প্রতিবেদন
পেট্রল ডিজেল এখন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের ‘মুনাফা’র অস্ত্র
Petrol and diesel are now the 'profit'

একটা সময় ছিল যখন, পেট্রলের দাম প্রশাসনিক স্তরে নির্ধারিত হত, সরকার ভর্তুকি দিত দাম নির্দিষ্ট স্তরে বেঁধে রাখতে। প্রশাসনিক মূল্য বাড়লে মানুষজন রাস্তায় নামত, প্রতিবাদ করত। নয়া উদারনীতির প্রবক্তা মনমোহন সিং’এর দ্বিতীয় দফার প্রধানমন্ত্রীত্বে ২০১০ সালে পেট্রলের মূল্যের উপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ বাতিল করা হয়। তার সময়কালেই ডিজেলের দামও আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে বিনিয়ন্ত্রণ শুরু হয় জানুয়ারি ২০১৩ থেকে। পরে বর্তমান এনডিএ সরকার ক্ষমতায় এসে ডিজেলকে ২০১৪ সালেই বিনিয়ন্ত্রিত করে। ডিজেলের দাম একধাক্কায় সাড়ে তিন টাকার মতো কমে যায়। ফলে সেই একধাক্কায় বিনিয়ন্ত্রণের জয়জয়কার পড়ে যায়। এখন সেই বিনিয়ন্ত্রণের ধাক্কা চলছে। ভর্তুকি এখন পাপ শব্দ। এই সরকার আরো বড় বেনিয়া। বলা হয়েছিল পেট্রল-ডিজেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমলে কমবে, বাড়লে বাড়বে। অর্ধসত্যবাদী মোদীজী বাড়লে বাড়বে বজায় রাখলেও কমলে কমবেকে পাত্তা দেননি। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমলে তিনি সেস, বিশেষ ডিউটি বসিয়ে তেলের দাম স্থির রাখেন। যখন তা বাড়ে তখন তাঁর সরকার ও পারিষদ টিভি চ্যানেল বলতে থাকে যে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ছে তো সরকার কী করবে?

যখন মোদীজীর ‘অচ্ছে দিন’এর সরকার ক্ষমতায় আসে তখন পেট্রলের উপর এক্সাইজ ডিউটি ছিল লিটার প্রতি ৯.৪৮ টাকা ও ডিজেলের উপর ৩.৫৬ টাকা। ২০১৪’র মে মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ১০৭ ডলার প্রতি ব্যারেল। জুন মাসের পর থেকে যখন দাম কমতে থাকে ও ২০১৬’র জানুয়ারিতে দাম কমে ২৮ ডলার প্রতি ব্যারেলে নেমে আসে, সেই সময়ে ২০১৪’র নভেম্বর থেকে ২০১৬’র জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ১৫ মাসে মোদী সরকার পেট্রলের উপর ৯ দফায় এক্সাইজ ডিউটি বাড়িয়ে দেয়। সব মিলিয়ে ওই ১৫ মাসে পেট্রলের উপর এক্সাইজ ডিউটি বাড়ে ১১.৭৭ টাকা, এবং ডিজেলের উপর ১৩.৪৭ টাকা। ২০১৭’র অক্টোবরে এক্সাইজ ডিউটি ২ টাকা কমানো হয়, ১ বছর বাদে আবার মোদী দয়াপরবশ হয়ে ১.৫০ টাকা ডিউটি কমান। ২০১৯’র জুলাইয়ে ডিউটি বাড়ানো হয় ২ টাকা করে প্রতি লিটারে; ২০২০’র মার্চে ৩ টাকা করে প্রতি লিটারে। কোভিড অতিমারীতে যখন বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম তলানিতে ঠেকছে তখন পেট্রলের উপর এক্সাইজ ডিউটি বাড়ানো হয় ১০ টাকা প্রতি লিটার ও ডিজেলের উপর ১৩ টাকা প্রতি লিটার। ফলে পেট্রলের উপর এক্সাইজ ডিউটি দাঁড়িয়েছিল ৩২.৯০ টাকা প্রতি লিটার যা মোদী সরকারের ক্ষমতায় আসার সময়কালের থেকে প্রায় সাড়ে তিনগুণ। ডিজেলের ক্ষেত্রে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩১.৮০ টাকা প্রতি লিটার, প্রায় ৮ গুণ। সাধারণভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের চাপানো শুল্ককে এক্সাইজ ডিউটি বা উৎপাদন শুল্ক হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু ওই শুল্ক ৪ ভাগে বিভক্ত। মূল এক্সাইজ ডিউটি, বিশেষ অতিরিক্ত এক্সাইজ ডিউটি, রাস্তা ও পরিকাঠামো সেস, কৃষি পরিকাঠামো ও উন্নয়ন সেস। ৩ নভেম্বর ‘দিওয়ালি তোফা’ ঘোষণার আগে মূল এক্সাইজ ডিউটি ছিল পেট্রলে ১.৪০ টাকা, ডিজেলে ১.৮০ টাকা। বিশেষ অতিরিক্ত এক্সাইজ ডিউটি ছিল যথাক্রমে ১১ টাকা ও ৮ টাকা, রাস্তা ও পরিকাঠামো সেস ছিল যথাক্রমে ১৮ টাকা প্রতি লিটার। কৃষি পরিকাঠামো ও উন্নয়ন সেস ছিল যথাক্রমে ২.৫০ টাকা ও ৪ টাকা প্রতি লিটার। মোট যথাক্রমে ৩২.৯০ টাকা ও ৩১.৮০ টাকা প্রতি লিটার। ২০১৭’র অক্টোবরে পেট্রল ও ডিজেলের উপরে মূল এক্সাইজ ডিউটি লিটার প্রতি ২ টাকা কমানোর আগে, ছিল যথাক্রমে ৯.৪৮ টাকা ও ১১.৩৩ টাকা প্রতি লিটার। পরে ২০১৮ সালের অক্টোবরে মূল এক্সাইজ ডিউটি প্রতি লিটারে ১.৫০ টাকা করে কমানো হয়। পরে বিশেষ এক্সাইজ ডিউটি বাড়নো হতে থাকে, মূল এক্সাইজ ডিউটি কমানো হয়। এই কমানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে রাস্তা ও পরিকাঠামো সেস, কৃষি পরিকাঠামো ও উন্নয়ন সেস বসানো ও বাড়ানো হতে থাকে। ২০২১ সালের বাজেটে পেট্রল ও ডিজেলের উপর কৃষি পরিকাঠামো ও উন্নয়ন সেস বসানো হয়, একইসাথে এক্সাইজ ডিউটি কমানো হয় যথাক্রমে ২.৫০ টাকা ও ৪ টাকা প্রতি লিটার।

১৬ নভেম্বর, ইন্ডিয়ান অয়েলের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী পেট্রলের মূল দাম (বেস প্রাইস) ছিল মোটামুটি ৪৮ টাকা প্রতি লিটার, ডিজেলের ৪৯ টাকা। এটি দিল্লীর জন্য প্রদত্ত হলেও তা কলকাতার জন্য প্রায় এক। এরসঙ্গে আমরা বিভিন্ন বিষয় জুড়ে যদি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের তহবিলের হিসেব করা যায়, তাহলে দেখা যাবে কেবল আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে বা কমলে কীভাবে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার তাদের তহবিলে টাকা ঢোকাচ্ছে। মূল এক্সাইজ ডিউটির থেকে প্রাপ্ত অর্থের ৪১% কেন্দ্রের তরফে রাজ্যকে দিতে হয় অর্থ কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। তাই কেন্দ্র ওই এক্সাইজ ডিউটি ক্রমাগত কমিয়েছে। কমাতে কমাতে এমন জায়গায় এনেছে যে আর কমানোর অবকাশ নেই বললেই চলে। বর্তমানে লিটারে তা পেট্রল ও ডিজেলের উপর যথাক্রমে ১.৪০ টাকা ও ১.৮০ টাকা। যা ইউপিএ সরকারের আমলে ছিল যথাক্রমে ৯.৪৮ টাকা ও ৩.৫৬ টাকা। অন্যদিকে অন্যান্য সেস ও কর বসিয়ে কেন্দ্র যথাক্রমে লিটার পিছু ৩১.৫০ ও ৩০.০০ টাকা আদায় করত সাম্প্রতিক ডিউটি কমানোর আগে।

যদি ভিত্তিমূল্যকে ৪৮ টাকা স্থির ধরে ২০১৪ সালের করের নিরিখে হিসেব করা যায়, তাহলে পেট্রলের লিটারপিছু কেন্দ্রের আয় দাঁড়াত ৫.৬০ টাকা ও রাজ্যের লিটার পিছু ২৩.৪০ টাকা। এক্সাইজ ডিউটি কমানোর অব্যবহিত আগে ওই ভিত্তিমূল্যই ছিল এবং সেইস্তরে কেন্দ্রের আয় দাঁড়িয়েছিল লিটারপিছু যথাক্রমে ৩২.৩০ টাকা ও রাজ্যের ২৬.১০ টাকা। কমানোর পরে তা দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ২৭.৩০ টাকা ও ২৪.৬০ টাকা।

ডিজেলের ক্ষেত্রে ভিত্তিমূল্য বর্তমান হারে ধরে হিসেব কষলে ইউপিএ’র সময়কালের হারে রাজ্যের আয় হত লিটার পিছু ১৩.২০ টাকা, নভেম্বরে শুল্ক কমানোর আগে ১৬.৭০ টাকা ও পরে ১৪.৮০ টাকা। কেন্দ্রীয় সরকারের আয় হত যথাক্রমে ৫.৬০ টাকা, ৩২.৩০ টাকা ও ২৭.৩০ টাকা।

এইসব হিসেব নিকেশ থেকে কী জানা যাচ্ছে? যদি আন্তর্জাতিক বাজারের দাম ধরে পেট্রলের দাম নির্ধারিত হত ও কেন্দ্রীয় সরকার লিটার প্রতি শুল্ক একই রাখতেন, যা তারা সরকারে আসার সময় ছিল, তাহলে পেট্রলের উপর কর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের আয় বর্তমানের (শুল্ক কমার পরে) ২৭.৩০ টাকার তুলনায় ২১.৭০ টাকা কম হত প্রতি লিটারে, রাজ্য (পশ্চিমবঙ্গ) সরকারের আয় কম হত ২৪.৬০ টাকা প্রতি লিটারের তুলনায় ১.২০ টাকা। ডিজেলের ক্ষেত্রে মোদীজীর আয় কমত প্রতি লিটারে ১৯.০০ টাকা, বর্তমান ২১.১০ টাকার তুলনায় আয় হত ২.১০ টাকা; আর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্ষেত্রে তা বর্তমান ১৫.৭০ টাকার তুলনায় ২.১০ টাকা কম হয়ে ১৩.৬০ টাকা হত। সামগ্রিকে কেবল কর বাড়নোর ফলে পেট্রলের দাম বর্তমানে ২২.৩০ টাকা ও ডিজেলের দাম ২০.৯০ টাকা বেশি হয়ে রয়েছে, মোদী সরকার শুল্ক কমানোর পরেও। শুল্ক কমানোর আগে ওই বর্ধিত দাম ছিল পেট্রলে লিটার পিছু ২৯.৪০ টাকা ও ডিজেলে লিটার পিছু ৩২.৯০ টাকা। যে সরকার বলেছিল বাজারদরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পেট্রল ডিজেলের দাম ওঠানামা করবে, সেই সরকার যদি তা না মেনে চলে তাহলে সেটি মিথ্যাবাদী হিসেবে পরিগণিত হয়, মোদী সরকার সেই দোষে দোষী।

পেট্রল ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফল রাজ্য সরকার স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ভোগ করে। কারণ রাজ্যের ভ্যাট বা বিক্রয় কর ওই বিক্রয়কর পূর্ববর্তী মূল্যের উপর নির্ভর করে। সাধারণভাবে তা পেট্রলের ক্ষেত্রে ৩০.০ শতাংশ ও ডিজেলের ক্ষেত্রে ২০.৪ শতাংশ। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে পেট্রলের ভিত্তিমূল্য বাড়ে, ফলে সেই অনুপাতে রাজ্য সরকারের লিটার পিছু কর বাড়ে। কেন্দ্রের অবশ্য তেমনটা ঘটেনা। কেন্দ্রের কর নির্ধারিত হয় লিটার পিছু। তবে অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমলে কেন্দ্রীয় সরকারের কর আয় কমে না, রাজ্যের কমার কথা। চমৎকারটা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে কেন্দ্রীয় সরকার এখন কর বাড়িয়ে দিয়ে করপরবর্তী ভিত্তিমূল্যকে প্রায় একজায়গায় রেখেছে, ফলে রাজ্যের কর আয় কমেনি। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার পরে সেই বাড়তি শুল্ক বজায় রাখায় করপরবর্তী ভিত্তি দাম বেড়েছে ও রাজ্য সরকার বেশি কর পেয়েছে। তদর্থে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারই জনগণের কাছ থেকে অধিক অর্থ আদায় করেছে। তবে বিশ্লেষণ ও তালিকা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার করের মাধ্যমে প্রভূত অর্থ নিজের তহবিলে ঢুকিয়েছে, রাজ্য সরকার সেই তুলনায় কম ‘মুনাফা’ করেছে।

- অমিত দাশগুপ্ত

খণ্ড-28
সংখ্যা-41