প্রতিবেদন
বাতিল হতে চলা তিন কৃষি আইন ফিরে দেখা
agricultural laws

সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার পক্ষে নরেন্দ্র মোদী সরকারকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল — ২৬ নভেম্বর কৃষি আইন বিরোধী কিষাণ আন্দোলনের একবছর পূর্তি হবে; তার আগেই সরকারকে কৃষক স্বার্থের পরিপন্থী তিন কৃষি আইন বাতিল করতে হবে, অন্যথায় কিষাণ আন্দোলনকে আরও বিস্তৃত ও তীব্রতর করা হবে। সেই সময়সীমা পার হওয়ার এক সপ্তাহ আগেই ১৯ নভেম্বর নরেন্দ্র মোদী তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের সরকারি সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করলেন। ঘোষণা করতে গিয়ে তিনি নিজেদের ভুল স্বীকার করলেন না, আইনের সদুদ্দেশ্য বুঝতে কৃষকদের অক্ষমতার দিকেই আঙুল তুলে বললেন “বোধহয় আমারই তপস্যায় কোথাও খামতি ছিল। তাই সবাইকে বোঝাতে পারিনি।” আর কয়েক মাসের মধ্যেই হতে চলা উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে পরিস্থিতিকে বিজেপির অনুকূল করে তোলার লক্ষ্যেই যে মোদীর এই সিদ্ধান্ত তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও ভাষ্যকাররা একরকম সহমত। কিষাণ আন্দোলনের জন্যই যে অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে উত্তরপ্রদেশেও বিজেপি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, যার পরিণামে মোদী নামক চরম ঔদ্ধত্যের প্রতিমূর্তিকেও মাথা নোয়াতে হল, বিজেপিপন্থীরাও তা অস্বীকার করতে পারছেন না। কিন্তু তিন কৃষি আইনের অন্তর্বস্তুতে কী এমন ছিল যা পুরো এক বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলনের পথে কৃষকদের অবিচল রাখল! সরকারের নামানো দমন পীড়ন ও কূটকৌশল আন্দোলনে চিড় ধরাতে পারল না! ভারতীয় কৃষির রূপান্তর ঘটাতে, কৃষক স্বার্থকে বিপর্যস্ত করে কৃষিকে কর্পোরেট কব্জায় তুলে দিতেই যে তিন কৃষি আইন বানানো হয়েছিল, আইন তৈরির সময়ই সেই অভিমতের প্রকাশ ঘটেছিল, এবং আইন প্রত্যাহারের আজকের এই লগ্নে সেই অভিমতের যথার্থতা প্রশ্নহীনভাবে প্রতিষ্ঠিত হল। আরও একবার আইনগুলোর দিকে ফিরে তাকানো যাক।

তিন আইনের একটা ছিল কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন সম্পর্কিত। উৎপাদিত পণ্যের বিক্রির জন্য সরকারি ব্যবস্থা হল মাণ্ডি — যেখানে কৃষকরা সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল বিক্রি করতে পারেন এবং যা পরিচালিত হয় কৃষিপণ্য বাজার কমিটির (এপিএমসি) হাতে। নতুন এই আইনে নিজেদের পছন্দের স্থানে ফসল বিক্রির স্বাধীনতা কৃষকদের দেওয়া হয়েছে বলে সরকারের পক্ষে দাবি করা হল। অর্থাৎ, ভালো দাম পেলে মাণ্ডি এলাকার বাইরে, ভিন্ন রাজ্যেও কৃষকরা তাঁদের ফসল বিক্রি করতে পারবেন। আইনে আরও বিধান দেওয়া হল, ফসল বিক্রির ওপর কোনো ফী বা সেস কোনো রাজ্য সরকার আদায় করতে পারবে না, মাণ্ডিতে বিক্রির ক্ষেত্রে যেমনটা হয়ে থাকে। সরকারের পক্ষে আরও দাবি করা হল, এই আইন আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে (যেটা মাণ্ডিতে চলে) কৃষকদের মুক্তি দেবে এবং ফসল বিক্রির জন্য কৃষকদের কাছে যেহেতু একাধিক ক্রেতাই থাকবে, কৃষকরা তাই দর কষাকষি করে ফসলের জন্য ভালো দামই আদায় করতে পারবেন। কিন্তু এই আইনটা যে প্রশ্নের মুখে কৃষকদের দাঁড় করিয়েছিল তা হল — মাণ্ডির বাইরে বিক্রি করলে ফসলের কি দাম তাঁরা পাবেন? ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি’র বেশি না হলেও এমএসপি’র সমান দাম কি তাঁরা পাবেন? বাস্তব পরিস্থতি বলছে, তা কখনই হওয়ার নয়। কৃষকদের উৎপাদিত সমস্ত ফসল মাণ্ডিতে বিক্রয় হয় না, সরকার ২৩টা ফসলের এমএসপি নির্ধারিত করলেও সব ফসল কৃষকদের কাছ থেকে কেনে না, অনেক ফসলই কৃষকদের বাজারে বিক্রি করতে হয়। আর বাজারের দাম মাণ্ডিতে নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশ কিছুটা কমই হয়। উদাহরণস্বরূপ, ভুট্টার জন্য সরকার নির্ধারিত এমএসপি যেখানে হল ১,৮৫০ টাকা, বাজারে ঐ ফসলই বিক্রি হয় ৮০০ থেকে ১,০০০ টাকায়। এই আইনের প্রকৃত উদ্দেশ্য অতএব ছিল এমএসপি ব্যবস্থাকেই তুলে দেওয়া (আইনটা তাই ‘এপিএমসি বাইপাস আইন’ নামেও পরিচিত) এবং শস্য সংগ্ৰহের দায় সরকারের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলা। এছাড়া, কৃষকের স্বাধীনতার কথা যেমন বলা হয়েছে, তেমনি কৃষি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত বড়-বড় কোম্পানির ক্রয়ের স্বাধীনতারও তো বিলোপ ঘটছে না। বড়-বড় কোম্পানির ক্ষমতার সঙ্গে কতটা পাল্লা দেওয়া কৃষকদের পক্ষে সম্ভব? এই আইন চালু হলে কৃষিপণ্যের বাজারের নিয়ন্ত্রণ বড় আকারের কর্পোরেট সংস্থাগুলোর কব্জাতেই থাকত এবং কৃষকদের সেই নিয়ন্ত্রণেরই অধীনস্থ হতে হত। কৃষি সংকটের মোকাবিলায়, কৃষকদের সুরাহা করার লক্ষ্যে যেখানে বিক্রয় মূল্যকে উৎপাদন খরচের দেড়গুণ করার প্রস্তাব করা হচ্ছে, এর বিপরীতে নরেন্দ্র মোদী সরকারের আইন এমএসপি ব্যবস্থাকেই তুলে দেওয়ার, কর্পোরেটদের কৃষি বাণিজ্যের অধীশ্বর করে তোলার দুরভিসন্ধিকেই প্রকট করেছে।

দ্বিতীয় যে কৃষি আইন নরেন্দ্র মোদী সরকার বানিয়েছিল সেটা ছিল কৃষিতে চুক্তিচাষ ও ফসলের মূল্য নিশ্চিতকরণ সম্পর্কিত। এই আইন স্পনসরদের (কৃষি বাণিজ্যের সংস্থা, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে যুক্ত সংস্থা, পাইকারি বিক্রেতা, রপ্তানিকারী, ইত্যাদি) সঙ্গে কৃষকদের চুক্তি ভিত্তিক চাষের পথ প্রশস্ত করেছিল। পূর্ব নির্ধারিত দামে স্পনসরের নির্দিষ্ট করা ফসল তার কাছে বিক্রিই ছিল চুক্তির মূল কথা। এই চুক্তিচাষের ক্ষেত্রে স্পনসররাই উৎপন্ন হতে চলা দ্রব্যের মান নির্দিষ্ট করে দিত। এই চুক্তির ফলে কৃষকরা বড় অর্থের ক্ষমতাসম্পন্ন ও রাজনৈতিক মদতপুষ্ট কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীনই হত। এছাড়া, চুক্তিবদ্ধ কৃষক স্পনসরের নির্দিষ্ট করে দেওয়া ফসল জোগাতে না পারলে কৃষকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করার অধিকার চুক্তি আইন স্পনসরদের দিয়েছিল। এবং ক্ষতিপূরণ অনাদায়ে কৃষকের জমি স্পনসরের হাতে দখল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও একেবারে অভাবনীয় ছিল না। চুক্তিচাষ কৃষিতে প্রধান ধারা হয়ে উঠলে স্পনসর তথা কর্পোরেট সংস্থাদের মুনাফার লক্ষ্যই উৎপাদনীয় দ্রব্যকে নির্দিষ্ট করত এবং অর্থকরী ফসলের চাষ প্রাধান্য লাভ করায় এফসিআই ও নাফেড’এর ভূমিকা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে খাদ্য নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়ার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়ার ছিল না।

তৃতীয় কৃষি আইনটা ছিল অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মজুতদারি সংক্রান্ত, যার পোশাকি নাম অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন তৈরি হয়েছিল ১৯৫৫ সালে, মজুতদারি রোখাই আইনটার উদ্দেশ্য হওয়ায় অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মজুতে একটা মাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। সেই নিয়ন্ত্রণকে পরিহার করতে, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মজুতদারিকে ঢালাও করতে মোদী সরকার ঐ আইনে সংশোধনী এনে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে খাদ্যশস্য, ডাল, আলু, পিঁয়াজ, তৈলবীজ, ভোজ্যতেল ও আরো কিছু দ্রব্যকে বাদ দিয়ে দিল। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মজুতকে অবাধ করার এই অনুমোদনে যেমন কালোবাজারি, খাদ্যদ্রব্যের কৃত্রিম সংকট তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হত, তেমনি অবাধ মজুতের অধিকার কৃষকদের ওপর চাপ সৃষ্টির, কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্যকে কমানোর সম্ভাবনাও সৃষ্টি করত। যুদ্ধ বা দুর্ভিক্ষর মতো পরিস্থিতিতে ঐ ধরনের মজুতদারি নিষিদ্ধ হওয়ার কথা আইনে বলা হলেও তার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ ছিল এবং মজুতদারি নিয়ম হয়ে ওঠাটাই বাস্তবে দেখা দিত। আর বড়-বড় কর্পোরেট সংস্থা ছাড়া এই বিপুল পরিমাণ মজুতদারি আর কাদের পক্ষেই বা সম্ভব হত!

কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট অনুপ্রবেশকে অবাধ করা, বেসরকারি বিনিয়োগের রাস্তা প্রশস্ত করা, এইক্ষেত্রে সরকারের দায়, বিশেষভাবে খাদ্যশস্য সংগ্ৰহের দায়িত্বকে ঝেড়ে ফেলার অভিপ্রায়ই যে তিনটে কৃষি আইন তৈরির পিছনে কাজ করেছিল তা নিয়ে এখন আর প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই। কৃষককে ‘স্বাধীনতা’ দেওয়ার নামে তাদের কর্পোরেটদের বশ্য করে তোলার বন্দোবস্তই যে আইনগুলোর মধ্যে দিয়ে হয়েছিল তাও একেবারেই পরিষ্কার। কৃষকদের সহজাত চেতনায় এটা অনায়াসেই ধরা পড়েছিল, যেমনটা ফুটে উঠেছে বিবিসি’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পাঞ্জাবের কৃষক সুখদেব সিং কোকরির মন্তব্যে “এটা (আইনগুলো) ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের কাছে মৃত্যু পরোয়ানা। এর লক্ষ্য বড়-বড় কর্পোরেটদের হাতে কৃষি ও বাজারকে তুলে দিয়ে কৃষকদের ধ্বংস করা। ওরা আমাদের জমি ছিনিয়ে নিতে চায়। আমরা কিন্তু ওদের এটা করতে দেবো না”। কর্পোরেট সংস্থাগুলো, বিশেষভাবে মোদী ঘনিষ্ঠ এক শিল্পপতি যে মোদী জমানার মধ্যে কৃষিক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ খুঁজে পাচ্ছিল তা একটা উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট হয়। গৌতম আদানি ২০০৫ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে কৃষি বাণিজ্যের কোম্পানি তৈরি করেছিলেন মাত্র দুটো। কিন্তু ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে, মোদী ক্ষমতায় বসার মাত্র ছ’বছরে ঐ ধরনের কোম্পানি তিনি তৈরি করেন একেবারে ২৯টা! মোদী জমানা যে জনস্বার্থের বিপরীতে কর্পোরেট স্বার্থের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ও কর্পোরেট আধিপত্যের প্রতিভু তা সাধারণ মানুষের কাছে জলজ্যান্ত বাস্তব।

কৃষি আইনগুলো প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করে কৃষকদের কাছে আর্জি জানিয়ে মোদী বলেছিলেন, “আন্দোলনরত সমস্ত কৃষকের কাছে আমি অনুরোধ জানাচ্ছি, পরিবারের কাছে এবং গ্ৰামে ফিরে যান এবং আসুন আমরা নতুন করে শুরু করি।” কিন্তু মোদীর এই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে কৃষকরা এখনও ধর্ণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, আগে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সংসদে কৃষি আইনগুলোর প্রত্যাহার সম্পন্ন হোক, তারপর তাঁরা আন্দোলন ছেড়ে বাড়ি যাওয়ার কথা ভাববেন। মোদী কৃষক নেতাদের ‘আন্দোলনজীবী’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। কিন্তু কৃষকদের আন্দোলন গণতন্ত্রের রক্ষায় মহান অবলম্বন বলেই প্রতিপন্ন হল। আন্দোলনের এই অদম্য উৎসাহকে হাজারো কুর্নিশ। কৃষক আন্দোলনের এই বিজয় অবশ্যই ঐতিহাসিক, ফ্যাসিবাদের প্রতি এক বড় ধাক্কা এবং ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলনে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর কাছে এক উদ্দীপনাময় অনুপ্রেরণা।

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-28
সংখ্যা-41