের আওতাধীন, অর্থাৎ মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সরকারি জমি, বাকি দুই-তৃতীয়াংশ সরকারের এ্যক্তিয়ার বহির্ভূত। এলাকায় সাকুল্যে একুশ হাজারের বেশি লোকের বাস, এসসি-এসটি মিলে প্রায় তের হাজারের কাছাকাছি। সুতরাং সেক্ষেত্রে বিরোধ-সংঘাতের পরিস্থিতি উদ্ভূত হওয়ার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দেখা যাক মমতা সরকার কিভাবে এগোয়।

খণ্ড-28
সংখ্যা-40